আনন্দ বৃদ্ধাশ্রম...................শাহানা জাবীন সিমি

আনন্দ বৃদ্ধাশ্রম...................শাহানা জাবীন সিমি
২০৫০ সাল, জানুয়ারী মাস। শীতের এক দুপুরে শামসুর রাহমানের লেখা কবিতা পড়েছিলেন শায়লা বারী।
'যেদিন মরবো আমি, সেদিন কি বার হবে বলা মুশকিল।
শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?
যে বারই হোক,
সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর,
যেন ঘিনঘিনে কাদা না জমে গলির মোড়ে।
সেদিন ভাসলে পথঘাট,
পূন্যবান শবানুগামীরা বড়ো বিরক্ত হবেন।'

এই পর্যন্ত পড়ে বইটি বন্ধ করে রাখলেন তিনি। কি অসাধারণ অভিব্যক্তি কবির! কত চিন্তা শবানুগামীদের জন্য। সত্যিই তো আমার মৃত্যুর দিনই বা কি বার হবে? কাঠফাটা রোদে তপ্ত হবে এই শহর নাকি শীতের হাওয়ায় ঝড়া পাতার মড়মড়ে আওয়াজে ঢেকে যাবে আমাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া শবানুগামীদের চাপা কান্না....কে আর কাঁদতে আসবে? বছর তিনেক হলো বারী সাহেব মারা যাবার পর নিজের ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়ে অনেকটা নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে আর নিরাপত্তার কথা ভেবে এই বৃদ্ধাশ্রমে এসে উঠেছেন সত্তর বছরের শায়লা বারী। স্কুল টিচার ছিলেন। অসংখ্য ছাত্র এই হাতে পার করেছেন। এদের মধ্যেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত কিছু ছাত্রছাত্রী সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে তার মতো বৃদ্ধ মাতাপিতাদের জন্য ঢাকার পূর্বাচলে এই বৃদ্ধাশ্রমটি তৈরী করেছে। এর উদ্দোক্তরা অবশ্য একে বৃদ্ধাশ্রম বলতে নারাজ। সার্ভিস এপার্টমেন্টের আদলে তৈরি এর নাম 'আনন্দ আশ্রম'। আসলেই তাই....সারাদিন যেন হাসি আনন্দে কেটে যায় এই আনন্দ আশ্রমের মানুষগুলোর। এখানে থাকতে হলে দুটো শর্ত অবশ্য পূরণ করতে হয়। এক; বয়স হতে হবে ৬৫র উপরে কারণ ৬৫বছর পর্যন্ত এখন মধ্যবয়স্ক তরুণ হিসেবে গণনা করা হয়। দুই; নিঃসন্তান বা অবিবাহিত পুরুষ বা মহিলা অথবা এমন বাবা মা যাদের সন্তানরা সবাই বিদেশে অবস্থানরত।

এই যেমন একটি মাত্র পুত্র সন্তান শায়লা আর বারী সাহেবের। ছেলে আমেরিকায় চাকরি ও পরিবার নিয়ে সেটেল। বহুবার মাকে কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছে সে কিন্তু শায়লাই রাজি হননি। এমনি বছরে দুবছরে ছেলের কাছে ঘুরতে যাওয়া হয় কিন্তু এদেশের মাটি ছেড়ে একবারে সেখান যে থাকতে শান্তি পান না তিনি। পাঁচ বিঘা জমির উপর তৈরী এই আনন্দ আশ্রম। বারো তলা বিল্ডিং স্টুডিও এপার্টমেন্ট। ইচ্ছে করলে একা থাকা যায় সেক্ষেত্রে পেমেন্ট একটু বেশি আবার কেউ চাইলে শেয়ারও করতে পারে। কমপ্লেক্সের মধ্যে আছে জিম, সুইমিং পুল, লাইব্রেরি, মসজিদ, গেস্ট হাউস এবং ইমারজেন্সি মেডিকেল সার্ভিস দেয়ার জন্য একটা ছোট ক্লিনিক। আরো আছে একটি বড়মাঠ যেখানে প্রাতঃভ্রমণ ও সান্ধ্যভ্রমণের পাশাপাশি চলে নির্মল আড্ডা, গল্প ও খুনসুটি। বিল্ডিং এর ছাদে যে ছাদকৃষি আর সামনে পেছনের খালি জায়গায় যে আঙিনা কৃষি রয়েছে তাতে অনেকেই সকাল বিকাল মালির সাথে হাত লাগান। তাদের পরিচর্যার কারণে আনন্দ আশ্রমে সবজি অনেক সময় বাজার থেকে কিনতেই হয়না।

খাবারের ব্যাপারে খুবই কঠিন আনন্দ আশ্রমের ডাইটেসিয়ান। বয়সে তরুণী মেয়েটি একটা বড় হাসপাতালের পুষ্টিবিদ আবার পার্ট টাইম এই বুড়ো বুড়িদের দেখভাল না করলে নাকি তার ভালো লাগেনা। তার নির্দেশে মাসে দুবার রেডমিট আর বাকি দিন মেডিটেরেনিয়ান ডায়েটের আদলে তৈরি বাংলাদেশী ডায়েট। রুচি পরিবর্তনের জন্য মাসে একবার থাই,জাপানিজ,কোরিয়ান বা কন্টিনেন্টাল কুজিন। তারপরও তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনিয়ম যে চলে না তা নয়! যখন যার ইচ্ছা দেদারসে চলছে অনলাইন খাবারের অর্ডার আর ডেলিভারি। ১২তলার এই স্টুডিও এপার্টমেন্টে রয়েছে দুটি ডাইনিং হল। সাধারণত তিনবেলার খাওয়া দাওয়া সবাই একসাথে ডাইনিং হলে করে থাকে। তবে চাইলে রুমেও ডেলিভারি নিতে পারে। শ'খানেক বোর্ডার কে দেখা শোনা করার জন্য এখানে রয়েছে দশজন উদ্যম ও চৌকষ তরুণ তরুণীর একটি দল। যারা লনড্রী থেকে শুরু করে সব কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা এমনকি সবাই ঔষধ ঠিকমতো খেলো কিনা সবকিছুর খবর রাখে। মাঝে মাঝে খাওয়া দাওয়ার পরে শুরু হয় জম্পেশ আড্ডা। এই যেমন আজকের বিষয় পূর্বাচল সিনেপ্লেক্সে ২০২০ এর করোনা মহামারী নিয়ে আবীর ফয়সালের 'করোনা ২০২০' নামের যে মুভিটা রিলিজ হয়েছে সেইটা নিয়ে। অসাধারণ নাকি স্টোরিলাইন আপ, সিনেমাটোগ্রাফী আর ডিরেক্শন। অনেকেই দেখতে যেতে ইচ্ছুক। কিন্তু শায়লা কে ফিসফিস করে নাবিলা বললো... এই ফিল্ম দেখার মতো মানসিক শক্তি আমার আর এখন নেই। কি দুঃসহ দিনগুলি গেছে! সারা পৃথিবী জুড়ে ছিল মৃত্যুর মিছিল। এক ঝটকায় ধনী ও ক্ষমতাবানদের নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল গরীব আর ক্ষমতাহীনের কাতারে। তোমার হাতে টাকা আছে কিন্তু আইসিইউ র বেড খালি নাই। তোমার প্রাইভেট জেট প্লেন আছে বিদেশে গিয়ে চিকিত্সা নেয়ার ক্ষমতা আছে অথচ এয়ারপোর্ট বন্ধ। ২০২০ এর করোনায় বাবা মা দুজনকেই হারিয়েছিলেন নাবিলা।

আজ মর্নিং ওয়াকে রাইয়ান সাহেবকে খুব খুশি মনে হচ্ছে। তিন বছর পর কানাডা থেকে ওনার মেয়ে জুহি বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে। উঠেছে আনন্দ আশ্রমের গেস্টহাউসে। সকালে অনেকের সাথে পরিচিত হয়ে ওর খুব ভালো লাগছে। কতগুলো অপরিচিত মানুষ শুধু দেশের শেকড়ের টানে, মাটির কাছাকাছি থাকবে বলে আজ একটা পরিবার; একথা ভাবলেই বারবার চোখ ভিজে আসছে জুহির। কিন্তু বাবাকে নিয়ে একটা সমস্যা অনুভব করছে সে। মনে হচ্ছে বাবা অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছে। এমন কি জুহির নামটাও মাঝে মাঝে মনে করতে পারছে না। কিছুটা ডিমেনশিয়া দেখা দিয়েছে। একটু উদগ্রীব হয় সে। বিদেশে তো এখন পার্কিনসন, এলজেইমার, ডিমেনশিয়া এগুলোর জন্য অনেক রিহ্যাব সেন্টার রয়েছে। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আজ বিকেলে একজন নিউরোলজিস্ট এর সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে জুহি।

এলজেইমার ডিজিস ডায়াগনসিস হয় জুহির বাবার। এটা এমন একটা রোগ যেখানে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন কাজের ক্ষমতাও হ্রাস পায়। হঠাত্ করে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না জুহি। যদিও বাবা কানাডার সিটিজেন তবুও কি তিনি দেশ ছাড়তে রাজি হবেন? এখানে বা কার ভরসায় রেখে যাবো আমি...এধরনের নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে জুহির মাথায়। সবকিছু শুনে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন নিউরোলজিস্ট ডাঃ আশফাক জামিল।
--- কিছু মেডিসিন লিখে দিয়ে বলেন একদম চিন্তা করবেন না; আমাদের দেশেই এখন এলজেইমার পার্কিনসন রিহ্যাব সেন্টার গড়ে উঠেছে....একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলেন;
--- একবার হলেও প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে আসুন।
হোমে ফিরে পরের দিন জুহি শায়লা আর নাবিলার সাথে বাবার ব্যাপারটা শেয়ার করে ।
---আন্টি তোমরা কেউ কি আমার সাথে রিহ্যাব সেন্টার টা দেখতে যাবে? এক কথায় রাজি হয়ে যায় ওরা দুইজন।
পরের দিন একটা গাড়ী নিয়ে ওরা চলে যায় পূর্বাচল থেকে দুই ঘণ্টার পথ টাংগাইলের দেলদুয়ার। রাজধানী ঢাকা এখন ডিসেনট্রালাইজ হতে হতে গাজীপুর ছাড়িয়ে টাংগাইলের দিকে।

রিহ্যাব ক্লিনিকের এমডি র সাথে কথা হয় জুহিদের।
--- আসলে কি ম্যাডাম মানুষের লাইফ এক্সপেকটেন্সি বাড়াতে এই ধরনের ওল্ড এজ প্রবলেম গুলো বেশি ফিল হচ্ছে। যদিও বিদেশে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব; কিন্তু এদেশে যেহেতু এটা সম্ভব না তাই অনেক শিল্পোদ্দক্তাই এখন দেশের বিশাল মানবসম্পদ কে কাজে লাগিয়ে এই সেবাখাত গুলোতে এগিয়ে আসছে। সত্যি অবাক হয় শায়লা একেবারে বিদেশের রিহ্যাব সেন্টারের মতো এদের কর্মযজ্ঞ। যেহেতু এধরনের অসুখে মানুষ শিশুর মতো হয়ে যায় তাই এদের খাওয়া দাওয়া, গোসল, ঘুম থেকে শুরু করে সব কাজেই অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন। যাদের পরিবার এই ধরনের সেবা দিতে অক্ষম তাদের জন্য এখানে সেবা দিয়ে যাচ্ছে একদল মানবদরদী অভিজ্ঞ স্টাফ। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির ফাইনান্সিং এর অর্ধেক অর্থ আসে রোগীদের কাছে থেকে। দুই একদিনের মধ্যেই আনন্দ আশ্রমের গভর্নিংবডির সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট করে জুহি। বাবার সমস্যাগুলো খুলে বলে তাদের। রিহ্যাব সেন্টারটার কথা শুনে তাদের কাজের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখান ওনারা। অভয় দেন জুহি কে। কয়েকদিনের মধ্যে আনন্দ আশ্রম ওল্ডহোমের সাথে রিহ্যাব সেন্টারটির একটা সমঝোতা চুক্তিও হয়।

কালকে রাইয়ান সাহেব তাঁর ঠিকানা বদল করবেন। পূর্বাচলের আনন্দ আশ্রম থেকে টাংগাইলের এলজেইমার রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। ওনাকে সেখানে রেখে জুহি ফিরে যাবে কানাডায়। এই প্রথম আনন্দ আশ্রম থেকে কেউ এভাবে বিদায় নিচ্ছে। এই উপলক্ষে রাতে সবাই কে ডিনারে ইনভাইট করেছে জুহি। আজকে ওনার পরিবর্তন যেন স্পষ্টতই সবার চোখে পড়ছে। রাইয়ান সাহেব আবেগপ্রবণ হয়ে কখনো বা খুব আনন্দিত হচ্ছেন আবার কখনো বা কেঁদে ফেলছেন। খাওয়া দাওয়া ও আড্ডা শেষে যে যার মতো বিদায় নিল সেদিন।

ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে আছে পুরো আনন্দ আশ্রম। শুধু ঘুম নেই জুহির চোখে। সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে একমনে ভাবছে সে। কত স্মৃতি...মা বাবা আর সে! একদিকে তার চাকরি, সংসার আরেক দিকে বাবা। সে কি একা ফিরে যাবে? নাকি বাবা কে নিয়ে ফিরবে? অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত বদল করে জুহি। ভোর হয়ে আসে আনন্দ আশ্রমের মসজিদ থেকে ভেসে আসে আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম। আজ বুধবার। রৌদ্রজ্বল এক শরতের বিকেলে মেয়ের হাত ধরে রাইয়ান সাহেব কানাডার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। আনন্দ আশ্রমের সব বোর্ডাররা অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বিদায় জানায় তাদের কিছুদিনের সঙ্গী একজন ওল্ডহোম মেট কে।


লেখক: এমবিবিএস চিকিৎসক
অধ্যাপক বায়োকেমিস্ট্রি
আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

সাদৃশ্যকরন...................................তুহিন রহমান (ঈদ সংখ্যা ২০২০)

সাদৃশ্যকরন...................................তুহিন রহমান (ঈদ সংখ্যা ২০২০)
‘শালা একটা কুত্তার বাচ্চা!’
‘আরে কাকে বলছিস?’
‘তোকে না।’
‘আমাকে না তো বুঝলাম কিন্তু কাউকে না কাউকে তো বলছিস।’
‘হ্যাঁ বলছি একজনকে। আমার পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে এখন দিতে চায়না। বলে এগুলো নাকি এখন দিতে পারবে না।’
‘তা তুই কি বলেছিস?’

লাড্ডু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সবাই রাস্তা ছেড়ে পালাচ্ছে যেদিকে পারছে। একটু ঝড়ো হাওয়াও আছে সাথে। সামনের গাছগুলো দুলছে। সামনের মোটা ইলেকট্রিক তারের ওপর কয়েকটা কাক বসেছিল। বৃষ্টি নামতেই উড়ে পালালো। ‘আমি কিছু বলিনি। একটা কুত্তার বাচ্চাকে কি বলবো আমি?’
‘তোর উচিত ছিল তাকে সামনে থেকে এই গালিটা দেয়া যাতে সে নিজেকে ঘৃনা করতে শেখে।’ বললো চপল। ‘তুই গিয়ে কথাটা তাকে বলবি।’
‘ঠিক আছে, দেখা যাক।’ লাড্ডু আরামদায়ক সোফাটার ওপর বসলো। ‘এক কাপ চা আনতে বল তোর কাজের মেয়েটাকে। যে বৃষ্টি শুরু হলো যাবো কিকরে তাই ভাবছি।’
চপল কাজের মেয়েটাকে ডেকে দু’কাপ চা দিতে বললো। তারপর আপনমনে নিজের কাজ করতে লাগলো টেবিলে। দশ মিনিট পর কাজের মেয়েটা দু’কাপ চা রেখে গেল টেবিলে।
লাড্ডু নিজের চায়ে চুমুক দিল। হঠাৎ রাস্তার ট্রান্সফর্মারটা বিকট শব্দে আর্তনাদ করে উঠলো। একই সাথে রুমটা অন্ধকার হয়ে গেল। কারেন্ট চলে গেছে।
‘এই যা, এই অন্ধকারে কাজ করি কিভাবে?’ চপল উঠে পড়লো টেবিলটা থেকে। ‘আচ্ছা তুই বস, আমি গোসলটা সেরে আসি।’
লাড্ডু মাথা নাড়লো। চায়ের কাপটা শূন্য করে নামিয়ে রাখলো টেবিলে। খোলা জানালা দিয়েঠান্ডা বাতাস আসছে হু হু করে। ও আরামে চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। এই গরমে যে এসি ছাড়া এমন ঠান্ডা বাতাস পাওয়া গেছে সেই তো অনেক। উফ, গরমে প্রানটা একেবারে গলার কাছে উঠে এসেছিল। পকেটে হাত দিতে সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে ঠেকলো। খুশি মনে প্যাকেটটা বের করে দেখলো একটাও সিগারেট নেই তার ভেতর। মনে মনে একই রকম একটা গালি ঝেড়ে লাড্ডু প্যাকেটটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিল বাইরে। তারপর মাথার পেছনে হাত রেখে চোখ বন্ধ করলো। কিন্তু পেটটা টনটন করছে। সেই সকালে বাথরুম সেরে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল, এখন পর্যন্ত বাথরুম সারা হয়নি। প্রশ্রাব জমে পেটটা একেবারে ফুলে উঠেছে। অস্থির লাগছে ভীষন। চপলের রাথরুমটায় যাওয়া যেত! মনে পড়লো চপল বাথরুমে গোসল করছে। ওদের বাড়িতে একটাই বাথরুম। যে করে হোক চেপে বসে থাকতে হবে।
কি আর করবে, উপায় নেই। লাড্ডু প্রশ্রাব চেপে সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকে বাইরের দিকে তাকিয়ে। গতরাতে ভালো ঘুম হয়নি। এখন চোখ বেশ ভার ভার বোধ হচ্ছে। বাড়ি গিয়ে আচ্ছা করে ঘুম দিতে হবে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে দুরের গাছগুলোর হেলে পড়া দেখতে ভীষন ভালো লাগছে।
বৃষ্টি থেমে যাবার পর আধাঘন্টা পেরিয়ে গেছে। চপল এখনও বেরুচ্ছে না বাথরুম থেকে। লাড্ডুও চেঁচিয়ে ডাকতে পারছেনা। ভেতরের ঘরে ওর মা, ওর দুটো বোন আছে। চপলের ছোট বোনটার প্রতি আবার লাড্ডুর একটু দুর্বলতা আছে। তাই এখানে জোরে কথা বলা বা কোন উদ্ভট আচরন করা যাবেনা। এদিকে পেট ফেটে যাচ্ছে।
‘দুর! উঠে পড়লো লাড্ডু। এখানে প্রশ্রাব করার দরকার কি? বাড়ি যাবার পথে সেরে নেয়া যাবে। চপল এসে দেখবে সে নেই। তাতে কোন সমস্যাও নেই। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করার সিস্টেম আছে। সেই সিস্টেম মেনে দরজাটা বন্ধ করে লাড্ডু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। ভেজা পিচঢালা রাস্তাটা চকচক করছে একেবারে। কি সুন্দরভাবে প্রকৃতি সব পরিস্কার করে দিয়ে গেছে!
লাড্ডু বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু প্রতি পদে তার পেটটা মুচড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে পেটের ভেতর থেকে প্রশ্রাবগুলো ফেটেই বেরিয়ে আসতে চাইছে। আল্লাই জানেন কিভাবে মেয়েমানুষগুলো দশ মাস দশ দিন বাচ্চা পেটের ভেতর চেপে রাখে।
চারপাশে তাকাতে লাগলো লাড্ডু। কোথায় যাওয়া যায়। আশেপাশে কোন পাবলিক টয়লেট নেই যে সে সেখানে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজটা সারবে। শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেল সে জায়গাটা। একটা ডাস্টবিনের ঠিক পেছনে চমৎকার একটা দেয়াল। একেবারে নতুন রঙ করা হয়েছে দেয়ালে। সম্ভবত কোন রাজনৈতিক পার্টি তাদের কলাম লিখবে এখানে। একেবারে ফাস্টক্লাস প্রশ্রাব করার জায়গা, মনে হয় খোদা মিলিয়ে দিয়েছে তাকে। একটা শান্তির দম ছেড়ে সেদিকে এগিয়ে গেল লাড্ডু। প্যান্টের চেইনটা খুললো। তারপর আস্তে ধীরে ছাড়তে লাগলো নতুন রঙ করা দেয়ালের ওপর। আহ কি শান্তি! পৃথিবীতে এর চেয়ে শান্তির কিছু আছে নাকি কে জানে। একই সাথে একটা ডিজাইন আঁকাও হয়ে যাবে দেয়ালটার ওপর। লাড্ডু একটা মুখ আঁকতে চাইলো সেখানে।

আচমকা পাশ থেকে কেউ ঘেউ করে উঠলো। লাড্ডু পাশে তাকিয়ে চমকে উঠলো একেবারে। একটা হলুদ রঙের ঘেয়ো কুকুর এক ঠ্যাং তুলে তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়েই প্রশ্রাব করছে একই দেয়ালের ওপর। লাড্ডু আরও অবাক হলো যখন দেখলো কুকুরটা তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে।
কোনমতে প্রশ্রাব শেষ না করেই তার যন্ত্রটা চেইনের ভেতর ঢোকালো লাড্ডু। সরতে যাবে কুকুরটা তার পথরোধ করে দাঁড়ালো। তারপর মানুষের গলায় বললো,‘প্রশ্রাব যে করলা, চাইয়া দেহ তোমার প্রশ্রাব গড়াইয়া রাস্তায় চইলা আসছে। এহান দিয়া মানুষ চলবো না? তাকায় দেহ আমি কেমনে করসি। আমারে তো কুত্তা বইলা গালি দাও। তুমি আর আমি তো একই জাগায় হিসি করলাম। তাইলে তুমিও আমার লাহান কুত্তার বাচ্চা।’
আঁৎকে উঠে ঢোক গিলল লাড্ডু। তাই দেখে কুকুরটা আরো জোরে হাসলো,‘হুনো মিয়া, তোমরা হইলা গিয়া মানুষের বাচ্চা। রাস্তায় মুতবা কেন? তোমাগো কত সুন্দর টয়লেট আসে, বাথরুম আসে হেইহানে এইসব কাম করবা। এইটা হইলো আমার মুতনের জাগা। ঠিক আছে তুমি আমার জাগায় তোমার কাম করসো ভালা কথা। দুই ট্যাকা দ্যাও।’
লাড্ডু ঢোক গিলে বললো,‘টাকা দিয়ে তুমি কি করবে?’
‘ওই মিয়া ট্যাকা দিয়া কি করে তোমারে শিখাই দ্যাওন লাগবো? তুমি আমার জাগায় মুতবা আর ট্যাকা দিবানা হেইডা কেমুন কথা?’ কুকুরটা আরো জোরো জোরে বললো।
লাড্ডু পকেট হাঁতড়ে দেখে তার কাছে কোন টাকাই নেই। তাই দেখে কুকুরটা যেন মজা পায় আরো। বলে,‘হুনো মিয়া, তুমি আজ থেইকা আর কোন মানুষরে কুত্তার বাচ্চা বইলা গালি দিবানা, ঠিকআসে?’
লাড্ডু ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ে। ‘তুমি দেহ,’ কুকুরটা আবার বলে,‘আমরা না খাইয়া থাহি। তোমরা কতো মজার মজার জিনিষ খাও। আর আমরা সারাদিন খালি পেটে ঘুরি। তোমরা দিলে খাই নাইলে খালি পেটে রাইতে ঘুমাইতে হয়। তুমি চিন্তা করসো কুকুরই হইলো একমাত্র প্রানী যে মানুষের উপরে পুরাপুরি নির্ভরশীল। অন্য সব প্রানীই নিজের খাবার নিজে খুঁইজা নিতে পারে, কিন্তু মানুষ না দিলে কুকুর নিজে কোন খাবার খাইতে পারেনা। মানুষের উচ্ছিষ্টের উপরে কুকুররা বাঁইচা থাকে। তোমরা ‘কতো বড়ো বড়ো কথা কও, অথচ দেহ তোমরা কি কখনও চিন্তা করসো তোমরা যহন লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলতাসো, কোটি টাকার গাড়ি চড়তাসো, মদ খাইতাসো, শত কোটি টাকা দিয়া পঞ্চাশ তলা বাড়ি বানাইতাসো তহন একটা কুকুর তোমার সামনের রাস্তায় না খাইয়া শুইয়া আসে?’
লাড্ডু মাথা নাড়ে। না, সেও কখনও এমন করে চিন্তা করেনি।
‘তোমাগো রাজনীতিবিদরা চিল্লায় গলা ফাটাইয়া ফেলায়।’ কুকুরটা দাঁতে দাঁত চিপে বললো,‘হ্যারা তোমাগোরে মিথ্যা সান্তনা দিয়া দ্যাশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে। হ্যারা যেমনে ট্যাকা চিবায় তেমনে আমরা হাড্ডিও চিবাইতে পারিনা। আর তোমরা মানুষরে কও কুত্তার বাচ্চা। আরে তোমগো তো কওন উচিৎ রাজনীতিবিদের বাচ্চা। গালি দিবা ঘুষখোরের বাচ্চা, মিথ্যাবাদীর বাচ্চা, মানুষের বাচ্চা, চোরের বাচ্চা, ডাকাতের বাচ্চা। তা না কইরা তোমরা গালি দাও আমাগোর জাতিকে নিয়া। এইটা কি ঠিক?’
লাড্ডু মাথা নাড়ে এপাশ ওপাশ। একদম ঠিক নয়।
দেহ, বিলাইরে তোমরা অনেক উপরে তুইলা রাখসো। কিন্তু বিলাই কি করে? তোমগো খাবার চুরি কইরা খায়। বিলাই তোমগোরে অভিশাপ দেয় য্যান তোমরা অন্ধ হইয়া যাও আর হ্যায় তোমগো খাওন চুরি কইরা খাইতে পারে। হ্যার পরও তোমরা মানুষরে বিলাইয়ের বাচ্চা বইলা কঠিন গালি দাওনা। তোমগো কঠিন গালি হইলো কুত্তার বাচ্চা, ক্যান উত্তর দাও?’
লেজ নাড়তে ইচ্ছে হলো লাড্ডুর। অন্তত সে যদি লেজ নাড়তে পারতো তবে এই কুত্তাটা তাকে কামড় না দিয়ে ছেড়ে দিতে পারতো। এখন তো এমনভাবে দাঁত খিচোচ্ছে যে ভাব কামড় দিয়ে বসবে পাছায়।
‘পারবানা, কোন উত্তর দিতেই পারবানা। কারন তোমরা মানুষরা খুব স্বার্থপর বুঝলা? কুকুরকে তোমরা কও কুত্তা। আরে কুত্তা তো হিন্দী উর্দু শব্দ। তোমরা দেশ স্বাধীন করসো বাংলার কথা ‘বলবা বইলা, অহন হিন্দী উর্দু কও ক্যান। কইবা কুকুরের বাচ্চা। যখন তোমরা কুত্তা কও তখন আয়নার মইদ্যে তাকাইয়া দেহ তোমার মুখটা কেমুন দেহায়। দেখবা মুখটা বাঁইকা গুলিস্থানের পাবলিক টয়লেটের লাহান লাগতাসে।’
লাড্ডু অনেক কষ্টে বলে,‘জ্বি স্যার।’
কুকুরটার মুখটা আনন্দের হাসিতে ভরে যায়। লেজ নাড়তে থাকে সে সুখে। বলে,‘এতোদিন পর একটা সুন্দর শব্দ শুনলাম। এইবার আমার মুখ দিয়ে শুদ্ধ কথা বেরুবে। লাড্ডু বাবাজি, আমার কাছে গতকালের একটা গরুর শুকনো হাড্ডি আছে, খাবে?’
লাড্ডুর গলা দিয়ে বমি উঠে আসে প্রায়। কোন মতে মাথা নাড়ে সে।
‘ওহ তোমরা তো আবার কুকুরের মুখের জিনিষ খাওনা।’ শুদ্ধ ভাষায় বলে কুকুরটা।‘ঠিকআছে, যাও বাকি প্রশ্রাবটা সেরে নাও। আমি জানি আমাকে দেখে তোমার প্রশ্রাব আবার ভেতরে ঢুকে গেছে। এবার শান্তিমতো বাকি কাজ সারো তো।’
লাড্ডু এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার আগের স্থানে ফিরে যায়। তারপর প্যান্টের চেইন খুলে আরামে ছাড়তে থাকে দেয়ালের ওপর। ওদিকে কুকুরটা সুখের হাসি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। আবার বৃষ্টি শুরু হলো নাকি? মুখের ওপর পানি পড়ছে কিসের?
আচমকা কানের কাছে আজানের শব্দ শুনে সচেতন হলো লাড্ডু। আরেনা, আজান নয়, কেউ চিৎকার করছে ক্রমাগত,‘ভাইয়া, ও ভাইয়া, একি করছে দেখে যাও!’


লাড্ডু যেন অচেতন থেকে সচেতন হলো। তার মুখের ওপর পানি ঢালছে কে? ঘুমঘুম আবেশে চোখ খুললো লাড্ডু। পায়ের দিক থেকে পিচকারী দিয়ে পানি এসে ওর চোখ মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে, সেই সাথে ভিজছে চপলের সোফা, দরকারী কাগজপত্র, ল্যাপটপ, মোবাইল, টেবিল। এক নিমিষে পুরোপুরি ঘুম থেকে জেগে উঠলো লাড্ডু গরম পানির ফোয়ারায়। তার প্যান্টের চেইন খোলা। সেখান দিয়ে পিচকারীর মতো পানি বেরিয়ে এসে সোজা ওর মুখ ভেজাচ্ছে। আর ওর সামনে মুখে হাত চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চপলের দু’দুটো বোন। তাদের চোখে লজ্জা আর মহা বিশ্ময়।
বৃষ্টি আর ভেজা বাতাসে কখন যে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল আর স্বপ্নে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করছিল। আসলে তখন সে চপলের সোফায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চেপে রাখা প্রশ্রাব আরাম করে ছাড়ছিল।






ফিরে আসা......................রাকিব সামছ শুভ্র

ফিরে আসা......................রাকিব সামছ শুভ্র
তেতাল্লিশ বছরপর ক্যাটকেটে কমলা রঙের খামটা হাতে নিতেই রহমান সাহেবের কেমন অস্থির লাগছিলো। ঘেমে নেয়ে একাকার, হাত কাঁপছে। কুরিয়ারের ছেলেটা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে, স্যার শরীর ঠিক আছে তো?
রহমান সাহেব উত্তরে শুধু মাথাটা একটু উপর নিচ করলেন। ছেলেটার দেখানো জায়গায় প্রাপকের ঘরে কোনরকমে সিগনেচার করে দিলেন। দরজা বন্ধ করে বসার ঘরের সোফায় ধপাস করেই বসে পরলেন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেইসব দিনগুলোর কথা। কতো স্মৃতি! কতো ভালোলাগা! 
তন্বী ঘরে ঢুকে রহমান সাহেবের এভাবে চুপচাপ বসে থাকা আর ঘর্মাক্ত মুখ দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। দৌড়ে কাছে এসে রহমান সাহেবের কপালে হাত দিয়ে জানতে চাইলো, বাবা তোমার শরীর খারাপ লাগছে? বাবা কী হয়েছে? প্রেশার বেড়েছে? দাঁড়াও আমি বিপি মেশিনটা নিয়ে আসছি। 
মেয়েটা বাবার কিছু হলেই এতো অস্থির হয়ে পরে! উল্টো রহমান সাহেবকেই তাকে সামলাতে হয়। এবারও তাই হলো। আমার কিচ্ছু হয়নি, আমি ঠিক আছি। পারলে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়া।
তন্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চার বছর আগে ডাক্তার ঠান্ডা পানি খেলে শরীরের ক্ষতি হয় বলার পর আর কোনদিন এক গ্লাস ঠান্ডা পানি পান করেন নি। আর আজ ঠান্ডা পানি চাচ্ছে? নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। চিন্তিত মুখে ঠান্ডা পানি আনতে গেলো।


চার ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় রহমান সাহেব। বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার। সারাজীবনের সঞ্চয় জমিয়ে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ঢাকা থেকে বেশ দূরে উওরায় একটা তিন কাঠার জমি কিনেছিলেন। সময়ের পরিবর্তন সেই দূরের জমিকে আজ এই ক্রমশ বড় হতে থাকা মেগা সিটির মধ্যে নিয়ে এসেছে তাদের। বাবার রেখে যাওয়া টিনশেডের বাড়িটাকে ভেঙে বছর পনেরো আগে রহমান সাহেব পাঁচতলায় রূপ দিয়েছেন। নিজে তিন তলায় থাকেন, মেজোকে দিয়েছেন চার তলা, ছোটকে পাঁচ তলাটা আর একমাত্র বোনকে দোতলাটা। ভাইবোন সবাই একই বাসাতেই থাকেন। এখনো চার ভাইবোন প্রতিদন বিকেলে-সন্ধ্যায় একসাথে চা খান। কোনদিন দোতলায়, কোনদিন চার তলায়! তলা চেঞ্জ হয় তাদের একসাথে চা-নাস্তা খাওয়া চেঞ্জ হয়না। 
তন্বী ঠান্ডা পানির গ্লাসটা বাবার হাতে ধরিয়ে দিতে গিয়ে সবুজ খামটায় চোখ আটকে গেলো। বাবা কার চিঠি? তোমার? কে দিয়েছে?
পরপর বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করলেও কোন উত্তরই পেলো না। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে এ জগতে নেই। অন্য কোন জগতে, অন্য কোন সময়ে বিচরন করছেন। 

বহুদিনপর রহমান সাহেব মনের দরজা খুলে দিলেন। হুহু করে পুরনো বাতাস বইতে লাগলো। রহমান সাহেবদের পাশের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হয়ে এলো পুতুলরা। রহমান সাহেব তখন ক্লাস ওয়ান কি টুয়ে পড়েন! পুতুল মাত্র স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করেছে। পাশের পাড়ায় স্কুল, প্রায় প্রতিদিনই একসাথে যেতো। বিকেলে বাসার সামনের মাঠে সবাই মিলে খেলতো। রহমান সাহেব হাফপ্যান্ট আর পুতুল ফ্রক পরতো। হঠাৎ করেই রহমান সাহেব খেয়াল করলেন গোল্লাছুট, টিলোএক্সপ্রেস, বরফ-পানি, খেলতে খেলতে তিনি ফুলপ্যান্ট পরছেন আর পুতুল ফ্রক থেকে সালোয়ার কামিজ! পুতুল তখন নতুন নতুন ওড়না পরাও শুরু করেছে। এই পুতুলকে দেখে রহমান সাহেব নতুন পুতুলকে আবিষ্কার করলেন। নিজের মধ্যেই তুলু (পুতুলকে আদর করে তুলু ডাকতেন) কে অনুভব করা শুরু করলেন। তখন পুতুল ক্লাস সিক্সে আর উনি ক্লাস এইটে। খেলার সাথী কখন মনের সাথী হয়েছে টের না পেলেও নিজের ভিতরের পরিবর্তনটা বেশ টের পেলেন। এক বিকেলে খেলার ফাঁকে পুতুলের হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে দেছুট। কিছুটা অস্বস্তি এবং কিছুটা ভয়! ওদিক থেকে কী প্রতিক্রিয়া আসে? কাগজটা দেবার পর বেশ কদিন পুতুল খেলতে এলো না। রহমান সাহেবের ঘুম শেষ! রাতে ঘুমাতে পারে না, বিকেলে মাঠে এলে চোখ এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে তুলুকে। পাঁচদিনের দিন তুলু এলো কিন্তু তার চোখ মুখে সম্পূর্ণ ভিন্ন আভা! রহমান সাহেবের সামনে পরতেই কেমন লজ্জায় গুটিসুটি মেরে রইলো। "কিরে তুই কয়দিন এলিনা কেন? আর জবাবও দিলিনা?"
পুতুল কোন উত্তর দেয়নি। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে হাতে বানানো একটা চোখ জ্বালাকরা কমলা রঙের খাম ধরিয়ে দিলো। সাথে বললো, বাসায় গিয়ে পড়বে প্লিজ, এখানে না।
রহমান সাহেব সেদিন খেলতে নামলেন না, একছুটে বাসায়। ঘরে গিয়ে খুব সাবধানে লুকিয়ে লুকিয়ে খামটা খুললো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটা চিঠি। 

‘কিভাবে চিঠি লিখতে হয় জানিনা। শুধু এটুকুই জানি তোমার চিঠি পাবার পর থেকে আমার পৃথিবী বদলে গেছে। সবকিছুতেই তুমি! আমি রাজি কিন্তু এক শর্তে। আমাকে তুইতোকারি করা যাবে না। তুমি করে বলতে হবে এবং কচুরিপানার ফুল এনে দিতে হবে।’

চিঠিতে শুরু এবং শেষে কোন সম্বোধন ছিলো না। এরপর প্রায় প্রতিদিনই ক্যাটকেটে কমলা খাম পাওয়া এবং তার উত্তর দেয়া রহমান সাহেবের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে তাদের প্রেম ভালোবাসা ভালোই চলছিলো। সমস্যা দেখা দিলো যখন রহমান সাহেব ইন্টার পাশ করে বিএ তে ভর্তি হলো। 

পুতুলের বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লো। ওদের সহায় সম্বল সব বিক্রি করেও শেষ রক্ষা হলোনা। বাবা মারা যাবার পর ওর মামারা ওদেরকে এখান থেকে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। এর মাস ছয়েক পরেই এক লন্ডনি ছেলের সাথে মামারা একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়ে দেয়। রহমান জানতে পেরে ছুটে গিয়েছিল পুতুলের কাছে। কিন্তু সংসারের অভাব আর পারিবারিক সম্মান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজের চাওয়াকে বিসর্জন দিলো পুতুল। ওর ছোট আরও চার ভাইবোন আছে। মামারা তাদের দেখভাল করবেন, পড়াবেন এই শর্তেই পুতুল রাজি হয়েছিলো। তাছাড়া রহমান তখনো ছাত্র, ওকে পালিয়ে বিয়ে করাটা দুই পরিবার মেনে নেবে না। পুতুলের উপায় ছিলোনা।
বিয়ের মাস চারেক পরই ওর স্বামী ওকে লন্ডন নিয়ে যায়। তিন চার বছর পরপর একবার দেশে এলেও কখনো রহমানের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেনি। রহমানও খোঁজ পেতেন তুলু দেশে এলেই। কিন্তু অভিমানে কখনোই সামনে যাওয়া হয়নি। 
তেরো বছর আগে একবার দেশে এসেছিলো পুতুল। তন্বীর বয়স তখন বারো। বাবা মেয়ে একসাথে শপিং এ গিয়েছিলো সেখানেই পুতুলের সাথে তিন যুগ পর রহমানের দেখা হয়ে যায়। রহমান বরফ পানি খেলায় ছুঁয়ে বরফ বললে যেমন মূর্তি হয়ে যায় ঠিক তেমনি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পুতুলও কিছুই বলতে পারছিলো না। তন্বীই পাশ থেকে রহমান সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে বললো, বাবা তোমার কী হয়েছে? এই আন্টিকে দেখে স্ট্যাচু হয়ে গেলে!
রহমান তাকিয়ে দেখছে, সেই একই চোখ, সেই একই হাসি! নাকের নিচের সেই প্রিয় তিলটা সব একই রকম আছে শুধু একটু ওজন বেড়েছে সেই ছিপছিপে ভাবটা নেই। আর সিঁথির দুপাশের কিছু চুলে কালো সরে গিয়ে সাদার দেখা মিলছে। কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিলো না। পুতুলই প্রথমে জিজ্ঞাসা করলো কেমন আছ? উত্তর পায়নি একটা হাসি ছাড়া। হাসিটার মানে ভালো আবার খারাপ দুটোই হয়। তন্বী কে আদর করে দিলো, মাশা আল্লাহ অনেক সুইট হয়েছে তোমার মেয়েটা। এর উত্তরেও সেই একই হাসি ফেরত পেলো। কথা জমেনি আর। দুজনই তাড়া আছে বলে নিজেদের ভীড়ে আড়াল করলো।
তন্বী বাসায় এসে বাবাকে হাজারটা প্রশ্ন করে কিন্তু উত্তরে শুধুই নিরবতা দেখেছে। তন্বী ফুফুর কাছে শুনেছে, বাবা একজনকে খুব বেশী ভালোবাসতো, এখনো মনে হয় বাসে। তার হঠাত করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বাবা সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। তাহলে ইনিই কী সেই তিনি? যার জন্য বাবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়া? অনেক চেষ্টা করেও বাবার মুখ থেকে তার নামটা জানা গেলোনা। ফুফুর কাছে ছুটে গেলো, বর্ননা দিতেই ফুফুর মুখ উজ্জ্বল হয়েও আবার নিভে গেলো। শুধু বললো, হুম উনিই পুতুল যার জন্য তোর বাবা সবকিছুই ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু আমাদের আঁকড়ে ধরে আছেন আজ তেতাল্লিশটা বছর।
আজ বাবার হাতে কমলা খামটা দেখে তন্বীর মন ছটফট করে উঠলো। বাবা চিঠিটা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন। তন্বী দরজায় কান পেতে শুনতে পেলো বাবার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। বাবা সন্ধ্যায় ছোট চাচার বাসায় চা খেতে গেলে তন্বী একটা অনুচিত কাজ করে ফেললো। বাবার চিঠিটা খুঁজে বের করে পড়লো।

যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাকে দেয়া কষ্ট গুলো অনেক বছরপরে হলেও আমাকেই ছুঁয়ে যাচ্ছে। তুমি জানো কিনা জানিনা? আমাদের একমাত্র সন্তান রোপেন দুই বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। আমি মা হয়ে শোকটা সামলে নিয়েছিলাম কিন্তু ওর বাবা তা আর পেরে উঠেনি। দেড়টা বছর অস্থিরতা নিয়ে দিন কাটিয়ে আট মাস আগে সেভিয়ার হার্ট এটাক করে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারলাম না। এই কদিনেই আমি উপলব্ধি করেছি কাছের মানুষ হঠাত করেই দূরে চলে গেলে কেমন লাগে! 
আমি ইচ্ছে করে তখন তোমায় ছেড়ে আসিনি। মামারা শর্ত দিয়েছিলেন যদি আমি বিয়েতে রাজি হই তাহলেই ওনারা মাকে এবং আমার ভাইবোনদের ওনাদের বাড়িতে থাকতে দিবেন, পড়ালেখা করাবেন। আমি রাজি না হলে সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। তুমিই বলো আমি আমার ভালোবাসা রক্ষা করতে গিয়ে পুরো পরিবারকে নিয়ে পথে কীভাবে নামতাম? তুমিও তখন ছাত্র। এতোটা বোঝা তোমার উপরেই কি করে চাপিয়ে দিতাম? তাই ভেবেছিলাম আমি একাই সব হারিয়ে আমার মা আর ছোট ভাইবোনদের ভালো ভাবে বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত করি। হ্যাঁ আমি এটুকু বলতে পারি, সারাজীবন আমি কিসের মধ্যে দিয়ে পার করেছি কেউ জানে না কিন্তু আমার ওই বড় ত্যাগটুকুর জন্যই আমার ভাই বোনেরা সবাই আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। সবাই ভালো আছে। 
তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। সেবার তোমার মেয়েকে দেখে অনেক ভালো লেগেছে। অনেক শান্তি পেয়েছি তোমাকে সংসার করতে দেখে। তুমি ভালো থাকো এই দোয়া করি। আমারও বয়স হচ্ছে ষাটে পৌঁছে গেছি৷ ভাবছি একা না থেকে কোন ওল্ড হোমে চলে যাবো। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও পারলে দোয়ায় রেখো।
ইতি 
তুলু।


বাবাটা এত্তগুলো বছর এতো কষ্ট চেপে রেখেছে। তন্বী রহমান সাহেবের মেয়ে না। তার মেঝো ভাইয়ের মেয়ে। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই তার নেওটা ছিলো। একটু বড় হয়ে বাবার কাছেই চলে এসেছে। ওর বাবা-মা ও আপত্তি করে নাই। একই বিল্ডিংয়েই সবাই৷ চিঠি পড়ে অনেক্ক্ষণ কাঁদলো তন্বী। চিঠিটা জায়গামতো রাখার আগে পুতুলের পোস্টাল এড্রেস টুকে নিলো। 
প্রায় মাস দুয়েক পর আবারো একটা কমলা খাম এলো রহমান সাহেবের ঠিকানায়। এবার অবাক হলেও আগের মতো অস্থির হলেন না রহমান সাহেব। হয়তো মনে মনে উনিও অপেক্ষা করছিলেন আরেকটা চিঠির! হাতে নিয়ে অনেকটা সময় বসেই থাকলেন। খুলে পড়লেন না। ভিতরে না জানি কী লিখা আছে? বরং চিঠি হাতে নিয়ে নিজের মতো ভেবে নেয়াটা অনেক বেশি নিরাপদ। 

রুমে গিয়ে চিঠি খুলে পড়তে বসলেন।
আজ চিঠিতে সম্বোধন আছে। 

প্রিয়.....
নামটা লিখতে গিয়েও লিখলাম না৷ যদি কোনদিন দেখা হয়! তখনই ডাকবো। তুমি আমায় ভালোবাসো তা জানি তবে এতোটা আশা করিনি। একটা জীবন কাটিয়ে দিলে একেবারেই একা! আমি এটা শোনারপর থেকে কোন ভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিনা। কান্নার দমকে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমি যাকে নিজের করে পাইনি সে কিনা নিজেকে আমার করেই রেখে দিয়েছে।
এখন বলাটা অন্যায় তারপরও মানুষ কতো ভুল করেও সুধরে নেয়। আমার জীবনের প্রথম সময়টুকু জুড়ে ছিলে তুমি। আমার শেষ সময়টুকু জুড়ে কী তুমি থাকতে পারো না?
তোমার কিংবা আমাদের ভালোবাসার উপরে এখন আর আমার কোন দাবী নেই। তবু খুব ইচ্ছে হচ্ছে বারান্দায় তোমার সাথে বসে চা খেতে। বাগানে তোমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট কাগজ মুঠোয় গুঁজে দেবার সৌভাগ্য কি হবে? আমি নেক্সট উইকে দেশে আসবো। যদি তুমি আমাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে আসো, খুব খুশি হবো। আর না এলেও মন খারাপ করবো না। সময়টাকে তার মতো করেই এগিয়ে যেতে দিতে চাই। 
তন্বীকে আমার আদর দিও। ও খুবই ভালো মেয়ে।
ইতি
তুলু।

রহমান সাহেব হাসছেন সেই হাসিটা! যার অর্থ হ্যাঁ কিংবা না দুই ই হতে পারে। তন্বী দূর থেকে বাবার হাসিটার মানে খুঁজছে। বুদ্ধি করে মেয়ে হয়ে মায়ের কাজটা করে দিলো তন্বীই।

ইউরোপ ভ্রমন ( ফ্রান্স -১ম পর্ব).....................মনিরুল ইসলাম জোয়ারদার

ইউরোপ ভ্রমন ( ফ্রান্স -১ম পর্ব).....................মনিরুল ইসলাম জোয়ারদার
প্রিয় শ্যালক তৌহিদ বললো দুলাভাই পর্তুগালে আর বেশি দিন নাই ইউরোপের বাইরে হয়তো অন্য কোথাও ট্রান্সফার করে দিবে সুতরাং আমি থাকতে থাকতেই পর্তুগাল বা পারলে ইউরোপের কয়েকটা দেশ ঘুরে যান। ঢাকায় তৌহিদের সাথে দেখা হলেই বলতাম তুমি শালা যেখানে যেখানে পোষ্টিং পাবে আমি সেখানে সেখানেই যাব। তোমার পিছু ছাড়বো না।ফলে তৌহিদের এই অফারটি এড়িয়ে যেতে মন চাইছিল না। বললাম ব্যবস্থা কর তোমার বুবু ভাগনে ভাগনি সহ যাব।

শেষ পর্যন্ত তৌহিদের ইনভাইটেশানে চারজনের পুরো পরিবারের সেনজেন ভিসাটা হয়েই গেল। অবশ্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ফ্রান্স এ্যামবেসিতে জমা দিয়েই ভিসা পেয়েছি। তৌহিদ যেহেতু পর্তুগালে অবস্থান করছে সেহেতু ওখানেই যেতে হবে। ভাবলাম সেনজেন ভিসা পেলাম ২৭টা দেশ ঘুরতে পরবো তবে কেন শুধু একটা দেশ ঘুরবো। এবার খোঁজা শুরু হলো কোন দেশে ঘনিষ্ট স্বজন বাস করে। পেয়েও গেলাম ভাস্তেকে। আমার কাজিনের ছেলে ইটালিতে বসবাস করছে স্ত্রী ও মাকে নিয়ে। ভাস্তেকে বললাম বাবা ইটালিতে আসতে চাই কদিনের জন্য তো হোটেল ভাড়াতো অনেক পড়বে তা তোমার বাসায় কি দু একদিন থাকা যাবে? ভাস্তে রেগে গিয়ে বললো কি বলেন কাকা দু এক দিনতো থাকা যাবে না আপনাকে কমপক্ষে দশদিন থাকতে হবে।আমিতো আপ্লুত। বললাম ভিসা পেয়েছি ৩০ দিনের শুধু ইটালিতে দশ দিন থাকলেতো হবে না। ভাস্তে বললো আগে আসেনতো তারপর দেখা যাক।
তৌহিদকে বলতেই সে বললো যেখানেই যান পর্তুগালে ১৫ দিন থাকতে হবে। এবার ভাবলাম তাহলে রওনা দেই প্রথমে ইটালি পরে পর্তুগাল।আমার বন্ধুবর শাহিদুলের ট্রাভেল এজেন্সি সিটিকম ট্রাভেলে যেয়ে টিকেট কিনলাম। শাহিদ ভাই সর্বোচ্চ ডিসকাউন্টে টিকেটের ব্যবস্থা করলো। টিকেট আনতে গেলে শাহিদ ভাইয়ের স্টাফ বললো এখন নিয়ম হয়েছে যে দেশের এ্যাম্বেসি থেকে ভিসা নিবেন সেই দেশ হয়ে অন্যদেশে যেতে পারবেন। শ্যালককে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো না এমন কোন নিয়ম নেই। কিন্তু স্টাফ ভদ্রলোক অনড় । 

সেদিন শাহিদ অফিসে ছিল না। তো কি করা প্রায় একই মুল্যে প্যারিস হয়ে যেতে পারছি তাছাড়া আমার মেয়ে আরশীর প্রচন্ড ইচ্ছা প্যারিস দেখা আমারও ইচ্ছে তাই তো কেটে ফেললাম সামান্য কয়েকটা টাকা বেশি দিয়ে। রিটার্ন টিকেট নিলাম ঢাকা- প্যারিস, লিসবন -ঢাকা। এখন খোঁজা শুরু হলো ফ্রান্সে পরিচিত আত্মীয় কে আছে পেয়েও গেলাম আমার ভায়রা আরাফাতের ছোট কাকা মি.আনোয়ার ওখানে বাস করছে টানা দশ বছর। ফেসবুকে তাঁকে খুঁজে এড করে কথা বলা শুরু করলাম।আরাফাত বলেছিল অসাধারন ভাল মানুষ কথা বলে দেখলাম ভালোর সাথে অসাধারন আন্তরিকও। ভিসা পাবার পর থেকেই ফ্রান্সে আনোয়ার কাকা ইটালিতে সজীবের সাথে প্রতিদিনই ম্যাসেঞ্জারে কথা চলছে অবিরত আর তৌহিদের সাথে যখন তখন। যেহেতু প্যারিসে প্রথমেই যাব তাই আনোয়ার কাকাকে হোটেল বুকিং দিতে বললাম। প্যারিসে আনোয়ার কাকা ও কয়েকজন যুবক মিলে এক ফ্লাট ভাড়া করে বসবাস করে।ফলে আমাদের জন্য হোটেল ঠিক করলেন। 
তবুও আমি একটু আশন্কায় ছিলাম যদি হোটেল ঠিকমত না মেলে মহা বিপদে পড়ে যাব।আনোয়ার কাকা আমাকে আশ্বস্ত করলেন। আমরা ২০ আগষ্ট টার্কিশ এয়ারে রওনা দিলাম। ঢাকা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন পার হয়ে বোর্ডিং পাস নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন প্লেনে উঠবো। ভোর পাঁচটায় প্লেনে উঠলাম প্লেন উড়লো ঠিক ছটা কুড়িতে। সিটে বসতেই আনান ঘুমিয়ে পড়লো।ছেলাটা গতরাতে একটুও ঘুমায়নি।আমরা কেউই ঘুমাইনি কিন্ত ওতো মাত্র আট বছরের ছেলে।উনিশ তারিখ রাত সাড়ে বারটায় বাসা থেকে বের হয়েছি ভ্রমনের উত্তেজনায় সারাদিন সারারাত ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেছে এখন সবাই গা এলিয়ে দিয়ে সিটে বসলো।সিট বেল্ট বেধে বসতেই প্লেন ছেড়ে দিল। একটু পর আকাশে উড়লো। জানালা দিয়ে দেখলাম নীচের বাড়ি ঘর ছোট ছোট কাগজের বক্সের মত। সামনের সিটের পেছনে আমার সামনে স্ক্রিনে দেখলাম সাত হাজার মিটার উপরে আছি। একটা সো সো আওয়াজ পাচ্ছি কানে। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম।একটু পর মেয়েলি কন্ঠে ইংরেজীতে কিছু কথা শুনে ঘুম ভাংলো। দেখি এয়ার হোস্টেস খাবার নিয়ে এসেছে।তাড়াতাড়ি সামনে ভাজ করে রাখা ট্রেটা মেললাম এয়ার হোস্টেস খাবারের প্যাকেট রেখে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। প্যাকেট খুলে হাইজেনিক খাবার দেখে মনটা ভরে গেল। খাওয়ার পর জুস খেলাম। খানিকটা পর কফি খেয়ে ঘুম। ঘন্টা চারেক পর আবার হালকা নাস্তা ও কফি খেলাম। স্থানীয় সময় চারটায় প্লেন ইস্তান্বুলে ল্যান্ড করলো। ছটা থেকে চারটা মোট দশ ঘন্টা প্লেন উড়েছে মনে হলেও আসলে সাত ঘন্টা উড়েছে। বাংলাদেশের সাথে তুরুস্কের সময়ের পার্থক্য তিন ঘন্টা এবং আটোমেটিকভাবে সময় এ্যাডজাস্ট হয়ে যায় বিশেষ করে মোবাইলে ও প্লেনের ঘড়িতে। ইস্তাম্বুলে চার ঘন্টা ট্রানজিট। ভিতরেই বসে থাকলাম। প্যারিসের প্লেন কত নাম্বার প্যাসেজ ওয়ে থেকে ছাড়বে জেনে নিয়ে লাউঞ্জে বসলাম।

এরপর আমি আর আনান ঘুরে ঘুরে সমস্ত এয়ারপোর্ট দেখলাম তারপর আমরা হ্যান্ড ব্যাগগুলো পাহারা দিলাম আর ডলি আরশী এয়ারপোর্ট ঘুরে দেখলো। বিশাল বড় এয়ারপোর্ট প্লেনের অভাব নেই যাত্রীরও অভাব নেই। এত যাত্রী তবুও হৈচৈ কম। ঠিক চার ঘন্টা পর প্যারিসের পথে বদলি প্লেন ছাড়লো। আবার প্লেনের ভিতর হোস্টেসের দেওয়া খাবার খেয়ে ঘুম।স্থানীয় সময় ছটা ত্রিশ মিনিটে প্যারিস সিডিজি এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম।ধীরে ধীরে প্লেন থেকে নেমে এয়ারপোর্টের বাসে উঠে চলে এলাম এক্সিট এরিয়ায়। সবচেয়ে অবাক লাগলো সারা এয়ারপোর্টে ইংরেজি লেখা নেই। ইংরেজি অক্ষরে ফ্রেন্স ল্যাঙ্গুয়েজ।শুধু এ্যারো চিহ্ন দেখে বের হলাম। এ্যারো চিহ্নের পাসে লেখা sorte পরে শুনেছি sorte অর্থ বাহির। ভিজিটর এলাকায় এসে দেখি আনোয়ার কাকা দাড়িয়ে সাথে আরো একজন। দেখে বুকের ভেতর আশ্বাসের চাঁদরটা লম্বা হয়ে গেল। আনোয়ার কাকার সাথে এই প্রথম সরাসরি দেখা এর আগে শুধুমাত্র মোবাইলে কথা ও দেখা হয়েছে।আনোয়ার কাকা জড়িয়ে ধরলো ও পাসের যুবকটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ও রতন। ওঁদের পাসে দেখি আরো দুজন দাড়িয়ে সামনে এসে পরিচয় দিল সে নির্ঝর অধিকারী ফ্রান্সে বাংলাদেশ দুতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি তৌহিদের কলিগ। আমার স্ত্রীকে চেনে ওঁর সাথে কথা বললো। নির্ঝর অধিকারী মোটর কার নিয়ে এসেছে। নির্ঝরের একটা বড় প্যাকেট ঢাকা থেকে আমরা নিয়ে এসেছি যার মধ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসে বাংলা নববর্ষ পালনের সরঞ্জাম ছিল। ওঁর গাড়িতে লাগেস সহ আমি আনোয়ার কাকা বাদে সবাইকে উঠিয়ে দিলাম। আমরা দুজনে মেট্রো রেলে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মেট্রো রেলের কথা অনেক শুনেছি এবার চড়লাম।সে এক অন্যরকম অনুভুতি।

চলবে.…...।

হাসপাতাল রহস্য...................শাহরীন মৌন

হাসপাতাল রহস্য...................শাহরীন মৌন
আগের পর্বের রেশ ধরে....

সে ফিরে তাকাতেই দেখলো তারই সহকারী শুভ।
: ওহ্, তুই! আমি ভাবলাম আবার এখানে কে আমাকে চিনে ফেললো।
: (সামান্য হেসে) তা ছদ্মবেশে এলেই পারতে!
: হ্যাঁ, তাই ভাবছি। এখন যখন প্রায়ই এখানে আসতে হবে তখন ছদ্মবেশ নিতেই হবে। তো তোর কাজটা হয়ে গেছে?
: হ্যাঁ, বেশ কিছু তথ্য আমি জোগাড় করেছি। ফিরে গিয়ে বলছি, চলো।
: দাঁড়া, নার্সটা সেই কখন ভেতরে গেছে, এখনো আসার নাম নেই।
: কেনো? ঢুকতে দিচ্ছে না ভেতরে?
: নাহ, এখন নাকি ভেতরে ঢোকা যাবে না। কিন্তু আমি ভাবছি যদি ঢুকতে না দেয়, তাহলে কীভাবে আমি ভেতরে যাবো।
: উমমম, আবির ভাই, নার্সটাকে হাত করা যায় না? মানে যদি কোনো ভাবে ওকে আমরা ম্যানেজ করতে পারতাম তাহলে ব্যাপারটা সহজ হতো না? এরা তো টাকার জন্যই খাটে।
: না, না। এটা করা যাবে না। এই হাসপাতালের সাথে জড়িত কাউকে কিচ্ছু জানানো যাবে না শুভ। কারণ, এরা হতেও পারে এই অপরাধের সাথে যুক্ত। তাই এই রিস্কটা নেয়া যাবে না।
: হ্যাঁ, কিন্তু যদি আমাদের ঢুকতে না দেয়, তবে আমরা কীভাবে কেবিনগুলো দেখবো বলো?
: একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। দেখি না, আগে নার্সটা আসুক। কি বলে শুনি।
: হুম।
ওরা দু’জন হাসপাতালের এক কোণায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে। এরই মধ্যে নার্স ফোনে কথা শেষে ওদের কাছে চলে আসে। শুভকে দেখে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আবির বুঝতে পেরে বলে,
: ও আমার ভাই, শাকিব। ইচ্ছা করেই আসল নামটা গোপন করে আবির। আচ্ছা, আমাদের যেতে দেবেন না ভেতরে? আমাদের তো খুবই দরকার।
: দেখেন, আমি তো সাধারণ নার্স। আমাকে যেমন নির্দেশ দেয়া হয় আমি তেমনই করি। আমি ওপর মহল থেকে অনুমতি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাঁরা অনুমতি দিলেন না। আপনারা জিনিসগুলোর মায়া ছেড়ে দিন। আর এমনিতেও আপনারা ওগুলো পেতেন না। কারণ, ডেডবডি সরানোর পরে কেবিন ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলা হয়। কিছু জিনিস থাকলে তা তাদের বাড়ির লোকই নিয়ে যায়, নয়তো আমরা ফেলে দেই। তাই বলছি, আপনাদের জিনিসও আপনারা পাবেন না।
: এমন বলবেন না। আমাদের যে ওগুলো খুব দরকার। একটু দেখেন না যদি ব্যবস্থা করতে পারেন ।
: আহা! আপনাদের বলছি না অনুমতি নেই! কেনো বায়না করছেন? আর কি এমন জিনিস যেটা না হলেই নয়? মানুষটাই তো মারা গেলো। আর কি চান বলেন তো। আমার কাজ আছে। আমাকে যেতে দিন। এই বলে নার্স ওখান থেকে চলে গেলো।
: আবির ভাই, কি ভাবছো? কি করবে এবার?
: বুঝতে পারছি না। তবে গণ্ডগোল যে বড় সড় সেটা আন্দাজ করতে পারছি ভালোভাবে।
: আমাদের অন্য রাস্তায় হাঁটতে হবে বুঝলে?
: হুমম, তাই ভাবছি। চল, আজকের মতো ফিরে যাই। কিন্তু কাল আবার আসবো।

আবির আর শুভ হাসপাতাল থেকে চলে আসে। শুভ, আবিরের সহকারী। ছোট ভাইও বলা যায়। একটা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ল পড়ছে। আর আবিরকে কাজে সহায়তা করছে। এরই মধ্যে আবিরের সাথে বেশ কিছু কেস সল্ভও করেছে। তাই আবির তাকে অনেক ভরসা করে। গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কাজের দায়িত্ব শুভ পালন করে। এইতো, এই কেসেও আবিরকে সাহায্য করছে।
শুভর বাবা, মা গ্রামে থাকেন। আর আবিরের বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছেন। চাচার কাছেই মানুষ হয়েছে আবির। বেশ কিছুদিন হয়েছে চাচাও মারা গেছেন। এখন আবির বলতে গেলে একাই। তাই আবির আর শুভ একসাথেই থাকে। ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। বাসায় তারা ছাড়া আর কেউ থাকে না, এতে তাদের কাজে সুবিধা হয়। বেশ কয়েকদিন হলো ওরা বাসায় ছুটা বুয়া রেখেছে। সকালে এসে কাজ করে দুপুরে চলে যায়। বুয়া অবশ্য জানে না যে ওরা গোয়েন্দা। বাড়তি সতর্কতা নিতেই হয়। কারণ শত্রুরা সব সময় তথ্য চায়, আর তাই এদেরকেই আগে হাত করে।

হাসপাতাল থেকে ফিরে শুভ আর আবির বারান্দায় বসে চা নিয়ে। শুভ আলাপ শুরু করে,
: এই নিয়ে মোট ৯টা সুইসাইডাল কেস হয়েছে এই হাসপাতালে।
: ৯ টা !!
: হুমম, ৯ টা। আর সবচেয়ে বড় আশ্চর্যজনক কি জানো? এই ৯ জনই কিছু না কিছু রোগ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছিলো।
: হাসপাতালে সবাই তো চিকিৎসার জন্যই আসে।কিন্তু এই ৯ জনই কেনো?
: আরেকটা কথা। সবারই মৃত্যু রাত ১ টা থেকে ৩ টার মধ্যে।
: অদ্ভুত তো। দেখো আবির ভাই,আমার যতো দূর ধারণা হাসপাতালে কিছু একটা ঘটনা আছেই।
: তা তো আছেই শুভ। বড় ধরণের খেলা চলছে ওখানে। কিন্তু,
: কিন্তু?
: আমি ভাবছি, এই যে মানুষগুলো সুইসাইড করেছে তাদের পরিবারের কেউ কেনো থানায় জানায়নি?
: তুমি গিয়েছিলে থানায়?
: হ্যাঁ,আগে থানায় গিয়েছিলাম। অফিসার বললেন যে,উনি এমনটা শুনেছেন কানাঘুষা কিন্তু কেউই নাকি উনার কাছে অভিযোগ দায়ের করেননি।
: এটা কীভাবে সম্ভব? না,মানে মানছি যে হাসপাতাল এই মৃত্যুগুলোর সাথে হয়তো জড়িত। কিন্তু তাই বলে ভিক্টিমের পরিবারও? উনাদের কি স্বার্থ?
: দেখ, কার কী স্বার্থ, কে কেনো কী করেছে এগুলোর উত্তর জানতে হলে আমাদের আগে হাসপাতালের ভেতরে যাওয়াটা খুব জরুরি। মারা যাবার আগে তারা যে কেবিনগুলোতে ছিলো সে জায়গাগুলো দেখা দরকার একবার।
: কিন্তু আমাদেরকে কোনো কারণ ছাড়া ওরা ঢুকতে দেবে না। ছদ্মবেশ নিতেই হবে।
: সেটাই ভাবছি। শুভ, তুই একটু থাক। আমি চট করে আসছি। বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো আবির।
(চলবে........)

আক্ষেপে কথোপকথোন....................আরিফা সানজিদা

আক্ষেপে কথোপকথোন....................আরিফা সানজিদা
-কিভাবে সময় কাটাচ্ছো ইদানীং? 

-এইতো লেখালিখি,টুকটাক গল্প পড়ি, বইয়ের ভাজে ভবিষ্যৎ খুঁজি, বিকেল বেলায় সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখি আর রাতের আধারে বেলকনিতে বসে অন্ধকার দেখি!! আর তোমার তো বেশ যাচ্ছে দিন, বন্ধু বান্ধব হৈ,হুল্লোড় বেশ তো কাটাচ্ছো তাইনা?হাহা সময় পাও এসবের মাঝে নিজের অস্তিত্ব খোঁজার? 

-ভালোই তো হেয়ালি সুরে কথা বলতে শিখেছো দেখছি! কাব্যিক সুরে, তো কাব্যগ্রন্থ বের করলেই তো পার! 

- হাহা! মাঝে মাঝে এমন হেয়ালি হতে হয়, তা না হলে একাকিত্ব কাটানো যায়না! আর হ্যাঁ লিখছি তো আমি। 

- কি লিখো? 

- এইতো দু দন্ড লাইন, অনুভূতিকে শব্দচয়নে রূপান্তর, ঝলসে যাওয়া হৃদয়কে টেনেটুনে বাক্যতে পরিণত করা; এইতো এসব লিখছি! 

- শুনাবে একলাইন? 

- এখন তোমার যাচ্ছে বেশ দিন, ঝলসানো এই পোড়া বুকে কি হবে আর বিলীন! 

শান্ত চোখের চাহনি দিয়ে শীতল করবে কি? 

একটুখানি পাশে বসে দেখো ভেজা আঁখি!! 

- সবখানেই কি আমাকে টেনে আনো? 

- হুম! তোমাকে ছাড়া সবকিছুই যে অপরিপূর্ণ! এই যে আমি নিস্পলকে আকাশ দেখি তার পিছনে রয়েছে তোমার শূন্যতা! 

এই যে আমি কাজল চোখে কান্না লুকাই তার পিছনে তোমার উপেক্ষা, এই যে আমি বইয়ের ভাজে মুখ লুকিয়ে থাকি এর পিছনে ও আছে দূরে যাওয়ার প্রচেষ্টা! কিসে বলবে তুমি নেই? 

- জানো এসব না আমার ভালো লাগেনা, এসব কাব্যিকতা কেবল শুনতেই ভালো লাগে জীবন চলে না এসব দিয়ে। 

- জীবনটা কি খুব বেশি বড়? আমার এই ব্যকুলতা শুনে এক জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়না কি? 

- না যায়না! 

- খুব কঠিন তুমি! 

- জীবন মানুষকে কঠিন করে দেয়! একদিন দেখবে তোমার এ আবেগ থাকবেনা, তখন বুঝবে জীবন কি। 

- হুম জীবন কঠিন মানলাম, আমি কঠিন হব তবে কি রাখা যায়না সেই জীবনে আমাকে পাশে? 

- সবার সবকিছু ভালোলাগেনা! জীবনকে গুছিয়ে নাও আর কতবার বলব তোমাকে। 

- হুম, ঠিক বলছ! সবার সবকিছু ভাললাগেনা! এই যেমন আমাকে তোমার ভাললাগেনা! একজীবনে পাবে এতটা আকুলতা কোথাও? 

- জানিনা! আজ উঠি আমি। 

- যদি না পাও তবে এসো দীর্ঘ আলোকবর্ষের পর কোন এক ক্লান্তি লগন গোধূলির সন্ধ্যায় সেদিন আমি লিখে দেব একখানি আকুলতা প্রেম উপাখ্যান-- দেখো কতকাল কাটিয়েছি তব পথ চেয়ে ঝাপসা চোখে কালি জমে হয়েছে ক্ষীণ, দেখো আজও চিনেছি তোমায়,মন থেকে হওনি এতোটুকু বিলীন! 

জানো সেদিন তোমার অজান্তে তোমারে চোখের কোণে একফোঁটা নোনা জল জমবে! সেদিন বুঝবে আমি ছিলাম কতটা তোমার!! 

- ভালো থেকো! 

-খুব তাড়া? ডাকছে তোমায় আড্ডা- হৈ হুল্লোড়? তবে যাও!ভাল থেকো আদিত্য!

দিনমানে দরিয়ায়..................সেমন্তী ঘোষ

দিনমানে দরিয়ায়..................সেমন্তী ঘোষ
শ্চর্য সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যে ভরা অথৈ-নীলের অপার সাগরবেলা প্রত্যেকবারই হৃদয়ের আঙিনায় প্রশান্তির ঢেউ তোলে।কখনো তার উত্তাল সৃষ্টির শৈল্পিক আদল আবার কখনো বা বিপুল বিশালতার মাঝে প্রাণবন্ত নির্মল রূপ। নারিকেল বীথিকায় ছাওয়া রূপালী বালুকাবেলায় কেরালার কোভালাম জলনিধি তেমনি এক শান্ত সমাহিত রুপমুগ্ধতা নিয়ে অভিসারী মনে কল্পকাহিনী রচনা করে। ভারতের দক্ষিণ ভাগের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত কেরালা রাজ্যের, তিরুবনন্তপুরম জেলার দক্ষিণ ভাগের একটি কোস্টাল অঞ্চল কোভালাম। মূলত হাওয়া বিচ ও সমুদ্র বিচ এই দুটির একত্রিত নাম কোভালাম বিচ।শালিমার থেকে ত্রিবান্দম সাপ্তাহিক দুদিন ট্রেন চলাচল করে এছাড়াও হাওড়া থেকে চেন্নাই পৌঁছাতে পারেন করমন্ডল এক্সপ্রেস করে। সেখান থেকে ত্রিবান্দম।রেল স্টেশন বা শহর থেকে কোভালামের দূরত্ব আনুমানিক ১৪ কিলোমিটার। যারা বিমানে আসবেন কলকাতা থেকে ত্রিবান্দম এয়ারপোর্ট -সেখান থেকে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার।
ছায়াসুনিবিড় বেলাভূমির শান্ত প্রশস্থ রূপের মাঝে ব্ল্যাক স‍্যান্ড -কালো বালির সাথে নীল জলরাশির স্বর্ণালী মেলবন্ধন। বিচ টিকে বেষ্টন করে রয়েছে সাধারন থেকে উচ্চতম মানের বিভিন্ন হোটেলাদি।সমুদ্রের জলের মোহিত করা রূপ।সারাদিনই চোখে পড়ল মৎস্যজীবীদের অবাধ আনাগোনা। গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে নৌকায় প্রত্যাগমনের মনোরম দৃশ্য। বিচের মাঝ বরাবর দ্বীপে Vizhinjam jama Masjid। বিচের উত্তর প্রান্ত ধরে হাঁটলে লাইটহাউস।
নির্দিষ্ট সময়ের ভিত্তিতে সুউচ্চ বাতিঘরের ওপর থেকে নীলকান্ত কোভালামের নীলাভ অনুভূতির মনকাড়া দৃশ্য।এর থেকে আনুমানিক ২০০ মিটার দূরে সামুদ্রা মেরিন একুরিয়াম এর অবস্থান।চারিদিকে ঘুরে এসে সমুদ্র সৈকতে বসে উপলব্ধি করলাম ২০১৮ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন কর্তৃক এটির পৃথিবীর সুন্দরতম বিচের মধ্যে একটির সম্মান পাওয়ার কারণ,এই দৃষ্টিনন্দন মোহিত রূপ আর ঢেউয়ের খেলা। শান্ত -অনুগত ঢেউ। বিচের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের জন্য চোরাবালি বা গভীর খাদ এখানে নেই। তাই সুখের ছোঁয়া লাগে ঢেউয়ের দোলায়। খুব বড় ঢেউ না হওয়ার জন্য ভাসিয়ে বা ডুবিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ও থাকে না। জলকেলিতে ভরে ওঠে মন ও প্রাণ। নেত্র পল্লবে সুদূরের মায়াঞ্জন।নীল নির্জন বালুচরে সমুদ্রের অসীম জলরাশি যেন কালো বালির বুকে আল্পনা এঁকে দিয়ে যাচ্ছে।
তরঙ্গের নৃত্যচপল ভঙ্গীর বিচিত্র লীলারঙ্গ।প্রাত্যহিক ক্লান্তিময় শহুরে জীবন থেকে দূরে নিস্তব্ধতার মাঝে ঢেউয়ের তালে পৃথিবী যেন তার আপন সৌন্দর্য বিছিয়ে রেখেছে এখানে।রূপমাধুরীর সেই অমোঘ আকর্ষণে স্নিগ্ধ বাতাস অনির্বচনীয় নির্জনতা মুখর হয়ে উঠেছে। অনাদি অনন্ত সৌন্দর্যের রূপবৈভব দেখতে দেখতে সূর্যের ধীরে ধীরে সমুদ্র শায়ন।শেষ বিকেলের আলোর গোধূলিলগ্নে পশ্চিম কোলে সূর্যের ঢলে পড়ায় আবির রাঙা আকাশের রেশ। সমুদ্রের নীল রং কালো বালি সূর্যের আভায় এক মায়াময় জগতের সৃষ্টি। ক্ষণে ক্ষণে রঙ পরিবর্তন।কখনো আবির রাঙালাল,কখনো কমলা,আবার কখনো হালকা লাল। তবুও কিছু আলো যেন অবশিষ্ট রয়ে গেল ঈশান কোণে জমা হওয়া পুঞ্জীভূত মেঘের মতো। সিঁদুর রাঙা অস্তগামী সূর্যের রক্তিম হাসিতে গোধূলিবেলার ঝিরঝিরে সমীরণে প্রণয়ভিসারী হয়ে উঠল মন। হোটেলে ফিরে গিয়ে সেই রাত্রিটা এক মুঠো সুখ স্মৃতিকে অবলম্বন করে হোটেলেই কেটে গেল। নবপ্রভাতে প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচনের সাথে সূর্যোদয় দেখে আবার একই পথ ধরে ফিরে এলাম কলকাতায় . ..... তবুও চোখে লেগে থাকল সেই কদিনের সমুদ্রসৈকতের মাধুর্য.......
দিগন্তের বালুকাবেলায় উত্তাল হওয়া
অচেতন মনে তার রোজ আসা যাওয়া...

চিত্র :পৃথ্বীশ ভদ্র

ফাগুনের আগুন শিখা.................সেমন্তী ঘোষ

ফাগুনের আগুন শিখা.................সেমন্তী ঘোষ
দোল পলাশের পদাবলী, আবির রাঙা কেশ
অভিসারে মাদল সুরে ফাগুনেরই রেশ---

আগুনের সুরে পলাশের ডাকে মন চলে অভিসারে। প্রকৃতিতে লাগে মধুর বসন্তের সাজ সাজ রব। দখিনা বাতাসের সাথে ডানা মেলে ইচ্ছেরা পাড়ি দেয় স্বপ্ন সুখের সন্ধানে।গগনচুম্বী অট্টালিকার দৃষ্টিনন্দন থেকে তাই দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে প্রতিবছরই ফেব্রুয়ারি মার্চ মাস করে আমরা পৌঁছে যাই বড়ন্তি তে।একদিকে যেমন অরণ্যের অসীম রহস্যময়তা তার শান্ত শ্যামল সৌন্দর্য নিয়ে বিরাজমান ,অন্যদিকে তেমনি প্রশস্ত উপত্যকার মাঝে পাহাড়ে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন লেক হৃদয়ের আঙিনায় নব নতুনের বার্তা বহন করে আনে। 
বাংলা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৫৬ সালের পহেলা নভেম্বর পূর্বতন বিহার রাজ্যের মানভূম জেলার সদর মহকুমা পুরুলিয়া জেলা নামে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হয়।সেই পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর মহাকুমার সন্তুরি থানার অন্তর্গত একটি ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম বড়ন্তি। এখনও বেশ কিছু জায়গায় মানভূম লেখা টি চোখে পড়ে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রাতেও রয়েছে মানভূমের ছাপ।
পলাশের বর্ণ মিছিলে যোগদানের জন্য যাতায়াতের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো হাওড়া থেকে ট্রেনে আসানসোল । আসানসোল থেকে গাড়িতে আনুমানিক ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে বড়ন্তি।চারিদিকে সবুজের সমারোহ উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বড়ন্তি আর মুরাডি পাহাড় দ্বারা আবৃত বড়ন্তি তে পৌঁছাতে আসানসোল থেকে লাগে প্রায় ঘন্টা দেড়েক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৬০০ ফুট উচ্চতায় বড়ন্তি পাহাড় ঘেরা রাঙ্গামাটি রাস্তায় চারপাশে রয়েছে ছোট-বড় বেশকিছু থাকার হোটেল।
রূপে রসে বৈচিত্রের লীলা চাঞ্চল্য নিয়ে বহু বিচিত্র সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র এই গ্রামটি।একদিকে শ্যামল গহন বনাঞ্চল অন্যদিকে আদিবাসী মানুষগুলির শিল্পকর্মে রঙিন জীবনের ছোঁয়া_

পাহাড়তলীতে ভূমিপুত্রদের মাটির বাড়ি
আলপনা আঁকা দেওয়াল সারি সারি...

যতবারই বড়ন্তি যাই গ্রাম্য পথের উদাসী হাওয়ায় যেন নিজেকে নতুন করে চিনতে পারি।ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে পলাশরাঙ্গা ফাগুনের মায়ায় চেনা- অচেনা পাখির সুরেলা ডাক কানে ভেসে আসে।মাঝে মাঝে ফ্রেমবন্দি হয় বুলবুলি ,ফ্রিঞ্চ,কোকিল কোয়েল,বি ইটার,ফিঙে ,টিয়া ,দোয়েলের দল।শাল, পলাশ, শিমূল, পিয়াল, মহুয়ার জঙ্গলের মাঝে মাঝে চোখে পড়ে আলপনা আঁকা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাটির বাড়ি।তবুও এত সৌন্দর্য এত আনন্দের মাঝেও গ্রামীণ মানুষগুলোর কষ্টের জীবন মনকে অস্থির করে তোলে।যদিও তাদের হাসিমাখা সরলতা মন ভরিয়ে দেয় ।তাদের রূক্ষ বৈচিত্রহীন জীবনে বসন্তের আগমনে ফাগের রং এর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পলাশের পদাবলী। 
তারা জানে নিজেদের সংস্কৃতিকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয় তাই ইট কাঠ কংক্রিট এর জীবন থেকে দূরে আজও বড়ন্তি আপন মহিমায় সেজে রঙিন তানে রূপালী জল ছবি আঁকে। অরন্যের অগ্নিশিখার মাঝে লেকের জলে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি আর সিঁদুর রাঙ্গা অস্তগামী সূর্যের মায়াবী আভায় রচিত হয় স্বপ্নের কথকতা। বড়ন্তির সান্ধ্যকালীন রূপেও বিমোহিত হতে হয়।নিঝুম নিশ্চুপ আঁধার, হিম পড়া মায়াবী সন্ধ্যা।কখনো বা হোটেলের ব্যালকনি থেকে দেখা পূর্ণিমার আছড়ে পড়া জোছনার মোহময়ী বৈভব। দূর থেকে ভেসে আসা ধামসা মাদলের ড্রিম ড্রিম বোল।মাঝে মাঝে কিছু অচেনা-অজানা প্রতিধ্বনি। সারাদিনের স্বপ্নবিভোর বিষন্নতায় রঙিন একগোছা পলাশের ঝাঁজালো গন্ধে অদ্ভুত প্রশান্তি।রাত্রি অতিবাহিত স্মৃতির মননে।প্রভাতের স্বর্ণালী আলোয় নব দিগন্তের নবরূপে সুনির্মল নীলাকাশে ফিরে ফিরে আসার অনন্তের আহ্বান:
মায়াবিনি প্রকৃতির অনন্ত ডাক
পলাশের ফাগে ;আগুনের রাগ।

চিত্র সৌজন্যে :পৃথ্বীশ ভদ্র

আম্মার বিয়ের শাড়ি...........রাকিব শামছ শুভ্র

আম্মার বিয়ের শাড়ি...........রাকিব শামছ শুভ্র

বুবুর উচ্ছ্বসিত হাসি দেখে খুশী হলেও কেমন একটা কষ্টও অনুভব করছি। আম্মা বুবুর জন্য জামা সেলাই করছে। আর আমি, আঁখি আর পাখি হা করে তাকিয়ে আছি। একটা না দুইটা না একসাথে তিন তিনটা জামা বানিয়ে দিচ্ছে।

মরা চারবোন, ভাই নেই আমাদের। ভাইয়ের আশায় চার সন্তানের মা-বাবা হয়েছেন কিন্তু ছেলে হয়নি। বুবু রাখি, আমি সাখি, আমার পরে আঁখি আর পাখি। আমরা মফস্বলে বসবাস করি। বাবা সরকারি চাকুরি করেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা তবে তার সততার জন্য খুবই সম্মানিত ব্যাক্তি। আমার মা আমাদের দেখাশোনা করে, সংসার এর সকল কাজ সামলায়। আমরা চার বোন, বাবা-মা, আমার দাদু এই নিয়ে আমাদের সংসার। বাবার একার আয়ে সবার পড়ালেখাসহ অন্যান্য খরচ জোগানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাদু কৃষিকাজ করতেন। বাবা নিজে লজিং থেকে বিএ পাশ করে চাকুরিতে ঢুকেছেন। আম্মা নাইন পর্যন্ত পড়েছে। এরপর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর পড়া হয়ে উঠেনি। আম্মাদের বড় গৃহস্থ পরিবার। শয়ে শয়ে বিঘা জমি, ধান, পাটের কারবারি। নানার অনেক পয়সা ছিলো কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব বড় মনের ছিলেন না। দুইটা বিয়ে করেছেন, একগাদা ছেলেমেয়ের বাপ হয়েছেন। আম্মার প্রেম মেনে নেননি, আর আম্মাও ছিলেন প্রচন্ড জেদি। বাবার হাত ধরে পালিয়ে চলে আসেন। বাবাই ছিলেন আম্মাদের বাসায় লজিং মাস্টার। বাবা পালিয়ে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না কিন্তু মায়ের জেদের কাছে নতি স্বীকার করে নিলেন। নানা এই বিয়ে মেনে নেননি, আম্মাও কখনো আর ওই বাড়িতে যাননি। আমাদের পরিবারে এসে বাবার পাশে যোগ্য স্ত্রী হিসেবে পাশে ছিলেন এবং আছেন। বাবার স্বল্প আয়ে সংসার সামলে যাচ্ছেন। কোন রকম বিলাসিতা আমাদের সংসারে একেবারে অপরিচিত শব্দ। 

মা নানার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার সময় তার শখের সেলাই মেশিনটা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। সিঙ্গার মেশিনটার বয়স প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেছে। আম্মার যত্ন এবং ভালোবাসায় এখনো একেবারে নতুন মেশিনের মতোই ছুটে। আম্মার এই শখের জিনিসটাই কখন যে সময়ের আবর্তে আমাদের সবার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে! খরচ বাঁচাতে আম্মার এই মেশিন এখন পরিবারের বড় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। মেশিনের ঘরঘর শব্দ শুনলেই আমরা বুঝি আম্মা নতুন কিছু সেলাই করছেন! আমরাও প্রতি রোজার ঈদে একসেট করে মোটামুটি ভালো জামা পাই। আর বাসায় পরার জন্য সবার মিলিয়ে ঝিলিয়ে কয়েকসেট কাপড় আছে। আমাদের চার বোনের সব জামাকাপড় আম্মার সেলাই করা। আমরা কখনো দোকানে গিয়ে জামা কিনিনি। আম্মার বানানো জামাগুলো অবশ্য দোকানের জামার চেয়ে ঢের সুন্দর। 

আজ বুবুর জন্য আম্মা তিনটা কাপড় এনেছেন। এখন বসে বসে সেলাই করছেন আর আমরা বুভুক্ষুর মতো আম্মার চারপাশে ঘিরে আছি। বুবুর ভাগ্যকে হিংসা হচ্ছে খুব। বুবু এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পাশ করেছে। এতোদিন বুবুরও আমাদের মতো একটা ভালো জামা ছিলো আর আজ থেকে চারটা বেড়ানোর জামা! আম্মার উপর খুব জিদ হচ্ছে। 

বুবু পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। মেডিক্যাল কলেজে টিকেছে। আগামী সপ্তাহে শহরে যাবে বাবার সাথে। এতোদিন কলেজ ড্রেস পরেই কাজ সারতো কিন্তু এখন না-কি মেডিক্যাল কলেজে ইউনিফর্ম নাই। বুবুর তো ভালো জামা মাত্র একটা! তাই আম্মা কাল কাপড় কিনে এনেছেন। বাসার সবাই খুব খুশি বুবুর রেজাল্টে। কিন্তু আমার খুশি লাগছে না। বুবু নতুন তিনটা জামা পাচ্ছে তার মানে এবার হয়তো ঈদে আমাদের আর নতুন জামা পাওয়া হবে না! বুবু বাড়ি ছেড়ে যাবে এতে যতটা না মন খারাপ হচ্ছে তারচেয়ে বেশী মন খারাপ নতুন জামার শোকে।

দুপুরে মন খারাপ নিয়ে খেতে বসেছি। পাতে মাছের টুকরার সাইজ ছোট দেখে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। আমাকেই শুধু সব মেনে নিতে হবে? আমি মুখ ফুলিয়ে বসে আছি। আম্মা খেয়াল করলেন আর বকা দিলেন। তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ। আমি ভাত নাড়াচাড়া করছি কিন্তু খাচ্ছি না। আম্মা কিছুই বললেন না। না খেয়ে উঠে পরলাম। চারটার দিকে আম্মা আমাকে ডাকলেন, রনির মা (আমাদের বাসায় আম্মাকে কাজে সাহায্য করে) এর সাথে তার বাসায় যেতে। রনির মা আমাকে নিয়ে তার ঘরে গেলো। পাশেই এক বস্তিতে থাকে ওরা। রনিরা তিন ভাই। বড়টার বয়স আট বছর, মেঝটা ছয় আর ছোটটা তিন বছর। একটা ছোট্ট ঘরে ওরা থাকে। ঘরটা অন্ধকার ঘুপচি মতোন। ভেড়ানো দরজা টেনে খুলতেই তিনভাই এক সাথে চেচিয়ে উঠলো, মা এসেছে, মা এসেছে। 

দরজার বাহিরে বসলো তিনজন। রনির মা কোচরে শাড়ী দিয়ে ঢেকে রাখা থালাটা বের করলো। আমার না খাওয়া মাছের টুকরা, সাথে ঝোল দুই টুকরা আলু আর এক থালা ভাত। তিনজনই প্লেটের উপর ঝাপিয়ে পরলো। ওই এক টুকরা ছোট মাছটা দিয়ে খাচ্ছে আর বলছে, মা অনেকদিন পর এত্ত বড় মাছ আনলা! আমি অবাক হয়ে দেখলাম রনির মা দু নালা ভাত মুখে দিয়ে আর দিলোনা। তার চোখের কোনে পানি অথচ মুখে কি সুন্দর হাসি! রনি মাছের কাটা বেছে নিজে না খেয়ে ছোট দুই ভাইয়ের মুখে তুলে দিচ্ছে। গপগপ করে খাচ্ছে আর খুনসুটিতে মাতছে।

আমি চুপ করে ওদের খাওয়া শেষ করা দেখলাম। বাসায় এসে দৌড়ে গেলাম আম্মার কাছে। গিয়ে আম্মার বুকে মুখ গুজে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। আম্মা কিছুই বলছেন না। শুধু আমার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি আম্মার বুক থেকে মুখ তুলে গলা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, আম্মা আমি আর কোনদিন খাওয়া নিয়ে নকতা করবো না। ওদের প্রতিদিন তুমি একটুকরা মাছ দিও। 
আম্মা হেসে বললেন, তোদেরই প্রতিদিন দিতে পারিনা। চেষ্টা করবো যেদিন বেশী থাকবে, সেদিন দিতে। 
আমার টুকরার অর্ধেক ওদের দিয়ে দিও। 
আম্মা আমার চুলের বেনি ধরে হালকা টান দিয়ে বললেন, থাক থাক আর পন্ডিতি করতে হবে না। ভালো করে পড়াশোনা করে বুবুর মতো ডাক্তারি পড়তে চেষ্টা কর। নিজে যখন আয় করবি এমন দশজনকে খাওয়াতে পারবি। 
আমি মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিলাম, আমিও বেশী করে পড়ে বুবুর মতোই হবো।

রাতে ঘুমানোর আগে বুবু সব নতুন জামা নিয়ে ঘুমুতে এলো। এটা আমাদের চার বোনেরই অভ্যাস। নতুন জামা পেলে না পরা পর্যন্ত সেটা কাছ ছাড়া করিনা। বুবুর জামা গুলো ধরে দেখছিলাম। নতুন জামায় কি সুন্দর গন্ধ থাকে! শুকে দেখছিলাম। 
তোর খুব পরতে ইচ্ছে করছে তাইনারে সাখি? ইচ্ছে হলে পরতে পারিস।
আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো কিন্তু বুবুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি যখন তোর মতো ভালো রেজাল্ট করবো তখন তোর জামা চেয়ে নিয়ে পরবো।
বুবু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, আমাদের সব্বাইকে পারতেই হবে। আম্মা-বাবার কষ্টকে স্বার্থক করতেই হবে। আমরা চারজন ওনাদের সব না পাওয়া পূরণ করে দেবো। আমিও হ্যাঁ হু করতে করতে বুবুর হাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। 

সকালে উঠে স্কুলে ছুটলাম। দুপুরে বাসায় এসে তাড়াহুড়া করে খেয়ে উঠতেই আমাদের চার বোনকে ঘরে ডাকলেন। চার বোন ঘরে যেতেই আম্মা প্রথমে পাখিকে খুব সুন্দর একটা জামা দিলো। এরপর আঁখি তারপর আমি, শেষে বুবু। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি৷ আম্মা বললেন, আমার বিয়ের শাড়িটা কেটে তোমাদের জন্য ড্রেস বানিয়েছি। আমারতো আর এই শাড়ি পড়াই হয়না। তাই ভাবলাম আমার রাজকন্যাদের একটা করে জামা বানিয়ে দেই। চারটা জামাতো এক শাড়ীতে হয় না তাই সবার জামার সামনে আমার শাড়ী আর পেছনে অন্য কাপড় জোড়া দিয়েছি।তোমরা চারজন এই ড্রেস পরে যখন একসাথে দাঁড়াবে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে। 
আমরা চারবোন মাকে জড়িয়ে ধরে বোকার মতো কেঁদেই যাচ্ছি। আর আমাদের আম্মাটা সেই চিরচেনা হাসিটা হাসছেন।

মাতৃত্ব..................তুহিন রহমান

মাতৃত্ব..................তুহিন রহমান
রকারী অফিসের পেছনের ডুমুর গাছের পাতা বুনে ছোট্ট একটা বাসা বানিয়েছে দুটো টুনটুনি পাখি। টোনা আর টুনি। টোনার নাম চিরিং। আর টুনির নাম রুরু। দু’জনেই বেশ দুরে থাকে। তাদের জায়গাটা নিরাপদ নয় তাই তাদের জঙ্গল থেকে বেশ দুরের এই সরকারী এলাকার গাছে বাসা বেঁধেছে চিরিং আর রুরু। গাছের ওপরের অংশে, যেখানে মানুষ নাগাল পাবেনা সেখানে কয়েকটা পাতা এক করে তুলোর চিকন বুনট দিয়ে বাসা বানিয়েছে দু’জন। বাসা বানাতে লেগেছে পুরো দুটো সপ্তাহ। ওপর থেকে যা’তে বৃষ্টির পানি না পড়ে সেজন্য বাসার ওপর সেলাই করে দিয়েছে একটা কচুপাতা। 

বাসা বানানো যখন শেষ তখন রুরু বললো,‘এবার আমি ডিম পাড়তে পারি।’
চিরিং বললো,‘আরেকটু অপেক্ষা করো। এই মাসটা যাক। পরের মাসে পেড়ো।’
‘তা ঠিকই বলেছো।’ রুরু বললো।‘এই মাসটা আমরা বিশ্রাম নেবো। সামনে তো আবার বাচ্চা বড়ো করার কষ্ট আছে।’
‘ঠিক বলেছো। এই মাসটা আমরা শুয়ে বসে কাটিয়ে দেবো।’
ওরা একটা মাস শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। কোন খাবার দাবারের ভাবনা নেই। খেলে খেলাম নাহলে না খেলাম এমন একটা ভাব। বাচ্চা হলে তো এসব চলবেনা। তখন তাকে বড়ো করার চিন্তা। শুধু তাকে বড়ো করলে চলবেনা। তাকে পাখির মতো পাখি বানাতে হবে। তাকে উড়তে শেখাতে হবে। পোকা শিকার করতে শেখাতে হবে। বিপদ চেনাতে হবে। আরও কতো কি। তারপর তার পড়ালেখার চিন্তা।
পরের মাসে রুরু ডিম পাড়ে। ছোট ছোট দুটো ডিম। ডিমের গায়ে নীল নীল ছোপ ছোপ। রুরুর চোখে অনেক স্বপ্ন। ডিম ফুটে কি টোনা হবে নাকি টুনি হবে এটাই সে চিন্তা করে। ডিমদুটো পাশাপাশি থাকলেও মাঝখানে কিছুটা তুলো গুঁজে দিয়েছে রুরু। যদি জোরে বাতাস বয় আর গাছটা জোরে জোরে দোলে তাহলে ডিম দুটো একে অন্যের সাথে বাড়ি লেগে ভেঙ্গে যেতে পারে। দু’দিন পর চিরিং কোন গাছের আঠা এনে ডিমের ওপর দেয়। এর ফলে নাকি তার ডিম্বজাত সন্তান আরও শক্তিশালী হবে। রুরু আবার কোথা থেকে একটা সবুজ পাতা নিয়ে ঘষে দেয় ডিমের ওপর যা’তে তার ডিমদুটোর খোসা আরও শক্ত হয়। ডিমের খোসা শক্ত হওয়া মানে ভেতরের বাচ্চার হাড্ডি শক্ত হওয়া।
এভাবে প্রায় চারদিন চলে গেল। রুরু সারাক্ষন বসে থাকে ডিমের ওপর। তা দেয়। চিরিং উড়ে যায়। কোথা থেকে যেন পোকা নিয়ে আসে। গুঁজে দেয় রুরুর মুখে। বলে,‘তোমার জন্যও নিয়ে এলাম। তুমি তো সেই সকাল থেকে কিছু খাওনি।’
‘ঠিকই বলেছো।’ রুরু বলে। ‘পেটটা চোঁ চোঁ করছিলো।’
সাতদিন যায়। ডিমদুটোর ওপরের নীল রং ধুসর হতে থাকে। যেন আকারেও কিছুটা বড়ো হয়েছে। মা রুরু তার বুকের সব উষ্মতা দিয়ে দিতে চায় ডিমদুটোকে। চিরিংকে ডেকে রুরু বলে,‘দেখো দেখো এই ডিমটা নিশ্চয়ই মেয়ে হবে।’
‘তুমি কিভাবে বুঝলে?’ চিরিং জিজ্ঞেস করে রুরুকে।
‘এই ডিমটা একটু ছোট তাইনা? ছোট ডিম হলে মেয়ে হয়।’
‘আমিও চাই আমার একটা মেয়ে হোক।’ চিরিং হাসিমুখে বলে। 
রুরু দশটা দিন একটানা কাটিয়ে দেয় ডিমের ওপর বসে। একটানা দশ দিন ডিমের ওপর বসে থাকার পর সে একবারের জন্য উড়ে যায় কাছের আম গাছের ডালে। হাত পা আর ডানা মেলে শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে নিতে চায়। এই সুযোগে বাবা মানে চিরিং বসে তা দেয় ডিমে। একটানা বসে থেকে একটু শুকিয়ে গেছে রুরু। ঠিকমতো খাওয়া হয়না তার। যতোটুকু চিরিং যোগান দেয় ততোটুকুই খায় সে। আরও একটা সপ্তাহ বসে থাকতে হবে ডিমের ওপর।
বারোদিনের মাথায় আকাশ কালো হয়ে এলো। এমন কালো যে কাছের জিনিষও দেখা যায়না। রুরু বললো,‘ঝড় আসবে। তুমি ভিতরে চলে এসো।’
‘অতোটুকু ঘরে তোমার বসার জায়গাই হয়না আবার আমি বসবো?’ চিরিং বললো। ‘আমি এই ডালেই থাকি।’
‘কিন্তু ঝড় আসছে তো!’ রুরু বাতাসের ভেতর চিৎকার করে বললো।
‘আমাকে নিয়ে ভেবোনা। আমি ভেতরে গেলে ডিমের ওপর চাপ লাগতে পারে। তা’তে বাচ্চাদের ক্ষতি হতে পারে। আমি এখানেই থাকি। সারাজীবনই তো বৃষ্টি আর ঝড়ে কষ্ট পেয়েছি। আমার বাচ্চাদের যেন কষ্ট না হয়।’
দেখতে দেখতে হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামলো। সেই সাথে প্রচন্ড ঝড়। মাথার ওপর কচুপাতাটা থাকাতে বাসার ভেতর পানি ঢুকলোনা। তবে কচুপাতার জন্যে রুরুও দেখতে পেলোনা চিরিংকে। চিরিং ওপরের ডালে বসে ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করছে। ছোট্ট একটা পাখি আর কতোক্ষন যুদ্ধ করতে পারে? আর ঝড়টাও ছিলো প্রচন্ড। এমন ঝড় জীবনেও দেখেনি চিরিং। ঝড়ে ডালপালা ভেঙ্গে উড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর একটা বড়ো ডাল এসে ওর মাথার ওপর পড়লো। যখন ঝড়বৃষ্টি থামলো রুরু চিৎকার করে চিরিংকে ডাকলো। এরপর ডাকতেই থাকলো। চিরিং এর সাড়া নেই। বাধ্য হয়ে রুরু ডিম থেকে উঠে এলো বাইরে। দেখলো চিরিং গাছের নিচে পড়ে আছে। অনেক আগেই মারা গেছে পাখিটা।
রুরু কাঁদতে থাকলো। পাখিটা কতো কষ্টই না করেছিলো জীবনে। বাচ্চাদের জন্য নিজের জীবনটাও উৎস্বর্গ করে দিলো। দিন যায় আর রুরু উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ডিমদুটোর ব্যপারে। ডিমদুটো ঠিক আছে তো? বাচ্চা বেরুবে তো? একদিকে মরে যাওয়া চিরিং এর কষ্ট আবার অন্যদিকে ডিমদুটোর ভাবনা। কে যেন বলেছিলো ডিমের ওপর যদি গলা থেকে বের করা রক্ত দেয়া যায় তবে ডিম থেকে সুস্থ দেহে বাচ্চা বের হয়। যেই চিন্তা সেই কাজ। দিন রাত উচ্চস্বরে চিৎকার করতে লাগলো রুরু। একদিন সত্যিই ওর গলা থেকে রক্ত বেরুলো। আর সেই রক্ত সে ঢেলে দিলো ডিমদুটোর ওপর। 
দুই দিন পর সত্যিই ডিম ফুটে দুটো ছানা বের হয়ে এলো। রুরু তখন খুবই দুর্বল। গলা দিয়ে আর কোন স্বরই বেরুলোনা। কিচির মিচির করার ক্ষমতা হারিয়েছে ও চিরদিনের জন্য। বোবা হয়ে গেছে পাখিটা। শরীর এতোটাই দুর্বল যে উড়ে গিয়ে খাবে এমন শক্তিও নেই। দু’দিন মরার মতো পড়ে রইলো রুরু। তিনদিনের মাথায় উড়ে যেতে পারলো কাছের একটা গাছে। দানাপানি খেয়ে একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিলো। তারপর ছোট ছোট দানা মুখে তুলে নিলো। মরে গেলেও ওকে ওর বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে। ওর বাচ্চারা না জানি কতো কাঁদছে খাবার জন্যে। উড়ে যাবার শক্তি নেই তবুও বহু কষ্টে উড়ে এলো ডুমুর গাছের ডালে, তার বাসায়। বাচ্চাদুটোর মুখের ভেতর গুঁজে দিলো দানা।
এভাবে দিন যায়। রুরু দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। বাচ্চারা বড়ো হতে থাকে। দুটো বাচ্চাই বেশ শক্তিশালী। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। মোটাসোটা ঠোঁট, রাগী চেহারা। বোঝাই যায়, চিরিং এর কেটাল গাছের আঠা, রুরুর গচু পাতার কষ আর গলার রক্ত কাজে লেগেছে-ছেলেমেয়ে দুটো সুস্থ সুন্দর দেহের হয়েছে। রুরুর স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। শুধু দুঃখ যে চিরিং ছেলেমেয়েদুটোকে দেখে যেতে পারলোনা। বাচ্চারা বড়ো হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। রুরু দুর্বল দেহে ওদের ওড়ার ট্রেনিংও দিতে পারলোনা। ওরা নিজেরা খেলতে খেলতে একদিন উড়তে শিখে গেল। রুরু বাসাটাকে আরেকটু বড়ো করেছে যা’তে দু’তিনজন আরাম করে বসতে পারে। ওর শরীর ভেঙ্গে যাওয়াতে ও নড়াচড়াও করতে পারেনা তেমন। ডালের কাছাকাছি কোন পোকা এলে ধরে খায় নাহলে উপোষ থাকে। বাচ্চাদুটো মাসদুয়েক বাদে বড়োসড়ো হয়ে যায়। উড়ে উড়ে যায়। খেয়ে দেয়ে পেট মোটা করে আসে। এদিকে মা না খেয়ে পড়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে বাচ্চাদের দিকে। যদি দুটো দানা এনে দেয় ওরা। ওরা কিছুই আনেনা মায়ের জন্যে। একদিন ছেলেটা বলে,‘দেখ মা, এই বাড়িতে আমরা আর থাকবোনা। এই বাড়িটা ছোট। আমরা দুজন মিলে বড়ো করে বাড়ি বানাবো। আর তুমি এখানেই থাকবে। তুমি তো বোবা। তোমাকে নিয়ে আরেক ঝামেলা বাধবে। তারচেয়ে এখানেই থাকো। আর আমরাও তোমার জন্য কোন খাবার দাবার আনতে পারবোনা। এতো সময়ও নেই আমাদের। বাসা বুনতে হবে, সংসার করতে হবে। কতো কাজ।’
রুরু তাকিয়ে থাকে বোবার দৃষ্টি মেলে। ছেলেমেয়েদুটোকে ও অত্যন্ত ভালোবাসে। ওরা যাতে সুখে থাকে সেটাই কামনা করে সে। রুরু জানে ও এতো দুর্বল যে যদি ওরা ওকে খাবার এনে না খাওয়ায় তবে ও না খেয়ে মারা যাবে। তারপরও নীরব দৃষ্টিতে সম্মতি জানায় সে। ছেলে পাখিটা মেয়ে পাখিটাকে বলে,‘এই ঝামেলাটাকে সাথে করে নিয়ে কি লাভ? বয়সও শেষ। এখানেই রেখে যাই। এমনিও মরবে ওমনিও মরবে।’
মেয়ে পাখিটা মায়ের দিকে তাকায়।‘ঠিকআছে মা, তুমি থাকে তাহলে। তুমি তো বোবা। ঠিকমতো কথা বলতে পারোনা। এখানেই থাকো। মাঝেমধ্যে এসে দেখে যাবো।’
রুগ্ন অসুস্থ মাকে পেছনে ফেলে উড়ে চলে গেলো পাখি দুটো।

...............অনেক ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়েছি। মা দিবসে মা বাবা দু’জনকেই এই গল্পটা উৎসর্গ করছি।

প্রকৃতির শোধ...............আরিফা সানজিদা

প্রকৃতির শোধ...............আরিফা সানজিদা

 

তারপর অনেকগুলো আঁকিবুঁকি,  কাছে নিয়ে মিলানোর চেষ্টা করল সুহৃদ, বুঝতে পারলো ভালবাসি লেখা। পরের পৃষ্ঠায় ও ঠিক এমন ভাবে আঁকিবুঁকি। একের পর এক পৃষ্টা উল্টাতে লাগল আর লেখাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো, সুহৃদের মনে হল অক্ষর গুলোর উপর জলের ফোটা ফোটা,পরক্ষণে টের পেল ওর চোখ থেকে টুপটুপ জলের ফোটা গড়াচ্ছেও কান্না মুছলো না, ডাইরির মাঝে বিষাদগ্রস্ত হয়ে ডুবে যেত লাগল জলের ফোয়ারা  মেখে, অনুপমার অনুভূতির শব্দঁগাথায়

কাল সকাল কুরিয়ার সার্ভিস অফিস থেকে ফোন এলো, ঘুমে চোখ মেলে তাকাতে পারছে সুহৃদ! অনেকটা বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরলোওপাশ থেকে শুনতে পেল আপনার একটা পার্সেল এসেছে, একটু কষ্ট করে নিয়ে যাবেনসুহৃদ ভাবতে লাগলো কে পাঠালো পার্সেল আবার, পরিচিত কেউ পাঠালে তো ফোন দিয়ে বলতঅনেকটা অবাক হলো আবার খুব আগ্রহ হলো বিষয়টা জানার জন্যে

বিকেলের রোদ পড়ে এলো, সুহৃদ হাঁটছে কুরিয়ার অফিসের দিকে, ছোট্ট একটা পার্সেল, হাতে নিতেই মনে হল একটা বইবিরক্তিভাব নিয়ে মনে মনে বলল একটা বইয়ের জন্যে এতদূর হেটে আসাটাই বৃথা গেল তাও কে পাঠিয়েছে তার ইয়ত্তা নাই

অনুপমার বান্ধবী নিলা, সেদিন বিয়ের অনুষ্ঠানের পর ওর রুমে গিয়ে ডাইরি টা পেয়েছিল, অনুপমা শ্বশুর বাড়ি থেকেই নরওয়ে চলে যাবে, ডাইরিটা যাকে নিয়ে লিখেছিল অনুপমা সেই মানুষটিকে নিলা খুব ভালভাবেই চিনে,সুহৃদের ঠিকানায় নিলা ই ডাইরিটা পাঠিয়েছে

র‍্যাপিং পেপারটা এক হিঁচকে টানে ছিড়ে ফেলল অনুপম, না এটা বই ছিল না একটি ডাইরিপৃষ্ঠা ওল্টাতেই বড় বড় অক্ষরে দেখতে পেল লেখা 'Beloved Diary 'তারপর ছোট অক্ষরে এলোমেলো ভাবে লেখা

''  নিয়ন আলোয় ডাইরির ভাজে তোমায় চিঠি লিখছি ডাকবাক্স বিহীন মনের ঠিকানায়, সবটুকু অনুভূতি দিয়ে লেখা শব্দ ছুঁয়ে দেখো বাতাসে, বেনামী খড়কুটো ভেবে ছিঁড়ে দিও তখনআমার কাকতাড়ুয়ার অপেক্ষার দিনে এই চিঠি, আমি আর তোমাকে ঘিরে থাকা অনুভূতিগুলো পাহারা দিয়ে আগলে রাখে বুকের ভেতর শূন্যতাদের!

লেখাগুলো কেমন যেন বিঁধে যাচ্ছিল ওর বুকের মাঝখানটায়, অথচ সুহৃদ জানে ও বেশ শক্তপোক্ত মানুষও দ্রুততার সাথে পৃষ্ঠা গুলো উল্টাচ্ছিল কিন্তু লেখাগুলো গভীর রেখাপাতে মুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিলঅনুপমার সাথে যোগাযোগ নাই তাও বেশ কয়েকবছর হলো, ঠিক মনেও নাই ওর কথা, তবে মাঝেমাঝে মনে পড়ত অনুর সাথে এমন টা না করলেও তো হত! এইটুকুই, এর বেশি আর কিছু করেনি সুহৃদ!

দ্বিতীয় পৃষ্ঠা উল্টালো, শুধু একটা তারিখ লেখা আর লেখা-

'কেমন আছো প্রিয়?'

তারপর অনেকগুলো আঁকিবুঁকিকাছে নিয়ে মিলানোর চেষ্টা করল সুহৃদ, বুঝতে পারলো ভালবাসি লেখাপরের পৃষ্ঠায় ও ঠিক এমন ভাবে আঁকিবুঁকিএকের পর এক পৃষ্টা উল্টাতে লাগল আর লেখাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো, সুহৃদের মনে হল অক্ষর গুলোর উপর জলের ফোটা ফোটা,পরক্ষণে টের পেল ওর চোখ থেকে টুপটুপ জলের ফোটা গড়াচ্ছেও কান্না মুছলো না, ডাইরির মাঝে বিষাদগ্রস্ত হয়ে ডুবে যেত লাগল জলের ফোয়ারা  মেখে, অনুপমার অনুভূতির শব্দঁগাথায়

অভিযোগ, অভিমান, ঘৃণাভালবাসা সব ধরনের অনুভূতিই লেখা ছিল, ওর উদ্দেশ্যই বলা একেকটি শব্দ শেলসমের মত বিঁধতে লাগল:

"প্রিয়!

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে,বৃষ্টির ছন্দে নিঃশ্বাসের উঠানামায় তোমার নামের আওয়াজ ধ্বনিত হচ্ছে মনের গভীরে! তোমাকে সারাদিন মনে নিয়ে হাটি, কাজে মন নাই, ঘুমিয়ে শান্তি নাই, সবখানে তুমি! আমি জানিনা কেন এত এত এত ভালবাসি তোমাকে! যখনি তোমার দুয়ারে ভালবাসা কাঙাল রুপে হাজির হই; অবহেলার সুনামি বইয়ে তাড়িয়ে দাও কোথাও যাব বল? যাওয়ার জায়গা নাই, আমি ভেঙ্গে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাই, টুকরো অংশ কুড়িয়ে আবার যাই, আবার ভেঙ্গে দেও ভেঙ্গে ভেঙ্গে  আমি গুড়ো হয়ে গেছি সেই কবে, তোমার দুয়ারে পরে থাকি, তুমি ফিরিয়ে দেও আমি আর তোমার দুয়ারে যাব না, যখনি বলি মনের কথা খুব করে শাসিয়ে দেও, আমার অভিমান অভিযোগ সব যেন আমারই, তুমি হয়ত কাউকে ভালবাস, আমি বুঝতে পারি  আমি তাই চলে যাব অনেক দূরে, দূরে থেকেও ভালবাসা যায়! কই তুমি দেখতে পাচ্ছ? পাবেনা, আমি অনুভব করছি আমি কত ভালবাসি!এটাই আমার প্রাপ্তি, আমি লিখছি তোমাকে নিয়ে, এখানে কথা ফুরায় না আমার, আর তুমি ধমক দিয়েও ছুড়ে ফেলোনা আমায়, আমার নিত্যদিনের ডাইরি তুমি! ভালবাসার রংতুলি, যেমন খুশি রাঙ্গাবো, কেউ জানবে না, কেউ দেখবেনা, শুধু মনের ভিতরের তুমি আর তোমার ভালবাসার পাগলি আমি ছাড়া!

কি করছ এখন তুমি? টেলিপ্যাথি দিয়ে খুঁজে দেখতে পাচ্ছি, তুমি বসে আছ আনমনে, কি যেন ভাবছ! কি ভাবছ? আমার কথা কখনো মনে পড়ে? আমাকে কখনো অনুভব কর তুমি? জানিনা কিচ্ছু জানিনা, আমি শুধু তোমাতেই মগ্ন থাকি, তুমি ভালবাস কিনা উত্তর খুঁজিনি, তবে বুঝেছি তুমি আমাকে কখনওই চাওনি, খুজনিআমার ব্যথায় নিলাভ হওনি আমি কেবল ভেঙ্গে চুড়ে আমাকেই বর্ণনা করেছি আমি এখন আড়ালে চলে এলাম, এবার একটু খুঁজবে কি? আমি ভাল আছি, আমার মন খারাপ নিয়ে ভাল থাকি, আমি একদিন চলে যাব ধরা ছোঁয়ার বাইরে, এত নিকটে ছিলাম বুঝোনি, তাই হারিয়ে গেলাম অন্য মঞ্জিলে!  কথা বলতে ইচ্ছে করছে, থাক আজ! পাগলের প্রলাপ কে শুনবে আর।।। সাবধানে থেকো, নিজের যত্ন নিও!    (  ২৭/১০/২০১৬)

 শুভসকাল! তোমাকে ভেবে একটা বেলিফুলের মালা গেঁথেছিলাম, এসব বড্ড ছেলেমানুষিসবাই বলে এই যুগে সত্যি ভালবাসতে নেইনিলা বলে এখনো কেন পড়ে আছি? উত্তরটা দিতে পারিনি ও বলে ভুল মানুষ কে ভালবেসেছি, কথাটা যাচাই করার অনুধাবন শক্তি নাই আমারভালবাসা আমার কাছে অন্যরকম  আমি এখনো বড্ড ছেলেমানুষিকি করবো বলো? সত্যিই ভালবাসি আগের থেকেও বেশি  ভালবাসা ঢাক ঢোল পিটানোর জিনিস না, আগে শুধু জানতাম সবাই জানুক এখন বুঝি গোপনেও ভালবাসা যায় এই অভিযোগ গুলি কাকে শুনাই আমি? তোমার নামে অনেক অভিযোগ আছে, যখন বলতাম অপমান করেছো, আঘাত দিয়েছো কথা দিয়ে এখন বলবো না কিছুই সব অভিমান অভিযোগ নিয়ে সরে আসতেছি,  ঘুম ভাঙলে কবিতা শুনাতাম, কবিতা তুমি বুঝোনা এসব ছেলেমানুষি  কিছু জিজ্ঞাসা করোনা উত্তর জানা নাই তোমাকে দেখার জন্যে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে!

                                       ৩০/১০/২০১৬

  তোমাকে খুব মনে পড়তেছে, কথা বললে ভাল লাগত কিন্তু কত আর বেহায়ার মত এমন করবতুমিও বিরক্ত হও পিছনের কথাগুলো মনে করে দীর্ঘশ্বাস নেই সব মনে আছে, এখন লিখতে ইচ্ছে করছেনা  ভাল লাগছেনা যত্ন নিয়ো!

                               ৩/১১/১৬

তারিখগুলো মিলিয়ে দেখল সুহৃদ ঠিক তিনবছর আগের লেখা, ভীষণ রকম অবহেলা তোলা ছিল অনুর জন্যেযা কিছু বলত, কেবল বলা ই ছিল! একেক করে মনে পড়ে যাচ্ছেমেয়েটার পাগলামি গুলো ভীষণ পীড়া দিয়েছিল তখন, সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিয়েছিল সুহৃদ ইকিন্তু তখনো তো অনেক কিছু বলত; কেবল হুম হ্যা বলেই এড়িয়ে যেত!

                      

"তোমাকে খুব মনে পড়ছে, মন খুলে কতদিন কথা বলিনা কি এক গোপন ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছি, এর নাম জানা নেই! এর শেষ কোথায় জানা নেই আমি হেরেছি নিজের কাছে, নিজের ব্যক্তিত্ব এর কাছে, কিন্তু ভালবাসার কাছে আমি বড্ড দূর্বল এই ব্যথা ঠিক কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে জানা নেই তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে খুব আমার কোন কান্নাই যে তোমাকে স্পর্শ করতে পারেনি এই নিঃশব্দ কান্না কিভাবে স্পর্শ করত? আমি ভুলতে পারিনা , আমি ছাড়তে পারিনা তাই নিঃশব্দে ভালবেসে যাই এই ভালবাসার কে কি নাম দিবে জানিনা আমি একা, এই রাতের ঝিঝিপোকার শব্দের মত একা, এই শব্দ কেউ শুনেনা আমার দীর্ঘশ্বাস জানে এই ব্যথার অনল, পুড়ে কেমন দগ্ধ হয়ে আছে মন কেন করছি আমি? কিসের জন্যে জানা নাই  এই মায়া থেকে মুক্তি চাই, এই কষ্ট থেকে মুক্তি চাই আমি বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই!

                            ২৩/১১/১৬

 "তুমি আমাকে মিস না করলেও আমি তোমাকে খুব মিস করব করছি, আমার প্রতিটা কথা, প্রতিদিন খোঁজ নেয়া  তোমার কাছে নিছক কথা হলেও আমার ছিল একেকটা অনুভূতি কত বাহানায় রোজ পেতে চাওয়া! কি করে ভুলে থাকব আমি? তুমি ভুলে যাবে, ভুলেই গেছ!অনেক টা দিন কেটে যাবে, অনেক সময়! তোমাকে ভালবেসে তোমাকে মনে রেখে আমিই কষ্ট পাচ্ছি! থাক না জীবন জুড়ে এই ব্যথা, এই না বলা কথা! কেউ জানল না, কেউ শুনল না তুমি তো ভাল আছ, ভাল থাকছো, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছ এতেই আমি সুখি কাছ থেকে দেখে দূর থেকেও ভালবাসা যায় আমি কেউ ছিলাম না তোমার, কখনোই ছিলাম না এর থেকে পরম তিক্ত সত্য আর কি আছে জগতে? তুমি বিহীন কি জঘন্য জীবন আমার যদি জানতে!! থাক নাই বা জানলে

                               ৩/১২/১৬

 " জানোসেই ময়নাপাখিটা কথা বলতে শিখেছে, প্রথম ডাক টা সুহৃদ!

                           ৫/১২/১৬

 'তোমাকে খুব মিস করছি, অনেক এবং অনেক তুমি আমার হওনি কেন? হলে কি হত! কিছু হত তাই হওনি হয়ত তোমাকে সব বলা হয়ে গেছে, হয়ে গেলে কি বলতাম? তুমি কি বলতে? তোমার কিছু বলার ছিল? ছিল না তো যতটা কষ্ট উপেক্ষা পেয়েছি নতুন করে পাওয়ার, নতুন করে বইবার সামর্থ্য আমার নাই কথারা থেমে গেছে, সব কথা তো আমারই ছিল তোমাকে আমি পড়তে পারিনি এটা আমার ব্যর্থতাএকজীবনে কেউ কি কাউকে পুরোটা পড়তে পারে? কিংবা কিছুটা? তোমার আমি কিছুই বুঝলাম না আমার মনে হয় আমি খুব স্বার্থপর গোছের মানুষ, শুধু নিজের অনুভূতির কথাই ভেবে গিয়েছি তোমার কথা শুনিনি, বুঝতে চাইনি যে তোমার ও ভালোলাগা আছে সবসময় ভেবেছি তুমি আমার আমাকেই ভাববে কি হয়েছে এত অধিকার দেখিয়ে? কি হয়েছে এত ভালবেসে? পেরেছি কি ধরে রাখতে? শেষমেশ কতটা দূরত্ব  এমন টা আমি চাইনি জীবনটা টা খুব ছোট এমন গভীর কিছু বয়ে বেড়ানোর সাহস শক্তি সবারই হয়ে যায় মাঝেমাঝে মনে হয় আমি খুব দূর্ভাগ্য নিয়ে এসেছি আমার চারপাশ টা ঝটলা লাগে, কেউ আমাকে সত্যি সত্যি উদ্ধার করত আহ কি ভালো থাকা! আহ কি কষ্ট! তোমাকে ছুঁয়ে না দেখার! তবে আমি ছুঁইতোমাকে অনবরত ছুঁয়ে যাই এটাই আমার প্রাপ্তি,এটাই পাওয়া!

                         ১৮/১২/১৬

 "প্রতিদিন এই সময়টায় তোমাকে প্রচণ্ডরকম মিস করি, কেমন শূন্যতা আমাকে আঁকড়ে ধরে; জগতের কোন কিছুই যেন দূর করতে পারেনা এই যন্ত্রণা  বিছানায় ছটফট করতে থাকি কুঁকড়ে যাই ডানাকাটা পাখির মত অনেক কষ্ট হয় বুকের মাঝখানটায় অনেক সময় লেগে যায় এই শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে তুমি একটু ধরা দিবে আমার কাছে? তোমাকে পরখ করে দেখতাম কি আছে তোমার মাঝে? যার রেষ আমাকে বেপরোয়া করে তুলে এভাবে তুমি কি শুনতে পাচ্ছ এ আহবানকি নিদারুণভাবে তোমাকে চাইছি, কি গভীর ভাবেতুমি কি একবার আসবে?  তুমি বধির তুমি এই ডাক শুনোনা, তুমি বোবা আমার এত এত আকুতির প্রত্যিুত্তর দিবেনা

                          ২০/১২/১৬

 

দু' একলাইন কবিতার লাইন, দৈনন্দিন কথা এসব লেখা ছিল অনেক পাতায়সুহৃদ একটা বিষয় খেয়াল করল লেখার কোথাও ঘৃণা নাই, কেবল অভিমান আর অভিযোগ আর শূন্যতার ছড়াছড়িএভাবেই কি মানুষের অনুভূতি গুলো হয় অপরজন ছেড়ে গেলে? এই মানুষটি কে সুহৃদ কষ্টের সিঁড়িতে তুলে দিল? খুব অপরাধী লাগছে

 

 সুহৃদ ভাবতে লাগল এই অপরাধী লাগা এই অনুশোচনা শব্দে পরিণত করলে কেমন হত? অনুর অভিমান রা খিলখিলিয়ে হাসতো? অনুর অভিমান ভালবাসার কাছে এই অনুশোচনা চোখ মেলে তাকাবার সাহস পাবেনাঅনু কি এখনো এভাবে লিখে? কিভাবে লিখবে ডাইরীটা তো এখন সুহৃদের কাছে, বাকী পাতা গুলো যদি লিখত কেমন হত ওর শব্দগুলো? সুহৃদের এই মুহুর্তে সে অনুভূতিগুলো খুব ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে, বলতে ইচ্ছে করছে আমি যাইনি কোথাও

অনু বাকি পৃষ্ঠাগুলো কেন লিখলোনা? সুহৃদের মনে হল এই পৃষ্ঠাগুলো অনুশোচনায় ভরিয়ে দেয়ার জন্যেই অনু লিখেনিঅনু কি এখনো এমন করে চায়? মানুষ একসময় অনুশোচনা করে পিছনের আকুতির জন্যে, সেই অনুশোচনা গুলো যদি হয় নিজেকে অপরাধী ভাবা তবে সেটার থেকে পরম তিক্ত কষ্ট আর নেইএই অনুশোচনা সুহৃদের পাওনা ছিল!

 অনু জিতে গেছে, সুহৃদ স্পষ্ট দেখতে পেল ওর অভিমানরা হাসছেসুহৃদ পৃষ্ঠা গুলো উল্টাতে লাগল! এ কেমন শাস্তি! নিজের স্বার্থের জন্যে সেই অনুকে কষ্ট দিল! ডাইরীটা স্পর্শ করতে ওর ভয় করছে এখন, এই বুঝি শেষ পাতায় লেখা ভেসে উঠবে আমি তোমাকে ক্ষমা করিনি! অনু যদি ক্ষমা করে দেয় তবে প্রকৃতি? প্রকৃতি তো কাউকে ছাড় দেয়না! প্রকৃতি এই শোধ তুলে দিল? নিজের ভিতর নিজে পিষ্ট হওয়া? প্রকৃতির শোধ বড়ই সুষ্ঠ.......