আম্মার বিয়ের শাড়ি...........রাকিব শামছ শুভ্র

বুবুর উচ্ছ্বসিত হাসি দেখে খুশী হলেও কেমন একটা কষ্টও অনুভব করছি। আম্মা বুবুর জন্য জামা সেলাই করছে। আর আমি, আঁখি আর পাখি হা করে তাকিয়ে আছি। একটা না দুইটা না একসাথে তিন তিনটা জামা বানিয়ে দিচ্ছে।

মরা চারবোন, ভাই নেই আমাদের। ভাইয়ের আশায় চার সন্তানের মা-বাবা হয়েছেন কিন্তু ছেলে হয়নি। বুবু রাখি, আমি সাখি, আমার পরে আঁখি আর পাখি। আমরা মফস্বলে বসবাস করি। বাবা সরকারি চাকুরি করেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা তবে তার সততার জন্য খুবই সম্মানিত ব্যাক্তি। আমার মা আমাদের দেখাশোনা করে, সংসার এর সকল কাজ সামলায়। আমরা চার বোন, বাবা-মা, আমার দাদু এই নিয়ে আমাদের সংসার। বাবার একার আয়ে সবার পড়ালেখাসহ অন্যান্য খরচ জোগানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাদু কৃষিকাজ করতেন। বাবা নিজে লজিং থেকে বিএ পাশ করে চাকুরিতে ঢুকেছেন। আম্মা নাইন পর্যন্ত পড়েছে। এরপর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর পড়া হয়ে উঠেনি। আম্মাদের বড় গৃহস্থ পরিবার। শয়ে শয়ে বিঘা জমি, ধান, পাটের কারবারি। নানার অনেক পয়সা ছিলো কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব বড় মনের ছিলেন না। দুইটা বিয়ে করেছেন, একগাদা ছেলেমেয়ের বাপ হয়েছেন। আম্মার প্রেম মেনে নেননি, আর আম্মাও ছিলেন প্রচন্ড জেদি। বাবার হাত ধরে পালিয়ে চলে আসেন। বাবাই ছিলেন আম্মাদের বাসায় লজিং মাস্টার। বাবা পালিয়ে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না কিন্তু মায়ের জেদের কাছে নতি স্বীকার করে নিলেন। নানা এই বিয়ে মেনে নেননি, আম্মাও কখনো আর ওই বাড়িতে যাননি। আমাদের পরিবারে এসে বাবার পাশে যোগ্য স্ত্রী হিসেবে পাশে ছিলেন এবং আছেন। বাবার স্বল্প আয়ে সংসার সামলে যাচ্ছেন। কোন রকম বিলাসিতা আমাদের সংসারে একেবারে অপরিচিত শব্দ। 

মা নানার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার সময় তার শখের সেলাই মেশিনটা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। সিঙ্গার মেশিনটার বয়স প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেছে। আম্মার যত্ন এবং ভালোবাসায় এখনো একেবারে নতুন মেশিনের মতোই ছুটে। আম্মার এই শখের জিনিসটাই কখন যে সময়ের আবর্তে আমাদের সবার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে! খরচ বাঁচাতে আম্মার এই মেশিন এখন পরিবারের বড় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। মেশিনের ঘরঘর শব্দ শুনলেই আমরা বুঝি আম্মা নতুন কিছু সেলাই করছেন! আমরাও প্রতি রোজার ঈদে একসেট করে মোটামুটি ভালো জামা পাই। আর বাসায় পরার জন্য সবার মিলিয়ে ঝিলিয়ে কয়েকসেট কাপড় আছে। আমাদের চার বোনের সব জামাকাপড় আম্মার সেলাই করা। আমরা কখনো দোকানে গিয়ে জামা কিনিনি। আম্মার বানানো জামাগুলো অবশ্য দোকানের জামার চেয়ে ঢের সুন্দর। 

আজ বুবুর জন্য আম্মা তিনটা কাপড় এনেছেন। এখন বসে বসে সেলাই করছেন আর আমরা বুভুক্ষুর মতো আম্মার চারপাশে ঘিরে আছি। বুবুর ভাগ্যকে হিংসা হচ্ছে খুব। বুবু এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পাশ করেছে। এতোদিন বুবুরও আমাদের মতো একটা ভালো জামা ছিলো আর আজ থেকে চারটা বেড়ানোর জামা! আম্মার উপর খুব জিদ হচ্ছে। 

বুবু পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। মেডিক্যাল কলেজে টিকেছে। আগামী সপ্তাহে শহরে যাবে বাবার সাথে। এতোদিন কলেজ ড্রেস পরেই কাজ সারতো কিন্তু এখন না-কি মেডিক্যাল কলেজে ইউনিফর্ম নাই। বুবুর তো ভালো জামা মাত্র একটা! তাই আম্মা কাল কাপড় কিনে এনেছেন। বাসার সবাই খুব খুশি বুবুর রেজাল্টে। কিন্তু আমার খুশি লাগছে না। বুবু নতুন তিনটা জামা পাচ্ছে তার মানে এবার হয়তো ঈদে আমাদের আর নতুন জামা পাওয়া হবে না! বুবু বাড়ি ছেড়ে যাবে এতে যতটা না মন খারাপ হচ্ছে তারচেয়ে বেশী মন খারাপ নতুন জামার শোকে।

দুপুরে মন খারাপ নিয়ে খেতে বসেছি। পাতে মাছের টুকরার সাইজ ছোট দেখে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। আমাকেই শুধু সব মেনে নিতে হবে? আমি মুখ ফুলিয়ে বসে আছি। আম্মা খেয়াল করলেন আর বকা দিলেন। তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ। আমি ভাত নাড়াচাড়া করছি কিন্তু খাচ্ছি না। আম্মা কিছুই বললেন না। না খেয়ে উঠে পরলাম। চারটার দিকে আম্মা আমাকে ডাকলেন, রনির মা (আমাদের বাসায় আম্মাকে কাজে সাহায্য করে) এর সাথে তার বাসায় যেতে। রনির মা আমাকে নিয়ে তার ঘরে গেলো। পাশেই এক বস্তিতে থাকে ওরা। রনিরা তিন ভাই। বড়টার বয়স আট বছর, মেঝটা ছয় আর ছোটটা তিন বছর। একটা ছোট্ট ঘরে ওরা থাকে। ঘরটা অন্ধকার ঘুপচি মতোন। ভেড়ানো দরজা টেনে খুলতেই তিনভাই এক সাথে চেচিয়ে উঠলো, মা এসেছে, মা এসেছে। 

দরজার বাহিরে বসলো তিনজন। রনির মা কোচরে শাড়ী দিয়ে ঢেকে রাখা থালাটা বের করলো। আমার না খাওয়া মাছের টুকরা, সাথে ঝোল দুই টুকরা আলু আর এক থালা ভাত। তিনজনই প্লেটের উপর ঝাপিয়ে পরলো। ওই এক টুকরা ছোট মাছটা দিয়ে খাচ্ছে আর বলছে, মা অনেকদিন পর এত্ত বড় মাছ আনলা! আমি অবাক হয়ে দেখলাম রনির মা দু নালা ভাত মুখে দিয়ে আর দিলোনা। তার চোখের কোনে পানি অথচ মুখে কি সুন্দর হাসি! রনি মাছের কাটা বেছে নিজে না খেয়ে ছোট দুই ভাইয়ের মুখে তুলে দিচ্ছে। গপগপ করে খাচ্ছে আর খুনসুটিতে মাতছে।

আমি চুপ করে ওদের খাওয়া শেষ করা দেখলাম। বাসায় এসে দৌড়ে গেলাম আম্মার কাছে। গিয়ে আম্মার বুকে মুখ গুজে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। আম্মা কিছুই বলছেন না। শুধু আমার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি আম্মার বুক থেকে মুখ তুলে গলা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, আম্মা আমি আর কোনদিন খাওয়া নিয়ে নকতা করবো না। ওদের প্রতিদিন তুমি একটুকরা মাছ দিও। 
আম্মা হেসে বললেন, তোদেরই প্রতিদিন দিতে পারিনা। চেষ্টা করবো যেদিন বেশী থাকবে, সেদিন দিতে। 
আমার টুকরার অর্ধেক ওদের দিয়ে দিও। 
আম্মা আমার চুলের বেনি ধরে হালকা টান দিয়ে বললেন, থাক থাক আর পন্ডিতি করতে হবে না। ভালো করে পড়াশোনা করে বুবুর মতো ডাক্তারি পড়তে চেষ্টা কর। নিজে যখন আয় করবি এমন দশজনকে খাওয়াতে পারবি। 
আমি মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিলাম, আমিও বেশী করে পড়ে বুবুর মতোই হবো।

রাতে ঘুমানোর আগে বুবু সব নতুন জামা নিয়ে ঘুমুতে এলো। এটা আমাদের চার বোনেরই অভ্যাস। নতুন জামা পেলে না পরা পর্যন্ত সেটা কাছ ছাড়া করিনা। বুবুর জামা গুলো ধরে দেখছিলাম। নতুন জামায় কি সুন্দর গন্ধ থাকে! শুকে দেখছিলাম। 
তোর খুব পরতে ইচ্ছে করছে তাইনারে সাখি? ইচ্ছে হলে পরতে পারিস।
আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো কিন্তু বুবুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি যখন তোর মতো ভালো রেজাল্ট করবো তখন তোর জামা চেয়ে নিয়ে পরবো।
বুবু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, আমাদের সব্বাইকে পারতেই হবে। আম্মা-বাবার কষ্টকে স্বার্থক করতেই হবে। আমরা চারজন ওনাদের সব না পাওয়া পূরণ করে দেবো। আমিও হ্যাঁ হু করতে করতে বুবুর হাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। 

সকালে উঠে স্কুলে ছুটলাম। দুপুরে বাসায় এসে তাড়াহুড়া করে খেয়ে উঠতেই আমাদের চার বোনকে ঘরে ডাকলেন। চার বোন ঘরে যেতেই আম্মা প্রথমে পাখিকে খুব সুন্দর একটা জামা দিলো। এরপর আঁখি তারপর আমি, শেষে বুবু। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি৷ আম্মা বললেন, আমার বিয়ের শাড়িটা কেটে তোমাদের জন্য ড্রেস বানিয়েছি। আমারতো আর এই শাড়ি পড়াই হয়না। তাই ভাবলাম আমার রাজকন্যাদের একটা করে জামা বানিয়ে দেই। চারটা জামাতো এক শাড়ীতে হয় না তাই সবার জামার সামনে আমার শাড়ী আর পেছনে অন্য কাপড় জোড়া দিয়েছি।তোমরা চারজন এই ড্রেস পরে যখন একসাথে দাঁড়াবে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে। 
আমরা চারবোন মাকে জড়িয়ে ধরে বোকার মতো কেঁদেই যাচ্ছি। আর আমাদের আম্মাটা সেই চিরচেনা হাসিটা হাসছেন।


শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
October 20, 2020 at 12:43 AM

সেরা লেখা লিখছেন ভাই। আপনার সব লেখা আকর্ষনীয় রকম সুন্দর।

Reply
avatar
Anonymous
October 20, 2020 at 6:42 PM

Valo onek valo hoyeche. Rudra

Reply
avatar
সাইফুল ইসলাম ফেনী
October 22, 2020 at 11:28 AM

বেশ সুন্দর লেখা লিখছেন আপনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

Reply
avatar
মনিরা মেমি, পু্র্ব বাসাবো,ঢাকা
October 25, 2020 at 11:11 PM

বেশ ভাল

Reply
avatar
October 30, 2020 at 8:13 AM

কৃতজ্ঞতা জানবেন। আপনাদের পাশে পাওয়াটা আমার জন্য অনেক কিছু। ভালো থাকবেন সবসময়

Reply
avatar
October 30, 2020 at 8:15 AM

অফুরান ভালোবাসা এবং শুভকামনা রইলো

Reply
avatar
October 30, 2020 at 8:16 AM

কৃতজ্ঞতা জানবেন। ভালো থাকবেন সাথেই থাকবেন।

Reply
avatar
October 30, 2020 at 8:16 AM

অফুরান ধন্যবাদ। শুভকামনা রইলো

Reply
avatar