'যেদিন মরবো আমি, সেদিন কি বার হবে বলা মুশকিল।
শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?
যে বারই হোক,
সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর,
যেন ঘিনঘিনে কাদা না জমে গলির মোড়ে।
সেদিন ভাসলে পথঘাট,
পূন্যবান শবানুগামীরা বড়ো বিরক্ত হবেন।'
এই পর্যন্ত পড়ে বইটি বন্ধ করে রাখলেন তিনি। কি অসাধারণ অভিব্যক্তি কবির! কত চিন্তা শবানুগামীদের জন্য। সত্যিই তো আমার মৃত্যুর দিনই বা কি বার হবে? কাঠফাটা রোদে তপ্ত হবে এই শহর নাকি শীতের হাওয়ায় ঝড়া পাতার মড়মড়ে আওয়াজে ঢেকে যাবে আমাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া শবানুগামীদের চাপা কান্না....কে আর কাঁদতে আসবে? বছর তিনেক হলো বারী সাহেব মারা যাবার পর নিজের ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়ে অনেকটা নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে আর নিরাপত্তার কথা ভেবে এই বৃদ্ধাশ্রমে এসে উঠেছেন সত্তর বছরের শায়লা বারী। স্কুল টিচার ছিলেন। অসংখ্য ছাত্র এই হাতে পার করেছেন। এদের মধ্যেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত কিছু ছাত্রছাত্রী সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে তার মতো বৃদ্ধ মাতাপিতাদের জন্য ঢাকার পূর্বাচলে এই বৃদ্ধাশ্রমটি তৈরী করেছে। এর উদ্দোক্তরা অবশ্য একে বৃদ্ধাশ্রম বলতে নারাজ। সার্ভিস এপার্টমেন্টের আদলে তৈরি এর নাম 'আনন্দ আশ্রম'। আসলেই তাই....সারাদিন যেন হাসি আনন্দে কেটে যায় এই আনন্দ আশ্রমের মানুষগুলোর। এখানে থাকতে হলে দুটো শর্ত অবশ্য পূরণ করতে হয়। এক; বয়স হতে হবে ৬৫র উপরে কারণ ৬৫বছর পর্যন্ত এখন মধ্যবয়স্ক তরুণ হিসেবে গণনা করা হয়। দুই; নিঃসন্তান বা অবিবাহিত পুরুষ বা মহিলা অথবা এমন বাবা মা যাদের সন্তানরা সবাই বিদেশে অবস্থানরত।
এই যেমন একটি মাত্র পুত্র সন্তান শায়লা আর বারী সাহেবের। ছেলে আমেরিকায় চাকরি ও পরিবার নিয়ে সেটেল। বহুবার মাকে কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছে সে কিন্তু শায়লাই রাজি হননি। এমনি বছরে দুবছরে ছেলের কাছে ঘুরতে যাওয়া হয় কিন্তু এদেশের মাটি ছেড়ে একবারে সেখান যে থাকতে শান্তি পান না তিনি। পাঁচ বিঘা জমির উপর তৈরী এই আনন্দ আশ্রম। বারো তলা বিল্ডিং স্টুডিও এপার্টমেন্ট। ইচ্ছে করলে একা থাকা যায় সেক্ষেত্রে পেমেন্ট একটু বেশি আবার কেউ চাইলে শেয়ারও করতে পারে। কমপ্লেক্সের মধ্যে আছে জিম, সুইমিং পুল, লাইব্রেরি, মসজিদ, গেস্ট হাউস এবং ইমারজেন্সি মেডিকেল সার্ভিস দেয়ার জন্য একটা ছোট ক্লিনিক। আরো আছে একটি বড়মাঠ যেখানে প্রাতঃভ্রমণ ও সান্ধ্যভ্রমণের পাশাপাশি চলে নির্মল আড্ডা, গল্প ও খুনসুটি। বিল্ডিং এর ছাদে যে ছাদকৃষি আর সামনে পেছনের খালি জায়গায় যে আঙিনা কৃষি রয়েছে তাতে অনেকেই সকাল বিকাল মালির সাথে হাত লাগান। তাদের পরিচর্যার কারণে আনন্দ আশ্রমে সবজি অনেক সময় বাজার থেকে কিনতেই হয়না।
খাবারের ব্যাপারে খুবই কঠিন আনন্দ আশ্রমের ডাইটেসিয়ান। বয়সে তরুণী মেয়েটি একটা বড় হাসপাতালের পুষ্টিবিদ আবার পার্ট টাইম এই বুড়ো বুড়িদের দেখভাল না করলে নাকি তার ভালো লাগেনা। তার নির্দেশে মাসে দুবার রেডমিট আর বাকি দিন মেডিটেরেনিয়ান ডায়েটের আদলে তৈরি বাংলাদেশী ডায়েট। রুচি পরিবর্তনের জন্য মাসে একবার থাই,জাপানিজ,কোরিয়ান বা কন্টিনেন্টাল কুজিন। তারপরও তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনিয়ম যে চলে না তা নয়! যখন যার ইচ্ছা দেদারসে চলছে অনলাইন খাবারের অর্ডার আর ডেলিভারি। ১২তলার এই স্টুডিও এপার্টমেন্টে রয়েছে দুটি ডাইনিং হল। সাধারণত তিনবেলার খাওয়া দাওয়া সবাই একসাথে ডাইনিং হলে করে থাকে। তবে চাইলে রুমেও ডেলিভারি নিতে পারে। শ'খানেক বোর্ডার কে দেখা শোনা করার জন্য এখানে রয়েছে দশজন উদ্যম ও চৌকষ তরুণ তরুণীর একটি দল। যারা লনড্রী থেকে শুরু করে সব কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা এমনকি সবাই ঔষধ ঠিকমতো খেলো কিনা সবকিছুর খবর রাখে। মাঝে মাঝে খাওয়া দাওয়ার পরে শুরু হয় জম্পেশ আড্ডা। এই যেমন আজকের বিষয় পূর্বাচল সিনেপ্লেক্সে ২০২০ এর করোনা মহামারী নিয়ে আবীর ফয়সালের 'করোনা ২০২০' নামের যে মুভিটা রিলিজ হয়েছে সেইটা নিয়ে। অসাধারণ নাকি স্টোরিলাইন আপ, সিনেমাটোগ্রাফী আর ডিরেক্শন। অনেকেই দেখতে যেতে ইচ্ছুক। কিন্তু শায়লা কে ফিসফিস করে নাবিলা বললো... এই ফিল্ম দেখার মতো মানসিক শক্তি আমার আর এখন নেই। কি দুঃসহ দিনগুলি গেছে! সারা পৃথিবী জুড়ে ছিল মৃত্যুর মিছিল। এক ঝটকায় ধনী ও ক্ষমতাবানদের নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল গরীব আর ক্ষমতাহীনের কাতারে। তোমার হাতে টাকা আছে কিন্তু আইসিইউ র বেড খালি নাই। তোমার প্রাইভেট জেট প্লেন আছে বিদেশে গিয়ে চিকিত্সা নেয়ার ক্ষমতা আছে অথচ এয়ারপোর্ট বন্ধ। ২০২০ এর করোনায় বাবা মা দুজনকেই হারিয়েছিলেন নাবিলা।
আজ মর্নিং ওয়াকে রাইয়ান সাহেবকে খুব খুশি মনে হচ্ছে। তিন বছর পর কানাডা থেকে ওনার মেয়ে জুহি বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে। উঠেছে আনন্দ আশ্রমের গেস্টহাউসে। সকালে অনেকের সাথে পরিচিত হয়ে ওর খুব ভালো লাগছে। কতগুলো অপরিচিত মানুষ শুধু দেশের শেকড়ের টানে, মাটির কাছাকাছি থাকবে বলে আজ একটা পরিবার; একথা ভাবলেই বারবার চোখ ভিজে আসছে জুহির। কিন্তু বাবাকে নিয়ে একটা সমস্যা অনুভব করছে সে। মনে হচ্ছে বাবা অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছে। এমন কি জুহির নামটাও মাঝে মাঝে মনে করতে পারছে না। কিছুটা ডিমেনশিয়া দেখা দিয়েছে। একটু উদগ্রীব হয় সে। বিদেশে তো এখন পার্কিনসন, এলজেইমার, ডিমেনশিয়া এগুলোর জন্য অনেক রিহ্যাব সেন্টার রয়েছে। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আজ বিকেলে একজন নিউরোলজিস্ট এর সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে জুহি।
এলজেইমার ডিজিস ডায়াগনসিস হয় জুহির বাবার। এটা এমন একটা রোগ যেখানে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন কাজের ক্ষমতাও হ্রাস পায়। হঠাত্ করে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না জুহি। যদিও বাবা কানাডার সিটিজেন তবুও কি তিনি দেশ ছাড়তে রাজি হবেন? এখানে বা কার ভরসায় রেখে যাবো আমি...এধরনের নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে জুহির মাথায়। সবকিছু শুনে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন নিউরোলজিস্ট ডাঃ আশফাক জামিল।
--- কিছু মেডিসিন লিখে দিয়ে বলেন একদম চিন্তা করবেন না; আমাদের দেশেই এখন এলজেইমার পার্কিনসন রিহ্যাব সেন্টার গড়ে উঠেছে....একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলেন;
--- একবার হলেও প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে আসুন।
হোমে ফিরে পরের দিন জুহি শায়লা আর নাবিলার সাথে বাবার ব্যাপারটা শেয়ার করে ।
---আন্টি তোমরা কেউ কি আমার সাথে রিহ্যাব সেন্টার টা দেখতে যাবে? এক কথায় রাজি হয়ে যায় ওরা দুইজন।
পরের দিন একটা গাড়ী নিয়ে ওরা চলে যায় পূর্বাচল থেকে দুই ঘণ্টার পথ টাংগাইলের দেলদুয়ার। রাজধানী ঢাকা এখন ডিসেনট্রালাইজ হতে হতে গাজীপুর ছাড়িয়ে টাংগাইলের দিকে।
রিহ্যাব ক্লিনিকের এমডি র সাথে কথা হয় জুহিদের।
--- আসলে কি ম্যাডাম মানুষের লাইফ এক্সপেকটেন্সি বাড়াতে এই ধরনের ওল্ড এজ প্রবলেম গুলো বেশি ফিল হচ্ছে। যদিও বিদেশে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব; কিন্তু এদেশে যেহেতু এটা সম্ভব না তাই অনেক শিল্পোদ্দক্তাই এখন দেশের বিশাল মানবসম্পদ কে কাজে লাগিয়ে এই সেবাখাত গুলোতে এগিয়ে আসছে। সত্যি অবাক হয় শায়লা একেবারে বিদেশের রিহ্যাব সেন্টারের মতো এদের কর্মযজ্ঞ। যেহেতু এধরনের অসুখে মানুষ শিশুর মতো হয়ে যায় তাই এদের খাওয়া দাওয়া, গোসল, ঘুম থেকে শুরু করে সব কাজেই অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন। যাদের পরিবার এই ধরনের সেবা দিতে অক্ষম তাদের জন্য এখানে সেবা দিয়ে যাচ্ছে একদল মানবদরদী অভিজ্ঞ স্টাফ। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির ফাইনান্সিং এর অর্ধেক অর্থ আসে রোগীদের কাছে থেকে। দুই একদিনের মধ্যেই আনন্দ আশ্রমের গভর্নিংবডির সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট করে জুহি। বাবার সমস্যাগুলো খুলে বলে তাদের। রিহ্যাব সেন্টারটার কথা শুনে তাদের কাজের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখান ওনারা। অভয় দেন জুহি কে। কয়েকদিনের মধ্যে আনন্দ আশ্রম ওল্ডহোমের সাথে রিহ্যাব সেন্টারটির একটা সমঝোতা চুক্তিও হয়।
কালকে রাইয়ান সাহেব তাঁর ঠিকানা বদল করবেন। পূর্বাচলের আনন্দ আশ্রম থেকে টাংগাইলের এলজেইমার রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। ওনাকে সেখানে রেখে জুহি ফিরে যাবে কানাডায়। এই প্রথম আনন্দ আশ্রম থেকে কেউ এভাবে বিদায় নিচ্ছে। এই উপলক্ষে রাতে সবাই কে ডিনারে ইনভাইট করেছে জুহি। আজকে ওনার পরিবর্তন যেন স্পষ্টতই সবার চোখে পড়ছে। রাইয়ান সাহেব আবেগপ্রবণ হয়ে কখনো বা খুব আনন্দিত হচ্ছেন আবার কখনো বা কেঁদে ফেলছেন। খাওয়া দাওয়া ও আড্ডা শেষে যে যার মতো বিদায় নিল সেদিন।
ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে আছে পুরো আনন্দ আশ্রম। শুধু ঘুম নেই জুহির চোখে। সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে একমনে ভাবছে সে। কত স্মৃতি...মা বাবা আর সে! একদিকে তার চাকরি, সংসার আরেক দিকে বাবা। সে কি একা ফিরে যাবে? নাকি বাবা কে নিয়ে ফিরবে? অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত বদল করে জুহি। ভোর হয়ে আসে আনন্দ আশ্রমের মসজিদ থেকে ভেসে আসে আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম। আজ বুধবার। রৌদ্রজ্বল এক শরতের বিকেলে মেয়ের হাত ধরে রাইয়ান সাহেব কানাডার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। আনন্দ আশ্রমের সব বোর্ডাররা অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বিদায় জানায় তাদের কিছুদিনের সঙ্গী একজন ওল্ডহোম মেট কে।
লেখক: এমবিবিএস চিকিৎসক
অধ্যাপক বায়োকেমিস্ট্রি
আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
খূব ভাল লেগেছে। লেখিকাকে অনেক শুভেচ্ছা।
Replyধন্যবাদ।
Replyধন্যবাদ।
Replyসিমি;তোমার লেখার মধে imotion,হ্নদয়ের সব লেখাতেই থাকে। এই লেখাটা তার ব্যাতিক্রম না। খুবই সুন্দর লিখেছ। তোমার জন্য অনেক দোয়া রইল। ভালো থাকো, সুস্থ্য থাকো এবং করোনা মুক্ত থাকো।
Replyছোট চাচা
ধন্যবাদ চাচা। তোমরা পড়ে উত্সাহ দাও... তাই অল্পবিস্তর এই লেখালেখি।
Replyএমন যদি সব ওল্ড হোমে ঘটত, কতই না ভাল হত, ধন্যবাদজ্ঞাপন করলাম তোমায়
Replyসময়ের সাথে পরিবর্তন আসুক প্রত্যেক ওল্ডহোমে...সব বাবা মায়েরা ভালো থাকুন এটাই আমার প্রত্যাশা।
Replyঅনেক সুন্দর লাগলো গল্পটা।
Replyধন্যবাদ।
Replyশাহানা জাবীন সিমি ।