নীলুর বয়স ৩৬ এর কোঠা ছুঁইছুঁই , শ্যামলা লম্বা লাবণ্যময়ী চেহারা, কোঁকড়ানো চুলে বেশ স্নিগ্ধময়ী লাগছে এখনো, চোখে চিকন ফ্রেমের বাধানো চশমা; এই বয়সে এসে যেখানে সংসার,স্বামী, সন্তান সামলানোর কথা সে এখন বই পড়ার অভ্যাসে ব্যস্ত, রন্ধ্রে রন্ধ্রে অস্থিমজ্জায় বইয়ের নেশা মিশে আছে এখনো যেন। বারান্দার পাশের রুম টায় মস্ত বড় লাইব্রেরি বানিয়ে রেখেছে সেই বার বছর আগে থেকে, নীলু বলে এই ঘরটা হলো স্বর্গীয় অনুভূতির জায়গা, এখানে এলে আমি হারিয়ে যাই জ্ঞানের রাজ্যে, কবিতার রাজ্যে, রূপকথার রাজ্যে। বইয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এই মানুষটির মনে গভীর কোন দুঃখ- কষ্ট আছে কিনা কেউ পড়তে জানেনা। অবশ্য এই বয়সে এসে কি কেউ দুঃখ - কষ্ট হিসেব করে? এই বয়সটা হলো দুঃখ-কষ্ট হিসেব করার মাঝামাঝি একটা বয়স, কখনো অতীতের স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়ে সময় কাটানো কিংবা অন্তিম যাত্রার অপেক্ষা করা। মানুষ আর কদিন ই বা বাঁচে?সেই হিসেব করলে তার এখন তিন ভাগের এক ভাগ বয়স হাতে আছে, এটাও বা কম কিসে। নীলু জানেনা নীলু কিসের অপেক্ষায় বেঁচে আছে। মানুষের অপেক্ষা গুলো ও কি আপেক্ষিক ?নীলু তা জানেনা। দুঃখ-কষ্ট, ভালবাসা, অভিমান এই জিনিসগুলো আপেক্ষিক হয়; তবুও একদিন অভিমান রা হারিয়েও যায়, কষ্টরা একদিন মিলিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাসে, ভালবাসাও একদিন ঢেউ খেলানো বন্ধ করে দেয়, মনের সেই কল্পনায় কিংবা বাস্তবতার সমুদ্রে; কখনো বা তলিয়েও যায় আবার কখনো চর জাগিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে ভাবলেশহীন ভাবে। কিন্তু অপেক্ষারা? অপেক্ষাদের শেষ কোথায়? অপেক্ষাদের জন্যে যদি একটা বিরাম চিহ্নের জন্ম হত!অপেক্ষার পাশে কি আদৌ বিরাম চিহ্ন টেকে? টেকেনা। হারিয়ে যায় কেবল হারিয়ে যায় ,জীবনের মতই হারিয়ে যায়। পৃথিবীতে অপেক্ষাদের থেকে জঘন্যতম অনুভূতি আর কি হতে পারে? একবার যে অপেক্ষায় নিজেকে বন্দি করে সে নিজেকেই বন্দি করে ফেলে ধূসর ছায়ায়, বন্দি জিনিস যে ক্ষয় হয়, নীলু কি নিজের সুখের ক্ষয় করেনি এতদিন? তবুও কেন অপেক্ষা করতে ভাললাগে তার? নীলু জানে শুধু অপেক্ষা ই বেঁচে থাকে এখন সে!
নীলু কি ফারহানের জন্য এখনো অপেক্ষা করে? ফারহান কি হয় নীলুর? প্রেমিক? ভালবাসার মানুষ? আমরণের সঙ্গী কিংবা স্বামী? নীলু হাসে, চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ, চোখ থেকে খুলে হাতে নেয় সেটা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মুখ থেকে একটা আওয়াজ বের হয় 'এই দীর্ঘশ্বাসটার নাম ই বোধ করি ফারহান'।
আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নেয় সে, এই বয়সের চোখের কান্না যে কাউকে দেখাতে নেই নীলু তা বেশ ভালভাবেই জানে। আর দেখবেই বা কে? ওর যে কেউ ই নেই। শেষ যে বার এই অশ্রু কোন মানুষ দেখেছিল তা ছিল ফারহান,তারপর আর কেউ দেখেনি।সেই ছোট্টবেলায় মাকে হারায় নীলু, বাবা ছিল স্কুল টিচার, মা বাবা কিংবা বন্ধু বলতে সে শুধু বাবাকেই চিনত।
প্রতিবার বইমেলায় নিয়ে যেত বাবা,কতশত বই কিনত। বাবা বলত বই পড়লে কি হয় জানো মামনি? বই হচ্ছে আলো,মনের আলো! যত বই পড়বে তত তোমার মন আলোকিত হবে। বুদ্ধিতে দীপ্তিতে তুমি হবে সেরা থেকে সেরা। তুমি উড়তে থাকবে উঁচু থেকে উঁচুতে, বই শব্দটি এসেছে বহি থেকে, আর বহি শব্দটি আরবী শব্দ ওহি থেকে এসেছে, এই নামটিতে তাই অলৌকিকতার সুঘ্রাণ বয়! তুমি যত বই পড়বে বই তত তোমাকে নিয়ে উড়াল দিবে অচেনা অজানা রাজ্যে সেখানে গেলে তুমি বুঝবে কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ, তোমাকে উদার করবে বই, করবে নমনীয়। টুক করে যখন মন খারাপ হবে তুমি বই হাতে নিবে এক নিমিষে মন ভালো হয়ে যাবে। আরো কত কি বলত! ছোট্ট নিলু অত কি বুঝত তখন? রূপকথার রাজা রাণীদের বই পড়ে বাবাকে বলত বাবা আমি যদি রাজকন্যা হতাম যাদুর ছোয়ায় আমার ঘুম ভাঙত কিন্তু তুমি হচ্ছ আমার সোনাজাদু বাবা!
নীলুর স্মৃতিপট টা একেক করে সামনে ভাসতে লাগল, সেই নীলু আর এই নীলুর মাঝে বেশ পার্থক্য! কিশোর বয়স পার হতেই নীলুর চোখ খুলে যেতে লাগল, যত বইয়ের সাথে সখ্যতা বাড়ছে ও ততই মগ্ন হতে শুরু করে। কিশোরী নিলুর মাঝে তীব্র স্বপ্ন ঝেঁকে বসে, বাবার দেখানো পথে চলতে থাকে নীলু। কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবাও চলে গেলেন মায়ের চলে যাওয়া পথে! নীলু হয়ে গেল বেশ গম্ভীর, মামার কাছে মানুষ হওয়া নীলুর জগৎ টা ক্রমান্বয়ে গণ্ডীতে চলে এলো। তারপর?
নীলু উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল, ঘুঘু ডেকে উঠল শিমুল গাছটা থেকে, দুপুরের এই সময়টায় রোদের মতই খাঁখাঁ করতে থাকে বুকের চারিপাশ, তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠে মন, শূন্যতা ঘিরে ধরে। চায়ের কাপে চুমুক রাখলে এই তৃষ্ণা কি কাটবে? খাঁখা রোদে কেউ চা পান করেনা,নীলু করে। সে একজন কলেজের লেকচারার, প্রতিদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে সে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে, আজ আর কলেজ নেই কিন্তু রোজকার অভ্যাস তাকে টানছে। এই অভ্যাস কি চায়ের অভ্যাস নাকি বুকের ভিতর যে শূন্যতা হাহাকার করে সেই শূন্যতা, সেই একাকীত্ব হাতড়ে বেড়ানোর অভ্যাস? একা থাকতে থাকতে ও কি একা থাকাটা অভ্যাস হয়ে যায় মানুষের? এই খারাপ লাগা, এই বুকের ভিতর হাসফাশ করা তো নিত্যদিনকার রুটিন, তাও কেমন গা ছাড়া ভাব নিয়ে নীলু থাকে। নীলু কি একজন সঙ্গীর সঙ্গ কখনো কামনা করেনা? ভালোথাকার চেয়ে আত্মসম্মান বড় হয়ে উঠলে আদৌ কি ভাল থাকা হয়?কিন্তু নীলুর এতেই তৃপ্তি! যে মানুষটি ছিল আশ্রয়, ছায়া, অভ্যাস, মায়া,প্রেম, ভালবাসা তার কাছে যখন আত্মসম্মান টিকানোর প্রশ্ন আসে তখন মানুষ কি করে?
নীলু ভাবে আজ কি হল ওর,অতীত আজ কেন তাড়া করছে!চায়ের কাপে চুমুক রেখে চোখ বুলাতে লাগল সেই সেই আবেগময় ভালবাসার দিনগুলিতে, একে একে মনে করত লাগল জীবনের সেই রক্তক্ষরণের মুহুর্তগুলোর কথা। ক্যাম্পাসের সব থেকে দুর্দান্ত বাকপটু আর আসর জমানো ছেলে ছিল ও, হাসিয়ে মাতিয়ে রাখত গোটা ক্লাস,গিটারে সুর তুলত বিকেলের ক্যান্টিনে। আর নীলু তখন কিনা সবুজ ঘাসের মাঠের এককোণে বসে জীবনানন্দের কবিতা আওড়াতো, হুমায়ন আহমেদের রুপা পড়ে হিমুর জন্যে অপেক্ষার অনুভূতি কল্পনা করতো, কখনো দুইলাইন কবিতা লিখে নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পেত, দুই মেরুর দু'জন ছিল নীলু আর ফারহান, শান্ত চুপচাপ স্বভাবের এই মেয়েটার প্রেমে পড়ল নাকি সে। যে মানুষটার কাঁধে থাকত গিটার,যাকে খুঁজে পাওয়া যেত আড্ডার আসরে তার এখন লাইব্রেরিতে নিত্য আসা যাওয়া। গুটিকতেক কবিতা মুখস্থ করে আওড়ায় বন্ধুদের সাথে, রাশিরাশি বই মালঞ্চে সাজিয়ে উপহার দেয়।
ধীরে ধীরে নীলুও ভাবতে লাগল ফারহান কে নিয়ে, শৈশব, কৈশোরে বাবা আর বই ছাড়া বন্ধু ছিলনা কেউ, চারপাশে একটা দেয়াল ছিল। কেউ দেয়াল ডিঙানোর সাহস করেনি, সেই দেয়াল ধীরে ধীরে ছেদ হতে লাগল ফারহানের পদচারণায়। তারপর আর কোন বাধা ছিল না ওদের মাঝে। গভীরতম সেই বন্ধুত্ব সেই ভালবাসা মুগ্ধ করেছে আশপাশ, নীলু প্রচন্ড অভিমানে যখন গাল ফুলাত ফারহান জীবনান্দের বনলতা সেন কবিতাটি কয়েকশবার আবৃত্তি করে অভিমান ভাঙাত। নীলুর আবদার গুলি ছিল যতসব আজগুবি আজগুবি, এই কিনা হুমায়ন আহমেদের রুপা পড়া শুরু করল অমনি মাথায় ভুত চেপে বসত নীল শাড়ি পড়ে ফারহানের সাথে বকুলফুল কুড়াবে। এমন আরো আরো পাগলামি, সাহিত্য পড়া মেয়েরা নাকি এমন ই হয় নীলু এটা ভেবে নিজেই লজ্জা পায় আবার।
হুট করে একদিন বর্ষার ভোরবেলায় ফারহান ভাবে আজ ওরা বিয়ে করবে, ভ্যানভরতি কদমফুল নিয়ে এসে হাজির হয়, লালশাড়ি পড়িয়ে সেই কদমফুলের মাঝে বসিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ায়, নীলু হাসে শুধু হাসে। প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ফারহানের দিকে এই যে আমরা বেমানান ভাবে বিয়ে করছি তাও আবার বর্ষায়, এই বর্ষার বৃষ্টির মত যদি আমাকে কাঁদতে হয়? ফারহান ভ্যান থামিয়ে নীলুকে নামিয়ে আনে, মুখ থেকে জলের ফোটা মুছিয়ে দেয়, বলে যতই দুঃখ-কষ্ট আসুক তোমার জন্যে আজকের দিনটার মতই ভালবাসা থাকবে। নীলু হাসে! চোখ থেকে অশ্রু বের হয়, এ যে আনন্দাশ্রু! পরম প্রাপ্তির কান্না।
ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে ফারহান, একঘেয়েমি লাগে নীলুকে। বইয়ের তাক থেকে ছুড়ে ফেলে বই, নীলু হা করে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলতে পারেনা, মনের মাঝে ঝড় বয়ে যায়, মেঘ জমে, জল পড়ে। নীলু সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে, ফারহান ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নীলু অশ্রু মুছে না কপোল থেকে, জল শুকিয়ে দাগ পড়ে যায়। নীলু আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, বুঝতে পারে না ওর ভুল কোথায়।
রাত যত বাড়ছে, নীলুর অস্বস্তি লাগছে তত। এপাশ-ওপাশ করতে থাকে, বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের ল্যাম্পপোস্ট গুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলো দিচ্ছে।নীলু ভাবে ওদের কি ঘুম পায়না? ওদের কি কোন কষ্ট আছে? নীলুর এই মুহুর্তে ল্যাম্পপোস্টের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, মা মারা যাওয়ার সময় নীলু নাকি চিৎকার দিয়ে কেঁদেছিল তারপর থেকে এমন বোবাকান্না। নীলু অপেক্ষা করে, ফারহান ফিরেনা। ও কি করবে বুঝতে পারেনা, ও কি মামার ওখানে ফিরে যাবে? কি বলবে সেখানে গিয়ে? না! ও কারো কাছে বোঝা হয়ে থাকতে চায়না, বিয়ের দু'বছর পর কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে! আজকে মায়ের কথা মনে পড়ছে নীলুর, মায়ের বুকে মুখ লুকাতে ইচ্ছে হচ্ছে! মায়ের আদর পায়নি নীলু। নীলু এই মুহুর্তে ভাবে ওর মত চরম দুঃখী এ জগতে কে আর আছে? যার মনের দুঃখ খুলে বলার মত একটা আপন মানুষ নেই তার মত অভাবী কেউ নেই। নীলুর এটাও মনে হচ্ছে এখন ও আসলে অভাবী মেয়ে!
সময় গড়িয়ে যায়, একা থাকায় অভ্যস্ত হয় নীলুও। ফারহানের খোঁজ করেনা, কেন খুঁজবে? যে কোন কারণ না দেখিয়ে, না বলে এভাবে ছেড়ে চলে যায় তাকে খুঁজে কি হবে! কিন্তু সেই মানুষটির কি একবার ও মনে পড়েনা? নীলু কি আদৌ কোন অর্থ বহন করেনি ফারহানের কাছে? প্রতি শুক্রবারে কল্যাণপুর বৃদ্ধাশ্রমে যায় নীলু, এখানে কত মা -বাবারা থাকে, সন্তানরা তাদের সুখের জন্যে এখানে রেখে যায়। নীলু তাদের মা ডাকে বাবা ডাকে, বুকে জড়িয়ে নেয়, গল্প করে। শান্তি পায়, ভাললাগে! ভাবে আজ যদি আমার মা-বাবাও বেঁচে থাকত? এত অভাববোধ, এত শূন্যতাবোধ কি থাকত!
রাস্তার পথশিশুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, টাকা দেয়, কখনো টিফিনক্যারিতে খাবার বহন করে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দেয়, শিশুরা ডাক দেয় মা! নীলুর মন ভরে যায় কাণায় কাণায়! বছর দুয়েক পর দরজার কড়া নাড়ে কেউ, নীলু গিয়ে সামনে তাকায়, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আবছা,অস্পষ্ট একটা ঘোরে পরে যায় মুখ থেকে কথা বেরোয় না!
-নীলু আমাকে ক্ষমা করো, আমি ভুল ছিলাম, আমি ভেবেছিলাম তুমি শান্ত, সরল, গম্ভীর আমায় সুখী করতে পারবেনা তাই আমি মোহের পিছনে ছুটেছি, মস্ত বড় অন্যায় করেছি তোমার সাথে, আমাদের প্রতিজ্ঞার সাথে! আমি বিয়ে করেছিলাম অনুপমা কে, ও এ যুগের আধুনিক মেয়ে,কিন্তু ভালবাসা ছিল না সেখানে। তুমিই ঠিক ছিলে ; আমি ফিরে এসেছি তোমার কাছে, আমাকে দূরে তাড়িয়ে দিওনা!
-কেন এসেছো? কার কাছে এসেছো? তুমি কি আমার কেউ? কেউ হও? তোমাকে দেখেই বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল,প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল কোথায় ছিলে? কেন আসোনি এতদিন? বলতে ইচ্ছে করছিল তোমাকে না দেখতে দেখতে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, অপেক্ষা করতে করতে আমার চোখ চাতক হয়ে রক্ত ঝরেছে অশ্রুর বদলে, বুকের ভিতরের হাহাকার আমায় পুড়িয়ে মেরেছে অজস্রবার! কিন্তু দেখো আমি কিছুই বলতে পারিনি, বরং ঘৃণা হচ্ছে খুব ; কিন্তু তোমাকে অসম্ভব রকম ভালবাসি! যখন কেউ প্রিয় মানুষকে দেখে তার কাছে তেষ্টার কথা, ভালবাসার কথা, অসহায়ত্বের কথা বলতে গিয়ে চোয়াল শক্ত করে ফেলে ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তখন সেখানে ভালবাসা থাকলেও থাকে আত্নসম্মান, থাকে অধিকারের প্রশ্ন! সেই অধিকার তুমি হারিয়েছো! না তুমি আমায় ছেড়ে গিয়েছিলে আর না অধিকার ছেড়েছিলে! যেদিন অনুশোচনা করতে করতে মনে হবে তোমার থেকে অভাবী, দুঃখী, অসহায় আর কেউ নেই সেদিন ফিরে আসবে, সেদিন তোমাকে ক্ষমা করব!
ফারহান চলে যাওয়ার পর নীলু চিৎকার দিয়ে কাঁদে দীর্ঘ ২০ বছর পর! তারপর থেকে প্রতিবছর ওদের বিবাহবার্ষিকীতে ফারহান আসে, ক্ষমা চায়, অনুশোচনা করে, কাঁদে, চলে যায়। নীলু থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে যেন জগতে ওর কিছু করবার নেই, কিছু চাইবার নাই, কিছু দেবার নেই ,কিছু পাওয়ার নেই!
নীলুর চা ঠান্ডা হয়ে যায়, বিকেলের রোদ পড়ে আসে, চোখে ক্লান্তি ঘুম ঘুম ভাব নেমে আসে। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টায়, ফারহানের আসার দিন গুনে,এবার বিবাহবার্ষিকী বর্ষার মৌসুমে পড়বে। নীলু আলমারির দরজা খুলে সেই লালশাড়িটা নামায়, বুকের সাথে লেপ্টে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে!
সকাল থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি, সারারাত নীলুর ঘুম হয়নি, ভাবে এই বৃষ্টিতে ফারহান আসবে কিভাবে? বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় দেখে একটা কদমভরতি ভ্যান, পাশে ফারহান দাঁড়ানো, তাকিয়ে আছে বেলকনির দিকে। কিছুটা বয়স্কের ছাপ শরীরে পড়েছে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি।খুব অসহায় লাগছে ওকে, নীলু ওর মন দেখতে পায় স্পষ্ট ; যেন বলছে নীলু লাল শাড়ি পড়ে এসো আজ সারা শহর ঘুরব আমরা।
নীলু সেই লালশাড়ি পরে ঘর থেকে বের হয়, একটা মানুষ আর কত অনুশোচনা করবে? নীলুর ছিল অপেক্ষা আর ফারহানের অনুশোচনা, অপেক্ষা আর অনুশোচনার দেয়াল ভেঙ্গে আজ নতুন একটা কিছুর সূচনা হতে যাচ্ছে? পাঠক কি নাম দেবে এর? দুটি মানব-মানবী এই মুহুর্তে দু'জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, দুজনেই শিশুর মত হাউমাউ করে কাঁদছে, হঠাৎ বৃষ্টিটাও থেমে গেল, দুজনের কানা দুজন শুনতে পেল, বৃষ্টি আড়াল করেনি মোটেও! দুটি মানুষের এই কান্না কতইনা অব্যক্ত কথা বলে গেল, বলে গেল তাদের অসহায়ত্বের কথা, একাকীত্বের কথা, অনুশোচনার কথা, অপেক্ষার কথা, ভালবাসার কথা! কিন্তু তা কেউ শুনতে পায়নি, ভাষা হয়না যার কোন। পৃথিবীর সব থেকে গভীরতম অনুভূতি গুলো এমনই হয় যা কোন ভাষায় প্রকাশ করা যায়না, প্রকাশ করতে হয় স্পর্শে, অনুভূতিতে।
ভ্যানে উঠতেই ঝুম বৃষ্টি নামল, নীলু সারা শহরে কদম ফুলের পাপড়ি ছিটাচ্ছে আর হাসছে, একই রকম দৃশ্য ঠিক বারো বছর আগে যে ঘটেছিল, এই দুটি নর-নারীর যাত্রা কোথায় তারা তা জানেনা, শুধু গেয়ে উঠল মনে মনে-' এই পথ যদি না শেষ হত তবে কেমন হত তুমি বলোনা!'
আকাশ গুড়ুম শব্দে ঢেকে বলে উঠল ওদের মনের সুরে সুর মিলিয়ে ভালবাসলে ক্ষমা করে দিতে হয়, অনুশোচনার থেকে বড় প্রায়শ্চিত্ত, ক্ষমার থেকে বড় মাহাত্ম্য আর অপেক্ষার থেকে মধুরতম গরল অনুভূতি জগতে আর কিছু নেই! জীবন যে একটাই!
লেখিকার অনুভুতির দহন অনুভব করছি বুকের ভেতর। শক্তিশালী লেখা।
Replyদারুন গল্প আপু। আরও লিখুন।
Replyধন্যবাদ আপু!ভালবাসা নিবেন
Replyভালবাসা নিবেন আপু!
Replyরুকাইয়া,প্রথম বর্ষ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,লোক প্রশাসন বিভাগ।
Replyঅনেক ভাল লেগেছে বলেই কমেন্ট দিলাম।
পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপি, আমি ও লোক-প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী, বরিশাল বিদ্যালয়!
Replyসুন্দর হয়েছ গল্পটা।
Reply