আজ আমার একমাত্র ছেলে আর বউমা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেলো। জায়গাটা খারাপ না! ওদের রূচি ভালো, আমারই সন্তান তো! শহরের এক ধারে, পাশ দিয়ে এক সময়ের নদী, কালের বিবর্তনে এখন খাল, বয়ে গেছে। একটা লম্বা মতোন ঘর অনেকটা স্কুল ঘরের মতো। সামনে টানা বারান্দা। ঘরের সামনে ছোট! নাহ ছোট বলা যায় না। ঢাকা শহরে তিন ফিট বাই চার ফিট বাথরুমও অনেক বড় আর এটাতো সেই তুলনায় বেশ বড়ই। বাউন্ডারি ধরে মেহগনি গাছ লাগানো। ছোট্ট একটা বাগান, সেখানে অনেক ধরনের ফুল গাছ এক দুইটা করে লাগানো। বিভিন্ন রঙ বর্ণ আর গন্ধের ফুলের সমারোহ অনেকটা আমাদের মতোই! অনেক পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের এক জায়গায় জড়ো করার মতোই। কারো বাড়ি কুমিল্লা তো কারো বাড়ি খুলনা আবার কেউ লম্বা কেউ খাটো অথবা কেউ ফর্সা কেউ কালো। একই বাগানে অনেক জাতের ফুল!
এখানে এসেই ওল্ডহোমের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "এই আধুনিক যুগে এমন সেকেলে ডিজাইনের স্কুল ঘরের মতোন ডিজাইনের ঘর কেন?"
উত্তরে ম্যানেজার, "আমাদের এই বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতার ভাষ্য, এখানে যারা আসছে তারা সবাই শিশু। তাই তাদের ছোটদের মতো করে লালনপালন করতে হবে। স্কুল ঘরের মতো দেখতে তাই তাদের পুরনোদিনের কথা মনে পরবে। তারাও হয়তো সেই ছোট্টবেলার মতো সবার সাথে বন্ধুত্ব করে নেবে।"
কথাটা নেহাৎ মন্দ বলেনি। এখানে এসেছি মাত্র আড়াই ঘন্টা অথচ এরই মধ্যে মাজেদ সাহেব, তারেক সাহেব, ফরিদ ভাই, রিজিয়া আপাসহ অনেকের সাথে বেশ ভালো রকমের পরিচয় হয়ে গেছে। সমস্যা হচ্ছে বুড়ো হয়েছি আগের মতো সবকিছু স্পষ্ট মনে থাকে না। এর নাম ভুলে যাই তো ওর চেহারা ভুলে যাই। সবচেয়ে অস্বস্তিতে পরতে হয় যখন একজনের নাম আর আরেকজনের চেহারা মিলিয়ে ফেলি! এইতো সেদিন আমার বেয়াইন সাহেব রহমান সাহেবকে ভুলে আকরাম ডেকে বিশ্রী পরিস্থিতিতে পরেছি। আকরাম হচ্ছে রহমান সাহেবের ড্রাইভার!
কি আর করা? বয়সের সাথে সাথে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে ভুল করবার এবং তা মেনে নেয়ায়।
আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমার একমাত্র পুত্র এবং তার স্ত্রী কতটা নিষ্ঠুর আর অকৃতজ্ঞ যে আমাকে এই একাত্তর বছর বয়সে নিজেদের সাথে না রেখে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে! নাহ, ওদের এতে কোন ভূমিকাই নেই। গত আড়াই বছরে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। আমাদের রাতুর (রাতুলকে আমরা আদর করে রাতু ডাকি) মা মারা গেছেন প্রায় চার বছর হলো। আমিও সরকারি চাকুরী থেকে অবসরে গেলাম আর উনিও আমাদের সবাইকে একা করে দিয়ে সংসার, জগৎ থেকেই অবসরে গেলেন! এরপর বাপছেলের প্রাণান্তকর চেষ্টা সংসার গুছিয়েরাখা, রান্নাবান্না বাজারের তদারকি করা। এক কথায় যাচ্ছেতাই অবস্থা দুজনের। মাঝেতো এমন এক অবস্থা সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাপ বেটা কেনা খাবার দিয়ে দিনাতিপাত করেছি। তখন আত্মীয়স্বজন আমাকে চেপে ধরেছিলো আবার বিয়ে করার জন্য। শুনে মেজাজ এতোটাই খারাপ হয়েছিলো যে, সবার সাথে কথা বলা যোগাযোগই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
আসলে রাতুর মা আর আমার সম্পর্ক এতোটা ভালো ছিলো! কেউ কখনো বলতে পারবে না আমরা জোরে কথা বলেছি একজন আরেকজনের সাথে। চব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে কোনদিন ঝগড়াঝাটি হয় নি। ওর জায়গায় অন্য কাউকে বসানো সম্ভব ছিলো না বরং আমি সবাইকে বললাম রাতুর জন্য মেয়ে দেখো। ওর বয়স তেইশ বছর আর এক দেড় বছর পর ওর গ্রাজুয়েশন শেষ হলেই ওকে বিয়ে দিয়ে দেবো। বুয়েট থেকে ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হবার ছয়মাসের মধ্যেই ওর বিয়ে দিয়ে দিলাম ফুটফুটে মালিহার সাথে। মালিহা মাত্রই বিবিএ শেষ করে বেরিয়েছে। ওদের দুজনেরই ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন ছিলো। বিয়ে চাকুরী প্রায় একই সাথে হয়ে গেলো। রাতু সেল কোম্পানিতে আর মালিহা ইন্টারন্যাশনাল এনজিওতে।
প্রথম প্রথম সবকিছুই খুব সুন্দর এগোচ্ছিলো। দুই পিচ্চিবাচ্চার সংসার, চাকুরী। কাজের লোক রান্না করে, ড্রাইভার আর আমি বাজার করি। আমি বরাবরই একটু অন্তর্মুখী, ভাই বোন আত্মীয়স্বজন সবার সাথে সম্পর্ক ভালো হলেও ঘনিষ্ঠতা কম। বাসায় আসা যাওয়া একেবারেই উপলক্ষ কেন্দ্রিক। জন্ম মৃত্যু বিয়ে এবং দুই ঈদ ছাড়া যাওয়াই হয় না। আমার দিন শুরু হয় ফজরের ওয়াক্তে নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ কোরআন তেলোয়াত করে রেডি হয়ে হাটতে বের হই। ঠিক এক ঘন্টা হেঁটে দশ মিনিট জিরিয়ে বাসায় ফিরি। এসেই গোসল করে খবরের কাগজ নিয়ে বসি। আমি দুটো সংবাদপত্র রাখি এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব সংবাদ পড়ি, যদি পড়ার কিছু না পাই তাহলে বিজ্ঞাপন পড়ি। কত অদ্ভুৎ বিজ্ঞাপন ছাপা হয় খবরের কাগজে প্রতিদিন! কেউ পাত্র চেয়ে আবার কেউ পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে আবার কেউ জমি বিক্রি করতে অন্যকেউ জমি ক্রয় করতে, কেউ চাকুরী দেবার জন্য কেউ চাকরি পাবার জন্য। আচ্ছা পত্রিকা ওয়ালারা নিজেরাই এদের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে না? তাহলেতো কত সহজে অনেক কঠিন কাজ সমাধা হয়ে যেত!
যাক যা বলছিলাম, সংবাদপত্র পড়তে পড়তেই সাড়ে সাতটায় সকালের নাস্তা করতে বসি। আমার খাবারও আমার মতোই সাদাসিধা। সকালে পাতলা দুটো রুটি সবজি, সপ্তাহে দুটো ডিম আর দুদিন একটু মিষ্টান্ন। দুপুর আর রাতেও সিম্পল খাবার। আমাকে কিছুটা স্বল্পাহারীই বলা যেতে পারে। দেখেছেন এই এক সমস্যা! বয়স হয়েছেতো কথা বলা শুরু করলে থামা হয় না আবার একটু পর পর লাইন চ্যুত হয়ে পরি।
রাতুর বিয়ের দুবছরের মাথায় ও মাস্টার্স করার স্কলারশিপ পেলো। ছেলেকে নিজ স্বার্থে আটকাতে চেয়েও পরে অনুমতি দিলাম। এদিকে রোহিঙ্গারা এদেশে আসারপর মালিহার কাজ দৌড়াদৌড়ি গিয়েছে অনেক বেড়ে। প্রতিমাসে দুতিনবার কক্সবাজার যেতে হয় অফিস থেকে। কখনো এক সপ্তাহ আবার কখনো টানা দুই সপ্তাহ থাকতে হয়। এর মাঝেই ওর মায়ের ক্যান্সার ধরা পরেছে। ঢাকায় এলেও ওকে এ বাড়িতে না থেকে মায়ের বাড়িতেই সময় দিতে হচ্ছে বেশী। আমি সবই বুঝি কিন্তু এই কদিনেই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। আমি খুব স্বার্থপর ধরনের মানুষ। প্রিয়জনদের দূরে থাকাটা মেনে নিতে পারি না। বাস্তবতা বুঝি তারপরও কেমন জেনো অবুঝের মতো আচরণ করি। ওদের সাথে আমার মান অভিমান বাড়তে থাকে। এতোদিন পর এসে রাতুর মাকে খুব বেশী মিস করা শুরু করেছি। একা একা থাকা যে কতটা দূর্বিষহ তা অনুভব করছি। ওদের বললাম একটা বাচ্চাকাচ্চা নাও, অন্তত আমি একজন সঙ্গী পাবো! ওরা বলে না বাবা, আগে স্যাটেল হয়ে নেই। এটা নিয়েও আমার সাথে ওদের মতের অমিল হচ্ছে। সব মিলিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
গত সপ্তাহে রাতু ঈদ উপলক্ষে দেশে এলে আমি খুব রিএক্ট করি। এভাবে সংসার, জীবন চলতে পারে না। হয়তো উল্টো পাল্টা আরো অনেক কিছুই বলেছিলাম। দুজনের চোখমুখ একেবারে অন্ধকারে ঢেকেছিলো। ওরা কোন প্রতিবাদ কিংবা যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করলো না! রাতু হয়তো বেশীই অবাক হয়েছে, আমার এই রূপ ওর একেবারেই অজানা। আমি একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলাম। রাতু থাকতেই একটা বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে বের করতে এবং আমাকে রেখে আসতে। ছিমছাম নিরিবিলি হতে হবে আর কোন চাওয়া নেই। রাতু আর বউমা দুজনেই ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলো। রাতুতো ওর চাচা খালাদের ফোন দিয়ে অস্থির করে ফেললো। সন্ধ্যাতেই বাসায় বিশাল জমায়েত, মনে হচ্ছে কোন মানুষ মারা গেছে! সবাই এসে আমাকে বোঝাচ্ছে আবার সবাই এটাও জানে আমি একবার সিদ্ধান্তে উপনিত হলে তা থেকে কখনোই সরে যাই না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম। দিন শেষে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে যার যার বাড়িতে ফিরে গেলো। সব্বাই আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতে জোরাজোরি করছিলো কিন্তু আমি কারো বাসাতে কয়েক ঘন্টা থাকারপর হাসফাস করতে থাকি, এটা সবার জানা।
রাতু খুঁজেপেতে এই বৃদ্ধাশ্রম বের করে কথা বলে রেখেছে। আজ আমাকে নিয়ে এলো এখানে। মালিহার আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে আমি বিদেশ যাচ্ছি বেড়াতে। সুন্দর ট্রলিতে আমার কাপড় চোপড় ভরে দিয়েছে সাথে এক ট্রলি বই, আমার সবসময়ের সাথি। ওদের জন্য খুব মন খারাপ হচ্ছে কিন্তু চাচ্ছি আমি বেঁচে থাকতেই ওরা নিজেরা সংসার গুছিয়ে নিক। আমি দূর থেকে দেখতে চাই ওরা কিভাবে কি করছে? দুজন আমাকে জড়িয়ে ধরে যখন ছোট বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো আমিও পারলাম না নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে৷ এতো পানি চোখে আসে কোথা থেকে? বৃদ্ধাশ্রমের অন্য সবাই অবাক হয়ে দেখছিলো, এখানে রেখে যাওয়ার সময় সবার মুখে নিষ্ঠুরতার ছাপ থাকে আর এই দুইটা ছেলেমেয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে!
আমি আসলে ওদেরকেও বলিনি আজ আটাশে শ্রাবন। প্রায় ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবন এর পেছনে এইদিনের একটা ভূমিকা ছিলো। আমি চল্লিশের পরে বিয়ে করেছি, তখন রাতুর মায়ের বয়স মাত্র তেইশ। ওর বড় ভাই আমার বন্ধু ছিলো। পিএইচডি করতে গিয়ে বিয়েটা দেরী হয়ে গেলো। দেশে ফিরে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম আজকের তারিখে। এক দেখাতেই পছন্দ সাথে সাথেই প্রস্তাব এবং আংটি পরানো।এত বছর পর সব কিছু থেকে নিজেকে ছিন্ন করে আবার রাতুর মায়ের কাছাকাছি আসার চেষ্টা চালালাম মাত্র। এখানে এখন থেকে আমি থাকবো আর সাথে থাকবে রাতুর মায়ের স্মৃতি।
রাতুরা পারবে আমাকে ছাড়াই নিজেদের গড়ে নিতে। আর আমি? দূর থেকে সবাইকে দেখে যাবো নিরবে।
রাতু আর মালিহা চলে যাচ্ছে। আসলে কি ওরা যাচ্ছে? নাহ ওরা এখানে ওদের অস্তিত্ব ছেড়ে আর আমিও আমার প্রজন্মকে ছেড়ে দিলাম ভবিতব্য পানে।
সবাইকে যেন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে না হয় সেই প্রার্থনা করি। শুভেচ্ছা রাকিব ভাই।
Replyআসাধারন গল্প খুব ভাল লেগেছে
Replyএকই প্রার্থনা আমারও। তবে সময় এবং পরিবেশ খুব দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন
Replyসাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সবসময়
Reply