কোথায় তুমি এদিকে এসো ব্যাগ দুটো ধরো বেশ হুঙ্কার দিয়েই ডাকলো স্ত্রী মোমেনা বেগমকে। মোমেনা বেগম প্রায় দৌড়ের মতো এসে বাজারের ব্যাগ দুটো হাতে নিলো মোবারক আলীর হাত থেকে।মোমেনা বেগম ওগুলো রান্না ঘরে রেখে গোসল খানায় দিকে পা বাড়াতেই আবারও হুঙ্কার ব্যাগে মলাই মাছ অাছে অনেকক্ষণ আগেই কিনেছি ওগুলো আগে কুটো নইলে পঁচে যাবে।মোমেনা বেগম একটু ইতস্তত করে বললো দাড়াও টয়লেট সেরে আসি ওমনি কড়া গলায় মোবারক আলী বললো কেন এতক্ষণ কি করেছো ঘোড়ার ঘাস কাটছিলে নাকি?আগে বাজার ঢালো পরে টয়লেটে যেও।মোমেনা বেগম তবুও টয়লেটে গেল আর সামলাতে পারছিলো না কি আর করা এই সাতষট্টি বছর বয়সে প্রকৃতির ডাক চেপে রাখা যায় না।ভোরে উঠে নামাজ পড়ে ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে সকালের নাস্তা বানিয়ে স্বামীকে খাইয়ে নিজে খেয়ে বেশ টায়ার্ড লাগছিল তাই বিছানায় শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল এমন সময় স্বামীর ডাকে ধড়মড় করে উঠে পড়লো।মোবারক আলী সকাল সাড়ে ছটায় উঠে মর্নিং ওয়াকে বের হয়ে ঠিক সাড়ে সাতটায় বাসায় এসে নাস্তা করে সাড়ে আটটায় বাজারের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে এটা তার নিত্যকার রুটিনই বলা চলে।বাজার থেকে এসে গোসল সেরে একটু রেষ্ট নিয়ে চা খেতে খেতে পত্রিকা পড়বে বা টিভি দেখবে ঠিক যোহরের আজান দিলে উঠে ওজু করে নামাজ পড়বে নামাজটা বাসায়ই পড়ে শুধু মাগরিব ও জুম্মা নামাজ মসজিদে পড়ে।বিকেলে চায়ের দোকানে চা খেতে যেয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে মাগরিবের আজান হলে পাসের মসজিদে নামাজ পড়ে,চায়ের দোকানে আড্ডার জন্য মাগরিব নামাজটা মসজিদে পড়তে হয় নইলে এটাও বাসায় পড়তো।ভোরের নামাজ অধিকাংশ সময়ই বাদ হয়ে যায় ঘুম থেকে দেরি করে উঠার কারনে। এভাবেই চলছে মোবারক আলীর রিটায়ার জীবন চক্র। মোবারক আলী একটি নামি-দামি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরীয়ান হিসেবে দীর্ঘদিন চাকরি করে পনেরো বছর যাবত রিটায়ার্ড লাইফ লিড করছে। স্ত্রী মোমেনা বেগমের আর রিটায়ার কর হলো না সেই বিয়ের পরদিন থেকেই সংসারের সব কাজকর্ম করা যে শুরু হয়েছে আজ অবধি চলছে যতদিন বেঁচে আছে ততদিন হয়তো চলবে হয়তো কেন চলতেই থাকবে।এখন রান্নাবাড়ার কাজ একটু কম হলেও শরীরের তুলনায় কম না।যখন ক্লাশ এইটে পড়ে তখনই তার বিয়ে হয়ে গেল সুঠাম দেহের অধিকারী বি এ পাস মোবারক আলীর সাথে তারপর থেকে সংসারের বোঝা বহন করে চলতে হচ্ছে মোমেনা বেগমের।মোবারক আলী চাকরির সুবাদে শহরে এসে সরকারি কোয়ার্টার পেয়েছে সেখানে মোমেনা বেগমকে নিয়ে এলেও গ্রামের স্বামীর বাড়ি থেকে স্বামীর ভাই বোন ভাইবোনদের ছেলে মেয়ে পরপর এসে এ কোয়ার্টারে উঠলে তাদেরকে হাসিমুখেই দেখাশোনা করতে লাগলো মোমেনা বেগম এর মধ্যেই তার নিজেরও পাঁচ পাঁচটি সন্তান পৃথিবীতে চলে এসেছে।সবাইকে খাওয়ানো লেখাপড়া করানো সেও মোমেনা বেগমকেই দেখতে হয়।মোমেনা বেগমের বুদ্ধিমত্তা এবং সবার জন্য ত্যাগের কারনে তার শুশুর বাড়িতে সুনামের ফল্গুধারা বয়ে যায়। রাতদিন সংসারের কাজ করলেও ধৈর্য কখনোই হারায় নি আরো একটা চমৎকার গুণ আছে তার দুপুরের খাবারের কিছুক্ষণ পর এক থেকে দেড় ঘন্টার একটা ঘুম দেবে ফলে শরীর সব সময় চাঙ্গা থাকে মাথাও ঠান্ডা থাকে এমনিতেও মোমেনা বেগমের মাথা সব সময়ই ঠান্ডাই থাকে এখনো পর্যন্ত এ নিয়মটার অনাথা হয়নি কখনো তবে বছর দুয়েক পূর্বে একটা মাইল্ড স্ট্রোক করার পর থেকে শরীরের ঝরঝরে ভাবটা বেশ খানিকটা কমে গেছে।
মোমেনা বেগম বাজারের ব্যাগ ফ্লোরে ঢেলেই বিস্মিত হয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো একি এত মাছ এনেছো কেন এত আমার পক্ষে কুটা কি সম্ভব? মোবারক আলী ততোধিক উত্তেজিত হয়ে বললো এই মাছগুলো কুটতে পারবে না কি এমন কাজ আছে সংসারে?আরে তুমিতো জানোনা ছোট মাছ শরীরের জন্য খুবই উপকারী চোখের শক্তি বাড়ায় হাড়ের ক্ষয় রোধ করে।মোমেনা বেগম একটু অসহিষ্ণু হয়ে বলে সংসারে আমরা মাত্র দুজন মানুষ এত মাছ আর এত তরকারি কে খাবে?
মোবারক আলী রেগে গিয়ে বলে তাহলে টান মেরে ফেলে দাও মাত্র দুই কেজি মাছ এতো হলো? মোমেনা বেগম আর কিছুই না বলে মাছগুলো একটা গামলার ভেতরে রেখে পানি ঢেলে রাখলো এমন সময় মোবারক আলী গমগম স্বরে স্ত্রীকে বললো চা বানাও আমি গোসল সেরে আসছি।স্ত্রী দ্রুত চা তৈরী করে স্বামীকে চা বিস্কুট দিয়ে তরকারি আলাদা করে গুছিয়ে রেখে সদর দরজা খুলতেই ক্যাচ করে একটু আওয়াজ হলো ঠিক তখনি আবার সেই গমগমে আওয়াজ প্রতিদিন সেই একই বিস্কুট দাও অন্য কিছু দিতে পার না। মোমেনা বেগম ঘরে আর কিছু নেই বলে পা বাড়ালো ভাবলো কানে কম শোনে বলে রক্ষে নইলে কোথায় যাচ্ছো কেন যাচ্ছো নানা কথা জিজ্ঞেস করতো।দ্রুত পা চালিয়ে পাসের বাসার কাঠ মিস্ত্রি মনোয়ারের বউকে মাছগুলো কুটতে দিয়ে বলে এলো শেষ হলে বাসায় দিয়ে যাস।মোমেনা বেগমের আরো একটা গুণ হলো পাড়াপড়শিদের সাথে সু সম্পর্ক রাখা তাছাড়া যাঁরা একটু দরিদ্র শ্রেণির তাদেরকে মাঝে মাঝে আর্থিক সহায়তা করা এবং টুকটাক ফুট-ফরমায়েশ খাটিয়ে পারিশ্রমিক দেন ফলে যেকোন কাজে তাদেরকে ডাকলে তাঁরা এসে কাজ করে দিয়ে যায় আজও মিস্তিরির বৌকে মাছ কুটতে দিয়ে গেল।
মোবারক আলী ঠিক একটার সময় নামাজে বসবে আধা ঘন্টা লাগে তার নামজ শেষ হতে, এমনিতেই অত্যাধিক মোটা মানুষ চেয়ারে ছাড়া জায়নামাজে বসে নামাজ পড়তে পারে না।নামাজ শেষ হলেই স্ত্রীকে হাক দিয়ে বলবে কইগো টেবিলে ভাত বেড়েছো প্রচন্ড খিদে লেগেছে।এইতো হলো আর একটু সময় লাগবে বললো মোমেনা বেগম।মোবারক আলী উচ্চ স্বরে হুমকি দিয়ে বললো ঠিক সময় ভাত না দিলে কিন্তু আজ আর আমি কিছুই খাব না মোমেনা বেগম শঙ্কিত হয়ে দ্রুত রান্না করতে লাগলো।এরপর হাক দেয় ইনসুলিন দিয়ে যাও খিদে সহ্য হচ্ছে না মোমেনা বেগম পড়িমরি করে এসে মোবারক আলীর পেটে সুই ঢুকিয়ে ইনসুলিন দেয়।মোবারক আলীর ডায়াবেটিক রোগ দীর্ঘ দিনের ইনসুলিন ছাড়া চলতেই পারে না কিন্তু খাবারে তার কার্পন্য নেই পেট পুরে রসিয়ে রসিয়ে সবই খায়। সময়মত টেবিলে ভাত দেয় মোমেনা বেগম,মোবারক আলী গোগ্রাসে খেতে থাকে একবারও স্ত্রীকে খাবার জন্য ডাকে না। বিভিন্ন পদের খাবার উদর পুর্তি করে হাক দেয় কই পানি দাও, মোমেনা বেগম তখন হয়তো নিজে খেতে বসেছে তিনি খাওয়া ফেলে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয় কখনোই পানিটা পর্যন্ত নিজ হাতে ঢেলে খাবে না পানির জগটা হাতের কাছে থাকলেও মোমেনা বেগমকেই ঢেলে দিতে হয়।একবার বড় জমাই বেড়াতে এলে খাবার টেবিলে জামাইয়ের সামনেই তিনি রাগত স্বরে হাতের কাছেই পানি ভর্তি গ্লাস থাকতেও স্ত্রীর কাছে পানি চাইলে জামাই বলে গ্লাসটাতো দেওয়াই আছে নিজ হাতে নিয়ে খেলেইতো হয় উত্তরে মোবারক আলী গর্ব ভরে দাঁত বের হে হে করে হাসে আর বলে বাবাজি বলোকি জীবনে কোনদিন নিজের হাতে খাইনি তোমার শাশুড়ীকেই দিতে হবে এটাই আমার নিয়ম জামাইও ঠোট কাটা স্বভাবের সে জবাব দেয় স্ত্রীকে চাকরের মর্যাদায় রেখেছেন তাহলে একথা শুনে মোবারক আলী রাগে চুপ মেরে যায় এরপর জামাইয়ের সামনে আর এমনভাবে কথা বলে না মোমেনা বেগম জামাইয়ের উপর খুশি হলেও লজ্জা পেয়ে যায়।
খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় যেয়ে গড়গড় করে নাক ডেকে টানা দু'ঘন্টা ঘুম এরপর ঘুম থেকে উঠে আসর নামাজ পড়ে হাতে লাঠি নিয়ে হেটে চায়ের দোকানে বসবে।সন্ধ্যার পর বাসায় বসে টিভি দেখতে দেখতে ঠিক আটটার সময় আবার হাক টেবিলে খাবার দাও।খাবার খেয়ে সোফায় বসে আবার একটু টিভি দেখবে তখন তার চোখে রাজ্যের ঘুম চলে আসে স্ত্রীকে বলবে মশারি টাঙিয়ে দাও মোমেনা বেগম জলদি করে মশারি টাঙিয়ে দিলে বিছানায় শুয়েই নাকডাকা শুরু হয়ে যায় এভাবেই তার লাইফ স্টাইল চলছে।
লোকে বলে মোবারক আলী বিয়ের রাতেই বিড়াল মেরেছে নইলে এইভাবে সারাটা জীবন স্ত্রীর উপর হম্বিতম্বি করে কিভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিল।কোন বিষয়ে কোনদিন যদি স্ত্রী মোমেনা বেগম সংসারের প্রয়োজনের জন্য কোন কথা বলে সেটাকে মোবারক আলী ধমক দিয়ে নাকচ করেই দেবে সেই প্রয়োজনটা যতই ভালো হোক না কেন। অথচ স্ত্রীর প্রায় সমস্ত প্রস্তাব ঠিকই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাস্তবায়ন করেত হয় তবুও সেটা হতে হয় তার নিজস্ব স্টাইলে।তার পাঁচ পাঁচটি সন্তান সবাই স্টাবলিশ তবুও বাবার এহেন কান্ডে কোন কথাই বলতে সাহস পায় না। এই পাঁচটি সন্তানের স্টাবলিশের পেছনের কারিগর তাদের মা মোমেনা বেগম তিনি শুধুই নিজ সন্তানদেরকেই মানুষ করেনি তার দেবর দেবরদের সন্তানদেরকেও লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে যদিও অর্থগুলো এসেছে স্বামীর বেতন ও স্বামীর পৈত্রিক সম্পত্তির ফসলাদি থেকে।মোমেনা বেগমের স্বামী সারাজীবনে একটি কাজ ভালো করে করতে পেরেছে তা হলো শহরে তিনতলা একটা বাড়ি বানানো।রিটায়ারের সমস্ত টাকা ঢেলে এবং কয়েকটা ডিপিএস করা ছিল ব্যাংকে সেই টাকা দিয়ে তিনতলা বাড়িটি তৈরি করেছেন তিনি। এই ইট গাথার কাজটি ভালই করতে পারেন তিনি,তবে এই বাড়ি বানানোর সময় মোমেনা বেগমকেই সব কাজ সামাল দিতে হয়েছিল। ইট কেনার সময় কত ইট কিনেছিল তার হিসেব খাতায় টুকে রাখা কত ব্যাগ সিমেন্ট এলো সেটার হিসেব রাখা,মিস্ত্রিদের রোজের টাকার হিসেব রডের বাকির হিসেব সবই মোমেনা বেগমকেই দেখতে হতো এর মধ্যে বাড়ির রান্না খাবার পরিবেশন ইত্যাদি সঠিকভাবে করতে হতো।এত চাপ নিয়েও মোমেনা বেগম কাজগুলো বেশ সুচারুভাবে করে গেছে।বাড়ি তৈরির কাজ শেষে কোয়ার্টার ছেড়ে বাড়িতে উঠার কাজটিও মোমেনা বেগমকেই একাই করতে হয়েছে কারণ মেয়ে তিনটেরই বিয়ে দিয়েছে তার নিজ নিজ সংসার নিয়েই ব্যস্ত মাকে এসে কিভাবে সাহায্য করবে তবুও মোমেনা বেগম বাড়িটি বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে এর মাঝে কখনো যদি সামান্য ভুল ত্রুটি হতো তবে মোবারক আলীর কড়া ধমকানিতে শরীর সবসময় হীম হয়ে থাকতো। বড় ছেলেটা স্ব-স্ত্রীক কানাডায় বসবাস করে ওখানকার নামীদামী এক ব্যাংকে আইটিতে ভাল চাকরী করে স্যালারীও ভাল পায় সে বাবা-মার কাছে মাসে বেশ কিছু টাকা পাঠায় তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের জন্য কিন্তু সে টাকা মোবারক আলী ইট গাথার কাজে লাগায় এভাবে তার থানা শহরে একটা মার্কেট তৈরী করে দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছে যা আয় হয় তা দিয়ে আবার চেষ্টা করে আরো কিছু করতে অথচ এই পচাত্তর বছরে আর ধকল না নিয়ে শান্ত হয়ে শান্তিতে বসবাস করাটাই ছিল শ্রেয়।তার সন্তানেরা যতই না করে তিনি কারো কথাই শুনবে না এদিকে ধকলটা স্ত্রী মোমেনা বেগমের ঘাড়ে এসে পড়ে শেষ পর্যন্ত একটু এদিক সেদিক হলেই মোমেনা বেগমের উপর রাগের তুফান ছুটাবে মোবারক আলী। এইতো সেদিন কয়েকজন মেহমান এসেছিল ছোট ছেলের শশুর বাড়ি থেকে তাদের নাস্তা দিতে সামান্য দেরি হওয়াতে সেকি কটুক্তি মোমানা বেগম রান্না ঘরে আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে আবার নাস্তা দিয়ে এসে দাড়াতে না দাড়াতেই হাক শোনা গেল চা বানাও মোবারক আলী বসে বসে হুকুম করেই যাচ্ছে তার এ অবস্থা দেখে বেয়াই সাহেব বলেই ফেললো থাক আমরা চা খাই না আপনি আর শুধু শুধু বেয়াইন সাহেবকে কষ্ট দিয়েন না।মোবারক আলী ততোধিক গম্ভীর স্বরে বললো মেয়েলোক মানুষকে লাঠির আগায় রাখতে হয় বুঝলেন বেয়াই সাহেব।বেয়াই সাহেব নরম মনের মানুষ মাথা নিচু করে চুপ হয়ে গেল।মোমেনা বেগম চুপচাপ আদেশকৃত কাজগুলো নীরবে করে যাচ্ছে আর ভেতরে গুমরে মরছে।
মোমেনা বেগমের স্বভাবই চুপচাপ থাকা বা নীরবে সব সহ্য করা এটা সবসময়ই ছিল এখনো আছে ফলে স্বামীর কথা নীরবেই হযম করে যায় তার দুখের কথা কাউকে জানায় না এমনকি তার মেয়েদরকেও না। মেয়েরা সবই বোঝে কিন্তু বাবার বদমেজাজের কথা জানে বলেই কিছু বলে না আর ছেলেরাতো এ বিষয়ে মাথাই ঘামায় না।
মোবারক আলীর এই বদমেজাজি স্বভাব শুধুই নিজ স্ত্রী ছেলে মেয়ে আর তার দুএকজন স্বজনেরাই কেবল ভুক্তভোগী এছাড়া বাইরে কারো সাথে এমন মেজাজ দেখাতে পারে না বরং উল্টো ঝাড়ি খেয়ে আসে আর বাসায় এসে স্ত্রীর উপর এর প্রভাব ফেলবে।একবার জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে তার এক আত্মীয়র সাথে কথা-কাটাকাটি হলে সেই আত্নীয়র ঝাড়ি খেয়ে মোবারক আলীর অবস্থার দফারফা হয়ে যায় প্রেশার বেড়ে যখন তখন অবস্থা। সেই অবস্থায় স্ত্রী মোমেনা বেগমের সেবাশুশ্রূষায় সুস্থ হয়ে উঠে তবুও স্ত্রী সারাক্ষণ স্বামীর আতঙ্কে আতঙ্কিত থাকে স্বামীর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা যেন তাঁর ফরজ কাজ হয়ে দাড়িয়েছে।মোবারক আলীর যখন যা মন চায় সেটাই তখনই করতে হবে এইতো সেদিন হঠাৎ বললো ঢাকা যাবে আগামীকাল মন চাইছে নাতনিদের দেখতে এদিকে মোমেনা বেগমের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না শরীরটা দূর্বল লাগছে কদিন পর যাবে বলার সাথে সাথেই সেই হুঙ্কার ঢাকা গেলে শরীর ভাল হয়ে যাবে আরেকদিন মোমেনা বেগম সংসারের সমস্ত কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘুমাচ্ছে হঠাৎ হুঙ্কার শোন আমারতো ঘুম আসছে না তাই মনে মনে চিন্তা করলাম রাতে মুড়িঘণ্ট খাবো তুমি এখনই রান্না শুরু করো নইলে সময় পাবে না,মোমেনা বেগম তড়িঘড়ি করে তিনদিন পূর্বে আনা রুই মাছের মাথাটা ফ্রীজ থেকে বের করে পানিতে ভিজিয়ে রখলো যেন সময়মত রান্না করা যায়।এভাবেই আতঙ্কেই দিন কেটে যায় মোমেনা বেগমের।
শরতের মাঝামাঝি এক দুপুরে প্রচন্ড গরমে মোমেনা বেগম শুয়ে আছে অন্য ঘরে,এসময় স্বামীর সাথে একই বিছানায় ঘুমাতে সঙ্কোচ বোধহয়। কখনো কখনো ছেলে মেয়ে নাতি নাতকুররা এলে দুপুরে একই বিছানায় স্বামীর সাথে তারা দেখলে কি ভাববে ছি ছি কি লজ্জার বিষয় তাই আলাদাই ঘুমান।শরতের আকাশটাও যেন কেমন বিক্ষিপ্ত। হঠাৎ হঠাৎ কোত্থেকে ঘন কালো মেঘ উড়ে এসে আরো ঘন কালো হয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে আসে এমন তেমন বৃষ্টি না একেবারে ভাসিয়ে দিয়ে যায় কিছুক্ষণ বৃষ্টি পড়ে সবকিছু ভিজিয়ে আকাশ আবার পরিষ্কার হয়ে পড়ে।মোমেনা বেগমের দিবানিদ্রা একটু গাঢ় হয়ে এসেছে এমন সময় তার মনে হলো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এসেছে মেঘের কড়কড়াত শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল চোখ মেলে দেখে সত্যি ঘন কালো অন্ধকার,যেন রাত গভীর দ্রুত বিছানা থেকে উঠে পড়লেন তিনি ছাদের দিকে যাবার জন্য, গ্রীলের গেটটা খুলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন,ছাঁদে কাপড় শুকতে দিয়েছে অনেকগুলো কাপড় নিজের শাড়ী পেটিকোট ব্লাউজ স্বামীর লুঙ্গি প্যান্ট শার্ট বিছানার চাদর দড়িতে নেড়ে দিয়েছিল বারোটা একটার দিকে কড়া রোদ ছিলো তখন ওগুলো দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল শুকোনোর জন্য এখন ছাদে উঠে এসেছে ওগুলো তুলতে একপ্রকার দৌড়ে ছাঁদে উঠে কাপড়ের কাছে আসতেই ঝমঝম করে করে বৃষ্টি নেমে এলো একটা কাপড়ও তুলতে পারলো না শুকনো অবস্থায় তাঁর পুরো শরীর ভিজে গেলো একদম গোছল হয়ে গেলো তাঁর। কি মনে হলো মোমেনা বেগমের সে দড়িতে দু-হাত রেখে আনমনে দাড়িয়ে ভিজতে লাগলো।আজ কেন যেন বৃষ্টিতে ভিজতে ভীষণ ভালো লাগছে সে যেন ফিরে গেছে সেই কৈশোরে যখন সে কিশোরী উঠোনে বিছানো শুকনো ধান বৃষ্টিতে যেন না ভেজে তাই মা'কে সাহায্য করতে মায়ের সাথে ধান উঠাতো। ধান উঠাতে উঠাতে বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও মোমেনা উঠতো না ধান ঘরে রেখে সে বৃষ্টিতে ভিজতো মা কত বকাঝকা করতো তবুও সে ভিজতো কত যে আনন্দ লাগতো যেন স্বাধীন ময়ুর সে পেখম তুলে নাচছে। আজ যেন সেই দিন ফিরে এসেছে আজ সে ভিজবে কারো কোন চোখ রাঙানীকে ভয় পাবে না বৃষ্টি আরো ঘন হয়ে নেমে আসছে যেন আকাশের উপরে নদী আছে সেই নদী ভেঙে পড়েছে আর অজস্র ধারায় জল নেমে আসছে মোমেনা বেগম আজ কিশোরী সব ভয় ভীতি উবে গেছে কি স্বামী কি অসুখ সব ভীতি দূর হয়ে গেছে এই বৃষ্টি যেন তাঁর সব ক্লান্তি সব দুঃখ বেদনা গ্লানি সব কষ্ট ধুয়ে মুছে দিচ্ছে তিনি দুহাত দড়ি ছেড়ে আকাশের দিকে মেলে ধরে আর খিলখিল করে হাসতে থাকে আহ কি শান্তি কি স্বাধীনতা খুশিতে তাঁর দুচোখ বেয়ে নেমে আসে কান্নার জল, বৃষ্টির জল আর কান্নার জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আর তাঁর হাসির গমকও বেড়ে যায়।
মোবারক আলীর ঘুমটা গভীর হচ্ছিল গড়গড় করে নাক ডাকার সাথে একটা সুখ স্বপ্নও দেখছিল সে আজ মুড়িঘন্ট দিয়ে বাসমতি চালের ভাত খাচ্ছে মোমেনা বেগম পুরো রুই মাছের মাথাটা স্বামীর পাতে উঠিয় দেয় মোবারক আলী তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে আর মোমেনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলছে আহা কত চমৎকার করে রেঁধেছ আজ যেন শাহী খানা খাচ্ছি দাও দাও ঐ মাছের টুকরোগুলো আমায় দাও যা রেঁধেছ না, একদম খাসা আর শোন দইয়ের হাড়িটা ফ্রিজ থেকে বের করে রাখো ঠান্ডাটা কমতে একটু সময়তো লাগবে না কি!আ হা কি যে অপুর্ব এমন সময় জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছিটে এসে মোবারক আলীর ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয় সে হাক দিয়ে স্ত্রীকে ডাকে কইগো জানালাটা বন্ধ করে দাও আমি আর বিছানা পাতি সব ভিজে গেলো। স্ত্রীর কোন সাড়া না পেয়ে নিজেই জানালা বন্ধ করে ওঘরে এঘর খুজেও স্ত্রীকে না পেয়ে ছাঁদে উঠে দেখে মোমেনা বৃষ্টিতে ভিজছে মোবারক আলীর মেজাজ গরম হয়ে গেলো চিৎকার করে ডাকলো এই বৃষ্টিতে ভিজছো কেন চলে এসো জ্বর হবেতো স্ত্রীর কানে তার কথা ঢুকলো কিনা বুঝা গেল না এবার মোবারক আলী আরো জোরে চিৎকার করে ডাকলো এই চলে এসো আর ভিজো না হঠাৎ মোমেনা বেগম মোবারক আলীর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো এবং ততোধিক চিৎকার করে ধমক দিয়ে স্বামীকে বললো যাও এখান থেকে আর একটা কথাও বলবে না যাও বলছি যা ও....।মোবারক আলী স্ত্রীর চোখের দিকে চেয়ে দেখলো সেখানে আগুন ঝরছে সে একদম চুপসে গেলো তেজি বীর পুরুষ এক ধমকেই যেন ভেড়া বনে গেছে সে ধীরে ধীরে পুরো নব্বই কেজি ওজনের মোটা ভুড়িওয়ালা শরীরটা ঘুরিয়ে সিড়িতে পা রাখলো ঘরে ফিরতে।ওদিকে মোমেনা বেগম খিলখিল করে জোরে জোরে হেসে উঠে স্ত্রীর হাসি শুনে মোবারক আলী প্রমাদ গুনলো। সিড়ি দিয়ে নামছে আর ভাবছে মোমেনা পাগল হয়ে গেলে আমার কি হবে কে রেঁধে দেবে কে ইনসুলিন দেবে কে যত্ন করবে হায় হায় আমার কি হবে।
ভালোই লিখেছেন দাদা। নারীরা এ সমাজে বরাবরই বঞ্চিত হয়ে আছে। সুন্দর কাহিনী বলা যায়।
Replyআগমেদ হোসাইন ভাই,আমাদের সমাজে নারীরা বঞ্চিত কে বলল?
Replyজাকির,চন্দনাইস,চট্টগ্রাম