মাতৃত্ব..................তুহিন রহমান

রকারী অফিসের পেছনের ডুমুর গাছের পাতা বুনে ছোট্ট একটা বাসা বানিয়েছে দুটো টুনটুনি পাখি। টোনা আর টুনি। টোনার নাম চিরিং। আর টুনির নাম রুরু। দু’জনেই বেশ দুরে থাকে। তাদের জায়গাটা নিরাপদ নয় তাই তাদের জঙ্গল থেকে বেশ দুরের এই সরকারী এলাকার গাছে বাসা বেঁধেছে চিরিং আর রুরু। গাছের ওপরের অংশে, যেখানে মানুষ নাগাল পাবেনা সেখানে কয়েকটা পাতা এক করে তুলোর চিকন বুনট দিয়ে বাসা বানিয়েছে দু’জন। বাসা বানাতে লেগেছে পুরো দুটো সপ্তাহ। ওপর থেকে যা’তে বৃষ্টির পানি না পড়ে সেজন্য বাসার ওপর সেলাই করে দিয়েছে একটা কচুপাতা। 

বাসা বানানো যখন শেষ তখন রুরু বললো,‘এবার আমি ডিম পাড়তে পারি।’
চিরিং বললো,‘আরেকটু অপেক্ষা করো। এই মাসটা যাক। পরের মাসে পেড়ো।’
‘তা ঠিকই বলেছো।’ রুরু বললো।‘এই মাসটা আমরা বিশ্রাম নেবো। সামনে তো আবার বাচ্চা বড়ো করার কষ্ট আছে।’
‘ঠিক বলেছো। এই মাসটা আমরা শুয়ে বসে কাটিয়ে দেবো।’
ওরা একটা মাস শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। কোন খাবার দাবারের ভাবনা নেই। খেলে খেলাম নাহলে না খেলাম এমন একটা ভাব। বাচ্চা হলে তো এসব চলবেনা। তখন তাকে বড়ো করার চিন্তা। শুধু তাকে বড়ো করলে চলবেনা। তাকে পাখির মতো পাখি বানাতে হবে। তাকে উড়তে শেখাতে হবে। পোকা শিকার করতে শেখাতে হবে। বিপদ চেনাতে হবে। আরও কতো কি। তারপর তার পড়ালেখার চিন্তা।
পরের মাসে রুরু ডিম পাড়ে। ছোট ছোট দুটো ডিম। ডিমের গায়ে নীল নীল ছোপ ছোপ। রুরুর চোখে অনেক স্বপ্ন। ডিম ফুটে কি টোনা হবে নাকি টুনি হবে এটাই সে চিন্তা করে। ডিমদুটো পাশাপাশি থাকলেও মাঝখানে কিছুটা তুলো গুঁজে দিয়েছে রুরু। যদি জোরে বাতাস বয় আর গাছটা জোরে জোরে দোলে তাহলে ডিম দুটো একে অন্যের সাথে বাড়ি লেগে ভেঙ্গে যেতে পারে। দু’দিন পর চিরিং কোন গাছের আঠা এনে ডিমের ওপর দেয়। এর ফলে নাকি তার ডিম্বজাত সন্তান আরও শক্তিশালী হবে। রুরু আবার কোথা থেকে একটা সবুজ পাতা নিয়ে ঘষে দেয় ডিমের ওপর যা’তে তার ডিমদুটোর খোসা আরও শক্ত হয়। ডিমের খোসা শক্ত হওয়া মানে ভেতরের বাচ্চার হাড্ডি শক্ত হওয়া।
এভাবে প্রায় চারদিন চলে গেল। রুরু সারাক্ষন বসে থাকে ডিমের ওপর। তা দেয়। চিরিং উড়ে যায়। কোথা থেকে যেন পোকা নিয়ে আসে। গুঁজে দেয় রুরুর মুখে। বলে,‘তোমার জন্যও নিয়ে এলাম। তুমি তো সেই সকাল থেকে কিছু খাওনি।’
‘ঠিকই বলেছো।’ রুরু বলে। ‘পেটটা চোঁ চোঁ করছিলো।’
সাতদিন যায়। ডিমদুটোর ওপরের নীল রং ধুসর হতে থাকে। যেন আকারেও কিছুটা বড়ো হয়েছে। মা রুরু তার বুকের সব উষ্মতা দিয়ে দিতে চায় ডিমদুটোকে। চিরিংকে ডেকে রুরু বলে,‘দেখো দেখো এই ডিমটা নিশ্চয়ই মেয়ে হবে।’
‘তুমি কিভাবে বুঝলে?’ চিরিং জিজ্ঞেস করে রুরুকে।
‘এই ডিমটা একটু ছোট তাইনা? ছোট ডিম হলে মেয়ে হয়।’
‘আমিও চাই আমার একটা মেয়ে হোক।’ চিরিং হাসিমুখে বলে। 
রুরু দশটা দিন একটানা কাটিয়ে দেয় ডিমের ওপর বসে। একটানা দশ দিন ডিমের ওপর বসে থাকার পর সে একবারের জন্য উড়ে যায় কাছের আম গাছের ডালে। হাত পা আর ডানা মেলে শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে নিতে চায়। এই সুযোগে বাবা মানে চিরিং বসে তা দেয় ডিমে। একটানা বসে থেকে একটু শুকিয়ে গেছে রুরু। ঠিকমতো খাওয়া হয়না তার। যতোটুকু চিরিং যোগান দেয় ততোটুকুই খায় সে। আরও একটা সপ্তাহ বসে থাকতে হবে ডিমের ওপর।
বারোদিনের মাথায় আকাশ কালো হয়ে এলো। এমন কালো যে কাছের জিনিষও দেখা যায়না। রুরু বললো,‘ঝড় আসবে। তুমি ভিতরে চলে এসো।’
‘অতোটুকু ঘরে তোমার বসার জায়গাই হয়না আবার আমি বসবো?’ চিরিং বললো। ‘আমি এই ডালেই থাকি।’
‘কিন্তু ঝড় আসছে তো!’ রুরু বাতাসের ভেতর চিৎকার করে বললো।
‘আমাকে নিয়ে ভেবোনা। আমি ভেতরে গেলে ডিমের ওপর চাপ লাগতে পারে। তা’তে বাচ্চাদের ক্ষতি হতে পারে। আমি এখানেই থাকি। সারাজীবনই তো বৃষ্টি আর ঝড়ে কষ্ট পেয়েছি। আমার বাচ্চাদের যেন কষ্ট না হয়।’
দেখতে দেখতে হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামলো। সেই সাথে প্রচন্ড ঝড়। মাথার ওপর কচুপাতাটা থাকাতে বাসার ভেতর পানি ঢুকলোনা। তবে কচুপাতার জন্যে রুরুও দেখতে পেলোনা চিরিংকে। চিরিং ওপরের ডালে বসে ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করছে। ছোট্ট একটা পাখি আর কতোক্ষন যুদ্ধ করতে পারে? আর ঝড়টাও ছিলো প্রচন্ড। এমন ঝড় জীবনেও দেখেনি চিরিং। ঝড়ে ডালপালা ভেঙ্গে উড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর একটা বড়ো ডাল এসে ওর মাথার ওপর পড়লো। যখন ঝড়বৃষ্টি থামলো রুরু চিৎকার করে চিরিংকে ডাকলো। এরপর ডাকতেই থাকলো। চিরিং এর সাড়া নেই। বাধ্য হয়ে রুরু ডিম থেকে উঠে এলো বাইরে। দেখলো চিরিং গাছের নিচে পড়ে আছে। অনেক আগেই মারা গেছে পাখিটা।
রুরু কাঁদতে থাকলো। পাখিটা কতো কষ্টই না করেছিলো জীবনে। বাচ্চাদের জন্য নিজের জীবনটাও উৎস্বর্গ করে দিলো। দিন যায় আর রুরু উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ডিমদুটোর ব্যপারে। ডিমদুটো ঠিক আছে তো? বাচ্চা বেরুবে তো? একদিকে মরে যাওয়া চিরিং এর কষ্ট আবার অন্যদিকে ডিমদুটোর ভাবনা। কে যেন বলেছিলো ডিমের ওপর যদি গলা থেকে বের করা রক্ত দেয়া যায় তবে ডিম থেকে সুস্থ দেহে বাচ্চা বের হয়। যেই চিন্তা সেই কাজ। দিন রাত উচ্চস্বরে চিৎকার করতে লাগলো রুরু। একদিন সত্যিই ওর গলা থেকে রক্ত বেরুলো। আর সেই রক্ত সে ঢেলে দিলো ডিমদুটোর ওপর। 
দুই দিন পর সত্যিই ডিম ফুটে দুটো ছানা বের হয়ে এলো। রুরু তখন খুবই দুর্বল। গলা দিয়ে আর কোন স্বরই বেরুলোনা। কিচির মিচির করার ক্ষমতা হারিয়েছে ও চিরদিনের জন্য। বোবা হয়ে গেছে পাখিটা। শরীর এতোটাই দুর্বল যে উড়ে গিয়ে খাবে এমন শক্তিও নেই। দু’দিন মরার মতো পড়ে রইলো রুরু। তিনদিনের মাথায় উড়ে যেতে পারলো কাছের একটা গাছে। দানাপানি খেয়ে একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিলো। তারপর ছোট ছোট দানা মুখে তুলে নিলো। মরে গেলেও ওকে ওর বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে। ওর বাচ্চারা না জানি কতো কাঁদছে খাবার জন্যে। উড়ে যাবার শক্তি নেই তবুও বহু কষ্টে উড়ে এলো ডুমুর গাছের ডালে, তার বাসায়। বাচ্চাদুটোর মুখের ভেতর গুঁজে দিলো দানা।
এভাবে দিন যায়। রুরু দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। বাচ্চারা বড়ো হতে থাকে। দুটো বাচ্চাই বেশ শক্তিশালী। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। মোটাসোটা ঠোঁট, রাগী চেহারা। বোঝাই যায়, চিরিং এর কেটাল গাছের আঠা, রুরুর গচু পাতার কষ আর গলার রক্ত কাজে লেগেছে-ছেলেমেয়ে দুটো সুস্থ সুন্দর দেহের হয়েছে। রুরুর স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। শুধু দুঃখ যে চিরিং ছেলেমেয়েদুটোকে দেখে যেতে পারলোনা। বাচ্চারা বড়ো হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। রুরু দুর্বল দেহে ওদের ওড়ার ট্রেনিংও দিতে পারলোনা। ওরা নিজেরা খেলতে খেলতে একদিন উড়তে শিখে গেল। রুরু বাসাটাকে আরেকটু বড়ো করেছে যা’তে দু’তিনজন আরাম করে বসতে পারে। ওর শরীর ভেঙ্গে যাওয়াতে ও নড়াচড়াও করতে পারেনা তেমন। ডালের কাছাকাছি কোন পোকা এলে ধরে খায় নাহলে উপোষ থাকে। বাচ্চাদুটো মাসদুয়েক বাদে বড়োসড়ো হয়ে যায়। উড়ে উড়ে যায়। খেয়ে দেয়ে পেট মোটা করে আসে। এদিকে মা না খেয়ে পড়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে বাচ্চাদের দিকে। যদি দুটো দানা এনে দেয় ওরা। ওরা কিছুই আনেনা মায়ের জন্যে। একদিন ছেলেটা বলে,‘দেখ মা, এই বাড়িতে আমরা আর থাকবোনা। এই বাড়িটা ছোট। আমরা দুজন মিলে বড়ো করে বাড়ি বানাবো। আর তুমি এখানেই থাকবে। তুমি তো বোবা। তোমাকে নিয়ে আরেক ঝামেলা বাধবে। তারচেয়ে এখানেই থাকো। আর আমরাও তোমার জন্য কোন খাবার দাবার আনতে পারবোনা। এতো সময়ও নেই আমাদের। বাসা বুনতে হবে, সংসার করতে হবে। কতো কাজ।’
রুরু তাকিয়ে থাকে বোবার দৃষ্টি মেলে। ছেলেমেয়েদুটোকে ও অত্যন্ত ভালোবাসে। ওরা যাতে সুখে থাকে সেটাই কামনা করে সে। রুরু জানে ও এতো দুর্বল যে যদি ওরা ওকে খাবার এনে না খাওয়ায় তবে ও না খেয়ে মারা যাবে। তারপরও নীরব দৃষ্টিতে সম্মতি জানায় সে। ছেলে পাখিটা মেয়ে পাখিটাকে বলে,‘এই ঝামেলাটাকে সাথে করে নিয়ে কি লাভ? বয়সও শেষ। এখানেই রেখে যাই। এমনিও মরবে ওমনিও মরবে।’
মেয়ে পাখিটা মায়ের দিকে তাকায়।‘ঠিকআছে মা, তুমি থাকে তাহলে। তুমি তো বোবা। ঠিকমতো কথা বলতে পারোনা। এখানেই থাকো। মাঝেমধ্যে এসে দেখে যাবো।’
রুগ্ন অসুস্থ মাকে পেছনে ফেলে উড়ে চলে গেলো পাখি দুটো।

...............অনেক ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়েছি। মা দিবসে মা বাবা দু’জনকেই এই গল্পটা উৎসর্গ করছি।

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
October 19, 2020 at 5:01 PM

আমার পড়া শ্রেষ্ঠ গল্প। রূপালী পাতা আমার সেরা ম্যাগাজিনের তালিকায় চলে এল।

Reply
avatar
Anonymous
October 21, 2020 at 12:14 AM

সত্যি রুকাইয়া আপনি ঠিক বলেছেন।

Reply
avatar
October 27, 2020 at 3:09 PM

আমি স্তব্ধ পুরো গল্প পড়ে। একটা পাখির জীবনি আমাকে এত নাড়া দিয়েছে যে আমি খেতে পর্যন্ত পারছিনা। অনেক কষ্ট লাগছে রুরুর জন্য। এ কি হল?

Reply
avatar
October 28, 2020 at 9:58 AM

আসলে তুহিন রহমানের লেখার তুলনা হয়না। এমনিতে বাঙালি লেখকরা বেশ ভাল লেখেন। এদের ভেতর আপনার লেখার আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। দীর্ঘজীবি হোন ভাই।

Reply
avatar