“ সাজিদ ” অবয়বটা ঘুরে গেল পেছনের দিকে। “ সাজিদ......সাজিদ......শোন, দাঁড়াও। কিন্তু অবয়বটার যেন ওর কথা শোনার সময় নেই। চলে যাচ্ছে ও। কেন সাজিদ দেখা দিল আমাকে? কি বলতে চায় ও?“ যেও না প্লিজ। একবার শোন আমার কথাটা ”নাহ, অবয়বটা মনে হয় ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল অবয়বটি। হ্যাঁ, অবয়বটি আর কারো নয় সাজিদই ছিল এটা। সাজিদকে চিনতে কখনো ভুল করবে না মেঘলা।
আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগের কথা। সময়টা ছিল ২০১৮ সালের জুন মাসের শেষ দিকে । ইয়ার ফাইনালের জন্য জাঁকিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল মেঘলা। এতটাই ব্যস্ত, এতটাই মগ্ন ছিল পড়াশোনায় নিজের বেস্ট়ফ্রেন্ডকে ও সময় দিতে পারছিল না । কিন্তু মেঘলার উপায়ও ছিল না। কারণ যেভাবেই হোক টপার ওকে হতেই হবে। তাই কেউই এখন আপন না ওর কাছে। হ্যাঁ, নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডও না। হয়তোবা সাজিদ ওর বেস্ট ফ্রেন্ড কখনোই ছিল না । শুধু ব্যবহারই করে গেছে সাজিদকে । বন্ধু হিসেবে সব রকম সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেছে সাজিদের কাছ থেকে । কিন্তু ওর জন্য কিছু করা উচিত ছিল ভাবেনি। হয়তো ভেবেছিল, কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি। সাজিদ ছেলে হিসেবে খুবই চাপা ছিল । হুহ ! ( ব্যাঙ্গাত্মক হাসি ) ছিলো কেন বলছি? কারণ ও আর নেই। চলে গেছে পৃথিবীর সমস্ত মায়া ত্যাগ করে । তার জন্য কি কিছুটা হলেও মেঘলা দায়ী নয়? অবশ্যই দায়ী। ও সময় দিতে পারেনি সাজিদের কঠিন সময়ে। যখন ও বইয়ে মুখ গুঁজে পড়েছিল তখন হয়ত সাজিদ যন্ত্রণায় কষ্টে আর্তনাদ করছিল। কিন্তু কাউকে বলতে পারছিল না । কাকেই বা বলবে । তার তো বলার মত কেউ ছিল না। যে ছিল সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। হ্যাঁ, নিজের স্বার্থের জন্য সাজিদকে অবহেলা করেছে মেঘলা। সাজিদের কথাগুলো শোনার মত সময় ওর কাছে ছিল না।
" মেঘলা, বাসায় আছিস ?" সাজিদ একদিন সকালে ফোন করে মেঘলাকে ।
" বল, কি বলবি । তাড়াতাড়ি বল। "
" এত কিসের তাড়া তোর , হুমম ?"
" সাজিদ, সামনে ইয়ার ফাইনাল । ভুলে গেছিস ?পড়ছি আমি । "
" হ্যাঁ , পড়ছিস তো ভালো কথা । ১০ টা মিনিটও সময় হবে না তোর আমার কথা শোনার জন্য ?". শান্ত গলা সাজিদের ।
" যদি পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলিস, তাহলে শুনছি , বল। অন্যকিছু হলে শুনবো না । পড়া থেকে মন উঠে যাবে। "
" আচ্ছা , থাক। ( দীর্ঘশ্বাস ) তুই পড় ভালো করে । রাখি । "
" হ্যাঁ , রাখ। " পড়ায় আবার ডুব দিলো মেঘলা। কিন্তু .......কিন্তু ও কি জানতো এটাই সাজিদের সাথে এর শেষ কথা । না , জানতো না । জানলে এতটা অবজ্ঞা করতো না সাজিদকে। বাস্তবে ফিরে এল মেঘলা। দেখলো যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যাবে এমন সময় দেখল যে যেখানে সাজিদ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে একটা কাগজ পড়ে আছে। কাছে গিয়ে তুলতে বুঝল এটা একটা চিঠি। চিঠিটা আর কারো নয় , সাজিদের । সাজিদ দিয়ে গেছে মেঘলাকে । মেঘলা কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলল।
‘‘মেঘলা,তোর কাছে যখন চিঠিটা পৌঁছাবে তখন আমি অনেক দূরে। জানি তুই তোর পড়াশোনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছিস। এতটাই ব্যস্ততা তোর যে আমার কথা শোনার মতো সময় বা ধৈর্য কোনটাই তোর নেই। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার তো তুই ছাড়া কেউ নাই কথাগুলো বলার জন্য। তুই ছাড়া আমি কাকে বলব বল। তুই শুনতে না চাইলেও আমি আজ বলবো। জানিস বন্ধু, ফিয়া আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমি তো ওকে অনেক ভালবাসতাম রে। কি ভুল ছিল আমার বল তো? কি অন্যায় করেছিলাম আমি যে ও আমাকে ছেড়ে অন্য কারো হয়ে গেল! ওর জন্য আমি কি করিনি বল? তুই তো সাক্ষী কতটা পাগলের মতো ভালোবাসি আমি ওকে। নিজের আপন সত্তাকে ভুলে ওর কথায় ওঠাবসা করেছি। শুধু ভালোবাসি বলে। কখনো অভিযোগ করিনি। ও এটা কিভাবে করতে পারলো আমার সাথে? যাক, ওকে আমি সুখী দেখতে চাই। ও যার সাথে থাকুক ভালো থাকুক। কিন্তু জানিস ও ছাড়া আমি যে অসম্পূর্ণ। ওকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি শ্বাস নিতে পারি না। একদিকে ওর দেয়া কষ্ট, অন্যদিকে বাবা-মার বঞ্চনা। তোকে কখনো বলিনি। আজ বলবো। বাবা-মা আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না রে। কেন বলে না জানি না। তবে ওদের ব্যবহারে আমি স্পষ্ট বঞ্চনা, বিরক্তির ছাপ পাই। সবসময় আমাকে পড়াশোনা নিয়ে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আমি কি চাই তা কখনোই জানতে চায় না। তাদের ইচ্ছা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। অথচ আমার ইচ্ছাগুলো তাদের ইচ্ছার ভারে চাপা পড়ে যায়। আমি না এভাবে আর পারছি না। কষ্টগুলো আমার বুকের ভেতর জেঁকে বসে আছে। সরানোর জন্য কারো সাহায্য দরকার, জানিস তো। কিন্তু কেউ নেই সাহায্যের জন্য। আমি আজ বড় অসহায় রে বন্ধু। তাই এভাবে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে সবাইকে শান্তি দেয়াই শ্রেয়। চলে যাচ্ছি আমি। তুই টেনশন করবি না। দেখিস তুই টপার হবিই। আমি জীবন যুদ্ধে হেরে গেলে কি হবে, আমি জানি আমার বন্ধু ঠিকই জয়ী হবে। সেদিনটা আমি হয়তো তোর বন্ধু হয়ে তোর পাশে থাকতে পারবো না, তোকে অভিনন্দন জানাতে পারবো না। কিন্তু দূর থেকে তোর আনন্দ দেখে ঠিক আনন্দিত হবো। আর হ্যাঁ, আমার মৃত্যুর পর এই চিঠিটা কোন না কোন ভাবে পৌঁছে যাবে। ভাল থাকিস বন্ধু।
ইতি“ তোর বন্ধু "
বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে মেঘলার। চোখের পানি বাঁধ মানছে না । " আমি , আমিই দায়ী সাজিদের মৃত্যুর জন্য। " হঠাৎই মেঘলার মনে হলো কেউ ওকে ডাকছে। " মেঘলা " " সাজিদ ....." ( কান্নায় ভেঙে পড়ে মেঘলা ) " তুই কাদিস না বন্ধু "
" আমাকে তুই ক্ষমা করে দে , সাজিদ। আমি তোর বন্ধু হতে পারিনি। তোকে শুধু ব্যবহারই করে গেছি। তোর প্রয়োজনে তোর পাশে থাকিনি । তোর কোন কথা শুনিনি। ক্ষমা করে দে আমাকে ভাই ।অনেক বড় অন্যায় করেছি তোর সাথে । ( কাঁদতে কাঁদতে বলে মেঘলা)
" আমার জন্য নিজেকে অপরাধী করিস না মেঘলা । আজ আমি আমার দোষেই সবার থেকে আলাদা। তবে আজকের পর আর আমাকে তুই দেখতে পাবি না। কিন্তু যেখানেই থাকিস জানবি এই বন্ধু তোর পাশে আছে। এই দুটো চোখ তোকে আগলে রাখবে। ভালো থাকিস , বন্ধু । ভালো থাকিস । "
হাওয়ায় যেন মিলে গেল সাজিদের অবয়ব । সাথে সাথে ঘুমটা ভেঙে গেল মেঘলার। কি ভয়ঙ্কর স্বপ্নই না দেখলো। মাঘ মাসের শীতেও দরদর করে ঘামছে ও। তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিল সাজিদকে ফোন করবে বলে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সাজিদের মেসেজ । খুলতেই দেখল সাজিদ বেশকিছু ছবি পাঠিয়েছে ওর। কক্সবাজার ঘুরতে গেছে গাধাটা। আপন মনে হেসে উঠল মেঘলা । উফফ !! কি দুঃস্বপ্নই না দেখলো !
মানে কি? সাজিদ কি মরেনি?
ReplyNa more ni Puratai sopno chilo....Thanks for reading ❤
Reply