ওর সাথে যেদিন দেখা হলো সেদিন কোন জাতের গোলাপ ফুটেছিলো তা জানিনা তবে সেদিন ছিলো শনিবার এই ব্যপারটা আমি নিশ্চিত। পল্টনের মোড়ে কিছু ঈদ কার্ড খোঁজার জন্য গিয়েছিলাম। ঈদের বাকি চার দিন। অফিস থেকে চেক পেয়েছি বেতন বোনাসের। চেক নিয়ে প্রাইম ব্যাংকের পল্টন শাখা থেকে পঁচিশ হাজার টাকা তুলে বেরিয়ে আসলাম বাইরে তারপর ঈদ কার্ড কিনে এক প্লেট গরম গরম মোরগ পোলাও আর এক গ্লাস হিম শীতল পেপসি মেরে দিয়ে যখন বাইরে বেরুলাম তখন আকাশ কালো করে টপ টপ করে বৃষ্টি ঝরা সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম যাত্রীরা টপাটপ রিকসায় উঠে পড়ছে। কেউ কেউ আগেভাগেই প্লাস্টিক পেপার গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছে। আমি খালি রিকসা না পেয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলাম আজাদ প্রোডাক্টস এর পাশ দিয়ে নয়া পল্টনের দিকে। কিন্তু বিধি বাম। কয়েক পা যেতে না যেতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। এতোটাই হঠাৎ করে যে আমি সামনে দৌড়াবো নাকি পেছনে দৌড়াবো বুঝতে না পেরে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম একটা হোটেল ধরনের জায়গা খোলা রয়েছে। সাধারনত: গরীব লোকদের খাওয়ার জন্য এ ধরনের হোটেল করা হয় ফুটপাথের ওপর। কোন মানুষজন নেই, একেবারে খালি। সেদিকেই ছুটলাম। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। ছোট হোটেল, উপরে টিনের ছাউনি। একটা মাত্র টেবিল। সিগারেট বিক্রির টংকে ম্যানেজারের কাউন্টার ধরনের কিছু একটা বানানো হয়েছে। সেখানে বসে আছে টেকো মাথার একটা বুড়ো। কিছুটা ভিজে গেছি আমি। পকেট থেকে রুমাল বের করে সবেমাত্র টেবিলে বসতে যাবো কেউ একজন হুড়মুড় করে আমার গায়ের ওপর এসে পড়লো। রেগেমেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবো ফ্রিজ হয়ে গেলাম। একটা অনিন্দ সুন্দরী মেয়ে আমার গায়ের ওপর এসে পড়েছে। বাইরের প্রচন্ড বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য দৌড় দিয়ে ভেতরে ঢুকে সম্ভবত: আমার গায়ের ওপর টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে।
মেয়েটা আমার গায়ের ওপর পড়ে গিয়ে হতবাক হয়ে গেছে। তার সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে চপচপে ভেজা। মাথার চুল বেয়ে গড়িয়ে নেমে ভ্রু টপকে গলার কাছে পড়ছে পানি। মনে হচ্ছে এই মাত্র শাওয়ার সেরে বেরিয়ে এসেছে। পরনে হালকা নীল রঙের একটা শাড়ী। বাম হাতে একটা চিকন ঘড়ি যেন তার কবজিতে বসার অপেক্ষাতেই ছিলো। মেয়েটা ঢোক গিলে বললো,‘আমি আসলে এতো জোরে ঢুকেছি...।’
আমি তাড়াতাড়ি হাত নাড়লাম,‘ইট’স অলরাইট।’
মেয়েটা নাছোড়বান্দা,‘আমি সত্যি বলছি আমি স্কিড করে একেবারে আপনার ওপর এসে পড়েছি। আসলে বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচার জন্য...।’
আবার হাত তুলে তাকে থামালাম আমি। ‘আহা আমি বললাম তো যে আমি কিছু মনে করিনি।’
‘আপনার কি খুব জোরে লেগেছে?’গলায় একই সুর বজায় রেখে মেয়েটা বললো। ‘আমার কনুই তো আপনার পিঠের ওপর আঘাত করেছে।’
‘আমার গন্ডারের চামড়া।’ বলে হেসে উঠলাম আমি। মেয়েটাও হাসিতে যোগ দিলো কিন্তু তার ভেতর কেমন এক আড়ষ্ঠতা। হয়ত: আমাকে আঘাত দিয়ে ফেলেছে বলে।
এবার পরিপূর্নভাবে আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। অদ্ভুত সুন্দর একটা মেয়ে। যাকে বলে ন্যাচারাল বিউটি। সবচেয়ে সুন্দর তার ভ্রুদুটো। এমনভাবে বাঁকানো যেন ছিলায় টান খাওয়া দুটো ধনুক তার কপালের ওপর বসানো। আম কাট মুখমন্ডল একেই বলে বোধহয়। চেহারায় কোথাও কোন খুঁত নেই। ঠোঁটদুটোকে এক করলে হয় তাকে প্রজাপতির মতো লাগবে নাহয় দুটো কমলালেবুর কোষা। আমার সবচেয়ে বড়ো দোষ হলো আমি মেয়েমানুষের শরীরের দিকে তাকাইনা। আমার সব কাব্য তার চেহারাকে কেন্দ্র করেই, তাই অন্য কেউ হলে যেখানে তার দেহকেন্দ্রিক রূপ লাবণ্যে বিমোহিত হয়ে কবিতা লিখতো বা তাকে তানপুরার সাথে তুলনা করে মহাকাব্য লিখে ফেলতো সেখানে আমি তার শরীরের দিকে তাকালামনা একপলকের জন্যও।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম,‘আপনি তো একদম ভিজে গেছেন। নিন এই রুমাল দিয়ে চুলটা মুছে ফেলুন।’
মেয়েটা আমার হাত থেকে রুমালটা নিয়ে তার চুলগুলো ঘষে ঘষে মুছতে লাগলো।
আমি টেবিলে বসে পড়লাম। এমন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে যে আমার কাছে মনে হচ্ছে এই বৃষ্টি জীবনেও থামবেনা। সেই সাথে ঠান্ডা বাতাস আসছে দক্ষিন দিক থেকে।
ভিতরে বৃষ্টির ছাঁট আসছে দেখে বুড়ো লোকটা গিয়ে চাটাই এর ছাউনিটা একটু নামিয়ে দিয়ে ফিরে এলো। আমি দেখলাম মেয়েটা তালপাতার মতো কাঁপছে। বৃষ্টিতে পুরোপুরি ভিজে না গেলেও তার উপরের অংশ বেশি ভিজেছে।
আমি আমার শার্টটা খুলে বাড়িয়ে দিলাম মেয়েটার দিকে,‘আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে। এটা গায়ে চাপিয়ে নিন।’
‘না না ঠিক আছে। আমার ঠান্ডা লাগছেনা।’
‘আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি ঠকঠক করে কাঁপছেন আর বলছেন যে আপনার ঠান্ডা লাগছেনা। নিন পরে নিন।’
সলজ্জ ভঙ্গিতে মেয়েটা শার্টটা পরে নিলো। তার আসলেই বেশ ঠান্ডা লাগছে। বৃষ্টি ভেজা শরীরে ঠান্ডা বাতাসের যে কি কামড় তা আমি বুঝি।
আমি বুড়ো লোকটাকে বললাম,‘ভাই চা হবে?’
দেখলাম লোকটা আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কি যেন বলার অপেক্ষায় আছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতে কি যেন বলতে চাইলো, তার আগেই মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললো,‘নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমি এখানে বসেছি ভাইয়া। তা নাহলে এখানে ঢুকতামনা।’
আমি তাড়াতাড়ি তাকালাম মেয়েটার দিকে। তার চেহারাটা লাল দেখাচ্ছে। ‘আমি ঠিক বুঝতে পারিনি কি বলতে চাইছেন আপনি।’
‘সবার চরিত্র তো এক রকম নয় ভাইয়া। আপনি একবারও আমার দিকে তাকাননি আর ওই বুড়ো ভাম ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখ সরাতে ইচ্ছেই করছেনা। মানুষ এতো বেহায়া হয় কি করে?’
আমি চোখে রাগ ফুটিয়ে লোকটার দিকে তাকাতে লোকটা চোখ সরিয়ে নিলো। আমি নিচু স্বরে বললাম,‘সব আলুর দোষ বুঝলেন, সব আলুর দোষ।’
মেয়েটা অবাক হয়ে বললো,‘কিসের দোষ বললেন?’
আমি হেসে উঠলাম,‘না কিছুনা। আপনি বুঝবেননা।’
‘বুঝবোনা কেন অবশ্যই বুঝবো।’ মেয়েটা তার সুন্দর ভ্রু দুটো পাকালো।‘আলুর দোষ মানে কি?’
‘তাহলে তো ঠিকই শুনেছেন, না শোনার ভান করছেন কেন?’ আমি বললাম।
‘আচ্ছা থাক বলার দরকার নেই। এভাবে এখানে ভিজে শাড়ি পরে বসতে চাইনি আমি যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে যাই বা কোথায়।’ মেয়েটা বললো। ‘আশেপাশে তো কোন ভালো জায়গাও নেই যে বসবো।’
‘ঠিক বলেছেন একদম।’ একটু চুপ থেকে আমি বললাম,‘আপনার নামটাই তো জানা হলোনা।’
‘আমার নাম বর্ষা।’
আমার আনন্দে হাততালি দিতে ইচ্ছা হলো এমন কোইন্সিডেন্স দেখে। উল্লসিত গলায় বললাম,‘আরে কি আশ্চর্য! বর্ষায় ভিজে বর্ষা বসে আছে আমার সামনে!’
মেয়েটা হেসে ফেললো,‘এখন আপনি যদি বলেন আপনার নাম বিদ্যুৎ তবে বেশী অবাক হবোনা আমি।’
‘হা: হা: হা: হা:।’ অট্টহাসি দিয়ে উঠলাম আমি।‘আরে না, এতো তেজ নেই আমার। নাম হচ্ছে বখতিয়ার।’
মেয়েটা নাক সিঁটকালো,‘সত্যি বলছেন আপনি? এমন নাম মানুষের হয়? আপনার চেহারা দেখে তো মনে হয়না এরকম উদ্ভট একটা নাম দিয়েছেন আপনার বাবা।’
‘তবে কেমন হবে বলে আপনার ধারনা?’
‘এই ধরুন রায়ান, জিয়ান, সায়হাম, কিংবা হিন্দী সিনেমার ঐ বস্তাপচা রাহুলই হোকনা কেন অন্তত: আপনার ঐ সদরঘাট মার্কা নাম থেকে তো ভালো।’
আরেকবার আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম,‘আসলেই আমার ভালো নাম বখতিয়ার। তবে কলিং নেম একটা আছে যেটাকে আপনি মোটেও সদরঘাট মার্কা বলতে পারবেননা।’
‘কি সেটা?’
‘তিয়া।’
‘তিয়া?’
‘হ্যাঁ তিয়া। কেন বিশ্বাস হচ্ছেনা?’
‘বিশ্বাস হচ্ছে কারন পৃথিবীতে কেউ যদি তার নাম তেলাপিয়া বা তেলাপোকা রাখে তবে আমার করার কি আছে তিয়া ভাই।’
‘দেখুন আর হাসতে পারছিনা। চা খাবেন বর্ষা আপা?’
‘কি? বর্ষা আপা? আপনি কি আমাকে আপনার চেয়ে বয়স্ক ভাবছেন নাকি?’
‘আরে কিছুই ভাবছিনা। চা খাবেন?’
‘খাবো।’
আমি চায়ের কথা বলতে যাচ্ছি দেখলাম টেকো বুড়ো আগেই চা বানিয়ে ফেলেছে। বাইরের বাতাস থেকে বাঁচতে আমার দিকে আরেকটু চেপে এলো বর্ষা। আমার দিকে চেয়ে বললো,‘আপনার শার্টটা না থাকলে কিন্তু আমি একদম ঠান্ডায় জমে যেতাম।’
‘থাক ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই।’
বুড়ো দু’কাপ চা দিয়ে গেল আমাদের সামনে। চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,‘পড়াশোনা শেষ করেছেন?’
‘না এখনও করিনি।’ বর্ষা বললো। ‘থার্ড ইয়ার ফাইনাল দিয়েছি।’
‘ভাইবোন ক’জন আপনারা?’
‘চার ভাই বোন।’
‘বাবা কি করেন?’
বর্ষা একটু মাথা নিচু করলো। ‘কিছু করেননা।’
‘রিটায়ার্ড?’
‘না।’
‘তবে?’
‘পঙ্গু। অসুস্থ। প্যারালাইসিসে পড়ে আছেন পাঁচ বছর ধরে।’
থমকে গেলাম কথাটা শুনে। মেয়েটা এতো সহজ সরলভাবে তার অসহয়াত্বের কথাটা বলে ফেলবে ভাবতে পারিনি। অন্তত: আমি হলে এভাবে বলতামনা। মুখে বললাম,‘সরি বর্ষা। এখন তাহলে আপনাদের পরিবার কিভাবে চলে?’
বর্ষা মাথা নিচু করে রাখলো। চায়ে চুমুক দেবার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে। আমি বললাম,‘তোমার কোন ভাই নেই?’
বর্ষা এপাশ ওপাশ মাথা দোলালো। নেই।
‘এদিকে এসেছিলেন কেন?’
‘সামনে ঈদ তো তাই একটা জিনিষ বিক্রি করতে এসেছিলাম।’ বর্ষা বললো।‘এভাবে বাড়ির জিনিষপত্র বিক্রি করে কোনমতে বাজার করতে হয়। আমি একটা টিউশনি করি। আমার আরেক বোনও টিউশনি করে। এভাবে সংসার চালানো যায়না ভাইয়া। বাবার অনেক ওষুধ লাগে। সামনে ঈদ। কিভাবে কি করি বুঝতে পারিনা। মা বললো তার একটা নেকলেস বিক্রি করে দিতে। গত সপ্তাহে আমার বোনের একটা আংটি বিক্রি করেছি।’
বিশ্ময় বাঁধ মানছেনা আমার। আমি এতো অসহায় একটা মেয়েকে দেখছি অথচ কি অসম্ভব রূপসী সে! ভাবতেও পারছিনা যে হয়ত: এখনও না খেয়ে আছে। পেটে খিদে কিন্তু টাকা নেই ব্যাগে। তাড়াতাড়ি বললাম,‘কিছু খেয়েছেন?’
‘খেয়েছি।’ মেয়েটা শুকনো মুখে বললো।
‘মিথ্যে বলছেন। আপনি কিছু খাননি।’
‘বাসায় গিয়ে ভাত খাবো।’
‘তাতো খাবেনই। কিন্তু যে বৃষ্টি যাবেন কিভাবে?’
‘আমি এখন যাবোনা। অপেক্ষা করবো একজনের জন্যে।’ বর্ষা বললো।
অজান্তেই বুকের ভিতর একটা খোঁচা লাগলো। কার জন্য অপেক্ষা করবে বর্ষা? নিশ্চয় তার ভালোবাসার কেউ আছে। আহ্ কি ভাগ্যবান পুরুষ সে। এমন সুন্দরী এক নারীর মন পেয়েছে সে। জিজ্ঞেস করলাম,‘সে কখন আসবে?’
‘জানিনা।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো বর্ষা। ‘আমাকে ফোনে বললো দুপুরে যেতে। আমি সেই বারোটা থেকে অপেক্ষা করতে করতে বিকাল হয়ে গেল।’
‘আশ্চর্য তো! কেমন মানুষ সে?’ আমি রেগে উঠলাম। ‘আপনি যে বৃষ্টিতে ভিজে বসে আছেন খেয়াল নেই তার?’
‘খেয়াল রাখার প্রয়োজনটাই বা কি? সেতো আমার কেউ নয়। আমাকে বসিয়ে রাখতে পারলে আরো কম দামে ছেড়ে দেবো তারই অপেক্ষায় আছে সে।’
‘কি ছেড়ে দেবেন?’
‘বললামনা ঐ নেকলেসটা। দেড় ভরি আছে ওতে। এখন পঞ্চাশ হাজার টাকা ভরি। আর সে দিতে চায় মাত্র তিরিশ হাজার। মানে আমার লস পঁয়তাল্লিশ হাজার। তারপরও অপেক্ষা করছে যদি আরেকটু দাম কমাই। আজ আমার টাকার খুব দরকার তাই তার কাছে এসেছি।’
আমার কথা বলার ভাষা নেই। প্রথম দেখায় আমি বুঝতেই পারিনি মেয়েটা এতো নিডি। আমি বললাম,‘আমি কি কিছু করতে পারি আপনার জন্য?’ তারপরও মনে একটা আনন্দ, যাক সে তার বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছেনা।
আর তার বয়ফ্রেন্ড হয়ত: এখনও নেই। চট করে নিজেকে সামলে নিলাম আমি। বললাম,‘আচ্ছা, কোথায় তার দোকান, আমি কি কিছু করতে পারি আপনার জন্য?’
বর্ষা বাইরের দিকে তাকালো। বৃষ্টি আর বাতাসের গতি মনে হয় বাড়ছে। সন্ধ্যার মতো অন্ধকার হয়ে গেছে আশপাশটা। মাথা নাড়লো সে,‘না এই বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষা করতে পারেন আমার সাথে। যতক্ষন সে না আসে।’
‘আচ্ছা বোকা মেয়ে তো তুমি!’ রেগে উঠলাম আমি অনেকটা।‘কোন মেয়ে কি এতোটা বোকা হয়?’
বর্ষা চুপ করে থাকলো।
‘আমার কাছে অবাক লাগছে। এতো বড়ো একটা জিনিষ যার দাম অনেক বেশী সেটা তুমি এতো কম দামে ছেড়ে দিতে চাইছো। তুমি শুধু তার জন্যে কেন অপেক্ষা করছো? অন্য কোন সোনার দোকান নেই? আরও কোন দোকান ঘুরে দেখ তারা তোমাকে আরও বেশী দাম দিতে পারে।’ আমার স্মরন নেই কখন যে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছি আমি।
মেয়েটা মাথা নিচু করে থাকলো।‘ভাইয়া আমার জায়গায় আপনি হলেও তাই করতেন। এই জিনিষ নিয়ে দোকানে দোকানে ঘোরা সম্ভব নয় আমার জন্য। আর এভাবে ঘুরতে ঘুরতে যদি আমার পেছনে ছিনতাইকারী লেগে যায়? তাহলে তো সব হারাবো আমি।’
‘সেটা ঠিক।’ আমি চায়ে চুমুক দিলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম মেয়েটাকে সাহায্য করবো আমি। কিন্তু কিভাবে করবো সেটা ভেবে বের করতে পারলামনা। বললাম,‘এক কাজ করুন আমাকে জিনিষটা দিন, আমি ওটা বিক্রি করার চেষ্টা করি।’
এক কথায় রাজি হয়ে গেল মেয়েটা। হাতের ব্যাগটা খুলে ভেতর থেকে নেকলেসটা বের করলো। চমৎকার ডিজাইনের সোনার নেকলেস। একনজর দেখলেই বোঝা যায় পুরাতন আমলের অথচ বাইশ ক্যারেটের সোনা। আমার যদিও এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা কম তারপরেও অনভিজ্ঞ চোখে যতটুকু চিনলাম তাতেই বুঝলাম যে নেবে জিনিষটা তার পোয়াবারো। বর্ষা নেকলেসটা তুলে দিলো আমার হাতে। আমি তার সরলতায় বিশ্মিত ও হতভম্ব হলাম। বোকা মেয়ে, চেনেনা জানেনা একটা মানুষকে কিভাবে এতো টাকা দামের জিনিষটা দিয়ে দিতে পারে। আমি নেকলেসটা আমার প্যান্টের পকেটে রাখলাম।
মেয়েটা ওটা নিয়ে একবারও কোন কথা বললোনা। রবং সে প্রসঙ্গ বদলে ফিরে গেল তার পরিবারের কথায়। জানাল কতো কষ্টে তার বোন পরীক্ষা দিচ্ছে। তার বাবা তাকে কতো নৈতিকতা শিক্ষা দেয় প্রতি দিন। ‘বাবা বলে কাউকে কখনো মিথ্যা আশ্বাস দিতে নেই।’ বর্ষা বলে চলে। ‘বাবা বলে তোমার চলাফেরায় আরও সাবধানী হতে হবে যেন তোমাকে দেখে অন্য কোন মানুষ ভুল মেসেজ না পায়। বাবা আরও বলে এই বয়সটা ভুল করার বয়স। কিন্তু এই বয়সে ভুল করলে সারা জীবনে শোধরানো যায়না।’
‘আপনার বাবা একদম ঠিক কথা বলেন।’ আমি বললাম।‘আমার মা আপনার বাবার মতোই কথা বলেন।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ। যাবে আমাদের বাড়িতে?’
‘যাবো। অন্যদিন। আজ তো বুঝতেই পারছেন কি বড়ো বিপদে পড়েছি।’
‘এটা কোন বিপদ নয়। আমি আছি না!’ আমি উঠে দাঁড়ালাম। ‘তুমি বসে বসে চা খাও আরেক কাপ, দেখবে আমি বিশ মিনিটে কাজ সেরে চলে আসবো।’
উঠে দাঁড়াতে দেখলাম মেয়েটা কেমন যেন একটু উশখুশ করছে। করাটাই স্বাভাবিক। এতো দামের একটা জিনিষ দু’মিনিটের পরিচয়ে একজনের কাছে তুলে দিয়েছে যার বাড়িও সে চেনেনা। আমি হাসলাম,‘কোন চিন্তা করোনা। ঢাকায় আমি নতুন নই। আমি তোমার এটা নিয়ে পালিয়ে যাবোনা। আচ্ছা ঠিক আছে এই নাও।’
পকেটে থাকা বেতনের পঁচিশ হাজার টাকা বের করে বাড়িয়ে দিলাম বর্ষার দিকে। ‘এটা রাখো। আর যা বিক্রি করতে পারবো সবটাই তোমাকে দিয়ে দেবো। এটা সিকিউরিটি হিসাবে তোমার কাছে রাখো।’
মেয়েটার চেহারা লাল হয়ে উঠেছে।‘কি যে বলেন ভাইয়া। আমি আপনাকে কেন বিশ্বাস করবোনা?’
‘না না ঠিক আছে এটা রাখোনা তোমার কাছে। দেখবে এটা এক লাখ টাকায় বিক্রি করে দেবো আমি। তুমি পারবেনা কারন ওরা তোমাকে দেখলেই বুঝে ফেলবে তোমাকে ঠকানো সহজ হবে।’
মেয়েটা ইতঃস্তত করে টাকাটা নিলো। বাইরে বৃষ্টি কমেছে। আমার গায়ে শার্ট নেই। ভেতরের গেঞ্জিটায় কয়েকটা ফুটো হয়ে আছে। মা বেশ ক’দিন বলেছেন সেলাই করে দেবার জন্য। আমাকে প্রতিদিন বাইরে যেতে হয় তাই আর সেলাই করা হয়নি। এখন মনে হলো কি ভুলটাই না করেছিলাম সেদিন। মা যদি সেলাই করে দিতো তাহলে মেয়েটার সামনে ছেঁড়া গেঞ্জি পরে বসে থাকতে হতোনা। আমাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বর্ষা নিজের গা থেকে শার্টটা খুলে দিলো। এছাড়া আর করার কিছুই নেই আমার। এখান থেকে বেরুতে গেলে আমাকে শার্ট পরতে হবে।
আমি শার্ট পরে নিলাম। বর্ষা অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষন মায়া হলো আমার মেয়েটার জন্য। সে হয়তো ভাবছে আমি ওকে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকাগুলো মেরে দেবো আমি। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া তার আর কিছু করারও নেই। আর বিশ্বাস না করলে তার হয়ত: আজ রাতে পেটে ভাতও জুটবেনা।
‘যত তাড়াতাড়ি পারি আমি চলে আসছি। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো।’ শেষবারের মতো তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে নেমে পড়লাম আমি।
আমার শার্টের ভেতর কেমন যেন এক উষœতা, কেমন এক সুবাস। মেয়েটা কিছু সময়ের জন্য আমার শার্টটা পরেছিলো তাতেই...।
আমি অনেক কষ্টে অন্যদিকে মনোযোগ দিলাম। হেঁটে নেমে এলাম পুরানা পল্টন এর মেইন রোডে। উল্টো দিকে বায়তুল মোকাররম। সারি সারি স্বর্নের দোকানগুলো যেন রূপকথার রাজকন্যার মতো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়। রাস্তা পার হয়ে আমি মার্কেটের সামনে এলাম। একটা স্বর্নের দোকানে ঢুকে পড়লাম। বৃষ্টিতে আটকা পড়া মানুষজন মার্কেট ছেড়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়। দোকানে কাস্টমার নেই। তিন চারজন সেলসম্যান বসে বসে চা খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে কাউন্টারের পিছনে।
‘আমি একটা নেকলেস বিক্রি করবো।’ আমি বললাম।
লোকগুলো তেমন কোন আগ্রহ দেখালো না আমার কথায়। আমি ভেবেছিলাম একথাটা শোনার সাথে সাথে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর। তারা আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এসব তারা প্রতিদিন শুনে দেখে অভ্যস্ত। একজন বয়স্ক সেলসম্যান আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। তারমানে দেখতে চাইছে জিনিষটা। আমি পকেট থেকে বের করলাম বর্ষার নেকলেসটা। লোকটা আমার হাত থেকে নেকলেসটা নিলো তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললো,‘আপনার বাড়ি কি বগুড়া ভাই?’
আমি অবাক হলাম। ‘না তা হবে কেন?’ ভ্রু কুঁচকে বললাম।
লোকটা মাথা নাড়লো।‘অনেক দিন পর এই জিনিষ দেখলাম। কতো টাকা নিয়েছে আপনার কাছ থেকে?’
‘কতো টাকা মানে?’
‘মানে এটা তো সোনার নেকলেস নয়। ইমিটেশনের। তবে খুব যতœ করে বানানো যাতে আসল না নকল চেনা না যায়। দেখলেন না আমার চিনতেও কতো সময় লাগলো।’
‘পাগল নাকি? এটা একজনের মানে খুব গরিব এক পরিবারের শেষ সম্বল। এটা বিক্রি করে তাদের সংসার চলবে।’
‘তাদের সংসার যে এবার খুব ভালোই চলবে তা খুব বুঝতে পারছি।’ লোকটা দাঁত বের করে হাসলো। ‘আপনার চেহারা দেখেই বিষয়টা অনুমান করে নিয়েছি আমি। এসব তো কম ডিল করিনা রে ভাই। আপনি বড়া ঠকা ঠকে গেছেন এবার।’
আমি হতবাক, বিশ্মিত ও হতভম্ব। কি বলবো বুঝতে পারছিনা। বড় ঠকা বলতে কি মিন করতে চাইছে লোকটা?
লোকটাও বুঝতে পারলো আমি তার কথা ঠিকমতো গিলতে পারিনি। সে বললো,‘মানে যে আপনাকে এটা দিয়েছে সে কতো টাকা রেখে দিয়েছে আপনার কাছ থেকে?’
‘না টাকা রাখবে কেন? আমি নিজে...।’ আমার কথা আটকে গেল মাঝপথে। লোকটার হাত থেকে নেকলেসটা ছোঁ মেরে নিয়েই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলাম বাইরে। ছুটলাম যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা আবার বাড়তে শুরু করেছে। আমার কোনদিকে হুঁশ নেই। পাগলের মতো ছুটলাম পুরানা পল্টনের গলির দিকে।
হোটেলের লোকটা আমার দিকে বোবার মতো তাকিয়ে থেকে বললো,‘আমি কিন্তু আপনাকে ইশারা করতে চাইছিলাম ভাইজান। সে আমার ইশারা বুঝতে পাইরা আপনারে অন্য কথায় নিয়া গেল, কইল আমার চোখ খারাপ। আপনে বুঝবার পারেন নাই।’
আমি হাঁপাচ্ছি,‘কোনদিকে গেছে সে?’
লোকটা উল্টোদিকে ইশারা করলো,‘হ্যার গাড়ি দাঁড়াই ছিলো ওদিকে। আপনি যাইতেই হ্যায় গাড়িতে উইঠাই চইল্লা গেল।’
আমি পকেট থেকে নেকলেসটা বের করলাম,‘ও যেসব কথা বললো সব কি মিথ্যা?’
‘কইতে পারুমনা ভাইজান। হ্যাদের গ্রুপ অনেক বড়ো আর শক্তিশালী। আপনে ওরে কতো দিসেন ভাইজান?’
‘পঁচিশ হাজার।’
‘ইশ ঈদের আগে আপনেরে এক্কেরে খালি কইরা দিয়া গেসে।’লোকটা মাথা নাড়লো।‘আমার সন্দেহ হইসিলো হ্যার কথা হুইনা। আমি বেশি কথা কইলে হয়ত: আপনে আমারে মাইর দিতেন। তাই কিছু কইতে সাহস পাই নাই।’
আকাশ তো অনেক আগেই আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়ে আছে। ওটাকে সরানো দরকার। মনে মনে চিন্তা করলাম কোথায় যাই। এতো টাকা বোকার মতো হারালাম। চুপচুপে ভিজে ঝড়ো কাকের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বাড়ি গিয়ে মায়ের সামনে পড়ার মতো সাহস রইলোনা বুকে। আগামীকাল ঈদের শপিং করতে যাবার কথা। তাছাড়া পাত্রী পক্ষ আসবে আমাকে দেখার জন্য। কোথায় পাবো টাকা? মায়ের জন্য একটা শাড়ী কেনার কথাও আছে। বর্ষার জন্য কিছু একটা করতে চাইছিলাম অথচ বর্ষার মতো আমার নিজেরই অবস্থা এখন। রাস্তায় নেমে এলাম আমি। বৃষ্টি আবার কমেছে। ভেজা শার্ট পরে হাঁটতে লাগলাম বাড়ির দিকে। এখন মনে হচ্ছে সুবাস নয়, পচা দুর্গন্ধ আসছে শার্টটা থেকে। মেয়েটা আমার পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে নকল সোনার একটা গহনা ধরিয়ে দিয়ে গেছে আমাকে। যাই হোক, ধরা একটা খেয়ে গেছি। এটা নিয়ে বেশিক্ষন ভাবা যাবেনা। টাকা হাতের ময়লা। এখন কোথাও থেকে ঈদের শপিং করার টাকা ম্যানেজ করতে হবে। একটা রিকসা ডেকে উঠে বসলাম আমি।
আমি চলে যাবার পর পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করলো হোটেলের বুড়ো লোকটা। বাইরে বেরিয়ে এদিক সেদিক তাকালো তারপর একটা নম্বরে ডায়েল করলো। আরেকটা বাড়ির ভেতর থেকে বর্ষা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে ঢুকলো বেড়ার হোটেলটাতে। হাতব্যাগ থেকে রাবার ব্যান্ডে বাঁধা নোটগুলো তুলে দিলো লোকটার হাতে,‘এসব আমি আর করতে পারবোনা বাবা।’ রাগ দেখিয়ে বললো সে। ‘তোমার বানানো কথা বলে মানুষকে এভাবে ঠকানো পছন্দ করিনা আমি।’
‘কি করবো রে মা? এই ছোট্ট জায়গার দাম হইলো বিশ লাখ টাকা। মাসে দিতে হয় পনেরো হাজার টাকা। তোদের পড়াশোনা,খাওয়া দাওয়া এসব কোত্থেইকা চালাই?’
‘এটাই শেষ। আর পারবোনা।’ গজ গজ করতে করতে বললো বর্ষা। পা বাড়ালো রাস্তায়।
‘মা তানিয়া।’ পেছন থেকে ডাকলো বুড়ো।
‘বলো?’
‘এই পাঁচশো টাকা তোর কাছে রেখে দে। এতো কষ্ট করলি।’
‘লাগবেনা। বাড়ি ফেরার সময় আমার জন্য কিছু ফুল কিনে এনো। আজ আমার জন্মদিন।’
কি অসাধারন কি অসাধারন! বুঝতে পারলাম না কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল! লেখক পাঠককেও সম্মোহন করে ফেলেছেন যে শেষের ঘটনাটা একেবারে অনুমান করা যায়নি যে কি ঘটতে চলেছে। ভাবছিলাম বোধহয় প্রেম হয়ে গেল। আর এখন আরেক কাহিনী। বাহ বাহ বাহ বাহ
Replyধন্যবাদজ্ঞাপন করছি।
Reply