অজ্ঞাতনামা কিশোর..........................সাকিব প্রধান অনিক

পৃথিবীটা গ্রহ, উপগ্রহ, মহাকাশের কণা; এসব বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা। আমার কাছে পৃথিবী অনেকগুলো গল্পের উপর টিকে থাকা গ্রন্থমালা। এই পৃথিবীর বুকে বাস করা প্রতিটা মানুষের গল্প আছে। কিন্তু সবসময় মানুষ নিজের গল্পের প্রধান চরিত্র হতে পাড়েনা। অন্য আরেকজনের গল্পের মধ্যেও সে প্রধান চরিত্র হয়ে উঠে। এই সুযোগটা সে পায় কারন, যার গল্প সে উপলব্ধি করতে পাড়ে না যে, তারও একটা গল্প আছে। 


স্মাইল নারায়নগঞ্জ শাখা একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন। এটি  যখন যাত্রা শুরু করে তখন তাদের ইচ্ছের দেয়াল ও মে দিবসে পথচারিদের শরবত বিতরন কর্মসূচি পালনের পরে আবিরের স্মাইলে যোগ দেওয়া। যেদিন প্রথম এই সংগঠনটির কথা জানতে পেড়েছিল আবির সেদিনই রাজি হয়েছিল। আসলে অন্যদের মতন করে বলব না যে, আবির খুব আগে থেকেই এমন কাজ করতে চেয়েছিল। যখন জানল স্মাইল এমন একটা সংগঠন, যারা পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে চায়, তখন শুনে ভালো লাগল। কারন শহরতলীর রাস্তা গুলোতে যখন সে দেখত এই পথশিশুগুলো ফুল বিক্রি করছে, ময়লা টোকাচ্ছে, মানুষ ওদের গাল মন্দ করছে, ভিক্ষা করছে বা তার কাছেই এসে বলছে —"ভাইয়া কিছু খাই নাই টাকা দেন। কিছু খামু।" বড় কষ্ট লাগত। সে কষ্টে বুকে হা হা কার না জমলেও ওদের জন্য কিছু না করতে পাড়ার অসহায়ত্ব ভেতরটাকে কুড়িয়ে দিত। তাই নিজেকে আর আটকে রাখেনি, স্মাইলের সদস্য হয়ে গেল। 

স্মাইল একে একে ইচ্ছের হাসি স্কুল,বৃক্ষরোপণ কর্মসুচি, এতিম ছেলেপুলের সাথে ইফতার করা,ঈদ প্রসাধনি বিতরন, গ্রীষ্মের ফল বিতরন ; ইভেন্টগুলো করল। আবিরের ভেতর থেকে মনে হচ্ছিল,সে শুধু সাক্ষী হল এসবের। তখনো পর্যন্ত এটা বলার সাহস পায়নি যে— "আমিও কিছু করেছি।" অন্তত নিজের কাছে বলার মতন গল্প সে তখনো স্মাইলে থেকে তৈরী করতে পাড়েনি। কিন্তু নিজের গল্প না হোক অন্য কারো গল্পে নিজেকে জুড়ে দিয়ে যে, নিজের একটা গল্প হতে পাড়ে সেটা আবির বুঝল সেদিন, যেদিন স্মাইল নারায়ণগঞ্জ শাখা একটা ক্ষতবিক্ষত কিশোরকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেল। আর নগরীর অন্যতম বৃহৎ ৩০০ শয্যা হাসপাতাল, খানপুরে নিয়ে এলো। কিশোরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, আর তার অভিভাবক তখন স্মাইল নারায়ণগঞ্জ শাখা। আর স্মাইল যেহেতু তার অভিভাবক তার মানে প্রতিটি সদস্যই তার অভিভাবক। কিশোর তার নাম ঠিকানা কিছুই বলে না। যে তার কাছে যায় সে তার দিকেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, তার চাহনিতে একটা নির্ভরতা খোজার চেষ্টা সারাক্ষন!

তার শরীর জুরে ক্ষত। চামড়া ছিলে গেছে পিঠের, কোমড়ের,পায়ের। ভেতরের শ্বেত মাংশপেশী দেখা যাচ্ছে আর শরীরটা যেন বাকলাহীন খসে পড়া নিম গাছের মতন হয়ে গেছে। নিম গাছের যেমন বাকলা খসে পড়লে কষ বেড় হয় তেমন করে তার শরীরেও লাল রক্ত জমাট বেধে বসে আছে। ধরলেই টপটপ করে গড়িয়ে পড়বে। আবিররা আন্দাজ করে নিল হয়তো সে ভিক্ষা করত। তার বয়সের ছেলেরা এ কাজই করে। আর তার পড়নে ভিক্ষুক ছেলেদের গায়ে যেমন ছেড়া ময়লা পাতলা পোশাক থাকে সেরকম পোশাক ছিল। আঙ্গুলের খোচায় সে জামা প্যান্ট ছিড়ে যাবে। ডাক্তার বলেছিল তার শরীরের যে ক্ষত, তা রাস্তার কংক্রিটের পীচের ওপর আছড়ে পড়ার ক্ষত। হয়তো কোন গাড়িতে ঝুলে পড়েছিল আর ছিটকে পড়েছে। 

প্রায় ১৫ দিনের মতন তার ট্রিটমেন্ট চলেছে।  এক এক দিন স্মাইল নারায়ণগঞ্জ শাখার এক একজন সদস্য যেত। কারন ডাক্তার বলেছিল তার শরীরের ব্যান্ডেজ দুই দিন অন্তর অন্তর বদলাতে হবে। এমনি একদিন এলো যেদিন অভিভাবক এর সেই ফাকা জায়গা পুর্ন করতে আবির আর শুভ ভাইয়ের যাওয়ার পালা। সেদিনের অভিজ্ঞতায় আবিরের জন্য তিনটি বিষয় ছিল নতুন।

প্রথমত, খানপুর হাসপাতালে তার প্রথম অন্দর প্রবেশ। হরেক রকমের রোগী গিজ গিজ করছে। আমরা মানুষেররা হাসপাতালে আর জেলখানায় পোকার মতন বিচরন করি। এর আগে কখনো সে এই হাসপাতালে আসেনি। 

দ্বিতীয়ত, আবির সেইদিন প্রথম কোন এমন রোগীকে এত কাছ থেকে দেখেছিল, যার শরীরের সব জায়গা ক্ষতবিক্ষত। সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে। লাল জমাট বাধা রক্ত। সে এমন কিছু এর আগে এত কাছ থেকে দেখিনি। কাউকে বুঝতে দেয়নি যে, তার লোম কাটা দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু কেন জানি সামনে গেল কিশোরের। কিশোরের চোখ আবিরের দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়েছিল। সে হয়তো আবারো নির্ভরতা খুজচ্ছিল। আবির তার সমস্ত শরীর দেখে হা করে বসে রইল, কিভাবে ও এখনো শান্ত নয়নে বসে আছে? সে তো সামান্য ব্লেডের পোচেই কাতরায়। ওই কি আবিরের থেকেও বেশি শক্তিশালী! ওর দুনিয়াতে কি ব্যাথাকে সহ্য করার এত সাহস আল্লাহ দিয়ে দিয়েছে! 
আবির কিশোরের নাম জিজ্ঞেস করল কয়েকবার, প্রতিবারেই নিজের ভিন্নভিন্ন নাম সে বলে গেল। ওর ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেই বলে শুধু ট্রেন এর কথা। শুভ ভাই বলল, খুব সম্ভবত কমলাপুর রেলস্টেশনে ওর বেড়ে উঠা হয়েছে। শুভ ভাই জিজ্ঞেস করলেন— "আর কে কে আছে তোর পরিবারে?", ও এই কঠিন প্রশ্নের জবাব আঊরাতে লাগল, তখন পাশের সিটের একজন রোগী বলল, নাস্তা করাতে। আবির সেদিন প্রথম কোন পথশিশুকে নিজের হাতে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিল। না আনন্দ হচ্ছিল, না দুঃখ! বেনামী অনুভূতি ছিল তা। ছেলেটি ভাইয়া বলে সম্বোধন করল খাওয়া শেষে। আর আবিরের তার প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া প্রতিটা লোকমা সে মুখে তুলে নিল। আর এক সময় হঠাৎ কেদে দিল। মনে হয় মায়ের কথা বা যার কাছে বড় হয়েছে তার কথা মনে পড়েছিল। আবির ওর কাছ থেকে চোখ সড়িয়ে নিল। শুভ ভাইকে বলল বাকী খাবার খাইয়ে দিতে। 
তারপর দুপুরে ডাক্তার বলল— "ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করাতে হবে, যারা এসেছেন একটু ওকে ধরে বসান আর ওকে ধরে রাখেন। ও হাত পা নাড়া চাড়া বেশি করে।" 

আবির কিশোরের উঠে বসার পর পিঠের অংশ দেখে হা করে রইল। ধরবে কোথায়? হাত রাখবে কোথায়? সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে। নির্মম দৃশ্য! 
শুভ ভাই জোর করল। আবির ওর কাধ চেপে ধরল ঠিকই কিন্তু ওর দিকে তাকায়নি। কারন সে ড্রেসিং করার সময় কিশোরের চিৎকার সহ্য করতে পাড়ছিল না। ডক্তার মেডিসিন দিচ্ছে আর কিশোর ছেলেটি চিৎকার করে বলছে — "ভাইয়া, ভাইয়া।" 
আবির তার এতটুকু আর্তনাদে এটা বুঝল যে, ছেলেট কখনো তার মাকে দেখেনি। যে মায়ের ভালোবাসা পায় না, তারা ভীষন ভয়েও মায়ের নাম মুখে নেয় না। কারন তাদের মানসপটে মা নামের কোন অস্তিত্বই নেই। আসলে সব শিশুর পৃথিবীতে প্রথম স্থান মায়ের কোল হয় না, কারো কারো জন্মের পর ডাস্টবিন, ময়লার ঝোপ, ট্রেনস্টেশন হয় আলো বাতাসের ঠিকানা। তাহলে মায়ের শরীরের ওম ছাড়াও শিশু বাচে, কিন্তু সে মানুষের মতন বাচে না আবার পশুর মতনও বাচে না। কারন পশুরাও নিজের সন্তানকে জন্মের পর ছেড়ে যায় না যতক্ষন পর্যন্ত না সে নিজের খাবার যোগার করা  শিখে। তারা বাচে  ঝড়া পাতার মতন। কেউ তা কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলে বা আগুনে পোড়ায়, কেউ হাতে তুলে নিয়ে তাতে কবিতা লিখে রাখে। তারা ঝড়া পাতা!

তৃতীয়ত, সেদিন প্রথমবারের মতন আবির বুঝেছিল সম্পর্ক রক্তের, বন্ধুত্বের, ভালোবাসার নয় শুধু। সম্পর্ক ক্ষনিকের জন্য হলেও নিখাত সত্য। বরঞ্চ দির্ঘ সম্পর্কগুলোই আধা সত্য আর ভাড়ি মিথ্যের। আর ক্ষনিকের এই অজ্ঞাতনামা শিশুটির সাথে আবিরের সম্পর্কটা মানবতার। 

ছেলেটি যখন হাটাচলা শুরু করে তারপর ছেলটিকে তার নিজ জায়গায় ছেড়ে আসে স্মাইল নারায়ণগঞ্জ শাখা। তাকে আমরা বিদায় দেইনি সেদিন।  সেটাকে আদৌ কি বিদায় বলে? তাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। আসলে বিদায় দেই তাদের যাদের ফিরে আসার পিছুটান থাকে। ওর পিছুটান নেই, যা তার সেই জন্মলগ্ন থেকেই নেই। হয়তো আজ সে রেললাইন এর টোকাই হয়ছে কোন অজানা সেইদিনের কারো ছেড়ে আসা বা ফেলে আসার কারনেই। 

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Anonymous
October 7, 2020 at 12:36 AM

সুন্দর গল্প। যদিও গল্প নয় অভিজ্ঞতার ঝুলি

Reply
avatar
Mahboob
October 12, 2020 at 3:07 PM

Osadharon valo legeche

Reply
avatar
মাইনুল কবির ভাটরহাটা, রাজশাহী
October 12, 2020 at 3:09 PM

গরিবের কষিট কেউ বুজেনা স্যীর

Reply
avatar