মন অরণ্যের শূন্যতা ( পর্ব ২)........জান্নাতুল ফেরদৌসী

নীলাম্বরীদের বাসাটা খুবই সাদামাটা। একতলা বাসার দেয়ালগুলো বেশ পুরোনো আর রঙ উঠে গেছে বেশ খানিকটা। স্যাঁতসেঁতে একটা ভাব পুরো বাসার মেঝেতে। জরাজীর্ণ আঙিনায় একটা বিশাল বড় আমগাছ। সেই গাছে গ্রীষ্মের সময় বেশ আম ধরে আর কাল বৈশাখী ঝড় হলে তো কথাই নেই। নীলাম্বরী, তার ছোটভাই শ্যামল আর ওদের মা বাবা একসাথে সবাই আম কুঁড়োতে ছুটে যেত। সে যে কি আনন্দের সময় ছিলো ভাবতেই নীলাম্বরীর খুব আফসোস হয়, কেনো যে সেই দিনগুলো আবার ফিরে আসেনা! এখন আর সেই স্বর্ণযুগ নেই ওদের। নীলাম্বরীর বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী, বেশ কয়েকবছর আগেই রিটায়ার করেছেন। মা দু'বছর ধরে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। বাকি রইল এক ভাই, সে পড়ছে ক্লাস নাইনে। পেনশনের স্বল্প টাকা দিয়ে ওদের সংসার চলে গেলেও, নীলুর মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে বেশ বেগ পেতে হয় ওদের।
তাই নীলাম্বরী নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু ছাত্রছাত্রী পড়ায়। কিন্তু মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে যেন তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে। সংসারের একটা অদৃশ্য কঠিন বোঝা যেন ওকে দিন দিন কোনঠাসা করে দিচ্ছে। তার এমন ছকে বাঁধা জীবন ভালো লাগেনা। তার ইচ্ছে করে একটা দুরন্ত,মুক্ত,উচ্ছ্বাসের জীবন পেতে। মন চায় নীল আকাশের নীচে খোলা প্রান্তরে প্রানভরে গান গাইতে। মাঝে মাঝে কেন যেন তাই নীলাম্বরী কণিকার জীবনটা পেতে চায় কারন কণিকা তো একাই, ওর নেই কোন বাঁধা, নেই কোন পিছুটান! রয়েছে কেবল বিশাল বড় প্রাসাদ আর প্রাচুর্য। কাঁধের ব্যাগ টা নামিয়ে নীলাম্বরী হাতমুখ ধুয়ে এলো। তার মনে পড়লো মায়ের ওষুধটা দেবার কথা। সে ব্যাগ খুলে মায়ের ওষুধটা বের করতে গিয়ে খেয়াল করলো তার ব্যাগে পাঁচশো টাকার বেশক'টি নোট। এতো টাকা কোথা থেকে এলো?! পরক্ষনেই তার মনে হলো এটা কণিকার কাজ। সে এমন এর আগেও করেছে। কিভাবে যেন কণিকা বুঝে যায় যে নীলুর মন কখন কেনো খারাপ থাকে বা তার আসলে কি সমস্যা। এই যেমন আজ! নীলু এই টাকার অভাবেই মায়ের কিছু টেস্ট করাতে পারছিলোনা বলেই মন খারাপ করে পুকুরপাড়ে বসে ছিলো, সেটা কণিকা বুঝে গেছিলো আর তাই সে এতোকিছু করে নীলুকে তার বাড়িতে নিয়ে গেছিলো। নীলাম্বরীর খুব লজ্জা হয়। সে এর আগেও এভাবে কণিকার দেয়া টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলো এমনকি ওকে বলেছিলো এভাবে না চাইতে টাকা না দিতে। কিন্তু কণিকা কখনোই একবার দেয়া টাকা ফেরত নেয়নি। বারবার বলেছে "আজ আমার মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এটাই করতেন আর আমি চাইনা আমার মত তুইও মা হারা হয়ে পড়!" নীলু ভাবে সত্যিই তো! তার তো এখন মাকে বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, কি দরকার এতোসব ভেবে! নীলুদের ক্যাম্পাসটা অনেক বড়। অনেকবছরের পুরোনো গাছ আর বিল্ডিং এর জন্য ক্যাম্পাসের চেহারাটাই কেমন যেন একটু গম্ভীর গম্ভীর লাগে দেখতে। কিন্তু আসলে দেখতে গুরুগম্ভীর হলেও ওদের ক্যাম্পাসটা ভীষণ প্রানবন্ত আর উদ্দীপনায় ভরপুর। তারুণ্যের যেই উচ্ছ্বাস এখানে আসলে দেখা যায় তা হয়তো অনেক ক্যাম্পাসেই নেই বলে ধারণা নীলুর। যদিও তার অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখার সুযোগ হয়নি। তবুও ক্যাম্পাসে আসলেই নীলুর মন যেন প্রান খুঁজে পায়। 
-কিরে রিচি কেমন আছিস? গতকালের লেকচারটা আমাকে দিস তো! বললো নীলু। 
-হুম আছি বেশ ভালোই। এই শোন, গতকাল যা দারুণ একটা নিউজ দিয়েছে না স্যার আমাদের! রিচির চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো। 
-কি নিউজ? 
-আমাদের ক্যাম্পাস থেকে ৭ দিনের শিক্ষা সফরে যাওয়া হবে! জানিস কোথায়? বান্দরবানে! ওখানের সবগুলো ঝর্ণা আর পর্যটনকেন্দ্র গুলো ঘুরানো হবে! শুনেই আমার কি যে আনন্দ লেগেছে জানিস না! আমিতো এখনই সব গুছানো শুরু করে দিয়েছি, তুইও শুরু করে দে নীলু! 
রিচি, নীলুদের বন্ধুমহলের একজন। হাসিখুশি মেয়েটা খুব অল্পতেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে শিশুদের মত বেশ শোরগোল তৈরি করে ফেলে। যদিও ব্যাপারটা নীলু খুব পছন্দই করে। জীবনে অল্পতেই খুশি থাকতে পারাটাও যে অনেক বড় গুণ! আর এই শিক্ষাসফরের বিষয়টা তো রীতিমতো খুশিরই খবর! নীলু কখনোই তার জেলার বাইরে দূরে কোথাও ঘুরতে যায়নি। ঝর্ণা দেখার তার খুব ইচ্ছে ছিলো, এবার মনে হয় সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। ভাবতেই নীলুর খুশিতে মনটা ভরে গেলো। 
এরইমধ্যে কণিকাও চলে এলো। তাকেও শিক্ষাসফরের খরবটা দিতেই সেও বেশ উল্লাসে মেতে উঠলো। তারা সবাই ঠিক করলো যে ক্লাস শেষে তারা একটা লিস্ট করবে যে তাদের এই ট্যুরে কি কি নিতে হবে আর তারা কি কি আনন্দ করবে! ক্লাস শেষে তারা সেই লিস্ট করতে তাই সোজা বড় মাঠে গিয়ে বসলো। ওদের ক্যাম্পাসে দুইটা মাঠ, একটা ছোট আর আরেকটা বেশ বড়। ওরা সাধারণত বড় মাঠটাতেই আড্ডা দেয়। বড় মাঠে বিভিন্ন সংগঠন, পলিটিকাল পার্টি ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বৈঠক বসে। ছোট মাঠটা অঘোষিতভাবে ক্যাম্পাসের কপোত-কপোতীদের দখলে চলে গেছে। 
সেখানে গেলে নাকি সবচেয়ে নীরস কর্কশ মানুষেরও মনে প্রেম ভুত ভর করে, এমনই কথার প্রচলন রয়েছে। তাই সবাই অলিখিতভাবেই ছোট মাঠের নাম দিয়েছে "প্রেমনগর"। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হলো নীলুদের আরেক বন্ধু সুব্রত প্রায়ই সেই প্রেমনগরে গিয়ে শুয়ে বসে থাকে, এই আশায় যে তার কাছেও একদিন সেই স্বপ্নের রমনী আসবে, প্রেমময় হবে তার জীবন আর সেই প্রেমবোধ থেকে সে লিখে ফেলবে গদ্য, পদ্য, কাব্য, মহাকাব্য! কিন্তু হায়! এতোদিনেও তার কোন গতিই হলোনা, তবুও সে হাল ছাড়েনা। রোজ ক্লাসের পরে সে ওখানে যায় আর কোন একা মেয়ে দেখলেই কথা বলার চেষ্টা করে। এভাবে দুই একবার সে মারও খেয়েছে বটে! তবুও সে "একবার না পারিলে দেখো শতবার" মন্ত্রে দীক্ষিত যোদ্ধা!

নীলুরা বসে গল্প করছিলো এমন সময় শুভ্র এসে বসলো ওদের পাশে। ওদের আলোচনা শুনে সে হুট করে বলে ফেললো, -হুম আমিও যাবো তোমাদের ট্যুরে। 
সাথে সাথেই কণিকা চটাং করে বললো, -আপনি? আপনি কেনো যাবেন আমাদের সাথে? আপনার কি নিজের কোন বন্ধু নেই? তাদের সাথে বেড়াতে যান! 
-হুম আমার বন্ধু আছে আর ওরাও যাবে তোমাদের সাথে। আমি যতদূর জানি এই ট্যুরটা ওপেন ফর অল মানে ভার্সিটির যেকোন ব্যাচের যে কেউ যেতে পারবে। 
-আহ! বাদ দে না কণিকা! যেতেই যখন চাচ্ছে শুভ্র ভাই, তাহলে চলুক না! বরং আরো বেশি মানুষ হলে মজাও হবে বেশ! বললো নীলু। 
নীলুর উচ্ছ্বাস দেখে কণিকা নিশ্চুপ হয়ে গেলো।


আজ সকাল থেকেই নীলুর মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। নীলু মায়ের ঔষুধ খাইয়ে ক্লাসের জন্য বের হবে, রাতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ভেবেছে। বাসার সামনে নীলু রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ শুনতে পেলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। 
- নীলু, এই নীলু! এই যে এইদিকে! 
- আরে শুভ্র ভাই আপনি! এখানে কি কাজে? 
- এই একটু কাজ ছিলো এদিকটায়, তুমি কি ক্যাম্পাসে যাচ্ছো? 
- জি। 
- ও তাহলে চলো একসাথে যাই আমিও ক্যাম্পাসেই যাচ্ছিলাম। 
নীলু শুভ্রর কথা ফেলতে পারলোনা। শুভ্রর সাথে নীলুর যেদিন প্রথম দেখা হয়, সেইদিনের কথা নীলুর এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ভার্সিটিতে ভর্তির পর সেইদিনই প্রথম ক্লাস ছিলো। আনন্দ, উত্তেজনার একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে নীলু প্রথম ক্লাস শেষ করে বের হয়েছিলো, ঠিক তখনই প্রায় ৭-৮ জন ছেলে নীলুকে ডাক দিয়েছিলো। - এই মেয়ে, হ্যা তুমিই, এদিকে এসো! 
নীলু একটু অবাক হলো অপরিচিত এতোগুলো ছেলে কেনো ওকে ডাকছে ভেবে। 
- হুম কি নাম তোমার? একজন দুষ্টু হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো। 
- নীলাম্বরী 
- ওরে বাবা! নীলাম্বরী! এতো দেখছি কবিতার বা গল্পের নায়িকাদের নাম! তুমি জানো এই নামের অর্থ? 
- হুম জানি। নীল রঙের শাড়ি। একটু অস্বস্তিভরে নীলু বললো। 
- কিন্তু আমরা তো দেখছি তুমি একটা শ্যামলা রঙের মেয়ে। নীল রঙের শাড়ি না! তাহলে এই নাম কেনো? 
বাকি সব ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠলো। 
নিলু খুব অপমানবোধ করেছিলো কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছিলোনা কারন সে একা ও নতুন এখানে। অন্যদিকে ওরা ছিলো নীলুর সিনিয়র ও সংখ্যাগরিষ্ঠ। নীলু এটাও বুঝেছিলো যে ওরা তাকে অপমান করতে বা র‍্যাগিং দিতেই ডেকেছে। হঠাৎ করে বিকটশব্দে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলো! সবাই দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড়াতে লাগলো। যে যেদিকে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। নীলু দেখলো ওর সামনের একটা ছেলেও নেই সবাই নিমিষেই পালিয়েছে। কিন্তু নীলু আতংকে আর ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলু খেয়াল করলো হুট করে কে যেন ওর হাতটা ধরে একটা হেঁচকা টান দিলো তারপর দৌড়াতে লাগলো। নীলুও কিছু না বুঝে পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। কিছুদূর দৌড়িয়ে যাওয়ার পর ওরা একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়ালো। 
দুইজনই বেশ হাঁপাচ্ছে। নীলু দেখলো একটা লম্বা, সুঠামদেহী, শ্যামবর্ণের সুদর্শন ছেলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 
- তুমি কি পাগল নাকি? এমন পরিস্থিতিতে কেউ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকে নাকি বোকার মত? আরেকটু হলে তো মরতে বসেছিলে! ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো। 
- না মানে ইয়ে... নীলুর মুখ দিয়ে আর কথা বের হয়না। 
- শোন, ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে এমন ঘটনা ঘটে, পলিটিকাল পার্টিদের মধ্যে গোলাগুলি হয়, তখন নিজের সেফটি নিজেকেই বুঝতে হবে। যাই হোক, আমি শুভ্র আর তুমি? নীলু কেবল তাকিয়েই থাকে আর ভাবে সে এখন নিরাপদে আছে। এমন নিরাপদ বোধ তার আগে কখনো হয়নি। এটা আসলে নিরাপত্তা নাকি অন্যকিছু? নীলু ভেবে পায়না। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই ক্যাম্পাসে তাদের দেখা, কথা হতে থাকে। নীলুর ভালো লাগে শুভ্রর সঙ্গ। তার জানতে ইচ্ছে করে শুভ্ররও কি একই অনুভূতি হয়?

(চলবে....)

শেয়ার করুন
ইহাই নতুন পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Rakib 01772390098
June 26, 2021 at 2:27 PM

darun hoyeche

Reply
avatar