পালকিতে চড়া যে এতটা ঝক্কির কাজ সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না শায়লার। ও মনে করেছিল খাটে ওঠার মতোই উঠে যেতে পারবে চারকোনা বাক্সের মধ্যে। কিন্তু বাঁধ সাধলো মনখানেক পাথর পুঁতি বসানো ওর মিরপুরের বেনারসি শাড়িটা। চারদিকে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামের মেয়েদের মধ্যে হাসির একটা রোল উঠলো। হঠাত্ করেই কোত্থেকে এগিয়ে এলো রুপম....শায়লার স্বামী; দেখিয়ে দিল কিভাবে পালকিতে উঠতে হয়। বিয়ের সময় করা মায়ের পালকিতে চড়ার ভিডিও দেখে শায়লার পাঁচ বছরের মেয়ে মিতি তার দাদার কাছে বায়না ধরেছে সেও পালকিতে চড়বে। চড়বে সোনা চড়বে তোমার বিয়ের সময় আমি একটা রুপোর পালকি নিয়ে আসবো....মিতি কে তার দাদার সান্ত্বনা! কিন্তু মিতি কে মানায় এমন সাধ্য কার? তাঁর নাতনিটা যে একটু জেদি। তাই ঈদের ছুটিতে বেড়াতে আসা নাতনির মন রক্ষার্থে একটা দুই বেহারার পালকির ব্যবস্থা করেছেন হাসান সাহেব। মিতি উঠে বসেছে পালকিতে আর গ্রামের এক দঙ্গল বাচ্চাকাচ্চা পালকির পেছনে পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে পুরো গ্রাম জুড়ে। রুপম পুরো দৃশ্যটা ভিডিওবন্দি করছে। হাসান সাহেব কিছুদূর দৌড়ে আর না পেরে তাঁরই স্কুলের বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে বসে পড়লেন। কি অদ্ভুত সুন্দরই না লাগছে দৃশ্যটা! ধানক্ষেতের আল ধরে ছুটছে পালকিটা আর মিতি সোনা মাঝে মধ্যেই মাথা বের করে দেখছে সবাই ঠিকঠাক মতো তার পালকির পেছনে আসছে কিনা? সবাই আছে কিন্তু দাদা ভাই কেই শুধু দেখা যাচ্ছে না । ধানক্ষেত ঘুরে একসময় পালকি এসে থামলো স্কুলের মাঠে। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে পালকির সামনে দাঁড়ালেন হাসান সাহেব। আদর করে নাতনি কে পালকি থেকে নামিয়ে কোলে তুলে নিলেন। চারপাশে ভীড় করে থাকা বাচ্চারা অবাক হয়ে দৃশ্য টি দেখছে কারণ তারা হাসান সাহেব কে একরোখা ও বদমেজাজি হিসেবে চেনে; বেহারাদের কে যখন তিনি টাকা দিয়ে বিদায় দিচ্ছেন তখন মিতি তাদের বললো আপনারা কিন্তু আমার বিয়ের সময় আবার আসবেন....'আপনার বিয়ের সময় আরো বড় পালকি নিয়ে আসবানে' বলে বিদায় নেয় বেহারারা।
সন্ধ্যার দিকে একটা জরুরী কাজে ঘন্টা দুয়েকের জন্য বাইরে গিয়েছিল শায়লা। বারবার ঘড়ি দেখছিল। মিতি কে একদম একা বাসায় রেখে এসেছে বলে একটু টেনশন হচ্ছিল। এবার ও' লেভেল দিল মিতি। একমাস পরেই রেজাল্ট। টিভি দেখা, মোবাইলে গেম খেলা, গল্পের বই আর টুকটাক ওভেন কুকিং করেই কেটে যাচ্ছে মিতির ছুটির দিনগুলি। বাইরে থেকে ফিরতেই মাকে একটা সারপ্রাইজ দিল মিতি। এই দুঘন্টার মধ্যেই একটা চকলেট ব্রাউনি বানিয়ে ফেলেছে সে; ওয়াও মামনি গ্রেট!...এই বলে মেয়ের কপালে একটা চুমু দিল শায়লা। রসিয়ে রসিয়ে মা মেয়ে মিলে স্বাদ নিল ব্রাউনিটার। বাবার টা বক্সে উঠিয়ে রেখে ব্যাগ গুছাতে গেল মিতি। কাল এক সপ্তাহের জন্য ও দাদুরবাড়ি যাচ্ছে।
খুব সকালে রওয়না হল রুপম আর মিতি। শায়লার অফিসে দুই একটা জরুরী মিটিং থাকা য় ও আর যায়নি। শায়লা আর রুপম দুজনই আর্কিটেক্ট। ইন্টেরিয়র ডিজাইনিংয়ের একটা ফার্ম চালায় ওরা। মিতি কে পৌঁছে কালই ফিরবে রুপম। কিছুদিন আগে কেনা নতুন প্রিমিও গাড়ীটা বাবাকে দেখানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে সে। পাশে রাজকন্যার মতো বসে আছে মিতি। শহর ছেড়ে গাড়ী হাইওয়েতে উঠতেই স্পিড বাড়ালো রুপম, ড্রাইভিংয়ে কনসেনট্রেইট করলো। বাবার সাথে টুকটাক কথা বলছে মিতি আবার কখনো বা আনমনে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে সে....খুবই লো টিউনে বেজে যাচ্ছে শ্রীকান্ত আচার্যের গান। হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে রিফ্রেশমেন্টের জন্য থামতে হলো একবার। কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিয়ে যাচ্ছেন রুপমের বাবা....আর কতদূর? অপেক্ষা যে শেষ হচ্ছে না।
একটা সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন রুপমের বাবা হাসান সাহেব। রিটায়ারমেন্টের পরে গ্রামেই থাকেন তিনি। এক মেয়ে কানাডায় আর রুপম ঢাকায়। গ্রামে স্কুল করেছেন, মসজিদ করেছেন। অনেক দৌড়ঝাপ করে এবার স্কুলটাকে এমপিও ভুক্ত করতে পেরেছেন। জমিজমা, ফলের বাগান আর দুদুটো পুকুরে মাছ চাষের তদারকি করে চাকরি জীবনের চেয়েও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। ঢাকায় একটু কমই যাওয়া হয়। ছেলে মেয়েরা যখন আসে তখন কয়েকদিন যেন ঈদের আনন্দ নেমে আসে ওনার বাড়িতে। গ্রামের রাস্তাটাও পাকা মসৃণ হওয়াতে ড্রাইভিংয়ে খুব একটা কষ্ট হলো না রুপমের। বাসার কাছাকাছি আসতেই এক দঙ্গল কচিকাঁচা ওদের গাড়ীর পিছনে আসতে লাগলো। হর্ণ শুনে বেরিয়ে এলো মিতির দাদা দাদু। সালাম দিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরলো মিতি। বাবার সাথে কুশল বিনিময় করে যখন মায়ের সাথে কথা বলছে রুপম তখন সে খেয়াল করলো বাবা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে তার পার্ল কালারের প্রিমিও গাড়ী টা কে।
পুকুর থেকে তোলা দু তিন রকমের ছোট মাছ, কাতলা মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, আলু দিয়ে মুরগির পাতলা ঝোল আর লাল শাক ভাজা দিয়ে দুপুরের খাবার খেল ওরা। মিতি এরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে গাছ থেকে পেড়ে এনেছে পেয়ারা, আমড়া আর লটকন। বিকেলে চা খেয়ে রুপম বাবা মাকে তার নতুন গাড়ী করে বেড়াতে নিয়ে গেল এদিক ওদিক আত্মীয়ের বাড়ি। বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর মিতি বিকেলে যে একটা ঘুম দিয়েছে তা ভাঙলো একেবারে রাত আটটার দিকে। ঘুম ভাঙতেই মিতির মনে হলো আসার পর থেকে একবারের জন্যও কুসুম কে দেখেনি সে। কুসুম দাদুরবাড়ির বুয়ার মেয়ে তার থেকে চার বছরের ছোট। ছোট বেলার খেলার সাথী। একে ওকে কুসুমের কথা জিজ্ঞেস করলো মিতি কিন্তু কেউ কোনো সদুত্তর না দিয়ে শুধু মুখ টিপে হাসতে লাগল। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরে ঘুমুতে গেল রুপম। ঠিক করলো সকালে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে সে আবার ৭-৮দিন পর এসে মিতি কে নিয়ে যাবে।
বাবাকে বিদায় দিয়ে সকালের নাশতা সেরে পুকুর পাড়ের পাকুড় গাছের নিচে বানানো বেঞ্চিতে আরাম করে বসলো মিতি। বেশ কিছু গল্পের বই নিয়ে এসেছে সে....পার্সি জ্যাকসন, স্টিফেন কিং আর ফেলুদা সমগ্র। মিতির যেমন ভালো লাগে ফেলুদার গোয়েন্দা কাহিনী আবার সমান ভাবে উপভোগ করে পার্সি জ্যাকসনের গ্রীক মাইথোলজি আর স্টিফেন কিং এর paranormal গল্প গুলো। বাবার জন্মদিনে মায়ের দেয়া ক্যাননের ডিএসএলআর ক্যামেরাটাও সাথে করে নিয়ে এসেছে মিতি। ইচ্ছে আছে ঘুরে ঘুরে কিছু পাখির ছবি উঠানোর। পুকুর পাড়ের এই পাকুর গাছ আর ইউক্যালিপ্টাসের ডালে দোয়েল টিয়া তো বসেই এর আগের বার বুলবুলি আর ঘুঘুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দাদাজান। নারকেল গাছে বেশ কয়েকটি বাবুই পাখির বাসাও সে আজকে দেখেছে। মিতি যখন পার্সি জ্যাকসনের হিরোস অফ অলিম্পাস সিরিজে বুঁদ হয়ে আছে তখন হঠাত্ করেই কাঁধে একটা হাতের স্পর্শে চমকে উঠল সে! আরে এ যে কুসুম! শুকনো মুখে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। কিরে কুসুম কাল আসার পর থেকে যে তোর দেখা নাই? ১৩ বছরের কুসুম এবার পিএসসি পাশ করেছে। চোখের কোণে পানি চিকচিক করে কুসুমের। পায়ের আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে হিজিবিজি দাগ কাটতে কাটতে বলে মিতি আপু আমার যে বিবাহ! আঁ বলিস কি? বলে জোড়ে চিত্কার দিয়ে ওঠে মিতি। তুমি আমাকে বাঁচাও আপু... 'আমি আরো পড়বার চাই। কিন্তু বাপজান আমার বিবাহ ঠিক করসে পাশের গ্রামের এক পোলার লগে যার বয়স সতেরো আর হে আগেও একটা বিয়া বসছে। তোমার দাদাজান বিয়ার সব খরচ দিতাসে।' এ যে রীতিমতো বাল্য বিবাহ! ও' লেভেলে child marriage নিয়ে বেশ কয়েকবার রচনা লিখেছে মিতি। ইউনিসেফ বলছে বাংলাদেশে ৬০% মেয়ের ১৮ আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর গ্রামে ছেলেদের ২১ এর আগে বিয়ের প্রবণতা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে দাদার কাছে কুসুমের কথাটা ওঠালো মিতি। আসলে কি মিতি সোনা গ্রামে এই বয়সের মেয়েদের বাড়িতে রাখা খুব ঝামেলা। আশেপাশের বখাটেরা বিরক্ত করে। তাছাড়া ওরা গরীব বেশ কটা ছেলে মেয়ে তাই যত তাড়াতাড়ি পারে বিয়ে দিয়ে মেয়ে কে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু দাদা দেশের আইনে child marriage যে অপরাধ। আর তাছাড়া কুসুম যে আরো পড়তে চায়। সবই বুঝলাম মিতি কিন্তু আইন করেও যে বাল্য বিবাহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাছাড়া কুসুমের মতো গরীব পরিবারের মেয়ের স্কুল কলেজ পাশ করে কি লাভ? তাকে বিয়ে করার জন্য তো অন্তত বিএ পাশ পাত্র লাগবে। গ্রামে কি এই ধরনের ছেলে পাওয়া যাবে? আমি এটা মানিনা দাদাজান। কুসুম এসএসসি পর্যন্ত পড়বে তারপর সে একটা ভোকেশনাল কোর্সে ভর্তি হতে পারে এবং সেটা শেষ হতে হতে ওর ১৮ বছর হয়ে যাবে তখন ওর বিয়ে দেয়ার কথা ভাবা যাবে। দেখো মিতি সোনা ব্যাপারটা এতো সহজ না। ওরা ছেলেকে যৌতুক বাবদ ৫০হাজারের মধ্যে ২৫ হাজার দিয়ে ফেলেছে। একে তো বাল্য বিবাহ তার উপর আবার যৌতুক....থানায় জানালে পুলিশ এসে ওই সতেরো বছরের পাত্র কে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে....মিতি মনে মনে ভাবে। মিতি একটা কথা বুঝে উঠতে পারে না তার দাদার মতো সমভ্রান্ত, শিক্ষিত ও প্রভাবশালী মানুষ গুলো কেন এই বাল্য বিবাহ রোধে এগিয়ে না এসে উল্টো আরো নিশ্চুপ থেকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়? সমাজের প্রত্যেক স্তরের মানুষের সাহায্য না পেলে বাল্য বিবাহ আর যৌতুক প্রথা সরকার রুখবে কিভাবে? পরদিন কুসুমের বাবা মন্জুমিয়াকেও বুঝাতে ব্যর্থ হয় মিতি।
তিন চারদিন পেরিয়ে গেছে ; শায়লাকেও ব্যাপারটা জানিয়েছে মিতি। এখন শেষ অস্ত্র হলো রুপম। মিতি ভাবে বাবা যদি দাদা জানকে বুঝাতে পারে। বিকেলের দিকে ক্যামেরাটা নিয়ে একটু বেড়িয়েছে মিতি; সাথে কুসুমও আছে। তেঁতুল গাছের চুড়ায় বসে শিষ দিচ্ছে এক জোড়া ঘুঘু। এতবার উড়ছে বসছে যে ক্যামেরাবন্দি করতে মিতি কে নাকাল হতে হচ্ছে । হঠাত্ করেই মিতির মাথায় একটা বড় ইটের টুকরো দিয়ে দূর থেকে সজোরে আঘাত করে কেউ। ব্যথায় ককিয়ে উঠে ক্যামেরাটাকে সামলে মাটিতে বসে পড়ে মিতি। রক্তাক্ত হয়ে যায় তার হাত! চিত্কার দিয়ে ওঠে কুসুম। শেষ বিকেলের আলোয় হঠাত্ খেয়াল করে ধানক্ষেতের আল ধরে দৌড়ে পালাচ্ছে তার সতেরো বছরের হবু স্বামী!
দাদুর বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মিতি আর দাদাজানের উপরে রাগে ফুঁসছে; চারটা সেলাই পড়েছে মাথায়। পেইনকিলার আর এন্টিবায়োটিক দিয়েছে ডাক্তার। চিন্তা করে হুড়োহুড়ি করে ছুটে আসবে এই ভেবে বাবা মাকে জানাতে দেয়নি দাদাজান। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা সুখবর পেল মিতি। তার উপর এই আক্রমণ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি দাদাজান। সেদিন রাতেই কুসুমের বিয়েটা ভেঙ্গে দেন তিনি। পুলিশ কে ফোন দিয়ে ধরিয়ে দেন সেই গুনধর পাত্র কে। খুবই খুশি হয় মিতি। মাথা টা যেন হালকা লাগে। কুসুম এসে জড়িয়ে ধরে মিতি কে। শুক্রবার এসে আদরের মেয়ের এই অবস্থা দেখে খুবই অবাক হয় শায়লা আর রুপম। মা বাবাকে কিছুটা সময় জড়িয়ে ধরে বসে থাকে মিতি। শায়লা তার শশুর কে বলে এখন থেকে গ্রামে বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে সে মানুষ কে মোটিভেট করবে। তুমি শুরু কর আমি তোমার সাথে আছি...এই বলে অনুপ্রেরণা দেন শায়লার শশুর ।
রবিবার সকালে দাদা দাদুকে বিদায় জানায় মিতিরা। লাগেজ গাড়ী তে উঠানো হয়ে গেছে; আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি বলে মিতি হেঁটে যায় বাসা থেকে অল্প কিছু দূরে দাদজানের স্কুলে। গতকালই ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছে কুসুম; বিধ্বস্ত চেহারা তে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করেছে। মিতিকে দেখে হাত নাড়লো সে। লাইনে দাঁড়িয়ে সব ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কুসুম গাইছে প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত....
"কী শোভা কী ছায়াগো,
কী স্নেহ কী মায়াগো-
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে
নদীর কূলে কূলে।"
গাড়ীতে এসে বসে মিতি। ব্যান্ডেজ করা মাথাটা এলিয়ে দেয় পেছনের সিটে। পার্ল কালারের প্রিমিও গাড়ী টা গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে দ্রুতই এগিয়ে চলে হাইওয়ের দিকে।
সন্ধ্যার দিকে একটা জরুরী কাজে ঘন্টা দুয়েকের জন্য বাইরে গিয়েছিল শায়লা। বারবার ঘড়ি দেখছিল। মিতি কে একদম একা বাসায় রেখে এসেছে বলে একটু টেনশন হচ্ছিল। এবার ও' লেভেল দিল মিতি। একমাস পরেই রেজাল্ট। টিভি দেখা, মোবাইলে গেম খেলা, গল্পের বই আর টুকটাক ওভেন কুকিং করেই কেটে যাচ্ছে মিতির ছুটির দিনগুলি। বাইরে থেকে ফিরতেই মাকে একটা সারপ্রাইজ দিল মিতি। এই দুঘন্টার মধ্যেই একটা চকলেট ব্রাউনি বানিয়ে ফেলেছে সে; ওয়াও মামনি গ্রেট!...এই বলে মেয়ের কপালে একটা চুমু দিল শায়লা। রসিয়ে রসিয়ে মা মেয়ে মিলে স্বাদ নিল ব্রাউনিটার। বাবার টা বক্সে উঠিয়ে রেখে ব্যাগ গুছাতে গেল মিতি। কাল এক সপ্তাহের জন্য ও দাদুরবাড়ি যাচ্ছে।
খুব সকালে রওয়না হল রুপম আর মিতি। শায়লার অফিসে দুই একটা জরুরী মিটিং থাকা য় ও আর যায়নি। শায়লা আর রুপম দুজনই আর্কিটেক্ট। ইন্টেরিয়র ডিজাইনিংয়ের একটা ফার্ম চালায় ওরা। মিতি কে পৌঁছে কালই ফিরবে রুপম। কিছুদিন আগে কেনা নতুন প্রিমিও গাড়ীটা বাবাকে দেখানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে সে। পাশে রাজকন্যার মতো বসে আছে মিতি। শহর ছেড়ে গাড়ী হাইওয়েতে উঠতেই স্পিড বাড়ালো রুপম, ড্রাইভিংয়ে কনসেনট্রেইট করলো। বাবার সাথে টুকটাক কথা বলছে মিতি আবার কখনো বা আনমনে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে সে....খুবই লো টিউনে বেজে যাচ্ছে শ্রীকান্ত আচার্যের গান। হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে রিফ্রেশমেন্টের জন্য থামতে হলো একবার। কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিয়ে যাচ্ছেন রুপমের বাবা....আর কতদূর? অপেক্ষা যে শেষ হচ্ছে না।
একটা সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন রুপমের বাবা হাসান সাহেব। রিটায়ারমেন্টের পরে গ্রামেই থাকেন তিনি। এক মেয়ে কানাডায় আর রুপম ঢাকায়। গ্রামে স্কুল করেছেন, মসজিদ করেছেন। অনেক দৌড়ঝাপ করে এবার স্কুলটাকে এমপিও ভুক্ত করতে পেরেছেন। জমিজমা, ফলের বাগান আর দুদুটো পুকুরে মাছ চাষের তদারকি করে চাকরি জীবনের চেয়েও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। ঢাকায় একটু কমই যাওয়া হয়। ছেলে মেয়েরা যখন আসে তখন কয়েকদিন যেন ঈদের আনন্দ নেমে আসে ওনার বাড়িতে। গ্রামের রাস্তাটাও পাকা মসৃণ হওয়াতে ড্রাইভিংয়ে খুব একটা কষ্ট হলো না রুপমের। বাসার কাছাকাছি আসতেই এক দঙ্গল কচিকাঁচা ওদের গাড়ীর পিছনে আসতে লাগলো। হর্ণ শুনে বেরিয়ে এলো মিতির দাদা দাদু। সালাম দিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরলো মিতি। বাবার সাথে কুশল বিনিময় করে যখন মায়ের সাথে কথা বলছে রুপম তখন সে খেয়াল করলো বাবা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে তার পার্ল কালারের প্রিমিও গাড়ী টা কে।
পুকুর থেকে তোলা দু তিন রকমের ছোট মাছ, কাতলা মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, আলু দিয়ে মুরগির পাতলা ঝোল আর লাল শাক ভাজা দিয়ে দুপুরের খাবার খেল ওরা। মিতি এরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে গাছ থেকে পেড়ে এনেছে পেয়ারা, আমড়া আর লটকন। বিকেলে চা খেয়ে রুপম বাবা মাকে তার নতুন গাড়ী করে বেড়াতে নিয়ে গেল এদিক ওদিক আত্মীয়ের বাড়ি। বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর মিতি বিকেলে যে একটা ঘুম দিয়েছে তা ভাঙলো একেবারে রাত আটটার দিকে। ঘুম ভাঙতেই মিতির মনে হলো আসার পর থেকে একবারের জন্যও কুসুম কে দেখেনি সে। কুসুম দাদুরবাড়ির বুয়ার মেয়ে তার থেকে চার বছরের ছোট। ছোট বেলার খেলার সাথী। একে ওকে কুসুমের কথা জিজ্ঞেস করলো মিতি কিন্তু কেউ কোনো সদুত্তর না দিয়ে শুধু মুখ টিপে হাসতে লাগল। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরে ঘুমুতে গেল রুপম। ঠিক করলো সকালে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে সে আবার ৭-৮দিন পর এসে মিতি কে নিয়ে যাবে।
বাবাকে বিদায় দিয়ে সকালের নাশতা সেরে পুকুর পাড়ের পাকুড় গাছের নিচে বানানো বেঞ্চিতে আরাম করে বসলো মিতি। বেশ কিছু গল্পের বই নিয়ে এসেছে সে....পার্সি জ্যাকসন, স্টিফেন কিং আর ফেলুদা সমগ্র। মিতির যেমন ভালো লাগে ফেলুদার গোয়েন্দা কাহিনী আবার সমান ভাবে উপভোগ করে পার্সি জ্যাকসনের গ্রীক মাইথোলজি আর স্টিফেন কিং এর paranormal গল্প গুলো। বাবার জন্মদিনে মায়ের দেয়া ক্যাননের ডিএসএলআর ক্যামেরাটাও সাথে করে নিয়ে এসেছে মিতি। ইচ্ছে আছে ঘুরে ঘুরে কিছু পাখির ছবি উঠানোর। পুকুর পাড়ের এই পাকুর গাছ আর ইউক্যালিপ্টাসের ডালে দোয়েল টিয়া তো বসেই এর আগের বার বুলবুলি আর ঘুঘুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দাদাজান। নারকেল গাছে বেশ কয়েকটি বাবুই পাখির বাসাও সে আজকে দেখেছে। মিতি যখন পার্সি জ্যাকসনের হিরোস অফ অলিম্পাস সিরিজে বুঁদ হয়ে আছে তখন হঠাত্ করেই কাঁধে একটা হাতের স্পর্শে চমকে উঠল সে! আরে এ যে কুসুম! শুকনো মুখে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। কিরে কুসুম কাল আসার পর থেকে যে তোর দেখা নাই? ১৩ বছরের কুসুম এবার পিএসসি পাশ করেছে। চোখের কোণে পানি চিকচিক করে কুসুমের। পায়ের আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে হিজিবিজি দাগ কাটতে কাটতে বলে মিতি আপু আমার যে বিবাহ! আঁ বলিস কি? বলে জোড়ে চিত্কার দিয়ে ওঠে মিতি। তুমি আমাকে বাঁচাও আপু... 'আমি আরো পড়বার চাই। কিন্তু বাপজান আমার বিবাহ ঠিক করসে পাশের গ্রামের এক পোলার লগে যার বয়স সতেরো আর হে আগেও একটা বিয়া বসছে। তোমার দাদাজান বিয়ার সব খরচ দিতাসে।' এ যে রীতিমতো বাল্য বিবাহ! ও' লেভেলে child marriage নিয়ে বেশ কয়েকবার রচনা লিখেছে মিতি। ইউনিসেফ বলছে বাংলাদেশে ৬০% মেয়ের ১৮ আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর গ্রামে ছেলেদের ২১ এর আগে বিয়ের প্রবণতা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে দাদার কাছে কুসুমের কথাটা ওঠালো মিতি। আসলে কি মিতি সোনা গ্রামে এই বয়সের মেয়েদের বাড়িতে রাখা খুব ঝামেলা। আশেপাশের বখাটেরা বিরক্ত করে। তাছাড়া ওরা গরীব বেশ কটা ছেলে মেয়ে তাই যত তাড়াতাড়ি পারে বিয়ে দিয়ে মেয়ে কে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু দাদা দেশের আইনে child marriage যে অপরাধ। আর তাছাড়া কুসুম যে আরো পড়তে চায়। সবই বুঝলাম মিতি কিন্তু আইন করেও যে বাল্য বিবাহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাছাড়া কুসুমের মতো গরীব পরিবারের মেয়ের স্কুল কলেজ পাশ করে কি লাভ? তাকে বিয়ে করার জন্য তো অন্তত বিএ পাশ পাত্র লাগবে। গ্রামে কি এই ধরনের ছেলে পাওয়া যাবে? আমি এটা মানিনা দাদাজান। কুসুম এসএসসি পর্যন্ত পড়বে তারপর সে একটা ভোকেশনাল কোর্সে ভর্তি হতে পারে এবং সেটা শেষ হতে হতে ওর ১৮ বছর হয়ে যাবে তখন ওর বিয়ে দেয়ার কথা ভাবা যাবে। দেখো মিতি সোনা ব্যাপারটা এতো সহজ না। ওরা ছেলেকে যৌতুক বাবদ ৫০হাজারের মধ্যে ২৫ হাজার দিয়ে ফেলেছে। একে তো বাল্য বিবাহ তার উপর আবার যৌতুক....থানায় জানালে পুলিশ এসে ওই সতেরো বছরের পাত্র কে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে....মিতি মনে মনে ভাবে। মিতি একটা কথা বুঝে উঠতে পারে না তার দাদার মতো সমভ্রান্ত, শিক্ষিত ও প্রভাবশালী মানুষ গুলো কেন এই বাল্য বিবাহ রোধে এগিয়ে না এসে উল্টো আরো নিশ্চুপ থেকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়? সমাজের প্রত্যেক স্তরের মানুষের সাহায্য না পেলে বাল্য বিবাহ আর যৌতুক প্রথা সরকার রুখবে কিভাবে? পরদিন কুসুমের বাবা মন্জুমিয়াকেও বুঝাতে ব্যর্থ হয় মিতি।
তিন চারদিন পেরিয়ে গেছে ; শায়লাকেও ব্যাপারটা জানিয়েছে মিতি। এখন শেষ অস্ত্র হলো রুপম। মিতি ভাবে বাবা যদি দাদা জানকে বুঝাতে পারে। বিকেলের দিকে ক্যামেরাটা নিয়ে একটু বেড়িয়েছে মিতি; সাথে কুসুমও আছে। তেঁতুল গাছের চুড়ায় বসে শিষ দিচ্ছে এক জোড়া ঘুঘু। এতবার উড়ছে বসছে যে ক্যামেরাবন্দি করতে মিতি কে নাকাল হতে হচ্ছে । হঠাত্ করেই মিতির মাথায় একটা বড় ইটের টুকরো দিয়ে দূর থেকে সজোরে আঘাত করে কেউ। ব্যথায় ককিয়ে উঠে ক্যামেরাটাকে সামলে মাটিতে বসে পড়ে মিতি। রক্তাক্ত হয়ে যায় তার হাত! চিত্কার দিয়ে ওঠে কুসুম। শেষ বিকেলের আলোয় হঠাত্ খেয়াল করে ধানক্ষেতের আল ধরে দৌড়ে পালাচ্ছে তার সতেরো বছরের হবু স্বামী!
দাদুর বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মিতি আর দাদাজানের উপরে রাগে ফুঁসছে; চারটা সেলাই পড়েছে মাথায়। পেইনকিলার আর এন্টিবায়োটিক দিয়েছে ডাক্তার। চিন্তা করে হুড়োহুড়ি করে ছুটে আসবে এই ভেবে বাবা মাকে জানাতে দেয়নি দাদাজান। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা সুখবর পেল মিতি। তার উপর এই আক্রমণ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি দাদাজান। সেদিন রাতেই কুসুমের বিয়েটা ভেঙ্গে দেন তিনি। পুলিশ কে ফোন দিয়ে ধরিয়ে দেন সেই গুনধর পাত্র কে। খুবই খুশি হয় মিতি। মাথা টা যেন হালকা লাগে। কুসুম এসে জড়িয়ে ধরে মিতি কে। শুক্রবার এসে আদরের মেয়ের এই অবস্থা দেখে খুবই অবাক হয় শায়লা আর রুপম। মা বাবাকে কিছুটা সময় জড়িয়ে ধরে বসে থাকে মিতি। শায়লা তার শশুর কে বলে এখন থেকে গ্রামে বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে সে মানুষ কে মোটিভেট করবে। তুমি শুরু কর আমি তোমার সাথে আছি...এই বলে অনুপ্রেরণা দেন শায়লার শশুর ।
রবিবার সকালে দাদা দাদুকে বিদায় জানায় মিতিরা। লাগেজ গাড়ী তে উঠানো হয়ে গেছে; আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি বলে মিতি হেঁটে যায় বাসা থেকে অল্প কিছু দূরে দাদজানের স্কুলে। গতকালই ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছে কুসুম; বিধ্বস্ত চেহারা তে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করেছে। মিতিকে দেখে হাত নাড়লো সে। লাইনে দাঁড়িয়ে সব ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কুসুম গাইছে প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত....
"কী শোভা কী ছায়াগো,
কী স্নেহ কী মায়াগো-
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে
নদীর কূলে কূলে।"
গাড়ীতে এসে বসে মিতি। ব্যান্ডেজ করা মাথাটা এলিয়ে দেয় পেছনের সিটে। পার্ল কালারের প্রিমিও গাড়ী টা গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে দ্রুতই এগিয়ে চলে হাইওয়ের দিকে।
বাহবা রইল আপনার জন্য, কিন্তু গ্রামের ওসব মানুষ তো আর ভাল হবেনা কোনদিন ওগুলা এমন কাজই করবে সবসময়।
Replyআরাফাত জনি
বাড়ি ৮৮৭
রোড ৫
উত্তরা।