বাতিঘর প্রকাশনী থেকে খুব শিগগীরই আসছে তুহিন রহমানের সাইন্স ফিকশন উপন্যাস ‘ট্রিপি’।.... ছায়াবীথি থেকে বের হয়েছে তুহিন রহমানের নতুন বই ‘মেঘ অরণ্য’ মূল্য ২৫০ টাকা। তুহিন রহমানের ভ্রমন বিষয়ক ৭০০ পাতার গাইড ‘অল ইন্ডিয়া ট্যুর গাইড’ এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এই সাইটটি প্রতিদিন ১২০০ ভিজিটর ভিজিট করছেন। এখানে আপনার বইয়ের সারামাসের বিজ্ঞাপনের খরচ মাত্র ১০০০ টাকা। *এইখানে আপনার বইয়ের বিজ্ঞাপন দিন*

মন অরণ্যের শূন্যতা ( পর্ব ২)........জান্নাতুল ফেরদৌসী

মন অরণ্যের শূন্যতা ( পর্ব ২)........জান্নাতুল ফেরদৌসী

নীলাম্বরীদের বাসাটা খুবই সাদামাটা। একতলা বাসার দেয়ালগুলো বেশ পুরোনো আর রঙ উঠে গেছে বেশ খানিকটা। স্যাঁতসেঁতে একটা ভাব পুরো বাসার মেঝেতে। জরাজীর্ণ আঙিনায় একটা বিশাল বড় আমগাছ। সেই গাছে গ্রীষ্মের সময় বেশ আম ধরে আর কাল বৈশাখী ঝড় হলে তো কথাই নেই। নীলাম্বরী, তার ছোটভাই শ্যামল আর ওদের মা বাবা একসাথে সবাই আম কুঁড়োতে ছুটে যেত। সে যে কি আনন্দের সময় ছিলো ভাবতেই নীলাম্বরীর খুব আফসোস হয়, কেনো যে সেই দিনগুলো আবার ফিরে আসেনা! এখন আর সেই স্বর্ণযুগ নেই ওদের। নীলাম্বরীর বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী, বেশ কয়েকবছর আগেই রিটায়ার করেছেন। মা দু'বছর ধরে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। বাকি রইল এক ভাই, সে পড়ছে ক্লাস নাইনে। পেনশনের স্বল্প টাকা দিয়ে ওদের সংসার চলে গেলেও, নীলুর মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে বেশ বেগ পেতে হয় ওদের।
তাই নীলাম্বরী নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু ছাত্রছাত্রী পড়ায়। কিন্তু মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে যেন তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে। সংসারের একটা অদৃশ্য কঠিন বোঝা যেন ওকে দিন দিন কোনঠাসা করে দিচ্ছে। তার এমন ছকে বাঁধা জীবন ভালো লাগেনা। তার ইচ্ছে করে একটা দুরন্ত,মুক্ত,উচ্ছ্বাসের জীবন পেতে। মন চায় নীল আকাশের নীচে খোলা প্রান্তরে প্রানভরে গান গাইতে। মাঝে মাঝে কেন যেন তাই নীলাম্বরী কণিকার জীবনটা পেতে চায় কারন কণিকা তো একাই, ওর নেই কোন বাঁধা, নেই কোন পিছুটান! রয়েছে কেবল বিশাল বড় প্রাসাদ আর প্রাচুর্য। কাঁধের ব্যাগ টা নামিয়ে নীলাম্বরী হাতমুখ ধুয়ে এলো। তার মনে পড়লো মায়ের ওষুধটা দেবার কথা। সে ব্যাগ খুলে মায়ের ওষুধটা বের করতে গিয়ে খেয়াল করলো তার ব্যাগে পাঁচশো টাকার বেশক'টি নোট। এতো টাকা কোথা থেকে এলো?! পরক্ষনেই তার মনে হলো এটা কণিকার কাজ। সে এমন এর আগেও করেছে। কিভাবে যেন কণিকা বুঝে যায় যে নীলুর মন কখন কেনো খারাপ থাকে বা তার আসলে কি সমস্যা। এই যেমন আজ! নীলু এই টাকার অভাবেই মায়ের কিছু টেস্ট করাতে পারছিলোনা বলেই মন খারাপ করে পুকুরপাড়ে বসে ছিলো, সেটা কণিকা বুঝে গেছিলো আর তাই সে এতোকিছু করে নীলুকে তার বাড়িতে নিয়ে গেছিলো। নীলাম্বরীর খুব লজ্জা হয়। সে এর আগেও এভাবে কণিকার দেয়া টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলো এমনকি ওকে বলেছিলো এভাবে না চাইতে টাকা না দিতে। কিন্তু কণিকা কখনোই একবার দেয়া টাকা ফেরত নেয়নি। বারবার বলেছে "আজ আমার মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এটাই করতেন আর আমি চাইনা আমার মত তুইও মা হারা হয়ে পড়!" নীলু ভাবে সত্যিই তো! তার তো এখন মাকে বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, কি দরকার এতোসব ভেবে! নীলুদের ক্যাম্পাসটা অনেক বড়। অনেকবছরের পুরোনো গাছ আর বিল্ডিং এর জন্য ক্যাম্পাসের চেহারাটাই কেমন যেন একটু গম্ভীর গম্ভীর লাগে দেখতে। কিন্তু আসলে দেখতে গুরুগম্ভীর হলেও ওদের ক্যাম্পাসটা ভীষণ প্রানবন্ত আর উদ্দীপনায় ভরপুর। তারুণ্যের যেই উচ্ছ্বাস এখানে আসলে দেখা যায় তা হয়তো অনেক ক্যাম্পাসেই নেই বলে ধারণা নীলুর। যদিও তার অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখার সুযোগ হয়নি। তবুও ক্যাম্পাসে আসলেই নীলুর মন যেন প্রান খুঁজে পায়। 
-কিরে রিচি কেমন আছিস? গতকালের লেকচারটা আমাকে দিস তো! বললো নীলু। 
-হুম আছি বেশ ভালোই। এই শোন, গতকাল যা দারুণ একটা নিউজ দিয়েছে না স্যার আমাদের! রিচির চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো। 
-কি নিউজ? 
-আমাদের ক্যাম্পাস থেকে ৭ দিনের শিক্ষা সফরে যাওয়া হবে! জানিস কোথায়? বান্দরবানে! ওখানের সবগুলো ঝর্ণা আর পর্যটনকেন্দ্র গুলো ঘুরানো হবে! শুনেই আমার কি যে আনন্দ লেগেছে জানিস না! আমিতো এখনই সব গুছানো শুরু করে দিয়েছি, তুইও শুরু করে দে নীলু! 
রিচি, নীলুদের বন্ধুমহলের একজন। হাসিখুশি মেয়েটা খুব অল্পতেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে শিশুদের মত বেশ শোরগোল তৈরি করে ফেলে। যদিও ব্যাপারটা নীলু খুব পছন্দই করে। জীবনে অল্পতেই খুশি থাকতে পারাটাও যে অনেক বড় গুণ! আর এই শিক্ষাসফরের বিষয়টা তো রীতিমতো খুশিরই খবর! নীলু কখনোই তার জেলার বাইরে দূরে কোথাও ঘুরতে যায়নি। ঝর্ণা দেখার তার খুব ইচ্ছে ছিলো, এবার মনে হয় সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। ভাবতেই নীলুর খুশিতে মনটা ভরে গেলো। 
এরইমধ্যে কণিকাও চলে এলো। তাকেও শিক্ষাসফরের খরবটা দিতেই সেও বেশ উল্লাসে মেতে উঠলো। তারা সবাই ঠিক করলো যে ক্লাস শেষে তারা একটা লিস্ট করবে যে তাদের এই ট্যুরে কি কি নিতে হবে আর তারা কি কি আনন্দ করবে! ক্লাস শেষে তারা সেই লিস্ট করতে তাই সোজা বড় মাঠে গিয়ে বসলো। ওদের ক্যাম্পাসে দুইটা মাঠ, একটা ছোট আর আরেকটা বেশ বড়। ওরা সাধারণত বড় মাঠটাতেই আড্ডা দেয়। বড় মাঠে বিভিন্ন সংগঠন, পলিটিকাল পার্টি ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বৈঠক বসে। ছোট মাঠটা অঘোষিতভাবে ক্যাম্পাসের কপোত-কপোতীদের দখলে চলে গেছে। 
সেখানে গেলে নাকি সবচেয়ে নীরস কর্কশ মানুষেরও মনে প্রেম ভুত ভর করে, এমনই কথার প্রচলন রয়েছে। তাই সবাই অলিখিতভাবেই ছোট মাঠের নাম দিয়েছে "প্রেমনগর"। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হলো নীলুদের আরেক বন্ধু সুব্রত প্রায়ই সেই প্রেমনগরে গিয়ে শুয়ে বসে থাকে, এই আশায় যে তার কাছেও একদিন সেই স্বপ্নের রমনী আসবে, প্রেমময় হবে তার জীবন আর সেই প্রেমবোধ থেকে সে লিখে ফেলবে গদ্য, পদ্য, কাব্য, মহাকাব্য! কিন্তু হায়! এতোদিনেও তার কোন গতিই হলোনা, তবুও সে হাল ছাড়েনা। রোজ ক্লাসের পরে সে ওখানে যায় আর কোন একা মেয়ে দেখলেই কথা বলার চেষ্টা করে। এভাবে দুই একবার সে মারও খেয়েছে বটে! তবুও সে "একবার না পারিলে দেখো শতবার" মন্ত্রে দীক্ষিত যোদ্ধা!

নীলুরা বসে গল্প করছিলো এমন সময় শুভ্র এসে বসলো ওদের পাশে। ওদের আলোচনা শুনে সে হুট করে বলে ফেললো, -হুম আমিও যাবো তোমাদের ট্যুরে। 
সাথে সাথেই কণিকা চটাং করে বললো, -আপনি? আপনি কেনো যাবেন আমাদের সাথে? আপনার কি নিজের কোন বন্ধু নেই? তাদের সাথে বেড়াতে যান! 
-হুম আমার বন্ধু আছে আর ওরাও যাবে তোমাদের সাথে। আমি যতদূর জানি এই ট্যুরটা ওপেন ফর অল মানে ভার্সিটির যেকোন ব্যাচের যে কেউ যেতে পারবে। 
-আহ! বাদ দে না কণিকা! যেতেই যখন চাচ্ছে শুভ্র ভাই, তাহলে চলুক না! বরং আরো বেশি মানুষ হলে মজাও হবে বেশ! বললো নীলু। 
নীলুর উচ্ছ্বাস দেখে কণিকা নিশ্চুপ হয়ে গেলো।


আজ সকাল থেকেই নীলুর মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। নীলু মায়ের ঔষুধ খাইয়ে ক্লাসের জন্য বের হবে, রাতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ভেবেছে। বাসার সামনে নীলু রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ শুনতে পেলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। 
- নীলু, এই নীলু! এই যে এইদিকে! 
- আরে শুভ্র ভাই আপনি! এখানে কি কাজে? 
- এই একটু কাজ ছিলো এদিকটায়, তুমি কি ক্যাম্পাসে যাচ্ছো? 
- জি। 
- ও তাহলে চলো একসাথে যাই আমিও ক্যাম্পাসেই যাচ্ছিলাম। 
নীলু শুভ্রর কথা ফেলতে পারলোনা। শুভ্রর সাথে নীলুর যেদিন প্রথম দেখা হয়, সেইদিনের কথা নীলুর এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ভার্সিটিতে ভর্তির পর সেইদিনই প্রথম ক্লাস ছিলো। আনন্দ, উত্তেজনার একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে নীলু প্রথম ক্লাস শেষ করে বের হয়েছিলো, ঠিক তখনই প্রায় ৭-৮ জন ছেলে নীলুকে ডাক দিয়েছিলো। - এই মেয়ে, হ্যা তুমিই, এদিকে এসো! 
নীলু একটু অবাক হলো অপরিচিত এতোগুলো ছেলে কেনো ওকে ডাকছে ভেবে। 
- হুম কি নাম তোমার? একজন দুষ্টু হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো। 
- নীলাম্বরী 
- ওরে বাবা! নীলাম্বরী! এতো দেখছি কবিতার বা গল্পের নায়িকাদের নাম! তুমি জানো এই নামের অর্থ? 
- হুম জানি। নীল রঙের শাড়ি। একটু অস্বস্তিভরে নীলু বললো। 
- কিন্তু আমরা তো দেখছি তুমি একটা শ্যামলা রঙের মেয়ে। নীল রঙের শাড়ি না! তাহলে এই নাম কেনো? 
বাকি সব ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠলো। 
নিলু খুব অপমানবোধ করেছিলো কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছিলোনা কারন সে একা ও নতুন এখানে। অন্যদিকে ওরা ছিলো নীলুর সিনিয়র ও সংখ্যাগরিষ্ঠ। নীলু এটাও বুঝেছিলো যে ওরা তাকে অপমান করতে বা র‍্যাগিং দিতেই ডেকেছে। হঠাৎ করে বিকটশব্দে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলো! সবাই দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড়াতে লাগলো। যে যেদিকে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। নীলু দেখলো ওর সামনের একটা ছেলেও নেই সবাই নিমিষেই পালিয়েছে। কিন্তু নীলু আতংকে আর ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলু খেয়াল করলো হুট করে কে যেন ওর হাতটা ধরে একটা হেঁচকা টান দিলো তারপর দৌড়াতে লাগলো। নীলুও কিছু না বুঝে পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। কিছুদূর দৌড়িয়ে যাওয়ার পর ওরা একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়ালো। 
দুইজনই বেশ হাঁপাচ্ছে। নীলু দেখলো একটা লম্বা, সুঠামদেহী, শ্যামবর্ণের সুদর্শন ছেলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 
- তুমি কি পাগল নাকি? এমন পরিস্থিতিতে কেউ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকে নাকি বোকার মত? আরেকটু হলে তো মরতে বসেছিলে! ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো। 
- না মানে ইয়ে... নীলুর মুখ দিয়ে আর কথা বের হয়না। 
- শোন, ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে এমন ঘটনা ঘটে, পলিটিকাল পার্টিদের মধ্যে গোলাগুলি হয়, তখন নিজের সেফটি নিজেকেই বুঝতে হবে। যাই হোক, আমি শুভ্র আর তুমি? নীলু কেবল তাকিয়েই থাকে আর ভাবে সে এখন নিরাপদে আছে। এমন নিরাপদ বোধ তার আগে কখনো হয়নি। এটা আসলে নিরাপত্তা নাকি অন্যকিছু? নীলু ভেবে পায়না। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই ক্যাম্পাসে তাদের দেখা, কথা হতে থাকে। নীলুর ভালো লাগে শুভ্রর সঙ্গ। তার জানতে ইচ্ছে করে শুভ্ররও কি একই অনুভূতি হয়?

(চলবে....)

মন অরণ্যের শূণ্যতা........জান্নাতুল ফেরদৌসী

 মন অরণ্যের শূণ্যতা........জান্নাতুল ফেরদৌসী
পর্ব এক
পুকুরের স্বচ্ছ জলে আকাশচুম্বী নারিকেল গাছগুলোর ছাঁয়া ভাসছে। নীল আকাশে তুলতুলে সাদা মেঘগুলো দলবেঁধে ছুঁটছে অজানায়। হালকা মিষ্টি বাতাসে জলে একটা অদ্ভুতরকম কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে আর সেই টলটলে জলে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে নীলাম্বরী। আজ তার মন ভালো নেই। মন খারাপের সময়টা সে এই পুকুরপাড়েই একা বসে থাকে। বসে বসে সে এটা ওটা আরো কত কি যে ভাবে! এই যেমন আজ তার মনে হলো সে পুকুরে ঝুপ করে একটা লাফ দিবে তারপর সেই শীতল শ্যামল বারিতে সে মৎস্যকন্যার মত উথাল-পাথাল সাঁতার কাটবে এপাশ থেকে ওপাশ। গল্প করবে মাছেদের সাথে, জানবে তাদের জীবন কেমন। তাদেরও কি এই উষ্ণতাহীন পাতালপুরী থেকে ক্ষনিকের জন্য হলেও সূর্যালোকের তপ্ত জগতে আসতে ইচ্ছে করে? কিন্তু নীলাম্বরীর আর তা জানা হয়না কারন সে যে সাঁতার জানেনা। তাই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাঁকালো আর ওমনি তার মনে হলো সে ওই পাখিগুলোর মত উড়তে চায়। যখন যেখানে খুশি উড়ে বেড়াবে, মন্দ কি! এলোমেলো এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ নীলাম্বরী খেয়াল করলো জলে কার যেন একটা ছায়া পড়েছে। -কিরে নীলু এখনো এখানে বসে আছিস? বললো কণিকা।
কণিকা, ভীষণ মেধাবী আর বুদ্ধিমতি মেয়ে। ধনাঢ্য পরিবারের একমাত্র মেয়ে, যেমন সুন্দরী তেমন চটপটে। ওরা স্কুলজীবন থেকে একসাথেই বড় হয়েছে, বলতে গেলে বেস্ট ফ্রেন্ড। অথচ দুইজনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য একদমই যেন দুই মেরুর! তাই বন্ধুমহলে প্রায়ই সবাই ওদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে কিন্তু ওরা যেন সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকেই দলিলে সই করে ওদের বন্ধুত্বের একশো ভাগ সত্তাধারী হয়ে এসেছে। পরিস্থিতি যেমনি হোক না কেনো ওরা সবসময় একে অপরের পাশে থাকবেই! 
নীলাম্বরী চুপ করে রইল। কণিকা তার পাশে এসে বসলো। 
-নীলু মন খারাপ করিসনা। 
-আমার যে মন খারাপ তোকে কে বললো? নীলাম্বরীর শীতল কন্ঠ। 
-এতো বছর পরও এই একই প্রশ্ন তুই প্রতিবারই করিস। তোর মন খারাপ আর আমি জানবোনা! কণিকার উত্তর। নীলাম্বরী এবার একটু হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো, -ইশ এতো বছর পরও যদি সবকিছু একটু বদলাতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ এই প্রশ্নই করতে হতোনা। 
-কি দরকার এসব ভেবে? মানুষের হাতে কি আর সব থাকে? তাছাড়া তুই তো তোর জায়গা থেকে অনেক চেষ্টা করছিস, আর কত? বললো কণিকা। 
-থাক এসব কথা। চল ক্লাসে যাই। নীলাম্বরী উঠে দাঁড়ালো। 
-না আজ ক্লাসে যাবোনা, আজ আমরা দুইজন সারাদিন রিকশায় ঘুরবো, ফুচকা খাবো, আর রাতে তুই আমার বাসায় থাকবি। কণিকার আবদার নীলাম্বরী ফেলতে পারেনা কারন সে জানে কণিকা কেন এসব করে। সে জানে পৃথিবীতে তার সবচেয়ে কাছের মানুষদের মধ্যে কণিকা অন্যতম।


রিকশায় এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে ক্যাম্পাসে এলো নীলাম্বরী আর কণিকা। ক্যাম্পাসের করিম মামার দোকানের ফুচকা চটপটি তাদের খুব পছন্দ। শুধু তাদেরই না বরং সবার কাছেই বেশ নামডাক আছে মামার দোকানের। নরম আলু আর গোল গোল গরম ডাবরির উপর মামা কি যেন একটা চটপটে মসলা ছিটিয়ে দেয় যা তাদের কাছে অমৃতের মত লাগে! তেতুলের টক মিষ্টি স্বাদ যেন তাদের মনের ক্ষুধা আরো বাড়িয়ে দেয়, তাই তারা প্রায়ই এখানে আসে সেই অমৃতের স্বাদ নিতে। 
-আরে কণিকা দেখি! কেমন আছো? আজ তোমরা ক্লাসে আসোনি কেনো? বললো শুভ্র। 
শুভ্র ওদের দুই বছর আগের ব্যাচের ছাত্র কিন্তু ওদের সাথে বেশ খাতির। মাঝে মাঝেই শুভ্র ওদের বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে ওঠে। তবে কেন জানি শুভ্রর এই অযাচিত অনুপ্রবেশ কণিকার ভালো লাগেনা। 
-আজ আমাদের ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করেনি তাই আর যাওয়াও হয়নি! বললো নীলাম্বরী। 
-আমরা ক্লাসে গিয়েছি কিনা সেটা আপনার জেনে কি হবে? আর তাছাড়া আপনি জানলেনই বা কিভাবে? আপনি কি তাহলে ২ বছর লস দিয়ে আমাদের ব্যাচের সাথে ক্লাস শুরু করলেন নাকি? বলেই একটা দুষ্টু হাসি হাসলো কণিকা। 
একটু বিব্রতবোধ করলো শুভ্র, সে বোঝে না কণিকা কেন তার সাথে এমন টিপ্পনী কেটে কথা বলে। তাকে অপদস্ত করে কণিকা কি মজা পায়? -না মানে রিচির সাথে দেখা হয়েছিলো, সে বললো তোমরা নাকি আজ ক্লাসে আসোনি। তাই ভাবলাম তোমরা ঠিক আছো কিনা! ইনিয়েবিনিয়ে শুভ্র বললো। 
-আচ্ছা শুভ্র ভাই, আমরা আজ আসি। আরেকদিন কথা হবে কেমন? ভালো থাকবেন। বলেই কণিকা নীলাম্বরীর হাতটা ধরে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো। 
কিছুদূর যেতেই নীলাম্বরী কণিকাকে বললো, -কণি তুই সবসময় শুভ্র ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলিস কেন? সে তো আমাদের খারাপ কিছু বলেনি কখনো! 
কথাটা শুনে কণিকার মনে হলো সত্যিই তো! কেন সে এমন করে শুভ্রর সাথে আর কেনই বা তার ওকে ভালো লাগেনা? শুভ্র ওদের ২ বছর বড় তারপরও এতো বেশি সখ্যতা চায়, তাই বলে কি কণিকার সন্দেহ হয়? শুভ্র কোনদিন কোন ক্ষতি করবেনা তো ওদের বা ওদের বন্ধুত্বের? এসব ভাবতে ভাবতেই কণিকা নীলাম্বরীর প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে যায় বা দিতে চায়না।

কণিকাদের বাড়িতে আসলেই নীলাম্বরীর মনে হয় সে কোন সাধারণ ইট পাথরের বাড়িতে নয় যেন একটা সোনাখচিত বিশাল রাজপ্রাসাদে বেড়াতে এসেছে। ডুপ্লেক্স এই বাড়িতে কেবল দেশি নয় বরং বিদেশি আধুনিক সব সরঞ্জামাদি আর সুযোগ সুবিধাও রয়েছে। জীবনকে সহজ ও সুন্দর করতে কোনরকম কমতি নেই এখানে। একাধিক চাকর বাকরের টুয়েন্টি ফোর সেভেন পরিচর্যা ও সেবায় বাড়ির চারপাশটা একদম স্বর্ণের খনির মত চকচক করে। খালি একটাই সমস্যা। বাড়িতে মমতাময়ী মা নেই। কণিকার বয়স যখন ৫ বছর তখন তার মা মারা যায়। মা ছাড়া বাড়িতে যে শুন্যতা বিরাজ করে তা নীলাম্বরীর ভালো লাগেনা। হয়তো কণিকাও তাই বাড়িতে থাকার চেয়ে বাইরে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কণিকার বাবা অনেক বড় ব্যবসায়ী। নাহ ব্যবসায়ী বললে ভুল হবে, ব্যবসায়ী তো আলু, পেঁয়াজ বিক্রেতাকেও বলা হয় অথবা মোড়ের মুদি দোকানদার সেও তো ব্যবসায়ী! কণিকার বাবাকে বিজনেস ম্যাগনেট বললে হয়তো তার উপযুক্ত পরিচয় দেয়া হবে। তিনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। বাড়িতে তাকে দেখাই যায়না। আজ দেশে তো কাল বিদেশে।বাড়িতে ফেরেনো বেশ রাত করে তাই কণিকার সাথে তার দেখাও হয় কয়েকদিনে একবার। কণিকা পরিবারের ভালোবাসা, বন্ধন থেকে অনেক বেশি বঞ্চিত বলে নীলাম্বরীর খুব মায়া হয়। যদিও কণিকা কখনোই তার একাকিত্বের অনুভূতি প্রকাশ করেনা। সে খুব শক্ত মানসিকতার যে! আজ কোন এক কারনে কণিকার বাবা মিস্টার রায়সুল কবির বাড়িতে একটু আগেই ফিরেছেন। দরজা দিয়ে ঢুকতেই নীলাম্বরীর সাথে তার দেখা হয়ে গেল। 
-আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন আপনি? 
নীলাম্বরীকে দেখেও না দেখার ভান করে মোবাইল টিপতে টিপতেই রায়সুল সাহেব ভেতরে চলে যান। ব্যাপারটা নীলাম্বরী খেয়াল করে তবে অবাক হয়না কারন এমন এর আগেও হয়েছে তার সাথে। সে বোঝে যে তার এ বাড়িতে আসা কণিকার বাবা পছন্দ করেন না। এদিকে টেবিলে রাতের খাবার তৈরি বলে কণিকা নীলাম্বরীকে ডাক দেয়। দু'জনে টেবিলে বসতেই রামু কাকা কণিকাকে বলেন, -কণি মনি স্যার আপনারে ডেকে পাঠাইসেন। 
রামু কাকা হলেন এ বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো সেবক। কণিকার পুরো শৈশব যেন তার হাতেই বোনা। ভীষণ স্নেহ করেন কণিকাকে। 
-এখন যেতে পারবোনা বলে দাও। খেতে বসেছি দেখছোই তো! গম্ভীর গলায় বলে কণিকা। 
-কিন্তু স্যার যে এখনই ডেকে পাঠাইসেন! একটুখানি শুইনা আসো লক্ষী মামনি আমার! 
বেশ বিরক্তি নিয়েই কণিকা উঠে তার বাবার রুমে যায়। 
-আমাকে ডেকেছো বাপি? 
-হুম কেমন আছো তুমি? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? 
-এটা জানতেই কি ডেকেছো! যাই হোক, আসল কথাটা বলে ফেলো বাপি আমি শুনছি। খুব দৃঢ়ভাবে বললো কণিকা। -আসল কথাতো তুমি জানোই কণিকা! তোমাকে না কতবার বলেছি তুমি ওই মেয়েটার সাথে মিশবেনা। তোমাকে আর কতবার বুঝাবো যে তুমি আমার মেয়ে, মিস্টার রায়সুল কবিরের মেয়ে! তুমি যার তার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারোনা। তোমাকে স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে চলতে হবে। তোমার বন্ধু হবে আমাদের মতই বড়লোক ঘরের ছেলেমেয়েরা আর তুমি কিনা ওই রিটায়ার্ড সরকারি চাকুরীজীবি একটা হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ের সাথে টইটই করে ঘুরে বেড়াও! একবারও কি তোমার আমার মান সম্মানের কথা মনে হয়না? 
প্রতিবারের মতই এবারো কথাগুলো শুনে কণিকার রাগে শরীরে জ্বালা দিয়ে ওঠে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে সে আবারও বলে ওঠে, -বাপি তোমাকে আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, নীলু আমার খুব কাছের বন্ধু তার ব্যাপারে আমি এসব অবান্তর কথা আর শুনতে চাইনা। তাছাড়া বন্ধুত্বে আবার স্ট্যাটাস কিসের? স্ট্যাটাস দিয়ে আর যাই হোক বন্ধুত্ব হয়না বাপি আর যদি হয়েও থাকে তাহলে সেটা বন্ধুত্ব নয়, সেটা কেবল স্বার্থের আদান-প্রদান। স্বার্থ ফুরোলে সেই বন্ধুত্বও ফুরিয়ে যায়। যাই হোক, তুমি এসব বুঝবেনা, তার চেয়ে বরং তুমি তোমার বিজনেসের হিসাবের বইটা দেখো! 
বলেই কণিকা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আর রায়সুল সাহেব বিরক্তিভরে তাকিয়ে রইলো। ফিরে এসে কণিকা দেখলো নীলাম্বরী দাঁড়িয়ে আছে মেইন গেটের সামনে। -কিরে কই যাচ্ছিস নীলু? 
-বাসা থেকে ফোন এসেছিলো মায়ের শরীরটা আবার খারাপ করেছে। আমাকে যেতে হবে রে! 
-কিন্তু রাতের খাবারটা খেয়ে যা! 
-না রে আজ থাক, অন্য কোনদিন। বলেই নীলাম্বরী বেরিয়ে যায়। 
কণিকা জানে যে নীলু সবই বোঝে। তার খুব কষ্ট হয় নীলুর জন্য। একইসাথে ভীষণ রাগ হয় এই ভেবে যে একটা ছোট্ট জীবনে "স্ট্যাটাস মেইনটেইন" এর নামে মানুষের এই রঙ তামাশা কবে বন্ধ হবে? আসলেই কি বেঁচে থাকতে এতোকিছুর প্রয়োজন, নাকি সবই মানুষের বানানো নাটক? জীবনে যদি সুখই না থাকে তবে কি হবে এই "স্ট্যাটাস" দিয়ে!

(চলবে........)

চাঁদ যেটুকু আমরা ভাগে পেয়েছি........ গোলাম রসুল

চাঁদ যেটুকু আমরা ভাগে পেয়েছি........ গোলাম রসুল


আকাশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঈগল উড়ছে
আর ওই ঈগল গুলোর ওপর বায়ুমণ্ডলের
সাক্ষী স্বরূপ চড়ে বসে আছে হাওয়া
কি মারাত্মক আমাদের জীবন
আর মানবতার দুটো কোণ
আমি জনতার সামনে আয়না ধরলাম
তারা যদি তাদের প্রভুকে দেখতে পায়
আমাদের জীবন নাকি প্রজাতান্ত্রিক দাসত্ব

নিরব রাত্রি আরো নিরব
চাঁদ যেটুকু আমরা ভাগে পেয়েছি 
সমুদ্র থেকে পাহাড় পাহাড় থেকে সমুদ্র 
মেঘ পাথরনামা একটি বই 
যার প্রস্তাবনায় রয়েছে সূর্যের মূর্তি 
আমি আলোর ব্যবসায়ী সূর্যের কাছে থেকে 
এক পেয়ালা আলো চাই 
বিনিময় মূল্য আমার হৃদয় 
মৃত্যুকে রাখবো বলে 
সর্বশেষ শূন্যতাও আমার জানা নেই 
মহাজগতের কেন্দ্রে থাকা জনতা 
তোমাদের চোখের দলিল কুচিকুচি করে ভাসিয়ে দাও 
ওই জলের ওপর কেঁদো না মানুষ
আমাদের রক্ষী আমাদের হাত

নীল যেখানে........শাহরিয়ার জাওয়াদ

নীল যেখানে........শাহরিয়ার জাওয়াদ
ধূসর বালুকাবেলা পেরিয়ে অনেকটা নীল
যে নীল মিশে গিয়েছে দিগন্তে;
যতদূর চোখ যায়- সে কী ভীষণ নীল!
হঠাৎ সমুদ্র!
তীরের ধূসর বালিতে আছড়ে পড়ে ঢেউ
সে কী দারুণ উল্লাস নীলের,
খোলা আকাশের নিচে তখন মনে হয়...
তুচ্ছ আমি, অতি ক্ষুদ্র!

মাঝে মাঝে মনে হয়-
আমি নাবিক হবো;
জাহাজের ডেকে আছড়ে পড়বে
উন্মত্ত ঢেউ।
কিংবা বেহালা কাঁধে কোন
নিঃসঙ্গ যুবক;
উড়তে থাকা সীগালের ঝাঁক ছাড়া
বেহালার সুর শুনবার নেই কেউ!

কখনো আবার বলিষ্ঠ পেশির
এক মধ্যবয়স্ক জেলে;
ভয়ঙ্কর উন্মত্ত নীলের সাথে যুদ্ধ করে
যে বেঁচে থাকে।
কিংবা ওই অ্যালবেট্রস পাখিটা
যার কালো ডানায় ভর করে
কোন আশাহত নাবিক
                                                                                                                                       তার স্বপ্ন আগলে রাখে!

উড়ে যাব আমি এই লোকালয় ছেড়ে
উড়ে যাব আমি সেই অসীম নীলে,
হয়তো কোন নিঃসঙ্গ নাবিক-
নয়তো কোন অ্যালবেট্রসের ডানায় চড়ে;
এই নগর, এই শহর...
অন্তত আমার জন্য নয়।
চলে যাব দূরে- অসীম নীল যেখানে
ফিরবো না আর এই লোকালয়ে, মানুষের ভীড়ে!

চিরবসন্ত........মুশফিকুর রহমান আবীর

চিরবসন্ত........মুশফিকুর রহমান আবীর

মানুষের সম্পর্কগুলো অনেকটা ফুটন্ত গোলাপের মতো। গোলাপ দূর থেকে তার স্বজীবতার চিরন্তন নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু মানুষ সেই সৌন্দর্যের আলিঙ্গন লাভ করার জন্যে গাছ থেকে সংগ্রহ করে প্রসাদময়  অট্টালিকার সবচেয়ে সুন্দর ফুলদানিতে গোলাপটিকে স্থান দেয়। তাতে গোলাপটির সৌন্দর্য যেন আরো বৃদ্ধি পায়। গোলাপটির সৌন্দর্য দেখে তার উপর ভ্রমর এসে বিচরণ করে।

এতো কিছু দেখে মানুষ তখন ভাবতে শুরু করে গোলাপটিকে গাছ থেকে তার আরো আগে এই ফুলদানিতে রাখা উচিত ছিলো।  আহ!  কি না ভুল করে ফেলেছে সে!

পর দিন তারা দেখতে পায় ফুলটি একটু মলিন হয়ে পড়েছে হঠাৎ করে। কালকের মতো আজ আর ভ্রমররা গোলাপটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেনি। পরের দিন দেখলো ফুলদানির সব সুন্দর জিনিস গুলোকে গোলাপটি কেমন যেনো বিবর্ণ করে রেখেছে। পরের দিন গোলাপটির পাতা গুলো শুকিয়ে মাটিতে পরে গিয়ে ফুলদানিটা সহো আসে পাশের জায়গাটা ময়লা করে দিতেছে। তখন মানুষ ভাবে এই সুন্দর ফুলদানিটার ভিতোর এই গোলাপটা রাখলে ফুলদানিটা অসুন্দর হয়ে যাচ্ছে। তাই তাকে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। গোলাপটা যেনো সময় যাওয়ার সাথে সাথে তার সব সৌন্দর্য হারিয়ে আজ তার আশেপাশের সব সৌন্দর্যের জন্যে বিশাদময় হয়ে উঠেছে।


মানুষে মানুষে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার সম্পর্ক গুলোও যেনো একই সূত্রে গাঁথা।  সম্পর্ক গুলোতে আপনজনদের সন্নিকটে পাওয়াটা অনেক বেশি মধুর মনে হয়।একটা সময় যখন সে তাদের সান্নিধ্য লাভ করে এবং ভাবতে থাকে, কতো না ভালো হতো, যদি এই কাছের মানুষগুলোকে আগে কাছে পাওয়া যেতো। তখন নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে খুশি মানুষ মনে হয় আপন ভালোবাসার মানুষগুলোকে কাছে পাওয়ার জন্যে। মনে হয় এই সুখ যেনো চিরস্থায়ী, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও এ ভ্রাতৃত্ব ভালোবাসার বন্ধন যেনো শেষ হওয়ার নয়।


কিন্তু মানুষের স্বভাব এমনই যে, তুমি যদি তোমার ভালোবাসা, ভাতৃত্বের বন্ধনের  দুয়ার ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্যে যতটুকু উন্মোচিত করবে, তারা তোমাকে দিন যাওয়ার সাথে সাথে ঠিক ততোটুকুই বা হয়তো তার চেয়ে বেশি তোমাকে হেয়ো করবে। ভালোবাসার প্রতিদানে তারা কষ্ট, হিংসা,গৃণা, অবহেলা, তাচ্ছিল্যতা ছাড়া আর কিছুই দিবে না। 


সময় যাওয়ার সাথে সাথে এই পরিচিত মানুষগুলোই যেনো খুব অপরিচিত হয়ে পড়ে। কাছের সবাইকে পেয়েও যেন নিঃসঙ্গ দ্বীপের কোনো এক বাসিন্দা হয়ে পড়তে হয়।  আজ তারাই যেন তোমাকে সব থেকে একা করে দিয়েছে। কাছে আসার জন্যে আজ তারা সবচেয়ে দুরে চলে গিয়েছে। শেষ পান্তে এসে মানুষ গুলোর সাথে  সম্পর্কটায় তিক্ততা ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না। মনে হয় তখন,

সম্পর্কটা তো দুর থেকে চিরস্থায়ী মধুর ছিলো। তখন তো সম্পর্কের ভিতর কোনো তিক্ততা ছিলো না। সবাই থেকেও আজ যেনো তুমি একা কোনো এক জনসমুদ্রের মাঝখানে। 


মানুষকে বিশ্বাস আর ভালোবাসলেই মানুষ সে বিশ্বাস আর ভালোবাসার অমর্যাদা, অবহেলা করবেই। এটাই মানুষের আসল পরিচয়।

অনেক মায়ের এক সন্তান........রাকিব শামছ শুভ্র

অনেক মায়ের এক সন্তান........রাকিব শামছ শুভ্র

মি কার ঔরসজাত সন্তান, সেটা মা কখনোই বলতে পারেনি। পারার কথাও না। আমার জন্মটাই যে এক আশ্চর্য! আমি একটা সময় পর্যন্ত মাকে প্রচন্ড ঘৃণা করতাম। নিজেকে অস্পৃশ্য মনে হতো। সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। মায়ের পরিচয় দিতেও লজ্জা পেতাম। কেন আমার সাথেই এমন হলো?

স্বাধীনতার পরপরই মা আমাদের গ্রাম থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে শ্রীমঙ্গল চলে যায়। আমি তখন মাত্র কয়েক মাসের বাচ্চা। মা ওখানে চা বাগানে কাজ নেয়। আমার মায়ের গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু চোখা নাক খুব সুন্দর। খুব মায়াময় চেহারা। সহজেই সবার চোখে পরতেন। আর আমার চেহারা? একেবারে ফর্সা, লম্বা ছয় ফুট। দেখলে যে কেউ ভাবে পাঠান!!

আমার বাবা করিম উদ্দিন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই এপ্রিলের শুরুতে পালিয়ে ভারত চলে যান ট্রেনিং নিতে। রমিজ চাচা বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। এক সময় মাকে খুব পছন্দ করতেন। মায়ের বিয়ে হয় বাবার সাথে, তখন থেকেই তার হিংসা ছিলোই। বাবা যুদ্ধে যাবার পর থেকেই তার আমাদের বাড়িতে আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিলো। মায়ের কাছ থেকে বাবার খোঁজ জানতে চাইতেন। মা কখনোই বলেনি বাবা কোথায় গিয়েছে। রমিজ চাচা ধারণা করতে পেরেছিলেন বাবা যুদ্ধে গেছেন। একদিন রাতে দরজা ঠকঠকালো। মা ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কে? বাহির থেকে উত্তর এলো, ভাবি আমি রমিজ দরজা খুলেন। আমার মা সরল বিশ্বাসে দরজাটা খুলে দিয়েছে। দরজা খুলতেই তিন চারজন পাকিস্তানি আর্মি ঘরে ঢুকলো। এরপর টানা সাত মাস আমার মায়ের উপর দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চলেছে। আর এরই ফসল হচ্ছি আমি। নিজেকে ভালোবাসার কোন কারণ আছে কি?

আমি এসব কিছুই জানতাম না। মা নিজের পরিচয় লুকিয়ে চা বাগানে কাজ নিয়েছে। সেখানেও মা খুব শান্তিতে ছিল তা না! বড় বাবু ছোট বাবু সহ আরো অনেকেই মায়ের একা থাকার সুযোগটা নিয়েছে। মা সব সহ্য করেছে শুধু আমার জন্য। মায়ের একটাই ব্রত ছিল, আমাকে মানুষ করতে হবে। আমি মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই মা এড়িয়ে যেতো। যখন আমার ১১ বছর বয়স! একদিন মা আমাকে ডেকে অনেক কথা বলল। তখন সব কথার মানে বুঝিনি। বরং মায়ের উপর আমার ঘৃণা জন্মেছে রাগ, অভিমান। মনে আছে অনেকদিন মার সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছিলাম।

আমার বাবার পরিচয় না কি মায়েরও জানা নেই। মা মাঝে মাঝে বলতো, মায়ের উপর কতজন যে অত্যাচার করেছে কোন হিসেব নেই। শুধু একজনের কথা আলাদা করে বলতে পারে মা। ইয়াসির খান। সবার মতো সেও মাকে ভোগ করেছে কিন্তু কোথায় যেন তার একটা টান ছিল মায়ের প্রতি। মাঝে মাঝে নিজের খাওয়া থেকে কিছু খাওয়া উঠিয়ে রাখতো মায়ের জন্য। সবাই যখন অত্যাচার করতো, একমাত্র ইয়াসির খানে সে মাঝে মাঝেই ওষুধ খাইয়ে যেত। মায়ের কেন যেন মনে হয়, আমার মধ্যে মা ইয়াসির খানের ছায়া দেখতে পায়। আমার শারীরিক গড়ন রং চেহারার আদল নাকি ইয়াসির খানের সাথে মিলে যায়। আমি বুঝতে পারিনা লোকটাকে কি আমি মায়ের অত্যাচারী হিসেবে ঘৃণা করবো নাকি নিজের বাবা হিসেবে মেনে নিবো? নিজেকে জারজ সন্তান ভাবতে খুব কষ্ট হয়। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে।

মা আমাকে কতোটা ভালোবেসেছে তা এখন উপলব্ধি করি। আমি যখন হতবিহ্বল হয়ে যেতাম কিংবা হতাশায় ভুগতাম! মা বলতো, তোর বাবা কে আমি জানি না কিন্তু তুই আমারই ছেলে এটা জানি। তোর কি আমার পরিচয়ে বড় হতে সমস্যা আছে? আমি মেনে নিতাম আবার নিতাম না।

মায়ের আগ্রহে আর পরিশ্রমের ফল আমি আজ পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকুরে। এখন আর আমার অতীত কেউ জানতে চায় না। আমার পরিচয়েই আমি পরিচিত। একটা সময় মাকে আমি অভিমানে দূরে সরিয়েছি আর এখন? আমি সারাদিন আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে খুঁজি অন্য মায়েদের মাঝে। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এগারো বছর আগে। আমি বিয়ে থা করিনি। সারাদেশে চষে বেড়াই আর সেই মায়েদের খুঁজে বের করি, যারা ১৯৭১ এ পাকিস্তানিদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে এবং এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। আমি তাদের আমার কাছে নিয়ে আসি। আমার এক মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এখন আমার কাছে আরো চার মা আছেন। একদিন হয়তো আমার কাছে হাজারো মা থাকবেন। আমি আমার মায়েদের মাঝেই আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে পাই। নিজেকে এখন আর একা মনে হয় না। হাজারো বীরাঙ্গনা মায়েদের আদরের সন্তান হয়েই এদেশে আমার বেঁচে থাকা।


বিঃদ্রঃ এটা সত্য ঘটনা না। তবে অনেক সত্য ঘটনা আমরা হয়তো জানিও না।

নীল নির্জনে...................সেমন্তী ঘোষ

নীল নির্জনে...................সেমন্তী ঘোষ
প্রকৃতির বিমূর্ত বিচিত্র রূপ। একদিকে তার সৃষ্টির মহিমান্বিত মধুর কলতান,অন্যদিকে প্রলয়হারিনি ধ্বংসের সুর।চতুর্দিকে কত বৈচিত্রের সমাবেশ -কল্পনার ইন্দ্রধনুর বর্ণালী। কোথায় মরুর বুকে উঠের সারি,কখনো অরন্যের বুগিয়ালী স্বপ্নসুখ।আবার কখনো সহস্য তুষারধবল শৃঙ্গরাশি উচ্চশির দণ্ডায়মান,কখনো বা দরিয়ার দিগন্ততটে শুভ্র ফেনায়িত তরঙ্গ রাশির উত্তাল সমীরন। প্রত্যেক রূপেই সে অনন্যা। কর্মসূত্রে 'ইনফরমেশন এন্ড টেকনোলজির সেন্টারে'র অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট ম্যানেজার,সহ অধ্যাপিকা হওয়ার জন্য এই অনন্ত চলার পথে বারংবার বিভিন্ন রূপে দেখা সেই প্রকৃতির সাথে__তার সৃষ্টির জলছবির কাহিনী তাই স্বপ্নের বিভোরতায় গল্পের পাহাড় বুনে হৃদয়ে এক বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছে....

প্রকৃতির ক্যানভাসে স্বপ্নিল সুখ 
অনাহুত আবিলতা দরিয়ার রূপ
বিগলিত অশ্রুর মুখরিত ধ্বনি
"কলমের ডাকনামে" দিনমানে শুনি......

নীল দিগন্তের মাঝে উত্তাল সমুদ্রের শান্ত সমাহিত রূপের সন্ধানে এবারের যাত্রা আন্দামানে।বহুচর্চিত ঐতিহাসিক ও স্বদেশীদের সাক্ষ্য বহন করা পোর্টব্লেয়ারের 'সেলুলার জেল'আর নীল আইল্যান্ডের নিবিড় সমুদ্র তটে।কলকাতা থেকে সকালের বিমানে পোর্টব্লেয়ার। বিমানবন্দরে নামার আগেই বিমান থেকে দেখা যায় সবুজ বনানী ঘেরা বিভিন্ন আইল্যান্ড আর নীলরঙা সমুদ্র। ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপাসাগরের বুকে অবস্থিত ৫৭২ টি দ্বীপের সমষ্টি নিয়ে এই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। যার মধ্যে যাওয়ার অনুমতি মেলে কেবল মাত্র ৩৮ টি দ্বীপে। এই দ্বীপ গুলির মধ্যে সবথেকে শান্ত সমাহিত রূপে বৈচিত্র্যে ভরা অথৈ নীলের অপার সাগর বেলা নীল আইল্যান্ড। কাজের সূত্রে বারবার আসার জন‍্য এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার সময় ২০১৪, ২০১৭ আর ২০১৯ পরিবর্তনটা বেশি করে যেন চোখে পড়ছিল। কালের নিয়মে পরিবর্তন আসবেই তবুও প্রকৃতির মায়াবী রূপের যে মনোহর ছটা আগে দেখেছিলাম আজ মানুষের ঢল, হোটেলাদি নির্মাণে অনেকটাই ম্লান মনে হল।

এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'সবুজ দ্বীপের রাজা' তার গৌরব হারিয়ে ম্লান হয়ে যাবে না তো যন্ত্রমানবের রূপায়নে!!!!যদিও পরবর্তী মুহূর্তেই নীলাভ প্রকৃতির সুরেলা ধ্বনি এই প্রশ্ন ভুলিয়ে হৃদয়ের আঙিনায় প্রশান্তির ঢেউ তুলে সব দ্বিধা দূর করে দিল তার অসীম রূপমাধুর্যে।হোটেলে পৌঁছে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পৌঁছে গেলাম নিরালা নিভৃতে আকাশের নীল আর সমুদের নীলের নীল দরিয়ায়। নিরালা নির্জনে শ্বেতশুভ্র সৈকতবেলা 'করবাইনস কোভ'। প্রকৃতির পরম যত্নে কোমলতায় আচ্ছাদিত এখানকার ঢেউয়ের খেলায় একবার নামলে খুব কম মানুষ এখান থেকে সহজে উঠতে চান।মনে হয় যেন শান্ত বেলাভূমির কোলঘেঁষে চঞ্চল সমুদ্র শখার অনন্তকালের অবিশ্রান্ত খেলায় আরো কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে যাই। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে থেকে হোটেলে ফিরে এসে দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষে যাওয়া হল ঐতিহাসিক সেলুলার জেলে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত দলিল। সাগরমুখী পাহাড়ের পিছনেও খাড়া পাহাড়। জানালাহীন সংকীর্ণ সেল। সাগরের রং কালো হোক বা না হোক রক্ত সংগ্রামের ইতিহাসে "কালাপানি"। পাশে রয়েছে ফাঁসি ঘর।উপরে টাওয়ার;যেখান থেকে পূর্বে নজর রাখা হত সমগ্র জেল চত্বরের। সেখান থেকে উন্মুক্ত প্রকৃতির রূপ বিস্মিত করে। বিকেলে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো এর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাস। যা এই অনন্ত সৌন্দর্যের মাঝেও মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া হলো মেরিন পার্কে। সাগরপারের মৃদুমন্দ নির্মল বাতাসের মনোরম পরিবেশ।চোখে পড়বে বিধ্বংসী সুনামির স্মারকরূপে' একটি স্মৃতিসৌধের স্তম্ভ। রাত্রি অতিবাহিত সুখস্মৃতি রোমন্থনে।পরের দিন সকালে যাত্রা করা হল নীল এর উদ্দেশ্য। পোর্টব্লেয়ার থেকে নীলের দূরত্ব প্রায় 37 কিলোমিটার।পোর্টব্লেয়ার বা হ্যাভলক থেকে জাহাজে চেপে আসা যায় নীল আইল্যান্ড। জাহাজের সামনের আর পিছনের ঢেউ খেলানো জলের তোড় ডেকে বসে দেখতে দেখতে আমরা পৌছে গেল নীল দ্বীপে। জাহাজ থেকে নেমে জেটি দিয়ে হেঁটে আস্তে আস্তে চোখে পড়ল স্বচ্ছ নীল জলের নীচে কোরালের রাজ্য। তটভূমি বরাবর সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে স্পিডবোট, গ্লাস-বটম র্বোট, ওয়াটার স্কুটার। সবদিক জুড়ে নারকেল সুপারি সহ বিভিন্ন গাছ গাছালি। সাথে আনা ব্যাগ হোটেলে রেখে বেরিয়ে পড়া হল নীলাভ্র জলের মায়ার টানে। আসমানী নীল আর জলতলের নীলে প্রকৃতির রূপের বাহার। জলের স্বচ্ছ রং এ যারা শুধুমাত্র পাহাড় প্রেমী তারাও এসে প্রেমে পড়ে যাবেন।এখানে বেশ কতকগুলি সমুদ্র সৈকত রয়েছে -ভরতপুর, লক্ষণপুর,সীতাপুর প্রভৃতি।প্রত্যেক জায়গাতেই নীল জলের স্বচ্ছ রূপ। জলের স্বচ্ছতা এতটাই যে গভীর জলে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের পাতা দেখা যায়।বেশ কয়েকজনকে দেখলাম 'স্নরকেলিং' এ যেতে।আমরা গেলাম 'গ্লাসবটমে' চেপে গভীর জলের তলদেশের কোরাল,স্টারফিশ দেখতে।বেশিরভাগই জীবিত কোরালের সমাগম। ফিরে আসার সময় সমুদ্রতটে কিছু শামুক,ঝিনুক,শঙ্খ জমে আছে দেখলাম। সেখান থেকে যাওয়া হলো রক ফাউন্ডেশন দেখতে। অসংখ্য কোরাল, কাঁকড়া,সামুদ্রিক ছোট ছোট প্রাণী,রঙিন মাছ আর পাথুরে বোল্ডারে পরিপূর্ণ অঞ্চল। মুহূর্তকে মুহূর্ত বন্দি করে সেখান থেকে ফিরে এসে সীতাপুর বীচে ঘুরে আসা হলো। চাইলে নীল জলতটৈ নিজেকে ভিজিয়ে নেওয়া যেতে পারে।নীল সবুজের চোখজুড়ানো জলছবি। 

আবারো ফিরে যাওয়া হল লক্ষণপুর বীচে। নীল নির্জন বালুচরে বসে মনে হল সমুদ্রের অসীম জলরাশি যেন সাদা বালির বুকে আলপনা এঁকে দিয়ে যাচ্ছে।প্রাত্যহিক ক্লান্তিময় শহুরে জীবন থেকে দূরে নিস্তব্ধতার মাঝে ঢেউয়ের তালে পৃথিবী যেন তার আপন সৌন্দর্য ছড়িয়ে রেখেছে এখানে। রুপমাধুরীর এক অমোঘ আকর্ষণে স্নিগ্ধ বাতাস অনির্বচনীয় নির্জনতা মুখর হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে সূর্য অস্তাচলে। সমুদ্রের জলে ক্ষণে ক্ষণে সেই রঙের পরিবর্তন। কখনো আবির রাঙালাল,কখনো কমলা,আবার কখনো হালকা লালে।ধীরে ধীরে দূর সমুদ্রের বুকে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম হাসিতে গোধূলি বেলার ঝিরঝিরে সমীরন। মধুর হাওয়া আর নীলাভ স্বপ্নকে সাথে নিয়ে হোটেলে ফিরে আসা হলো। পরেরদিন প্রভাতে একই ভাবে ক্রজে চেপে ফিরে আসা হল পোর্ট ব্লেয়ার।পোর্টব্লেয়ার এসে দেখে নেওয়া হলো এনথ্রপলজিকাল মিউজিয়াম,সামুদ্রিকা নাভাল মিউজিয়াম আর জুওলজিক্যাল মিউজিয়াম। এক মুঠো স্বপ্নসুখের স্মৃতি কে অবলম্বন করে পরের দিনের বিমানে ফিরে আসা হল কলকাতায়। তবুও চোখে লেগে রইল নীল মেঘতটে সাদা বালুকারাশিতে নীল আইল্যান্ডের মোহ........

(চলবে)

ছবি: পৃথ্বীশ ভদ্র

চত্বর এবং বিবিধ....................শাহরিয়ার জাওয়াদ

চত্বর এবং বিবিধ....................শাহরিয়ার জাওয়াদ
এটা একটা চত্বরের গল্প-
কংক্রিটে মোড়া ধূসর একটা চত্বর।
তারুণ্যের সে কী দাপট তখন
সাক্ষী দেয়ালের প্রতিটি প্রস্থর!

এটা হয়তো তারুণ্যের গল্প-
সে কী তেজ, ঠিক যেন অগ্নিপিণ্ড!
জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় সবকিছু
দম ফেলবার ফুসরত নেই একদণ্ড।

এটা হয়তো আনন্দের গল্প-
অনেকে খুলত গল্পের ঝাঁপি, অঙ্কন,
কবিতা, গান, অভিনয় আর কিছু
বলিষ্ঠ আঙ্গুল তুলত গিটারের তারে কম্পন!

দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হতো

শত সহস্র রঙিন গ্রাফিতি;
কখনো তা হতো প্রতিবাদের ভাষা
আবার কখনো বাড়াত সম্প্রীতি।

বেশ তো ছিল ধূসর চত্বর-
হাজারো রঙে পড়েছিল ঢাকা,
হঠাৎ সবই পালটে গেল
নিমেষমাত্রেই সবই ফাঁকা।

কেউ আর খোলেনা তার গল্পের ঝাঁপি
কেউ আর গায় না গান; কবিতাটাও ঠিক জমে না।
অগ্নিপিণ্ড আজ নিজেই ভস্ম যেন
গিটারের তার আর কাঁপে না।
চুপচাপ এক বৃদ্ধ চত্বর নীরবে ঝিমোতে থাকে
দেয়ালে ফাঁকে জন্মেছে মস, ক্রমেই বাড়ছে তাতে।
ভয়াবহ এ নিঃসঙ্গতা, অসহ্য মনে হয়
এরই মাঝে আজও দেয়ালের গ্রাফিতিরা জেগে রয়!

সমুদ্র বিলাস................রাকিব সামছ শুভ্র

সমুদ্র বিলাস................রাকিব সামছ শুভ্র
'গরীব মিসকিন আত্মীয় বাসায় আসা মানেই টাকা ধার চাইতে আসা' ফুপার শুনিয়ে জোরে বলা কথাটা হয়তো অপমান সূচক। কিন্তু আমি শুনেও না শোনার ভান করলাম। পাশে বসা ফুপুর চেহারার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছে না। না তাকিয়েও আমি বেশ বুঝতে পারছি, তার বড় ভাইয়ের এই ছেলেটার জন্য দুয়েক ফোটা অশ্রুজল ভালোবেসে গড়িয়ে পরছে।
ঢাকা শহরে আমার এই একজনই আত্মীয় যে কিনা নিঃস্বার্থভাবে আমাদের ভালোবাসেন। নিজেদের প্রয়োজনে হলেও এখানে আমরা মাঝে মাঝেই আসি। বাসার সবাই খুব আনন্দচিত্তে আমাদের আসাকে পছন্দ করে বললে ভুল বলা হবে। তারপরও আপন ভাইয়ের ছেলে তাই হয়তো মেনে নেয়।

আমি আব্দুর রহমান, বিএ। মফস্বলের কলেজ থেকে পড়াশোনা করে ঢাকায় এসেছিলাম দশ বছর আগে। এই ফুপুর বাসাতেই উঠেছিলাম। ডুপ্লেক্স বাড়ির গেস্ট রুম সারা বছর খালি পরে থাকে, তারপরেও আমার জায়গা হয়েছিলো ড্রাইভারের থাকার ঘরে। রুমটা বাসা লাগোয়া গ্যারেজের উপরে। অনেকটা দেড়তলা উচ্চতায়। আমার তাতে অবশ্য আপত্তি ছিলোনা। ফুপু কষ্ট পেতেন কিন্তু আমার হাসিমুখ তাকে একটু দম ছাড়ার সুযোগ করে দিতো। পড়ালেখায় মোটামুটি হলেও সততায় একশোতে কানা কড়ি নাম্বারো কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। এবাসায় এসে আমার উপর প্রথম দায়িত্ব পরলো বাজার করবার। আমি প্রায় একবছর এ দায়িত্ব পালন করেছি এবং একদিনের জন্যেও একটা টাকা এদিক ওদিক করিনি। ফুপা উঠতে বসতে অপমান করলেও ঝানু ব্যবসায়ী। মানুষ চিনতে কখনো ভুল করেন না। বাজারের খরচ কমে যাওয়াতেই ফুপুকে একদিন বললেন, তোমার ভাইপো আব্দুর নাজানি আব্দুল! ওকে আমার অফিসে পাঠিয়ে দিও। ওকে অফিসে একাউন্ট সেকশনে বসিয়ে দেবো। পরের দিন থেকেই আমার ফুপার অফিসে এসিস্ট্যান্ট একাউন্টেন্ট এর চাকুরি শুরু। বেতন ধরলেন সাড়ে ছয় হাজার টাকা।

চারবছর মনপ্রাণ দিয়ে চাকুরি করারপর একদিন ফুপু ঘরে ডেকে পাঠালেন। ফুপার চাচাতো ভাইয়ের এক মেয়ের জন্য আমাকে প্রস্তাব করতে চান। আমি না বলে দিলাম। আমার যা সামর্থ্য! বিয়ে করাটাই বোকামি হবে তাও আবার ফুপার ভাইয়ের মেয়ে! ফুপু অনেক করে বোঝালেন, এই ভাই পয়সা ওয়ালা না। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, পাঁচটা মেয়ে। মেয়েরা বড় হচ্ছে পয়সার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না। ফুপা কোন প্রকারের দায়িত্ব নেন না। যদিও ফুপা নাকি এই ভাইয়ের কাছে থেকেই পড়ালেখা করেছেন প্রাইমারী স্কুলে। ফুপু ভাইয়ের ঋণ শোধ করতে চান মেয়েকে ভালো পাত্রস্থ করে। আমাকে মেয়ে পক্ষ কিছুই দিতে পারবে না আর আমারও তাদের কিছুই দেওয়া লাগবে না। ফুপু আমাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আমার মিয়াভাই গরীব হতে পারেন কিন্তু আমার জন্য জীবনে জান দেয়া ছাড়া সব করেছেন হয়তো চাইলে জানটাও দিয়ে দিতেন। তার ছেলে তুইও হয়েছিস বাবার মতোই। আর আমার ভাসুরের মেয়ে নিতুও খুব লক্ষ্মী। তোরা খুব সুখী হবি রে। আমি কিছু বলতে পারিনি। ফুপুর পা ছুঁয়ে সালাম করে শুধু বললাম, ফুপু তুমি দোয়া কর এবং যেটা ভালো মনে হয় কর। আমার আপত্তি নেই। ফুপু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বিড়বিড় করে বললেন, মা মরা মেয়েটা ভালো একটা ঠিকানা পেলো।

নিতু আর আমার বিয়ে হয়ে গেলো মাস খানেকের মধ্যেই। কাজী সাহেবকে ডেকে আমার বাবা মা, বোনেরা আর ওদের পরিবারের চারজন সবমিলিয়ে দশ বারোজন। শুধু এই একটা দিন ফুপাকে দেখলাম বেশ হাসিখুশী। ফুপুই পোলাও কোরমা রাঁধালেন। ওনার বাসাতেই খাওয়া দাওয়া হলো। নিতুকে আমার এক রুমের বাসায় তুললাম। মিরপুর এক নাম্বার মাজারের পেছনে একরুম সাবলেট নিয়েছি। 
তখন সর্বসাকুল্যে বেতন পেতাম দশ হাজার টাকা। ঘর ভাড়া দিতাম সাড়ে তিন হাজার সাথে গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল আটশো টাকা। অফিসে যেতে আসতে খরচ হতো চারশো টাকার মতো। দুজনে খেয়ে পড়ে কিছু টাকা জমানো যেতো। তা সে দুশো টাকাই হোক কিংবা পাঁচশো টাকা। নিতু খুব বেশী লক্ষ্মী মেয়ে। কোনদিন মুখ ফুটে কিছু চায় না। আমি যা এনে দেই তাই হাসিমুখে গ্রহন করে। পাঁচ সাতশো টাকার শাড়ী পড়ে যখন সামনে আসে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রই! এই মেয়েটা আমার বউ? এতো অল্পতেই এতো খুশী কিভাবে থকে মানুষ! ওর শুধু একটা প্রিয় জিনিস আছে আমি তা জানি। বাসায় ফ্রিজ নেই নয়তো আমি কষ্ট হলেও বাক্স ভরে নিয়ে আসতাম। আইসক্রিম খেতে খুব পছন্দ করে। অবশ্য ও কমলা রঙের ললি আইসক্রিম ছাড়া অন্য আইসক্রিম কখনো খায় না। অনেকবার জোর করেছি কিন্তু রাজি হয় না। ও অদ্ভুত ভাবে আইসক্রিম খায়। মুখে নিয়ে টেনে চুষে আইসক্রিমের রস আর কালারটুকুন খেয়ে নেয়। আইসক্রিমটা তখন একেবারে সাদা হয়ে যায়, শুধুই বরফ। সেই বরফটাই কামড়ে কামড়ে খাবে। আমার কাজ হচ্ছে ওই সময়টা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে দেখা। আমি আইসক্রিম খাই না। একটা খেলেই সাতদিন গলা ব্যথা করে। টনসলের সমস্যা ছোট বেলা থেকেই। 

পাঁচ বছরে আমাদের সংসারের পালে খুব একটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগেনি। বেতন বেড়েছে আমার। এখন চোদ্দ হাজার পাচ্ছি। নিতুও পাশের একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়াচ্ছে। বেতন শুনলে হাসবেন। দেড় হাজার টাকা। স্কুলের আয়ার বেতন চার হাজার টকা! জিজ্ঞেস করে জেনেছি ওদের প্রিন্সিপাল বলেন, আয়াতো আর টিউশনি করে আয় বাড়াতে পারবে না কিন্তু নিতুতো টিউশনি করলে হাজার টাকা কামাতে পারবে! নিতু একটা টিউশনি করায় বেতন নির্ধারণ করে দেয় নি। আয়ার মেয়ে বাসায় এসে পড়ে যায়। যখন যেমন পারে দেয়। কখনো দুইশো কোন মাসে তিনশো। আমি বলেছিলাম তুমি ফ্রি পড়ালেই পারো এই দুশো তিনশো টাকা না নিলেই হয়। ও উত্তরে বলেছিলো ফ্রি পড়ালে গুরুত্ব দিবে না। এখন টকা দিতে হচ্ছে বলেই নিজে থেকে বাচ্চাকে পড়তে দিয়ে যায়। ওর যুক্তিতে কিছু বলার পাইনি। 
আমরা সাবলেট থেকে বেড়িয়ে নিজেরা একটা দেড়রুমের বাসা নিয়েছি। একটা বেডরুম সাথে আধাখানা ডাইনিং, একটা ছোট্ট রান্নাঘর। একটা বাথরুম আর আমাদের প্রিয় জায়গা একটা চার ফিট বাই আড়াই ফিটের বারান্দা। নিতু খুব সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছে ঘর। বারান্দায় কয়েকটা গাছও লাগিয়েছে। নীল অপরাজিতা, একটা গোলাপ আর দুটো ঝুলন্ত গাছ শোভা বাড়াচ্ছে আমাদের বারান্দার। ছোট দুটো টুল পেতে মাঝে মধ্যেই আমরা চা পান করি আর দুজনে স্বপ্নের কথা বলি। বিয়ের পরে একটা আব্দার করেছিলো নিতু। যদি কোনদিন আমাদের টাকা হয় তাহলে যেনো ওকে একবার সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাই! সত্যি কথা বলতে কি! আমি নিজেও কখনো সমুদ্র দেখিনি। আমার খুব ইচ্ছে করে এক গোধুলিবেলায় নিতুর হাত ধরে সমুদ্র জলে পা ভিজাবো। ও নীল রঙের শাড়ী পড়বে, ওর আঁচল বাতাসে উড়বে। আমি একদিকে পড়ন্ত সূর্যকে দেখবো অন্যদিকে আমার জীবনের জ্বলজ্বলে সূর্যকে সাথে নিয়ে। 
হিসেব করে দেখেছি যাওয়া আসা, হোটেলে থাকা খাওয়া সব মিলিয়ে দশ বারো হাজার টাকা লাগবেই। এই টাকাটা কতবার চেষ্টা করেছি যোগাড় করতে। কোননা কোন ভাবেই টাকাটা খরচ হয়ে যায়। একটা কথা বলা হয়নি। চার বছর আগে নিতু আর আমার ভালোবাসার ফসল অনির জন্ম। এরপর থেকে আমাদের জীবন এবং জীবনের গল্প অনিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। পাওয়া না পাওয়া সব ওকে নিয়েই।
প্রতিবার টাকা জমাতে জমাতে দশ হাজারের কাছে গেলেই একটা বিপদ কিংবা প্রয়োজন এসে সামনে দাঁড়ায়। একে এড়িয়ে টাকাটা ধরে রাখা আর হয় না। গত দুই বছর ধরে প্রতিমাসে বেতন থেকে পাঁচশত টাকা আলাদা করে আলমারিতে রাখা ছোট বক্সে রেখে দেই। এবার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি এই টাকা ভাঙবো না। নিতু আর অনিকে নিয়ে সমুদ্র দর্শনে যাবোই। গতমাসে দশ হাজার টাকা পূর্ণ হয়েছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে গুনে দেখি সাথে দিবা স্বপ্নে হারিয়ে যাই। এখন অবশ্য স্বপ্নে দুজন দুজনের হাত ধরিনা বরং দুজনে মিলে অনির দুহাত ধরে সমুদ্র জলে পা ভিজাই। 
মনে মনে ঠিক করেছি ওদের চমকে দেবো সবকিছু ঠিক করে। ছুটি নেয়ার চেষ্টা করছি। নিতুকে বলতেই ওর মুখে খুশীর ঝলক দেখতে পেলাম। আর চার বছরের অনিটা! পুরো বাসা জুড়ে প্রজাপতির মতো উড়ছে আর বলছে, কি মজা সমুদ্দ দেখতে যাবো, সমুদ্দ দেখবো (ও এখনো সমুদ্র বলতে পারে না। সমুদ্দ বলে।) ওর আনন্দ দেখে আমাদের চোখে পানি চলে এসেছে। আমি নিতুকে আমার বাহুডোরে টেনে নিলাম। ও আমার বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে। আর আমাদের পাকনা পাখিটা এসে দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে। এরচেয়ে বেশী সুখ আর কি বা চাওয়ার আছে?

নিতু জামাকাপড় গুছাচ্ছে। আমাদের ভালো কোন ব্যাগ নেই। দুজনে মার্কেটে গিয়ে একটা ব্যাগ কিনলাম। বিয়ের পর এই প্রথম বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও বেড়াতে যাবো। দুজনের মধ্যেই খুব এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। অকারণেই আমরা হাসছি, দুজনের চোখে চোখ পরলেই। অনিতো আশেপাশের বাসায় গিয়ে এরইমাঝে বলে এসেছে আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি। 
আমি ভয়ে ভয়ে আছি। সামনে কোন অযাচিত বিপদ বা প্রয়োজন সামনে এসে দাঁড়ায় কিনা! আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তদের সাধ আর সাধ্য কখনোই এক সুতোতে গাঁথা হয়ে উঠে না। অবশ্য এখনকার পরিবেশে নিজেদের নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাবার চাইতে মধ্যে মধ্য বাদ দিয়েই ভাবতে হয়।
চারদিন বাদে আগামী বৃহস্পতিবার রাতে আমাদের কক্সবাজার যাবার কথা। সব গোছগাছ শেষ। অফিসের এক কলিগের কাছ থেকে একটা ক্যামেরাও ধার করে এনেছি। 

অফিস থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে চা মুড়ি খাচ্ছি। এমন সময় দরজায় শব্দ। সাথে কলিং বেলের মুহুর্মুহ বেজে ওঠা। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো নিতু। পাশের বাসার রিতা ভাবি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকলেন। ভাবি আমার হৃদয়কে বাঁচান। ও সিড়িতে পরে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে, এখন বমি করছে। শুনে আমি হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে বললাম, ভাবি এক মূহুর্ত সময় নষ্ট করবেন না, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। পাঁচ বছরের হৃদয়ের বাবা বোকার মতো তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। মাসের শেষ পকেট খালি। এখন চিকিৎসার টাকা পাবেন কোথায়? ওনারাও আমাদের মতোই স্বল্প আয়ের পরিবার। 
একবার ভেবেছিলাম চুপ থাকি। কিন্তু নিতুর চোখে চোখ পরতেই যা বোঝার বুঝে নিলাম। আমি ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে কক্সবাজারের যাবার জন্য রাখা টাকাটা এনে নিতুর হাতে দিলাম। নিতু টাকাটা নিয়ে ভাবির হাতে দিয়ে বললো, ভাবি এটা রাখুন এরচেয়ে বেশি দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। 
ভাবি জানতেন আমাদের কক্সবাজার যাবার কথা। টাকাটা ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। নিতুর জোড়াজুড়িতে টাকাটা নিতে বাধ্য হলেন।

ভাই সহ আমি হৃদয়কে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলাম। তিনদিন পর হৃদয়কে নিয়ে বাসায় ফিরলে আমরা ওকে দেখতে গেলাম।
অনি আর হৃদয় খেলতে শুরু করেছে। ওদের নিষ্পাপ প্রাণবন্ত হাসির আওয়াজে আমরা সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন অনুভব করছিলাম। সবার অলক্ষ্যে আমি নিতুর হাত হাতে নিলাম। ওর গভীর স্পর্শ আমাকে অনেক কথাই বলে দিলো।

মৃত্যু চুম্বন (সেরা গল্প) ..................মনিরুল ইসলাম জোয়ারদার

মৃত্যু চুম্বন (সেরা গল্প) ..................মনিরুল ইসলাম জোয়ারদার
সময়টাতে রিক্সা পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। সকাল নটা থেকে দশটা সাড়ে দশটা এগারোটা পর্যন্ত রাস্তায় সব ধরনের কর্মজীবিরা নেমে আসে ফলে রিকশা কিংবা সিএনজি পাওয়া খুবই দুষ্কর। দেরি হলে ক্লাশ মিস হয়ে যাবে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লো অনুরাধা ব্যানার্জী।ঠিক দশটা চল্লিশে ক্লাশ শুরু,উদ্বিগ্ন হয়ে এদিক ওদিক দেখলো একটা রিকশাও খালি নেই এদিকে দশটা পনের বাজে হঠাৎ মাথায় ঢুকলো পাঠাওয়ের মোটরসাইকেলের কথা কদিন আগে ওর ক্লাশফ্রেন্ড মলির কাছে শুনেছিল সে মাঝে মাঝে পাঠাও এর মোটর বাইকে ভার্সিটিতে আসে।সেদিনই অনুরাধা পাঠাও এ্যাপটি ডাউনলোড করে নেয়,ভাবলো এসময় কি আর বাইক ফ্রী থাকবে তাছাড়া ভাড়া বাইকে চড়তে ওর সঙ্কোচ বোধ হয় ভয়ও লাগে কি জানি কে কি মনে করে কিংবা কোন বিপদে পড়ে যায় কিনা।আজ সে উপায়ান্ত না দেখে কল করলো এবং প্রায় সাথে সাথে কল পেল ওপাস থেকে বললো আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।ঠিক সাত মিনিটের মধ্যেই মোটরবাইক চলে এলো বললো হেলমেটটা পরে নিন স্পষ্ট আকর্ষনীয় স্বর শুনে মন্ত্রমুগ্ধের মত দুপা একদিকে দিয়ে বাইকারের পেছনে বসলো,বাইকার এবার সেই একই স্বরে বললো প্লিজ দু'দিকে পা দিয়ে বসেন পুলিশ ঝামেলা করে অনুরাধা ইতস্তত করছে দেখে বাইক চালক বললে ঠিকাছে একদিকেই পা দিয়ে বসেন অনুরাধা দু'পা একদিকে দিয়ে বসে পড়লো ঠিক ক্লাশের দশ মিনিট পূর্বেই ক্যাম্পাসে চলে এলো।নেমেই বললো কত দিতে হবে চালক মুচকি হেসে বলে কেন ম্যাডাম এ্যাপসেতো ভাড়া শো করছে দেখে নিন আর আমাকে একশো দশ টাকা দিন।অনুরাধা সরি আমি এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি তাই দেখা হয়নি।একটা দুশো টাকার নোট বের করে দিলো।চালক বহু কষ্টে মানিব্যাগ এবং এ পকেট ও পকেট হাতড়ে ভাংতি বের করে নব্বই টাকা ফেরত দিলো।অনুরাধা ভেবেছে পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিলেই হবে কিন্তু পুরো নব্বই টাকা ফেরত দেওয়াতে অবাকই হয়ে বললো আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিন বাকিটা রেখে দিন চালক আবারো মৃদু হেসে দৃঢ় কন্ঠে বলে ম্যাডাম উহু এটা আমি নেইনা আপনি টাকাটা রাখুন বলে নব্বই টাকাই ফেরত দিলো। অনুরাধা টাকাটা হাতে নিয়েই ছুটতে শুরু করলো আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে অর্থাৎ বেশ দ্রুতই চলে এসেছে,ভাবছে রিক্সায় এলে তিন তিন বার রিক্সা বদল করতে হতো ভাড়া পড়তো একশো কুড়ি টাকা আর সিএনজিতে এলে পুরো দুশো টাকা তবেতো মোটার বাইকে আসা বেশ সাশ্রয়ী।
জুনায়েদ সাইড স্ট্যান্ড নামিয়ে বাইকটাকে কাত করে দাড় করিয়ে হেলমেটটা খুলে মেয়েটির গমন পথের দিকে এক পলক দেখেই তার গলা দিয়ে অপুর্ব শব্দ বের হয়ে এলো ঠিক তখনি আরেকটা কল এলো,বাইক নিয়ে সেদিকে চলে গেল জুনায়েদ।
কিরে রাধা কার বাইকে এলি শুরু হয়ে গেল নাকি?ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম কেমনে কি খুলে বল দেখি। ধ্যাত কি শুরু করলি ওতো পাঠাওয়ের বাইক চালক দ্রুত আসার জন্য ভাড়ার বাইকে চলে এলাম।ও আচ্ছা বলে রিমি বললো চল ক্লাশে ঐ যে স্যার আসছে।
ক্লাশ শেষে মলির সাথে দেখা মলি সবসময় ক্লাশের সামনের বেঞ্চে বসে ওর বাসা ভার্সিটি থেকে দু কিমি হবে তাছাড়া মলি নিজেদের গাড়িতেই আসা যাওয়া করে ফলে বেশ আগে আগেই ক্লাশে এসে সামনের বেঞ্চে বসতে পারে এমনিতেই মলি দারুণ স্মার্ট ও ভার্সাটাইল,ভার্সিটির যে-কোন কার্যক্রমে তাকে থাকতেই হবে।এদিকে অনুরাধার বাসা বেশ দূরে থাকায় ওর আসতে প্রায়ই দেরি হয়ে যায় 
ফলে তাকে পেছনের বেঞ্চেই অধিকাংশ সময়ই বসতে হয়।আজ ক্লাশ শেষে অনুরাধা পেছন থেকে এসে মলিকে জড়িয়ে ধরতেই মলি তাকে প্রশ্ন করে কিরে রাধা কি শুনলাম? রাধা অবাক হয়ে মলিকে বলে কেন কি হয়েছে? খুলে বল। শুনছি তুই নাকি কারো প্রেমে পড়ে তার বাইকে ঘুরছিস? অনুরাধা হো হো করে হেসে উঠে বললো তুই যেমন মাঝে মাঝে প্রেমে পড়িস তেমনি। ও আচ্ছা তাহলে এই বিষয় এদিকে ক্লাশের সবার মুখে রটে গেছে তুই প্রেমিকের বাইকে ঘুরসিছ হা হা হা!
মলি অনুরাধার বেস্ট ফ্রেন্ড দূজনে দু'জনার মনের কোনের সব কথাই শেয়ার করে এরা দু'জন ছাড়াও রিমি ছন্দা আলিশা শোয়েব রুপম এরাও ওদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তবুও মলি আর অনুরাধার ঘনিষ্ঠতা সবারই জানা।ক্লাশ শেষে খানিকটা আড্ডা মেরে ওরা ফিরে গেল।
পরদিন একই অবস্থা রিক্সা সিএনজি কোনাটাই খালি পাওয়া যাচ্ছে না আজ মনে হয় আরো ভিড় বেশি, আজ অনুরাধা সাড়ে ন'টায় বের হয়েছে তাই ভাবলো রিক্সা নেবে কিন্তু একটা রিক্সাও খালি নেই একটু দূরে একটা খালি রিক্সা দেখে ডাক দিতেই আরেক ভদ্রলোক লাফ দিয়ে চড়ে বসলো কি আর করা আবার অপেক্ষা কিন্তু যেই প্রায় দশটা বাজে বাজে অবস্থা তখনি তার হুঁশ হলো ফলে আজো পাঠাওয়ের শরণাপন্ন হলো একটু পর কল দিলে দু'মিনিট আমি আসছি আপনি কি কৃষ্ণ চুড়া গাছের নিচে আছেন?জি আমি ওখানেই আছি। ঠিক দু মিনিটের ভেতর বাইক হাজির,ম্যাডাম হেলমেটটা পরে নিন।কোন কথা না বলেই হেলমেট মাথায় দিয়ে পেছনে বসে পড়লো অনুরাধা সময়ের বেশ আগেই পৌছে গেল ক্যাম্পাসে বাইক থেকে নেমেই মোবাইলে এ্যাপস দেখলো একশো তিন টাকা সে ব্যাগ থেকে একশো তিন টাকাই বের করে চালকের হাতে দিয়েই ছুটলো ক্লাশের দিকে বাইক চালক আজ আর না থেমেই ঘুরিয়ে চলে গেল।অনুরাধা যখন বাইকে উঠে তখনই বুঝেছিল এ লোকটাই গতকালের একই চালক।এভাবেই কয়েকদিন একই মোটর বাইকে যাবার পর অনুরাধার মনে হলো প্রতিদিন একই চালকের বাইকে চড়া ঠিক হচ্ছে না।পরেরদিন সকাল সকাল বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে ভার্সিটিতে চলে এলো।
আজো কোন কল না পেয়ে জুনায়েদ ভাবলো মেয়েটির কি কোন অসুখ হলো! ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা অনুভব করছে সে। এভাবেই তিনটে দিন কেটে গেল চতুর্থ দিনে জুনায়েদ মেয়েটির কল না পেয়ে নিজেই কল করলো মেয়েটি ইতস্তত করেও কলটি ধরলো।নাম্বারটা অনুরাধার মুখস্থই হয়ে গেছে ও বুঝতে পেরেও জিজ্ঞেস করলো কে বলছেন
-আমি পাঠাও এর বাইক চালক 
-ও আচ্ছা আমিতো ভার্সিটিতে চলে এসেছি
-ও কাল কি যাবেন?
-কালকের বিষয় কালকে আচ্ছা প্রতিদিন আপনি একাই আসেন কেন শুনেছি অনেক বাইক রাস্তায় থাকে?
-না মানে আমিতো পাসেই থাকি তাই। 
-ও আচ্ছা তবে আপনি কি আর কোন প্যাসেঞ্জার নেন না।
-নিই তবে তিন চারটা এর বেশি না। 
ও আচ্ছা ঠিকাছে, বাই।
পরেরদিন রাস্তায় বেরুতে দেরি করে ফেললো অনুরাধা তাড়াতাড়ি যাবার জন্য পাঠাওয়ে কল করলো দ্রুতই চলে এলো জুনায়েদ বাইকের পেছনে বসে চলে এলো ভার্সিটিতে। অনুরাধা বাইক থেকে নেমে হাত ঘড়ি দেখলো এখনো পঁচিশ মিনিট বাকি প্রথম ক্লাশের।প্যান্টের পকেট থেকে লম্বা ছয় ইঞ্চি পার্সটা বের করে দুশো টাকার নোটটা বাইক চালক জুনায়েদের হাতে দিলো।জুনায়েদ ইতস্তত করে বললো 
-আমার কাছে ভাংতি নেই ঠিকাছে আপনি একশো টাকা দেন। 
-আমার কাছেতো একশো টাকার নোট নেই। 
-ও ঠিকাছে তাহলে কাল দিবেন।
-আমি কারো কাছে ঋণী থাকতে চাই না। 
-ও 
-আপনি ভাংতি নিয়ে বের হন নাই?
-আসলে গতকাল বের হয়নি তাই,হাতে যা ছিল খরচ হয়ে গেছে।
-তো দুতিনটে ভাড়াতে আপনার সংসার চলে?
জুনায়েদ তবুও এ পকেট সে পকেট খুঁজতে লাগলো। 
-আসলে আমার এত পয়সার দরকার নেই পড়াশোনা শেষে করেছি এখন কাগজপত্র জোগাড় হলেই দেশের বাইরে চলে যাবো। তাই ভাবলাম যে কদিন আছি পকেট খরচটা উঠিয়ে নিই বারবার বাবার কাছে টাকা চাইতে লজ্জা লাগে তাছাড়া বাইরে যেয়েতো অডজব করে চলতে হবে সেই কারণে লজ্জটাকে জলাঞ্জলি দিতে প্রাকটিস করছি। 
অনুরাধা তন্ময় হয়ে যুবকটির কথা শুনছে আর মনে মনে প্রশাংসা করছে।অনুরাধা তাকে জিজ্ঞেস করলো
-কোন ভার্সিটিতে পড়েছেন?
-আপনার এই ভার্সিটিতেই।
-বলেন কি কোন সাবজেক্টে? 
-মাইক্রোবায়োলজিতে।
-কবে শেষ করলেন?
-এইতো গত বছর।আপনি কোন সাবজেক্টে?
-বিবিএ,ম্যানেজমেন্টে এবার সেকেন্ড ইয়ারে। 
-তাহলে যাই আপনি টাকাটা পুরোই রেখে দেন কাল চড়লে শোধ হয়ে যাবে।
-এটা কেমন দেখায় না?
-কি এমন দেখাবে যেহেতু কারো কাছেই নেই তাছাড়া আপনি আমাদের ভার্সিটির সিনিয়র ভাই একটু সুযোগতো দিতেই হয় মুচকি হেসে আসি বলে হাটা দিলো।দুপা হেটেই ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করলো আপনার নামটা বলবেন প্লিজ? 
-জুনায়েদ।
অনুরাধা আর একমুহূর্ত না থেমে হনহন করে হাটতে লাগলো ওদিকে রিমি মলি ছন্দা অপেক্ষা করছে।
জুনায়েদ টাকাটা নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবলো আজ হাজার খানেক টাকার খউব দরকার। টাকাটা পকেটে রেখে বাইক স্ট্রাট দিলো।
অনুরাধা জুনায়েদের সাথে ভাড়া নিয়ে কথা বলছিল যখন, তখন দূর থেকে শোয়েব ছন্দা রিমি অনুরাধার দিকে তাকিয়ে ছিল।অনুরাধা কাছে আসতেই ওকে ছেকে ধরলো কিরে বাইকওয়ালার সাথে এত কথা বলছিলি কি ব্যাপার।নারে উনার কাছেও ভাংতি নেই আমার কাছেও নেই তাই ব্যাগে খুজঁতে খুঁজতে দেরি হলো। ক্লাশ শেষে মলিকে বললো চলতো সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে মলি বললো কেনরে যাবি ওখানে?একটু কাজ আছে বলেই হাঁটতে হাঁটতে মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের অফিসে ঢুকে চেয়ারে বসে থাকা অফিসারকে জিজ্ঞেস করলো গত বছর পাস করে বের হয়েছে এমন স্টুডেন্টের খোঁজ কিভাবে পেতে পারি ম্যাডাম? মহিলাটি বললো এখানেই, কেন? বলেই গত বছরের রেজিস্ট্রার খাতা বের করে জিজ্ঞেস করলো নাম কি? অনুরাধা বললো জুনায়েদ। মলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনুরাধার দিকে চেয়ে রইলো।অফিসারটি খাতাটা বন্ধ করে বললো ও জুনায়েদ সেতো দারুণ মেধাবী ছেলে ফার্স্ট ক্লাশ সেকেন্ড হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান স্কলারশিপও যোগাড় হয়ে গেছে তাঁর এ ডিপার্টমেন্টের সবারই প্রিয় সে, টিচারদের ফেবারিট স্টুডেন্ট আবার হেভি হ্যান্ডসামও বলে মুচকি হাসি দিয়ে অনুরাধার দিকে চেয়ে বললো বিয়েটিয়ের ব্যাপার নাকি? এরকম ছেলে কিন্তু লাখে একটা হয়। অনুরাধা হ্যা এরকমই বলে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে মলির হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে এলো মলিতো বিশ্ময়ে কিছুই জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গেছে যেন।
পরদিন কল দিলেই জুনায়েদ চলে এলো বাইকে উঠতে উঠতেই অনুরাধা জিজ্ঞেস করলো অস্ট্রেলিয়ার কোন ভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়েছেন?জুনায়েদ বাইক স্ট্রাট দিলেও হ্যান্ডব্রেক চেপে ধরে পেছন ফিরে অনুরাধার দিকে বিশ্ময়ে চেয়ে বললো আপনি জানলেন কিভাবে?
-হুম জানতে পারলাম।
-গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করেন নাকি?
-ধরুন তাই। 
-ওরে বাবা তাইলে তো আমার সবই জেনে গেছেন?
-তা অনেক কিছুই জেনেছি বটে তবে এখন চলেনতো।জুনায়েদ বাইক ছেড়ে দিল পনের মিনিটের মধ্যেই ক্যাম্পাসে চলে এলো।আজ বেশ খানিকটা আগেই এসেছে অনুরাধা, এখনো প্রায় এক ঘন্টা বাকি ক্লাশের। এখনো বন্ধুরা কেউ আসেনি।বাইক থেকে নেমেই জুনায়েদকে জিজ্ঞেস করলো কই বললেন নাতো কোন ভার্সিটিতে পড়তে যাবেন?
-অস্ট্রেলিয়ার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে। 
-বাহ্ ওটাতো খুউবই ভালো ইউনিভার্সিটি তা কবে যাচ্ছেন? 
-সব রেডি হলে সামনের মাসে বলে জুনায়েদ বাইক স্ট্রাট দিলো চলে যেতে যেতে অনুরাধা বললো বারে টাকাটা নিবেন না?
-গতকাল বেশি নিয়েছি আজ নিবো না।চলে যায় জুনায়েদ। অবাক হয়ে মোহগ্রস্তের মত তাকিয়ে থাকে।
এখন প্রায় প্রতিদিনই জুনায়েদের বাইকে ভার্সিটিতে যায় গল্প করে এভাবেই ওদের মধ্যে ধীরে ধীরে ভালবাসা জন্মায় তা প্রেমে গড়িয়ে যায় ভুলে যায় ওরা দু'জন দু ধর্মের মানুষ।ভুলে যায় ওদের পারিবারিক সংস্কৃতি। কিছুই ভাবেনা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি।ভালবাসায় মনের আরো কাছে চলে আসে দুজনে।ওরা সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করার এবং দু’তিনজন বন্ধুদেরকে নিয়ে কাজী অফিসেই বিয়েটা সেরে ফেলে তবে বিয়ের খবর কেউ ফাঁস করে না।ওরা সিদ্ধান্ত নেয় চেষ্টা করবে দুজনেই অস্ট্রেলিয়ায় যাবে একত্রে যদি অনুরাধা ভিসা না পায় তবে জুনায়েদ যাবার পর অনুরাধা দ্রুত যাবার চেষ্টা করবে। জুনায়েদের যাবার সময় হয়ে এলো দু সপ্তাহ পর ফ্লাইট। সব রেডি অনুরাধার মন ভীষণ ভীষণ খারাপ এর মধ্যেই বিভিন্ন দেশে করোনা দেখা দিয়েছে লকডাউন শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও লকডাউন শুরু হলো জুনায়েদের যাওয়া হলো না।দুজনের দেখাও হয় না প্রতিদিন তবে মোবাইলে কথা চলে ঘন্টার পর ঘন্টা হঠাৎ একদিন জুনায়েদ কল করেও পায়না অনুরাধাকে জুনায়েদ বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় পরদিন ফোন করে কেউ ধরে না তবে কি অনুরাধার পরিবার জেনে গেছে বিয়ের কথা আর তাই তাকে মোবাইল থেকে দূরে রাখছে! তৃতীয় দিন ফোন করতেই রিসিভ হলো ওপাস থেকে কথা বলার আগেই জুনায়েদ অবিরাম বলতে লাগলো কেন ফোন ধরছো না,কেন দুদিন কথা বললে না তুমি জাননা তোমার কন্ঠ না শুনলে আমর মরে যেতে ইচ্ছে করে হঠাৎ মনে হলো ওদিক থেকে চাপা কান্নার শব্দ হ্যালো হ্যালো কি ব্যাপার কাঁদছো কেন অনু কি হয়েছে রাধা? ফুপানো শব্দে ওপাস থেকে বললো আমি রাধার মা বলেই আবার কান্না কয়েক সেকেন্ড পর আবার কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো বাবা রাধাকে গতকাল ভোরে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে ওর অবস্থা ভালো না ও না বাঁচলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো!তুমি জুনায়েদ? জি বলে জুনায়েদ জিজ্ঞেস করে কোন হসপিটালে? রাধার মা হসপিটালের নাম বলতেই জুনায়েদ কল কেটে দিয়ে মোটর বাইক নিয়ে সোজা হসপিটালে।রিসিপশনে জিজ্ঞেস করলো অনুরাধা নামে একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছে কোন ওয়ার্ডে।ছয় ফিট দূরত্বে কাচ দিয়ে ঘেরা নতুন রিসিপশনের ভেতর থেকে পুরো শরীর পিপিই দিয়ে ঢাকা লোকটি বললো ডান দিকে যেয়ে পেছনে করোনার জন্য আলাদা ওয়ার্ড খোলা হয়েছে তবে ওখানে কাওকে যেতে দেওয়া হয় না।জুনায়েদের কানে কোন কথা ঢুকলো না সে সোজা করোনা ওয়ার্ডে চলে এলো ওখানে দু'জন গার্ড দাড়িয়ে সে কাছে যেতেই ওরা হই হই করে উঠলো বললো দূরে যান দূরে যান যদিও ওর হাতে গ্লাভস মুখে ডাবল মাক্স তবু্ও। জুনায়েদ তার হাতের গ্লাভস খুলে গেটের দিকে যেতেই গার্ড দু'জন ইলেকট্রক শক খাবার মত ওর কাছ থেকে দূরে ছিটকে সরে গেলো ও ভেতরে ঢুকে খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেল অনুরাধাকে কাছে যেতেই একজন নার্স দৌড়ে এলো বললো এখানে ঢোকা নিষেধ ঢুকলেন কিভাবে নার্সের কথা না শুনে বসে পড়লো অনুরাধার বেডে।অক্সিজেন চলছে প্রায় নির্জীব শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে কারো বসার অনুভবে চোখ মেলে চাইলো অনুরাধা।ইতোমধ্যে একজন ডাক্তার ও দু'জন নার্স ওর দুদিকে পাঁচ ফিট দূরে ওকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। জুনায়েদ অনুরাধার দিকে একটু ঝুকলো ইয়াং ডাক্তার কড়া ধমক দিয়ে বললো আপনি সরে যান এক্ষুনি নইলে পুলিশ ডাকবো সিনিয়র নার্স বললো সরে যান প্লিজ আপনারও নিশ্চিত করোনা হবে। হলে হোক বলে অনুরাধার করুণ মুখের দিকে আরেকটু ঝুকলো জুনায়েদ। অনুরাধার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে দুহাত দিয়ে জুনায়েদকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে সে তার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ।আর সহ্য করতে পারছে না জুনায়েদ ভাবছে অনুরাধার কষ্টটা ভাগ করে নেবে নিজে। সে এক হাতে একটানে নিজের মাক্স টেনে ছুড়ে ফেলে দেয় তা দেখে অনুরাধাও নিজের মুখে লাগানো অক্সিজেন মাক্সটি খুলে ফেলে,জুনায়েদ ঝটকরে অনুরাধার ঠোটে ঠোট লাগিয়ে গাঢ় চুম্বনে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।ইতোমধ্যে তাদের চারিদিকে আরো দু'জন গার্ড এসে দাড়িয়েছে নবীন ডাক্তারটি গার্ডদ্বয়কে যুবকটিকে টেনে আনতে বলে গার্ডদ্বয় একটু এগুতেই সিনিয়ার নার্স হাতের ইসারায় ডাক্তারকে না করে মুখে বলে থাক এখন আর লাভ নেই যা হবার হয়ে গেছে ছেলেটি অলরেডি এফেক্টেড।জুনায়েদ চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিলো অনুরাধাকে তার চোখেও পানি গড়িয়ে পড়ছে অনুরাধাকে বলছে তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা নিষ্ফল মরলে দু'জনে এক সাথে মরবো বাঁচলে একসাথে।সিনিয়র নার্সের চোখেও জলের ধারা নেমে আসছে তাঁর মনে পড়লো হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত তাঁর স্বামী তাঁকে এভাবেই শেষ চুম্বন দিয়েছিলো।
এরপর যুবক যুবতীটির কি হয়েছিল কেউ খোঁজ করেনি কেউ তাঁদের খবর রাখেনি এই প্যান্ডামিকের সময় প্রতিদিন অসংখ্য লোকের মৃত্যু হচ্ছে কে কার খবর রাখে হয়তো তাঁরা দু'জন মৃত লাশের গননায় পড়েছে কিংবা সুস্থতার তালিকায়ও পড়তে পারে লেখক সে খোঁজ নিতে পারেনি।

শিরোনামহীন পর্ব ২................মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন

শিরোনামহীন  পর্ব ২................মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন
ব্দুর রহমান সা‌হেব বন্দী পাক চৌ‌কি‌তে। গত তিন দি‌নে তাঁর ওপর দি‌য়ে অমানু‌ষিক নির্যাতনের ষ্টিম রোলার চ‌লে‌ছে। শারী‌রিকভা‌বে ভীষণ ক্লান্ত তি‌নি। প্রচন্ড ঘুম পা‌চ্ছে কিন্তু শরী‌রের ব্যথায় ঘুমা‌তেও পার‌ছেন না। তারপরও সন্ধ্যার পর থে‌কেই ঘু‌মের ভান ক‌রে রূ‌মের এক কোণায় মে‌ঝে‌তে শু‌য়ে আছেন আর স্ত্রী সন্তা‌নের জন্য দু‌শ্চিন্তা কর‌ছেন। রাত ১১টার পর চারদিকের সব আলো নি‌ভি‌য়ে দেয়া হ‌লো। 
অন্ধকারের ম‌ধ্যেও তি‌নি প‌রিষ্কার দেখ‌তে পা‌চ্ছেন দু'জন সিপাহী পাহারা দি‌চ্ছে। হঠাৎ লক্ষ্য কর‌লেন, তারা ফিস‌ফিস ক‌রে পরষ্পর কথা বল‌ছে। তি‌নি কান খাড়া কর‌লেন, এখন শুন‌তে পা‌চ্ছেন কিন্তু বুঝ‌তে পার‌ছেন না। চার‌দি‌কে তা‌কি‌য়ে নি‌শ্চিত হ‌য়ে নি‌লেন যে, আপাতত আলো জ্বলার সম্ভাবনা নাই। 
এবার উঠে পা টি‌পে টি‌পে এগু‌তে লাগ‌লেন গেটের দি‌কে। হ্যাঁ, এখন প‌রিষ্কার বুঝ‌তে পার‌ছেন তি‌নি। 
১ম ব্যক্তিঃ অপা‌রেশান শুরু হোয়া। ইন সাব‌কো মি‌ত্তি‌কে সাথ পিছাল দো।
২য় ব্যক্তিঃ হামা‌রে সাথ কন্স‌পি‌রেসী? ইতনা বড়া হিম্মত হো তোম কেহ‌তে হো, এবা‌র কো সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। দে‌খো আভি কিত‌নে মজা! আভি পি‌ঞ্জি‌রে মে ছাড়‌তে রা‌হো।
১ম ব্যক্তিঃ আজ এক অফিসার কো কেহ‌তে শুনা কি কালুরঘাট‌সে আজাদী কি এলান কিয়া। শালা, বাঙ্গালী কো মালুম নে‌হি কি পাক আর্মি কেয়া চিজ হ্যায়।
২য় ব্যক্তিঃ শুনা‌য়ে কি কাল এক বকরা কা ব‌লিদান হোগা। বকুল মোল্লাসে এক বিরাট বা‌হিনী বানা‌নে কা কাম শুরু হোয়া।
যা বুঝার আব্দুর রহমান সা‌হে‌বের বুঝা হ‌য়ে গে‌ছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নি‌লেন, মৃত্যু তো নি‌শ্চিতই। দেখা যাক চেষ্টা ক‌রে কিছু করা যায় কিনা। অন্ততপ‌ক্ষে যে ভয়াবহ ষড়য‌ন্ত্রের কথা তি‌নি জান‌তে পে‌রে‌ছেন তা স্থানীয় লিডার‌দের‌কে জানা‌নো দরকার। আর য‌দি কো‌নোভা‌বে বা‌পের ব্যাটা মেজ‌রের সা‌থে সাক্ষাৎ করা যায় তাহ‌লে সব খু‌লে বল‌তে হ‌বে। 

তাঁর মন বল‌ছে এবার কিছু একটা হ‌বেই। মাত্র ক‌য়েক‌দিন আগেই বঙ্গবন্ধু সকল‌কে যার যা আছে তা নি‌য়ে প্রস্তুত হ‌তে ব‌লে‌ছেন। কিন্তু অস্ত্র ছাড়া ঘ‌টি বা‌টি দি‌য়ে তো আর যুদ্ধ হয় না। এবার যে‌হেতু আর্মির একজন মেজর ঘোষণা দি‌য়ে‌ছেন কা‌জেই কিছু একটা নি‌শ্চিত হ‌বে। এখন বা‌কি শুধু সকলে একত্র হওয়া। 
‌তি‌নি ঘ‌রের কোণায় ফি‌রে গে‌লেন। সেখান থে‌কে সিপাহীকে ফিস‌ফি‌সি‌য়ে ডাক‌তে ডাক‌তে এগি‌য়ে এলেন সাম‌নে। বল‌লেন, বাথরূ‌মে যাওয়া প্র‌য়োজন। একজন মুখ ভেং‌চি‌য়ে ঘ‌রের ম‌ধ্যেই কাজ সার‌তে বল‌লেন। তি‌নি কাতরভা‌বে বুঝা‌তে লাগ‌লেন, এটা তার অভ্যাস নাই। অব‌শে‌ষে অন্যজন গেট খু‌লে তা‌কে বাথরূ‌মে যে‌তে দি‌লো আর বলল, কাজ সে‌রে দ্রুত ফির‌তে। 
‌তি‌নি ভেত‌রে ঢু‌কেই আল্লাহর নাম নি‌য়ে ভে‌ন্টি‌লেট‌রে হাত দি‌লেন। সময় অল্প, খুব দ্রুত কাজ সার‌তে হবে। নতুবা একটু প‌রেই দরজায় ধাক্কাধা‌ক্কি শুরু হ‌বে। 
পুর‌নো বি‌ল্ডিং। একটু চাঁড়া দি‌তেই ভে‌ন্টি‌লেট‌রের বড় জানালাটা খু‌লে গে‌লো। কাকতালীয়ভা‌বে তা এতো দ্রুত হ‌লো যে, তি‌নি কিছুটা ভড়‌কেই গে‌লেন। আস্তে ক‌রে জানালার ভার সাম‌লে তা নি‌চে না‌মি‌য়ে রেখে বের হ‌য়ে পড়‌লেন খুব সাবধা‌নে।
একবার শুধু পেছন ফি‌রে দেখ‌লেন। আবছা আলোয় যা দেখা যায় তা দি‌য়ে দে‌খে অনেকটা হামাগু‌ড়ি দেয়ার ম‌তো ক‌রে দ্রুত দৌড় দি‌লেন বাগা‌নের পা‌শে দি‌য়ে। ধরা পড়ার ভ‌য়ে রাস্তা এড়ি‌য়ে চল‌লেন তি‌নি।
মূল গে‌টের কাছাকা‌ছি এসে দেখ‌তে পে‌লেন দু'জন বিশালদেহী সিপাহী ভারী অস্ত্র হা‌তে পাহারা দি‌চ্ছে। চেহারা দে‌খেই অনুমান কর‌লেন, এরা বেলুচ রে‌জি‌মে‌ন্টের হ‌বে। বেলুচরা সাধারণত পাঠান‌দের চে‌য়ে দূর্ধর্ষ হয়। 
‌সেখান থে‌কে কিছুটা বাঁক ঘু‌রে একটা বড় ড্রে‌নের সাম‌নে গি‌য়ে হা‌জির হ‌লেন। খেয়াল ক‌রে দেখ‌লেন ড্রেনটা সাম‌নের পাঁ‌চিলটা ভেদ ক‌রে বে‌রি‌য়ে গে‌ছে বাই‌রে। নে‌মে পড়‌লেন ড্রে‌নে খুব সাবধা‌নে। আস্তে আস্তে হামাগু‌ড়ি দি‌য়ে এগু‌তে লাগ‌লেন। বিশ্রী দূর্গ‌ন্ধে ব‌মি আস‌তে চা‌চ্ছিল কিন্তু পে‌টে কিছু থাক‌লে তো! গত তিন‌দিন পে‌টে তেমন কিছু প‌ড়ে‌নি। বাঙ্গালী মানুষ, সারা‌দি‌নে দুইপিস রু‌টি আর এক দলা গুড় খে‌য়ে কি চল‌তে পা‌রে?
অব‌শে‌ষে পাঁ‌চিলটা পে‌রি‌য়ে বাই‌রে এসে যে‌নো হাঁফ ছাড়‌লেন। কিন্তু এখনই ওপরে ওঠা যা‌বে না। এখনও ঝুঁ‌কি আছে। মূল গেটটা এখান থেকে কা‌ছেই। সুতরাং, আরো কিছু দূর যাবার পর ড্রেন থে‌কে বের হ‌তে হ‌বে।
‌কিছুটা এগি‌য়ে‌ছেন, হঠাৎ পা‌য়ে কিছু একটা ধাক্কা লাগা‌তে শব্দ হ‌য়ে‌ছে। মাথা তু‌লে দেখ‌লেন, একজন সিপাহী এদি‌কে তাকি‌য়ে‌ছে। ভয় পে‌য়ে গে‌লেন। দেখ‌লেন, ঐ সিপাহী পা‌শের সিপাহী‌কে কিছু একটা ব‌লে এদি‌কেই আস‌ছে। এবার তো দম বন্ধ হবার পালা। চিন্তা কর‌ছেন উ‌ঠে দৌড় দি‌বেন কিনা। কিন্তু সেটা কর‌তে গে‌লে তো এক গু‌লি‌তেই ঝাঁঝড়া। সিদ্ধান্ত নি‌লেন দম বন্ধ ক‌রে ব‌সেই থাক‌বেন শেষ দেখার জন্য। সিপাহীটা দ্রুত এগি‌য়ে এলো একদম কাছাকা‌ছি। এবার কাঁধ থে‌কে অস্ত্র না‌মি‌য়ে হা‌তে নি‌য়ে‌ছে।

শুভ নববর্ষ..............তুহিন রহমান

শুভ নববর্ষ..............তুহিন রহমান
(প্রকাশিত বই থেকে)

হেলা বৈশাখ ১৪২৭
ওর সাথে দেখা হয়েছিলো পহেলা বৈশাখের দিন রমনা পার্কে। দিনটাকে এখনও আমি আমার জীবনের সেরা দিন মনে করি। কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে দুটো রিকসায় আমরা সকাল সকাল চলে গিয়েছিলাম রমনায়। উদ্দেশ্য পান্তা ইলিশ খাবো। তখন সুর্য্যমামা সবেমাত্র উঠেছে ওপরে। বাতাসে কেমন একটা ঘ্রান। রাস্তায় অনেক মানুষ। এতো সকালবেলাতেই সবাই একটা আমেজ নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। মন খারাপ হয়ে গেল। আগেরদিন অনেক পরিকল্পনা করে ভোরবেলা রমনায় যাওয়ার জন্য আগেভাগে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেকেই আমাদের আগে আগে রমনায় পৌছে গেছে। ভোরবেলা গোসল আর শেভ সেরেছি। মুখে মেখেছি মুলতানী মাটি। কাঁচা হলুদও কিছুটা মাখা হয়েছে। পরনে লাল পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা। আমাকে নিখাদ রাজপুত্রের মতো লাগছে।
ভোরের বাতাসে চুল উড়ছে আমার। পাশের রিকসা থেকে সাগর চেঁচিয়ে উঠলো,‘কিরে রাজপুত্র, আজও কি খালি হাতে ফিরে আসবি নাকি গতবারের মতো? নাকি সাথে রাজকন্যা থাকবে?’
‘ইনশাল্লাহ্ সাথে রাজকন্যা থাকবে!’ আমি হাসলাম। আমার গালে টোল পড়লো। নিশ্চয় দেখতে আমাকে কিছুটা শ্রী কৃষ্ণের মতো লাগছে।
সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। আমাকে নিয়ে যতো চিন্তা ওদের। কারন এখনও আমি এনগেজড নই। আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। অথচ ওদের সবার কেউ না কেউ আছেই। যার নেই সে অন্তত: ছাদে উঠে পাশের বাড়ির মেয়ের সাথে টাংকি মারে। ববির সাথে তানিয়ার অনেক দিনের সম্পর্ক। একবার কাট্টি একবার ভাব-এই অবস্থা। ইশান প্রেম করে টিনার সাথে। আমরা ওকে অনেক ক্ষ্যাপাই টিনা নামটা নিয়ে। বলি টিনার আকারটা উঠিয়ে দিলে ওর নাম টিন মানে ঢেউটিন হয়ে যাবে। আর ববিকে ক্ষ্যাপাই ছড়া দিয়ে:
ববির বউ তানিয়া
সকল কথা জানিয়া
সংসার করে ববি
বউ এর আদেশ মানিয়া।
ববি হাসে কিন্তু কিছু বলেনা। কি বলবে ও? বলার কিছু আছে নাকি ওর? প্রেম করলে মাথা ঠান্ডা হয়ে যায় আর ছ্যাক খেলে মাথা গরম। কামরুল ওরফে কালা মিয়া ভালোবাসে একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে যে কিনা এখনও ম্যাট্রিক পাস দুরে থাক ক্লাস টেনেই ওঠেনি। আমরা ওকে ক্ষ্যাপাই নানা নাতনি বলে। একবার নাকি ও লতা মানে ক্লাস নাইনের মেয়েটাকে নিয়ে গিয়েছিলো রমনা পার্কে। তখন অনেকেই ওকে নানা নাতনি বলে কমেন্ট করেছিলো। এই কথা আমাদের কাছে বলার পর থেকেই সে আমাদের কাছেও নানা নাতনি। আমি অবশ্য এসবের চরম বিরোধী ছিলাম, মানে এইসব প্রেম প্রেম খেলার। আমার কাছে এসব হালকা বিষয়কে নিতান্তই ছেলেখেলা বলে মনে হতো সবসময়। আমি গভীরতায় বিশ্বাসী সবসময়। যদি কাউকে পছন্দ হয় তাকে ভালোবাসবো জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।
শিল্পকলার গলির মাথা পর্যন্ত রিকসা যেতেই আটকে দিলো পুলিশ। রিকসা আর যাবেনা। আমরা নেমে পড়লাম। কেবল আমি ছাড়া আর অন্য তিনজন ছড়িয়ে গেল তিনদিকে। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম যেখানে রিকসা থেকে নেমেছিলাম সেখানেই। ওদের তিনজনের গার্লফ্রেন্ড ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে কে কোথায় থাকবে। তিনজন তিনদিকে যেভাবে ছিটকে গেল তাতে মনে হলো ওরা তাদেরকে এতোই গুরুত্ব দেয় যে আমার কথাটা পর্যন্ত মনে থাকলোনা। অথচ রিকসা থেকে নামার আগেও জানতামনা তাদের কেউ এখানে আসবে। এটাই হলো প্রেম। আর প্রেম মানে হলো চরম গোপনীয়তা।
আমি বোকার মতো চারপাশে তাকাচ্ছি। আশেপাশে বেশ মানুষজন জড়ো হয়েছে। সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা হলুদ, সাদা শাড়ী পরে বান্ধবীদের সাথে মজা করছে। চমৎকার সাজ পোশাক সবার। চারপাশে যেন রঙের মেলা চলছে। এখনও মানুষজন তেমন আসেনি। একটুপরই ভিড় জমে উঠবে। আমার দিকে সবাই বেশ অবাক হয়েই তাকাচ্ছে। মেয়েরা তো পারলে দু’বার তাকায়। কেউ কেউ আমাকে নিয়ে বান্ধবীদের সাথে কানে কানে কথা বলে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ছে। এর কারন আমার নায়ক নায়ক চেহারা। খুব কম মানুষের আমার মতো সুন্দর চেহারা আছে-থ্যাংক গড।
দু’জন মেয়ে আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় কি যেন বললো আমি ঠিক শুনতে পেলামনা। শোনার চেষ্টাও করলামনা। কারন মেয়েদের এরকম কমেন্ট শুনে আমি অভ্যস্ত। আমি পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে তিনজনকেই ফোন দিলাম। শালারা ফোন বন্ধ করে রেখেছে। মেজাজটা বিগড়ে গেল আমার। ঝাড়া তিরিশ মিনিট ওদের অপেক্ষা করলাম আমি। তারপর বড়বড় পা ফেলে স্থান ত্যাগ করলাম।
রমনা পার্কের ভেতর অনেক ভিড়। নানা জায়গায় পান্তা ইলিশের আয়োজন। আমি ঘুরতে লাগলাম। এক জায়গায় মেয়েমানুষের সাজ সরঞ্জাম নিয়ে বসেছে কিছু মহিলা। কিছু ছেলে বাঁশি আর ঢাক ঢোল নিয়ে ঢুকেছে ভেতরে। সম্ভবত: তারা এসব বাজাবে আর জমিয়ে আড্ডা দেবে। আমার পাশে এসে গেল রঙের প্যালেট আর রঙ তুলি নিয়ে একটা লোক,‘একটা আর্ট করে দেই স্যার?’
‘আর্ট মানে?’
লোকটা হাতের প্যালেট উঁচু করে দেখালো,‘এইতো স্যার, রঙ দিয়ে ডিজাইন করে দেবো। লেখা থাকবে পহেলা বৈশাখ। একটা একতারার ছবিও থাকবে নাকের পাশে।’
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সকাল বেলা কতো কষ্ট করে ফেসিয়াল করেছি। আর এই ব্যাটা আমার নাকের পাশে একটা একতারা আঁকবে রঙ দিয়ে। ঘুরে অন্যদিকে হাঁটা ধরলাম আমি। সবাইকে বলেছি বটে আমি আজ একজনকে সাথে নিয়ে তবে ফিরবো, বাস্তবে তার ইচ্ছা মোটেও নেই। কথাটা বলা হয়েছে ওদেরকে সুখী করার জন্য। যে প্রেম করে সে চায় সবাই প্রেম করুক। যে বিয়ে করে সে চায়না পৃথিবীর কেউ বিয়ে করুক। এটাই হলো জীবনের গনতন্ত্র।
প্রধান রাস্তার পাশ দিয়ে বাগানের ভেতরে হাঁটছি। লোকজন ভিড় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সকাল আটটা বাজে। ফেরিওয়ালা আর খাবারের দোকানদাররা খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জায়গায় জায়গায় চটপটি আর ফুচকার দোকান। হঠাৎ হাত টেনে ধরলো কেউ। ঘুরতেই দেখলাম ইয়ং একটা ছেলে। হাতে সেই রঙের প্যালেট। সাথে সাথে হাত তুললাম আমি,‘আমি ভাই নাকের পাশে একতারা আঁকবোনা।’
‘না না একতারা কেন? আরো কত কিছু আছে বৈশাখের প্রতিক! যেমন ধরুন ইলিশ মাছ, প্যাঁচা, হাতপাখা, ঢেঁকি....।’
‘আরে দাঁড়ান দাঁড়ান।‘ হাত তুললাম আমি।‘আপনার কি মনে হয় আমার মতো একজন নাকের পাশে ঢেঁকি বা ইলিশ মাছ নিয়ে ঘুরবে?’
ছেলেটা অপ্রতিভভাবে হাসলো,‘দেখুন সবাই করছে। একদিনই তো।’
‘এই একদিন নাকের পাশে ঢেঁকি নিয়ে হাঁটতে হবে? কমপালসারি?’
ছেলেটা কি বলবে বুঝতে না পেরে অন্যদিকে হাঁটা দিলো।
আমি আবার হাঁটতে লাগলাম। তিনজনকে দ্বিতীয়বারের মতো রিং করলাম। এবার একজন ছাড়া বাকি দু’জনকেই পেলাম। দু’জনই বললো তাদের মোবাইল বন্ধ ছিলোনা। নেটওয়ার্কের সমস্যা ছিলো। আমি চরম রাগে জানতে চাইলাম তারা এখন কোথায়। কেউ বললো দুই নাম্বার গেটের কাছে। কেউ বললো রমনার ভিতরে যে পানির পাম্পটা আছে সেখানে আছে। তিন নাম্বারের তো পাত্তাই নেই। যতোক্ষন প্রেমিকার জন্য অপেক্ষায় ছিলো ততক্ষন ফোন ছিলো খোলা। আর দেখা হবার পর সব ফোন বন্ধ।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ওদেরকে খুঁজতে যাবোনা। দরকার হলে একাই থাকবো এখানে। সারাদিন। আবার হাঁটা। মানুষজন বারবার আমার দিকে তাকায় এটা অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। আমি চুইংগাম চিবোতে চিবোতে হাঁটতে লাগলাম। অনেকটা উদাসিনভাবে হাঁটছি। বড়ো পুকুরটাকে কেন্দ্র করে একপাক দিলাম। ইতিমধ্যে জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতি চলে এসে দখল নিয়ে ফেলেছে পুকুরের পাড়গুলোতে। সাধারন মানুষ শুধু ঘুরছে আর দেখছে। আমার বেশ মজাই লাগছে হাঁটতে। বন্ধু বান্ধব থাকলে কথা বলতে হয়, গল্প করতে হয়। একা থাকলে বরং নিরিবিলি থাকা যায়, চিন্তা করা যায় এবং বেশী উপভোগ করা যায় সবকিছু। আমার জীবনে বড়ো যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং যেসব ঘটনা সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে সেগুলো ঘটেছে বন্ধু ছাড়া। আমি একা থাকার সময় ঘটেছে।
আবার হাতে একটা টান। আমি জানি কে টান দিয়েছে। সেই প্যালেটআলা কেউ একজন। এরা যে কেন এসব জায়গায় ঘুরঘুর করে আনন্দ নষ্ট করে! আমি রাগ করে ঘুরলাম সেদিকে। হ্যাঁ, প্যালেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তবে লোক বা ছেলে নয় একটা সুন্দরী মেয়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
‘ভাইয়া, এঁকে দেই?’ মেয়েটা সুন্দর করে হাসলো। ‘শুভ নববর্ষ?’
‘শুভ নববর্ষ?’
‘নাকি ঢোল?’
আমি ঢোক গিললাম।‘আপনি আঁকবেন?’
‘হ্যাঁ, আমি আঁকবো।’
‘না তাহলে প্যাঁচা আঁকতে হবে।’ আমি হাসলাম।‘মানে একটা বার্ন আউল।’
মেয়েটা একটু চিন্তা করলো। তাকে একটু চিন্তিতও দেখাচ্ছে মানে টেনস্ড। মনে হয় প্যাঁচা কখনও আঁকেনি আগে। তারপর হঠাৎ হেসে উঠলো,‘ঠিক আছে আসুন এদিকে। এঁকে দিচ্ছি।’
আমি তারপরও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম,‘আচ্ছা যদি প্যাঁচা না হয়ে ওটা একটা ডাইনোসর হয়ে যায় তখন?’
‘ডাইনোসর হবে কেন?’ মেয়েটা অবাক হয়ে বললো।
‘আপনি যেভাবে চিন্তা করলেন তা’তে ভয় হচ্ছে।’ আমি বললাম।
মেয়েটা খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো। ‘যদি দেখি প্যাঁচা হচ্ছেনা তাড়াতাড়ি ওটাকে একটা ঢোল বানিয়ে দেবো।’
‘তাহলে তো আমার গালটাকে শেষ করে দেবেন।’
‘না না শেষ হবেনা।’ মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো।‘আপনার গালের ওপর প্যাঁচার চেয়ে ঢোল সুন্দর লাগবে।’
‘না না প্যাঁচাই লাগবে। প্যাঁচা আমার ফেবারিট পাখি।’
‘প্যাঁচা ফেবারিট পাখি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি বলছেন? এতো সুন্দর সুন্দর পাখি থাকতে প্যাঁচা আপনার ফেবারিট পাখি?’
‘ঠিক বলেছেন। প্যাঁচা আমাদের বৈশাখী পাখি। তাছাড়া এটার সাথে আমাদের কালচারের একটা সম্পর্ক আছে।’
‘কিন্তু আপনাকে দেখে তো মনে হয়না এতো একটা বিশ্রী পাখি আপনার প্রিয় পাখি।’
‘ওরে বাবা চেহারা দেখে এতো কিছু বুঝতে পারেন নাকি?’
‘পারি পারি।’
‘দেখি কি পারেন। আমার গালে একটা প্যাঁচা এঁকে দিন।’ আমি বাগানের কিনারে গিয়ে একটা বট গাছের পাশে থাকা বেঞ্চে বসে পড়লাম। মেয়েটা তার প্যালেট আর রঙ তুলি নিয়ে এগিয়ে এলো আমার পেছন পেছন। তার নরোম বাম হাতে আমার মুখটা ধরে তার দিকে ঘোরালো। আমার গালের ওপর নজর দিলো ও। ঝুঁকে পড়লো আমার মুখের ওপর। খুব কাছ থেকে আমি তার মুখটা দেখতে পাচ্ছি। চমৎকার চেহারা, ভ্রু, চোখ, ঠোঁট যেন একটার সাথে একটা অতি সামঞ্জস্যপূর্ন। পাতলা ঠোঁটটা একটু ফাঁক। চমৎকার একটা মেয়েলি সুবাস পাচ্ছি তার গলা আর বুক থেকে। হঠাৎ করে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে নিলাম।
মেয়েটা প্যাঁচা আঁকছে। তার রঙ তুলির টান আমার গালের ওপর সুড়সুড় করছে। আমার বেশ ভালো লাগছে। আমার বড়ো চুল মেয়েটা হাত দিয়ে সরালো। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ যতœ করে ছবিটা আঁকার চেষ্টা করছে আমার গালের ওপর। নাকি সে একটু বেশী সময় নিচ্ছে? তার কি আমার গালের ওপর ছবি আঁকতে ভালো লাগছে? অনেক কথা ভাবছি আমি চোখ বুঁজে।
তারপর তার ছবি আঁকা শেষ হলো। সে নিচু হয়ে ফুঁ দিয়ে রঙগুলো শুকাতে চেষ্টা করছে। আমার মনে হচ্ছে এই কাজটা সে বাড়তি করছে। ফুঁ দিয়ে শুকানো তো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা। গালের ওপর এক অচেনা নারীর ফুঁ। আমার নিসঙ্গ একাকী হৃদয়টা কেমন যেন মোচড় খেয়ে উঠলো। মনে মনে একটা কবিতা লিখতে শুরু করলাম আমি ঃ
রমনার দখিনা হাওয়ায় যখন মাতলো সারা শহর
তখন সবাই ছেড়ে গেছে আমায়
নিসঙ্গ সবার মাঝেও আমি
একাকী তবে বেশ খোশমেজাজে
কারন?
গালের ওপর এক অচেনা নারীর ফুঁ।
‘আপনার স্কিন খুব সুন্দর। ছেলেদের স্কিন এমন হয়না।’ মেয়েটা বললো।
‘ধন্যবাদ। প্যাঁচা আঁকা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। শেষ।’
‘রঙগুলো কি শুকিয়েছে?’
‘না এখনও শুকায়নি। দাঁড়ান শুকিয়ে দিচ্ছি।’ মেয়েটা নিচু হয়ে আবার ফুঁ দিতে লাগলো।
আমি মনে মনে হাসলাম। রবী ঠাকুরের সেই কথা মনে পড়ে গেল-সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। কথাটা প্রমান করার জন্য বোধহয় মেয়েমানুষের প্রয়োজন। সে আরো এক মিনিট ফুঁ দিলো। আমি নিচু স্বরে বললাম,‘আমার মনে হয় এখনও শুকায়নি।’
মেয়েটার চেহারাটা একটু লাল হয়ে উঠলো সাথে সাথে।
আমি পকেট থেকে আমার স্যামসুং ডুয়োসটা বের করে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম,‘একটা ছবি তুলে দিন আমার গালের। সাথে তো আয়না নেই।’
‘আমার কাছে আয়না আছে, দেখবেন?’ মেয়েটা তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ভেতর থেকে একটা কমপ্যাক্ট পাওডার কেস বের করে খুললো। আয়নাটা বের করে বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। আয়না দিয়ে দেখলাম চমৎকার একটা প্যাঁচা এঁকেছে মেয়েটা আমার বাম দিকের গালে। তিনটা রঙ ব্যবহার করেছে সে। লাল আর সবুজ রঙে লিখেছে শুভ নববর্ষ। মেয়েটা নিশ্চিতভাবে আর্ট জানে। অসাধারন। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,‘চমৎকার!’
মেয়েটা হাসলো,‘বললামনা, আঁকতে পারবো আমি।’
‘এটা থাকবেনা বেশিক্ষন। একটা ছবি তুলে দিন।’
মেয়েটা আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে আমার গালের একটা ছবি তুলে দিলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম,‘গালের আর্টের ছবি তো তুললাম এবার আর্টিস্টের একটা ছবি নিতে পারি?’
মেয়েটা তার সুন্দর ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো। একটু ভাবলো।‘ঠিক আছে নিন।’ সে পোজ দিলো। আমি তার একটা ছবি নিলাম। ‘আপনার নামটা?’
‘ইরিনা মুম।’ মেয়েটা বললো।‘আনকমন তাইনা?’
‘একেবারে রাশিয়ান বাট আর্টিস্টিক।’ আমি হাসলাম। ‘খুব সুন্দর নাম। আই স্যয়ার।’
মেয়েটা লজ্জা পেলো। আমি তাড়াতাড়ি বললাম,‘এতো সুন্দর একটা আর্ট করলেন কতো দেবো বলুনতো?’
‘আপনার ইচ্ছা।’ সে নিচু মুখে বললো।
‘ঠিক আছে।’ আমি পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিলাম। মানিব্যাগে গুনে গুনে চারটা পাঁচশো টাকা তিনটে একশো টাকা আর কিছু দশ বিশ টাকার নোট আছে। কিন্তু পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়েই জমে গেলাম। মানিব্যাগটা নেই। ডানদিকের পকেটে হাত দিলাম। সেখানেও নেই। তারমানে পকেটমার হয়ে গেছে। পাঞ্জাবীর পকেট মারা খুব সোজা ব্যপার। এই ভিড়ের ভেতর আমার রোমান্টিক মুডের সুজোগে কেউ মেরে দিয়েছে পকেটটা। আমি শেষ।
মেয়েটা আমার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে গেল ব্যপারটা। আমি কিছু বলার আগেই সে জিজ্ঞেস করলো,‘কি হয়েছে? হারিয়ে গেছে টাকা?’
‘মানিব্যাগ নেই।’
‘ও মাই গড!’
‘সব টাকা সেখানেই ছিলো। ফোনটা অন্য পকেটে ছিলো তাই সেটা বেঁচে গেছে।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে আপনার টাকাটা এখনই দিতে পারছিনা।’
মেয়েটা হেসে উঠলো,‘আপনি আমার টাকা নিয়ে চিন্তা করছেন? লাগলে আরো নিন আমার কাছ থেকে।’
‘না না ছিঃ কি বলেন। আমি খুব লজ্জিত। তবে আমার সমস্যা নেই। আমি আমার ফ্রেন্ডদের ডেকে আনছি। ওরা আশেপাশেই আছে।’
ফোনটা তুলতে যেতেই মেয়েটা হাত চেপে ধরলো আমার। আমি স্থির হয়ে গেলাম। ‘বললাম তো টাকার চিন্তা করবেননা। আপনার এতোবড়ো একটা অঘটন ঘটে গেছে আর আপনি ভাবছেন আমি আপনার কাছে টাকা চাইবো?’ ইরিনা অন্যরকম একটা ভঙ্গি করলো যেন ও আমার কতোদিনের চেনা। ‘আপনি বসুন। মানিব্যাগে কি গুরুত্বপূর্ন কিছু ছিলো?’
‘না তেমন কিছুনা। হাজার দু’য়েক টাকা এই আরকি।’ আমি বললাম। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম।‘আমিই কি আপনার প্রথম ক্লায়েন্ট?’
ইরিনা আবার হাসলো,‘এর আগে একটা বাচ্চার গালে একতারা এঁকে দিয়েছি।’
‘তারমানে আমি দ্বিতীয়?’
‘হ্যাঁ। চটপটি খাবেন?’
আমি আড়ষ্ঠভাবে বললাম,‘আপনি খাওয়াবেন কেন? একটু অপেক্ষা করুন আমি আপনাকে খাওয়াবো।’
ইরিনা ভ্রু কোঁচকালো,‘আপনাকে স্মার্ট দেখালেও আপনি আসলে আনস্মার্ট।’
‘একথা কেন মনে হলো?’
‘জানিনা তবে আপনি যেভাবে সংকোচ বোধ করছেন সেটা আপনার চেহারার সাথে মানাচ্ছেনা।’
আমি হেসে উঠলাম। ‘আপনি একজন আর্টিস্ট। আপনার চোখে আসলে পুরো পৃথিবীটাই অন্যরকম।’
ইরিনাও হাসলো,‘চটপটি খাবেন কিনা বলুন।’
‘ঠিক আছে খাবো।’
ইরিনা কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা চটপটির গাড়ির কাছে গিয়ে কিছু বললো। তারপর ফিরে এলো আমার কাছে। হাতের রঙের প্যালেট আর তুলি নামিয়ে রাখলো পাথরের বেঞ্চের ওপর। নিজেও বসলো। আমার দিকে তাকালো,‘আপনি আবার দাঁড়িয়ে গেছেন?
‘না না এইতো বসছি।’ আমি ইরিনার পাশে বসলাম। বললাম,‘আমি কিন্তু একা আসিনি। আমার বন্ধুরাও আমার সাথে এসেছে। মানিব্যাগটার মতো ওরাও হারিয়ে গেছে।’
‘মানে!’
‘আরে ওরাও হারিয়ে গেছে। আমি ওদের তিনজনকে খুঁজে পাচ্ছিনা।’
‘খুঁজে পাচ্ছেননা মানে? ওদের মোবাইল নাম্বার নেই আপনার কাছে?’
‘আছে কিন্তু ফোন দিলে বলছে এখানে আছি সেখানে আছি।’
ইরিনা একটু চিন্তা করে বললো,‘তারমানে তাদের সাথে কেউ আছে?’
‘রাইট ইউ আর!’ আমি বললাম। ‘এই জন্যেই তারা আমার কাছে আসছেনা। একেকজন একেকদিকে চলে গেছে সাথের জনকে নিয়ে।’
ইরিনা ভেবে বললো,‘তারমানে আপনি ছাড়া বাকি তিনজনই এনগেজড?’
আমি মাথা নাড়লাম।
‘একে বন্ধুত্ব বলে? তারা আপনার সাথে এলো আর আপনাকে রেখে চলে গেল?’ ইরিনা এপাশ ওপাশ মাথা দোলালো।‘আপনার এক ফ্রেন্ডের নাম্বার দিন তো?’
আমি ববির নাম্বারটা ডায়াল করে ইরিনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ইরিনা আমার ফোনটা তার কানে চাপালো। ওদিক থেকে ববি ফোন রিসিভ করতেই ও বললো,‘হ্যালো,এই মোবাইলটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি। ডায়েল লিস্টে আপনার মোবাইল নাম্বার ছিলো তাই এই নাম্বারটায় ডায়েল করলাম। আমি এখানে আর দশ মিনিট আছি। প্রয়োজন মনে করলে ফোনটা আমার কাছ থেকে সংগ্রহ করুন। আমি লেকের দক্ষিন পাড়ে পাথরের বেঞ্চে বসে আছি।’
লাউডস্পিকার থাকায় আমি বেশ ভালোভাবে শুনতে পেলাম ববি বলছে,‘ও এটা তো আমার ফ্রেন্ড সায়েমের নাম্বার। আমি আসছি। একটু অপেক্ষা করুন।’
ইরিনা তার ফোনটা কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকালো,‘কেমন হলো বলুন তো?’
‘ও মাই গড! আপনার সিচুয়েশন কাভার করার অসাধারন ক্ষমতা তো!’ আমি অবাক হয়ে বললাম,‘এখন তো ও দৌড়ে চলে আসবে।’
‘আসুক না। তারপর দেখুন আমি তাকে কি বলি।’ ইরিনা ফোনটা আমার হাতে ফেরৎ দিলো।
দশ মিনিট পার হবার আগেই দেখতে পেলাম ববি সাথে তানিয়াকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। আমার পাশে ইরিনাকে দেখে ও থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তানিয়াকে কিছু একটা বললো নিচু স্বরে তারপর এগিয়ে এলো আমার দিকে,‘কিরে তুই? তোর ফোন নাকি হারানো গেছে?’
আমি জবাব দেয়ার আগেই ইরিনা বললো,‘আপনার বন্ধুকে একা রেখে বান্ধবীকে সময় দিচ্ছেন? ফোন দিলে কখনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কখনও নিজের লোকেশন বলছেননা। আপনার বন্ধুকে যদি আপনার সাথে নিয়ে যেতেন তাহলে কি খুব একটা সমস্যা হতো? উনি একটু দুরে বসে থাকতেন।’
ববি নিজের কান চুলকালো বোকার মতো। কান থেকে চুলে চলে গেল আঙুল। কি বলবে বুঝতে পারছেনা।
ইরিনা বললো,‘আপনাদের আরো দুই জন কোথায় গেছেন?’
‘আমি বলতে পারবোনা।’ ববির কান চুলকানো থামছেনা। ‘আসলে ওরা কোন দিকে গেছে....।’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। বসুন। চটপটি খান।’
‘না না চটপটি আমরা খেয়েছি।’ ববি আমার দিকে একটু প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। আমার গালের ওপর প্যাঁচা আঁকা দেখে ও আরও বিশ্মিত হয়েছে।
‘ঠিক আছে তাহলে যান। আপনার বন্ধুর দায়িত্ব এখন আমার হাতে।’ ইরিনা বললো। ও আবার আমার পাশে এসে বসলো। ববি চলে যাওয়ার ভঙ্গি করতেই আমি হাত তুললাম,‘দাঁড়া, আমাকে পাঁচশো টাকা ধার দে। আমি মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলেছি।’
‘এক টাকাও না। আপনি যান।’ ববির দিকে তাকিয়ে বললো ইরিনা।‘আমি দেখবো ব্যপারটা।’
ববি আরেকবার আমাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে তানিয়াকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। ও যার পর নাই বিশ্মিত আমার কাজ কারবারে। হোক বিশ্মিত। ওদের কাজ কারবারে আমিও কি কম বিশ্মিত? ওরা দু’জন বেশ কিছুটা দুরে গেল বটে কিন্তু একেবারে উধাও হলোনা। আমি দেখতে পেলাম ওরা একটু দুরে গিয়ে বসে আমাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা এতোকিছু দেখতে পেলনা-ও আমার জন্য একটা আর নিজের জন্য একটা চটপটির প্লেট নিয়ে এসে পাশে বসলো,‘নিন শুরু করুন। আজকের দিনের প্রথম চটপটি। শুভ নববর্ষ।’
‘শুভ নববর্ষ।’
চটপটি দিয়ে নববর্ষ শুরু করলাম। ইচ্ছা ছিলো পান্তা ইলিশ খাবো কিন্তু আমার বন্ধুদের অন্তর্ধানের কারনে সব ভেস্তে গেল। সকাল ন’টা বাজতে চললো। রমনা পার্ক ভরে যাচ্ছে মানুষে। নানা ধরনের নানা বর্নের চটকদার মানুষ। আজ সবাই হ্যাপি মুডে আছে। কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে, কেউ হৈ হৈ করছে, কেউ দল বেঁধে লাফাতে লাফাতে আসছে, কেউ জোকার সেজে আসছে, তবে বেশীরভাগ আসছে জোড়ায় জোড়ায়।
ববি মনে হয় ইশানকে ফোন দিয়েছিলো। একটু পরে ওকে দেখা গেল। আমাদের সাথে বেশ কিছুটা দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে টিনা। আমাদের দিকে ওদের দু’জনার দৃষ্টি। আমি ভাব করলাম যেন ওদেরকে দেখতেই পাইনি। লেকের দিকে মুখ করে বসে থাকায় ভালোই হয়েছে। আমাদের মুখ দেখতে পাচ্ছেনা কেউ। আমি একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলাম ইরিনার সাথে। বললাম,‘যাক এখনও সারাদিন পড়ে আছে। আমি ভেবেছিলাম একা একা ঘুরতে হবে। আপনি মানুষের মুখে ছবি আঁকুন আর আমি এখানে বসে বসে দেখবো-তাও ভালো।’
‘না না ঠিক আছে। আজ আর কিছুই করবোনা। এখানেই বসে থাকবো সারাদিন। ভালোই লাগছে।’ ইরিনা বললো চটপটি খেতে খেতে। ‘আপনার মতোই অবস্থা হয়েছে আমারও। একজনকেও সাথে আনতে পারিনি। সবাই যার যার মতো যার যার পথে চলে গেছে। ভেবেছিলাম আর্ট কেমন করতে পারি একটা এক্সপিরিয়েন্স দরকার। হয়েছে।’
‘দুটো ডিজাইন করে শখ মিটে গেল?’
ইরিনা ওর নিজের হাতের দিকে তাকালো। কিছু রঙ ওর হাতে লেগে আছে। ‘সারা দিন যদি এসব করি তাহলে আর আনন্দ করা হবেনা।’
‘কতোক্ষন আনন্দ করার ইচ্ছে?’
‘সারাদিন। ধুলোয় ধুসরিত একটা দিন। রোদে আর ঘামে ভেজা একটা দিন। গাছের ছায়ায় বসে হাতের তালপাখা দিয়ে বাতাস করার একটা দিন। কপালের চুলগুলো ঘামের সাথে মিশে লেগে থাকবে। কোথাও একটা কোকিল ডাকবে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,‘আপনি তো একজন কবি!’
‘শিল্পী।’ ইরিনা বললো,ওর চোখে খেলা করছে রোমান্টিকতা। ‘যারা ছবি আঁকে তারা স্বপ্ন দেখে। আর এই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে চায় তারা। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তব থেকে অনেক দুরের পথ। একা একা হেঁটে যেতে হয়-তাই কেউ স্বপ্নের কাছে যেতে চায়না।’
আমি হেসে উঠলাম,‘কি চমৎকার উদাহরন। আপনি ভবিষ্যতে অনেক বড়ো একজন শিল্পী হবেন।’
‘যদি হই আপনাকে নিয়ে প্রথম একটা পোট্রেট করবো। নাম দেবো কবি।’
‘কবি কেন?’
‘কারন আপনাকে দেখে কেমন যেন কবি কবি মনে হয়েছিলো। কেমন ভাবুক ভাবুক একটা ভাব। জীবনের প্রতি আকর্ষনহীন একজন। পকেটমার হয়ে গেছে কিন্তু কোন বোধ নেই।’
‘বোধ থাকবে কিভাবে? তার আগেই তো আপনি চলে এলেন।’
ইরিনা হাসতে লাগলো। ওর চটপটি খাওয়া বাধাগ্রস্থ হলো। ববির পাশে গিয়ে বসেছে ইশান। আমাকে দেখিয়ে কি সব বলছে। এবার আমি সাগরকেও দেখতে পেলাম ওদের মাঝে। তিনজন জোট বেঁধেছে। আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। নিঃসন্দেহে ওদের প্রত্যেকের গার্লফ্রেন্ডের চেয়ে ইরিনা অনেক সুন্দরী।
ছোট্ট একটা ঘটনা অথচ কি অপুর্ব তার আবেশ। জীবনে তো কোন মেয়ের সাথে এভাবে ঘনিষ্ঠভাবে বসিনি। সবসময় নিজের সৌন্দর্য নিয়ে এতোটাই বিমোহিত ছিলাম যে আর কারো দিকে তাকানোর সময় হয়ে ওঠেনি। বলতে গেলে কিছুটা অহংকারীও ছিলাম।
সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় বলছে অপুর্ব জুটি। দু’জনেই সুন্দর। এমনটা খুব একটা চোখে পড়েনা।
‘সত্যি বলছি আমি বাস্তববাদী নই।’ আমি বললাম। ‘অন্যদের কারো মতো নই। জীবনটাকে আমি অন্যভাবে সাজাতে চেয়েছি সবসময়। আমার চিন্তাধারার সাথে আমি কারও মিল পাইনি।’
খুব কাছ থেকে ইরিনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ও বুঝতে চেষ্টা করছে আমি কি বলছি। ‘তাহলে আপনিও চেষ্টা করলে আর্ট করতে পারবেন। দেবেন আমার গালে একটা ঢেঁকি এঁকে?’
‘ঢেঁকি? আপনার গালে?’ আমি হেসে উঠলাম।‘ডাক্তারকে ওষুধ দেবো আমি?’
‘দুর! আমি ফাজলামী করছিনা। দেবেন একটা ঢেঁকি এঁকে?’
‘কি বলছেন এসব?’
‘আমি বলছি আপনি আমার গালে একটা ঢেঁকি এঁকে দিন। সবার গালে কতোকিছু লেখা রয়েছে কেবল আমার গালে নেই।’ ইরিনা তার হাতের রঙতুলি বাড়িয়ে দিলো। ‘খাওয়া শেষ করে আমার গালে এঁকে দিন।’
আমার চটপটি খাওয়া শেষ। রঙতুলি হাতে নিয়ে ইরিনার মুখটা ধরলাম এক হাতে। কিছুটা সংকোচ আমাকে বেঁধে ফেললো আস্টেপৃষ্ঠে। ওর নরোম গাল,গা থেকে ভেসে আসা মিস্টি সুবাস আমার মনকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিলো। ভালোলাগার এক অন্যরকম অনুভুতি। ওর গালে আমার হাত। ইচ্ছে হচ্ছে ওর আরো কাছে যেতে। ওর গালে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে। আমি ঢেঁকি আঁকা শুরু করলাম। বৈশাখের ঢেঁকি। বাঙালীর রঙের বাহারী ঢেঁকি। চারপাশের কোলাহল আর আমেজের মাঝে অন্য এক অনুভুতি।
রঙের প্রতিটি টান আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। তারপর একসময় ঢেঁকি আঁকা শেষ হলো। ইরিনা নিজের আয়নায় গালটা দেখলো তারপর অবাক হয়ে বলে উঠলো,‘আপনিও তো আর্টিস্ট! কি চমৎকার এঁকেছেন।’
সত্যি আঁকাটা সুন্দর হয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি এতো সুন্দর করে আঁকতে পারবো। আমি গ্রামের ছেলে নই। জীবনে কখনও ঢেঁকি দেখিনি আমি সামনে থেকে। যা দেখেছি ছবিতে বা টিভিতে। তা’তেই এতো চমৎকার হয়েছে আঁকাটা যে আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিনা। ‘ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই।’ আমি বললাম। ‘যা শিখেছি আপনার কাছ থেকে শিখেছি।’
‘আমার কাছ থেকে?’
‘এই এক ঘন্টায় আমি ছবি আঁকার যে অনুপ্রেরনা পেয়েছি আপনার কাছ থেকে তা থেকেই এঁকেছি এটা।’
ইরিনা একটু হেসে বললো,‘কতো দেবো?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,‘কতো দেবো মানে?’
‘আপনি যে আমাকে দিতে চাইলেন তখন। এবার আমি আপনাকে কতো দেবো বলুন?’
আমি হেসে ফেললাম।‘আপনি দিতে চাচ্ছেন আমাকে? হ্যাঁ, দিতে পারেন। বাড়ি ফেরার ভাড়াটা।’
ইরিনাও হাসলো,‘বাড়ি আমি আপনাকে পৌছে দেবো।’
‘আপনি?’
‘হ্যা্’ঁ
‘আপনি আমার বাড়ি যাবেন?’
‘যাবো।’
‘সত্যি?’
‘সত্যি। কারন আমি আপনার মাকে বলবো যেন উনি আপনাকে বাড়ির বাইরে বের হতে না দেন। আপনি নিজেই কখন যে হারিয়ে যান তাই বা কে জানে।’
আমি হা হা করে হেসে উঠলাম। ‘আপনার ধারনা আমি একটা শিশু কারন আমি আমার মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলেছি।’
‘ঠিক তাই।’
‘ভুল।’
‘ভুল?’
‘হ্যাঁ, কারন এই আমিই আবার আজ আপনার মতো একজনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললাম এই বা কম কিসে?’
ইরিনা মুখ বাঁকালো,‘উঁহু এটা কোন ব্যপার হলোনা। মানুষ এর চেয়েও বড়ো বড়ো কাজ করে।’
‘যেমন?’
‘যেমন মানুষ চাঁদে গেছে, পারমানবিক বোমা বানিয়েছে, কতো কিছু আবিস্কার করেছে আর আপনি?’
‘আমি আবিস্কার করেছি আপনাকে।’
ইরিনা হাসলো,‘এটা কোন আবিস্কার হলো? আমি তো এখানেই ছিলাম।’
‘আমি আপনাকে আবিস্কার করলাম এটাই আমার কৃতিত্ব। আপনি সত্যি বলছেন আমার বাড়ি যাবেন?’
‘অবশ্যই যাবো।’
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম সকাল দশটা বাজতে চলেছে। ববিদের দিকে তাকালাম। ওরা নিজেরা নিজেদের ভেতর কি নিয়ে যেন গল্প করছে আর ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। একটু পর ববি উঠে এলো। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ও অন্যদের সাথে কি যেন পরিকল্পনা করে এসেছে। চেহারায় কেন যেন মুখস্ত মুখস্ত একটা ভাব ফুটে উঠেছে।
‘কিরে? কিছু বলবি?’ আমি ববির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম।
ববি আমাকে পাত্তাই দিলোনা। সে ইরিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,‘আপনাকে তো চিনলামনা, আপনি কি ওর গার্লফ্রেন্ড?’
ইরিনা মূহুর্তে লাল হয়ে গেল। কিন্তু ও সামলে নিয়ে বললো,‘কি হলে আপনি খুশি হবেন?’
‘আপনি যদি ওর গার্লফ্রেন্ড হয়ে থাকেন তবে আমি সবচেয়ে বেশী খুশি হবো কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ব্যপার হলো ও আমাদের কাছে কোনদিন আপনার কথা বলেনি। এইটা ও খুব খারাপ করেছে।’ ববির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ও সিরিয়াসলি বলছে। ‘আমি ওর ক্লোজড ফ্রেন্ড কিন্তু ও আমার কাছেই বলেনি আপনার কথা।’
ইরিনা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো,‘বলেননি কেন?’
আমিও হাসলাম,‘কারন আমি চেয়েছিলাম পহেলা বৈশাখের দিন ওদেরকে সারপ্রাইজ দেবো। তোরা সারপ্রাইজড তো?’
ববি বললো,‘সারপ্রাইজড মানে? আমি তো এখনও বিশ্বাস করতেই পারছিনা যে তোর মতো একটা ছেলে এমন রূপসী একটা মেয়ে বাগাতে পারে। আর তুই তো কোন কথা চাপা রাখতেই পারতিসনা, কিভাবে এমন একটা গল্প চাপা রাখলি বলতো?’
আমি বলার আগেই ইরিনা বললো,‘অনেক কষ্টে। অনেকবার ফোন করে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আপনাদের বলবে কিনা। আমিই নিষেধ করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম পহেলা বৈশাখের দিনই ওদেরকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। তাই ফোন হারানোর ভান করে আপনাকে ডেকে এনেছিলাম।’
আমি ইরিনার বুদ্ধিমত্তা দেখে হতবাক হলেও মনে মনে ওর প্রশংসা করলাম। এ ধরনের বুদ্ধি সব মেয়ের থাকেনা। মনে মনে আরও আনন্দ লাগছিলো যে ইরিনা নিজেই স্বীকার করলো যে সে আমার গার্লফ্রেন্ড। জানিনা বিষয়টা ও মন থেকে বলছে কিনা। নাকি ওদের সাথে ফাজলামী করছে? যাইহোক, মেয়েটার একটা প্রস্তুতি আছে বলতে হবে। আমার ভালো লাগছে যে আমাকে আর বেশী দুর এগুতে হবেনা।
ববি ইশারায় বাকিদের ডাকলো। সবক’টা এসে ঘিরে দাঁড়ালো আমাদের। ইশান আমার মাথায় একটা খোঁচা দিলো,‘কিরে শালা, তুই আমাদের ঠকিয়েছিস, এখন তোকে এর জরিমানা দিতে হবে।’
‘উনি জরিমানা দিতে পারবেননা কারন ওনার মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে।’ ইরিনা আমার হয়ে বললো,‘আমি জরিমানা দেবো।’
‘তাই?’ সাগর পাশ থেকে বললো।‘তাহলে তো আমরা আজ বাইরে লাঞ্চ করছি।’
‘নো প্রবলেম,’ ইরিনা বললো।‘আজ আমরা বাইরে খাবো এবং তারপর ফিরে আসবো আবার। এখানে।’
‘আবার এখানে ফিরে আসবো?’ আমি বললাম।
‘আমরা আজ এখানেই থাকবো সারাদিন। বছরের প্রথম দিন। কবিতা লিখবো। ঘুরবো। চটপটি খাবো। ছবি আঁকবো।’ ইরিনা বললো। ‘আপনি কি বলেন?’
আমি বললাম,‘আমার আপত্তি নেই।’
‘আপনি আপনি কেন?’ ববি বললো,‘তুমি নয় কেন?’
‘সময় হলে।’ ইরিনা বললো।‘আমিই বলবো।’
‘না-না, আজ। আজ যখন এতোকিছু হবে তখন এটা বাকি থাকে কেন?’ ববি বললো।‘আজই তুমি শুরু হবে।’
আমি হাসলাম,‘না আজ নয় অন্যদিন।’
‘না আজই।’ ইশান অনড়, ‘আমরা দেখতে চাই।’
‘এটা একটা বিশেষ দিন।’ ববি আবার বললো।‘নামটাই তো জানলামনা।’
‘ইরিনা।’
‘চমৎকার নাম। তো ইরিনা আমি দেখতে চাই আপনি ওকে তুমি করে ডাকছেন।’
ইরিনাও এক ডিগ্রী বেশী। ও আমার দিকে ফিরে বললো,‘তুমি বলো আমরা কোথায় কি দিয়ে লাঞ্চ করবো?’
আমি হেসে বললাম,‘আপনি খাওয়াবেন আপনিই বলতে পারবেন সেটা।’
‘এ্যাই!’ ববি ধমকে উঠলো,‘আপনি কি? ও তোকে তুমি বলছে আর তুই ওকে আপনি বলছিস?’
‘আচ্ছা তুমি বলবো।’
‘বলবো কি? বল?’
‘আমি একটু দেরি করে বলতে চাইছি।’
‘না-না কোন দেরি নয়। আজ এই শুভক্ষনে বলতে হবে।’ জেদ ধরলো ববি। ‘বল। আমাদের সামনে বল।’
‘আচ্ছা তুমি।’
‘আচ্ছা তুমি কি? একটা সেনটেন্স বল?’
আমি ইরিনার দিকে তাকিয়ে বললাম,‘তুমি যা খাওয়াবে তাই আমরা খাবো।’
ছয়জন একসাথে চিৎকার করে উঠলো। ববি, ইশান, সাগর আর ওদের তিন বান্ধবী। লোকজন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। মাত্র দুটো ঘন্টা আগেও আমরা কেউ কাউকে চিনতামনা। আর এখন, দু’ঘন্টা পর, একে অন্যকে আমরা তুমি করে বলছি।
একেই বলে ভাগ্য। বছর শুরুর দিনেই তার সাথে পরিচয় এবং দু’ঘন্টা পরই তুমি করে বলা। একে সাহিত্যের ভাষায় কি বলা যেতে পারে তা আমার জানা নেই তবে যদি শিল্পীর তুলি দিয়ে তা প্রকাশ করা হয় সেটা বোধহয় আরও ভালো ফুটবে, কারন আমরা দু’জনই ভালো শিল্পী।
ববি, ইশান আর সাগর তিনজনই পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। ববি বললো,‘দু’জন দু’জনার হাত ধর-আমি ছবি তুলবো।’
ও ঘুরে এসে আমাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।
অনিচ্ছা সত্বেও আমি ইরিনার হাতে হাত রাখলাম। ইরিনাও একটু সংকোচ করে আমার হাত ধরলো।