বাঘা মামার হিমালয় অভিযান (পর্ব -১) .................তুহিন রহমান

বাঘা মামার হিমালয় অভিযান (পর্ব -১) .................তুহিন রহমান
‘উহ্, কি ভয়ংকর কান্ড। কারেন্ট পোকা নামের একধরণের পোকা সব ধান টান খেয়ে ফেলছে। উহ্ বাবা, বাদামী গাছ ফড়িংও আছে! ঢ্যাপ্ আবার কি জিনিস? একর প্রতি ফলন হয়েছে মাত্র তিনমন ধান ! হায়, আমরা খাব কি তাহলে! এতো দেখছি পোকদের বিরুদ্ধে মিলিটারি পাঠাতে হবে। প্রয়োজন হলে জাতিসংঘ বৈঠক বসাতে হবে, এরতো একটা সুরাহা করা দরকার,তাইনা?’
‘ জ্বি, মামা। আমার মনে হয় একটা পুরস্কার ঘোষনা দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, মামা।’
মামা এমন ভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন কড়মড় করে চিবিয়ে ফেলবেন আমাকে, কিংবা আমাকেই তিনি “কারেন্ট পোকা” ভেবে বসে আছেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘তোকে পড়াতে পড়াতে জুতোর তলা ক্ষয় করে ফেললাম তাও এখনো সরল শিখতে পারলিনা আবার কথা বলছিস! ”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম মামার দিকে।
মামা বললেন, ‘জুতোর তলা কিভাবে ক্ষয় করলাম বুঝতে পারিসনি? তোকে জুতো পেটা করে করে আমার জুতো ক্ষয় হয়ে গেছে, হারামজাদা। ঠিক করে মনোযোগ দিয়ে পড়; আবার বলে পাইলট হবে! পাইলট হওয়া এতো সোজা? তারচে’ গফুরের রিকসার গ্যারেজে আরেকটা নতুন রিকসা নামাচ্ছে গফুর, তাকে বলে দিলেই তোকে রিকসা চালাতে দেবে। রিকসা নিয়ে সোজা চলে যাবি সিলেটে। ওখানে রিকসাআলাকে পাইলট ডাকে , তোর পাইলট হবার শখ মিটে যাবে।’
মামার কথা শুনে আমার কান্না পেয়ে গেল কিন্তু কাঁদা টাঁদা হচ্ছে মেয়েলি অভ্যাস তাই কাঁদলাম না, বরং গোঁ গোঁ করে বললাম, ‘আমি কি করেছি,তুমিই তো ট্যাগ্ কোশ্চেন জুড়ে দিলে তোমার কথার সাথে। তুমি বললে এই সমস্যার সুরাহা করা দরকার,তাইনা? তাইনা শব্দটা না বললে আমিও কথা বলতাম না।’
মামা বললেন, ‘এটা আমার একটা অভ্যাস। তাই বলে তুই ভাবিসনা আমি তোর সাথে কথা বলছি। তুই পড়।’
আমি মনে মনে বললাম --- অভ্যাস নয় , বল এটা তোমার বদঅভ্যাস। বড়রা সব কিছু করলে অভ্যাস হয় আর ছোটরা করলে হয় বদঅভ্যাস, বাহ্ কি চমৎকার আইন কানুন। যাই হোক, একটা আইন যখন সংবিধানে ঢুকে যায় তখন সেটা ভালো হোক আর মন্দ হোক প্রচলিত হয়ে যায়- কারো করার কিছু থাকে না। যেমন মামা গতবারে সুন্দরবনে বাঘের বাচ্চা সংগ্রহ করতে গেলেন। শাহানার আব্বু আমাদের একটা বাঘের বাচ্চাও দিলেন, মামাকে বলে দিলেন যেন ওটাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাই বছর খানেক পরে। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল, বাঘের বাচ্চার জন্য খাঁচাও বানান হলো। তিনদিন দু’টাকা করে প্রায় চারশো টিকিট বিক্রি হয়ে গেল। উঠে এলো আমাদের খরচের টাকা। কি›তু চতুর্থ দিনের মাথায় বাঁধলো গন্ডগোল। আব্বু মামাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘এসব পেয়েছিস কি, বাড়ির মধ্যে চিড়িয়াখানা বানানো হয়েছে, না ?’
‘জ্বিনা, বড় দুলাভাই। এটা চিড়িয়াখানা নয়, একটা দর্শনীয় প্রাণী আনা হয়েছে, ওটাকে মানূষ দেখতে আসছে, ব্যাস।’
‘ব্যাস,না ? পরিবর্তে দর্শনী নিচ্ছিসনা ?’
‘দর্শনী?’
‘মানে টিকিট, গাড়ল।’
‘হ্যাঁ, নিচ্ছি। তাতে কি।’ মামা বললেন। ‘এটাকে পাওয়ার জন্যে কষ্ট করতে হয়নি আমাদের? টাকা খরচ হয়নি ? সেই টাকা ওঠাতে হবেনা? সব ভালো কাজের একটা দাম থাকে।’
‘এই তোর ভালো কাজ? বাঘের বাচ্চা ধরে এনে টাকা কামাচ্ছিস। এরচেয়ে মধুমিতা হলের সামনে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি কর, আরো বেশী টাকা কামাতে পারবি।’
মামা কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন আব্বার মুখের দিকে, তারপর গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে এলেন। এসেই আমাদের সবাইকে ডেকে ঘোষনা দিলেন, এ বাড়িতে এই মানবকল্যাণমুখী কাজ কারবার হবেনা। এ বাড়িতে যতোসব হুতোম প্যাঁচাদের রাজত্ব। তাই যতোদিন পর্যন্ত আলাদা একটা বাড়ি নেয়া হচ্ছে না ততদিন পর্যন্ত নীরব সংঘের তহবিল সংগ্রহের কাজ বন্ধ থাকবে। আর বাঘের বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হবে সুন্দরবনে। ব্যস “নীরব সংঘ বালিকা বিদ্যালয়” মাচায় উঠে গেল।


সন্ধ্যার দিকে মামা আমাকে ডেকে বললেন,‘তোর ল,সা,গু গুলো শেষ হয়েছে?’
‘জ্বি, মামা।’ আমি মামার রুমের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে পড়লাম, ‘ওগুলো নিয়ে আসবো?’
‘দরকার নেই।’ মামা মোটা একটা বই পড়ছিলেন। সেটা নামিয়ে রাখলেন। ‘নিতু আর জ্যোতি কোথায়?’
‘মনে হয় দাবা খেলছে।’
‘মাশারকে পাওয়া যাবে?’
‘যাবে মনে হয়, একটু আগে বাপের হাতে ধোলাই খেয়েছে। এখন ছাদে থাকতে পারে।’
‘যা, সবাইকে ডেকে আন।’ মামা বললেন। ‘নীরব সংঘের জরুরী মিটিং।’
আমি ছুটলাম মামার নির্দেশ মতো। নিতুকে পাওয়া গেল পড়ার টেবিলে। আমাদের বাড়ির সবার  ভেতর নিতুই একমাত্র ব্যাক্তি যার পড়ার আগ্রহ অসীম। গল্পের বই পেলেই হয়েছে , ওটা শেষ করতে না পারা পযর্ন্ত শান্তি নেই। এজন্য ওর জ্ঞানও বেশি সবার চাইতে। ওর পড়ার টেবিলে যতনা পাঠ্য বই তার চেয়ে বেশি গল্পের বই। আব্বু এতে বাধা দেননা। তিনি বলেন গল্পের বই মানুষকে শান্ত হতে শেখায়, ভদ্র করে, জ্ঞান বাড়ায়। পড়ার বই পড়লে যে জ্ঞান বাড়ে তা কিন্তু নয়। ক্লাসের একটা বই আমরা সারা বছর ধরে পড়ি। যা শিখি তার চেয়ে বেশি মুখস্ত করি। কিন্তু গল্পের বই ছাড়াও নানা ধরণের বই পড়তে পারি আমরা। ভ্রমণ কাহিনী, সায়েন্স ফিকশন, জীবনী,রূপকথা, উপকথা, এগুলো একবছরে একশোর বেশি পড়া যায়। ফলে দেখা যায় একবছরের একজন ছাত্র পাঠ্যবই থেকে যা শিখেছে তার দশগুণ বেশি শিখেছে গল্পের বই থেকে। নিতুকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়-- বলতো “স্ট্যাচু অব লিবাটি” কোন নদীর তীরে অবস্থিত? ও চট্ করে বলে দেবে“হ্যাডসন।”কিন্তু মাশার কিংবা শিশিরকে যদি বলা হয় বলতো বাংলাদেশে কোথায় চা- বাগান আছে? ওরা দু’জন বলবে,এতোদিন জানতাম ফুলের বাগান,ফলের বাগান,এখন দেখছি চায়ের বাগানও হয়,এই যাহ্, তমাল,তুই আমাদের সাথে ফাজলামী করছিস; চা কি গাছে হয় নাকি? আমি দৌড়ে দোতলায় গেলাম নিতুকে মামার কাছে যেতে বলে। গিয়ে দেখি শিশির আর জ্যোতি চুল ছেঁড়াছেঁড়ি খেলছে। কে কার কতো চুল ছিঁড়তে পারে তার প্রতিযোগিতা। শিশিরের মাথায় চুল কম, জ্যোতি হাত দিলেই তেলে হাত পিছলে যাচ্ছে। কিন্তু জ্যোতির শ্যাম্পু করা লম্বা চুলগুলো শিশির মজা করে চড়চড় করে ছিঁড়ছে ঠিক যেন ঘাস ছিঁড়ছে মাটি থেকে। জ্যোতির মাথা থেকে একগাদা চুল ছিঁঁড়েছে শিশির সেগুলো ও আমাকে উঁচু করে দেখালো,‘তমাল, শিগগির এদিকে আয়। দেখ কত চুল ছিঁড়েছি। তুই ছিঁড়বি, আয় এই শয়তানটাকে চেপে ধরে আছি।’
শিশির বিছানায় জ্যোতিকে ফেলে ধরে রেখেছে পা দিয়ে আর দু’হাতে ছিঁড়ছে জ্যোতির চুল। আমি বললাম, ‘মামা তোমাদের ডাকছে।’
‘কেন?’ চুল ছেঁড়া থামিয়ে  ভ্রু পাকালো শিশির । ওর গাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। ‘মামার বার্লি খাবার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?’
‘কি?’
‘কিছুনা, চল যাচ্ছি।’ শিশির লাফিয়ে জ্যোতির বুকের ওপর থেকে নেমে গেল। মুঠো করে জ্যোতির ছেঁড়া লম্বা লম্বা চুল গুলো তুলে নিল। একগাদা চুল। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে আবার থমকে দাঁড়ালো ও , ‘দাঁড়া, আসল নষ্টামীটাই করা হলোনা। একটু দাঁড়া।’
সিঁড়ির নামার মুখেই শিশিরদের রান্না ঘর। আজ খালা রান্না ঘরে নেই। খালুকে নিয়ে গেছেন কোথায় যেন। রান্না ঘরে চুলোয় হাঁড়ি চড়িয়েছে গোবর বুড়ি। শিশিরদের রান্না বান্না করার জন্য এই বুড়িটাকে অল্প কিছুদিন হলো রাখা হয়েছে। এর আগে কাজ করতো ইন্দ্রানীর মা নামে এক হিন্দু মহিলা। সে থাকা কালে শিশির অর জ্যোতির জন্য রান্না ঘরটা ছিল সাক্ষাৎ স্বর্গ। খালা গোসল খানায় ঢুকলে কিংবা কোথাও গেলে দু’জন হামলে পড়তো রান্না ঘরে। রান্না ঘরে থাকতো গুঁড়ো দুধের টিন, কনডেন্সড্ মিল্ক, আচারের বৈয়ম, জলপাই-এর মিষ্টি সস্, পনিরের ডিব্বা,আরও কতো কি। ইন্দ্রানীর মা কিছুই বলতোনা কেবল মুচকি মুচকি হাসতো। দেখতে দেখতে সাবাড় হয়ে যেত দুধের টিন, আচারের বৈয়ম। কি›তু এই গোবর বুড়ি আসার পর থেকে শিশির আর জ্যোতির সুখের দিন গেছে। গোবর বুড়ি এক চোখে দেখে আর নিজ দায়িত্বে সামলে রাখে পুরো রান্না ঘরটা।
শিশির রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই গোবর বুড়ি খ্যানখ্যানে গলায় জিজ্ঞেস করলো,‘কি চাই এখানে?’
শিশির বললো,‘ গোবর বুড়ি, আমাকে একটু লবন দাওতো।’
‘ও দিয়ে আবার কি বদমায়েশি করবে?’ একই রকম গলায় বললো গোবর বুড়ি।‘ আমি বাপু পারবোনা তোমাকে লবন দিতে।’
‘আহা, একচিমটি। পেয়ারা খাবো।’
বুড়ি এক চোখে কুটকুট করে তাকালো শিশিরের দিকে তারপর উঠে গিয়ে মিটসেফ খুললো। এই সুজোগে চট্ করে রান্না ঘরে ঢুকে পড়লো শিশির। চুলোয় বসানো তরকারির হাঁড়ির ভেতর জ্যোতির চুলগুলো ছেড়ে দিল, লাফিয়ে ফিরে এলো আবার দরজার কাছে। বুড়ি এক চিমটি লবন এনে শিশিরের হাতে দিতে ও হেঁটে চলে এলো সিঁড়িতে। ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল লবন টুকু। তারপর হি হি হাসিতে ফেটে পড়লো,‘আজ গোবর বুড়ি বাপের হাতে ধোলাই খাবে,উহ্,! কি যে আনন্দ হবে আমার! একেবারে ঈদের আনন্দ!’

মামা বললেন,‘গোল হয়ে বোস, একেবারে পৃথিবীর মতো গোল।’
আমি বললাম,‘তোরা সব কমলালেবুর মতো গোল হয়ে বোস, কারণ পৃথিবী কমলা লেবুর মতো।’
নিতু বললো,‘পৃথিবী কমলা লেবুর মতো নয়। ওটা হবে ঊখখওচঞওঈ. ’
মামা বললেন,‘চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেবো একেবারে! এটা কোন বিজ্ঞান ক্লাস নয়। এখানে তোমাদের পন্ডিত গিরি দেখাতে ডাকা হয়নি। ’
ঝম্ করে নীরবতা নামলো ঘরের ভিতরে। সবার ঘাড় একে বারে নুইয়ে পড়েছে বুকের উপর। যেন আমাদের চেয়ে ভালো মানুষ আর একটিও নেই পৃথিবীতে। মামা মোটা বইটা বুকের উপরে থেকে নামালেন। সোজা হয়ে বসলেন বিছানার ওপর,  অদ্ভুত ব্যপার তার কানটা নড়ছে। অনেক দিন পর মামার এই কান নড়া দেখতে পেলাম। মামা যখন কোন বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে ভাবেন তখন তিনি কানটা মাঝে মধ্যে নাড়ান। অনেক দিন হলো এমনটা ঘটতে দেখিনি। আজ এটা দেখে বুঝতে পারলাম নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে আবার। আরেকটা এ্যাডভেন্চার?
মামা নড়ে চড়ে বসলেন। বালিশের তলা থেকে আজকের খবরের কাগজ বের করে “গ্রাম বাংলা” পাতাটা খুললেন। এই পাতাতে গ্রামের সব খবরাখবর ছাপা হয়। মামা বললেন, ‘আমি পড়ছি Ñ তোরা শুনে যাবি খালি। ’ একটু থেমে কাশি  দিয়ে গলা পরিস্কার করে নিলেন; তারপর পড়তে লাগলেন,‘ ”উত্তরবঙ্গের ধান ক্ষেত গুলোতে পোকার দারুণ উপদ্রব। এই বছর উত্তরবঙ্গের জেলা গুলিতে ব্যাপক হারে ধানের ফলন দেখা দিলেও পোকার দারুন উপদ্রবের কারণে চাষীরা মহা বিপাকে পড়িয়াছে। বছরের এই সময়ে যখন চাষীরা ধান পাকার আশায় ক্ষেতগুলির দিকে তাকাইয়া অপেক্ষার প্রহর গুনিতেছে ঠিক তখনই কারেন্ট পোকার ব্যাপক উপদ্রবের কারণে সেই আশাও তাদের নস্যাৎ হইয়া যাইতেছে। কারেন্ট পোকা ছাড়াও মাজরা পোকা, বাদামী গাছফড়িং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করিতেছে। ইতিপূর্বে গত দু’বছর ঢ্যাপের আক্রমনে চাষীরা বিপাকে পড়িয়াছিল কিন্ত এবছর কারেন্ট পোকার আক্রমন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করিয়াছে। বাজারে কিটনাশক গুলির মান অতি নিু। চাষীরা অভিযোগ করিয়াছে যে, এসব কীটনাশক ব্যবহারে পোকা গুলির কিছু হয়না কেবল পোকারা খানিক সময় মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া থাকে এবং পরবতীতে তাহারা আবার উঠিয়া খাদ্যান্বেষনে প্রবৃত্ত হয়। এমতাবস্থায় এগুলিকে কীটনাশক না বলিয়া কীটঘুমপাড়ানীয়া বলা উচিৎ এবং ..।’ মামা থেমে খবরের কাগজটা সরিয়ে রাখলেন। একএক করে সবার মুখের উপর দিয়ে ঘুরে এলো তার দৃষ্টি, ‘হ্যাঁ তার মানে হলো এটাই যে, বাজারে ভালো কোন কীটনাশক পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যাচ্ছে সেটাও হয়তঃ নকল কারণ এখানে সব কিছুতেই নকল। চাষীরা যা চাচ্ছে তা হলো খাঁটি কিছু। যা দিলে সব পোকা বাপ বাপ বলে পালিয়ে যাবে’ আবার থামলেন তিনি। পাশ থেকে লাল কাভারের মোটা বইটা তুলে নিলেন হাতে , ‘এই বইটা ফ্লাওয়ার ক্যাটালগ। এখানে পৃথিবীর নানা ধরণের ফুলের নাম,ধরণ এবং তাদের আদিবসতির নাম আছে।’ মামা পৃষ্ঠা উল্টে দুটো ফুলের ছবি বের করলেন। একটা ফুল হলুদ অন্যটা সাদা। মামা বললেন,‘এই ফুলটা তোমরা দেখছো এটার গোত্রের নাম প্যাপাভেরাসি এবং এটার নাম মার্ক এরিনতোলিয়া সংক্ষেপে ইনসেকটিটার। এই ইনসেকটিটারের একমাত্র কাজ হলো এটা তার চমৎকার হলুদ বর্ন দিয়ে পোকাদের আকর্ষন করে এবং পোকা ফুলের উপর বসলেই গপ্ করে খেয়ে ফেলে। এজন্যেই এর নাম ইনসেকটিটার। আর এই সাদা যে ফুলটা দেখছো এটার নাম হচ্ছে স্পারক্স স্টিংকার। এই ফুল যখন ফোটে তখন এমন ভয়ংকর গন্ধ বের হয় য়ে, চারপাশের যত পোকামাকড় সব উড়ে পালিয়ে যায়। স্পারক্স স্টিংকার এবং ইনসেকটিটার হচ্ছে একেবারেই দূর্লভ প্রজাতি এবং এই বইতে যে ছবিটা তোমরা দেখেছো সেটা আসল ছবি নয়।’    
 আমরা সবাই একসাথে বললাম, ‘তবে?’
‘এই ছবিটা হচ্ছে একটা স্পেশাল ইফেক্ট বা কম্পিউটারে তৈরী করা একটা ছবি। লেখক একবারই এই দুটো ফুল দেখেছেলেন এবং এরপরে কোন বই ঘেঁটে এই দুটোর কোন ছবি বা বর্ননা কিছুই পাননি। ফলে তিনিই এই ফুল দুটোর নাম  দিয়েছিলেন ইনসেকটিটার এবং স্পারক্স স্টিংকার। তিনি কল্পনা থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ছবি দুটো বানিয়েছেন ঠিক যেরকম দেখেছিলেন প্রায় দশবছর আগে। ’
‘বুঝেছি!’ মাশার লাািফয়ে উঠলো। ‘আমরা বন থেকে ওসব ফূল তুলে আনবো, তাইতো?’
মামা বাঘের মতো মাশারের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ‘ তারপর ফুলটা তোমার শার্টের ভেতর ঢুকিয়ে দাও যাতে তোমার বাপ বাপ বাপ বলে পোকার মতো ছুটে পালিয়ে যায়। এ ফুলতো আর কদমফুল নয় যে বন বাদাড় থেকে ছেঁড়ে নিয়ে এলে।’
‘তবে ?’ আমি বললাম।
‘ লেখক দশ বছর আগে হিমালয়ে এই ফুল দুটো দেখে এসেছিলেন। তাও দুটো ফুল এক জায়গায় ছিলনা। লেখক তার বইয়ের একস্থানে লিখেছিলেন এই স্পারক্স কেবল পোকদের তাড়ায় না এটার আশে পাশে সাপও ঘেঁষতে পারেনা , সাপেরা এক মাইল দুর থেকে এর গন্ধ পায়। নিতু, তুমি বলো আমাদের প্রসপেক্ট কতো খানি।’
“প্রসপেক্ট ”শব্দটা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় নিল নিতু, এর মধ্যেই সুজোগ পেয়ে নাক গলিয়ে দিও মাশার, ও বললো,‘ আরে গাধা, ফসপেট ,ফসপেট Ñ ফসপেট চিনিস না? ইউরিয়া, ফসপেট এগুলো হচ্ছে গাছের সার। মামা জানতে চাচ্ছেন কতখানি ফসপেট দিলে গাছ ভালভাবে বেড়ে উঠবে।’
‘মাশার।’ মামা ডাকলেন।
‘জ্বি, মামা?’
‘ টেবিলটা দেখতে পাচ্ছো সামনে?’
‘জ্বি মাম্’া
‘ ওটার  নিচে গিয়ে আধবসা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো, যাও। তোমার শরীরটা হতে হবে দ- এর মতো, বসাও নয় দাঁড়ানোও নয়। এটাই হচ্ছে তোমার শাস্তি। ’
মাশার অবিশ্বাসে মামার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মামা যে তাকে কোন কারণে শাস্তি দিতে পারেন এটা তার কল্পনার বাইরে ছিল।
মামা বললেন , আজ থেকে নীরব সংঘের বিধানে শাস্তির বিধান রাখা হলো। কেউ অপরাধ যোগ্য কোন অপরাধ করা মাত্রই তাকে টেবিলের তলায় চলে যেতে হবে।’
‘দ্বিতীয়বার বলার আগেই মাশার বিছানা থেকে নেমে গেল। সবার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে টেবিলের তলায় ঢুকলো। মামা এবার মনোযোগ দিলেন আমাদের দিকে। নিতুকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,  ‘হ্যাঁ, বলো। এসবের ভেতর আমাদের প্রসপেক্ট মানে আমাদের আশা কতোটুৃকু।’
‘আমরা ঐ দুটো ফুলের গাছ সংগ্রহ করবো। যেহেতু বাজারে ভালো কোন কীটনাশক নেই তাই আমরা ইনসেকটিটার আর স্পারক্স স্টিংকার এদেশে আমদানী করতে পারি। এভাবে আমরা আমাদের নীরব সংঘ বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে পারি।’  নিতু মুচকি হাসলো।
মামা দুহাতে নিতুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘এইতো, এমনই তো চাই। এই হচ্ছে নীরব সংঘের একজন কৃতী সদস্যা। নিতুকে আমি এই সংঘের ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দিলাম, হাততালি।’
সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো । আবাহনী আর মোহামেডানের খেলাতেও বুঝি এতো হাততালি পড়েনা, আমার কান ঝাঁ - ঝাঁ করতে লাগলো হাততালির শব্দে। মাশার পর্যন্ত হাততালি দিচ্ছে টেবিলের তলা থেকে কিন্তু হাততালির পাশাপাশি মুখ ভ্যাংচাচ্ছে।
   ‘ এখন দেখতে হবে ঐ সব ফুলের গাছ কোথায় পাওয়া যায়। লেখকের লেখায় আমরা দেখেছি ইনসেকটিটার আর স্পারক্স স্টিংকার একমাত্র পাওয়া যায় হিমালয়ে। তিনি সাতাশি সালের দিকে হিমালয়ের ঐ পাহাড়ে উঠেন। তখন সেখানে অক্টোবর চলছিল। লেখক দেখেন যে এই অসম্ভব ঠান্ডার মধ্যেও হিমালয়ের ঐ অংশে তখনও বরফ জমা শুরু হয়নি। তিনি ধারণা করেন হিমালয়ের ঐ অংশে সহজে তুষার পড়েনা , ফলে মাটিতে জন্ম নেয় নানা ধরণের উদ্ভিদ। এর ভেতর ঐ দুটো প্রজাতির ফুল গাছ ছাড়াও নানা ধরণের ফুল গাছ আছে যাদের মধ্যে ক্ষমতাবান কোন গাছ গাছড়াও থাকতে পারে।’ মামা বললেন। ‘ নানা ধরণের গাছ পালা লেখক দেখেছেন যাদের কাঁটার ভেতর “ ফ্লু” Ñ এর নিয়ামক রয়েছে। একটা গাছের পাতা থেকে এমন এক ধরণের রস পাওয়া গেছে যা খেতে পারলে কোনদিন শরীরে খোঁস পাচড়া হবেনা। তবে আমরা ঐ সব গাছ গাছড়ার ব্যপারে ততোটা অগ্রহী নই যতটা ইনসেকটিটার এবং স্পারকস্ স্টিংকার Ñ এর ব্যপারে আগ্রহী। কারণ হচ্ছে লাভ। যে গাছ বা ফুল আমাদের দেশের বিরাট এক সমস্যার সমাধান করবে আমরা সেটাই আনবো এদেশে। তোমরা কি বলো ?
আমরা তখনও বুঝতে পারিনি মামার মতলবটা কি তাই চুপ করে থাকলাম। ভুল জবাব দিয়ে মাশারের পাশে যেতে চাইনা। মামা বললেন, ’আমরা গাছ দুটো সংগ্রহ করবো। ঐ গাছ দুটোর চাষ করবো আমাদের বাগানে। এটাই হবে ইনসেকটিটার আর স্পারকস্ স্টিংকার Ñ এর একমাত্র চাষাগার ও পাইকারী বিক্রির একমাত্র স্টল। আমরাই ওগুলোর চাষ করবো এবং আমরাই ওগুলো বিক্রি করবো।’
‘ কিন্তু মামা .. .. ..।’ আমি বললাম। থেমে গেলাম মাঝপথে। মামা শব্দটা বলার সাথে সাথে মামার রক্ত চক্ষু আমার দিকে ঘুরে গেছে। এখন যদি আমি চুপ করে থাকি তাহলে নির্ঘাত ডিসটার্ব করার দায়ে আমাকেও টেবিলের নিচে গিয়ে দ ডাউন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তাড়াতাড়ি বললাম, ‘ কিন্তু মামা, হিমালয় থেকে আমরা কিভাবে আনবো ওগুলো ? তাছাড়া ওগুলোকে চেনার ব্যবস্থা না হয় করা গেল কিন্তু ঠিক কোন খানটায় ওগুলো জন্মায় তা বইতে বলা হয়নি।’
‘ কোন সমস্যা নেই । ওই জায়গা খুঁজে বের করা যাবে।’ মামা বললেন।‘  যদি বরফের তলায় চাপা থাকে তাহলেও ওটাকে বের করা হবে। যদি চারাগাছটা মরে গিয়ে থাকে তবে ওটার বীজ থাকবে। আর বীজ যদি মাটিতে পড়ে থাকে তবে ওটার আরও চারা জন্ম নেবে। ইনসেকটিটার না থাকলেও স্পারকস্ স্টিংকার থাকবে। স্পারকস্ স্টিংকার না থাকলে ইনসেকটিটার থাকবে। একটাকে আমরা পাবোই।’
‘ কিন্তু হিমালয় থেকে আমাদের গাছ গুলো পাঠাবে কে ?’ এতোক্ষন চুপ করে থাকার পর জ্যোতি মুখ খুললো।
‘ কে আর পাঠাবে ? আমরা যাবো। ’মামা গম্ভীর ভাবে বললেন , ‘ আমি ঠিক করে রেখেছি সব কিছু। টিকিট কনফার্ম করা হলেই কাজ ফিনিশ। এখন শুধু পান্নালালকে ডেকে বলতে হবে টিকিট কনফার্ম করতে। হ্যাঁ, আগামী পরশু যাচ্ছি আমরা। নেপালে।’
..........................................চলবে