ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে ঝম ঝম শব্দ। সামনের রাস্তা দিয়ে স্রোতের মতো ছুটছে বৃষ্টির পানি। নুরু সেই পানিতে কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসাতে চেষ্টা করছে। বাড়িতে পুরোনো অনেক কাগজ আছে তাদের। নুরুর মা এসব কাগজ দিয়ে ঠোঙ্গা বানায় সারাদিন। নুরুর বাবার সেই ঠোঙ্গাগুলো ভীষন কাজে লাগে। তাকে আর নতুন ঠোঙ্গা কিনতে হয়না। এক কেজি নতুন ঠোঙ্গা কিনতে তাকে গুনে গুনে চল্লিশ টাকা দিতে হয়। এই চল্লিশ টাকা থাকলে নুরুর মা চম্পা বেগম বাজার থেকে দুই কেজি আলু কিনতে পারে। আর এই চল্লিশ টাকা বাঁচাতে তাকে প্রায় পুরো বিকেলটা ঠোঙ্গা বানাতে হয়। এই ঠোঙ্গাগুলোতে করে নুরুর বাপ সেলিম মিয়া বাদাম বিক্রি করে।
নুরুর মাথা ভিজে গেছে বৃষ্টির পানিতে। টিনের চালের আড়াল থেকে মাথা বের করে নৌকা ভাসাতে গেলেই মাথা ভিজে যাচ্ছে। সে একটু ঘুরে বসে চিতকার দিল,‘মা, খিদা লাগসে।’
চম্পা বেগম ঠোঙ্গা বানাতে ব্যস্ত। ওর দিকে না তাকিয়ে বললো,‘পাকঘরের বৈয়ামে খোসাছিলা বাদাম আছে খাইয়া নে।’
নুরু ভ্রু কুঁচকে বললো,‘কি কও মা, দুপুর বেলা কেউ বাদাম খায়? আজও ভাত রান্দোনাই?’
‘হ তোর বাপে কি বাজার করসে? হ্যায় তো বাদাম বেচতে গেসে বালুর মাঠে।’ গজ গজ করলো চম্পা বেগম। ‘হ্যায় মনে করে মানষের খাইয়া কাম নাই, সারাদিন বাদাম খাইবো। এদিক যে ঘরে চাউল ডাল নাই হেই খেয়াল নাই। তুই কি মনে করস আমার খিদা নাই? আমার খিদা পায়না? খালি তোরই খিদা লাগে?’
নুরু কিছু বলেনা। আবার বৃষ্টির পানিতে নৌকা ভাসাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষন পর আর না পেরে রান্নাঘরে গিয়ে, বৈয়াম খুলে একমুঠো বাদাম খেয়ে আসে নুরু। তারপর আবার চলে তার নৌকা ভাসানো।কিছুক্ষন পর আবারও খেলা থামিয়ে নুরু মায়ের দিকে তাকায়।
‘‘আই”ছা মা, কাল তো ঈদ। বাবায় আমগো জন্য তো কিছু কিনে নাই অহনও।
’‘কি কিনবো? খাইতে পাসনা আবার জামা কাপড় কিনোনের চিন্তা করোস? ঈদ হইলো বড়োলোকগো জইন্ন যাগো অনেক ট্যাকা।’ চম্পা বেগম ঠোঙ্গা বানাতে বানাতে উদাস হয়ে যায়,‘জানোস আমি যে বাসায় আগে কাম করতাম হেই বাসার মানষের না অনেক ট্যাকা। হ্যারা কি মজার খাওন খায়।’
নুরুর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি উঠে মায়ের কাছে চলে আসে।‘হ্যারা কি খায় মা?
‘সকাল বেলা যখন কামে যাইতাম তখন হ্যারা টেবিলে বইয়া কি মজার খাওন খাইতো! আমি তো সকালে নাস্তা না কইরা কাম করতে যাইতাম, আমার পেটে তহন অনেক খিদা থাকতো। হেই খাবারগুলার গন্ধে আমার কাম করনের শক্তিও থাকতনা। আমার ইচ্ছা হইতো হেই খাবারগুলা খাইতে। পেটটা মোচড় দিত খিদায়। তারপর যহন পেলেটগুলা পাকঘরে ধুইতে দিত তখন পেলেটের মইদ্যে কিছু খাবার লাইগা থাকত হেইগুলা আঙুল দিয়া নিয়া খাইতাম।’
নুরু ঢোক গিলে জানতে চায়,‘খাইতে অনেক মজা মা?’
‘হ মনে হইত বেহেশতের খাবার খাইতাসি। এতো মজা! হেই কারনেই তো আমারে তাড়াই দিলো হ্যারা।’
‘ক্যান তাড়াই দিল?’
‘ওইযে আমি হ্যাগো খাওনের পর পেলেটে যে খাবারগুলা লাইগা থাকতো হেই খাবারগুলা খাইতাম। হ্যারা কইলো আমি নাকি হেগো পেলেট নোংরা করি। আমি কইলাম, আমি তো পেলেটগুলা পরে সাবান দিয়া ধুইয়া দেই। তাও আমারে রাখলোনা। খ্যাদাই দিল।’
নুরু ধীর গলায় বললো,‘হ্যারা তো তোমারে হ্যাগো খাওন থেইকা একটুখান দিতে পারতো। তা না দিয়া কেন খ্যাদাই দিল?’
‘হ্যাগো খাওন আমারে দিব ক্যান? আমি তো কামের বুয়া। ফিরিজের ভিতরে কতো খাওন থাকতো হেগো। দেকলেই খাইতে ইচ্ছা করত।’
‘ফিরিজের ভিতরে খাওন থাকতো?’ নুরু উতসাহে মায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
‘হ। ঠান্ডা খাওন। অনেক মজা।’
নুরুর চোখে আরও কৌতুহল ঝরে পড়ে। ‘অনেক মজা? খাইতে কেমন মা?’
বিরক্তিতে চম্পা বেগম নুরুকে একটা থাপ্পড় দেয়,‘ওই ছ্যাঁমড়া, আমি কি খাইয়া দেকসি নাকি? উল্টাপাল্টা কথা জিগাস ক্যান। যা উইঠা গিয়া নিজের কাম কর। আমার কাম নষ্ট করস খালি।’
নুরু উঠে গিয়ে আবার কাগজের নৌকা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছোট ছোট পিঁপড়াকে নৌকায় তুলে ভাসিয়ে দেয়, আবার কিছুদুর গিয়ে কাগজের নৌকাটা যখন ভিজে যায় তখন ও দৌড়ে গিয়ে পিঁপড়াটাকে উদ্ধার করে শুকনো জায়গায় রেখে দেয়। খিদেয় তার পেটের ভেতর পাক দিতে থাকে। মায়ের কথাটা নুরুর মনে ঘুরতে থাকে। অনেক মজার খাবার খায় মানুষ। ও যখন বাবার মতো অনেক বড়ো হবে তখন নিশ্চয়ই ওর অনেক টাকা হবে। তখন ও তাদের মতো মজার মজার খাবার কিনে খাবে।
সেলিম মিয়া বাদামের ঝুঁড়িটা মাথায় তুলে নিল। বৃষ্টিটা কমে আসছে একটু একটু করে। সেই দুপুর বারোটা থেকে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তার শেষ হবার নাম নেই। এর মধ্যে বাদাম বিক্রি হয়েছে মোটে ত্রিশ টাকার। তার ধারনা ছিল ঈদের আগের দিন বলে মানুষ প্রচুর বাদাম কিনবে।
তাছাড়া বৃষ্টি হলে বাদামের চাহিদা বেড়ে যায়। আজ দেখা যাচ্ছে উল্টো। বৃষ্টির কারনে রাস্তাঘাটে মানুষ কম। এমনিতে ভাইরাসের কারনে মানুষ বাইরের খাবার খায়না, তার ওপর যোগ হয়েছে বৃষ্টি আর ঈদে মানুষের সংকট। বিশাল বালুর মাঠে অন্যসময় ক্রিকেট খেলে ছেলেরা, অনেক মানুষ ঘুরতে আসে। তারও বিক্রি হয় মোটামুটি। বৃষ্টি আর ঈদের কারনে আজ মানুষশুন্য মাঠ। মুদির দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে বাদামের ঝুঁড়ির ওপর পাতলা পলিথিন বিছিয়ে দেয় সেলিম মিয়া। তারপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ভেতর বেরিয়ে আসে বাইরে।
হাঁক দেয়,‘বাদাম, ভাজা বাদাম, বাদাম নেবেন? ওই বাদাম।’
ওর কাছে ঘড়ি নেই, তবে সেলিম মিয়া বুঝতে পারছে যে দুপুরের খাবার সময় পার হয়ে গেছে। পেটের ভেতরটা অন্য দিনের চেয়ে বেশী খাবার চাইছে আজ। মুদির দোকান থেকে একটা বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি খেয়ে নিয়েছে সে। এতেই তার চলে যাবে বিকেল পর্যন্ত। রাস্তা দিয়ে মাথায় ঝুঁড়ি নিয়ে যায় সে আর হাঁক দেয়,‘বাদাম, বাদাম নেবেন? বুট বাদাম।’
তার ডাক বিশাল উঁচু দালানগুলোতে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। নীরব নিস্তব্দ সব এ্যাপার্টমেন্ট, কোথাও কোন শব্দ নেই।সেলিম মিয়ার খুব জানতে ইচ্ছে হয় এতো বড়ো বড়ো বাড়িতে যারা থাকে তারা কি খায়। এই সময়টাতে তো তাদের জেগে থাকার কথা নয়। বৃষ্টির সময় মানুষের ঘুম হয় বেশী। বড়োলোক মানুষগুলো এখন হয়তঃ খেয়ে দেয়ে ঘুমোচ্ছে। তাদের বাদাম খাবার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া ঈদের আনন্দময় মুহুর্তে তারা হয়তঃ বাদামের চেয়েও আরও মজার খাবার দাবার খেয়েছে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয় সেলিম মিয়ার।
অলিগলিতে গিয়ে হাঁক ছাড়ে, বাদাম, বাদাম, বাদাম, বাদাম। কেউ ডাকে না। কেউ বলেনা এই বাদাম এদিকে এসো। আরো দু’ঘন্টা এগলি ওগলি, রাজপথ মেঠোপথ, লেইন, বাই লেইন ঘুরে বেড়ায় সেলিম মিয়া। এরমধ্যে দু’জন বিশ টাকার বাদাম কেনে তার কাছ থেকে। আজ সারাদিনে মাত্র পঞ্চাশ টাকা আয় হয়েছে তার। তাও এই টাকার মধ্যে তার চালানও রয়েছে। চারপাশে মানুষজনের কতো আনন্দ। কেউ দোকানে কেনাকাটা করছে, কেউ বাজার সওদা নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। কাল ঈদ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় হৈ হল্লা করছে। আর তার কালকের জন্য কিছুই কেনা হয়নি। কিনবেই বা কিভাবে, তারতো টাকা নেই। আজ বাজারও করা হয়নি। পকেট হাঁতড়ে গতকালের মোটে চল্লিশ টাকা পেল সে। ঈদের জন্য তার এই সম্বল। আচ্ছা, ভাবলো সেলিম মিয়া, তার ভাগ্য ফেরেনা কেন? বাদামআলারা কি সারাজীবন গরীব থেকে যায়?
সন্ধ্যার দিকে দুই কেজি মোটা চাল আর এক কেজি আলু নিয়ে বাড়ি ফিরলো সেলিম মিয়া। নুরু বাপকে দেখে দৌড়ে আসে। তার হাতে পলিথিন দেখে আনন্দে হাততালি দেয় সে,‘মা দেখো বাবা চাউল আনসে, আলু আনসে। আজ রাইতে ভাত খাইতে পারুম আমরা!’
নুরুর মাথায় হাত রাখে ক্লান্ত সেলিম মিয়া। হাসে। শরীরটা দুর্বল লাগে, একটু জ্বর জ্বর বোধ হয়। দুপুর থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাদাম বেচার ফল। ‘দুপুরে কি খাইছস?’ ছেলেকে প্রশ্ন করে সে।
‘বাবা, আমরা মনিরের দোকান থন মুড়ি কিন্যা আনসিলাম। দুপুরে পিঁয়াজ দিয়া মুড়ি খাইসি।’ আনন্দের সাথে বললো নুরু।‘তুমি কি খাইসো বাবা?’সেলিম মিয়া ওর কথার উত্তর না দিয়ে বৌকে বলে চাল আলুগুলো নেবার জন্য। তারপর বাদামের ঝুঁড়িটা নামিয়ে রাখে একপাশে। নুরু বলতে থাকে,‘বাবা মা কি বলসে জানো, মা যহন মানষের বাড়িত কাম করতো তহন মা দেখতো হ্যারা নাকি মজার মজার জিনিষ খায়। বাবা মজার জিনিষগুলা কি কইতে পারো?’
সেলিম মিয়া নড়বড়ে চৌকিটার ওপর গা এলিয়ে দেয়। মাথা নাড়ে এপাশ ওপাশ। তার নিজেরও জানার খুব ইচ্ছে বড়োলোকেরা মজার মজার কি জিনিষ খায়।
‘কইতে পারো না?’ নুরু বলে,‘আইচ্ছা বাবা তুমি আমারে একদিন মজার জিনিষ আইনা দিবা? আমি খামু।’
‘আইচ্ছা দিমু।’
নুরু খুশি হয়ে যায়। সরে যায় বাবার পাশ থেকে। চম্পা বেগম পলিথিনদুটো খুলে চাল আর আলু বের করছে। সে চোখে রাজ্যের কৌতুহল নিয়ে মায়ের কাজ দেখতে থাকে। গত রাতে তারা মুড়ি আর পিঁয়াজ মাখিয়ে খেয়েছিল। আজ অন্ততঃ ভাত খেতে পারবে। ভাত জিনিষটার ওপর তার অনেক দুর্বলতা। ভাত খেলে তার পেট পুরোপুরি ভরে যায়। মুড়ি খেলে পেট খালি থাকে। আর তখন ঘুম আসে না।
সেলিম মিয়ার শরীরটা সত্যিই খারাপ হয় রাতের দিকে। জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে শেষ রাতের দিকে উল্টোপাল্টা বকে সে। চম্পা বেগম উঠে ‘হারিকেন জ্বালায়। নুরু বাপের পাশে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নড়বড়ে চৌকির ওপর বিছানো ময়লা চটচটে কাঁথার ওপর কুঁকড়ি মেরে শুয়ে আছে সে। চম্পা বেগম স্বামীর কপালে হাত রাখে। মনে হচ্ছে গা পুড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি সে গামছা ভিজিয়ে স্বামীর কপাল মাথা মুছে দেয়। তালপাখার বাতাস করে মাথার ওপর।
সকালের দিকে জ্বর কিছুটা কমে সেলিম মিয়ার। চম্পা বেগম জিজ্ঞেস করে,‘কিছু খাইবা? রাইতের ভাত আসে আর একটুস আলু ভর্তা রাইখা দিসি, খাইবা?’
মাথা নাড়ে সেলিম মিয়া,‘বিস্কুট দিয়া চা খাইতে ইচ্ছা করতাসে।’আজ ঈদের দিন। হুনতাসো না মসজিদের মাইকে নামাজের জন্য কি কইতাসে? অহন কই পাইবা চা বিস্কুট। আলু ভর্তা দিয়া বাসি ভাত খাইয়া লও।’
‘মুড়ি দ্যাও।’
গতকাল দুপুরের কিছু মুড়ি রেখে দিয়েছিল চম্পা বেগম। নুরুর ঘনঘন খিদে লাগে। সেটাই এখন স্বামীকে দিয়ে দিল। মুড়ি চিবাতে চিবাতে সেলিম মিয়া বলে,‘কারো বাড়ি তন কিছু খাবার দাবার চাইয়া আনোনা। আইজ ঈদের দিন, তোমারে কেউ ফিরাই দিবোনা।’
চম্পা বেগম চিন্তা করে দেখে তার স্বামীর কথা ঠিক। ঈদের দিন বলে সে যদি কারো বাড়ি গিয়ে কিছু চায় তবে তাকে ফিরিয়ে দেবেনা। সে উঠে দাঁড়ায়,‘আইচ্ছা, দেখি কার বাড়ি যাওন যায়।’
সেলিম মিয়া চট করে চম্পা বেগমের হাতটা ধরে। তারপর করুন চোখে তার মুখের দিকে তাকায়,‘বিশ্বাস করো, তোমারে পাঠাইতাম না, আইজ ঈদের দিন, পোলাডা উডলে খাওন চাইবো। কি দিবা হ্যারে?’
মাথা নাড়ে চম্পা বেগম। সত্যি কথা বলেছে সেলিম মিয়া। তার স্বামী কখনও ভুল কথা বলতে পারেনা। তার স্বামী যা বলে সঠিক কথাই বলে। সে বিয়ের পর থেকে কোনদিনই স্বামীর কথার বাইরে যায়নি। স্বামীকে সে অনেক ভালোবাসে। তার পেটে ভাত সে হয়তঃ সঠিকভাবে দিতে পারেনা কিন্তু স্বামী হিসাবে সে অনেক ভালো তার কাছে। বেড়ার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।
সকাল থেকে মেজাজ খারাপ আহমেদ সাহেবের। এমনিতে ব্যবসায় বড়ো একটা ধ্বস নেমেছে, ব্যাংকের সুদ কমিয়ে দিয়েছে সরকার, গচ্ছিত টাকায় কোন সুদ পাওয়া যায়না আর। সেই চিন্তা করে বারো কোটি টাকার বড়ো একটা ইনভেস্ট ছিল তার নতুন ব্যবসায়ে। এক মাসে দেখা যায় এক কোটি টাকাই লস। যদিও তার জুয়েলারী ব্যবসা এখন লালে লাল তারপরও তার কথা লস হবে কেন?ঈদের দিনেও পার্টনারদের সঙ্গে কথা বলছেন ফোনে। স্ত্রী যখন নামাজে যাবার তাড়া দিল তখন তার ইচ্ছে হলো জুতো ছুঁড়ে মারে মরিয়মের দিকে। বড়ো ছেলেটার ইচ্ছে ছিল এবার থাইল্যান্ডে ঈদ করবে। আহমদ সাহেব কাজের চাপে সময় পাননি। তাই দিহান, মানে তার বড়ো ছেলেটা ঘোষনা দিয়েছে আজ ঈদই করবেনা, কিছুই মুখে তুলবেনা। দরজাও খুলবেনা রুমের। তার মা সকাল থেকে অনেক চেষ্টা করছেন তার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে,‘বাবা দরজা খোল। ঈদের দিন এমন করেনা বাবা। কিছু খেয়ে নামাজ পড়তে যা।’
‘মা আমি তোমার ওই ইটালিয়ান স্পেগেটি, স্বামী কাবাব, জালি কাবাব, মাখন পরোটা বা ফিন্নি কিছুই আজ মুখে তুলবোনা। ওইসব ওল্ড ভার্সন খাবার দাবার আমার একদম পছন্দ নয়।’ রুমের ভেতর থেকে বললো দিহান। ‘আজ আমার থাইল্যান্ডে থাকার কথা। আমি ফ্রেন্ডদের কাছে কতোটা ছোট হয়ে গেছি চিন্তা করেছো একবার? ফেসবুকে অলরেডী স্ট্যাটাস দিয়ে ফেলেছি আমি ঈদ করতে থাইল্যান্ড যাচ্ছি, আর এখন বাবা ভাইরাসের ভয় দেখায়। ওইসব করোনা ভাইরাসকে অন্ততঃ দিহান ভয় করেনা।’
‘আচ্ছা বাবা তোর সব কথা মানা হবে। এখন বেরিয়ে এসে একটু মুখে খাবার তোল বাবা। তুই না খেলে এতো খাবার দাবার কি হবে বাবা?’
ভেতর থেকে কিছু বলেনা দিহান। এদিকে ছোট ছেলেটাও রেগে আছে। তার আবদার তাদের পুরোনো সিলভার প্রিমিওটা বদলে ফেলতে হবে। কাকরাইলের গাড়ির শোরুমে নতুন একটা ব্রাউন এলিয়ন তার খুব পছন্দ হয়েছিল পরশুদিন। বাবার কাছে আবদার করেছিল প্রিমিওটা বিক্রি করে নতুন গাড়িটা কেনার জন্য। বাবা বলেছে ঈদের পর সব হবে। সেজন্য বাবার সাথে কথা বন্ধ।
মরিয়ম ডাইনিং রুমে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার তিনটে ফ্রিজ অথচ এতো খাবার আটছে না সেগুলোতে। উপরন্ত কালকের বানানো কেক, পিজা, চপ, মিস্টি, সিমাই এগুলোও রয়ে গেছে। এগুলো ঈদের খাবার নয়, তাই ফ্রিজেনা রেখে সেগুলো ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখেছেন। আহমদ সাহেব ডাইনিঙে ঢুকে রেগে উঠলেন,‘এগুলো এখনও রেখে দিয়েছো? তোমাকে না বললাম এগুলো না রেখে বুয়াকে দিয়ে দাও?’
‘বুয়াতো ঈদের দিন আসবেনা।’ মিনমিন করে বললেন মরিয়ম।
‘তাহলে কালকের খাবারগুলো জানালা দিয়ে পেছনের ডাস্টবিনে ফেলে দাও। ঈদের দিন অন্তত এইসব বাসি খাবার ঘরের ভেতর রেখোনা।’
মাথা নেড়ে মরিয়ম একটা পলিথিনের ভেতর ঢোকালেন খাবারগুলো। বাড়ির ঠিক পেছনে একটা ডাস্টবিন আছে। চারতলা থেকে এইম করে ফেললে ঠিক তার ভেতর পড়তে পারে। বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়া যাবে বাসি খাবার। মরিয়ম পলিথিনটা ভালো করে বন্ধ করে বারান্দায় এলেন। তারপর নিচের ডাস্টবিনটা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলেন। তিনি কি আর দিদি নাম্বার ওয়ান হবার জন্য কোনদিন প্রাকটিশ করেছেন যে ঠিকঠাকমতো একেবারে ডাস্টবিনে ফেলতে পারবেন? কোথায় ডাস্টবিন আর কোথায় ফেললেন পলিথিনটা। আরেকটু হলেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মহিলার মাথার ওপরই পড়তো ওটা। মরিয়ম তাড়াতাড়ি সরে এলেন বারান্দা থেকে। যাক বাসি খাবারগুলো ফেলা গেছে। তিনি খুব টেনশনে ছিলেন খাবারগুলো নিয়ে।
আরেকটু হলেই এতবড় প্যাকেটটা চম্পা বেগমের মাথার ওপর পড়তো। চম্পা বেগম চারপাশে তাকালো। কে ফেললো এটা? কাউকে তো দেখা যাচ্ছেনা বিল্ডিঙের ওপর! যখন দেখলো কেউ নেই পলিথিনটা তুলে নিয়ে দেখলো ভেতরে অনেক খাবার দাবার।
এমন খাবার যে সে মুখে তোলার কথা চিন্তাও করতে পারেনা। এগুলো হয়তঃ ভুল করে কেউ ফেলে দিয়েছে। হয়তঃ কারো ঈদের জন্য রান্না করা খাবার। চম্পা বেগম এদিক সেদিক তাকালো। না, কোন দাবীদার নেই এসবের। কিন্তু চম্পা বেগম কি এগুলো নিতে পারে? দোটানায় পড়লো সে।
নুরু ঘুম ভেঙে দেখলো তার মা বাবা দু’জনই হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তাদের একমাত্র রাজকুমার নুরুর এইমাত্র ঘুম ভেঙেছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে বসলো বিছানায়,‘মা তোমরা হাসতাসো ক্যান?’
‘আজ যে ঈদের দিন হেইলাইগা হাসতাসি।’ চম্পা বেগম ছেলের কপালে চুমো খেলেন।
‘হেইলাইগা হাসতাসো?’
‘হ হেইলাইগা হাসতাসি। যা মুখ ধুইয়া আয়। ঈদের খাওন খাবিনা?’
নুরু মুখ কুঁচকে বললো,‘কাইলকার আলু ভর্তা দিয়া ভাত?’
‘আরে না, তুই না মজার খাওন খাইতে চাইসিলি।’
‘সত্যি বলতাসো মা? আমি মজার খাওন খামু?’ নুরু দৌড়ে যায় কলপাড়ে। দ্রুত চোখে মুখে পানি দেয়, কুলি করে। তারপর বাথরুম না সেরেই দৌড়ে আসে ঘরে। বিশ্ময়ে তার চোখ বড়ো হয়ে যায়। নড়বড়ে চৌকির ওপর রাজ্যের দামী দামী খাবার। কেক, পিজা, চপ, মিস্টি, সিমাই। এসবের নামও জানেনা ওদের কেউ।
নুরু পায়ে পায়ে সেদিকে এগোয়। পুরো ঘরটায় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে দামী খাবারের। এতো খাবার যে তারা তিনজন তিনদিনেও এগুলো শেষ করতে পারবেনা।
‘এগুলো কে আনসে?’ হতভম্বের মতো প্রশ্ন করে সে।
‘তোর বাবায় আনসে। কাল এগুলা আইনা বিছানার তলে লুকাই রাখসিলো।’ চম্পা হেসে তার স্বামীর দিকে তাকায়।
সেলিম মিয়াও হেসে তার বৌয়ের দিকে তাকায়। তার লক্ষি বউটা নিজের অর্জনটা স্বামীকে দিয়ে দিয়েছে অনায়াসে। নুরু খুশিতে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে,‘বাবা তুমি কত্তো ভালো!’ তারপর একটা মাংসের চপ তুলে নিয়ে কামড় দেয়। নাচতে নাচতে উঠোনে গিয়ে দু’হাত দু’দিকে বাড়িয়ে চিতকার করে ওঠে,‘তোমরা দেইখা যাও আমি কতো মজার খাবার খাইতাসি। তোমরা কেউ খাইবা? অনেক মজার খাওন!’
অনেক অনেক বই পড়েছি আপনার। সেই ১৯৯০ সাল থেকে আপনার লাভস্টোরী পড়া শুরু। আমি লাভস্টোরীই বলব কেননা আমি ওগুলোর ভক্ত ছিলাম। সেবা রোমান্টিকের গল্পগুলোতে থ্রিল ছিল কিন্তু আপনার গল্পে বা উপন্যাসে আমি প্রকৃত প্রেমটাকে খুঁজে পেতাম। প্রেম তেমনই হওয়া উচিত ছিল। তাই আপনার গল্প উপন্যাস পড়ে আমার নিজেরই খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করত কিন্তু বাস্তবে হত উল্টো। সে যাই হোক, আপনার তুমি অনন্যা পড়ে আমি দু তিন দিন স্তব্দ হয়ে বসেছিলাম। আর তৃনাকেই ভাবছিলাম আর একটা সুগন্ধ ছিল আমার মন জুড়ে। আমি আছি রূপালী পাতার সাথে এবং থাকবো, হয়তঃ আপনার গল্প পড়ার লোভেই। বেশী করে লাভস্টোরী লিখবেন। ভালবাসা নিবেন। বন্যা, মনিপুরিপাড়া, ঢাকা। bonna4rmmon19@gmail.com