এক দিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত, অন্য দিকে উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি। মাঝখানে মসৃণ পথ যেন মিশে গেছে অজানায়! এই পথ ধরে চলতে চলতে কখনও সমুদ্রের লোনা বাতাসের ঝাপটা ছুঁয়ে যাবে আপনাকে, কখনও সবুজ পাহাড়ের সতেজতায় ভরে উঠবে মন। হ্যাঁ, বুঝতে পারছেন আমি কোন রাস্তার কথা বলছি। আমি বলছি বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে কক্সবাজারের কলাতলী সৈকত থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ রোডের কথা। আপনার খুবই অবাক লাগবে যখন শুনবেন কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এবং একই সাথে সেখানকার মেরিন ড্রাইভ রোডও পেয়েছে একই খেতাব। পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক। একটি এলাকার দু’ দু’টি বিশ্ব রেকর্ড আর বুঝি কোথাও মিলবেনা।
সত্যিকথা বলতে কি, কক্সবাজার বাংলাদেশের এমনই এক সৈকত যা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতে চায়না যে এমন টানা তটরেখায় আপনি হেঁটে চলে যেতে পারবেন যতোদুর চোখ যায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই সৈকত আছে এবং তা বেশ সুন্দর, কিন্তু কক্সবাজারের মতো এমন বিন্যস্ত দৃশ্যাবলী সেখানে বিরল।
এই নিয়ে কক্সবাজারে মোট আটবার ভ্রমন করেছি। প্রতিবারই এই মেরিন ড্রাইভ দিয়ে সুগন্ধা বিচ থেকে টেকনাফ পর্যন্ত চলে গেছি। পথে থেমেছি হিমছড়ি, ইনানী বিচ, তারপর চলে গেছি সাবরাং বেড়ি বাঁধ পর্যন্ত। ওটাকে বলা হয় জিরো পয়েন্ট। ওখান থেকেই বাংলাদেশের শুরু।
সৌন্দর্য পুরোপুরি প্রাকৃতিক। এখানকার কোথাও কৃত্তিম সৌন্দর্য দেখবেন না। আপনি যখন কলাতলী বা সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে যাত্রা করবেন ইনানী অভিমুখে তখন আপনার দুইপাশে থাকবে পাহাড় নয়তো সমুদ্র। বাম পাশে কখনও সবুজ পাহাড়, সফেন ঝর্না, আর ডানপাশে নীল সমূদ্র। আর পুরোটা পথই এই দুটো জিনিষ আপনার সঙ্গী হয়েই থাকবে। যারা পাহাড়কে ভালোবাসে তারা এর অকৃত্তিম রূপে মুগ্ধ হবে। যারা সমুদ্র ভালবাসে তারা কাছ থেকে এর আঁকবাঁক, তটভুমিতে আছড়ে পড়া ঢেউ, ঝাউবন দেখে মোহিত হবে।
মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে যেতে যেতে বিস্তৃত সাগরের সব সৌন্দর্য এবং জেলেদের সাগরে মাছ ধরার দৃশ্য উপভোগ করা যায় । সেই সাথে সমুদ্র সৈকতে দেখা মিলবে টেকনাফ গর্জন ফরেস্ট খ্যাত চির হরিৎ বন । চলতি পথে আরো দেখতে পাবেন রেজু খাল আর সমুদ্রের মিলন স্থলের এক পাশে সারি সারি সুপারি গাছ, অন্য পাশে ঝাউ বন । দুই পাশে আছে শ্বাস মূলীয় বন । এখান থেকে বেশি দূরে নয় ইনানী সমুদ্র সৈকত । ভাটার সময় ইনানীর সৈকতে জেগে ওঠা মৃত প্রবালের মাঝে সময় ভালোই কাটবে । ইনানী থেকে সামান্য সামনে জালিয়াপালং ধরে এগিয়ে গেলে দেখা পাবেন পাহাড় কোলের নির্জন মেরিন ড্রাইভ । সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন ছাড়া এখানে আর কোনো শব্দ পাওয়া বিরল । তবে এখানকার সমুদ্রে চিংড়িপোনা সংগ্রহে ব্যস্ত মানুষের দেখা মিলবে।
পৃথিবীর আর কোন দেশে এতো দীর্ঘ কোন মেরিন ড্রাইভ নেই এটা সর্বজনস্বীকৃত। আর সেই সাথে এতো দীর্ঘ সময় ধরে বর্নালী সৌন্দর্য উপভোগ সেটাও কোথাও পাবেন না।
২০১৬ সালে এই রাস্তার অনেক স্থান সেনাবাহিনী অধিগ্রহন করে নেয় এবং এটির উন্নয়ন করতে শুরু করে। ২০১৭ সালের ৬ মে এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। তাই উদ্বোধনের পরই পর্যটকদের সুবিধার জন্য কক্সবাজার থেকে সাগরঘেঁষে টেকনাফমুখী
তবে আপনি যদি অল্প সময় নিয়ে কক্সবাজার আসেন তবে টেকনাফ যাবার দরকার নেই কারন যাওয়া আসাতেই আপনার দশ ঘন্টা চলে যাবে। পর্যটকদের মূল আগ্রহ কক্সবাজার, হিমছড়ি এবং ইনানী বিচ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আপনারও এই পর্যন্ত ভ্রমন সীমাবদ্ধ রাখা দরকার, আর বিশেষ করে যদি পরিবার নিয়ে আসেন তবে টেকনাফ পর্যন্ত যাওয়ার একেবারে দরকার নেই।
আমার মনে হয় মেরিন ড্রাইভ সড়কে প্রকৃতি নিজের হাতে সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। এখানকার মেরিন ড্রাইভ সড়কে বিশেষ বাস সেবা চালুর নির্দেশনা দেয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তারই ধারাবাহিকতায় এবার থাইল্যান্ডের অনুভূতি দিতে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে চালু হচ্ছে ট্যুরিস্ট ক্যারাভ্যান। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এটি চলাচল করবে কলাতলী থেকে টেকনাফ জিরো পয়েন্ট হয়ে আবার কলাতলী পর্যন্ত। ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২,০০০ টাকা জনপ্রতি। সঙ্গে থাকবে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, বিকেলের স্ন্যাক্স, এন্ট্রি টিকিট ও সাইটসিন দেখার সুযোগ।ভাড়া একটু বেশি মনে হলেও এতে ওয়াইফাই, লাইব্রেরি, ওয়াশরুমও থাকবে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে যাত্রা শুরু করবে এ ক্যারাভ্যান। ফলে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়ক অনায়াসেই ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা। যদিও এর আগে অন্যান্য কোম্পানি মেরিন ড্রাইভে তাদের বাস সেবা চালু করেছে।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত এতদিন সত্যি অবহেলিত ছিল। কক্সবাজারে অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন ছিল না তেমনি ছিল না ভালমানের যোগাযোগ ব্যবস্থাও। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার রাস্তার যে বেহাল দশা ছিল, সেটা চিন্তা করলেই ভ্রমণের আনন্দ অনেকটা ম্লান হয়ে যেত ভ্রমণপিপাসুদের। বর্তমান সরকারের ঐকান্তিকতায় একদিকে সবুজঘেরা পাহাড়, অন্যদিকে সমুদ্রের ঢেউ পর্যটকদের জন্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সমুদ্রের তীর আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ নিঃসন্দেহে পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। মেরিন ড্রাইভ সড়ক এখন শুধু কক্সবাজার বা গোটা দেশের নয়, বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় ও নান্দনিক একটি সড়কে পরিণত হয়েছে। পুরো দেশের পর্যটনের বিকাশের ক্ষেত্রে এই সড়ক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।