অকৃত্রিম হিমালয়,হিমবন্ত হিমালয়,দেবভূমি হিমালয়। দিগন্তপ্রসারী হিমাদ্রি তার সহস্র তুষারধবল শৃঙ্গরাশি নিয়ে উচ্চশিরে দণ্ডায়মান।ধ্যানমগ্ন এক তপস্বী -যুগ যুগ ধরে মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কখনো তার ভয়াল ভয়ার্ত রূপ কেড়ে নেয় অসংখ্য প্রাণ,আবার কখনও সেই অভ্রভেদী চূড়াই মানুষকে বাঁধে প্রাণের সুরে।এবারের পূজায় আকাশচুম্বী অট্টালিকার দৃষ্টিনন্দন থেকে দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে আমাদের যাত্রা মর্ত্যের সেই স্বর্গধামে।দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের এক অন্যতম অদ্বিতীয়ম কেদারনাথে।প্রকৃতির ক্রুদ্ধ অভিশাপে ২০১৩ সালে যেখানে হঠাৎই নেমে এসেছিল জলের তোড়,মৃত্যু মিছিলে পরিণত হয়েছিল পুন্য তীর্থভূমি ;ধীরে ধীরে দুঃখ দূরে সরিয়ে আজ আবার তা মাটির স্বর্গ হয়ে চোখ মিলেছে এক অনন্ত নন্দনের বুকে।
কেদারনাথে যেতে গেলে প্রথমে পৌঁছাতে হবে হরিদ্বার। হাওড়া থেকে প্রতিদিন হরিদ্বার যায় দুন এক্সপ্রেস। এছাড়াও প্রতি মঙ্গল আর শুক্রবার ছাড়ে হাওড়া দেরাদুন উপাসনা এক্সপ্রেস।এবং মঙ্গল ও শুক্র ছাড়া বাকি দিনগুলো চলে হাওড়া হরিদ্বার কুম্ভা এক্সপ্রেস।অথবা রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে বা বিমানে দিল্লি গিয়ে সেখান থেকে জনশতাব্দীতে চেপে বা গাড়ি ভাড়া নিয়ে পৌঁছানো যায় হরিদ্বার।সেদিনটা হরিদ্বারের 'হর কি পৌড়ি' ঘাট দর্শন করে বিশ্রাম নেওয়াই শ্রেয়। পরেরদিন প্রভাতে সীতাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। কিলোমিটার হিসেবে যেতে ৮_৮.৩০ঘন্টা লাগার কথা হলেও রুদ্রপ্রয়াগের পর কেদারের দিকে যাওয়ার রাস্তা সরকার থেকে নির্মাণ করার জন্য এবং মাঝে মাঝেই ধ্বস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তার গতি বেগতিক হলে তা ১২ থেকে ১৫ ঘন্টাও লাগতে পারে।সীতাপুর ছাড়াও উত্তরকাশী,শোনপ্রয়াগ থেকেও কেদারনাথ যাত্রা শুরু করা যায়।তবে কেউ যদি হেলিকপ্টারে কেদার দর্শনে যাবেন ঠিক করেন তারা অবশ্যই সীতাপুরে থাকতে পারেন কারণ ফাটা সেরসি সহ আরেকটি হেলিপ্যাড তিনটি সীতাপুর থেকে প্রায় সমদূরত্বে।
দিগন্তের নীলাভরণ প্রকৃতি আর মহাদেবের ধ্যানমগ্ন সৌন্দর্যের নিকেতন কেদারে এটা তৃতীয়বার যাত্রা।যতবারই আসি বারবার ফিরে আসার ইচ্ছা জাগে মনের কোণে।সীতাপুরে সেদিনের রাত্রি অতিবাহিত করে প্রকৃতির রূপ আস্বাদনে হাঁটাপথে আমাদের কেদার যাত্রা শুরু হলো।
সীতাপুর থেকে এক কিলোমিটার শোনপ্রয়াগ। বাস বা প্রাইভেট গাড়ির দু'ই যায়-ব্যবস্থা রয়েছে সরকারি পার্কিংয়ের। আগে গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত গাড়ি গেলেও ২০১৩-র বিধ্বংসীকতার পর তা বন্ধ হয়ে এখন শোনপ্রয়াগ পর্যন্ত যাওয়া যায়। শোনপ্রয়াগেই রয়েছে বায়োমেট্রিক পারমিশনের শেষ জায়গা।এছাড়া হরিদ্বার হৃষীকেশ থেকেও পারমিট পাওয়া যায়।শোনপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুণ্ড ৫.৫/৬ কিলোমিটার।২০১৬ থেকে গৌরীকুণ্ডের হাফ্ কিলোমিটার আগে পর্যন্ত চলে লোকাল জিপ।গৌরিকুন্ড এর ৫০০ থেকে ৫৫০ মিটার যাওয়ার পর রয়েছে উত্তরাখণ্ড সরকারের কাউন্টার,যেখানে ঘোড়া,ডুলি,পালকির ব্যবস্থা রয়েছে।ঘোড়ার খরচ ২৫০০/ টাকা একপিঠ। ডুলি ৪০০০/ টাকা একপিঠ।আর যারা হেলিপ্যাডে যাবেন তাদের পড়বে ৪৭৫০/ টাকা উভয় পিঠ।প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মানি রিসিট(স্লিপ) দেওয়া হয়।
পৌরাণিক কাল থেকে কেদারনাথের উল্লেখ বিভিন্ন জায়গায়। কখনো মহাভারতে আবার কখনো দেবাদিদেব মহাদেব আর পার্বতীর বিবাহ প্রসঙ্গে-ভ্রাতৃহত্যার পাপস্খলনে পাণ্ডবরা এসেছিলেন কেদারধামে,আবার শোনপ্রয়াগ থেকে ৭-৭.৫ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন মন্দির 'ত্রিযুগীনারায়নে'স্বয়ং নারায়ন কে সাক্ষী রেখে শিব পার্বতীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল।সেখানে রয়েছে একটি জ্বলন্ত ছোট্ট অগ্নিকুণ্ড 'অক্ষয়ধুনী'-অনন্ত কাল ধরে একইভাবে প্রজ্বলিত তার শিখা।
গৌরীকুণ্ড থেকেই কেদারের আঁকাবাঁকা চড়াইপথের শুরু।এর ডান দিকে কুলুকুলু শব্দে প্রবাহিত মন্দাকিনীর জলধারা।২০১৩ -র ধ্বংসলীলার পর গৌরীকুণ্ড প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এখানে থাকা উষ্ণপ্রস্রবণটি আজও প্রসারিত হয়ে মন্দাকিনী তে গিয়ে মিশেছে।ধ্বংসলীলা পারেনি তার গতিপথ রুদ্ধ করতে।২০১৩-র আগে গৌরীকুণ্ড থেকে কেদার ১৪ কিলোমিটার রাস্তা ছিল,সরকারি হিসাবে এখন তা পরিবর্তিত হয়ে প্রায় ১৭-১৮ কিলোমিটার।ঘোড়া সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার ব্যবধানে গিয়ে পৌঁছায় কেদারে।সাধারণ মানুষের হেঁটে যেতে প্রায় লাগে ৬ সাড়ে ৬ ঘন্টা।
চড়াই রাস্তায় মন্দাকিনী কে ডান পাশে নিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর আসে চিরবাসা ভিউ পয়েন্ট।এখানে একটি হেলিপ্যাড ও আছে তবে তা সাধারণের জন্য ব্যবহৃত হয় না।এই হেলিপ্যাডের উপর দাঁড়ালে প্রকৃতির রূপ লাবণ্যে বিস্মিত হতে হয়।কখনো পাহাড়
ছাপিয়ে কালো কাজল মাখা আকাশ,কখনো শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গরাশির মনোহরণ রূপ।এখান থেকেই প্রথমবারের জন্য কেদার মন্দিরের পশ্চাতের বরফাবৃত শৃঙ্গের দেখা মেলে।চড়াই পথে শীতল হাওয়ায় মেঘবালিকাকে সঙ্গী করে আরো কিছুদূর যাওয়ার পর বা'হাতে পড়ে চোখ জুড়ানো মিঠাপানি ওয়াটারফল্স।জলাধারে জল মাটির অর্ধেক ভিজা অর্ধেক শুষ্ক রাখলেও দুষ্টু মিষ্টু ঘোড়ার দলের জলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে নিজেদের আর দর্শনার্থীদের ভিজানোর মজাদার দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়।সারথির তাদের আয়ত্তে আনার শতচেষ্টা বিফলে যায়।
আরো কিছুটা যাওয়ার পর গৌরীকুণ্ড আর কেদারের প্রায় মাঝ বরাবর ভীমবালি।সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে হাজার হাজার দর্শনার্থী অক্ষয় তৃতীয়ার পূজার দিন থেকে কালীপুজোর দিন পর্যন্ত মহাদেবের প্রার্থনায় শংকরের নাম নিয়ে এগিয়ে চলেন এই পথে।এখানে তাই সরকারি চেকপোস্টের সাথে বিশ্রাম নেওয়ার চা-নাস্তার বেশকিছু দোকান রয়েছে।ধ্বংসলীলার পর এই
ভীমবালির পর থেকেই রাস্তা পরিবর্তিত হয়ে গেছে।পুরানো পথ চলে গেছে রামবারার দিকে,যেখান থেকে কিছুটা যাওয়ার পর স্বামী রামানন্দ সন্ত আশ্রম,কিছু ধর্মশালা রয়েছে।তবে প্রকৃতির তাণ্ডবে রুদ্ধ হয়েছে যাত্রাপথ আজ রামবারার সাথে কেদারের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
আমরা এগিয়ে চললাম নতুন পথ ধরে।ভীমবালির এক কিলোমিটার পর রাস্তা ভাগ হয়ে গেল। মন্দাকিনী নদীর ওপর নির্মিত নতুন মেটালব্রিজ অতিক্রম করতেই মন্দাকিনী চলে এলো আমাদের বামদিকে।বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়ল উত্তরাখন্ড সরকারের নির্মিত রাত্রিযাপনের কটেজ।সাথে লিনচোলি হেলিপ্যাড,লিনচোলী ভিউ পয়েন্ট।সেখান থেকে মন্দিরের পশ্চাতের পর্বত শৃঙ্গ অনেক স্পষ্ট ও বৃহৎ দেখায়।আরো ৩-৪কিলোমিটার হাঁটার পর কেদারনাথ হেলিপ্যাড।মূলত যারা সীতাপুর থেকে হেলিকপ্টারে আসেন তারা এখানে এসে নামেন।তার থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে সরকারি তরফে অস্থায়ী হাসপাতাল।সেখান থেকে ৭০০-৮০০ মিটার দূরত্বে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে কেদারনাথ মন্দির।
অপূর্ব নৈসর্গিক শোভার মাঝে প্রস্তর নির্মিত সুশোভন কেদারনাথের মন্দির,যা যাত্রাপথের সমস্ত ক্লান্তি নিমেষেই মুছিয়ে দেয়।প্রশান্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে মন্দিরময়।মন্দিরপ্রাঙ্গণে বিরাজমান নন্দীদেব,বেশকিছু ত্রিশূল মন্দিরের চারপাশে।ধ্যানে নিমগ্ন সাধুসন্তের দল।পাশেই পুণ্যার্থীদের সারিবদ্ধ লাইন।তাদের কারও হাতে পূজার ডালি কেউবা মনস্কামনা পূরণে করজোড়ে দাড়িয়ে।প্রবেশ করলাম মন্দিরের ভিতর।প্রস্তরখন্ড রূপে পূজিত মহাদেবেকে স্পর্শ করে জীবনের সব গ্লানি যেন দূর হয়ে গেল।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পান্ডবদের ধরা দেবেন না বলেই তিনি মহিষ রূপ ধারণ করেছিলেন।সেই মহিষের পশ্চাৎভাগ এখানে মহাদেব রূপে পূজিত।মন্দিরের পশ্চাতে সজ্জিত ও পূজিত বিশালাকৃতির ভীমশিলা,যার জন্য ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল এই মন্দিরপ্রাঙ্গণ।মন্দির চত্বরে বেশকিছু বসার জায়গা,কেদার মন্দিরকে সামনে রেখে বাঁদিকে তাকালে মন্দাকিনী নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিস্থাপিত 'মেডিটেশন ক্যাম্প' যা লোকমুখে 'মোদি গুহা' নামেও পরিচিত।
মন্দির চত্বরে বসে প্রাণভরে দেখলাম প্রকৃতিকে।নবারুণ আলোর নীলাকাশের প্রেক্ষাপটে একটু একটু করে অবগুণ্ঠন সরিয়ে উন্মোচিত তুষারগিরি।পড়ন্ত রোদের কিরণছটায় তার মহিমাদীপ্ত উপস্থিতি।সান্ধ্যকালীন ইলেকট্রিকের আলোয় প্রজ্বলিত মন্দিরপ্রাঙ্গণ।সন্ধ্যারতি শেষে কেদারের ধর্মশালায় রাত্রিযাপন।(বলে রাখা ভালো পারদ যত নিচে নামে অক্সিজেনের কিছুটা অভাব বোধ হয়)ভোরের প্রস্ফুটিত আলোয় কেদারজীকে প্রণাম জানিয়ে ফিরে আসার পালা. ......
''কতভাবে বিরাজিছ বিশ্বমাঝারে,মত্ত এ চিত তবু তর্ক বিচারে''
চিত্র সৌজন্যঃ পৃথ্বীশ ভদ্র।
অভিভুত
ReplyDhanyobad
Replyকেদারনাথ অসাধারণ একটা জায়গা। শুধু যে ধর্মীয় তা নয়, পাশাপাশি নিরেট সৌন্দর্য। তোমার ভ্রমন কাহিনী সত্যি অনেক গুছিয়ে রোমান্টিকভাবে লেখা। সেই জন্যই একে ভ্রমন রোমান্স বলছি।
ReplyDanyobad dada
ReplyDarun hoiche 👌😊❤️💚
ReplyDhanyobad
ReplyDarun laglo..ashadharon .
ReplyAsankhyo dhanyobad ❤
Replyআমি কোনদিন যাইনি কেদারনাথ, কেবল শুনেছি আর ভিডিও দেখেছি। হঠাৎ রূপালী পাতা চোখের সামনে আসলো আর আপনার লেখা পড়লাম। ভ্রমন কাহিনীর পাশাপাশি মনে হলো কবিতাও পড়ছি। বেশ সুন্দর আপনার লেখা। ধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyAsankhyo dhanyobad porar janyo....parle ghure asben...sudhu mondir noy prakitir ek anyo jogot kedarnath....amay bodhay tai barbar tane...
Reply