বান্দরবান মূল শহর থেকে রোয়াংছড়ির বাস ছাড়ে সকাল আটটায়। এর আগের দিন বান্দরবানে এসে পৌঁছেছি বেলা বারটার দিকে- আমি, সালমান ভাই, অয়ন আর পান্থ। আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে সতের তারিখ। আঠার তারিখ দুপুরে অয়ন যখন টেক্সট করলো, "ভাই, বান্দরবান চলেন কালকে, সালমান ভাই যাবেন। আপনিও চলেন।"
আমি তখন নিউমার্কেটে। বললাম, "বিকেলে বাসায় গিয়ে জানাচ্ছি।"
বিকেলে জানাবো বললেও আমাদের ট্যুর প্ল্যান ফাইনাল হলো সেদিন রাত ন'টার পরে। আমার হাতে জমানো কিছু টাকা ছিলো, বান্দরবানের জন্য ওটাই আমার একমাত্র সম্বল।
ঊনিশ তারিখ দুপুর বারটায় বান্দরবান পৌঁছে যে ব্যাপারটা আমাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো সেটা- রাতে থাকবো কোথায়?
বাস স্টপেজের সামনে বান্দরবান শহরের সবচেয়ে বড় যে হোটেলটা- হিলভিউ, ওটাতে আগামী হপ্তাখানেকের মধ্যেও কোন রুম ফাঁকা পাওয়া যাবে না।
ডিসেম্বরের ধূসর আকাশের নিচে ভর দুপুরে চারজন ছেলে কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে হাঁটছে আর ড্যাবড্যাব করে চাঁদের গাড়ির ড্রাইভারদের সাথে ট্যুরিস্টদের দর কষাকষি দেখছে।
শেষমেশ থাকার ব্যবস্থা হলো। হোটেলের নাম হিলবার্ড। তিন তলায় ডাবল বেডের পাশাপাশি দু'টো রুম পাওয়া গেল। প্রতি রুমের ভাড়া চারশ পঞ্চাশ টাকা করে।
হোটেল রুমে কোন টিভি নেই, অ্যাটাচড বাথরুম নেই। বাথরুম যা একটা আছে ওটা ফ্লোরের একপ্রান্তে। বাথরুম বা ওয়াশরুম না বলে এক্ষেত্রে পাবলিক টয়লেট টার্মটা ইউজ করা বেশি যুক্তিযুক্ত। পানির ট্যাপের কোন হাতল নেই। যেগুলো আছে সেগুলো কিছু মরচে পড়া স্ক্রু। বেসিনের ওপর আধখাওয়া সিগারেটের একগাদা ছাই ফেলে রাখা।
হোটেল রুমের প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া সাদা চাদর আর বালিশের কভার দেখে এক মুহূর্তের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। এটুকু পেয়েই আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, "থাকার জায়গাটা অন্তত পাওয়া গেলো। রাতে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে পথে পথে ঘুরতে হবে না অন্তত।"
হোটেলে ব্যাগপত্র নামিয়ে রেখেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে যাবো স্বর্ণমন্দির; বুদ্ধ ধাতু জাদি ক্যাং।
একটা মাহিন্দ্রা ভাড়া করা হলো। শহর পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ছুটে চললো মাহিন্দ্রা।
অয়ন সাথে করে তার উকুলেলেটাও নিয়ে এসেছে। কিনে রাখা চিপস আর কেক চিবোতে চিবোতেই
অয়ন আর পান্থ উকুলেলের টুংটাং এর সাথে গলা মেলালো। মাহিন্দ্রা যেখানে এসে থামলো সেখান থেকে পিচঢালা পাহাড়ি পথ বেয়ে আরো কিছুদূর গিয়ে মন্দিরের সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে হয়। কিছুদূর ওঠার পর জুতা রাখার নিদৃষ্ট জায়গা আছে। নয় কী দশ বছরের একটা ছেলে গম্ভীর মুখে সেখানে বসে। প্রতি জোড়া জুতা রাখতে তার কাছে পাঁচ টাকা করে দেওয়া লাগে। ছেলেটার পাশে একটা সাইন বোর্ড, তাতে লেখা : মন্দিরে হাফ প্যান্ট বা থ্রি কোয়ার্টার পরে যাওয়া নিষেধ।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে যত ওপরে উঠি বান্দরবানের স্বর্ণমন্দির আমাদের চোখের সামনে নিজেকে তত প্রকাশ করতে থাকে। আমরা অবাক হয়ে দেখি- কী তীব্র সেই সোনা রঙ!
সিঁড়ির শেষে মোজাইক করা বাঁধানো মেঝে। মূল মন্দিরের চারপাশে চক্রাকারে সাজানো পাথরের বেদিগুলোর ওপর মঙ্গল, বৃহষ্পতি কিংবা শনিদেবের মূর্তি। মূষিক আর গরুড় মূর্তি। মন্দিরের দেয়ালে তৈরি করা হয়েছে ছোট- বড় কুঠুরির মতো জায়গা যেখানে রাখা আছে সোনালী রঙের বেশ কয়েকটি মূর্তি। বোধ করি সেগুলো বুদ্ধেরই হবে। এ ব্যাপারে জ্ঞান স্বল্পতার কারণে মূর্তি বিষয়ক আলোচনা নাহয় তোলা থাকুক।
দু' হাজার সালে বার্মার স্থাপত্যবিদদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত মন্দিরটির পেছনের দিকে রয়েছে বড় একটি ধাতব ঘণ্টা। ঘণ্টার ফ্রেমের ওপর চারপায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে একটা ড্রাগন। মন্দিরের উঠোনে আরো আছে পৌরাণিক সিংহের মূর্তি।
মূল মন্দিরের ভেতর সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। শুধু যারা পূজা- অর্চনার কাজে এসেছে তারাই প্রবেশ করতে পারে। তবে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মন্দিরের ভেতরের অংশটা দেখা যায়।
মন্দিরের ভেতরে প্রায় অন্ধকার। আলো অন্ধকারের লুকোচুরি যেন কেমন একটা ইন্দ্রজাল তৈরি করেছে। সেই ইন্দ্রজালের মাঝে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তিটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
"সালমান ভাই, কী পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে বুদ্ধের মূর্তি বানানো হয়েছে, দেখলেন!", আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
মন্দিরের দরজায় কিছু বয়স্কমতো লোক জটলা পাকিয়েছে। মন্দিরে কেন ঢুকতে দেওয়া হবে না, কেন তাদেরকে পঞ্চাশ টাকার টিকেট কেটে এখানে আসতে হলো- এই নিয়ে তারা মোটামুটি বিদ্রোহ ঘোষণার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা বৌদ্ধ ভিক্ষু অসহায়ভাবে মুখস্থ বুলির মতো আওড়ে যাচ্ছেন, "দেখুন... এটা একটা উপাসনালয়, একটু বুঝুন। সবাই ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন না।"
দরজায় দাঁড়ানো প্রতিবাদী বুড়ো মানুষের দল একটু একটু করে ভারী হচ্ছে আর চেঁচামেচি বেড়ে চলেছে। তাদের কেউ কেউ আবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলছে, "মন্দিরেই যদি ঢুকতে না পারি, তাহলে টিকেট কেটে দেখতে আসার কোন মানে হয় না। টাকা ফেরত দেন।"
এত শোরগোল আর চেঁচামেচির মাঝেই আমরা তন্ময় হয়ে বুদ্ধকে দেখি- আহা, কী সুন্দর! আহা, কী অপূর্ব!
বান্দরবান মূল শহরে ফিরে 'কলাপাতা' রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। বেলা পড়ে এসেছে প্রায়। তবুও রেস্টুরেন্টে প্রচণ্ড ভীড়। আমাদের বসবার জায়গা হলো না। অগত্যা রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একজন ওয়েটার এসে চারটা চেয়ার দিয়ে গেলো বসবার জন্য।
আমাদের পাশেই এক দম্পতি দাঁড়িয়ে। স্বামী স্ত্রী ম্যাচিং করে একই ডিজাইনের হুডি পরেছেন। আর বাবার আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে আছে বছর চারেকের একটা মেয়ে। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখছে মানুষের ব্যস্ততা, মানুষের ছুটোছুটি। অয়ন আর সালমান ভাই তাদের দিকে তিনটে চেয়ার এগিয়ে দিলেন, "ভাইয়া, আপনারা বসেন।"
বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের খাবারের ব্যবস্থা হলো। অর্ডার দিলাম- ভাত, ডাল, আলুভর্তা আর মুরগির মাংসের। খাওয়ার সময় জানালার ওপাশে সেই দম্পতিকে আবার দেখতে পেলাম। স্ত্রী স্বামীর চুল ধরে টানাটানি করছেন আর স্বামী ব্যথা পাওয়ার মিথ্যা অভিনয় করছেন। বাবা- মা'র অনর্থক ভাঁড়ামি দেখে ছোট মেয়েটা হি হি করে হাসছে। বাচ্চাটার হাসি দেখে আমারও হাসি পেলো। হাসি বড় সংক্রামক। অকারণেই হাসি সংক্রমিত হয়। আমি ঠোঁট টিপে টিপে হাসছি। তাঁরা এখন জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলোর একটা পার করছেন কীনা!
আমাদের বিকেলটা কাটলো নীলাচলে।
নীলাচল, বাংলাদেশের দার্জিলিং। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ছ' কিলোমিটার দূরে টাইগার পাড়ার পাহাড়চূড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্র। যেখান থেকে মেঘ ছোঁয়া যায়। অবাক মেঘের বাড়ি- কথাটা নীলাচলের জন্য কোনরকম সন্দেহ ছাড়াই প্রযোজ্য।
পাহাড়চূড়ার অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটা অংশে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদ ছুঁয়ে
যাচ্ছে আমাদেরকে।
পাহাড়চূড়া থেকে যতদূর চোখ যায় জমাট বাঁধা কুয়াশা আর পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। এর মাঝেই আবছা দেখা যায় পাহাড়, বান্দরবান শহর। এরপর বোধ করি সমুদ্র... দৃষ্টি অতটা পৌঁছায় না।পাহাড়ের সবুজ আর আকাশের নীল ছুঁয়ে ভেসে থাকা সাদা মেঘ, জমাট বাঁধা ধূসর কুয়াশা কী এক অদ্ভুত মোহ সৃষ্টি করে!
সালমান ভাই নীলাচল আগে একবার এসেছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই একটা স্টাডি ট্যুরের সময়। উনি বললেন, "এখানেই থাকবা? আরো জায়গা আছে তো দেখার।"
আমি, অয়ন আর পান্থ সালমান ভাইয়ের পিছু পিছু হাঁটি। পথের মাঝে একটা ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারের সিঁড়ি ধরে একগাদা আণ্ডাবাচ্চা ঝোলাঝুলি করছে। অতএব, ওয়াচ টাওয়ারে ওঠার ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখতে হলো।
নীলাচলে যে পার্কের মতো জায়গাটা আছে ওখানে বড় বড় দু'টো স্লাইড। ছেলে- বুড়ো সবাই বিপুল উৎসাহে স্লাইড বেয়ে নামছে আর হাত- পা ছুঁড়ে বাচ্চাদের মতো হাসছে। বছর পঞ্চাশেকের কাঁচাপাকা চুলের এক ভদ্রলোককে দেখলাম স্লাইডিং করতে গিয়ে নিচে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। আমরা ভাবলাম, উনি ব্যথা পেলেন কীনা। তারপর দেখি, উনি দু'পা ছড়িয়ে উঠে বসে হো হো করে হাসছেন।
বুড়ো বয়সে ছোট হয়ে যাওয়ার আনন্দ বোধহয় সবচেয়ে বেশি। যে আনন্দে কোন ফাঁক থাকে না, যে আনন্দ নির্ভেজাল হাসির মতোই ভীষণ সংক্রামক, নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে অন্যদের মাঝেও।
সেদিন আমরা সূর্যাস্ত দেখলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ষোলশ' ফুট উঁচুতে, রেস্ট হাউজের রেলিং- এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। সোনালী- হলুদ সূর্যটা একদম পশ্চিমে পাহাড় আর কুয়াশা ছুঁয়ে অস্ত যাচ্ছে। দেখতে দেখতে হলুদ সূর্যটার রঙ হয়ে গেলো কমলা, এরপর আরো কমলা... তারপর টকটকে লাল। পশ্চিম আকাশে লাল আলো ছড়াতে ছড়াতে সূর্যটা যেন পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ছে। ঘুমে যেন দু' চোখ লেগে আসছে সারাদিনের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত সূর্যটার। এরপর ঘুম, ঘুম, ঘুম। পাহাড়ের ওপাশে সূর্য হারিয়ে গেলো। আর আমি দেখলাম জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সূর্যাস্তগুলোর একটা।
সন্ধ্যায় হোটেলের সামনে যখন মাহিন্দ্রা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করছি, এমন সময় একজন পুলিশ অফিসার এসে মাহিন্দ্রা চালককে আটকালেন।
সাদ পোশাকের পুলিশ অফিসার। বিকেলে স্ত্রী- কে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন।
প্রথমদিকে আমরা অতটা খেয়াল করি নি। একসময় দেখি, ভদ্রলোক চেঁচামেচি শুরু করেছেন। ড্রাইভারকে বললেন তার লাইসেন্স দেখাতে। লোকটা ভীত চেহারা নিয়ে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে পুলিশ অফিসারের হাতে দিলো।
অফিসার সাহেব মাহিন্দ্রা চালককে কান ধরে উঠবস করাচ্ছেন; আমরা এগিয়ে গেলাম,
"আঙ্কেল, কী হইসে?"
এরপর অফিসার যা বললেন তার সারসংক্ষেপ মোটামুটি এরকম-
অন্ধকারে ছিলেন বলে আপনারা বোঝেন নি কিন্তু আমরা দেখেছি। খাঁদের পাশ দিয়ে বাঁক ঘুরবার সময় একটা বাস আপনাদের ঠিক গা ঘেষে চলে গিয়েছে। বাসের লুকিং গ্লাস ছিলো আপনাদের মাহিন্দ্রার ওপর। বাঁক ঘুরবার সময় আপনাদের মাহিন্দ্রার ড্রাইভার কোন সিগনালই দেয় নি। হর্ন দেয় নি। সে কোন সিগনাল না দিয়েই টার্ন নিতে চেয়েছিলো। আরেকটু হলেই আপনারা এখন খাঁদে পড়ে থাকতেন।
আমরা থমথমে মুখে নিজেদের রুমে ফিরে আসলাম। পান্থ বারবার বলছে, "আরেকটু হলে মরে যেতাম ভাই! এটা কিছু হলো?"
এরপরও অয়নদের রুমে আমরা তাস বের করে বসলাম। সালমান ভাই এ ব্যাপারে একদম আনাড়ি। তাঁকে পান্থ সময় নিয়ে কল ব্রিজ শেখালো। প্রথম খেলায় দান জিতে সালমান ভাইয়ের সে কী হাসি! কিছুক্ষণ আগে মনের মধ্যে জমে ওঠা ভয় ভয় মেঘ কেটে গেলো। আমরা তাসের কার্ডে মন দিলাম।
রাত সাড়ে আটটার দিকে আমরা রাতের খাবারের জন্য বেরোলাম। বাসস্ট্যান্ড ফেলে কিছুদূর সামনে এগোলেই বাজার। সাঙ্গুর তীরে একটা হোটেলে খাওয়া- দাওয়া হলো : সাদাভাত, মুরগি, সবজি, টাকি মাছের ভর্তা, শিম ভর্তা আর ডাল। আমাদের পেটে তখন রাজ্যের ক্ষুধা।
পৃথিবীর সকল শহর যেন রাতের জন্যই তৈরি। এত রঙের আলো, এত ব্যস্ততা শহরগুলোকে অপার্থিব করে তোলে। বাজারের পরই সাঙ্গু ব্রিজ। ব্রিজের ওপাশে বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট।
সাঙ্গু ব্রিজের নিচে টিন আর কাঠের ছোট ছোট খুপড়ি মতো ঘর। খুব সম্ভবত বস্তির বিকল্প কিছু একটা। এই ট্যুরে শুরু থেকেই অয়ন বলে চলেছে, "ভাই, বান্দরবান আসলাম কিন্তু বান্দর তো দেখি না কোথাও।"
অয়নের ইচ্ছা পূরণ হলো। আমরা হোটেল থেকে খেয়ে বেরিয়েছি এমন সময় ওই খুপড়ি বাসাগুলোর একটা থেকে একটা বানর ছুটে বেরিয়ে এলো। পোষা বানর। বানরটার পেছনে হৈহৈ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে এলো বানরের মালিক। ছিপছিপে গড়নের এক কিশোর। তখন ইচ্ছেপূরণের আনন্দে অয়নের হাসি দু' কান ছুঁয়েছে।
সাঙ্গু ব্রিজের ওপর লাল- সবুজ- নীল- হলুদ স্ট্রিট লাইট। আর সাথে জাঁক দিয়ে পড়ছে কুয়াশা। আমরা সাঙ্গু ব্রিজে দাঁড়িয়ে সাঙ্গু নদী দেখি, আলো ঝলমলে বান্দরবান শহর দেখি।
শহরের শহীদ মিনারটা লাল- সবুজ বাতি দিয়ে সাজানো। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর শহীদ মিনারগুলোর একটা। আমরা শহীদ মিনারের বেদির সামনে কুয়াশাভেজা দূর্বাঘাস মাড়িয়ে হাঁটি। হোটেলে ফিরতে হবে। সামনে একটা বড় দিন অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।
খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯, শুক্রবার। পাশের বেডে সালমান ভাই মুখ ভোঁতা করে বসে আছেন৷ ব্যাপারটা হলো, গতরাতে হোটেলের কোন এক রুমে মধ্যবয়স্ক কোন লোক মাতলামি করেছে৷ চেঁচামেচি, অশ্রাব্য গালাগাল করে পুরো হোটেল মাথায় তুলেছে। আর ওদিকে আমি আর পান্থ মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। সালমান ভাই আর অয়ন দু'চোখের পাতা এক করতে পারেন নি কোনভাবেই।
আমি বিছানায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি, ঘুমের রেশ তখনো কাটে নি। এর মাঝেই দেখলাম, সালমান ভাই গোসল সেরে আসলেন। মাথা মুছতে মুছতে বললেন, "বইসা আছো কেন ব্রো? রেডি হইয়া নাও।"
সকাল ছ'টার কিছু পরে হোটেলের রিসিপশনে চাবি জমা দিয়ে চেক আউট কমপ্লিট করে বেরোলাম। পুরু লেদারের জ্যাকেটেও আমার শীত মানছে না। সেলফোনে দেখলাম, টেম্পারেচার নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমি আর অয়ন সালমান ভাই আর পান্থকে পেছনে রেখে এগিয়ে গেলাম। রোয়াংছড়ির বাসের টিকেট কনফার্ম করতে হবে। সাঙ্গুর দু'ধারে ঘন কুয়াশা। আমরা ভোরের সাঙ্গু নদী দেখে আরো একবার অবাক হলাম। পাহাড়ি নদীগুলো এত মায়াময় হয় কেন?
বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি।
পাহাড় কেটে তার মাঝ দিয়ে রাস্তা বানানো। রাস্তার দু'পাশে পাহাড়ের ঢালে বড় বড় গাছগুলো কেমন সবুজ একটা টানেল তৈরি করেছে। কাটা পাহাড়ের শেষে একটা ছোট বাসস্ট্যান্ড। একটা টিনের তৈরি বাস কাউন্টার আর তার সাথে লাগোয়া একটা ছোট চা- সিগারেটের দোকান। সামনে একটুখানি খোলা জায়গা। ওখানেই বাস থামে। চারটা টিকেট কনফার্ম করা হলো।
ছোট্ট বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল ঠিক আটটা বাজে বাস ছাড়লো। আমরা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে রোয়াংছড়ির উদ্দেশ্যে ছুটছি। রাস্তার দু'পাশে কখনো গভীর খাঁদ, কখনো পাহাড়। আকাশে ধূসর মেঘ আর পাহাড়ের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসছে যেন মাঝারি ধরণের কুয়াশা। এর মাঝেই আমাদের বাস ছুটে চলেছে। কখনো খাড়া ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আবার কখনো সোজা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আর আমরা বড় বড় চোখে পাহাড় দেখছি, মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ দেখছি।
রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ড পেরোলেই টেরেক খাল। এই খালের একটা দিক গিয়ে মিশেছে সাঙ্গু নদীতে, আরেকটা দিক মিশেছে দেবতাখুমে।
রোয়াংছড়ি বাজারে আমাদের সাথে আমাদের গাইডের দেখা হলো। গাইডের নাম মং মারমা। হাসিখুশি, আন্তরিক একজন মানুষ। একটা হোটেলে বসে দু'টো ফরমে আমরা আমাদের ব্যাসিক ইনফোগুলো পূরণ করলাম। প্রতিটা ফরমের সাথে একটা করে আইডি কার্ডের ফটোকপি। এগুলোর একটা জমা পড়বে পুলিশ চেকপোস্টে। আরেকটা জমা দিতে হবে কচ্ছপতলী আর্মি ক্যাম্পে।
রোয়াংছড়ি বাজার থেকে একটা মাহিন্দ্রা ঠিক করা হলো। এখানেও সেই পাহাড়ি পথ। আমরা নিজেদের নিঃশ্বাস চেপে চোখ বড় বড় করে মাহিন্দ্রায় বসে আছি। উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ ধরে আমাদের মাহিন্দ্রা ছুটে চলেছে।
দেবতাখুমের একটা গল্প আছে। পৌরাণিক গল্প বলতে পারেন খানিকটা। 'খুম' শব্দের অর্থ জলাশয়। দেবতাখুম বলতে বোঝায় দেবতার জলাশয়। কচ্ছপতলী থেকে টেরেক খালের অববাহিকা ধরে ট্র্যাকিং করতে করতে পৌঁছাবেন শিলাবদ্ধ পাড়ায়। এখানে স্থানীয় মারমা উপজাতির বাস। তাদের নিজস্ব মোড় আছে, নিজেদের স্বকীয় কিছু আচার- ব্যবহার আছে। এই মানুষগুলো মনে করে : দেবতাখুমের কোন তল নেই, খুমের নিচে মাটি নেই। খুমের গভীরে দু'টো 'স্বর্ণ মাছ' বাস করে খুম সৃষ্টির পর থেকেই। মাঝে মাঝে তাদের দেখা যায়। তারা গ্রামবাসীর সৌভাগের প্রতীক, শক্তির প্রতীক, মাছগুলো তাদের মৎস দেবতা।
মানুষগুলো শিকার করে, মাছ ধরে, পাহাড়ের ঢালে কৃষিকাজ করে পুরো জীবনটা কোন রকম ঝুট ঝামেলা ছাড়াই পার করে দেয়।
ওহ.. হ্যাঁ, দেবতাখুমের গভীরতা মোটামুটি ত্রিশ ফুট।
কচ্ছপতলী পৌঁছে আমরা নিজেদের জামা- কাপড় বদলে নিলাম। ভারী জ্যাকেট আর জিন্স বদলে টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার ট্রাউজার। টেম্পারেচার তখন বারো থেকে চৌদ্দ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে।
আর্মি ক্যাম্পে সব ধরণের ব্যাসিক ইনফো আর কাগজপত্র জমা দেওয়া হলো। পুলিশ ফাঁড়িতে কাগজপত্র আগেই জমা দেওয়া হয়েছে। কচ্ছপতলীর একটা আদিবাসী পাড়ার মধ্য দিয়ে কিছুদূর এগিয়েই আবার টেরেক খাল। ওখান থেকেই আমাদের ট্র্যাকিং- এর শুরু।
দু'টো বড় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে টেরেক খাল। পাহাড়ের গায়ে জন্মেছে পত্রঝরা আর চিরহরিৎ বৃক্ষ, বিশালাকৃতির ফার্ন আর পাহাড়ি কলাগাছ। আমরা কিছুক্ষণ খালের পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটছি আবার কিছুক্ষণ পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
একটা জায়গায় এসে পান্থ দাঁড়িয়ে গেলো, "ভাই, এই গাছগুলা দেখেন তো?"
আমি একটু ঝুঁকে এলাম। ফার্নের মতো দেখতে কিছুটা। পপি গাছ। আফিম।
পৌনে দুই ঘণ্টা ট্র্যাকিং- এর পর আমরা এসে পৌঁছলাম শিলাবদ্ধ পাড়ায়। এই সেই আদিবাসী গ্রাম। এটা পেরোলেই খুমের শুরু।
ছোট্ট গ্রামটাকে ঘিরে আছে নারিকেল গাছ। একটা বাঁশের টংঘরে বসে এক বৃদ্ধা গাছের ছায়ায় আয়েশ করে পাইপ টানছেন। দু'জন বাচ্চা আবার পোষা কুকুরের পিঠে ওঠা নিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়েছে। আদিবাসী নারীদের কেউ তাঁত বোনায় ব্যস্ত আবার কেউ রান্না বান্নার কাজে ব্যস্ত। শিলাবদ্ধ পাড়ার শেষ প্রান্তে একটা বাঁশের মাচা। মাচায় বসে দেবতাখুমের পাহাড় দু'টোকে দেখতে দেখতে বোধ করি কয়েকটা বছর ক্লান্তিহীনভাবে অনায়াসে পার করে দেওয়া যায়। কিন্তু এরকম ভয়ানক সৌন্দর্যের কাছে বেশিক্ষণ থাকতে হয় না। আমরা শিলাবদ্ধ পাড়া থেকে নিচে নেমে এলাম।
শিলাবদ্ধ পাড়া থেকে নিচে নেমে আসতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধালাম আমি। আমার অ্যাক্রোফোবিয়া আছে। সহজ বাংলায় যেটাকে বলে 'উচ্চতায় ভয়'। সরু একটা পাথর খোঁদাই করে বানানো লম্বা সিঁড়িটা বেয়ে নিচে নেমে আসতে বেশ কসরত করতে হলো আমাকে। আমার সীমাবদ্ধতা আমি এখানে অকপটে স্বীকার করছি।
নিচে, ভেজা ভেজা বালির ওপর একদল আদিবাসী ছেলে- মেয়ে খেলছে। আমাদের ইচ্ছা হলো, বাচ্চাগুলোর সাথে ছবি তুলবো। মং আঙ্কেল মারমা ভাষায় তাদেরকে ডাকলেন। ওরা আমাদের চারপাশে এসে জড়ো হলো। মং আঙ্কেল 'রে' বলেন আর ওরা খিলখিল করে হেসে ওঠে। আর আমরা ছবি তুলি। পরে মং আঙ্কেলের কাছ থেকে জেনেছিলাম, 'রে' মানে হলো হাসি।
ওখান থেকে দুই- তিন মিনিট হাঁটলেই একটা ঝুপড়ি মতো খাবার দোকান। সাথে ভেলা আর লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থাও তারাই করে। আমরা খাবারের অর্ডার দিলাম। চারজনের জন্য লাইফ জ্যাকেট নিলাম। লাইফ জ্যাকেট পরে মং আঙ্কেলের সাথে হাঁটছি। এখান থেকে আরো কিছুদূর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে যেতে হবে৷ তারপর টেরেক খাল ধরে নৌকায় চড়ে দেবতাখুম।
এই জায়গাটাতে টেরেক খালের পানির রঙ সবুজ আর নীলের মাঝামাঝি। খালের দু'পাশে পাহাড়। পাহাড়ের পাথুরে শরীরে জমে আছে শ্যাওলা। এই জায়গাটাকে খাল না বলে গিরিখাঁদের শুরু বললে বেশি উপযোগী হয়।
এখানেও পাহাড়ের গায়ে জন্মে আছে বিশালাকার ফার্ন আর পাহাড়ি কলাগাছ। এখানে ওখানে পাথুরে মাটি ভেদ করে ওঠা কিছু মাঝারি আকৃতির চিরহরিৎ বৃক্ষ। এর মাঝ দিয়ে চলতে চলতেই আমাদের নৌকা মূল খুমের সামনে একটা পাথুরে জায়গায় এসে ভিড়লো। এখান থেকে ভেলা নিয়ে এগোতে হয়।
আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন সেখানে ভেলার সঙ্কট চলছে। একটা ভেলাও সেই পাথুরে ডাঙ্গায় ভেড়ানো নেই। আমাদের চারজনের পিছু পিছু সেখানে এসে পৌঁছলো ছয়জনের আরো একটা গ্রুপ। দুই জন নারী আর চারজন পুরুষ। পুরুষদের মধ্যে একজন বয়স্ক। লোকটা তার মাথার টাক কাউবয় হ্যাট দিয়ে ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার কেন জানি খুব হাসি পেলো। দেবতাখুমের সাথে কাউবয় হ্যাট বেমানান কিন্তু মাথার টাক বেমানান নয়। নিজের অপূর্ণতাকে স্বীকার করতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু মানুষ কোন এক বিচিত্র কারণে নিজের অপূর্ণতাকে মেনে নিতে চায় না। তার দলের বাকি পাঁচজন যুবক- যুবতী। কিছুক্ষণ পর যখন পাথুরে ডাঙ্গায় একটা- দু'টো ভেলা ভিড়তে শুরু করলো তখন সেই ছয় জন তাড়াহুড়ো করে ছুটে গিয়ে ভেলাগুলো দখল করলো। আমরা হাসলাম।
অবশেষে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পরে আমরা নিজেদের জন্য দু'টো ভেলা পেলাম। সালমান ভাই আর অয়ন উঠলেন একটাতে। আমি আর পান্থ অন্যটায়।
আমাদের চারজনের মধ্যে আমার জন্য এটা ভেলা চালানোর প্রথম অভিজ্ঞতা। আমি একদমই আনাড়ি। অয়ন আর পান্থ ভেলা না চালালেও তাদের কায়াকিং করার অভিজ্ঞতা আছে। আর সালমান ভাই এদিকে বেশ পুরোনো মানুষ। ছোটবেলায় কলাগাছের ভেলা বানিয়ে তাকে সেই ভেলায় চড়ে বর্ষাকালে স্কুলে যেতে হতো কীনা!
ভেলায় আমি বসেছি সামনে আর পান্থ পেছনে। প্রথম দশ পনেরো মিনিট আমাকে দাঁড় বাওয়ার ব্যাসিক শেখাতেই পার হয়ে গেলো। দাঁড় হিসেবে আমাদের হাতে আছে একটা করে চার ফুট লম্বা কাঁচা বাঁশ। ওগুলো দিয়েই খুমের শান্ত নীল পানি কেটে এগিয়ে চলেছি আমরা। আমাদের ওপর দেবতাখুমের দু'পাশের বিশাল পাহাড়দু'টোর ছায়া এসে পড়েছে।
খুমের শুরুর দিকের একটা প্রশস্ত অগভীর অংশে সবসময়ই ভেলার জ্যাম লেগে থাকে। কিছুটা এলাকার মোড়ের বাস স্টপেজের মতো অবস্থা। কেউ ভেলা থামিয়ে ছবি তুলছে। কেউ ফিরতি পথে ভেলা ঘোরাচ্ছে আবার কেউ আমাদের মতো খুমের ভেতরে প্রবেশ করছে।
আমার আর পান্থ- র ভেলা দুইবার অগভীর জায়গায় নিচের পাথরে আটকে গেলো। বেশ ধাক্কাধাক্কি করে, বেশ কায়দা করে ভেলার এই সমস্যা দূর করা হলো।
ভেলা এগিয়ে চলেছে দেবতাখুমের শান্ত নীল পানি কেটে। আমার আর পান্থ'র তখন অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসেছে- সবুজের নেশা, স্বচ্ছ নীল পানির নেশা। আমরা দুইজন ভেলায় বসে হাঁটু অব্দি পা ডুবিয়ে দিয়েছি খুমের বরফশীতল পানিতে। খুমের শেষপ্রান্তে দুই পাহাড়ের মাঝে শেষ বাঁকটা অপার্থিব সুন্দর। এই সৌন্দর্য লিখে বা বলে প্রকাশ করা অসম্ভব। কিছু সৌন্দর্য শুধু দেখেই বোঝা যায়, উপলব্ধি করা যায়। সেইসব সৌন্দর্যকে লিখে বা বলে প্রকাশ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দেন নি।
আমি আর পান্থ সালমান ভাইদের সাথে দেবতাখুমের শেষ বাঁকটার কাছে গিয়ে একসাথে হলাম। দু'টো ভেলা পাশাপাশি রেখে চারজন একসাথে সামনে এগিয়ে যাই আর মুগ্ধ চোখে দেবতাখুম দেখি।
খুমের শেষ প্রান্তে গিয়ে সালমান ভাই পাথরে ভেড়ানো আরেকটা ভেলা নিলেন। আমি আর পান্থ একটা ভেলায় আর অয়ন- সালমান ভাই ভিন্ন দু'টো ভেলায়। আমাদের গাইড মং আঙ্কেল অন্য ভেলা থেকে তাড়া দিচ্ছেন বারবার। আমাদের ফিরতে হবে।
ভেলা থেকে পাথুরে ডাঙ্গায় নামবার পর আমি আর পান্থ বুঝতে পারলাম কী ভুলটা করেছি! ঠাণ্ডা পানিতে দীর্ঘক্ষণ ডুবিয়ে রাখায় আমাদের দুই জনের পা অসাড় হয়ে গিয়েছে। আমি দাঁড়াতেই পারছিলাম না। নৌকায় টেরেক খালের অংশটুকু পেরোবার পর খাবারের দোকানে পৌঁছানোর পথটুকুতেই আমি আবার বিপত্তি বাঁধালাম। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পা আর চলে না। মং আঙ্কেল আমাকে ধরে ধরে পাহাড়ের ঢালটুকু পার করালেন।
খাবারের দোকানটায় পৌঁছে লাকড়ির চুলার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের ভেজা জামাকাপড় শুকোলাম। আগুনের কাছে যাওয়ার পর আমার পায়ের স্নায়ু কাজ করতে শুরু করেছে৷ আমরা হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। খাবারের অর্ডার ছিলো- সাদাভাত, সেদ্ধ ডিম, সবজি, ডাল আর আলুভর্তার। খাবার যখন সার্ভ করা হলো টেবিলে, আমরা চারজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। দেশি মুরগি তো আমাদের অর্ডারে ছিলো না। তখন মং আঙ্কেল মুচকি হাসলেন, "ভাইয়া, এগুলা আপনারা খান। এগুলা আমার পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য ছোট্ট গিফট। আপনারা ভালো মানুষ।"
মানুষটার কথা শুনে আমরা হাসলাম। খেতে বসে আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। মং আঙ্কেলের সালমান ভাইকে খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি হাসছেন আর আবদুল্লাহ সালমান নামের গোলগাল থলথলে মানুষটাকে কিছুক্ষণ পরপর 'ইস্পাত ভাই' বলে ডাকছেন।
আমরা যখন কচ্ছপতলী আর্মি ক্যাম্পে ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা। ডিসেম্বরের বিকেল খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। হঠাৎ করেই বঙ্গদেশে অন্ধকার নামে। ট্র্যাকিং এর কিছু পথ আমাদেরকে মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ক্যাম্পে বসে থাকা মিলিটারি আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, "ফিরে আসার সময় কখন ছিলো আপনাদের?"
মং আঙ্কেল কাচুমাচু মুখে বললেন, "সাড়ে পাঁচটা।"
"পনেরো মিনিট লেইট কেন?"
সালমান ভাই হাসি হাসি মুখে বললেন, "আমরা ঠিকঠাক পাহাড় বাইতে পারি না তো..."
চেকপোস্টে বসে থাকা গোমড়ামুখো আর্মি সদস্য হো হো করে হাসতে শুরু করলেন।
আমাদের ফিরতে হবে। কচ্ছপতলী থেকে বান্দরবান। সেখান থেকে কোন একটা বাস ধরে চট্টগ্রাম। রোয়াংছড়ি থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে শেষ বাসটা অনেক আগেই ছেড়ে গিয়েছে। মং আঙ্কেল আমাদেরকে কচ্ছপতলী থেকে বান্দবান শহর পর্যন্ত একটা মাহিন্দ্রা ঠিক করে দিলেন।
আমরা যখন মাহিন্দ্রায় চড়ে বসবো তখন আমি মং আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করলাম, "আঙ্কেল, তারা'কে মারমা ভাষায় কী বলে?"
"ক্রে।"
আমি এক লাফে মাহিন্দায় উঠে বসলাম।
মাহিন্দ্রা ছেড়ে দিয়েছে৷ মং আঙ্কেল এক আকাশ তারার নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে নেড়ে চোখ মুছছেন, "ভাইয়া, আবার আসবেন পারলে। ভালো থাকবেন খুব।"
কেন জানি না, মাত্র একদিনের পরিচিত মধ্যবয়ষ্ক মানুষটার জন্য আমার চোখের কোণ ভিজে উঠলো। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। এই মনে কোন যুক্তি খাটে না। যুক্তিতে সবকিছু হয় না বোধহয়!
এবার বাড়ি ফিরতে হবে।