হৃদি..............................নাজমুল জুবায়ের

হৃদি..............................নাজমুল জুবায়ের

- আব্বু মানুষ মরে গেলে কি হয়? 
- আকাশের তারা হয়ে যায়। 
- আব্বু আকাশের ঐ তারাটা সব চেয়ে উজ্জ্বল কেন? 
- ঐ টা সবচেয়ে ভালো মানুষের তারা মা-মণি। 
- আচ্ছা আব্বু ঐ তারাটার নাম কি? 
- হৃদি । 
- উনি কি খুব ভালো ছিলেন ,তাই না আব্বু? 
- হ্যা মামণি। 
- আচ্ছা আব্বু আমার নাম হৃদি রাখলে কেন? 
- তুমি আমার রাজকন্যা তাই। 
- আচ্ছা আব্বু রাজকন্যার গল্পটা বল। 
- এক দেশে এক রাজকন্যা ছিল।রাজকন্যার নাম ছিল হৃদি।রাজ্যের অনেক আদরের রাজকন্যা ছিল হৃদি, সবাই অনেক ভালবাসত।আর রাজকন্যাও ছিল অনেক ভাল। একদিন এক রাক্ষস এসে রাজকন্যাকে তুলে নিয়ে যায়।তারপর রাজকন্যাকে মেরে ফেলে,আর তখন থেকে আকাশের সবচেয়ে বড় তারা হয়ে যায় হৃদি। 
- আমাকেও যদি রাক্ষস তুলে নিয়ে মেরে ফেলে? 
আবির সাহেব বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন উনার ৫ বছরের মেয়ে হৃদিকে তারপর আস্তে আস্তে বলেন 
- না রে মামণি। আমি একটা হৃদিকে হারিয়ে ফেলেছি আরেকটা হৃদিকে হারাতে দেব না। 
একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মাঝারি মানের একটা পোস্টে চাকরি করে আবির। স্ত্রী অবন্তী আর ৫ বছরের মেয়ে হৃদিকে নিয়ে তার সংসার। অফিস থেকে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে আকাশের দিকে উদাস হয়ে চেয়ে থাকা ওর নিয়মিত কাজ। দূর থেকে দেখলে যে কেউ মনে করবে ও যেন আকাশের দিকে চেয়ে কারো অপেক্ষা করেছে। 
মা-বাবা যখন মারা যান তখন সে কলেজে পড়ে। ছোট বোন ছাড়া আর আপন বলতে কেউ ছিল না পৃথিবীতে।সপ্ন ছিল বুয়েটে পড়বে কিন্তু সংসার আর হৃদিকে দেখাশুনা করতে গিয়ে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয় নি।বোনকে নিয়ে সব সপ্ন ছিল, বোনও নিরাশ করে নি।নিজে পড়তে পারে নি বলে যে আক্ষেপ ছিল হৃদি বুয়েটে সুযোগ পেয়ে সেই আক্ষেপ গুছিয়ে দিয়েছে।সব ঠিকমত চলছিল হৃদি ভর্তি হওয়ার ৬ মাস পর থেকে কেমন যেন বদলে গেল।ঠিকমত বাসায় যোগাযোগ করত না,বাসায় গেলে কেমন যেন ছটফট করত। আবির বোনের এমন আচরণে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।খুজ নিয়ে জানতে পারল বড়লোক বাবার বখে যাওয়া ছেলে পলাশের সাথে প্রেম করছে হৃদি। সব শুনে আবির সিদ্ধান্ত নেয় হৃদির পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়ার।পরের সপ্তাহে হৃদি বাসায় আসার পর আবির ওর পড়া বন্ধ করে দেয়ার কথা বলে সেই সাথে বলে দেয় হৃদি যেন বাসার বাইরে না যায় । হৃদির অনেক কান্নার পরও আবির তার সিদ্ধান্ত বদল করে না। একদিন সবার অজান্তে হৃদি পলাশের হাত ধরে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। এরপরের ৬ মাস ছিল হৃদির জন্যে অনেক কষ্টের। একদিকে মা-বাবার আদর দেয়া ভাই আর অন্যদিকে তার ভালবাসা।সে চেয়েছিল পলাশকে অন্ধকার জগত থেকে ফিরিয়ে এনে তার ভাইয়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে।পলাশের উন্নতি দেখে নিশ্চয় তার ভাই তাকে ফিরিয়ে দিবে না। ৬ মাস পর পলাশকে ঠিকই আলোর রাস্তায় ফিরিয়ে এনেছিল,পলাশ নিজ যোগ্যতায় ভাল একটা চাকরী পায়। হৃদি মনে করে এখনই তার ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ার উপযুক্ত সময়।কিন্তু ওর ভাগ্যটাই খারাপ। দুইবার ভাইয়ের বাসায় যায় কিন্তু গেটের বাইরে থেকে ফিরে আসতে হয় হৃদিকে।অনেক কান্নাকাটির পরও কেউ গেট খুলে নি।এরপরের সপ্তাহে চট্টগ্রাম বেড়াতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রান হারায় হৃদি ও পলাশ। বোনের লাশ পর্যন্ত দেখতে যায় নি অভিমানী আবির। একসময় নিজের দাম্ভিকতার জন্যে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয় আবিরের।বোনের স্মৃতি মনে রাখার জন্যে নিজের মেয়ের নাম রাখে হৃদি। এরপর থেকে প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর আকাশের দিকে থাকিয়ে থাকে আবির শুনতে পায়, দূর আকাশ থেকে কে যেন খুব করুন সুরে বলছে " প্লিজ, ভাইয়া আমাকে ক্ষমা করে দে,ভাইয়া আমি তোকে অনেক ভালবাসি" 
আজও আবিরের চোখ বেয়ে পড়ছে পৃথিবী হারানোর সেই অশ্রু

গুপ্তধন................................রাকিব সামছ শুভ্র (সেরা গল্প)

গুপ্তধন................................রাকিব সামছ শুভ্র (সেরা গল্প)

হু কাঙ্ক্ষিত আম্মার ট্রাংকটা আজ খোলা হবে। আমরা চার ভাইবোন আম্মার ঘরে জড়ো হয়েছি। সবাই ভীষণ উত্তেজিত এবং অস্থির বোধ করছি। একান্ন বছরের পুরনো ট্রাংক তবে তালাটা এতো পুরনো না। তালার বয়স বড়জোড় বছর চারেক হবে। ছোটদা লুকিয়ে তালা ভাঙতে গিয়ে আগের তালাটা নষ্ট করে ফেলেছে। কিন্তু ট্রাংক খোলার আগেই ধরা পড়ে গিয়েছিলো। তখন নতুন তালা লাগানো হয়।

আমরা চার ভাইবোন। আমি সবার ছোট। বড়দা তারপর আপা এরপর ছোটদা। বড়দা বেশ গোবেচারা টাইপের। মাস্টার্স করে আমাদের শহরেই একটা কলেজে পড়াচ্ছেন। সবাই প্রফেসর আজিম নামেই ডাকে তাকে। বড়দা দুই মেয়ের বাবা, রুনু ভাবি স্কুলে পড়ান। আলো আপা ভয়ঙ্কর সুন্দরী একেবারে আম্মার ডুপ্লিকেট। মাঝে মাঝে ভাবি আপা কী ডাবল পার্ট করছেন নাকি? দুলাভাই ব্যবসায়ী,পয়সাওয়ালা বাড়ি গাড়ির অভাব নাই। আপারা এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে থাকেন কুমিল্লায়। ছোটদাও ব্যবসা করে কিন্তু কেন যেন খুব একটা ভালো করতে পারে না। দু-দিন লাভ করলে পাঁচ দিন লস করে। ঝুমু ভাবি ডাক্তার তাই ছোটদার উঠানামায় ভারসাম্য ধরে রাখেন। ছোটদাদের এক মেয়ে।

আর আমি? আমার নাম আঁখি। স্বামী হাসিব আর্মিতে মেজর। হাসিবের পোস্টিংয়ের জন্য আমার নির্দিষ্ট কোন শহরে থাকা হয়না। কখনো খাগড়াছড়ি আবার কখনো সিলেট এখন অবশ্য কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আছি। হয়তো বছর খানেক এখানে থাকবো তারপর আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে নতুন জায়গায়। আমাদের একটাই ছেলে নাম রুদ্র।

আমাদের দাদাবাড়ী মাদারীপুর হলেও আব্বা তার চাকুরী জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন চাঁদপুরে। ডিসি অফিসে হেডক্লার্ক ছিলেন। আম্মা চাঁদপুরেরই মেয়ে তবে বড় হয়েছেন চট্রগ্রামে। ১৯৬৯ সালে আম্মা আব্বার বিয়ে হয়। আব্বা মারা গিয়েছেন প্রায় এগারো বছর। আম্মা আমাদের ছেড়ে গেছেন মাত্র একচল্লিশ দিন আগে। আম্মার চল্লিশা আয়োজন করতেই আমরা সবাই চাঁদপুরে এসেছি।

আব্বা আম্মার বিয়েটাও হয়েছিলো অদ্ভুত ভাবে। নানাজান কোন এক কাজে ডিসি অফিস (তখন অবশ্য সাব ডিভিশনাল অফিস ছিলো) এসেছিলেন। আব্বার ব্যবহার আর চেহারা দেখে সরাসরি নিজের মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেন। নানাজান অবশ্য বলেছিলেন তার মেয়ে শিক্ষিত, ভদ্র, সংসারী তবে গায়ের রঙ বেশ চাঁপা। আব্বা আম্মাকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে যান। বিয়ের রাতে বাসর ঘরে আম্মাকে প্রথম দেখে আব্বা নাকি ভুত দেখেছেন। ভয়ংকর রূপবতী একজন মানুষ তার বিছানায় বসা! তার চিৎকারে বাসার সবাই বন্ধ দরজার সামনে হাজির। আব্বা দরজা খুলে দাদীকে নাকি বলেছিলেন, ওই বাড়ির লোকেরা ভুল করে অন্য মেয়ে দিয়ে গেছে! এক যাচ্ছেতাই অবস্থা। গভীর রাতে নানাজানকে খবর দেয়া হয়। লোকজন সমেত উনি আমাদের বাড়িতে আসেন। সব বুঝিয়ে বলার পর আব্বা ঠান্ডা হন। নানাজান আব্বাকে পরীক্ষা করার জন্য মেয়ে কালো বলেছিলেন। আসলে আম্মার গায়ের রঙ ছিলো দুধে আলতা। 

আব্বার বেতন খুব বেশী ছিলোনা কিন্তু সবসময়ই চাইতেন আম্মা সেজেগুজে পরিপাটি থাকুক। আম্মাও নিজের মতো করে সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছিলেন। আব্বার কেনা শহরের এক কোনে বাস স্ট্যান্ডের পাশে পাঁচ শতাংশের জমিটায় তিনরুমের বাসা আব্বা আম্মার সারাজীবনের সঞ্চয়ে গড়ে উঠা ভালোবাসার প্রাসাদ। 

বিয়ের কদিন পরেই আব্বা আম্মাকে একটা কালো রঙের ট্রাংক কিনে দিলেন। আম্মা সযতনে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো ওই ট্রাংকে রেখে দিতেন। আম্মা কখনো আমাদের সামনে ট্রাংক খুলতেন না। ঘরের দরজা বন্ধ করে ট্রাংক খুলতেন আবার তালা লাগিয়ে চাবি সড়িয়ে রাখতেন। ছোটবেলায় বহুবার জিজ্ঞেস করেছি, আম্মা ট্রাংকে কি আছে একবার দেখাবে? কখনোই দেখাতে রাজি হয়নি৷ খুব চাপাচাপি করলে বলতো, গুপ্তধন, মহামূল্যবান  জিনিস এর মধ্যে রাখা আছে। আমার সারা জীবনের সবচেয়ে দামী সঞ্চয় এর মধ্যে রক্ষিত আছে। 

আমাদের চার ভাইবোনের কেমন যেন একটা আকর্ষন অথবা লোভও বলা যায় ছিলো ট্রাংকটার উপরে। আব্বাও আম্মাকে বলতেন, তোমার এই যক্ষের ধন তুমি না থাকলে সামলাবে কে? 

আম্মা কোন উত্তর দিতোনা। অদ্ভুত একটা হাসি দিতো আর আমাদের গা জ্বলতো। আম্মা গহনা তেমন পরতোনা তাই আমাদের সবার ধারণা, ট্রাংকে নিশ্চয়ই আম্মা সব গহনা রেখে দিয়েছে। আরো না জানি কতো কিছু আছে?

আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর আম্মার ট্রাংকের প্রতি দরদ আর যত্ন আরো বেড়ে গিয়েছিলো। দরজা আটকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাংক নিয়ে বসে থাকতো। আমরা এমনকি নাতিনাতনিরাও ওই সময় ঘরে ঢুকতে পারতাম না। এতে আমাদের ধারণা আরো বদ্ধমূল হলো, ট্রাংকে অমূল্য ধনরত্ন আছে। শুনেছিলাম নানাজান আম্মাকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর অনেক দামী উপহার দিয়েছিলেন। সেসবও মনে হয় ওই ট্রাংকেই রাখা। 

চার বছর আগে ছোটদার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছিলো। একদিন আম্মা পাশের বাসায় গিয়েছে এমন সময় ছোটদা আম্মার ঘরে খাটের নীচ থেকে ট্রাংক বের করে তালা ভাঙার চেষ্টা করছিলো। ঠিক ওই সময় ভাবি চলে আসায় আর ভাঙতে পারেনি। আম্মা বাসায় এসে খুব কেঁদেছিলো। ছোটদাও খুব লজ্জা পেয়েছিলো। আম্মার পা ধরে কান্নাকাটি করায় ক্ষমা পেয়েছিলো সাথে আম্মার কোলে আশ্রয়। ছোটদা ছোটকাল থেকেই একটু ডানপিটে ধরনের। একমাত্র আম্মা ছিলো ওর শেষ আশ্রয়স্থল। যত ঘটনাই ঘটাক আম্মার কোলে ঠিকই জায়গা করে নিতো। মানুষ হিসেবে কিন্তু ছোটদা অসম্ভব দিলখোলা। খরচের হাতও বেশ বড়। ধুমধাম খরচ করতে ওর চেয়ে পারঙ্গম কেউ নেই।

আব্বা মারা যাবার কিছুদিন আগেই তার রেখে যাওয়া বাড়ি এবং জমি চার ভাইবোনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন। এতে অবশ্য কারো কোন আপত্তি ছিলো না। কিন্তু সবারই চোখ রয়ে গেছে আম্মার ট্রাংকের জিনিসের দিকেই। আম্মা মারা যাবার আগের রাতে বড়দাকে ডেকে বললো, বাবা আমি চলে গেলে তোমরা ট্রাংকটা খুলে তোমাদের যার যা পছন্দ নিয়ে নিও। ট্রাংকটা ফেলে দিওনা, ঘরের এক কোনে কোথাও ফেলে রেখো। আমার খুব প্রিয় এবং ভালোলাগার সম্পদ। 

আম্মা হুট করেই চলে গেলেন। আমরা কেমন হঠাৎ করেই এক বিশাল শূন্যতায় আবদ্ধ হলাম। আমাদের সব কিছু আছে আবার কিছুই নেই। অদ্ভুত একটা বিষয় হলো, যেই ট্রাংকের ভেতরের জিনিসের জন্য আমরা বুভুক্ষু ছিলাম, আম্মা চলে যাওয়ার পর সেই ট্রাংক খোলবার কথা কারো মনেও আসলো না। আমরা চার ভাইবোন কান্না পেলেই ট্রাংকটা ছুঁয়ে আম্মার ছোঁয়া নিতে চাই। 

যে যার মতো নিজেদের শহরে চলে গিয়েছিলাম। আম্মার চল্লিশা আয়োজন করতে বাড়ির সবাই আবার চাঁদপুরে এসেছি। খাওয়াদাওয়ার পরে সবাই আম্মার ঘরে বসে কথা বলছি। এমন সময় হাসিব কথাটা পারলো। আম্মাতো অনুমতি দিয়েছেন তার ট্রাংক খুলতে, আমরা খুলে দেখতে পারি না? কেউই আগ্রহ প্রকাশ করলো না। অথচ এর ভিতরে কী আছে তা নিয়ে গত চল্লিশ বছরের অপেক্ষা আজ কেমন হালকা হয়ে গেছে। তারপরও সবাই একমত হলাম, খুলে অন্তত দেখি!

পরদিন নাস্তারপর সবাই আম্মার ঘরে জড়ো হয়েছি। বড়দা খাটের নীচ থেকে ট্রাংক বের করলো। চাবি হাতে নিয়ে তালায় ঢোকানোর সময় হাত কাঁপছে। আমরা ভিতরে অস্থিরতা বাহিরে প্রকাশ করছিনা। ট্রাংকের ঢাকনা খুলতেই দেখতে পেলাম ছোট ছোট কাগজের অনেকগুলো প্যাকেট। বড়দা প্রথম প্যাকেট নিয়ে তা খুলতেই যা বের হলো তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।

একটা বহু পুরনো আলতার শিশি। আলতা নেই শুধু লালচে দাগ রয়ে গেছে শিশিতে। সাথে ছোট্ট একটা কাগজে লেখা ওর দেয়া প্রথম উপহার। একান্ন বছর আগের একটা তারিখ।
আরেকটা প্যাকেট খুলতেই বের হলো একটা টিপের পাতা যাতে একটাই টিপ অবশিষ্ট রয়েছে। বিয়ের তারিখ লেখা সাথের কাগজে।
পরের প্যাকেটে পাওয়া গেলো একটা মেরুন রঙের পার্কার কলম। কাগজে লেখা বাবার দেয়া সবচেয়ে দামী উপহার। ম্যাট্রিকুলেশনে ভালো ফলাফলের পরে পাওয়া।
বের হলো বড়দার প্রথম জুতো জোড়া, আপার প্রথম জামা, ছোটদার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মার্বেল (বাবার হাতে কতো মার খেয়েছে এই মার্বেল খেলার জন্য), আমার কাঁচের ফিডার, বাবার বিয়ের রুমাল, দাদার টুপি, নানিজানের পানের বাটা, আমাদের চার ভাইবোনের প্রথম পরে যাওয়া দাঁত। আরো অনেক কিছুই বের হলো ট্রাংক থেকে।

আরেকটা জিনিস পাওয়া গেলো, যা আমাদের সবচাইতে বেশী অবাক করেছে, একটা মলাট বদ্ধ খাতা। সেটা ছিলো আম্মার লেখা একটা কবিতার খাতা! আমাদের অতি চেনা আম্মার নতুন আরেকটা দিক আমাদের সামনে উন্মোচিত হলো।

আম্মার এতো প্রিয়রা এই ছোট্ট ট্রাংকে এতোদিন চাপাচাপি করেছিলো! ঐ মূহুর্তে আম্মার রেখে যাওয়া গুপ্তধনেরা আমাদের চার ভাইবোনকে অদ্ভুত ভালোবাসায় জড়িয়ে নিলো। হঠাৎ করেই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পদের মালিক হয়ে গেলাম আমরা।

রংমহল..............................আশিকুর রহমান বিশ্বাস

রংমহল..............................আশিকুর রহমান বিশ্বাস
কটু পর রাত নামে। জহির ভাবে, সে হয়তো কাউকে খুঁজে পাবে, কিন্তু নিকটবর্তী কাউকে দেখতে পায় না সে। সন্ধ্যা রাতে শহরাঞ্চলে কোলাহল থাকে। মানুষ অবসর নিয়ে খুচরা আলাপে লিপ্ত হয়, চায়ের কাপে টুংটাং আওয়াজ দেয়, হকারদের দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু এখানে সে- সবের কিছুই নেই। যদিও প্রত্যন্ত গ্রামদেশে কোলাহল খোঁজাটা বড় অবান্তর। তবে সে শুনেছিল, এখন গ্রাম আগের মতো একেবারে অবহেলিত নয়, মানুষ শিক্ষিত হয়ে গেছে, রাস্তাঘাট উন্নত, শিল্পায়নের প্রভাবে তাদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে, হতদরিদ্র মানুষ আজকাল আর চোখে পড়ে না বললেই চলে, তারাও গভীর রাত অবধি দোকানপাটে পড়ে থাকে, বলা যায় গ্রাম এবং শহরের পার্থক্যটা কমে এসেছে। জহিরের চশমা ঢাকা চোখে সে চিত্র এখনও পড়েনি। সে সন্তর্পণে একটা বাঁশ ঝোপের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়। বস্তুত এটাই যাবার রাস্তা। জহির শব্দ করে না, কিন্তু কেনো জানি বাঁশ ঝোপে লুকিয়ে থাকা পাখিরা বুঝে ফেলে তাকে এবং গলা ছেড়ে বাকিদের জানান দেয়, তারপর জোটবদ্ধ চিৎকারে লিপ্ত হয় তারা।

আকস্মিক সেই চিৎকারে জহিরের গা টা ছমছম করে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণে আবার ভালো লাগে তার, এবং ভাবে, আহারে যদি আরেকবার অমন ডাকতো ওরা! কিন্তু পাখিরা আর চিৎকার করে না। জহির অপেক্ষা করে তবু, দপদপ শব্দ করে পা ফেলে, কিন্তু পাখিরা নিশ্চুপই। এবার সে হাঁটা শুরু করে; ঘোলাটে অন্ধকারে পচা কাদায় তার পা খপ করে আটকে যায়। কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে ঢের কষ্ট হয় তার। তারপর সে পায়ের জুতা জোড়া খুলে হাতে নেয় এবং পুনরায় হাঁটতে থাকে। কয়েক পা হেঁটে গেলে জহিরের ডান পায়ের তলে পিচ্ছল অনুভূতি হয়। ঠিকমত বুঝতে পারে না সে, অতএব তাকে অনুমান করে নিতে হয়; তখন সে অস্ফুটে মুখে বলে, পাখির পায়খানা হবে বোধহয়। ঐ সময় কোনো এক কারণে যেন একটু ঘেন্না লাগে তার কিন্তু আশপাশে বাড়িঘর কিংবা পরিষ্কার পানির সন্ধান এখুনি মিলবে না এমন সান্ত্বনায় তাকে মানিয়ে নিতে হয়। একটা লাল শেয়াল তাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়, জহির হিস্ হিস্ শব্দ করে তাকে তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। শেয়ালটি তার দিকেই তেড়ে আসতে থাকে, জহির ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে এবং তাকে চলে যাবার রাস্তা করে দিতে একটু পার্শ্বে সরে গিয়ে নীরবে দাঁড়ায়। কেননা এই জাতীয় আক্রমণাত্মক প্রাণীগুলো দল বেঁধে খাবারের সন্ধানে রাতে ঘুরতে থাকে। জহির অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আশপাশ তাকিয়ে দেখে এবং স্বস্তি পায় এই আশায় যে নিকটবর্তী এই শেয়ালটি ছাড়া একটা ইঁদুরও দেখে না সে। শেয়ালটি তার কোল ঘেঁষে অত্যন্ত ভদ্রভাবে হেলেদুলে গন্তব্যে চলে যায়। জহিরের গা থেকে ঘাম ছাড়ে। 

এবার পূর্বের ন্যায় আপেক্ষিক আরো অনুন্নত একটা রাস্তায় পৌঁছে যায় সে। জহির অবাক হয় এবং আক্ষেপও হয়, অতঃপর অস্ফুটে বলে, এই রাস্তায় মানুষ চলে! কিন্তু তারপর সে আরো কঠিন বাস্তবতায় পৌঁছে যায় এবং ডিপটয়েলের আলো এসে রাস্তায় পড়ে তখন, অতঃপর সেই আলোয় সে অস্পষ্ট দেখে রাস্তার অসংখ্য জায়গায় গোবর পড়ে আছে। থিতিয়ে আছে গোবর কাদামাটির সাথে। এখন এই গোবর ডিঙিয়ে তাকে যে গ্রামের ভিতর যেতে হবে এটা পুরোপুরি নিশ্চিত। তখন তার মনে হয় এই গ্রামের মানুষ খুব পরিশ্রমী হবে নিশ্চয়। তারা গরু পোষে, ক্ষেতখামারে কাজ করে, বস্তুত অত্যন্ত সহজসরল জীবনযাপন তাদের। সেই সাথে একটু তৃপ্তিও হয় বটে, কেননা যতদিন সে এখানে থাকবে নিশ্চয়ই টাটকা সবজি, গাভীর দুধ, অন্ততপক্ষে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারবে এই ভাবনায়। শহরে হাশেম নামে যে লোকটি তাকে রোজ সকালে দুধের জোগান দিতো, সে দুধ মোটেও খাঁটি নয়। তবুও লোকটি কী অবলীলায় একশত একটা মিথ্যা একজায়গায় করে আত্মশুনানি করে চলতো। সে ইঙ্গিত করতো, তার সেই দুধের মতো নির্ভেজাল সুস্বাদু দুধ অত্রাঞ্চলে নেই, তার গরু শুধুই কাঁচাঘাস-খড়-খৈল-ভুষি এবং পরিষ্কার পানি ব্যতীত আর কিছুই খায় না, এমনকি আধুনিক খাদ্যখাবার মোটাতাজাকরণ ঔষধ পর্যন্ত সে কখনওই গরুকে দেয়নি, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সে যাই বলে না কেনো দুধ জ্বাল দেবার পর জহির মুখে নিয়ে দেখতো তা কেমন যেন বিস্বাদ, টকটক, বস্তুত অখাদ্য বলা চলে। এখন তার মন বলে ঐ কাজটি এখানে নিশ্চয় হবে না। তারপর কিছুক্ষণ হেঁটে গেলে একটা বাড়ি দেখতে পায় জহির। খোলামেলা ঐ বাড়িতেই একটা নীল রঙ করা টিউবওয়েল তাকে অভ্যর্থনা জানাতে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হয় তার। জহির কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে হাত পা ধুয়ে নেয়। ঐ সময় একজন স্ত্রীলোক তার কাছে এসে দাঁড়ায় এবং তার সম্পর্কেই বিস্তারিত জানতে চায়। জহির নিজের পরিচয় প্রায় একদমে বলে যায় এবং একটু থেমে তার এখানে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে চলে। স্ত্রীলোকটি এবার ভরসা পায় এবং অনুনয় করে তাকে ভিতরে যেতে বলে। জহির অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং হেসে বলে বেশি বিলম্ব হলে নিশ্চয় তার গন্তব্যস্থানের লোকেরা দুশ্চিন্তা করতে পারে। তখন স্ত্রীলোকটি তার গন্তব্যস্থান ও তাদের নামধাম জানতে ব্যগ্র হয়। জহির এবার ইতস্তত বোধ করে কেননা তার গন্তব্যস্থান এখনও ঠিক হয় নি, এবং তার ধারণা আজ রাতটা সে কোনোরকমভাবে মসজিদ কিংবা অন্য যে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে ঘুমিয়ে কাটাতে পারবে। স্ত্রীলোকটি তার মনোভাব বুঝতে পারে এবং তার ছেলেদের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে ডাক দেয়, অতঃপর তাদেরকে বলে তাদেরই এই বাড়িতে সে যেন আজকের রাতটা আতিথেয়তা গ্রহণ করে। কিন্তু জহির দ্বিতীয় বারের মতো তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে এবং তখন তাদের এক ভাই এখানে থাকার পক্ষে অনেকগুলো যুক্তি দাঁড় করিয়ে দেয়। জহির এ পর্যায়ে এসে সম্মতি না দিয়ে পারে না, এবং পরবর্তীতে সে ভিতরে গিয়ে বসে। তাদের আন্তরিকতায় সে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যায়, এই মানুষগুলো এত সহজসরল কেনো? এই জাতীয় প্রশ্ন মাথায় আসে তার। তারপর সে একটা ব্যথার অনুভব করে। কাদাভরা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে তার পায়ে মুহূর্তে ব্যথা করতে থাকে এবং সে পায়ের পাতা মাটিতে রাখতে ব্যর্থ হয়। অতঃপর জহির বিছানায় নিরুপায় হয়ে শুয়ে থাকে এবং কীসব যেন চিন্তা করতে করতে তার ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। 

তখন জহির প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। তার সরু লম্বা নাকটা অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারিতার মতো ভারী গর্জন করছে এমনটা একবার মনে হয়েছিল তার, কেননা, নিশ্বাস ভারী বোঝাচ্ছিল। এমতাবস্থায় একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায়। আপনি কি সজাগ আছেন? -এই সাদৃশ্য কণ্ঠ তার কানে এসে লাগে। জহির ধসমস করে উঠে বসে, একটু স্বাভাবিক হয়, অবশেষে দরজার কপাট খুলে দেয়। এবং আচমকা তখন সে অনুভব করে তার পায়ে আর অতটা ব্যথা নেই। যে লোকটির ডাকে সে ঘুম থেকে জাগে, এ পর্যায়ে সেও আবিষ্কার হয় এবং জহির দেখে, সে আসলে নতুন কেউ নয় বরং ঐ যুক্তিবাদী লোকটিই- যার কথামত সে এখানে রয়ে গেছে। জহির- আসুন ভিতরে আসুন, বসুন- নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে বলে। লোকটি তার পাশে চুপটি বসে থাকে কিছুসময়। এরপর সে আচমকা উৎকণ্ঠিত গলায় ইঙ্গিত করে যে, অদূরে কোথাও গানের আসর বসেছে, এখন সে যদি আগ্রহী হয় তবে তাকে নিয়ে যেতে পারে। জহির বিস্তারিত জানতে চায়,অতঃপর লোকটি ভেঙে বলে। লোকটির বর্ণনা থেকে জহির যা বুঝতে পারে তা এমন: এই অঞ্চলে এখনও লোকসংগীত টিকে আছে এবং প্রায়শ রাতে আসর জমে। মধ্যরাত অবধি সেই আসর চলে এবং সকলে তা খুব মুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করে। তখন হঠাৎই তার মনে হয় যে, একটু সচেতন হলে নিশ্চয়ই আমরা আরো কিছু লালন, হাছন, শাহ্ আব্দুল করিম খুঁজে পেতাম। এরপর জহির মৌন সম্মতি দেয় এবং যেহেতু সে শুধু লুঙ্গি পরেই শুয়েছিলো সুতরাং তাকে এবার পূর্বের পোশাকে ফিরতে হয়। অতঃপর একটা প্রাথমিক গোছগাছের পর তারা দু'জনে বেরিয়ে পড়ে। 

গানের আসর শেষ হলে জহির ফিরে এসে কখন যে আবার শুয়েছিল তা আর মনে করতে পারে না সে। বস্তুত সকাল হয়ে যায় কিন্তু সে আশপাশ তাকিয়ে কাউকে খুঁজে পায় না। এমনকি যার সাথে প্রায় মধ্যরাত অবধি গানের আসর জমিয়েছিলো, তাকেও সে খুঁজে পায় না। জহির হাঁটতে বের হয় কেননা তার মন বলে নিশ্চয় হাঁটতে বেরুলে পথিমধ্যে কাউকে না কাউকে খুঁজে পাবে এবং সেখান থেকে এই নাটকীয়তার বিস্তারিত জেনে নিবে সে। গ্রামের একাংশ ঘুরে শেষ করে জহির, এবং কয়েকজন লোক তাকে এমনি ইঙ্গিত দেয় যে, আজ এনজিও থেকে তাগাদা দিতে পারে যেহেতু তারা বেশ কিছু টাকা নিয়েছিলো সেখান থেকে, এবং সাধারণত তারা খুব কড়া ভাবেই তাগাদা দিয়ে থাকে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, অবশেষে ঘরের বাসনকোসন পর্যন্ত ছিনিয়ে নিতে দ্বিধাবোধ করে না। এবার সে বুঝতে পারে যে, নিশ্চয় কিস্তির টাকা আজ বন্দোবস্ত হয় নি তাদের, কেননা কয়েকদিন ভারী বর্ষণে কর্মশূন্য তারা -এমনটা বোঝাও যাচ্ছিল রাতে, অতএব সাময়িক ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছে ঝামেলা এড়াতে। কিন্তু জহিরকে না বলে তারা চলে গেলো কেনো? তাকে তো তারা বুঝিয়ে বলতেও পারতো। সে তো দুধের শিশু নয় যে বললে বুঝবে না। ফিরে এসে নিশ্চুপ বসে থাকে সে এবং ভাবে। পালিয়ে তারা কতদিনই বা বাঁচতে পারবে? পরক্ষণে আবার তার মনে হয়, এটাকে আদৌ পালানো বলা ঠিক নয়, কেননা তারা ফিরবে এবং টাকার বন্দোবস্ত করেই ফিরবে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও তারা যে তাকে আপ্যায়ন করলো, আশ্রয় দিলো, এমনকি একটু বুঝতেও দিলো না - এতে করে সে এই রংমহলে নিজেকে একজন অপদার্থই মনে করলো। কেননা গানের আসরে যাবার পথে লোকটির সাথে নানান কথোপকথন হয়েছিলো রাতে, লোকটি তাদের অসহায়ত্বের ছাপ রেখে যাচ্ছিল প্রতিটি কথায়, অথচ জহির তা আমলেই নেয় নি। একে ঠিক অপদার্থই বলা চলে। ভীষণ স্বার্থপরতা। অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুম আসে জহিরের। এই অসময়ে কিছুসময় ঘুমায়ও সে, কিন্তু সেই ঘুম ভাঙে আকস্মিক অপরিচিত একটি কণ্ঠস্বরে। অতঃপর সে ঘুমঘুম আবছা চোখে তার দিকে তাকায় এবং দেখে ভদ্র পোশাকে একজন লোক তার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। আপাতদৃষ্টিতে ভদ্র মনে হলেও সে কিন্তু অতটা ভদ্র নয়, তা বোঝায় যাচ্ছে। জহির তার সম্পর্কে বিনীত জানতে চায়, তখন ভদ্রলোকটি খুলে বলে। কিন্তু সে মহা ঝামেলার ভিতরে পড়ে অতি শীঘ্র। কেননা, ভদ্রলোকটি তার থেকে কিছু শুনতে না চেয়েই বরং পাওনা টাকার দাবি করে বসে। জহির আচমকা হকচকিত হয়। সে কিছু বলতে চায় অথচ লোকটি বড় বাচাল প্রকৃতির হওয়ায় জহির তা পেরে ওঠে না। এক পর্যায়ে দু'জনার ভিতর কথা কাটাকাটি হতে থাকে। উচ্চস্বরে কথোপকথনের একপর্যায় জহির বলে ফেলে সে কেবলই একজন আগন্তুক বই কিছু নয়, এমনকি গতকাল রাতের ঘটনাটাও কখনও স্পষ্ট, কখনওবা অস্পষ্ট করে বলে ফেলে সে, কিন্তু লোকটি তার কথা বিশ্বাসই করতে পারে না। দুজনার মধ্যকার এই বাকবিতণ্ডা থেকে একসময় হাতাহাতি শুরু হয়। দেখতে লোকটি ভদ্রবেশী হলেও গায়ে শক্তি ছিলো বেশ কাজেই জহির তার সাথে আর পেরে ওঠে না। প্রচণ্ড একটা আঘাত আচমকা জহিরের মাথায় এসে লাগে এবং সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর সে আবছা দেখতে শুরু করে। এই রংমহল যার রং আজ সকাল অবধিও ছিলো উজ্জ্বল তা এখন ফিকে মনে হয় তার। তারপর জহির ক্রমশ জ্ঞান হারাবার পথেই এগিয়ে যায়।

মধ্যরাতের চিঠি....................সঞ্জয় দেবনাথ

মধ্যরাতের চিঠি....................সঞ্জয় দেবনাথ
রাত তখন তিনটা। বিছানা ছেড়ে হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে উঠলো স্নেহ। টেবিলের পাশে রাখা প্যাডের পাতা ছিড়ে লিখতে বসলো চিঠি। কেন এতো রাতে এই চিঠি লেখার কান্ড! সকালেই তো লিখতে পারতো। কিংবা বিকাল বা মধ্যদুপুর। কি এমন হলো যে গভীর রাতে ওঠে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চিঠি লিখতে বসলো! নিশ্চই কারণ আছে। কার্যকারণ ছাড়া তো কিছুই হয়না পৃথিবীতে...।

পৃথিবী যখন ঘুমাচ্ছিলো তখন মৃত শরীরের গল্প নিয়ে অনেক লেখা স্নেহ পড়েছিলো। কেন মানুষ মরে যায় খুন হয়ে। হত্যা তো সর্বদা হয়। শোষিত শ্রেণি মরে মরে বেঁচে যায় আধমরা হয়ে। মানুষইতো মানুষকে খাটায়। তাহলে আসল মানুষ কে? ভাবনাগুলো ঘুরে তার মাথায়। তাহলে মানুষ কেন ঘুমায় প্রতিবাদী না হয়ে- এমন সব প্রশ্ন নিয়ে স্নেহ দিশেহারা। কোথায় যেনো পড়েছিলো- ‘বীর সেই, মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনকে যে সৃষ্টি করে, মৃত্যুকে যে জয় করে।’

  ঘটনাটা সেই থেকে শুরু যখন দূর নীলিমায় আকাশের রঙ লাল হয়ে সূর্য পাটে যেতে বসেছে। ঠিক তখনই নবীনার আবির্ভাব। স্নেহ রাতকে টেনে আগেকার মতো আর দীর্ঘ করতে পারেনা। কখন সকাল হবে ছুটে যাবে নবীনার কাছে। নিজের প্রতি একসময়ের অযত্নের শরীর পরিপাটি করে সে দেয় দৌড় এক নিঃশ্বাসে, বুক ভর্তি সুখশ্বাস টেনে। কি পড়েছে, কি গল্প জেনেছে তার সবটুকু জ্ঞান যে নবীনাকে দেয়া চাই। তা না হলে তার এই জানা যে ব্যর্থ! যার জন্যে বিছানায় রাতঘুম দিয়ে সকালে খেয়ালই থাকেনা সিগারেটের ছাই মুছে যাবার কথা। প্রতিরাতে খাবার পর বিছানায় শুয়ে নবীনাকে ভেবে ভেবে জ্বলন্ত সিগারেট টানা সে তো অনুভবের অনাবিল স্নিগ্ধতা। সেই নবীনা এখন তার ধ্যানজ্ঞান। তার মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা। যাকে সারাক্ষণ বুঝায় কি করে ‘মানুষ’ হতে হয়। হাজার বছরের জমানো নোংরা জিনিস মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কিভাবে নিজেকে বদলাতে হয়। পরিবর্তন নয় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সমাজকে পাল্টাতে হয় এইসব কত কি! নবীনাও স্নেহের কথায় মোহাবিষ্ট হয়। অজানা আকর্ষণে স্নেহকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়...। 

  নবীনা এখন আর হতাশা খুঁজে পায়না। সমুদ্রের অনাবিল ঢেউ প্রতি মুহূর্ত ভরসার জল হয়ে যে তাকে স্নাত করে চলেছে। ছোট্ট মনে তার রাতদিন স্নেহের বসবাস। কি করছে, কি খাচ্ছে, আজ কোথায় যাওয়া হবে- এগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ নবীনার জানা চাই। স্নেহেরও তাই...। 

  এভাবেতো অনেকদিন ভালোই চলছিলো। ধ্বংসের ভিতরে হঠাৎ কিভাবে প্রাণের জন্ম হয় আর সেই প্রাণ লক্ষকোটি প্রাণের মুক্তি ঘটায়; সে তো নবীনা শিখেছে স্নেহের কাছ থেকে। সেতো শুধু রক্ত-মাংসে গড়া মেয়ে নয়, একজন মানুষ। যে মানুষ অন্যের দুঃখে অনুশোচনা করেনা, জ্বলে ওঠে। যে মানুষ ভিতরে জমানো এতোকালের নোংরা উপাদান ত্যাগ করে দ্রোহী হয়। প্রেমিক-প্রেমিকার সস্তা ভোগ-বিলাসের আমি-তুমিতে আর আত্মকেন্দ্রিক ভালোবাসায় মগ্ন থাকেনা। নিজের আত্মসম্মানবোধে বাঁচা মানুষরাই বেঁচে থাকে, অন্যরা মরে যায়...। 

  এও জেনেছে নবীনা, ‘একটা ভালো কাজ করা কারো পক্ষেই কঠিন নয়। কঠিন হচ্ছে- সারাজীবন ধরে ভালো কাজ করা। কখনো কোনো খারাপ কাজ না করা।’ চারপাশে মুখস্থ মানুষ আর ছেলে-মেয়েদের কঠিন আবেগে বিপথগামী হওয়ার গল্পের পাঠতো অহর্নিশ নিয়েছে নবীনা স্নেহের কাছ থেকে...। 

  

  অপ্রত্যাশিত এক কালবৈশাখি ঝড় এসে সব তছনছ করে দিলো তাদের নির্মোহ-নির্মল ভাবাবেগে। স্নেহ সেটা মানতেই পারছেনা। আকাশ কালো করা অন্ধকারে রাতের জোনাক আর নক্ষত্রের আলো- এখন স্নেহের দু’চোখ সেটা খুুঁজে পায়না। চোখ দু’টো অন্ধই মনে হয়। 

  পাঁজর বিদীর্ণ করা ক্ষত নিয়ে স্নেহ বলেছিলো নবীনাকে-

  ‘কেন তুমি এটা করলে গো?’

  ‘আমি তোমাকে হারানোর ভয়ে লুকিয়েছি’

নবীনার সহজ-সরল উত্তরে তার মনটা আরও ক্ষতবিক্ষত হয়। সে আঘাত পায়। এ কেমন কথা! আমাকে হারানোর ভয়ে তোমাকে দেয়া এতোদিনের আদর্শের গল্পগুলো তুমি ভুলে যাবে? আমাকে লুকিয়ে তোমার ভিতরের সেই নোংরা উপাদান বয়ে নিয়ে বেড়াবে? হারানোর ভয়ে সেই নোংরামো করবে? 

 স্নেহ কিছুতেই মানতে পারছেনা। অসাড় ক্ষতবিক্ষত শরীর-মন নিয়ে ভাবনাগুলো মাথায় ফিরে ফিরে আসতেই থাকে...

  তোমাকে তো যত্ন করে বুঝিয়েছি। এই পৃথিবীর আত্মত্যাগী মহৎ বিপ্লবীদের কথা বলেছি। প্রতিরোধ যুদ্ধে নাৎসী বাহিনী কর্তৃক ফাঁসি দেয়া বিপ্লবী কিশোরী লেপা রেডিক থেকে শুরু করে ক্ষুদিরাম, ভগত সিং, মঙ্গল পান্ডে, প্রীতিলতার মতো মহৎপ্রাণের আত্মবলিদানের কথা বলেছি। মানুষের মুক্তি-স্বাধীনতার জন্যে এইসব বিপ্লবীরা প্রাণ দিয়েছেন খুব অল্প বয়সেই। আমিতো তোমায় দ্রোহী সত্তা ধারণ করতে বলেছি তোমার হৃদয়ে; এইসব মহৎ প্রাণের মতোই...। 

  তুমি ভুল করলে, শোধরালাম, আবার ভুল! তাও মেনে নিলাম... 

উষ্ণ রক্তে বুকের প্রকোষ্ট ভরে যায় স্নেহের। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো কি যেনো একটা জিনিস সজোরে ধাক্কা দিয়ে কাঁপায় তার সমগ্র শরীর। সে ঘুমাতে পারেনা। 

 মনকে প্রবোধ দেয়- ‘ঠিক হয়ে যাবে, ছোট মানুষ ভুল করেছে, ক্ষমাও চেয়েছে’

 আবার মন মানে না- ‘এতো বুঝাবার পরও বার বার আঘাত দেয়া! সেতো আমায় ভালোবাসে। তাহলে অন্য দশটা মেয়ের মতোই আচরণ করবে কেন? সেতো অন্যমেয়েদের পাল্টাবে নিজের মতাদর্শ দিয়ে। তাহলে? আমার সব শিক্ষা-আদর্শ কি ব্যর্থ হয়ে গেলো!’

  স্নেহ ঘুমের ওষুধ খায়, সিগারেটের টেনে নেয়া ধোয়ায় তার গলায় কফ জমে। সে কাশতে থাকে। রাতের আকাশে জেগে থাকে তার গলা-ঠোঁট-চোখ-মুখ সব। মাথাটা নিয়ে কোনরকমে বিছানায় যায়, ঘুম নিরুদ্দেশ...।

  ‘চাপ দিয়ে গোপন কথা বের করা’ এমন তো নবীনা করতে পারেনা! স্বপ্রণোদিত হয়ে গড়গড়িয়ে সব বলে দিলো না কেন? 

স্নেহ না ঘুমানো চোখে প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে গভীর রাতে চিঠি লিখতে বসে নবীনাকে। আবার বুঝাবে বলে- যদি আর ভুল না করে! নিজেকে বাঁচাবে বলেই আশা নিয়ে কলম ধরে। কারণ স্নেহ তো জানে ‘লেগে পড়ে থাকার নাম বিজয়।’        


দেবতাখুমের পথে..................শাহরিয়ার জাওয়াদ

দেবতাখুমের পথে..................শাহরিয়ার জাওয়াদ
বান্দরবান মূল শহর থেকে রোয়াংছড়ির বাস ছাড়ে সকাল আটটায়। এর আগের দিন বান্দরবানে এসে পৌঁছেছি বেলা বারটার দিকে- আমি, সালমান ভাই, অয়ন আর পান্থ। আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে সতের তারিখ। আঠার তারিখ দুপুরে অয়ন যখন টেক্সট করলো, "ভাই, বান্দরবান চলেন কালকে, সালমান ভাই যাবেন। আপনিও চলেন।"
আমি তখন নিউমার্কেটে। বললাম, "বিকেলে বাসায় গিয়ে জানাচ্ছি।"
বিকেলে জানাবো বললেও আমাদের ট্যুর প্ল্যান ফাইনাল হলো সেদিন রাত ন'টার পরে। আমার হাতে জমানো কিছু টাকা ছিলো, বান্দরবানের জন্য ওটাই আমার একমাত্র সম্বল।
ঊনিশ তারিখ দুপুর বারটায় বান্দরবান পৌঁছে যে ব্যাপারটা আমাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো সেটা- রাতে থাকবো কোথায়?
বাস স্টপেজের সামনে বান্দরবান শহরের সবচেয়ে বড় যে হোটেলটা- হিলভিউ, ওটাতে আগামী হপ্তাখানেকের মধ্যেও কোন রুম ফাঁকা পাওয়া যাবে না।
ডিসেম্বরের ধূসর আকাশের নিচে ভর দুপুরে চারজন ছেলে কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে হাঁটছে আর ড্যাবড্যাব করে চাঁদের গাড়ির ড্রাইভারদের সাথে ট্যুরিস্টদের দর কষাকষি দেখছে।
শেষমেশ থাকার ব্যবস্থা হলো। হোটেলের নাম হিলবার্ড। তিন তলায় ডাবল বেডের পাশাপাশি দু'টো রুম পাওয়া গেল। প্রতি রুমের ভাড়া চারশ পঞ্চাশ টাকা করে।
হোটেল রুমে কোন টিভি নেই, অ্যাটাচড বাথরুম নেই। বাথরুম যা একটা আছে ওটা ফ্লোরের একপ্রান্তে। বাথরুম বা ওয়াশরুম না বলে এক্ষেত্রে পাবলিক টয়লেট টার্মটা ইউজ করা বেশি যুক্তিযুক্ত। পানির ট্যাপের কোন হাতল নেই। যেগুলো আছে সেগুলো কিছু মরচে পড়া স্ক্রু। বেসিনের ওপর আধখাওয়া সিগারেটের একগাদা ছাই ফেলে রাখা।

হোটেল রুমের প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া সাদা চাদর আর বালিশের কভার দেখে এক মুহূর্তের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। এটুকু পেয়েই আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, "থাকার জায়গাটা অন্তত পাওয়া গেলো। রাতে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে পথে পথে ঘুরতে হবে না অন্তত।"
হোটেলে ব্যাগপত্র নামিয়ে রেখেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে যাবো স্বর্ণমন্দির; বুদ্ধ ধাতু জাদি ক্যাং।
একটা মাহিন্দ্রা ভাড়া করা হলো। শহর পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ছুটে চললো মাহিন্দ্রা।
অয়ন সাথে করে তার উকুলেলেটাও নিয়ে এসেছে। কিনে রাখা চিপস আর কেক চিবোতে চিবোতেই

অয়ন আর পান্থ উকুলেলের টুংটাং এর সাথে গলা মেলালো। মাহিন্দ্রা যেখানে এসে থামলো সেখান থেকে পিচঢালা পাহাড়ি পথ বেয়ে আরো কিছুদূর গিয়ে মন্দিরের সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে হয়। কিছুদূর ওঠার পর জুতা রাখার নিদৃষ্ট জায়গা আছে। নয় কী দশ বছরের একটা ছেলে গম্ভীর মুখে সেখানে বসে। প্রতি জোড়া জুতা রাখতে তার কাছে পাঁচ টাকা করে দেওয়া লাগে। ছেলেটার পাশে একটা সাইন বোর্ড, তাতে লেখা : মন্দিরে হাফ প্যান্ট বা থ্রি কোয়ার্টার পরে যাওয়া নিষেধ।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে যত ওপরে উঠি বান্দরবানের স্বর্ণমন্দির আমাদের চোখের সামনে নিজেকে তত প্রকাশ করতে থাকে। আমরা অবাক হয়ে দেখি- কী তীব্র সেই সোনা রঙ!
সিঁড়ির শেষে মোজাইক করা বাঁধানো মেঝে। মূল মন্দিরের চারপাশে চক্রাকারে সাজানো পাথরের বেদিগুলোর ওপর মঙ্গল, বৃহষ্পতি কিংবা শনিদেবের মূর্তি। মূষিক আর গরুড় মূর্তি। মন্দিরের দেয়ালে তৈরি করা হয়েছে ছোট- বড় কুঠুরির মতো জায়গা যেখানে রাখা আছে সোনালী রঙের বেশ কয়েকটি মূর্তি। বোধ করি সেগুলো বুদ্ধেরই হবে। এ ব্যাপারে জ্ঞান স্বল্পতার কারণে মূর্তি বিষয়ক আলোচনা নাহয় তোলা থাকুক।

দু' হাজার সালে বার্মার স্থাপত্যবিদদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত মন্দিরটির পেছনের দিকে রয়েছে বড় একটি ধাতব ঘণ্টা। ঘণ্টার ফ্রেমের ওপর চারপায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে একটা ড্রাগন। মন্দিরের উঠোনে আরো আছে পৌরাণিক সিংহের মূর্তি।
মূল মন্দিরের ভেতর সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। শুধু যারা পূজা- অর্চনার কাজে এসেছে তারাই প্রবেশ করতে পারে। তবে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মন্দিরের ভেতরের অংশটা দেখা যায়।
মন্দিরের ভেতরে প্রায় অন্ধকার। আলো অন্ধকারের লুকোচুরি যেন কেমন একটা ইন্দ্রজাল তৈরি করেছে। সেই ইন্দ্রজালের মাঝে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তিটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
"সালমান ভাই, কী পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে বুদ্ধের মূর্তি বানানো হয়েছে, দেখলেন!", আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
মন্দিরের দরজায় কিছু বয়স্কমতো লোক জটলা পাকিয়েছে। মন্দিরে কেন ঢুকতে দেওয়া হবে না, কেন তাদেরকে পঞ্চাশ টাকার টিকেট কেটে এখানে আসতে হলো- এই নিয়ে তারা মোটামুটি বিদ্রোহ ঘোষণার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা বৌদ্ধ ভিক্ষু অসহায়ভাবে মুখস্থ বুলির মতো আওড়ে যাচ্ছেন, "দেখুন... এটা একটা উপাসনালয়, একটু বুঝুন। সবাই ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন না।"
দরজায় দাঁড়ানো প্রতিবাদী বুড়ো মানুষের দল একটু একটু করে ভারী হচ্ছে আর চেঁচামেচি বেড়ে চলেছে। তাদের কেউ কেউ আবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলছে, "মন্দিরেই যদি ঢুকতে না পারি, তাহলে টিকেট কেটে দেখতে আসার কোন মানে হয় না। টাকা ফেরত দেন।"

এত শোরগোল আর চেঁচামেচির মাঝেই আমরা তন্ময় হয়ে বুদ্ধকে দেখি- আহা, কী সুন্দর! আহা, কী অপূর্ব!
বান্দরবান মূল শহরে ফিরে 'কলাপাতা' রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। বেলা পড়ে এসেছে প্রায়। তবুও রেস্টুরেন্টে প্রচণ্ড ভীড়। আমাদের বসবার জায়গা হলো না। অগত্যা রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একজন ওয়েটার এসে চারটা চেয়ার দিয়ে গেলো বসবার জন্য।
আমাদের পাশেই এক দম্পতি দাঁড়িয়ে। স্বামী স্ত্রী ম্যাচিং করে একই ডিজাইনের হুডি পরেছেন। আর বাবার আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে আছে বছর চারেকের একটা মেয়ে। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখছে মানুষের ব্যস্ততা, মানুষের ছুটোছুটি। অয়ন আর সালমান ভাই তাদের দিকে তিনটে চেয়ার এগিয়ে দিলেন, "ভাইয়া, আপনারা বসেন।"
বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের খাবারের ব্যবস্থা হলো। অর্ডার দিলাম- ভাত, ডাল, আলুভর্তা আর মুরগির মাংসের। খাওয়ার সময় জানালার ওপাশে সেই দম্পতিকে আবার দেখতে পেলাম। স্ত্রী স্বামীর চুল ধরে টানাটানি করছেন আর স্বামী ব্যথা পাওয়ার মিথ্যা অভিনয় করছেন। বাবা- মা'র অনর্থক ভাঁড়ামি দেখে ছোট মেয়েটা হি হি করে হাসছে। বাচ্চাটার হাসি দেখে আমারও হাসি পেলো। হাসি বড় সংক্রামক। অকারণেই হাসি সংক্রমিত হয়। আমি ঠোঁট টিপে টিপে হাসছি। তাঁরা এখন জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলোর একটা পার করছেন কীনা!

আমাদের বিকেলটা কাটলো নীলাচলে।
নীলাচল, বাংলাদেশের দার্জিলিং। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ছ' কিলোমিটার দূরে টাইগার পাড়ার পাহাড়চূড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্র। যেখান থেকে মেঘ ছোঁয়া যায়। অবাক মেঘের বাড়ি- কথাটা নীলাচলের জন্য কোনরকম সন্দেহ ছাড়াই প্রযোজ্য।
পাহাড়চূড়ার অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটা অংশে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদ ছুঁয়ে

যাচ্ছে আমাদেরকে।
পাহাড়চূড়া থেকে যতদূর চোখ যায় জমাট বাঁধা কুয়াশা আর পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। এর মাঝেই আবছা দেখা যায় পাহাড়, বান্দরবান শহর। এরপর বোধ করি সমুদ্র... দৃষ্টি অতটা পৌঁছায় না।পাহাড়ের সবুজ আর আকাশের নীল ছুঁয়ে ভেসে থাকা সাদা মেঘ, জমাট বাঁধা ধূসর কুয়াশা কী এক অদ্ভুত মোহ সৃষ্টি করে!
সালমান ভাই নীলাচল আগে একবার এসেছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই একটা স্টাডি ট্যুরের সময়। উনি বললেন, "এখানেই থাকবা? আরো জায়গা আছে তো দেখার।"
আমি, অয়ন আর পান্থ সালমান ভাইয়ের পিছু পিছু হাঁটি। পথের মাঝে একটা ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারের সিঁড়ি ধরে একগাদা আণ্ডাবাচ্চা ঝোলাঝুলি করছে। অতএব, ওয়াচ টাওয়ারে ওঠার ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখতে হলো।


নীলাচলে যে পার্কের মতো জায়গাটা আছে ওখানে বড় বড় দু'টো স্লাইড। ছেলে- বুড়ো সবাই বিপুল উৎসাহে স্লাইড বেয়ে নামছে আর হাত- পা ছুঁড়ে বাচ্চাদের মতো হাসছে। বছর পঞ্চাশেকের কাঁচাপাকা চুলের এক ভদ্রলোককে দেখলাম স্লাইডিং করতে গিয়ে নিচে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। আমরা ভাবলাম, উনি ব্যথা পেলেন কীনা। তারপর দেখি, উনি দু'পা ছড়িয়ে উঠে বসে হো হো করে হাসছেন।
বুড়ো বয়সে ছোট হয়ে যাওয়ার আনন্দ বোধহয় সবচেয়ে বেশি। যে আনন্দে কোন ফাঁক থাকে না, যে আনন্দ নির্ভেজাল হাসির মতোই ভীষণ সংক্রামক, নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে অন্যদের মাঝেও।
সেদিন আমরা সূর্যাস্ত দেখলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ষোলশ' ফুট উঁচুতে, রেস্ট হাউজের রেলিং- এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। সোনালী- হলুদ সূর্যটা একদম পশ্চিমে পাহাড় আর কুয়াশা ছুঁয়ে অস্ত যাচ্ছে। দেখতে দেখতে হলুদ সূর্যটার রঙ হয়ে গেলো কমলা, এরপর আরো কমলা... তারপর টকটকে লাল। পশ্চিম আকাশে লাল আলো ছড়াতে ছড়াতে সূর্যটা যেন পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ছে। ঘুমে যেন দু' চোখ লেগে আসছে সারাদিনের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত সূর্যটার। এরপর ঘুম, ঘুম, ঘুম। পাহাড়ের ওপাশে সূর্য হারিয়ে গেলো। আর আমি দেখলাম জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সূর্যাস্তগুলোর একটা।
সন্ধ্যায় হোটেলের সামনে যখন মাহিন্দ্রা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করছি, এমন সময় একজন পুলিশ অফিসার এসে মাহিন্দ্রা চালককে আটকালেন।
সাদ পোশাকের পুলিশ অফিসার। বিকেলে স্ত্রী- কে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন।
প্রথমদিকে আমরা অতটা খেয়াল করি নি। একসময় দেখি, ভদ্রলোক চেঁচামেচি শুরু করেছেন। ড্রাইভারকে বললেন তার লাইসেন্স দেখাতে। লোকটা ভীত চেহারা নিয়ে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে পুলিশ অফিসারের হাতে দিলো।
অফিসার সাহেব মাহিন্দ্রা চালককে কান ধরে উঠবস করাচ্ছেন; আমরা এগিয়ে গেলাম,
"আঙ্কেল, কী হইসে?"
এরপর অফিসার যা বললেন তার সারসংক্ষেপ মোটামুটি এরকম-
অন্ধকারে ছিলেন বলে আপনারা বোঝেন নি কিন্তু আমরা দেখেছি। খাঁদের পাশ দিয়ে বাঁক ঘুরবার সময় একটা বাস আপনাদের ঠিক গা ঘেষে চলে গিয়েছে। বাসের লুকিং গ্লাস ছিলো আপনাদের মাহিন্দ্রার ওপর। বাঁক ঘুরবার সময় আপনাদের মাহিন্দ্রার ড্রাইভার কোন সিগনালই দেয় নি। হর্ন দেয় নি। সে কোন সিগনাল না দিয়েই টার্ন নিতে চেয়েছিলো। আরেকটু হলেই আপনারা এখন খাঁদে পড়ে থাকতেন।

আমরা থমথমে মুখে নিজেদের রুমে ফিরে আসলাম। পান্থ বারবার বলছে, "আরেকটু হলে মরে যেতাম ভাই! এটা কিছু হলো?"
এরপরও অয়নদের রুমে আমরা তাস বের করে বসলাম। সালমান ভাই এ ব্যাপারে একদম আনাড়ি। তাঁকে পান্থ সময় নিয়ে কল ব্রিজ শেখালো। প্রথম খেলায় দান জিতে সালমান ভাইয়ের সে কী হাসি! কিছুক্ষণ আগে মনের মধ্যে জমে ওঠা ভয় ভয় মেঘ কেটে গেলো। আমরা তাসের কার্ডে মন দিলাম।
রাত সাড়ে আটটার দিকে আমরা রাতের খাবারের জন্য বেরোলাম। বাসস্ট্যান্ড ফেলে কিছুদূর সামনে এগোলেই বাজার। সাঙ্গুর তীরে একটা হোটেলে খাওয়া- দাওয়া হলো : সাদাভাত, মুরগি, সবজি, টাকি মাছের ভর্তা, শিম ভর্তা আর ডাল। আমাদের পেটে তখন রাজ্যের ক্ষুধা।

পৃথিবীর সকল শহর যেন রাতের জন্যই তৈরি। এত রঙের আলো, এত ব্যস্ততা শহরগুলোকে অপার্থিব করে তোলে। বাজারের পরই সাঙ্গু ব্রিজ। ব্রিজের ওপাশে বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট।
সাঙ্গু ব্রিজের নিচে টিন আর কাঠের ছোট ছোট খুপড়ি মতো ঘর। খুব সম্ভবত বস্তির বিকল্প কিছু একটা। এই ট্যুরে শুরু থেকেই অয়ন বলে চলেছে, "ভাই, বান্দরবান আসলাম কিন্তু বান্দর তো দেখি না কোথাও।"
অয়নের ইচ্ছা পূরণ হলো। আমরা হোটেল থেকে খেয়ে বেরিয়েছি এমন সময় ওই খুপড়ি বাসাগুলোর একটা থেকে একটা বানর ছুটে বেরিয়ে এলো। পোষা বানর। বানরটার পেছনে হৈহৈ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে এলো বানরের মালিক। ছিপছিপে গড়নের এক কিশোর। তখন ইচ্ছেপূরণের আনন্দে অয়নের হাসি দু' কান ছুঁয়েছে।
সাঙ্গু ব্রিজের ওপর লাল- সবুজ- নীল- হলুদ স্ট্রিট লাইট। আর সাথে জাঁক দিয়ে পড়ছে কুয়াশা। আমরা সাঙ্গু ব্রিজে দাঁড়িয়ে সাঙ্গু নদী দেখি, আলো ঝলমলে বান্দরবান শহর দেখি।

শহরের শহীদ মিনারটা লাল- সবুজ বাতি দিয়ে সাজানো। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর শহীদ মিনারগুলোর একটা। আমরা শহীদ মিনারের বেদির সামনে কুয়াশাভেজা দূর্বাঘাস মাড়িয়ে হাঁটি। হোটেলে ফিরতে হবে। সামনে একটা বড় দিন অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।

খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯, শুক্রবার। পাশের বেডে সালমান ভাই মুখ ভোঁতা করে বসে আছেন৷ ব্যাপারটা হলো, গতরাতে হোটেলের কোন এক রুমে মধ্যবয়স্ক কোন লোক মাতলামি করেছে৷ চেঁচামেচি, অশ্রাব্য গালাগাল করে পুরো হোটেল মাথায় তুলেছে। আর ওদিকে আমি আর পান্থ মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। সালমান ভাই আর অয়ন দু'চোখের পাতা এক করতে পারেন নি কোনভাবেই।
আমি বিছানায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি, ঘুমের রেশ তখনো কাটে নি। এর মাঝেই দেখলাম, সালমান ভাই গোসল সেরে আসলেন। মাথা মুছতে মুছতে বললেন, "বইসা আছো কেন ব্রো? রেডি হইয়া নাও।"

সকাল ছ'টার কিছু পরে হোটেলের রিসিপশনে চাবি জমা দিয়ে চেক আউট কমপ্লিট করে বেরোলাম। পুরু লেদারের জ্যাকেটেও আমার শীত মানছে না। সেলফোনে দেখলাম, টেম্পারেচার নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমি আর অয়ন সালমান ভাই আর পান্থকে পেছনে রেখে এগিয়ে গেলাম। রোয়াংছড়ির বাসের টিকেট কনফার্ম করতে হবে। সাঙ্গুর দু'ধারে ঘন কুয়াশা। আমরা ভোরের সাঙ্গু নদী দেখে আরো একবার অবাক হলাম। পাহাড়ি নদীগুলো এত মায়াময় হয় কেন?
বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি।
পাহাড় কেটে তার মাঝ দিয়ে রাস্তা বানানো। রাস্তার দু'পাশে পাহাড়ের ঢালে বড় বড় গাছগুলো কেমন সবুজ একটা টানেল তৈরি করেছে। কাটা পাহাড়ের শেষে একটা ছোট বাসস্ট্যান্ড। একটা টিনের তৈরি বাস কাউন্টার আর তার সাথে লাগোয়া একটা ছোট চা- সিগারেটের দোকান। সামনে একটুখানি খোলা জায়গা। ওখানেই বাস থামে। চারটা টিকেট কনফার্ম করা হলো।

ছোট্ট বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল ঠিক আটটা বাজে বাস ছাড়লো। আমরা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে রোয়াংছড়ির উদ্দেশ্যে ছুটছি। রাস্তার দু'পাশে কখনো গভীর খাঁদ, কখনো পাহাড়। আকাশে ধূসর মেঘ আর পাহাড়ের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসছে যেন মাঝারি ধরণের কুয়াশা। এর মাঝেই আমাদের বাস ছুটে চলেছে। কখনো খাড়া ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আবার কখনো সোজা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আর আমরা বড় বড় চোখে পাহাড় দেখছি, মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ দেখছি।

রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ড পেরোলেই টেরেক খাল। এই খালের একটা দিক গিয়ে মিশেছে সাঙ্গু নদীতে, আরেকটা দিক মিশেছে দেবতাখুমে।
রোয়াংছড়ি বাজারে আমাদের সাথে আমাদের গাইডের দেখা হলো। গাইডের নাম মং মারমা। হাসিখুশি, আন্তরিক একজন মানুষ। একটা হোটেলে বসে দু'টো ফরমে আমরা আমাদের ব্যাসিক ইনফোগুলো পূরণ করলাম। প্রতিটা ফরমের সাথে একটা করে আইডি কার্ডের ফটোকপি। এগুলোর একটা জমা পড়বে পুলিশ চেকপোস্টে। আরেকটা জমা দিতে হবে কচ্ছপতলী আর্মি ক্যাম্পে।
রোয়াংছড়ি বাজার থেকে একটা মাহিন্দ্রা ঠিক করা হলো। এখানেও সেই পাহাড়ি পথ। আমরা নিজেদের নিঃশ্বাস চেপে চোখ বড় বড় করে মাহিন্দ্রায় বসে আছি। উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ ধরে আমাদের মাহিন্দ্রা ছুটে চলেছে।

দেবতাখুমের একটা গল্প আছে। পৌরাণিক গল্প বলতে পারেন খানিকটা। 'খুম' শব্দের অর্থ জলাশয়। দেবতাখুম বলতে বোঝায় দেবতার জলাশয়। কচ্ছপতলী থেকে টেরেক খালের অববাহিকা ধরে ট্র‍্যাকিং করতে করতে পৌঁছাবেন শিলাবদ্ধ পাড়ায়। এখানে স্থানীয় মারমা উপজাতির বাস। তাদের নিজস্ব মোড় আছে, নিজেদের স্বকীয় কিছু আচার- ব্যবহার আছে। এই মানুষগুলো মনে করে : দেবতাখুমের কোন তল নেই, খুমের নিচে মাটি নেই। খুমের গভীরে দু'টো 'স্বর্ণ মাছ' বাস করে খুম সৃষ্টির পর থেকেই। মাঝে মাঝে তাদের দেখা যায়। তারা গ্রামবাসীর সৌভাগের প্রতীক, শক্তির প্রতীক, মাছগুলো তাদের মৎস দেবতা।
মানুষগুলো শিকার করে, মাছ ধরে, পাহাড়ের ঢালে কৃষিকাজ করে পুরো জীবনটা কোন রকম ঝুট ঝামেলা ছাড়াই পার করে দেয়।
ওহ.. হ্যাঁ, দেবতাখুমের গভীরতা মোটামুটি ত্রিশ ফুট।

কচ্ছপতলী পৌঁছে আমরা নিজেদের জামা- কাপড় বদলে নিলাম। ভারী জ্যাকেট আর জিন্স বদলে টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার ট্রাউজার। টেম্পারেচার তখন বারো থেকে চৌদ্দ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে।
আর্মি ক্যাম্পে সব ধরণের ব্যাসিক ইনফো আর কাগজপত্র জমা দেওয়া হলো। পুলিশ ফাঁড়িতে কাগজপত্র আগেই জমা দেওয়া হয়েছে। কচ্ছপতলীর একটা আদিবাসী পাড়ার মধ্য দিয়ে কিছুদূর এগিয়েই আবার টেরেক খাল। ওখান থেকেই আমাদের ট্র‍্যাকিং- এর শুরু।
দু'টো বড় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে টেরেক খাল। পাহাড়ের গায়ে জন্মেছে পত্রঝরা আর চিরহরিৎ বৃক্ষ, বিশালাকৃতির ফার্ন আর পাহাড়ি কলাগাছ। আমরা কিছুক্ষণ খালের পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটছি আবার কিছুক্ষণ পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
একটা জায়গায় এসে পান্থ দাঁড়িয়ে গেলো, "ভাই, এই গাছগুলা দেখেন তো?"
আমি একটু ঝুঁকে এলাম। ফার্নের মতো দেখতে কিছুটা। পপি গাছ। আফিম।

পৌনে দুই ঘণ্টা ট্র‍্যাকিং- এর পর আমরা এসে পৌঁছলাম শিলাবদ্ধ পাড়ায়। এই সেই আদিবাসী গ্রাম। এটা পেরোলেই খুমের শুরু।
ছোট্ট গ্রামটাকে ঘিরে আছে নারিকেল গাছ। একটা বাঁশের টংঘরে বসে এক বৃদ্ধা গাছের ছায়ায় আয়েশ করে পাইপ টানছেন। দু'জন বাচ্চা আবার পোষা কুকুরের পিঠে ওঠা নিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়েছে। আদিবাসী নারীদের কেউ তাঁত বোনায় ব্যস্ত আবার কেউ রান্না বান্নার কাজে ব্যস্ত। শিলাবদ্ধ পাড়ার শেষ প্রান্তে একটা বাঁশের মাচা। মাচায় বসে দেবতাখুমের পাহাড় দু'টোকে দেখতে দেখতে বোধ করি কয়েকটা বছর ক্লান্তিহীনভাবে অনায়াসে পার করে দেওয়া যায়। কিন্তু এরকম ভয়ানক সৌন্দর্যের কাছে বেশিক্ষণ থাকতে হয় না। আমরা শিলাবদ্ধ পাড়া থেকে নিচে নেমে এলাম।

শিলাবদ্ধ পাড়া থেকে নিচে নেমে আসতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধালাম আমি। আমার অ্যাক্রোফোবিয়া আছে। সহজ বাংলায় যেটাকে বলে 'উচ্চতায় ভয়'। সরু একটা পাথর খোঁদাই করে বানানো লম্বা সিঁড়িটা বেয়ে নিচে নেমে আসতে বেশ কসরত করতে হলো আমাকে। আমার সীমাবদ্ধতা আমি এখানে অকপটে স্বীকার করছি।
নিচে, ভেজা ভেজা বালির ওপর একদল আদিবাসী ছেলে- মেয়ে খেলছে। আমাদের ইচ্ছা হলো, বাচ্চাগুলোর সাথে ছবি তুলবো। মং আঙ্কেল মারমা ভাষায় তাদেরকে ডাকলেন। ওরা আমাদের চারপাশে এসে জড়ো হলো। মং আঙ্কেল 'রে' বলেন আর ওরা খিলখিল করে হেসে ওঠে। আর আমরা ছবি তুলি। পরে মং আঙ্কেলের কাছ থেকে জেনেছিলাম, 'রে' মানে হলো হাসি।
ওখান থেকে দুই- তিন মিনিট হাঁটলেই একটা ঝুপড়ি মতো খাবার দোকান। সাথে ভেলা আর লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থাও তারাই করে। আমরা খাবারের অর্ডার দিলাম। চারজনের জন্য লাইফ জ্যাকেট নিলাম। লাইফ জ্যাকেট পরে মং আঙ্কেলের সাথে হাঁটছি। এখান থেকে আরো কিছুদূর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে যেতে হবে৷ তারপর টেরেক খাল ধরে নৌকায় চড়ে দেবতাখুম।
এই জায়গাটাতে টেরেক খালের পানির রঙ সবুজ আর নীলের মাঝামাঝি। খালের দু'পাশে পাহাড়। পাহাড়ের পাথুরে শরীরে জমে আছে শ্যাওলা। এই জায়গাটাকে খাল না বলে গিরিখাঁদের শুরু বললে বেশি উপযোগী হয়।
এখানেও পাহাড়ের গায়ে জন্মে আছে বিশালাকার ফার্ন আর পাহাড়ি কলাগাছ। এখানে ওখানে পাথুরে মাটি ভেদ করে ওঠা কিছু মাঝারি আকৃতির চিরহরিৎ বৃক্ষ। এর মাঝ দিয়ে চলতে চলতেই আমাদের নৌকা মূল খুমের সামনে একটা পাথুরে জায়গায় এসে ভিড়লো। এখান থেকে ভেলা নিয়ে এগোতে হয়।


আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন সেখানে ভেলার সঙ্কট চলছে। একটা ভেলাও সেই পাথুরে ডাঙ্গায় ভেড়ানো নেই। আমাদের চারজনের পিছু পিছু সেখানে এসে পৌঁছলো ছয়জনের আরো একটা গ্রুপ। দুই জন নারী আর চারজন পুরুষ। পুরুষদের মধ্যে একজন বয়স্ক। লোকটা তার মাথার টাক কাউবয় হ্যাট দিয়ে ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার কেন জানি খুব হাসি পেলো। দেবতাখুমের সাথে কাউবয় হ্যাট বেমানান কিন্তু মাথার টাক বেমানান নয়। নিজের অপূর্ণতাকে স্বীকার করতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু মানুষ কোন এক বিচিত্র কারণে নিজের অপূর্ণতাকে মেনে নিতে চায় না। তার দলের বাকি পাঁচজন যুবক- যুবতী। কিছুক্ষণ পর যখন পাথুরে ডাঙ্গায় একটা- দু'টো ভেলা ভিড়তে শুরু করলো তখন সেই ছয় জন তাড়াহুড়ো করে ছুটে গিয়ে ভেলাগুলো দখল করলো। আমরা হাসলাম।
অবশেষে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পরে আমরা নিজেদের জন্য দু'টো ভেলা পেলাম। সালমান ভাই আর অয়ন উঠলেন একটাতে। আমি আর পান্থ অন্যটায়।
আমাদের চারজনের মধ্যে আমার জন্য এটা ভেলা চালানোর প্রথম অভিজ্ঞতা। আমি একদমই আনাড়ি। অয়ন আর পান্থ ভেলা না চালালেও তাদের কায়াকিং করার অভিজ্ঞতা আছে। আর সালমান ভাই এদিকে বেশ পুরোনো মানুষ। ছোটবেলায় কলাগাছের ভেলা বানিয়ে তাকে সেই ভেলায় চড়ে বর্ষাকালে স্কুলে যেতে হতো কীনা!

ভেলায় আমি বসেছি সামনে আর পান্থ পেছনে। প্রথম দশ পনেরো মিনিট আমাকে দাঁড় বাওয়ার ব্যাসিক শেখাতেই পার হয়ে গেলো। দাঁড় হিসেবে আমাদের হাতে আছে একটা করে চার ফুট লম্বা কাঁচা বাঁশ। ওগুলো দিয়েই খুমের শান্ত নীল পানি কেটে এগিয়ে চলেছি আমরা। আমাদের ওপর দেবতাখুমের দু'পাশের বিশাল পাহাড়দু'টোর ছায়া এসে পড়েছে।
খুমের শুরুর দিকের একটা প্রশস্ত অগভীর অংশে সবসময়ই ভেলার জ্যাম লেগে থাকে। কিছুটা এলাকার মোড়ের বাস স্টপেজের মতো অবস্থা। কেউ ভেলা থামিয়ে ছবি তুলছে। কেউ ফিরতি পথে ভেলা ঘোরাচ্ছে আবার কেউ আমাদের মতো খুমের ভেতরে প্রবেশ করছে।
আমার আর পান্থ- র ভেলা দুইবার অগভীর জায়গায় নিচের পাথরে আটকে গেলো। বেশ ধাক্কাধাক্কি করে, বেশ কায়দা করে ভেলার এই সমস্যা দূর করা হলো।

ভেলা এগিয়ে চলেছে দেবতাখুমের শান্ত নীল পানি কেটে। আমার আর পান্থ'র তখন অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসেছে- সবুজের নেশা, স্বচ্ছ নীল পানির নেশা। আমরা দুইজন ভেলায় বসে হাঁটু অব্দি পা ডুবিয়ে দিয়েছি খুমের বরফশীতল পানিতে। খুমের শেষপ্রান্তে দুই পাহাড়ের মাঝে শেষ বাঁকটা অপার্থিব সুন্দর। এই সৌন্দর্য লিখে বা বলে প্রকাশ করা অসম্ভব। কিছু সৌন্দর্য শুধু দেখেই বোঝা যায়, উপলব্ধি করা যায়। সেইসব সৌন্দর্যকে লিখে বা বলে প্রকাশ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দেন নি।
আমি আর পান্থ সালমান ভাইদের সাথে দেবতাখুমের শেষ বাঁকটার কাছে গিয়ে একসাথে হলাম। দু'টো ভেলা পাশাপাশি রেখে চারজন একসাথে সামনে এগিয়ে যাই আর মুগ্ধ চোখে দেবতাখুম দেখি।

খুমের শেষ প্রান্তে গিয়ে সালমান ভাই পাথরে ভেড়ানো আরেকটা ভেলা নিলেন। আমি আর পান্থ একটা ভেলায় আর অয়ন- সালমান ভাই ভিন্ন দু'টো ভেলায়। আমাদের গাইড মং আঙ্কেল অন্য ভেলা থেকে তাড়া দিচ্ছেন বারবার। আমাদের ফিরতে হবে।
ভেলা থেকে পাথুরে ডাঙ্গায় নামবার পর আমি আর পান্থ বুঝতে পারলাম কী ভুলটা করেছি! ঠাণ্ডা পানিতে দীর্ঘক্ষণ ডুবিয়ে রাখায় আমাদের দুই জনের পা অসাড় হয়ে গিয়েছে। আমি দাঁড়াতেই পারছিলাম না। নৌকায় টেরেক খালের অংশটুকু পেরোবার পর খাবারের দোকানে পৌঁছানোর পথটুকুতেই আমি আবার বিপত্তি বাঁধালাম। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পা আর চলে না। মং আঙ্কেল আমাকে ধরে ধরে পাহাড়ের ঢালটুকু পার করালেন।

খাবারের দোকানটায় পৌঁছে লাকড়ির চুলার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের ভেজা জামাকাপড় শুকোলাম। আগুনের কাছে যাওয়ার পর আমার পায়ের স্নায়ু কাজ করতে শুরু করেছে৷ আমরা হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। খাবারের অর্ডার ছিলো- সাদাভাত, সেদ্ধ ডিম, সবজি, ডাল আর আলুভর্তার। খাবার যখন সার্ভ করা হলো টেবিলে, আমরা চারজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। দেশি মুরগি তো আমাদের অর্ডারে ছিলো না। তখন মং আঙ্কেল মুচকি হাসলেন, "ভাইয়া, এগুলা আপনারা খান। এগুলা আমার পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য ছোট্ট গিফট। আপনারা ভালো মানুষ।"
মানুষটার কথা শুনে আমরা হাসলাম। খেতে বসে আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। মং আঙ্কেলের সালমান ভাইকে খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি হাসছেন আর আবদুল্লাহ সালমান নামের গোলগাল থলথলে মানুষটাকে কিছুক্ষণ পরপর 'ইস্পাত ভাই' বলে ডাকছেন।

আমরা যখন কচ্ছপতলী আর্মি ক্যাম্পে ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা। ডিসেম্বরের বিকেল খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। হঠাৎ করেই বঙ্গদেশে অন্ধকার নামে। ট্র‍্যাকিং এর কিছু পথ আমাদেরকে মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ক্যাম্পে বসে থাকা মিলিটারি আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, "ফিরে আসার সময় কখন ছিলো আপনাদের?"
মং আঙ্কেল কাচুমাচু মুখে বললেন, "সাড়ে পাঁচটা।"
"পনেরো মিনিট লেইট কেন?"
সালমান ভাই হাসি হাসি মুখে বললেন, "আমরা ঠিকঠাক পাহাড় বাইতে পারি না তো..."
চেকপোস্টে বসে থাকা গোমড়ামুখো আর্মি সদস্য হো হো করে হাসতে শুরু করলেন।
আমাদের ফিরতে হবে। কচ্ছপতলী থেকে বান্দরবান। সেখান থেকে কোন একটা বাস ধরে চট্টগ্রাম। রোয়াংছড়ি থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে শেষ বাসটা অনেক আগেই ছেড়ে গিয়েছে। মং আঙ্কেল আমাদেরকে কচ্ছপতলী থেকে বান্দবান শহর পর্যন্ত একটা মাহিন্দ্রা ঠিক করে দিলেন।

আমরা যখন মাহিন্দ্রায় চড়ে বসবো তখন আমি মং আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করলাম, "আঙ্কেল, তারা'কে মারমা ভাষায় কী বলে?"
"ক্রে।"
আমি এক লাফে মাহিন্দায় উঠে বসলাম।
মাহিন্দ্রা ছেড়ে দিয়েছে৷ মং আঙ্কেল এক আকাশ তারার নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে নেড়ে চোখ মুছছেন, "ভাইয়া, আবার আসবেন পারলে। ভালো থাকবেন খুব।"
কেন জানি না, মাত্র একদিনের পরিচিত মধ্যবয়ষ্ক মানুষটার জন্য আমার চোখের কোণ ভিজে উঠলো। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। এই মনে কোন যুক্তি খাটে না। যুক্তিতে সবকিছু হয় না বোধহয়!
এবার বাড়ি ফিরতে হবে।

মুনতাহার মন ভালো হয়ে গেল...................মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন

মুনতাহার মন ভালো হয়ে গেল...................মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন
মুনতাহা ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। খুব মেধাবী ছাত্রী। ক্লাসে কেউই তার সাথে পড়াশুনায় পারে না। এজন্য যারা তার সাথে প্রতিযোগিতায় পারে না তারা মনে মনে খুব হিংসে করে। কিন্তু হিংসে করলে কী হবে? মুনতাহার সাথে কেউ কোনো খারাপ আচরণ করতে পারে না। কারণ মুনতাহা শুধু মেধাবীই নয় বরং তার রয়েছে অপূর্ব এক গুণ।
সে খুব সহজেই যে কোনো কাউকে বন্ধু বানিয়ে নিতে পারে। কারো সাথে কখনো ঝগড়া-বিবাদ করে না। কোনো সহপাঠী পড়া জিজ্ঞেস করলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়। এসব কারণে শুধু তার সহপাঠীরাই নয় বরং তার শিক্ষকরাও তাকে খুব স্নেহ করেন, অনেক সময় বাড়তি যত্নও নেন।
মুনতাহা তার বাবা, মা, চাচা, চাচী এবং তার চেয়ে যারা বড় তাদের সকলকেই খুব সম্মান করে আর যারা তার ছোট তাদের প্রতি রয়েছে তার এক সহজাত স্নেহপ্রবণ মন।
এতকিছুর পরেও কিন্তু মুনতাহার ভেতরে রয়েছে আলাদা একটি বিষয়। তা হলো, সে যে কোনো কিছুতেই খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন, যদি তার মনের মতো কোনো কিছু হয়ে যায় তাহলে সে যেমন আহলাদে আটখানা হয়ে যায় ঠিক তেমনি তার বিপরীত হলে মন বিষন্নতায় ভরে যায়।
এই যেমন ধরো, যখন স্কুলে পরীক্ষা চলে তখন তার মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। সারাক্ষণ মনে হয়, যদি পরীক্ষায় নাম্বার কম পাই, যদি ক্লাসে সেকেন্ড হয়ে যাই কিংবা যদি পরীক্ষার সময় অসুস্থ হয়ে পড়ি। এজন্য সব সময়ই সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। অহেতুক কোনো সময় নষ্ট করে না। এই এতো অল্প বয়সেও সে ক্লাসের পড়া সব শেষ না করে কখনো খেতে বসে না কিংবা ঘুমাতে যায় না। এ রকম দুশ্চিন্তার কারণে অনেক সময় তার পড়াশুনায় মন বসাতে খুব কষ্ট হয়। আবার অনেক সময় সে পরীক্ষায় জানা উত্তরও ভুল লিখে চলে আসে।
যদি এমন কোনো বিষয় আসে যা মুনতাহা করতে পারছে না বা সে যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে ঘটছে না তখন তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, বিষন্নতা পেয়ে বসে, সে হতাশ হয়ে পড়ে। সে করতে পারছে না কিংবা যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে হচ্ছে না বলেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়।
একদিন সে খুব খুশি হয়ে এক রকম নাচতে নাচতেই স্কুল থেকে বাসায় ফিরলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো ব্যাপারে ভেতরে ভেতরে সে খুব উত্তেজিত। যখন সে বাসায় ফিরলো, তখন তার মা রান্না ঘরে বিকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। সে বাসায় ঢুকেই গড়গড় করে বলতে শুরু করলো, জানো মা, আগামী শুক্রবারে আমরা সকলে স্কুল থেকে পিকনিকে যাবো। খুব মজার মজার খাবার থাকবে। সারাদিন আমরা অনেক খেলবো - লুকোচুরি, কানামাছি, লুডু ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে যারা গান জানে, তারা গান গাইবে। আমাদের টিচাররাও নাকি গান শুনাবেন। খুব মজা হবে তাই না, মা?
হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। এ রকম হলে তো বেশ মজাই হবে। ঠিক আছে, স্কুল থেকে এসেছো, এখন হাত মুখ ওয়াশ করে নাস্তা খেয়ে পড়তে বসো। তাড়াতাড়ি হোম-ওয়ার্ক শেষ করতে হবে।
মুনতাহা মা’র নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করলো। ড্রেস চেঞ্জ করে হাত মুখ ওয়াশ করে পড়তে বসলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে খুব উত্তেজিত। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো, আগামী শুক্রবারে কতোই না মজা করবে তারা। এমন সময় হঠাৎই তার মন থেকে খুশির ভাব দূর হয়ে দুশ্চিন্তা এসে ভর করলো। তার মনে হলো, ‘যদি আমি শুক্রবারের আগে অসুস্থ হয়ে পড়ি? তাহলে তো আর আমি পিকনিকে যেতে পারবো না। সারাদিন আমাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে আর আমার বন্ধুরা সব কতো মজা করবে, খেলবে, ফড়িং ধরবে।’
রাতের খাবারের কিছু আগে মুনতাহা’র বাবা সানাউল্লাহ অফিস থেকে ফিরলেন। তিনি ফ্রেস হবার পর মুনতাহা’র মা লোপা সকলকে খাবার জন্য ডাইনিং টেবিলে ডাকলেন। তারা সকলে একত্রে খেতে বসলো। কিন্তু মুনতাহা একদম চুপচাপই বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে থেকেই তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। কিছুতেই সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। লোপা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, যে মেয়ে কতক্ষণ আগেই স্কুল থেকে খুশিতে লাফাতে লাফাতে এলো তার হঠাৎ করে কী হলো? সানাউল্লাহও মেয়ের চুপচাপ থাকা লক্ষ্য করেছেন। কারণ তিনি জানেন, প্রতিদিন খেতে বসে মুনতাহা কত কথা বলে।

মা, তুমি আজ স্কুলে সারাদিন কী করেছিলে? মুনতাহা’র বাবা জানতে চাইলেন।

আমরা আজকে অনেক নতুন কিছু শিখেছি। মুনতাহা আরো বললো, জানো বাবা, আজকে আমাদের টিচার আমাকে বোর্ডে ডেকে একটা অংক করতে দিয়েছিলেন আর আমি একটুও ভয় না পেয়ে ঠিকভাবে তা করেছি।

খুব ভালো করেছো, সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি কী তোমার স্কুলের সুখবরটা তোমার বাবাকে দিতে ভুলে গেলে? মুনতাহার মা বললো।

বাবা, আমরা আগামী শুক্রবারে স্কুল থেকে পিকনিকে যাচ্ছি।

খুব ভালো কথা মা। কিন্তু তোমাকে তো তার জন্য খুশি মনে হচ্ছে না।

লোপা বললেন, তুমি যখন স্কুল থেকে এলে তখন তোমাকে খুব বেশি উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো কিন্তু এখন কেমন যেনো বিষন্ন মনে হচ্ছে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এমন কী হলো যে তোমার মনটা এতো খারাপ হয়ে গেলো।

হ্যাঁ মা, তুমি ঠিকই বলেছো। আমি যখন স্কুল থেকে এলাম তখন সত্যিই আমি মনে মনে খুব খুশি ছিলাম। কিন্তু এরপর যখন আমি হোমওয়ার্ক করতে বসলাম তখন হঠাৎ করেই একটা বাজে চিন্তা মাথায় এসে আমার মনটা ভীষণ খারাপ করে দিলো।

বাবা বললেন, কী সে বাজে চিন্তা যা তোমার মনকে এতো খুশির সময়ও চুপচাপ করে রেখেছে?

বাবা, আমি যদি শুক্রবারে অসুস্থ থাকি তাহলে তো আর পিকনিকে যেতে পারবো না। আমার বন্ধুরা সকলে কতো মজা করবে আর আমি সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটাবো!

মা বললেন, দেখো মা, তুমি কিন্তু এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আর আমরা কেউই বলতে পারি না যে, একটু পরে কী ঘটতে যাচ্ছে। সামনে কী ঘটবে, না ঘটবে সে ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। তাহলে চিন্তা করে দেখো, তুমি এমন এক বিষয় নিয়ে মন খারাপ করছো যা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।

তার বাবা আরো যোগ করলেন, দেখো মা, এটা তোমার এ জন্যই মনে হচ্ছে যে, যা এখনও ঘটেনি সে ব্যাপারে শয়তান তোমার মাথায় সারাক্ষণ একটা খারাপ চিন্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমাদের মনে যতো খারাপ চিন্তা আসে কিংবা আমরা যতো দুশ্চিন্তা বা উদ্বিগ্নতায় ভুগি তার সবই শয়তান আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। “আর যদি প্ররোচিত করে তোমাকে শয়তানের প্ররোচনা তাহলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করো। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বোজ্ঞ।” [সুরা আল আ’রাফঃ আয়াত ২০০]

মুনতাহা, তার মা বললেন, যখনই তোমার মনে এসব খারাপ চিন্তা আসবে তখনই আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। দোয়া করবে, আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম।

তার বাবা বলতে লাগলেন, শোনো মা, আমাদের কার জীবনে কী ঘটবে তা আল্লাহ তা’আলা অনেক আগে থেকেই জানেন। যেহেতু তিনি আমাদেরকে অনেক ভালোবাসেন তাই আমাদের জন্য যেটা সবচেয়ে উত্তম সেটারই ব্যবস্থা সব সময়ে করে দেন। আমরা হয়তো ঠিকমতো বুঝতে পারি না। ধরো, তোমার যদি কোনো কারণে পিকনিকে যাওয়া না হয় তাহলে নিশ্চিত থাকবে তোমার জন্য এটাই সবচেয়ে মঙ্গলজনক। অনেক মানুষ আছে যারা ভুলে যায় যে, সব কিছুর মধ্যেই মঙ্গল আছে। কারণ হয়তো অনাকাঙ্খিত এমন দু’একটা ঘটনা তাদের সামনে ঘটে যার ফলে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। অথচ এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ কোনো না কোনো এক উসিলায় অলৌকিকভাবে সে বিপদ থেকে উদ্ধারও করতে পারেন। কিন্তু ঐ সকল মানুষ এভাবে চিন্তা করে না বলে তারা খুব সহজেই হতাশ হয়ে পড়ে। আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস কম বলেই এমন অবস্থা হয়।

মুনতাহা ঘাড় নাড়লো, হ্যাঁ, আমি এখন বেশ ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছি। আল্লাহ হলেন আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এখন থেকে যখনই আমার মনে কোনো খারাপ চিন্তা আসবে, তখনই আমি তাঁর কাছে আশ্রয় চাইবো, সাহায্য প্রার্থনা করবো এবং তাঁকে ধন্যবাদ দিবো আমাকে সবচেয়ে উত্তম জিনিস দিবার জন্য।

কুমারী মা ও একটি ভ্রুন ...............................রহিমা আক্তার মৌ (সেরা গল্প)

কুমারী মা ও একটি ভ্রুন ...............................রহিমা আক্তার মৌ (সেরা গল্প)
রপর বিশ থেকে পঁচিশটা কল করে সাড়া না পেয়ে নাবিলা কয়েকটা খুদেবার্তা পাঠায়।

"প্লিজ রাকিব কল ধরো।"
"প্লিজ রাকিব কল ধরো, জরুরী কথা আছে।"
রাকিব কল ও ধরেনি খুদেবার্তার জবাব ও দেয়নি। গতমাসের ৯ তারিখে নাবিলার পিরিয়ড হয়, এর আগের মাসে ১১ তারিখে, তার আগের মাসে ১৪ তারিখে। এই ভাবে প্রতি মাসে দুদিন করে এগিয়ে আসে বিশেষ দিনটা। কখনও আবার তিনদিনও এগিয়ে আসে। কিন্তু আজ ১০ তারিখেও পিরিয়ড না হওয়ায় চিন্তায় পড়ে ও। আর সে জন্যেই কল করে যাচ্ছে রাকিবকে।
রাকিব রায়হান একসময় রঙিন পর্দার মানুষ ছিলো, এখন সে ব্যবসায়ী। মাঝে মাঝেই ব্যবসা লাটে উঠে, আবার সময় সময় জোয়ারে ভাসে। রাকিবকে দেখলেই বুঝা যায় কখন তার ব্যবসার কি অবস্থা। নাবিলার অফিসের একটা কাজে দুজনের পরিচয়। পরিচয়ের পর প্রেম ভালোবাসা। দুই পরিবারের সবাই জানে ওদের সম্পর্কের কথা। রাকিবের পরিবারের একটা নিয়ম আছে। ছেলেদের অধিক বয়সে বিয়ে করানো। ওর বয়স ২৮ হলেও তার বড় দুই ভাই এখনো অবিবাহিত।

পরিবারের নিয়ম অনু্যায়ী বড় দুজনের বিয়ে হলেই রাকিব বিয়ে করতে পারবে। একজনের বিয়ে ঠিক হয়েছে, অন্যজনের জন্যে দেখাশুনা চলচ্ছে। রাকিবের জন্মদিন ছিলো গতমাসের ২৪ তারিখে। কয়েকজন বন্ধু আর নাবিলা সহ জন্মদিন পালন করে। জন্মদিনের আনন্দ শেষে রাকিব নিজেই নাবিলাকে বাসায় পৌছে দেবার জন্যে বের হয়, ঠিক তখনি মন এলোমেলো হয়ে যায়। পাশের এক আবাসিক হোটেলে চলে যায় দুজন। সারারাত সেখানে কাটিয়ে বাসায় আসে নাবিলা। এদিকে সারারাত নির্ঘুম কাটে ওর বিধবা মায়ের।
ছোট বেলায় ওদের দুই ভাই বোনকে আর ওর মাকে ছেড়ে বাবা নিরুদ্দেশ হয়। তখন ওদের বয়স মাত্র সাত আর পাঁচ। দুই সন্তান নিয়ে নাহার আক্তার গ্রামে চলে যান। সন্তানদের কথা ভেবেই আবার আসেন রাজশাহী শহরে। প্রায় পরেনো বছর পর ওরা বাবার সন্ধান পায়, কিন্তু কেউ কারো দায়িত্ব নিতে রাজি নয়, বা পরিচয় দিতেও রাজি নয়। এভাবে পার হয়ে যায় বছর তিন। গতবছর নাবিলার বাবা মারা যায়, খবর শুনে ওর মা বিধবার পোষাক পরেন। নাকের ফুল খুলে ফেলেন। বলতেই হয় হায়রে বাঙ্গালী নারী, যে স্বামী সন্তান জন্ম দিয়েই নিরুদ্দেশ সেই স্বামী মরার পর নিজেকে বিধবা পরিচয় দিচ্ছো। নাবিলার ভাই বিয়ে করেছে, চাকরির কারণে বউকে নিয়ে অন্য শহরে থাকে। বিকেল বেলায় রাকিব অন্য নাম্বার দিয়ে কল দেয় নাবিলাকে।

-- হ্যালো নাবিলা কেমন আছো?
নাবিলার মুখে কথা নেই, হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ওপাশ থেকে রাকিব কিছুই বুঝতে পারছে না। বারবার জিজ্ঞেস করে
-- নাবিলা কি হয়েছে তোমার, তুমি এমন করছো কেনো?
জবাব না পেয়ে রাকিব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। নাবিলা কাঁদতেই থাকে প্রায় মিনিট তিন। আস্তে কান্না থেমে আসে।
-- নাবিলা এবার বলো কি হয়েছে, খালাম্মার কোন সমস্যা।
-- না, আম্মা ভালো আছে। তুমি কই ছিলে, তোমার মোবাইল কোথায়? সকাল থেকে আমি কত কল দিয়েছি তুমি ধরোনি কেনো?
-- আস্তে বলো। আমায় তো কিছু বলতে দিবে। সকাল ভোরে বের হয়েছিলাম ব্যবসার কাজে। ছিনতাইকারী আমার সব নিয়ে যায়। সেই থেকে আমি বাইরে, প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ হারাই, সে জন্যেই দৌড়াচ্ছি। মোবাইলের সিম গুলো ও তোলা হয়নি। আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলো, এমন করে কি কেউ কাঁদে?
-- রাকিব তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে প্লিজ কালকেই দেখা করো।
-- তুমি বলো কি হয়েছে, কাল তো আমি সিমগুলো তুলতে যাবো। তুমি তো জানোই আমাদের কাস্টমার কেয়ার গুলোর যে অবস্থা। একটা সিম তুলতে দিনের অর্ধেক পার হয়ে যায়।
-- রাকিব তোমার সিমের চেয়ে ও এই বিষয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
-- বলবে তো কি হয়েছে।
-- রাকিব পিরিয়ডের তারিখ তিনদিন পার হয়ে গেছে, আমার পিরিয়ড হয়নি এখনো।
-- পাগল তুমি, কি বলো এসব, হবে না কেন? দেইখো আজ রাতেই হয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি কি আমার নাম্বারে কোন খুদেবার্তা দিয়েছো?
-- দিয়েছি, আচ্ছা এখন যে নাম্বার দিয়ে কথা বলছো এটা কার নাম্বার।
-- এটা আম্মুর নাম্বার। তুমি আবার এই নাম্বারে কল দিও না।
-- আচ্ছা তা না হয় দিবো না, কিন্তু আমি কি করবো।
-- তুমি আরো দুদিন অপেক্ষা করো।

এই ভাবে কথা বলে দুজন বিদায় নিলো। একদিকে রাকিব ব্যস্ত নিজের ব্যবসার কাগজপত্রের খোঁজে, অন্যদিকে কঠিন দিন পার করছে নাবিলা। এমন এক বিষয়, কারো সাথেই শেয়ার করতে পারছে না। এক একটা ঘন্টা যেনো এক একটা দিন পার হচ্ছে নাবিলার। কোথাও যাচ্ছে না, খাওয়া দাওয়া করছে না। যে রাতে পিয়ালী বাইরে ছিলো সে থেকেই মা ওর সাথে অন্যরকম আচরন করছে। দুদিন এই ভাবেই কাটিয়ে দেয়। অফিসেও যায়নি। দুদিন পর ঘন্টাখানেকের জন্যে বের হয়। এলাকার বাইরে গিয়ে দোকার থেকে একটা স্টিক কিনে আনে। ১৩ তারিখ ভোরে টেস্ট করে। কিন্তু কোন রেজাল্ট পায় না। রাকিবের সাথে কথা হয়েছে, তবে আগের মতো নয়। ওর একই কথা," হয়ে যাবে হয়ে যাবে"।
১৩ তারিখে অফিস যায়, দুপুর বেলায় লাঞ্চ করতে গিয়ে হঠাৎ শরীর খারাপ হয়, কেমন জানি লাগছে। তবুও অফিসে থাকে। সন্ধার আগে আগে বাসায় আসে। রাকিবকে জানায়।
-- নাবিলা তুমি দুদিন পর আবার টেস্ট করে দেখো।

দুদিন পরে নাবিলা ঘরে টেস্ট করে, রেজাল্ট পজেটিভ। রাকিবকে কল--
-- ঘরের এমন রেজাল্ট ভুল ও হতে পারে নাবিলা, তুমি হাসপাতালে পরীক্ষা করাও।
-- রাকিব আমার কখনো ২/৪ দিন পিছিয়ে যায় না, বরং এগিয়ে আসে। তুমি বলছো আমি করাবো, তুমি আসবে?
-- আমার আসাটা কি ঠিক হবে?
কথাটা নাবিলাকে কষ্ট দেয়। পরে ভেবে দেখে এই সময়ে ওর না আসাই ভালো। আশেপাশের হাসপাতালে গেলে সমস্যা আছে। দুরে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে।
হাসপাতালে পরীক্ষা করতে দিয়ে আসে নাবিলা। আজ রিপোর্ট দিবে, রাকিবকে আসতে বলেছে নাবিলা। ঠিক সময়ে রাকিব চলে আসে। একটা ফাস্টফুডের দোকানে ওরা বসবে বলে ঠিক করা আছে। নাবিলা রিপোর্ট নিয়ে এসেছে। দুজন মুখোমুখি বসা। রাকিব তাকিয়ে আছে নাবিলার মুখের দিকে, আর নাবিলা তাকিয়ে আছে নিজের হাতে থাকা হাসপাতালের খামের দিকে।

এটা এখন শুধু একটা খাম নয়, একটা ভ্রূণের আগমনের খবর। পৃথিবীর এক অনাগত নবজাতকের খবর। রাকিব কি কথা দিয়ে শুরু করবে আজ ভেবে পাচ্ছে না। নাবিলার চোখ থেকে টপ করে একফোঁটা পানি পড়ে খামের মাঝে। রাকিব দেখতে পেয়ে বলে উঠে--
-- নাবিলা রেজাল্ট কি?
-- পজেটিভ।
-- কি করবে ভেবেছো?
-- আমি একা কি ভাববো, আমি জানতাম এমনি কিছু হবে। সেজন্যেই তোমায় ডাকা। রাকিব আমি ঘরে থাকতে পাচ্ছি না, অফিস যেতে পারছিনা। মায়ের মুখোমুখি হতে পারছিনা। সেদিনের পর থেকে মা আমার সাথে ঠিক মতো কথাও বলছে না। তুমি বলো আমি এখন কি করবো।
-- নাবিলা তুমি তো জানো এই মুহূর্তে বিয়ের কথা বাসায় বলা যাবে না। আর এমন খবর জানলে আমাকে বাড়ি থেকেই বের করে দিবে। কোথায় গেলে এই কাজ করা যাবে খোঁজ নাও। প্রয়োজনে আমিও যাবো তোমার সাথে। যে ভাবে হোক বেশিদিন পার হবার আগেই----
নাবিলা খামটা ব্যাগে ঢুকিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাকিব একবার ও ভাবেনি নাবিলা এখন চলে যাবে। নাবিলা কিছুই বলছেনা। সোজা বেরিয়ে আসে। রাকিব পেছন পেছন আসে, কিন্তু নাবিলা একবার ও পেছনে তাকায় নি।

ভাবছে রাকিবের মা কে কল করে সব বলে দিবে, আগত সন্তানকে সমাজে পরিচয় দিবে। কিন্তু রাকিব যে এমন করছে। দুদিনে নাবিলা একবার ও কল করেনি রাকিবকে। রাকিব অনেকবার কল করেছে, কল ধরেনি ও। অফিসের নাম্বারে কল করছে, অফিস থেকে জানিয়েছে নাবিলা অফিসে যায় নি। মা ওকে অনেক ধরণের প্রশ্ন করে, কোন জবাব নেই ওর মুখে। ২০ তারিখে নাবিলা একটা হাসপাতালে যাবে, আগে হাসপাতালের নার্সের সাথে কথা হয়েছে। একটা আল্ট্রাসোনোগ্রাম করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। নার্স বলে দিয়েছে সব। রাতে নাবিলা কল করে রাকিবকে--
-- কাল সকাল ১১ টায় তুমি ওভারব্রিজ এর পাশে এসো, আমি তোমায় নিয়ে হাসপাতালে যাবো।

-- কালকেই যেতে হবে নাবিলা, তোমায় কত কল করেছি, তুমি ধরো নি। আমি ব্যবসার জন্যে শহরের বাইরে। প্লিজ তুমি কালকে একাই যাও, আমি পরশু চলে আসছি, তখন যা করার আমি করবো।
নাবিলা কথা বাড়ায় না, কল কেটে দেয়। অফিসে যাবার সময়েই বাসা থেকে বের হয়, মাসের ৩ তারিখে বেতন পেয়েছিলো। বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে সব বকেয়া পরিশোধ করেছে। হাতে যে টাকা তা দিয়ে যাতায়াত খরচ আর টুকটাক সারতে হবে বেতন পাওয়া পর্যন্ত। এতো কিছু হিসাব করলে এখন হবে না। হাসপাতালে পৌছানোর আগেই নার্সের সাথে আবার কথা হয়।ডাক্তার দেখানো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে আজ আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়ে গেলো। ডাক্তার তারিখ দিয়েছে ২২ তারিখে এসে কাজ সারতে হবে। সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকা লাগবে। ২২ তারিখে করতে হলে আজই ওকে একটা ইনজেকশন দিতে হবে। সব মিলিয়ে সেদিন ঘন্টা চার ওকে হাসপাতাল থাকতে হবে। নাবিলা ইনজেকশনটা দিয়ে সোজা পার্কে যায়। পাকা একটা বেঞ্চিতে বসে থাকে বিকেল পর্যন্ত। অফিস ছুটির সময় বাসায় ফেরে। আজ ওকে অন্য রকম লাগছে। চেহারায় কোন উচ্ছ্বাস নেই, মলিন এক অন্য নাবিলা। ঘরে ঢুকতেই মা ওকে আগলে ধরে।

-- তোর কি হয়েছে, আমায় বল।
কোন কথা না বলে নিজের রুমে চলে যায় নাবিলা। রাতে খাওয়ার সময় রুম থেকে বের হয়। টেবিলে খাবার রাখা, মা বারান্দায় গিয়ে বসে আছে। নাবিলা মায়ের কাছে যায়।
-- মা মরিচ পিয়াজ বেশি করে দিয়ে আমায় একটা ডিম ভেজে দিবে। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
মা ডিম ভেজে দেয়, নাবিলা আজ অনেক গুলো ভাত খেয়ে মায়ের পাশে ঘুমাতে যায়। মাঝে মাঝেই ওরা একসাথে ঘুমায়। নাবিলার একটা হাত মায়ের পেটের উপর দেয়া, অন্য হাত নিজের পেটে দেয়া। সারারাত কল্পনা করে কাটিয়ে দেয় ও।

সকালে অফিস যাবার আগে রাকিবকে কল দিয়ে সব জানায়। রাকিব সব শুনে চিন্তা করতে নিষেধ করে। টাকার কথা জানালেই রাকিব বলে--
-- আপাতত তুমি কারো কাছ থেকে হাওলাত নাও, আমি পরে দিয়ে দিবো।
-- আমি কোথায় পাবো টাকা, তুমি টাকাটাও দিতে পারবে না। রাকিব সব কি আমার দায়?
বলেই লাইন কেটে দেয়। মিনিট ১০ পরে ওর মোবাইলে খুদেবার্তা আসে-
"আমি কাল ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকবো। পুরোটা সময় তোমার পাশেই থাকবো। "

ঘর থেকে বের হবার আগে মায়ের কাছে যায় নাবিলা। নিজেই জানে মায়ের কাছে কোন টাকা থাকে না। নাবিলার ছোট বেলার দুটি আংটি আর দুই জোড়া কানের দুল আছে মায়ের কাছে। শত অভাবে এই জিনিসটুকু আগলে রেখেছেন মা।
-- মা আমায় একজোড়া কানের দুল দিবে। সময় হলে আমি আবার তোমায় দিয়ে দিবো।
মা কোন কথা না বলে রুমে যায়, এক জোড়া দুল এনে মেয়েকে দেয়।
-- এগুলো তোর, তোর জিনিস তোকে দিতে আমার কোন আফসোস বা সংকোচ নেই। ভালো কাজে লাগাস, এটুকুই বলবো।
নাবিলার খুব ইচ্ছে করছিলো মা কে জড়িয়ে ধরে বলতে--
"মা এর চেয়ে ভালো বা খারাপ কাজ পৃথিবীতে আছে কিনা আমার জানা নেই।"
পাথরের মূর্তির মতো নাবিলা জিনিসটা নিয়ে বের হয়। অফিসে কল করে জানিয়ে দেয় আসতে একটু দেরি হবে। আগে যায় জিনিস বিক্রি করতে। বিক্রি করে সাড়ে এগারো হাজার টাকা পায়। এরপর অফিস যায়। বিকেলে অফিস থেকে সোজা বাসায় আসে। আজো ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খায়। আজ নাবিলা একা ঘুমায়। মাঝরাতে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে, স্বপ্নে দেখে ওরা মা মেয়ে হাত ধরে সাগরের পাড়ে হাটছে। বড় বড় ঢেউ আসে, ও মায়ের হাত শক্ত করে ধরে। জেগে গিয়ে নাবিলা ভাবনায় বসে, তার মানে ওর গর্ভের অনাগত সন্তান এক কন্যা শিশু। সাথে সাথে রাকিবকে খুদেবার্তা পাঠায়--

"তুমি কি এই শহরে এসেছো। কাল দশটায় ওভারব্রিজ এর পাশে দাঁড়াবে, আমি তোমায় তুলে নিয়ে যাব।"
মিনিট খানেকের মাথায় ফিরতি বার্তা আসে-
"আমি এসেছি ঠিক সময়ে আমি থাকবো।"
নাবিলার খুব ইচ্ছে করছে রাকিবের পাশে যেতে, ওর কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে। মুহূর্তে ইচ্ছেটা মরে যায়, বুঝতে পারে না কি থেকে কি হতে যাচ্ছে। এই সময়ে নিজেকে শান্ত রাখতে হবে এটা বুঝতে পারছে।

সকাল সকাল উঠে রেডি হয়, মা নিজেই ডিম ভাজি করে নাবিলাকে গরম গরম ভাত দেয়। খেয়েদেয়ে বের হবার সময় মা বলেন--
-- আজ এতো তাড়াতাড়ি বের হচ্ছিস। আচ্ছা যা, ভালো ভাবে ফিরে আসিস। আমি জানি তুই খারাপ কিছু করতে পারিস না, আমি আছি তোর সাথে সুখে দুঃখে।
কিছু না বলে বের হয়ে যায় নাবিলা। ভাবে, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ কাজ। মনে মনে বলে -

"মা এই মুহূর্তে দোয়া ছাড়া আর কিছুই চাই না। ভালোবেসে এক মুহূর্তের আবেগকে আয়ত্বে রাখতে না পেরে আমি যে খারাপ কাজটি করেছি। তাকে মাটিচাপা দিতে পরিবার সমাজ আর এই পৃথিবীর মাঝে নিজেকে ভালো মেয়ে হিসাবে পরিচয় দিতে আর রাখতেই আজ আমি অজানার পথে পা বাড়াচ্ছি মা। যে সন্তানের পিতৃত্বের পরিচয় নেই সমাজে, যে সন্তানকে সমাজ অবৈধ বলে মা, সে সন্তানকে আমি রাখবো কি করে বলতে পারো মা। যাকে ভালোবেসে সব দিয়েছি সে ও আজ অনেক দুরে, বুঝতে পারছিনা এটা কি ওর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া নাকি সে পরিস্থিতির স্বীকার।"
ঠিক সময়ে রাকিব আসে, দুজন একসাথে যায় হাসপাতালে। যে পথটুকু একসাথে ছিলো, কেউ কারো সাথে কিছুই বলেনি। হাসপাতালে গিয়ে নার্সের সাথে রাকিবকে পরিচয় করিয়ে দেয়। রাকিব ওর স্বামী নাকি অন্যকিছু হয় তা বলেনি। কাজ খুব দ্রুত হচ্ছে। নার্স বলেছে দুই ঘন্টা নাবিলাকে ভেতরে থাকতে হবে, রাকিব বাইরে অপেক্ষা করবে ততক্ষণ। অতীত আর ভবিষ্যতের কথা ভাবার সময় নেই নাবিলার। নার্সের সাথে ভেতরে চলে যায়।

চোখ খুলে দেখতে পায় একটা এসি রুমে শুয়ে আছে নাবিলা। মনে পড়ে স্কুল জীবনের কথা, তখন ও গ্রামে থাকতো। উপরের ক্লাসের বিথীর পেট বড় দেখে অনেকে অনেক কথা বলেছে। এক পর্যায়ে দশ মাসের সন্তান প্রসব করার জন্যে বিথীর মা দুরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যায় বিথীকে। জীবিত হয়ে জন্ম নেয়া শিশুকে ওরা গলা টিপে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছে। ঘটনা দুরে হলেও পরে সবাই জেনে যায়।
মনে পড়ে পাশের বাড়ীর ইয়াসমিনের কথা। দাম্পত্য জীবনে কলহ বলে ইয়াসমিন থাকতো নানার বাড়ীতে। একরাতে ওর স্বামী বাবর এসে ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মিলিত হয়। হবার সময় প্রতিরোধক হিসাবে কনডম ব্যবহার করে। সেই মিলনে ইয়াসমিনের গর্ভে সন্তান আসে। গর্ভের সন্তান যখন আট মাস তখন সব জানাজানি হয়। বাবর সেদিনের ঘটনা অস্বীকার করে। সমাজ ইয়াসমিনকে চরিত্রহীন বলে, সে আঘাত সইতে না পেরে ইয়াসমিন আত্মহত্যা করে। ইয়াসমিনের মৃত্যুর পর বাবর স্বীকার করে সে সন্তান তার নিজের ছিলো। সে রাতে বাবর ইয়াসমিনের সাথে মিলিত হয়েছে। ইয়াসমিন জানে ওরা কনডম ব্যবহার করেছে, আসলে বাবর কনডম ব্যবহার করলেও তা নিজে ফুটো করে নেয়।

একটা ঠান্ডা রুমে শুয়ে কত কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে না রাকিবের মুখটা। নার্স আসে কিছু কথা বলে ওদের বিদায় দেয়। বের হয়েও রাকিবের সাথে কোন কথা নেই নাবিলার। বাসায় আসে দুপুরের পর। দিনের বাকি সময় রুমেই থাকে নাবিলা। নিজের বর্তমানের হিসাব মিলায়, বিথীর মতো অবস্থায় তাকে পড়তে হয়নি। ইয়াসমিনের মতো অকালে নিজেকে শেষ করতে হয়নি। সমাজ কখনোই জানবে না আজ নাবিলা একটা ভ্রুণকে হত্যা করে এসেছে। এই পৃথিবীর আলো দেখার আগে, বাতাস অনুভব করার আগেই তাকে হাসপাতালের ডাস্টবিনে ফেলে এসেছে। কোন কুকুর নিশ্চই বুঝবেনা এটা এক মানব সন্তানের ভ্রুণ ছিলো। কেউই জনতে পারবে না আজ এক কুমারী মা হওয়া থেকে বেঁচে গেলো।

নীলাদ্রি থেকে সাদাপাথর.......................শাহানা জাবীন সিমি

নীলাদ্রি থেকে সাদাপাথর.......................শাহানা জাবীন সিমি
আপনি কি পাহাড় পছন্দ করেন? ঝর্ণা? পাথুরে নদী? কিংবা ঘুরে দেখতে চান চা বাগান আর সোয়াম ফরেস্ট? তাহলে এক কথায় আপনার ভ্রমণ তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে নিতে পারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট। শ্রীমঙ্গল আগেই ঘোরা হয়েছে তাই দুদিনের ছুটিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বর্ষার পরপরই চলে গেলাম সিলেট । উদ্দেশ্য ঘুরে দেখা টাংগুয়ার হাওড়, রাতারগুল আর সাদাপাথর।
কথায় বলে ভ্রমণের আনন্দ অনেকাংশে নির্ভর করে ভ্রমণসঙ্গীর ওপর। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। দীর্ঘদিনের বান্ধবী রিতু সাথে তার পতি ইমতিয়াজ ভাই, আমাদের তিনকন্যা যায়ীমা, লাবিবা আর আদিবা, ইমতিয়াজ ভাইয়ের এক বন্ধু ও বন্ধুপত্নী। আমার কন্যা যায়ীমার বাবার শেষ মুহূর্তে অফিসে একটা জরুরী মিটিং পড়ে যাওয়াতে এ যাত্রা উনি আমাদের সঙ্গী হতে পারলেন না। কি আর করা! একটু মন খারাপ নিয়ে পৌঁছে গেলাম গ্রীনলাইন পরিবহনের বাস টার্মিনালে।

বাসে উঠে বেশ নস্টালজিক হয়ে গেলাম। কারণ দীর্ঘদিন পর আবার ভ্রমণ করছি দোতলা বাসে। মনে পড়লো সেই ছোট বেলায় সত্তরের দশকে গুলিস্হান থেকে ডাবলডেকার বাসে চেপে দাদা দাদীর সাথে প্রায়ই মিরপুরে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়ানোর স্মৃতি। যাই হোক সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে বাইরের দৃশ্য খুব একটা উপভোগ করা না গেলেও ছয় সাত ঘন্টার ঢাকা সিলেট জার্নি রিতুর সাথে বকবক করে কিভাবে ফুরিয়ে গেলো টেরই পেলাম না। মাঝখানে অবশ্য ডিনারটা সেরে নেয়া হয়েছিল একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে...পরোটা, সবজি, চা আর রিতুর আনা শিককাবাব দিয়ে।

রাত বারোটা নাগাদ সিলেট শহরে পৌঁছে ইমতিয়াজ ভাইয়ের ব্যবস্থা করে রাখা মাইক্রোবাসে চেপে পৌঁছে গেলাম সুসজ্জিত একটি হোটেল মীরা গার্ডেনে। হোটেল চেকইনের ফর্মালিটিস সেরে যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে। পরদিন সকাল নয়টায় যাত্রা...গন্তব্যে টাঙ্গুয়ার হাওড়।

জম্পেশ একটা বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে সিলেট থেকে মাইক্রোবাসে রওয়ানা দিলাম সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওড়ের উদ্দেশ্য। শহরের মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে মনে পড়লো... সেই স্কুলে থাকতে বাবা মায়ের সাথে এসেছিলাম সিলেট...ঘুরে বেড়িয়েছিলাম জাফলং আর তামাবিল। পথিমধ্যে সঙ্গী হলো ইমতিয়াজ ভাইয়ের একজন সহকর্মী আর তার পাঁচ বছরের কন্যা। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের রাস্তা পুরোটা মসৃণ নয়। মাঝে মাঝে বন্ধুর ও চড়াই উতরাই পেরিয়ে ঘন্টা দুয়েক লেগে যায় টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ঘাটে পৌঁছাতে। শুনেছি পদ্ম ফুল নাকি সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ফুটে ওঠে আবার দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঁজে যায়। এই দুঘন্টার যাত্রায় অনেকগুলো দিঘীতে পদ্ম ফুটে থাকার সৌন্দর্য চড়াই

উতরাই পথের ঝাঁকুনির কষ্টটা কে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল। ঘাটে পৌঁছে একটা ইন্জিন নৌকা সারাদিনের জন্য ভাড়া করে হাওড়ের পানিতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এই নৌকাগুলো সাধারণত দোতলা হয়ে থাকে। নিচের তলায় বিছানা পেতে শোওয়ার ব্যাবস্থা, ওয়াশরুম আর কিচেন। আর দোতলার ছাদটিতে রোদ থেকে বাঁচার জন্যে মাথার উপর সামিয়ানা খাটিয়ে পরিপাটি করে বসার ব্যবস্থা...বেশ একটা জমিদারি ভাব। যে যার মতো ছাদটিতে আরাম করে বসলাম। ইন্জিন নৌকার ঘটঘট আওয়াজ প্রথমে একটু বিরক্তির কারণ হলেও যখন নৌকাটি জনবহুল ঘাট ছেড়ে এগিয়ে চললো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের মেঘালয় তার সবুজ পাহাড়ের দর্শন দিল তখন টাঙ্গুয়ার হাওড়ের নীল পানি আর সবুজের সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার।

সৌন্দর্য পিপাসুরা বলে থাকে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ভ্রমণের ভালো সময় শীতকাল তখন এখানে নানা প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে অথবা বর্ষার শেষে যখন মেঘালয় থেকে উড়ে আসা মেঘ হঠাত্ কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি ঝরিয়ে সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলে। টাঙ্গুয়ার হাওড় শীতকালে অতিথি পাখিদের জন্য যেমন অভয়ারণ্য তেমনি বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ এর সম্পদ। এই মাছের উপর নির্ভর করে এই হাওড়ের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। যাইহোক যাত্রা শুরু করেছিলাম রৌদ্রজ্বল নীল আকাশে কিন্তু দুপুরের পর আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনায় হাওড়ের পানির রঙ বদলানোর খেলা বেশ উপভোগ্য হলো। হায় রে কেনযে কবি হলাম না! হঠাত্ মনে পড়লো এই অঞ্চল তো হাসন রাজার দেশ এবং অদ্ভুত ভাবে সুযোগও হয়ে গেল হাসন রাজার কিছু বাউল গান শোনার। কিভাবে? সেটাই বলছি। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে আছে একটা ওয়াচ টাওয়ার যেখানে পর্যটকরা উঠে পুরো হাওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। আমরাও উঠে পড়লাম ওয়াচ টাওয়ারের চুড়ায়। সেখানে দেখা মিললো কিছু স্থানীয় কিশোরের যারা গেয়ে চলেছে একটার পর একটা বাউল গান...'লোকে বলে লোকে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নয় আমার। কি ঘর বানাইবো আমি শূন্যের মাঝার'।

ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটার ঘর ছুঁয়েছে ; ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে নৌকায় ফিরতে ক্ষিদে যেন চনমনিয়ে উঠলো। ফ্রেশ হয়ে নৌকার ছাদেই পাটি পেতে আহারের ব্যবস্থা। বাইন মাছ ও কাইক্কা মাছের দোপেঁয়াজি, আলু দিয়ে দেশি মুরগির ঝোল, সবজি, ডাল এবং ভাত। এতো সুস্বাদু রান্না যে নৌকার রাঁধুনি কে ফাইভ স্টার রেটিং দিতে আমরা কেউ কুণ্ঠিত হলাম না। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় চা পান করতে করতে জানতে পারলাম তাহিরপুর সীমান্তে 'নীলাদ্রি' লেকটা একবার দেখে না গেলে নাকি জীবনই বৃথা। অনেকক্ষণ পরে নৌকা থেকে নামতে পেরে তিন কন্যা আর সাথে তাদের দুই মায়েরা ফটোসেশনে ব্যস্ত হয়ে রইলাম। হঠাত্ ইমতিয়াজ ভাইয়ের ডাক শোনা গেল...তোমরা তাড়াতাড়ি এদিকে এসো 'নীলাদ্রি' তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

কে যে রেখেছিল নামটি....নীলাদ্রি!! পাহাড় বেষ্টিত অদ্ভুত সুন্দর নীলাভ সবুজ পানিতে ভরা লেকটি যেন বাংলাদেশের বুকে একটা ছোট্ট কাশ্মীর। এ সৌন্দর্য যে চুপচাপ বসে বসে আস্বাদন করতে হয়। আরো কিছু বিস্ময়কর ঘটনা যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা কে জানতো? হঠাত্ তাঁর নির্দেশে মেঘ বৃষ্টির দুত যখন অসময়ে শুরু করলো ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি তখন নিজেদের বাঁচাতে একটা উঁচু টিলার উপরে ছাউনির নিচে সবাই দাঁড়ালাম সেখান থেকে নীলাদ্রি লেক যেন আরো অপূর্ব আরো পরিপূর্ণ। হঠাত্ বৃষ্টির মধ্যেই আকাশে দেখা মিললো সূর্যের...সাথে আমাদের অবাক করে দিয়ে পরপর দুটি রঙধনু। জীবনে রঙধনু তো বহুবার দেখেছি কিন্তু 'ডাবল রেইনবো' এই প্রথম। যাইহোক মনের ক্যানভাসে নীলাদ্রি লেক আর দ্বৈত রঙধনুর ছবি এঁকে আর মোবাইল ক্যামেরার ফ্রেমে এদের সৌন্দর্য কে বন্দী করে শুরু হলো ফিরতি যাত্রা। ফিরতি যাত্রায় বোনাস হিসেবে পেলাম টাংগুয়ার হাওড়ে সূর্যাস্ত দর্শন। দ্বিতীয় দিনের গন্তব্যে রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট আর সাদাপাথর।

রাতারগুল পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি প্রাকৃতিক সোয়াম্প ফরেস্টের একটি কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে যারা সুন্দরবন যাননি তাদের জন্য রাতারগুল হতে পারে একটি 'মিনি সুন্দরবন'। সিলেট থেকে মাইক্রোবাসে গোয়াইনঘাট উপজেলায় গোয়াইন নদীর তীরে রাতারগুল পৌঁছাতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে। রাস্তা মসৃণ চাইলে একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন। সোয়াম্প ফরেস্ট ঘুরে দেখতে নৌকা ভাড়া করতে হলো। পশুপাখির অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে এখানে ইন্জিন নৌকা নিষিদ্ধ। নৌকার বৈঠা বেয়ে মাঝি ঘুরিয়ে দেখালো নানারকম জলজ উদ্ভিদে ঠাসা এই বন। যতই ভিতরে ঢুকছি বন যেন গভীর হচ্ছে ; নীল আকাশ হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের আচ্ছাদনে। তবে এখানে পাখির কলকাকলি যেমন আনন্দদায়ক তবে সদা সজাগ থাকতে হয় গাছ থেকে ঝুলে থাকা নৌকার মাঝির ভাষায় বিষহীন একধরনের চিকন

সাপের ব্যাপারে যা যখন তখন নৌকার উপর টুপটুপ করে পড়ে হানা দেয়।
রাতারগুল থেকে বেরিয়ে এবারের যাত্রা সিলেটের সীমান্তবর্তী গ্রাম ভোলাগন্জ। রাস্তা মসৃণ; গাড়ীতে বসে চিপ্স, চকলেট; কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম কোম্পানিগন্জ উপজেলার সর্ববৃহত্ পাথর কোয়ারির এই অঞ্চলে। বড় করে লেখা ভোলাগন্জ "জিরো পয়েন্ট"। সীমান্তের ওপারেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। স্হানীয়দের কাছে এই জায়গাটি সাদাপাথর নামে পরিচিত। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানির সাথে নেমে আসে পাথর। সেই পাথরই ছড়িয়ে আছে ভোলাগন্জ জিরোপয়েন্টের বিশাল এলাকা জুড়ে। এখানে ভোলাগন্জ বর্ডারের কাছে এসে ইন্জিন নৌকা ভাড়া করতে হলো। ইন্জিন নৌকায় ধলাই নদ ধরে দশ মিনিটের পথ পেরোলেই বিস্তীর্ণ সাদাপাথরের হাতছানি। মেঘালয়ের পাহাড়, ধলাই নদ আর সাদাপাথর মিলে মিশে একাকার। নৌকা থেকে নেমে আরো কিছুক্ষণ কষ্ট করে ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে হাঁটার পর দেখা মিললো স্বচ্ছ শীতল জলধারার। একেবারে সেই কিশোরবেলায় দেখা জাফলং এর মতো। সবাই এখানে ব্যস্ত হলাম শীতল পানিতে পা ডুবাতে। তবে পাথরগুলো অতিরিক্ত পিচ্ছিল হওয়ায় সতর্কতা অবলম্বন খুবই জরুরী । দ্রুতই ঘড়ির কাঁটা এগোতে লাগলো। এবার যে বিদায়ের পালা। তবে একটা কথা বলে রাখি সিলেটের এই দর্শনীয় স্থানগুলি একা ভ্রমণ না করে গ্রুপে ভ্রমণ করলে খরচের দিক থেকেও যেমন সাশ্রয় হবে তেমনি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকা ফেরার বাস। চারটার মধ্যে হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে একটু জিরিয়ে রওয়ানা দিলাম। এই দুদিনে প্রকৃতি আমাকে দিল অদ্ভুত এক মানসিক প্রশান্তি। বাসে উঠে বসলাম; খুব দ্রুতই গ্রীনলাইন পরিবহনের দোতলা বাস সিলেট ছেড়ে বেরিয়ে গেল ব্যস্ত নগরী ঢাকার দিকে।

কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর................................তুহিন রহমান

কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর................................তুহিন রহমান
ব্যাঙ্গালোর রেল স্টেশন
১৯৮৯ সাল। অকটোবরের শেষ দিক। ইন্ডিয়ান ভিসা তখনও বেশ কঠোর। দিতেই চায়না। প্রতিদিন পাঁচ ডলার করে এনডোর্স করাতে হতো। এভাবে যতো দিন থাকা যায়। আমার হাতে অনেক টাকা। পুরো ইন্ডিয়া ঘোরার জন্য তিন মাসের ভিসা দরকার। ইন্ডিয়ান এ্যাম্বাসি তখন ধানমন্ডিতে, যেখানে এখন পপুলার, ঠিক তার বীপরিতে। গিজগিজ করছে মানুষ। বেশীরভাগকেই ভিসা দিচ্ছেনা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। যদি ভিসা না পাই তাহলে তো পরিকল্পনাটাই মাঠে মারা যাবে। লাইনে, আমার ঠিক পেছনে, একটা ফ্রেঞ্চ মহিলা দাঁড়িয়ে আছে হাতে তাদের দেশের পাসপোর্ট। বয়স পঁচিশ বা ছাব্বিশ হবে। বেশ ভালো ইংরেজী বলতে পারে। তবে এ্যাকসেন্টটা ডিফরেন্ট। লাল একটা শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরা মেয়েটার চুলগুলো একেবারে অবার্ন, মানে যাকে বলে লালচুলো। আগেই তার সাথে পরিচয় হয়েছে। তার নাম ওয়েলা (Wella), প্যারিসের বাইরে লিয়নে থাকে। ইংরেজীতেই বললাম, যদি ওরা আমার ইন্টারভিউ নেয় তবে আমি বলবো আমি তোমার সাথে একজন গাইড হিসাবে যাচ্ছি। ওয়েলা তার নীল চোখ ঘুরিয়ে হেসে বললো, তাহলে কিন্তু আমার গাইড হতেই হবে তোমাকে। আমি বললাম, হতে আপত্তি কোথায়? ও বললো, ইটস ওকে। তখন আবার ইন্টারভিউয়ের প্রচলন ছিল। প্রত্যেককে কবাটবিহীন একটা জানালার সামনে দাঁড় করিয়ে কিছু কথা বাংলাতেই জিজ্ঞেস করতো তারপর সিল মেরে দিত। নাহয় রিজেক্ট করে দিত। আমার পনেরো দিনের ডলার নেয়া আছে। ইচ্ছে কোলকাতা যাবার পর ভিসা বাড়িয়ে নেবো। জানালাতে আমার ডাক পড়লো। ওয়েলা নিচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওপরের সিঁড়িতে। ওকে দেখিয়ে অফিসারকে বললাম, আমি ওর গাইড হিসাবে যাচ্ছি। ও যেখানে যাবে আমাকেও যেতে হবে। অফিসার বললো, লিখিত দিতে হবে। অফিসারের কথা শেষ হবার আগে ওয়েলা বললো, নো প্রবলেম, গিভ হিম এ্যা ভিসা। হি ইউল ট্রাভেল উইথ মি। 
অফিসার একবারের জন্য আমার চেহারাটা স্ক্যান করলো তার শ্যেন দৃষ্টিতে। তারপর অনিচ্ছা সত্বেও সিল লাগালো পাসপোর্টে। আমি পনেরো দিনের ভিসা পেলাম। 

ওয়েলা আগেই আমাকে বলে রেখেছে ও কমলাপুর এর বিআরটিসির শেড থেকে বাসে উঠবে। আমার বাড়িও ওখানে। আটটায় বাস ছাড়বে, দেখি ওয়েলা আধাঘন্টা আগেই পৌছে গেছে ওখানে। ও জানালো, ও দুটো টিকিট কেটে রেখেছে। ওর পাশের সিটটাতে আমার জায়গা বুক করেছে। হাত বাড়ালো, বললো, টিকিটের টাকাটা দাও। আমি মনে মনে বললাম, ফ্রেঞ্চগুলোও কি এমন কিপটে হয়? তারপর ওর প্রতি বেশ কৃতজ্ঞ আমি। ওর কারনে ভিসা পেয়েছি। দুশো টাকা বের করে দিলাম। বেনাপোল পর্যন্ত ভাড়া একশো আশি টাকা। 
পুরো পথটা বকবক করে মাথা নষ্ট করে ছাড়লো ওয়েলা। ওর বাবা কি করে, ভাইবোনরা ওকে খুব পছন্দ করে, ও এশিয়াতে ভ্রমনে আসবে শুনে হায় হায় করেছে ওরা। কারন ওরা মনে করে পুরো এশিয়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর ভয়ানক জায়গা। সাগরকলা আর পাঁউরুটি দিয়েই সারাটা পথ চললো সে। মাঝে মাঝে আমাকে অফার করলো, কিন্তু সেটা না করার মতোই। টুরিস্টরা এমনই হয়। বেনাপোলে নেমে চেক আপ সারলাম। হরিদাসপুর থেকে রিকসায় আমি আর ওয়েলা চললাম বনগাঁ স্টেশনের দিকে। তখন বিকেল তিনটে। ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোলকাতায় ‍তুমি কি আমার সাথে হোটেলে থাকবে? 

কোলকাতায় যদিও আমার থাকার জায়গার অভাব নেই তারপরও ইতস্তত করে বললাম, ইফ ইউ এগ্রি। -তাহলে ডাবল রুম নিতে হবে। 
-আই উইল পে হাফ, আমি বললাম, ডোন্ট ওরি। 
বনগাঁ থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌছুলাম সন্ধ্যা সাতটায়। কোলকাতায় সেবার শীতকালে বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা দু’জন স্টেশনের বাইরে বেরুতেই পারছিলাম না। কোনমতে শার্ট প্যান্ট ভিজিয়ে একটা ট্যাকসি ধরে চলে এলাম ধর্মতলা। একটা হোটেলে ডাবল রুম নিলাম ৫০০ রুপি দিয়ে। কিন্তু হুট করে পরেরদিন সকালে জ্বর আসলো। উঠতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার শরীরে জ্বর রয়েছে বেশ। ওয়েলা তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ওকে ডাকলাম। ও তাড়াতাড়ি উঠে আমার সেবা করা শুরু করলো। এ্যাসপিরিন আর কি কি যেন ওর কাছে ছিল। তাই খেয়ে বিকেলের দিকে সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি। কোলকাতায় আমার কাছে একটাই প্রিয় জিনিষ আছে, সেটা হলো মিউজিয়াম। এছাড়া গোটা কোলকাতায় আর কিছুই দেখার নেই। চিড়িয়াখানাটাও তেমন নয়, পশুপাখিদেরকে এমনভাবে আবদ্ধ করে রাখে যে বাইরে থেকে দেখার উপায় নেই। পরের দিন মিউজিয়াম দেখা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। ওয়েলা প্রচুর সিগারেট খায়। পুরো রুম ধোঁয়া হয়ে থাকে। আমিও সিগারেট টানতাম তবে ওর মতো নয়। সিগারেটের ধোঁয়ায় আমি ঘুমাতে পারিনা। ধোঁয়াগুলো বের হবার জন্য শীতকালেও রুমের জানালা খুলে রাখতে হয়েছিল। 

পরেরদিনই ব্যাঙ্গালোরের ট্রেনের টিকিট কাটলাম। আমি ওয়েলার গাইড। পুরো ইন্ডিয়া কয়েকবার ঘুরেছি, তাই সব চেনা আছে। সেদিনই সন্ধ্যের ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম। ইন্ডিয়ার দক্ষিন দিকে যেতে হবে এবার। প্রায় ত্রিশ ঘন্টা সময় লাগতো তখন সেই আশির দশকে। ট্রেনগুলোও ততটা উন্নত মানের ছিলনা। হাওড়ার স্টেশনের ডিসপ্লে বোর্ডগুলোও হাতে সুইচ টিপে শো করতো কখন ট্রেন কোন স্টেশনে পৌছুবে। খাবার দাবার নিয়ে ট্রেনে উঠলাম আমি আর ওয়েলা। পানির পেট বোতল তখনও ভারতের বাজারে আসেনি। ওয়েলার কাছে একটা টেক্সান কাউবয়দের ওয়াটার বকস টাইপের বোতলে দেড় লিটার পানির সংস্থান ছিল। আর ট্রেনের বুফেতে টাকা দিলে মিলতো পানি। সারা রাত জার্নি করলাম। ভোর হলো। বন জঙ্গল, শহর পার হয়ে ছুটছে ট্রেন। সূর্য্য উঠলো। ব্যস্ত হয়ে উঠলো পরবর্তী শহরগুলো। তারপর আবার রাত। সেই রাত দুটোয় ব্যাঙ্গালোর পৌছালো ট্রেন। চমৎকার ছোটখাট স্টেশন। ইংরেজীতে বড়ো বড়ো করে লেখা ব্যাঙ্গালোর ক্রান্তিভিরা সাঙোলী রায়ান্না স্টেশন, তবে বেশীরভাগ মানুষের কাছে এটা সিটি স্টেশন নামেই পরিচিত। সবচেয়ে অদ্ভুত এখানকার বর্নমালা-মনে হলো আমরা বুঝি থাইল্যান্ডে চলে এসেছি। এদের বর্নমালার সাথে থাই বর্নমালার এত্তো মিল! কিছুই পড়তে পারছিনা। কর্নাটক রাজ্যের একটা শহর এই ব্যাঙ্গালোর, বর্তমানে ব্যাঙ্গালুরু। আসলে আমরা কোথাও দীর্ঘ সময় থাকার পরিকল্পনা নিয়ে আসিনি, অল্প টাকায় বেশীরভাগ শহর ঘোরার ইচ্ছে নিয়ে ইন্ডিয়া ভ্রমনে আসা। এখানে একটা হোটেলে তিন দিন ছিলাম। দেখার মতো দুটো জিনিষই আছে এখানে। একটা হলো কাবন পার্ক, আরেকটা হলো নেহেরু প্লানেটোরিয়াম। কাবন পার্ক আমাদের রমনা পার্কের মতো তবে বাতাসটা আরও বিশুদ্ধ। প্লানেটোরিয়ামটা আমাদের ভাসানি নভো থিয়েটারের মতো এতো উন্নতমানের ছিলনা তখন। তবে ব্যাঙ্গালোর ঘোরার মজাই আলাদা। আমরা দ্রুত প্যাক আপ করে নিলাম। আমাদের কন্যাকুমারী যেতে হবে। আমি ঘোরার একটা লিস্ট করেছিলাম। সেখানে কন্যাকুমারীর জন্য আলাদা একটা সাতদিনের স্টে প্ল্যানিং ছিল। কিন্তু ওয়েলার উত্তরে যাবার চিন্তা বেশী। ওদিকেই নাকি তার বেশী পরিকল্পনা। এদিকে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলগুলোতে ওকে মশা খুব বিরক্ত করে মারছে। চায়না থেকে কি যেন মোমের মতো একটা পেন্সিল নিয়ে এসেছে ও। ওটা গায়ে মাখতে থাকে সারাক্ষন। আমাকে মশা ধরেনা একদম। 

কন্যাকুমারী হলো তামিলনাড়ুর শেষ একটা স্থান। বলা যায় ভারতের শেষ স্থলসীমানা। ব্যাঙ্গালুরু থেকে অনেক দুরের পথ। আবারও ট্রেন যাত্রা শুরু হলো। এবারও প্রায় বিশ ঘন্টার পথ। এদিকের রেলপথটা আগের মতো নয় বরং কিছুটা লোকাল ধরনের। তারপরও নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে আমরা তামিলনাড়ু পৌছুলাম। আমাকে সব ঘটনা ছোট করে বলতে হচ্ছে কেননা আমরা এতোগুলো শহর আর রাজ্য ভ্রমন করেছিলাম যে একটা ম্যাগাজিনে তা আটবে না। শহরের পর শহর, রাজ্যের পর রাজ্য। এমন একটা সময়ের কথা বলছি যখন মানুষের হাতে ক্যামেরা লাগানো ফোন তো দুরের কথা ক্যামেরাও ছিলনা। আর বেড়ানোর সময় আমরা ক্যামেরায় ছবি তুলবো এই চিন্তাও করতাম না। ওয়েলার কাছে ক্যামেরা ছিল, ও ছবিও তুলেছিল প্রচুর। কিন্তু সেসব ছবি আর পরে নেয়া হয়নি আমার কারন ও ইন্ডিয়া থেকে নেপাল চলে গিয়েছিল। 

কন্যাকুমারী বিশুদ্ধ একটা জায়গা। বাংলাদেশের কুয়াকাটার মতো সেখান থেকেও সুর্যাস্ত সূর্যোদয় এবং চন্দ্রদয় ও চন্দ্রাস্ত দেখা যায়। কন্যাকুমারী জেলার সর্বশেষ জায়গা বা ভারতের সর্বশেষ স্থলসীমানা পয়েন্টটা হলো বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল। এটা একেবারে সমুদ্রের ভেতরে দাঁড়ানো একটা মুর্তি যেখানে আপনি নৌকায় করে যেতে পারবেন কন্যাকুমারী বিচ থেকে। 
ব্যাস, এখানে দু’দিনের ভ্রমন শেষ হলো। ওয়েলা অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে উত্তরে যাবার জন্য। আমার একবার ইচ্ছে হয়েছিল ওকে ছেড়ে চলে যেতে, কেননা আমার এত তাড়া নেই। আস্তে আস্তে ঘুরবো এটাই ছিল আমার ইচ্ছে। কিন্তু ওর সাথে সাথে থাকায় আমার সব দেখা মাটি হচ্ছে। তারপরও ওর সাথে আছি কারন খরচটা দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে বেড়াতে গেলে শেয়ারিং কতো যে উপকার করে তা বলে বোঝানো যাবেনা। 

তামিল নাড়ুর আবহাওয়া মানুষকে কালো করে দেয়। ওখান থেকে ট্রেনে ওঠার পর আয়নায় নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। আমাদের কক্সবাজারের মতো এর রোদ একেবারে চামড়ার মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। এরপরের টার্গেট গোয়া। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল গোয়াতে যাবার। বেশীদুরের যাত্রা নয়, কর্নাটক পার হলেই গোয়া। আমরা এর রাজধানী পানাজীতে না নেমে বড় শহর ভাস্কো দা গামায় নেমে গেলাম। সেখানে ওয়েলা তার পছন্দমতো একটা হোটেল নিল। আমি তার কাছ থেকে আলাদা হয়ে ঘুরতে লাগলাম। চমৎকার একটা জায়গা। ইন্ডিয়াতে যতো জায়গায় আমি গেছি, এর মতো সুন্দর জায়গা খুব কমই চোখে পড়েছে আমার। লোকাল ইন্ডিয়ানদের চেয়ে বিদেশীদের সংখ্যাই এখানে বেশী। এখানকার একটা কথা বলে নেয়া ভাল। ভারতের বেশীরভাগ জায়গায় প্রকাশ্যে মদ্যপান নিষিদ্ধ কিন্তু এখানে তা বৈধ। এখানে জুয়া খেলা, প্রকাশ্যে ক্যাবারে ড্যান্স, ক্যাসিনো, বার, পতিতালয় সবই বৈধ। আর এখানকার বেশীরভাগ স্থানীয় হলো পর্তুগীজ। আপনি যেখানে যাবেন দেখবেন, বিদেশীরা ব্যবসা করছে। বর্তমানের কথা জানিনা, আমি যখন গিয়েছিলাম আশির দশকে-তখনকার কথা বলছি। আমি এখানে থাইল্যান্ডের স্বাদ পেয়েছি। ভারতে বিনোদনের সর্বোচ্চ পয়েন্টটাই পাবেন আপনি গোয়াতে। তিনদিন থাকার পর গোয়া থেকে বাসে করে আমি ওয়েলা চলে এলাম মুম্বাইতে। ভারতের অন্যান্য শহরের মতোই মুম্বাইয়ের চেহারাতেও প্রাচীন একটা ভাব আছে। আমাদের আসলে প্রতিটা টুরিস্ট স্পটে ঘোরার এত সময় নেই। যেতে হবে জুহু বিচে। ওটা দেখে, মুম্বাই স্টুডিও থেকে ঘুরে চলে যেতে হবে আগ্রা। তবে ইচ্ছে পুনের ইলোরা অজন্তায় কিছুটা সময় কাটাতে হবে। জুহু বিচে ঘুরে আমরা চলে এলাম হোটেলে। পরের দিন শুরু হলো মুম্বাই স্টুডিও ট্যুর। পালোমা টুরিস্ট হেভেন নামে একটা ট্যুর গাইড এজেন্সি থেকে টিকিট কাটলাম আমরা একেকজন ৫০ রুপি করে। একটা এসি বাসে ওঠানো হলো আমাদের। পুরো বাসে বিদেশী আর অন্য রাজ্য থেকে আসা টুরিস্ট ভরা। মুম্বাইয়ের যেসমস্ত জায়গায় সিনেমার স্যুটিং হয় সেসব জায়গায় বাস থামিয়ে নামানো হলো আমাদের। কয়েকটা সিনেমার স্যুটিং তখনও চলছিল। দুর থেকে দেখেই ক্ষান্ত দিতে হলো। 

ব্যস, এরপর পুনা। সেই রাতেই মুম্বাই থেকে বাসে রওয়ানা দিলাম আমরা। রাতে আমি জার্নি করতে চাইনা কারন পথে আমি মোটেও ঘুমোতে পারিনা। ফলে বেশ ক্লান্ত লাগে। ওয়েলা দিব্যি কানে ওয়াকমেন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনতে শুনতে যাচ্ছে। ওর দেখাদেখি আমিও কানে ওয়াকমেন লাগালাম। 
দেড়শো কিলোমিটার তিন ঘন্টায় পাড়ি দিলো বাস। ভোর রাতের দিকে পুনা নামলাম আমরা। একটা ঐতিহাসিক আর স্নিগ্ধ শহর হলো পুনা। মন ভরে যাবার মতো পবিত্রতা আছে এই শহরে। পরে শুনেছিলাম ভারতের মধ্যে এখানেই নাকি সবচেয়ে কম অপরাধ ঘটে থাকে। মানুষজনগুলো এখন কেমন জানিনা তবে সেই সময় সবার চোখে কেমন যেন এক নির্লিপ্ততা দেখেছিলাম, যেন বাইরের কারো ব্যপারেই তাদের মাথাব্যথা নেই। খুব ভোরে রেস্টুরেন্টগুলো খোলে ওখানকার। আমরা কিছু রসগোল্লা জাতীয় মিস্টি আর পরোটা দিয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। এখান থেকে ইলোরা আবার পাঁচ ঘন্টার পথ।সেই জায়গার নাম ঔরঙ্গাবাদ। ইচ্ছে করছিল সেদিনটা ওখানে থেকে যেতে। কিন্তু ওয়েলার ভয়ঙ্কর রকম এনার্জি। কোন ক্লান্তি নেই ওর ভেতর। আবার শুরু হলো পথ চলা। মধ্য দুপুরে আমরা ঔরঙ্গাবাদ পৌছুলাম। ঔরঙ্গাবাদের যাত্রা সেদিনের মতো শেষ করে হোটেলে উঠলাম। পরেরদিন সেখান থেকে সরকারী বাসে ১৫ টাকায় ইলোরা গুহায় পৌছুলাম। অজন্তায় পৌছুতে ওখান থেকে আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। তবে ইলোরা আমার মনকে মুগ্ধ করে ফেললো। এতো বিশাল কারুকাজ করা পাহাড়ী স্থাপত্য নিদর্শন এশিয়াতে আর নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। প্রাচীন বিশালকায় শিলালিপিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দিল আমার সামনে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে খোদাই করা স্তম্ভ আর মুর্তিগুলো কতো হাজার বছরের পুরোনো কে জানে। 

ওয়েলা খুব কাছ থেকে গুহার ভেতরটা দেখছে। পাহাড়ের অনেক গভীর পর্যন্ত চলে গেছে পাথুরে গুহা। ভেতরে ইলেক্ট্রিক লাইট আছে, যেন মনে হচ্ছে কোন রাজার দরবারে চলে গেছে এই পথ। অসেলে এটা প্রায় দশ হাজার বছর আগের খোদাই করা পাথুরে পাহাড়। এতো বিশাল বিশাল মুর্তিগুলো দেখলে আপনার গায়ের ভেতর শিরশির করবে। গুহার পাথুরে দেয়ালে হায়ারোগ্লিফিকের মতো সব সাংকেতিক 
চিহ্ন। ওয়েলার কন্ঠস্বরে আমি মাঝে মাঝে চমকে উঠছিলাম। এরপর অজন্তা। সেই একই রকম একটা পাহাড়। যেন দুটো জমজ ভাই। অজন্তা আবার ইলোরার কাছ থেকে অনেক দুরে। হলে কি হবে, দুটোর নকশা, খোদাই কর্মের ভেতর অনেক মিল। আমার কাছে মনে হয় ভারতীয় সব খোদাইকর্ম প্রায় একই

রকম, বিষয়বস্তু ভগবান ও নারী। কিছু কিছু নকশা এমনই যে চোখ বন্ধ করে ফেলতে হয়। বা না দেখে দুরে সরে আসতে হয়। 

আমরা হোটেলে ফিরে কার কত টাকা খরচ হয়েছে তার হিসাব নিয়ে বসলাম। এদিকে হোটেলে শর্ট সার্কিটে ইলেক্ট্রিক চলে গেছে। আবার বেশ ঠান্ডা বাইরে। মোমের আলোতে দু’জন হিসাব করছি কতো টাকা আছে আমাদের কাছে। দেখা গেল আমার আর ওয়েলার সমান সমান খরচ হয়েছে। কিন্তু ওর ফ্রাঁ আছে অনেক যেগুলো ভাঙালে ফ্রান্স থেকে দশবার যাতায়াত করতে পারবে। আর আমার কাছে আছে মাত্র পঁচিশ হাজার রুপি। ভাবছি এই টাকা দিয়ে কাশ্মীর পর্যন্ত যেতে আসতে পারবো কিনা। 
ওয়েলা আছে বলে একাকিত্ব থেকে দুরে আছি। ভ্রমনে গেলে একা একা ঘোরা বেশ কষ্টের। কথা বলা বা সঙ্গী একজন থাকলে ভালো লাগে। ভাগ্য ভালো যে দেশ থেকেই এমন একজনকে পেয়ে গিয়েছি যার একই ধরনের ট্রিপের পরিকল্পনা ছিল। 

ম্যাপ নিয়ে বসলাম। এরপর আমার দিল্লী যাবার পরিকল্পনা। চেক করে দেখলাম আড়াইশোর ভেতর যাওয়া হয়ে যাবে। দেরী করে লাভ নেই। পরের দিনই বাসে উঠলাম ঔরঙ্গাবাদ থেকে। ইন্দোর, জয়পুর পার হয়ে আঠাশ ঘন্টার সড়কপথে যাত্রা। প্রায় দেড় দিনের মতো বাসের ভেতরই বসে থাকতে হলো। আমার মনে হলো আমরা যতোটা পথ ভ্রমন করেছি এ পর্যন্ত তা যদি টেনে সোজা করা যেত তবে ঢাকা থেকে ইরান পর্যন্ত পৌছুতাম আমরা। 

শরীরে ক্লান্তি নিয়ে দিল্লী নামলাম আমরা। একটা অটো নিয়ে চলে এলাম পুরান দিল্লীতে। একি! আমি কি নবাবপুর রোডে চলে এলাম নাকি? একি দিল্লী? এর আগে আমি দিল্লীতে আসিনি। তাই গুলিস্তানের মতো অবস্থা দেখে আমারই হতভম্ব ভাব। নবাবপুর থেকে সদরঘাটের দিকে যে রাস্তাটা গেছে হুবহু সেই রাস্তার মতো রিকশা, টেম্পু, হোন্ডা আর অটো ভরা একটা রাস্তায় এলাম আমরা। ওখানেই নাকি হোটেল বেশী। ওহ কি অবস্থা! হাউকাউ, চিল্লাচিল্লি- এর নামই দিল্লী! ক্লান্তিতে আর পারছিলাম না, একটা হোটেল নিয়ে কোনমতে উঠে পড়লাম। দুপুর হয়ে গেছে। রুমেই অর্ডার দিয়ে ভাত আনালাম। সেই সাথে বেগুন ভাজি, করোলার চপ আর ডাল। খাওয়ার পর আমার বিছানায় পড়তে যতটুকু দেরী। তারপর কি ঘটেছে আর মনে নেই।

চলবে.....................................