একজন কুহু অথবা সহস্র হৃদয়ের কান্না........................আরিফা সানজিদা

ফে
ইসবুকে নিউজফিড স্ক্রল করতেই আটকে গেল কুহুর দৃষ্টি, হাতে কাঁপন শুরু হল,ক্রমশ
নিঃশ্বাস ভারি হয়ে  গলায় ধলা পাকানো অনুভূব ক্রমশ অবশ করে তুলছিল কুহুর সমস্ত স্বত্বাকেচোখের পাপড়ি কখন যে ভিজে বর্ষণ শুরু হলো কুহু তা টের পায়না, একি চোখের বর্ষণ নাকি বুকের ভিতর  ছলাৎ ছলাৎ জলের ধ্বনি? নিঃশব্দ এই জলের ফোয়ারা কখনো দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে অভিশাপ ছুড়ে আকাশপানে তবুও কিঞ্চিৎ হয়না শোধএই জন্মে কি শোধ হওয়া আর সম্ভব? আর সম্ভব? নিশ্চুপ এই কান্না গগন বিদারক আর্তনাদে পরিণত হল তারপর:

-না! এ জীবন চাইনা আমার! চাইনা! চাইনা! সুন্দর একটা জীবন চেয়েছি আমি, একটি স্বপ্ন,  অনেকগুলো সম্ভাবনাতবে কেন এমন হলো, হে খোদা! এ কোন পাপের শাস্তি আমায় দিলে? মানবজন্ম ঘেন্নার আমার

ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে কুহুর গলার স্বরআয়নার সামনে দাঁড়ায় গিয়ে, সেই নখের আঁচড়; সেই ছিঁড়ে যাওয়া ক্ষত এখনো স্পষ্টশকুনের নখের আঁচড় যে শরীরে বিঁধেছে সে শরীর জানে কতটা ঘৃণায়, কতটা অশুচিতে বেঁচে থাকতে হয়

দৌঁড়ে স্নানাগারে যায়  ; ঝর্ণা ছেড়ে জল ঢালেঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়, কত জল ঢাললে ধুয়ে মুছে যাবে সব? কুহু আবার কাঁদে,  জলের সাথে মিশে যায় এই কান্নাভাবে এইমাত্র যে নিউজটা দেখলাম সেই মেয়েটিও কি এমন কাঁদছে এখন? মেয়েটির পাশে যেয়ে বসতে ইচ্ছে হয় কুহুর, মাথার ধারে বসে চুলে বিলি কেটে দিতে ইচ্ছে করে ; তারপর বুকের সাথে লেপ্টে ধরে আর্তনাদে মেতে উঠে মেয়েটার কষ্ট লাঘব করে দিতে,  মেয়েটার আর কুহুর কান্নার জলের রঙ যে এক, দুজনের জল মিশে অভিশাপ হত;বারুদ হত; বর্ষণ হত;সেই বারুদ নরপিশাচদের কলিজা ভষ্ম করে দিতকত অশ্রুর অগ্নিতে বারুদ হয় কুহু জানেনা, একজনম কি কেটে যাবে তাতে? তাও চায় যেন নরপশুগুলো বিনাশ হয়, এভাবে বুক ফুলিয়ে না হাঁটে

গোধূলির বেলা পড়ে এলো, সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো আকাশেবেলকনির গা ঘেষে দাঁড়ায় কুহু,এই বেলকনি কত আনন্দ ব্যথার সঙ্গী; এই গ্রীল আর কুহুর দু'হাতের স্পর্শ  জানে

ভাবতে থাকে সেই দিনগুলির কথা, কত সুন্দর ফুরফুরে দিন ছিলসাড়া পাড়া মেতে উঠত কুহুর আনাগোনায়মা-বাবার একমাত্র কন্যা ও, কিসের অভাব ছিল ওর? গান গাইতে জানে, ছবি আঁকতে জানে, কতইনা গল্প - কবিতা লিখত কুহু, পড়াশুনায় ও প্রথম সারির ছিলক্লাস মাতিয়ে রাখত যেই মেয়েটি সেই মেয়েটির ভাষা এখন কেউ পড়তে জানেনাকত ছেলে এই মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে কত প্রেমের কবিতা লিখেছিল-

- উপমায় তুমি অনন্যা প্রিয়া, চোখের তারায় হারাতে দিবে?

-দৃষ্টি মেলোনা, ঐ চোখে ভষ্ম হয়ে যাব, দাবানল বইবে বুকের পাঁজরায়

-তোমার চোখের কাজলে লেপ্টে রইব, ঐ চোখে জল এনে মুছে দিওনা রেখা

আর ও কত ছন্দে,কত উপমায় সেই কবিতা দেয়ালে দেয়ালে লেখা হতআর এখন? সেই চোখের নীচে কালচে দাগ,কেউ কি প্রেমে পড়ে?  ছন্দ আনে মনে?

বাবা বলত, মেয়েটা হলো হরিণের ডাগর ডাগর চোখের, ঠিক ওর দাদীর মতবাবা চুমু খেত অজস্র সেখানে, বাবার চুমুর সেই ছোঁয়া মুছে গেছে অশ্রুর দাগেবাবা চোখের দিকে তাকায়না কতদিনতাকায়না নাকি তাকাতে পারেনা? বাবার বুকের পাজরায় ও কি বাণ ছুটে এমন? নাকি বাবার মনে প্রশ্ন আসে কেন আমি কুহুর বাবা হলাম?

বাবার চোখ দেখেছিল কুহু সেদিন,ঠিক দুবছর তিনমাস আটদিন আগের সেই ঘটনার পরে,সেই চোখে ছিল সমাজে মুখ দেখাবার লজ্জা,ভয়, চাপা কান্না- ছিল প্রতিবাদী দাবানলের অগ্নিসম রূপসমাজের কোন কোন শুভাকাঙ্ক্ষীরা এসে বলেছিল থানা পুলিশ হন,  এই পিশাচদের ছেড়ে দেয়া চলবে না, এর একটা বিহীত করতেই হবেবাবা ঠিকই জানত এখানে এই নরপশুদের শাস্তি হয়নাশুধু হয় পত্রিকার শিরোনাম, মামলায় কাগজে সীলমোহর তারপর আর খোঁজ মিলেনা

সেদিনের ঠিক দুদিন আগে রোজকার মতন কুহু বের হয় ক্যাম্পাসে, মোড় ঘুরতেই কানে আসতে থাকে শিষের আওয়াজ এ যেন নিত্যদিনেরপ্রতিবাদ করতেই ফুসলে উঠে নরপিশাচগুলো তারপর?

তারপর কুহু আর ভাবতে পারেনা, ঠিক দুদিন পর বাবার বুকের এসে কানায় ভেঙ্গে  পড়ে -

-বাবা! সব শেষ আমার, সব শেষ!এ সমাজ আমায় বাচঁতে দিলনা বাবা! আমায় ক্ষমা কর বাবা

বাবা সেদিন শুধু নির্বিকার চোখে তাকিয়ে রইল, কিছু বলবার ভাষা যে নেইহুশ ফিরতেই দেখে তার বুক খালি,দৌড়ে যায় কুহুর ঘরে কেবল ফাঁস পড়ল গলায়এক ঝটকায় খুলে ফেলে ওড়নার প্যাচশুধু বলল, মা তুই অন্তত বেঁচে থাক,যে সমাজ তোকে বাঁচতে দিলনা সেই সমাজ ছেড়ে এ শহর ছেড়ে অনেক দূরে গিয়ে বাঁচ মা, তুই শুধু বেঁচে থাক মা!  নইলে যে আমার পুরষত্ব বিলীন হয়ে যাবেসেদিন বাবা মেয়ে কেঁদেছিল, সেই কান্নার জলের মত এত পবিত্র এত স্নিগ্ধ এত স্বচ্ছ আর কি হতে পারে? সেই কান্নার সাক্ষী হয়েছিল দেয়ালের ঘড়ি, জানালার পর্দা,  বেলকনির গ্রীল আর ঘড়ির আড়ালের টিকটিকিটা

এই খবর বাতাসের আগায় পৌছে গেল আনাচেকানাচে, এখানে ওখানে ফিসফিসানি মেয়েটা....?শুধু পৌঁছল না বাবা মেয়ের বেঁচে থাকার যে যুদ্ধটা শুরু হল সেই খবরটা

 দুদিনবাদে সৌমিকের ফোন যার সাথে ভালবাসা ছিল, যার সাথে বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে সেই ভরসা করার, বুকের গহীনে আশ্রয় দেয়া মানুষটির ফোন:

-কুহু! মা-বাবা বিয়েটা মেনে নিলনা যে আর!

আর কিছু বলেনি সৌমিক,  জানতে চায়নি কুহু তুমি কেমন আছ? কুহু তুমি কি বেঁচে আছ? একবারের জন্যেও বলেনি, আমি তোমার সাথে আছি কুহু, এ অশুচি এই দাগ যে কেবল দেহের; আমাদের যে আত্মার সম্পর্কসমাজের এই দেয়া নাম যে কেবল ই নাম, এ সমাজ ছেড়ে অন্য সমাজে বসত গড়ব আমরা যে সমাজে নরপিশাচরা নেই, চোখের জল মুছে ফেল কুহু এই যে আমি তোমার আছি! কুহু কাঁদেনি একটুও তার যে কান্নার ভার শুরু হল সেই কান্নার সাথে ভালবাসার মানুষ চলে যাওয়ার যে কান্না তা যে কেবলই বেমানান!  শুধু মনে মনে বলল, পৃথিবীর সব পুরুষ ই কি এক? নাহ তা কি করে হয়,বাবা তো এক নয়, যে পুরুষদের জন্যে মৃত্যু পথে যাত্রা করলাম অন্য পুরুষ যে আমায় বাঁচিয়ে রাখলসেদিন যদি বাবা এই বিদেশ বিঁভুইতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত না নিত তবে সেই সমাজ বাঁচতে দিতনা যে

এমন ঘটনা রোজ দেখতে পায় কুহু, কুহু শুধু কাঁদে তখনএই দুই বছরে কত যে লোমহর্ষক ঘটনা পড়েছে পত্রিকা গুলোয়,কেউ গলায় ফাঁস দেয়,কেউ বিচার চায়,কেউ সমাজের গঞ্জনা সয়, কেউ বিচার পায় আবার কেউ নরপিশাচদের হাতেই বলি হয়কি করুন সে মৃত্যু!  কুপিয়ে,আগুনে পুড়ে, খন্ড-বিখন্ড সে লাশ পঁচে গলে মিশে যায় কখনো জলে কখনো মাটিতেকুহুর ও ইচ্ছে করে সেই লাশের মিছিলে অংশ নিতে, সেই মাটিতে সেই জলে সেই গোরে ফুলশয্যা রচে দিতে, বিলবোর্ড টানিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় এখানে একটা নারী ঘুমিয়ে আছে যার জীবন হওয়ার কথা ছিল ফুলের মত সুগন্ধিময়,পবিত্রকুহুর ইচ্ছে করে মৃত্যুর সাথে লড়াই করা এই বীরকন্যাদের নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সেই রণে নরপিশাচদের  খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলতে তারপর  জিন্দা করে আগুনে পোড়াতে,প্রস্তরবর্ষণে মস্তক থেথলে দিতে কিংবা লাঞ্ছনা-গঞ্চনায় সমাজের দেয়ালে দেয়ালে এঁটে দিতেএকবার অন্তত একবার যেন বুঝতে পারে এই সম্ভম হরণের আর্তনাদ!

কুহু আবার কাঁদে, এ কান্নার রং পরাজয়ের রং! নরপিশাচদের শাস্তি দিতে না পারার পরাজয়, কুহু কাঁদে গভীর মুনাজাতে কাঁদে, অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদে, সিলিং ফ্যানে ঝুলতে না পেরে কাঁদেকখনো এ কান্নায় অশ্রু হয় কখনো রক্তক্ষরণদৌঁড়ে যায় স্নানাগারে,জল পড়ে,মুছে যায়না দাগ;অশুচি লাগে!কুহু আবার কাঁদে,অশ্রু মিশে যায় জলের সাথে


শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Anonymous
September 28, 2020 at 10:48 PM

ধর্ষন বিষয়ে লিখলেন? ধর্ষকের কি হলো তা কড়া ভাষায় দিতে ভাল হত

Reply
avatar