বাবার ফেরা (সাইন্স ফিকশন) দ্বিতীয় পর্ব................................তুহিন রহমান

(প্রথম পর্বের পর................)

বাড়িতে এসে বাবা অবাক। বাড়ি ঘরের এতো পরিবর্তন দেখে তিনি কিছুক্ষন স্তব্দ হয়ে থাকলেন। বুঝতে পারছেননা কি বলবেন। তারপর আমার দিকে তাকালেন,‘ঠিক বুঝতে পারছিনা। এইতো কিছুক্ষন আগে সব অন্যরকম ছিলো। এখন এতো পরিবর্তন হলো কিভাবে? এইসব মেশিন মানুষগুলো কোত্থেকে এলো?’
আমি হাসলাম,‘বাবা আসলে তুমি মারা গিয়েছিলে অনেক দিন আগে। আজ আবার তোমাকে পুনরুত্থিত করা হয়েছে।’
বাবা আমার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকলেন। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বিষয়টা। ‘তুই বলছিস আমি মরে গিয়েছিলাম? এটা কি বলছিস তুই?’
‘ঠিক তাই বাবা। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে তুমি মারা গিয়েছিলে। তোমাকে ডিপ ফ্রিজিং করা হয়েছিলো। আর আজ তোমাকে জাগিয়ে তোলা হলো।’
তারপরও বাবা বিশ্বাস করতে পারলেননা আমার কথা। তিনি ঘরের ভিতর গিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগলেন সবকিছু। বাড়ির ভিতর কেয়ারমেকাররা বাবাকে স্যালুট করলো। তিনি অবাক হয়ে আমাকে বললেন,‘আমাদের সময়ে বাড়িতে কাজের বুয়ারা থাকতো আর আজ তুই এদের দিয়ে রান্নাবান্না করাচ্ছিস? আমাকে কি এদের হাতের রান্না খেতে হবে?’
‘বাবা।’ আমি বললাম। ‘এরা এতো উন্নত ধরনের রান্না জানে যে কখনও কোন খাবারে লবন বেশী হয়না বা কোন খাবারে চুলও পাওয়া যায়না। আর এদের বললে পৃথিবীর যেকোন খাবার মুহুর্তের ভেতর বানিয়ে দিতে পারবে তোমাকে।’
তারপরও কেন যেন বাবার ভালোলাগলোনা তাদেরকে। পঁচিশ বছর আগের কথা মনে পড়লো আমার। মা মারা যাবার পর খুশির মা আমাকে আগলে রাখতো। বাবাও আমাকে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়েছিলেন তার কাছে। আমার খাওয়া দাওয়া সাজা গোজা ভালো মন্দ সব ছিলো খুশির মার ওপর। সে আমাকে অনেকটাই মায়ের অভাব ভুলতে সাহায্য করেছিলো। আমার মনে হলো বাবাও তাই ভাবছিলেন। খুশির মা তাকে যে পরিমান নিশ্চিন্ত হতে সাহায্য করেছিলো তা নিশ্চয় এই রোবটদুটো করবেনা। বাবা আমার রুমে ঢুকলেন। সবকিছু দেখতে লাগলেন গভীর মনোযোগে। 
আমি যেন ফিরে গেছি পঁচিশ বছর আগে। তবে তখনকার সেই বাবার শরীর আর এখনকার বাবার শরীরের মধ্যে ব্যাপক তফাৎ। তবে আমার মনে হয় কিছুদিনের মধ্যেই বাবা আবার আগের মতো হয়ে যাবেন। তিনি নিয়মিত বাগানের গাছগুলোর যতœ নেবেন, নিয়মিত পানি দেবেন গাছগুলোতে, ব্যস্ত থাকবেন রোবট মালিদের নিয়ে। বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম,‘আচ্ছা বাবা তোমার মনে আছে যখন তোমার মৃত্যু হলো তারপর কি হয়েছিলো?’
বাবা মাথা নাড়লেন। ‘আমি যে কখন মারা গেলাম আর কোথা দিয়ে এতো সময় কেটে গেল সেটাই তো জানলামনা।’
‘তারমানে তুমি মারা যাবার পর কিছুই দেখনি?’
বাবা হাসলেন,‘কিছুই তো ঘটেনি দেখবো কি?’
‘তোমাকে যে ডিপ ফ্রিজিং করা হয়েছিলো সেজন্য তোমার একটুও ঠান্ডাও লাগেনি?’
বাবা মাথা নাড়লেন। না, তার ঠান্ডাও লাগেনি।

বাবার সাথে এভাবে দুটো দিন কেটে গেল। বাবা এই দুটো দিন কিছুই করলেননা। খালি ঘুমোলেন। স্বাভাবিক ব্যপার, এতোগুলো বছর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এতোদিন পর জেগে উঠেছেন এখন শরীর সেই ঘুমটা এতো তাড়াতাড়ি কাটিয়ে ওঠে কিভাবে? তৃতীয় দিনে বাবাকে একটু কর্মব্যস্ত দেখা গেল। বাবা বাগানের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখে একটু স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন। তার বাগানটা যে আমি ঠিক রেখেছি সেটা দেখে তিনি বেশ শান্তি অনুভব করছেন। 
দুপুরে খেতে বসেছি হঠাৎ বাবা খাওয়া থামিয়ে প্রশ্ন করলেন,‘আচ্ছা আমি যখন মারা যাই তখন আমার বয়স ছিলো তিরাশি বছর। তুই বলছিস আমি পঁচিশ বছর আগে মারা গিয়েছিলাম। তাহলে এখন আমার বয়স দাঁড়ালো প্রায় একশো আট বছর।’
আমি হেসে বললাম, ‘এতে সমস্যা কি বাবা? যা খরচ হচ্ছে সব আমার।’
বাবা আগের মতোই ভ্রু কোঁচকালেন,‘খরচ হচ্ছে মানে কি?’
আমি তার দিকে তাকিয়েছিলাম। স্মিত হেসে বললাম,‘তোমার ছেলের টাকা আছে তাই তোমাকে সপ্তাহে এক হাজার ডলার পে করে আমার কাছে রেখে দিয়েছি।’
বাবা এক মুহুর্তের জন্য ফ্রিজড হয়ে গেলেন। তারপর তার চোখে বিস্ফোরন ঘটলো,‘ইউ আর সার্টেনলি এ্যা ম্যাড...তারমানে আমার জন্য এ পর্যন্ত...।’
‘হ্যাঁ বাবা, তোমার জন্য আমি গত দু’মাসে ব্যয় করেছি অনেক ডলার। কিন্তু তাও কোন সমস্যা নয়। প্রতি সপ্তাহে একবার করে তোমাকে যেতে হবে এমআর সেন্টারে আর সেখানে তোমার শরীরে বিশেষ রক্ত ঢোকানো হবে। এভাবেই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবো আমি।’
‘এটা খুব খারাপ করছিস তুই। আমি একদম মানতে পারছিনা। আমি কতদিন বাঁচবো আর? কি দেখার আছে আমার?’
‘আমি যতদিন থাকবো ততদিন তুমি থাকবে।’ আমি হেসে বললাম।


বাবার মনটা খারাপ হয়ে গেল যখন জানলেন তার প্রিয় বন্ধু কালিদাস মারা গেছে দশ বছর আগে। তার আরেক বন্ধু মনসুরও মারা গেছে দুই বছর আগে। বাবা বেঁচে থাকতে এরা প্রতিদিনই আসতেন। আর বাবা এদের নিয়ে সব ভুলে থাকতেন। বাবার প্রিয় আরেকটা জিনিষ ছিলো। পাইপ। প্রতিদিনই তিনি পাইপে তামাক ভরে টানতেন। সবাই মিলে বৈঠকখানায় পাইপ টানতো আর হৈ হল্লা করতো। এই খবরটা শোনার পর থেকেই বাবার মনটা বিষন্ন থাকতো। একদিন জিজ্ঞেস করলেন,‘আচ্ছা মনসুর আর কালিদাসের বয়স কতো হয়েছিলো বলতে পারিস?’
‘মনে হয় তোমার মতোই বয়স হয়েছিলো ওদের’। আমি বললাম।
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,‘আমিই শুধু একশো আট বছর আয়ু পেলাম তাইনা?’
আমি বললাম,‘একশো আট বছর কোথায়? এখান থেকে পঁচিশ বছর বাদ দাও।’
বাবা বললেন,‘এতোদিন বেঁচে থাকার কোন যুক্তি নেই। আমি কাউন্ট ড্রাকুলা হতে চাইনা।’
আমি বললাম,‘ছি: বাবা, এসব কি বলছো? তোমার কি আমার সাথে থাকতে ইচ্ছে হয়না?’
বাবা বললেন,‘অবশ্যই হয়। কিন্তু এটা অর্থহীন বেঁচে থাকা। এভাবে কতোদিন বেঁচে থাকবো? সবকিছুর একটা শেষ আছে। শেষ থাকতেই হবে।’
‘তা নাহয় থাকলো কিন্তু এখনই আমাকে ছেড়ে যেতে পারবেনা তুমি।’



পরের সপ্তাহে বাবাকে আমি এমআর সেন্টারে নিয়ে গেলাম। সেখানে বাবাকে বিশেষ রক্ত দেয়া হলো আর মাথায় পরানো হলো অদ্ভুত হেলমেট। আধাঘন্টা পর রুম থেকে বেরিয়ে এলেন বাবা। বাবাকে নিয়ে অনেক মার্কেটে গেলাম আমি। বাবা এসব শপিং মল দেখেননি। গত পঁচিশ বছরে ঢাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাবাকে কিছু শার্ট প্যান্ট আর লুঙ্গি কিনে দিলাম আমি। বাবা বাড়িতে ফিরে নামাজ পড়লেন। এটা বাবার একটা ইম্পর্টেন্ট কাজগুলোর একটা। যদিও পৃথিবী থেকে ধর্ম বিদায় নিয়েছে কিন্তু বাবা চিরদিন নামাজ পড়েছেন। তাই অভ্যাসগত ভাবে এটা তার ভুল হলোনা। বাবাকে বললাম,‘আচ্ছা বাবা মৃত্যুর পর তো কিছুই দেখনি তুমি। তোমার আত্মা তোমার দেহ ত্যাগ করে ঘুরে ফিরে এলো। কিন্তু এখনও তুমি ধর্ম পালন করে যাচ্ছ? এটা কি তোমার বিশ্বাস নাকি অভ্যাস?’
বাবা হেসে বললেন,‘কোনটাই না। আমি শুধু এটাই ভাবি যে, এইযে তুই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিস কৃত্তিমভাবে এতে তোর লাখ লাখ ডলার অপচয় হচ্ছে। আমাকে প্রতি সপ্তাহে নিতে হচ্ছে এমআর সেন্টারে। মাথায় পরাতে হচ্ছে হেলমেট। শরীরে ঢোকাতে হচ্ছে কৃত্তিম রক্ত। কিন্তু একটা সাধারন মানুষ সুন্দরভাবে প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে থাকতে গেলে এতো টাকার দরকার পড়েনা। তাকে কোথাও গিয়ে শরীরে কোন রক্ত ঢোকাতে হয়না। কাউকে ট্যাক্স দিতে হয়না। তারপরও আমরা সামান্য সময়ের জন্যও তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিনা। অথচ তিনি মহা বিজ্ঞানী।’
আমি কিছু বললামনা। ইদানিং ব্যবসায় লস যাচ্ছে আমার। বেশ অনেকগুলো স্পেস প্রোজেক্টে লোকবল কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। ব্যবসায় আরও লস হলেই সমস্যায় পড়ে যাবো আমি। হ্যাকাররা চেষ্টা করছে আমার ব্যবসাটা ছিনিয়ে নিতে। একদিন উঠে দেখলাম আমার ওয়েবসাইটটা তারা হ্যাক করে সেখানে নিজেদের ব্লগ সাইট এ্যাড করে দিয়েছে। এসব হ্যাকারদের কাউকে আমি চিনিওনা। তারা কেন আমাকে মারতে চায় তাও আমি জানিনা। তবে এটা আমি বুঝি যে আমার অনেক টাকা আছে এটা তারা জানে এবং সেজন্যই আমাকে তারা ঈর্ষা করে।
বাবা প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। ফুলের গাছের যত্ন, টিভি দেখা, বাবা বেঁচে থাকতে পাবলিক হেলথ ডিভিশনে কাজ করতেন। একদিন সেখানে গেলেন তিনি। দেখলেন তার সাথে যারা কাজ করতো তারা কেউ বেঁচে নেই। অফিসের অনেক কিছুই তখন আর নেই। তিনি যে টেবিলে বসে কাজ করতেন সেটাও নেই। সেখানে অন্য রুমের দেয়াল উঠে গেছে। রুম্পা নামের এক সুন্দরী মহিলা বাবার সাথে চাকরি করতো। বাবাকে সে বেশ পছন্দ করতো। মাঝে মাঝে কারনে অকারনে বাবার হাত চেপে ধরতো সে। বাবা এতে মজা পেতেন। বাড়ি ফিরে আমাকে এসব কথা বলতেন আর হাসতেন। বাবা অফিসে গিয়ে জানলেন রুম্পাও নেই। সে প্রায় বছর খানেক হলো মারা গেছে। বাবাকে অফিসের নতুন কর্মচারী কর্মকর্তারা চিনতে পারলোনা। বাবাও নিজের পরিচয় দিলেননা তাদেরকে। 
বাড়িতে ফিরলেন বাবা অনেকটা বিমর্ষ মনে। বাড়িতে ফিরেই আমার রুমে ঢুকলেন। জানতে চাইলেন আমি কোন গুরুত্বপূর্ন কাজ করছি কিনা। আমি বললাম না, আমি তেমন কোন গুরুত্বপূর্ন কাজ করছিনা।
বাবা সব খুলে বললেন আমাকে। এটা তার চিরদিনের অভ্যাস। মা বেঁচে থাকতে বাইরে কোন কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে সে কথাও মাকে এসে বলতেন। আর এখন আমাকে বলেন। তাকে মনোক্ষুন্ন দেখাচ্ছে। শেষে যোগ করলেন,‘আচ্ছা আমার বেঁচে থাকাটাকে কি বলা যেতে পারে? জীবন্মৃত নাকি লিভিং আফটার ডেথ নাকি ডেড ম্যান লিভিং?’
আমি হাসলাম,‘বাবা তোমার মতো আরও বহু মানুষ এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে। যখন প্রয়োজন হচ্ছে তাদের বাঁচিয়ে তোলা হচ্ছে আবার প্রয়োজন না হলে ডিপ ফ্রিজিং করা হচ্ছে। তুমি দরকার হলে ছয়শো বছর বাঁচবে।’
বাবা মাথা নাড়তে নাড়তে পাশের ঘরে চলে গেলেন। তিনি কোনভাবে মানতে পারছেননা এই নিয়ম। 
আমার বেশ ঠান্ডা লেগেছে। খুক খুক কাশির সাথে গলায় কফ জমে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। বেগতিক দেখে বাবাই আমাকে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার একটা চারকোনা পেপার রাখলেন আমার জিভের ওপর আর তাতে সব রোগের বিবরন উঠে গেল। তিনি আমাকে ওষুধ দিলেন। 
মজার ব্যপার হলো থার্মোমিটারে বাবার কোন তাপমাত্রা শো করেনা। প্রেশার মাপা মেশিনে বাবার কোন ব্লাড প্রেশার দেখায়না। ঠিক এক মিনিট পরপর বাবার বুকটা একবার ওঠানামা করে। বাবা খুব ব্যথিত গলায় বললেন,‘আমি নিজেও একটা রোবট। কেনযে তুই আমাকে আবার বাঁচিয়ে তুললি!’


বাবা দু’দিন বেশ চুপচাপ হয়ে থাকলেন। সম্ভবত: তার ব্লাডপ্রেশার নেই এই বিষয়টা তাকে বেশ কষ্ট দিয়েছে। তিনি মানুষের মতো বেঁচে ছিলেন। সেটাই তিনি এখনও চান। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। বাবা বেঁচে ওঠার একমাস পার হলো। একদিন আমি সুপার কম্পিউটারে কাজ করছি আর কফি খাচ্ছি বাবা রুমে ঢুকলেন। বেশ খুশি খুশি লাগছে তাকে। অনেকদিন পর তাকে এই রকম ফ্রেশ লাগছে দেখে আমারও ভালো লাগছে। আমি বললাম, ‘বাবা, চা খাবে?’
বাবা বললেন,‘খাবো।’
আমি কেয়ারমেকারদের নির্দেশ দিতে বাবার জন্য চা এনে দিলো তারা।
বাবা আমাকে বললেন,‘আমি জানি তুই খুব ব্যস্ত থাকিস। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় তোর নেই। এতোদিন হয়ে গেল তাও তুই বিয়ে করলিনা এখনও। এবার একটা বিয়ে কর। আমি বৌমার মুখ দেখতে চাই।’
আমি একটু চমকে গেলাম। বাবাকে বললাম,‘তুমি ভুল করছো বাবা।’
‘ভুল করছি?’
‘হ্যাঁ বাবা।’
‘কি ভুল?’
‘বিয়ে বলে এখন আর কিছু নেই। কেউ বিয়ে করেনা। আমি বিয়ে করিনি।’
বাবা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ‘কেউ বিয়ে করেনা মানে?’
‘মানে বিয়ে করার দরকার পড়েনা।’
‘সেটা কি রকম?’
‘হয়ত: তুমি বলবে তাহলে নারী পুরুষ রয়েছে কেন, তাইতো?’
বাবা মাথা নাড়লেন।
শোন বারো বছর হবার পর প্রতিটি মানুষের মাথার ভেতর একটা করে পিএপি চিপ সেট করা বাধ্যতামূলক। আর এর ফলে তার যখনই প্রয়োজন হবে তখনই সে কল্পনায় তার প্রিয় নারীর সাথে মিলিত হতে পারবে। আমার স্ত্রী আমার মাথার ভেতর একটা হলোগ্রাফিক চিপের ভেতর অবস্থান করে। আমার যখন তাকে প্রয়োজন হয় তখনই আমি সেমিসেন্স পর্যায়ে চলে যাই আর তখন সে আসে। আমার আত্মিক ও শারিরিক তৃপ্তি আমি তার কাছ থেকে পাই। কিন্তু তুমি তাকে দেখতে পারবেনা। সেমিসেন্স পর্যায়ে তুমি তার ছবি তুলতে পারবে এবং তার প্রিন্ট নিতে পারবে। এইযে দেখ তোমার পুত্রবধুকে।’
আমি বাবার দিকে একটা ছবি বাড়িয়ে দিলাম। একটা অনিন্দসুন্দর মেয়ের ছবি। বাবা অবাক হয়ে বললেন,‘কি যা তা বলছিস? এটা তো সায়রা বানু। দিলীপ কুমারের বৌ!’
আমি বাবার দিকে চেয়ে তার ভাব বোঝার চেষ্টা করলাম। আমি নিশ্চিত হলাম বাবা কিছুই বোঝেনি। আমি বললাম,‘বাবা তুমি তাকে চেন কিন্তু আমি তাকে চিনিনা। সে হয়তো তাই বা সে বহুদিন আগে মারা গেছে কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসেনা। তার ছবি আমি ইন্টারনেটে পেয়েছি এবং তার ছবি আমি ডাউনলোড করে জমা দিয়েছি মেটিং কাউন্সিল এ। মেটিং কাউন্সিল আমার মাথায় লাগানো পিএপি চিপ এর ভেতর এটাকে ইন্সটল করে দেয়। ফলে যাকে তুমি সায়রা বানু নামে চেন সে আমার স্ত্রী হয়ে যায়। এই সায়রা বানুই যখনই আমি সেমিসেন্সে চলে গিয়ে ডাকি হাজির হয়। আমি তাকে বিছানায় নিয়ে যাই। যা খুশি করি। এমনকি স্বাভাবিক নারী পুরুষের মিলনের ফলে নারী যেমন গর্ভবতী হয় তেমনি সেও হয়। যখন আমি সন্তান চাইবো ঠিক তখনই আমি সন্তান নিতে পারবো। আর সন্তান কেমন হবে সেটাও আমি নির্ধারন করে দিতে পারবো। শেষে একটা কেবলের মাধ্যমে সেই ইমেজ সন্তানকে ট্রান্সফার করতে পারবো আমি কাউন্সিলের কাছে। কাউন্সিল সেই ইমেজটাকে আমার ডিএনএ কম্পাউন্ডের মাধ্যমে ধারন করে দীর্ঘসময় ইনকিউবেশন করে আমার সন্তানকে ঠিক যেভাবে আমি ইমেজিং করেছিলাম ঠিক সেভাবে আমার কাছে দিয়ে যাবে।’ আমি খুশি হয়ে বললাম,‘বাবা তুমি কি জানো যে আমার ইমেজিং অনেক আগেই আমি করেছি এবং তা কাউন্সিলের কাছে জমা দিয়েছি। এখন চার মাস চলছে। আর মাত্র দু’মাস পরই আমি আমার বেবীকে পাবো নিজের কাছে। একটা ছেলে নিয়েছি আমি।’
বাবা চোখ ছানাবড়া করে জিজ্ঞেস করলেন,‘সায়রা বানু না হয়ে যদি তুই ইন্দিরা গান্ধী বা প্রিন্সেস ডায়ানার ছবি দিতি তবে কি তারা...।’
আমি বাবাকে শেষ করতে না দিয়ে অট্টহাস্যে বললাম,‘কি যে বলো বাবা, শুধু সায়রা বানু বা ইন্দিরা গান্ধী কেন যদি হলিউডের কোন নায়িকাকে চাই তাও পাবো। এবং আমি ইচ্ছে করলেই একশো বা দু’শো বিয়ে করতে পারবো। এটা অনেকটা মুভি দেখার মতো। যতো খুশি মুভি দেখ।’
আমার কথাগুলো বাবা ঠিক যেন গিলতে পারছেনা। হতবাক বিশ্মিত দেখাচ্ছে তাকে। দশ সেকেন্ড বিরতি নিয়ে তিনি বললেন,‘নাউজুবিল্লাহ! এটাতো মারাত্বক পাপ কাজ। বিয়ে ছাড়াই সবাই এভাবে বসবাস করছে। হোক তা স্বপ্নে বা বাস্তবে। আমি কোনভাবেই মানতে পারছিনা। এটা মানতেও পারবোনা। আচ্ছা আমি কি পঁচিশ বছর ঘুমিয়ে ছিলাম নাকি তারও বেশী?’
‘না বাবা, মাত্র পঁচিশ বছরে দুনিয়াটা বড্ড বদলে গেছে। এখানে সবকিছুই সাইবার, সবকিছুই কপোট্রনিক, সবকিছুই সায়েন্টিফিক। যা যুক্তিতে আসে তাই এখানে করা হয়। যা অংকে মেলেনা তা বাদ দিয়ে দেয়া হয়। আমার বাচ্চাটাকে দেখবে বাবা?’
আমি কম্পিউটারের ড্রাইভ থেকে একটা ছবি খুললাম। বাবাকে বড়ো করে দেখালাম। খুব সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা। অসাধারন! আর মাত্র দু’মাস পর এই বাচ্চাটা আমার বাড়িতে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াবে। 
বাবাকে কেন যেন খুব আহত দেখাচ্ছে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,‘তুই নিজেও একটা কপোট্রনিক মানুষ। আমার সন্তান না। আমি এই পৃথিবীর কেউ না। এই পৃথিবী আমার জন্য নয়। এই ধর্মহীন পৃথিবী আমি জানিনা তোদের কোথায় নিয়ে যাবে। আমার এই রোবটিক বেঁচে থাকাও আমি সহ্য করতে পারছিনা আর।’
আমি হাসলাম কিন্তু বাবার মুখে হাসি নেই, অর্থাৎ তিনি যা বলেছেন তাই তিনি বিশ্বাস করেন। 

দুটো দিন আমি বাবার খোঁজ রাখতে পারলাম না। বাবাকেও দেখলাম তিনি কি নিয়ে যেন খুব ব্যস্ত আছেন। বড় বড় বই খুলে পড়াশোনা করছেন। মাঝে মাঝে আমার কম্পিউটার খুলে কি যেন সব খোঁজেন ইন্টারনেটে। এভাবে দিনের পর দিন কেটে যায় আর আমিও বাবার কথা ভুলে থাকি। আমার এটা ভালো লাগে যে বাবা আবার আগের মতো হয়ে গেছেন। তার কংকালসার শরীর এখন বেশ তরতাজা লাগে। তবে সব ভুলে গেলেও বাবার এমআর সেন্টারে যাবার কথা ভুলিনা। অটোকার পাঠিয়ে দেই আর রোবট ড্রাইভার ঠিকমতোই তাকে নিয়ে যায় সেখানে। এভাবে বাবার কাছ থেকে বেশ দুরে সরে থাকা হয় আমার। আর আমিও চাই যেন বাবা নিজের কাজে মন দেন।
বাবার পুনরুত্থানের দুই মাস পুর্ন হলো। এদিকে আমার ইনকিউবেটেড সন্তানকে বাড়িতে আনার মাত্র সাতদিন বাকি। কর্তৃপক্ষ ইমেইল করে তারিখ জানিয়েছে আমাকে। আমি পরপর দু’রাত সেমিসেন্স পর্যায়ে গিয়ে আমার স্ত্রী ডলবিকে জানিয়েছি সুসংবাদটা। ডলবি শুধু বলেছে,‘দেখতে কেমন হবে কে জানে?’
আমি ইচ্ছে করে বলেছি,‘একদম দিলীপ কুমারের মতো।’
ডলবি অবাক হয়ে বলেছে,‘সে কে?’
‘বাবা নামটা বলেছেন আমাকে। বিংশ শতকের নায়ক। আর তোমার আসল নাম হচ্ছে সায়রা বানু। সায়রা বানুই আমার স্ত্রী যাকে আমি ডলবি বলে ডাকি।’
ডলবি রাগ করে বললো,‘আমার নামই ডলবি। সায়রা বানু হবে কেন?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’


ইনকিউবেটেড বাচ্চা বাড়িতে আসার আর পাঁচদিন বাকি সেই সময়টাতেই ঘটে গেল সেই ঘটনা। আমি অটোকারে করে বাড়ি ফিরে এলাম, দেখি বাবা বসে বসে কি যেন লিখছেন। জিজ্ঞেস করতে বললেন কিছু শেখার চেষ্টা করছেন তিনি আর বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে গবেষনা করছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম,‘তুমি সাইন্সকে সারাজীবন ঘৃনা করে এসেছো আর সেই সাইন্স নিয়েই গবেষনা করছো।’
বাবা হাসলেন,‘এটা ঠিক বিজ্ঞান নিয়ে গবেষনা নয়। এটা অনেকটা নিজেকে নিয়ে গবেষনা বলতে পারিস। আমি নিজের বেঁচে ফিরে আসা নিয়ে একটু পড়াশোনা করছিলাম। জানলাম যে, আসলে আমি মানুষই না। মানুষ হতে গেলে প্রথম যে শর্ত অর্থাৎ ব্রেন সেটাই নেই আমার। আমার মাথার ভেতরেও তারা বসিয়ে দিয়েছে কপোট্রন। আর সেই কপোট্রনেই আমার জীবনের সব তথ্য তারা আপলোড করে দিয়েছে। আর শরীরে ঢুকিয়েছে গ্লিসারিন রক্ত। যে হার্টটা আমার ছিলো সেটা তারা সরিয়ে সেখানে যোগ করেছে প্লাস্টিকের হার্ট যে কারনে আমার হার্টবিট নেই। আমার প্লাস্টিকের কিডনি, লিভার, পাকস্থলী সব তারা সংযোজন করে দিয়েছে নতুন করে অর্থাৎ আগের সেই আমার অর্ধেকটাই নেই। আমি নতুন করে জন্ম নিয়েছি পুরাতন স্মৃতিগুলো নিয়ে। এ বড়ো যন্ত্রনাদায়ক বিষয়। তাই নিজেকে কিভাবে ধ্বংশ করবো সেটা নিয়েই পড়াশোনা করছিলাম আমি।’
‘কি বলছো তুমি বাবা!’
‘তুই তো জানিস তোর মা মারা গেছেন অনেক আগে। আমার বন্ধু যারা ছিলো তারা সবাই মারা গেছে। আমার সমসাময়িক কেউ বেঁচে নেই এখন কেবল আমিই বেঁচে আছি। এ যেন সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর একা একা বিছানায় শুয়ে নির্ঘুম ছটফট করা। আমি হয়ত: আরো অনেকদিন নিরোগভাবে বেঁচে থাকতে পারবো বিজ্ঞানের কল্যানে কিন্তু তা হবে তোর রোবট বাবার বেঁচে থাকা, আসল বাবা নয়। এভাবে মৃত বাবা মা স্ত্রী আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের স্মৃতি বুকে নিয়ে দিনের পর দিন বেঁচে থাকা সত্যিই কষ্টের। তাই আমি দেখছিলাম কিভাবে আমি নিজেকে ধ্বংশ করতে পারবো। এমনকি আমি যদি ফোর ফরটি ইলেকট্রিক লাইন ধরে ঝুলে পড়ি তাও মারা যাবোনা, আমার কোনদিন হার্টের অসুখ হবেনা। কিডনি নষ্ট হবেনা। যদি হয়ও তাও আবার ইমপ্ল্যান্ট করা যাবে। এভাবে আমি বাঁচবোনা। তুই যতোই চেষ্টা করিস না কেন। এই ধর্মহীন পৃথিবী আমি দেখতে চাইনা একদন্ডও। এই পৃথিবীতে এখন বিয়ে নেই। বাচ্চা হয় মেশিনের ভেতর দিয়ে। স্ত্রী আসে অবচেতন মনের ভেতর দিয়ে। এ আমি সহ্য করতে পারছিনা একদম। তাই তোর অজ্ঞাতে আমি নিজেকে ধ্বংশ করে দিয়েছি।’
‘কি?’
‘আমি তোর একজন ডি-ফোর্সকে দিয়ে এক বোতল এসিড আনিয়ে নিয়েছিলাম। সেটা আজ সকালে চায়ের সাথে পান করেছি। কোন যন্ত্রনা নেই শরীরে, কেবল পেটের নিচের অংশ গলে পড়ে গেছে।’ বাবা প্যান্ট খুললেন। দেখলাম তার নিচের অংশ পুড়ে গলে নেমে গেছে নিচে। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।
‘আমার শরীর থাকলেই তুই তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবি। আর কয়েকটা মিনিট হয়ত: বাঁচবো আমি। তোর মেশিন মানব অর্থাৎ আমার মেশিন নাতিপুতি আমার দেখার শখ নেই।’ বাবা ক্লান্তভাবে বললেন। ‘এবার আমি মারা গেলে আমাকে আর ডিপ ফ্রিজ করবিনা। আমাকে কবর দিবি। যেভাবে তোর মাকে কবর দিয়েছিলাম ঠিক সেভাবে তার কবরের পাশে মাটিতে আমাকে কবর দিবি জানাজা পড়িয়ে।’
বাবা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেননা আর। এসিড তার পুরো শরীরকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। সম্ভবত: আমাকে ঘটনাটা বলার আগ্রহ এতোটা সময় তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ঘোলাটে চোখে বাবা তাকালেন আমার দিকে। চোখে হাসি। বিজয়ের হাসি। বললেন,‘বাবা মারা গেলে সবাই একবার কষ্ট পায়, একবার কাঁদে। তুই দুইবার কষ্ট পেলি, দুইবার কাঁদলি। এরকম ভুল আর করিসনা। মনে রাখিস সব কিছুর শেষ আছে। শেষ যদি না থাকে তার শুরুই থাকেনা। তাই আমাকে চলে যেতেই হবে যেখান থেকে আমি এসেছি ঠিক সেখানে। এটাই নিয়ম।’
বাবা বসে পড়লেন,‘আমাকে এতো ভালোবাসিস তুই। আমি জানতামনা। আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ...।


শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Porimal Biswas, Thanapara, Kustia
September 11, 2020 at 12:58 PM

যারা সায়েন্স ফিকশন লেখেন তারা বেশীরভাগই অন্য গ্রহ নক্ষত্র আর রোবট নিয়ে লেখেন। তার এমন গল্প লিখতে জানেনা। আমি এই প্রথম একটা সায়েন্স ফিকশন পড়লাম যেটা একেবারে অন্য ধাঁচের আর শেষটা অত্যন্ত করুন। ভালোলাগলো এবং কি আর বলবো

Reply
avatar
Anonymous
September 30, 2020 at 12:53 AM

এক কথায় বলা যাবনা। বার বার পড়ে বিশ্ময় জেগে থাকে

Reply
avatar
October 1, 2020 at 8:21 PM

অনেক ধন্যবাদ দাদা। আপনাদের অনুপ্রেরনায় আরও লিখবো।

Reply
avatar
October 2, 2020 at 10:27 PM

Science sob dik theke egiye geleo manobotar dik theke bodhoi manush k akhono harate pareni,golpotao setai bole gelo👍

Reply
avatar