একটু পর রাত নামে। জহির ভাবে, সে হয়তো কাউকে খুঁজে পাবে, কিন্তু নিকটবর্তী কাউকে দেখতে পায় না সে। সন্ধ্যা রাতে শহরাঞ্চলে কোলাহল থাকে। মানুষ অবসর নিয়ে খুচরা আলাপে লিপ্ত হয়, চায়ের কাপে টুংটাং আওয়াজ দেয়, হকারদের দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু এখানে সে- সবের কিছুই নেই। যদিও প্রত্যন্ত গ্রামদেশে কোলাহল খোঁজাটা বড় অবান্তর। তবে সে শুনেছিল, এখন গ্রাম আগের মতো একেবারে অবহেলিত নয়, মানুষ শিক্ষিত হয়ে গেছে, রাস্তাঘাট উন্নত, শিল্পায়নের প্রভাবে তাদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে, হতদরিদ্র মানুষ আজকাল আর চোখে পড়ে না বললেই চলে, তারাও গভীর রাত অবধি দোকানপাটে পড়ে থাকে, বলা যায় গ্রাম এবং শহরের পার্থক্যটা কমে এসেছে। জহিরের চশমা ঢাকা চোখে সে চিত্র এখনও পড়েনি। সে সন্তর্পণে একটা বাঁশ ঝোপের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়। বস্তুত এটাই যাবার রাস্তা। জহির শব্দ করে না, কিন্তু কেনো জানি বাঁশ ঝোপে লুকিয়ে থাকা পাখিরা বুঝে ফেলে তাকে এবং গলা ছেড়ে বাকিদের জানান দেয়, তারপর জোটবদ্ধ চিৎকারে লিপ্ত হয় তারা।
আকস্মিক সেই চিৎকারে জহিরের গা টা ছমছম করে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণে আবার ভালো লাগে তার, এবং ভাবে, আহারে যদি আরেকবার অমন ডাকতো ওরা! কিন্তু পাখিরা আর চিৎকার করে না। জহির অপেক্ষা করে তবু, দপদপ শব্দ করে পা ফেলে, কিন্তু পাখিরা নিশ্চুপই। এবার সে হাঁটা শুরু করে; ঘোলাটে অন্ধকারে পচা কাদায় তার পা খপ করে আটকে যায়। কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে ঢের কষ্ট হয় তার। তারপর সে পায়ের জুতা জোড়া খুলে হাতে নেয় এবং পুনরায় হাঁটতে থাকে। কয়েক পা হেঁটে গেলে জহিরের ডান পায়ের তলে পিচ্ছল অনুভূতি হয়। ঠিকমত বুঝতে পারে না সে, অতএব তাকে অনুমান করে নিতে হয়; তখন সে অস্ফুটে মুখে বলে, পাখির পায়খানা হবে বোধহয়। ঐ সময় কোনো এক কারণে যেন একটু ঘেন্না লাগে তার কিন্তু আশপাশে বাড়িঘর কিংবা পরিষ্কার পানির সন্ধান এখুনি মিলবে না এমন সান্ত্বনায় তাকে মানিয়ে নিতে হয়। একটা লাল শেয়াল তাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়, জহির হিস্ হিস্ শব্দ করে তাকে তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। শেয়ালটি তার দিকেই তেড়ে আসতে থাকে, জহির ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে এবং তাকে চলে যাবার রাস্তা করে দিতে একটু পার্শ্বে সরে গিয়ে নীরবে দাঁড়ায়। কেননা এই জাতীয় আক্রমণাত্মক প্রাণীগুলো দল বেঁধে খাবারের সন্ধানে রাতে ঘুরতে থাকে। জহির অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আশপাশ তাকিয়ে দেখে এবং স্বস্তি পায় এই আশায় যে নিকটবর্তী এই শেয়ালটি ছাড়া একটা ইঁদুরও দেখে না সে। শেয়ালটি তার কোল ঘেঁষে অত্যন্ত ভদ্রভাবে হেলেদুলে গন্তব্যে চলে যায়। জহিরের গা থেকে ঘাম ছাড়ে।
এবার পূর্বের ন্যায় আপেক্ষিক আরো অনুন্নত একটা রাস্তায় পৌঁছে যায় সে। জহির অবাক হয় এবং আক্ষেপও হয়, অতঃপর অস্ফুটে বলে, এই রাস্তায় মানুষ চলে! কিন্তু তারপর সে আরো কঠিন বাস্তবতায় পৌঁছে যায় এবং ডিপটয়েলের আলো এসে রাস্তায় পড়ে তখন, অতঃপর সেই আলোয় সে অস্পষ্ট দেখে রাস্তার অসংখ্য জায়গায় গোবর পড়ে আছে। থিতিয়ে আছে গোবর কাদামাটির সাথে। এখন এই গোবর ডিঙিয়ে তাকে যে গ্রামের ভিতর যেতে হবে এটা পুরোপুরি নিশ্চিত। তখন তার মনে হয় এই গ্রামের মানুষ খুব পরিশ্রমী হবে নিশ্চয়। তারা গরু পোষে, ক্ষেতখামারে কাজ করে, বস্তুত অত্যন্ত সহজসরল জীবনযাপন তাদের। সেই সাথে একটু তৃপ্তিও হয় বটে, কেননা যতদিন সে এখানে থাকবে নিশ্চয়ই টাটকা সবজি, গাভীর দুধ, অন্ততপক্ষে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারবে এই ভাবনায়। শহরে হাশেম নামে যে লোকটি তাকে রোজ সকালে দুধের জোগান দিতো, সে দুধ মোটেও খাঁটি নয়। তবুও লোকটি কী অবলীলায় একশত একটা মিথ্যা একজায়গায় করে আত্মশুনানি করে চলতো। সে ইঙ্গিত করতো, তার সেই দুধের মতো নির্ভেজাল সুস্বাদু দুধ অত্রাঞ্চলে নেই, তার গরু শুধুই কাঁচাঘাস-খড়-খৈল-ভুষি এবং পরিষ্কার পানি ব্যতীত আর কিছুই খায় না, এমনকি আধুনিক খাদ্যখাবার মোটাতাজাকরণ ঔষধ পর্যন্ত সে কখনওই গরুকে দেয়নি, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সে যাই বলে না কেনো দুধ জ্বাল দেবার পর জহির মুখে নিয়ে দেখতো তা কেমন যেন বিস্বাদ, টকটক, বস্তুত অখাদ্য বলা চলে। এখন তার মন বলে ঐ কাজটি এখানে নিশ্চয় হবে না। তারপর কিছুক্ষণ হেঁটে গেলে একটা বাড়ি দেখতে পায় জহির। খোলামেলা ঐ বাড়িতেই একটা নীল রঙ করা টিউবওয়েল তাকে অভ্যর্থনা জানাতে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হয় তার। জহির কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে হাত পা ধুয়ে নেয়। ঐ সময় একজন স্ত্রীলোক তার কাছে এসে দাঁড়ায় এবং তার সম্পর্কেই বিস্তারিত জানতে চায়। জহির নিজের পরিচয় প্রায় একদমে বলে যায় এবং একটু থেমে তার এখানে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে চলে। স্ত্রীলোকটি এবার ভরসা পায় এবং অনুনয় করে তাকে ভিতরে যেতে বলে। জহির অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং হেসে বলে বেশি বিলম্ব হলে নিশ্চয় তার গন্তব্যস্থানের লোকেরা দুশ্চিন্তা করতে পারে। তখন স্ত্রীলোকটি তার গন্তব্যস্থান ও তাদের নামধাম জানতে ব্যগ্র হয়। জহির এবার ইতস্তত বোধ করে কেননা তার গন্তব্যস্থান এখনও ঠিক হয় নি, এবং তার ধারণা আজ রাতটা সে কোনোরকমভাবে মসজিদ কিংবা অন্য যে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে ঘুমিয়ে কাটাতে পারবে। স্ত্রীলোকটি তার মনোভাব বুঝতে পারে এবং তার ছেলেদের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে ডাক দেয়, অতঃপর তাদেরকে বলে তাদেরই এই বাড়িতে সে যেন আজকের রাতটা আতিথেয়তা গ্রহণ করে। কিন্তু জহির দ্বিতীয় বারের মতো তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে এবং তখন তাদের এক ভাই এখানে থাকার পক্ষে অনেকগুলো যুক্তি দাঁড় করিয়ে দেয়। জহির এ পর্যায়ে এসে সম্মতি না দিয়ে পারে না, এবং পরবর্তীতে সে ভিতরে গিয়ে বসে। তাদের আন্তরিকতায় সে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যায়, এই মানুষগুলো এত সহজসরল কেনো? এই জাতীয় প্রশ্ন মাথায় আসে তার। তারপর সে একটা ব্যথার অনুভব করে। কাদাভরা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে তার পায়ে মুহূর্তে ব্যথা করতে থাকে এবং সে পায়ের পাতা মাটিতে রাখতে ব্যর্থ হয়। অতঃপর জহির বিছানায় নিরুপায় হয়ে শুয়ে থাকে এবং কীসব যেন চিন্তা করতে করতে তার ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে।
তখন জহির প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। তার সরু লম্বা নাকটা অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারিতার মতো ভারী গর্জন করছে এমনটা একবার মনে হয়েছিল তার, কেননা, নিশ্বাস ভারী বোঝাচ্ছিল। এমতাবস্থায় একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায়। আপনি কি সজাগ আছেন? -এই সাদৃশ্য কণ্ঠ তার কানে এসে লাগে। জহির ধসমস করে উঠে বসে, একটু স্বাভাবিক হয়, অবশেষে দরজার কপাট খুলে দেয়। এবং আচমকা তখন সে অনুভব করে তার পায়ে আর অতটা ব্যথা নেই। যে লোকটির ডাকে সে ঘুম থেকে জাগে, এ পর্যায়ে সেও আবিষ্কার হয় এবং জহির দেখে, সে আসলে নতুন কেউ নয় বরং ঐ যুক্তিবাদী লোকটিই- যার কথামত সে এখানে রয়ে গেছে। জহির- আসুন ভিতরে আসুন, বসুন- নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে বলে। লোকটি তার পাশে চুপটি বসে থাকে কিছুসময়। এরপর সে আচমকা উৎকণ্ঠিত গলায় ইঙ্গিত করে যে, অদূরে কোথাও গানের আসর বসেছে, এখন সে যদি আগ্রহী হয় তবে তাকে নিয়ে যেতে পারে। জহির বিস্তারিত জানতে চায়,অতঃপর লোকটি ভেঙে বলে। লোকটির বর্ণনা থেকে জহির যা বুঝতে পারে তা এমন: এই অঞ্চলে এখনও লোকসংগীত টিকে আছে এবং প্রায়শ রাতে আসর জমে। মধ্যরাত অবধি সেই আসর চলে এবং সকলে তা খুব মুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করে। তখন হঠাৎই তার মনে হয় যে, একটু সচেতন হলে নিশ্চয়ই আমরা আরো কিছু লালন, হাছন, শাহ্ আব্দুল করিম খুঁজে পেতাম। এরপর জহির মৌন সম্মতি দেয় এবং যেহেতু সে শুধু লুঙ্গি পরেই শুয়েছিলো সুতরাং তাকে এবার পূর্বের পোশাকে ফিরতে হয়। অতঃপর একটা প্রাথমিক গোছগাছের পর তারা দু'জনে বেরিয়ে পড়ে।
গানের আসর শেষ হলে জহির ফিরে এসে কখন যে আবার শুয়েছিল তা আর মনে করতে পারে না সে। বস্তুত সকাল হয়ে যায় কিন্তু সে আশপাশ তাকিয়ে কাউকে খুঁজে পায় না। এমনকি যার সাথে প্রায় মধ্যরাত অবধি গানের আসর জমিয়েছিলো, তাকেও সে খুঁজে পায় না। জহির হাঁটতে বের হয় কেননা তার মন বলে নিশ্চয় হাঁটতে বেরুলে পথিমধ্যে কাউকে না কাউকে খুঁজে পাবে এবং সেখান থেকে এই নাটকীয়তার বিস্তারিত জেনে নিবে সে। গ্রামের একাংশ ঘুরে শেষ করে জহির, এবং কয়েকজন লোক তাকে এমনি ইঙ্গিত দেয় যে, আজ এনজিও থেকে তাগাদা দিতে পারে যেহেতু তারা বেশ কিছু টাকা নিয়েছিলো সেখান থেকে, এবং সাধারণত তারা খুব কড়া ভাবেই তাগাদা দিয়ে থাকে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, অবশেষে ঘরের বাসনকোসন পর্যন্ত ছিনিয়ে নিতে দ্বিধাবোধ করে না। এবার সে বুঝতে পারে যে, নিশ্চয় কিস্তির টাকা আজ বন্দোবস্ত হয় নি তাদের, কেননা কয়েকদিন ভারী বর্ষণে কর্মশূন্য তারা -এমনটা বোঝাও যাচ্ছিল রাতে, অতএব সাময়িক ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছে ঝামেলা এড়াতে। কিন্তু জহিরকে না বলে তারা চলে গেলো কেনো? তাকে তো তারা বুঝিয়ে বলতেও পারতো। সে তো দুধের শিশু নয় যে বললে বুঝবে না। ফিরে এসে নিশ্চুপ বসে থাকে সে এবং ভাবে। পালিয়ে তারা কতদিনই বা বাঁচতে পারবে? পরক্ষণে আবার তার মনে হয়, এটাকে আদৌ পালানো বলা ঠিক নয়, কেননা তারা ফিরবে এবং টাকার বন্দোবস্ত করেই ফিরবে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও তারা যে তাকে আপ্যায়ন করলো, আশ্রয় দিলো, এমনকি একটু বুঝতেও দিলো না - এতে করে সে এই রংমহলে নিজেকে একজন অপদার্থই মনে করলো। কেননা গানের আসরে যাবার পথে লোকটির সাথে নানান কথোপকথন হয়েছিলো রাতে, লোকটি তাদের অসহায়ত্বের ছাপ রেখে যাচ্ছিল প্রতিটি কথায়, অথচ জহির তা আমলেই নেয় নি। একে ঠিক অপদার্থই বলা চলে। ভীষণ স্বার্থপরতা। অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুম আসে জহিরের। এই অসময়ে কিছুসময় ঘুমায়ও সে, কিন্তু সেই ঘুম ভাঙে আকস্মিক অপরিচিত একটি কণ্ঠস্বরে। অতঃপর সে ঘুমঘুম আবছা চোখে তার দিকে তাকায় এবং দেখে ভদ্র পোশাকে একজন লোক তার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। আপাতদৃষ্টিতে ভদ্র মনে হলেও সে কিন্তু অতটা ভদ্র নয়, তা বোঝায় যাচ্ছে। জহির তার সম্পর্কে বিনীত জানতে চায়, তখন ভদ্রলোকটি খুলে বলে। কিন্তু সে মহা ঝামেলার ভিতরে পড়ে অতি শীঘ্র। কেননা, ভদ্রলোকটি তার থেকে কিছু শুনতে না চেয়েই বরং পাওনা টাকার দাবি করে বসে। জহির আচমকা হকচকিত হয়। সে কিছু বলতে চায় অথচ লোকটি বড় বাচাল প্রকৃতির হওয়ায় জহির তা পেরে ওঠে না। এক পর্যায়ে দু'জনার ভিতর কথা কাটাকাটি হতে থাকে। উচ্চস্বরে কথোপকথনের একপর্যায় জহির বলে ফেলে সে কেবলই একজন আগন্তুক বই কিছু নয়, এমনকি গতকাল রাতের ঘটনাটাও কখনও স্পষ্ট, কখনওবা অস্পষ্ট করে বলে ফেলে সে, কিন্তু লোকটি তার কথা বিশ্বাসই করতে পারে না। দুজনার মধ্যকার এই বাকবিতণ্ডা থেকে একসময় হাতাহাতি শুরু হয়। দেখতে লোকটি ভদ্রবেশী হলেও গায়ে শক্তি ছিলো বেশ কাজেই জহির তার সাথে আর পেরে ওঠে না। প্রচণ্ড একটা আঘাত আচমকা জহিরের মাথায় এসে লাগে এবং সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর সে আবছা দেখতে শুরু করে। এই রংমহল যার রং আজ সকাল অবধিও ছিলো উজ্জ্বল তা এখন ফিকে মনে হয় তার। তারপর জহির ক্রমশ জ্ঞান হারাবার পথেই এগিয়ে যায়।
সজিব হোসেইন, আকুর টাকুর পাড়া টাঙাইল
Replyআন্তরিক ধন্যবাদ।
Replyএটার কি কোন পর্ব আছে নাকি লেখক ভাই?
Replyজি না, ভাইয়া। রংমহল এতটুকুই। ছোটোগল্প।
Reply