গুপ্তধন................................রাকিব সামছ শুভ্র (সেরা গল্প)

হু কাঙ্ক্ষিত আম্মার ট্রাংকটা আজ খোলা হবে। আমরা চার ভাইবোন আম্মার ঘরে জড়ো হয়েছি। সবাই ভীষণ উত্তেজিত এবং অস্থির বোধ করছি। একান্ন বছরের পুরনো ট্রাংক তবে তালাটা এতো পুরনো না। তালার বয়স বড়জোড় বছর চারেক হবে। ছোটদা লুকিয়ে তালা ভাঙতে গিয়ে আগের তালাটা নষ্ট করে ফেলেছে। কিন্তু ট্রাংক খোলার আগেই ধরা পড়ে গিয়েছিলো। তখন নতুন তালা লাগানো হয়।

আমরা চার ভাইবোন। আমি সবার ছোট। বড়দা তারপর আপা এরপর ছোটদা। বড়দা বেশ গোবেচারা টাইপের। মাস্টার্স করে আমাদের শহরেই একটা কলেজে পড়াচ্ছেন। সবাই প্রফেসর আজিম নামেই ডাকে তাকে। বড়দা দুই মেয়ের বাবা, রুনু ভাবি স্কুলে পড়ান। আলো আপা ভয়ঙ্কর সুন্দরী একেবারে আম্মার ডুপ্লিকেট। মাঝে মাঝে ভাবি আপা কী ডাবল পার্ট করছেন নাকি? দুলাভাই ব্যবসায়ী,পয়সাওয়ালা বাড়ি গাড়ির অভাব নাই। আপারা এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে থাকেন কুমিল্লায়। ছোটদাও ব্যবসা করে কিন্তু কেন যেন খুব একটা ভালো করতে পারে না। দু-দিন লাভ করলে পাঁচ দিন লস করে। ঝুমু ভাবি ডাক্তার তাই ছোটদার উঠানামায় ভারসাম্য ধরে রাখেন। ছোটদাদের এক মেয়ে।

আর আমি? আমার নাম আঁখি। স্বামী হাসিব আর্মিতে মেজর। হাসিবের পোস্টিংয়ের জন্য আমার নির্দিষ্ট কোন শহরে থাকা হয়না। কখনো খাগড়াছড়ি আবার কখনো সিলেট এখন অবশ্য কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আছি। হয়তো বছর খানেক এখানে থাকবো তারপর আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে নতুন জায়গায়। আমাদের একটাই ছেলে নাম রুদ্র।

আমাদের দাদাবাড়ী মাদারীপুর হলেও আব্বা তার চাকুরী জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন চাঁদপুরে। ডিসি অফিসে হেডক্লার্ক ছিলেন। আম্মা চাঁদপুরেরই মেয়ে তবে বড় হয়েছেন চট্রগ্রামে। ১৯৬৯ সালে আম্মা আব্বার বিয়ে হয়। আব্বা মারা গিয়েছেন প্রায় এগারো বছর। আম্মা আমাদের ছেড়ে গেছেন মাত্র একচল্লিশ দিন আগে। আম্মার চল্লিশা আয়োজন করতেই আমরা সবাই চাঁদপুরে এসেছি।

আব্বা আম্মার বিয়েটাও হয়েছিলো অদ্ভুত ভাবে। নানাজান কোন এক কাজে ডিসি অফিস (তখন অবশ্য সাব ডিভিশনাল অফিস ছিলো) এসেছিলেন। আব্বার ব্যবহার আর চেহারা দেখে সরাসরি নিজের মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেন। নানাজান অবশ্য বলেছিলেন তার মেয়ে শিক্ষিত, ভদ্র, সংসারী তবে গায়ের রঙ বেশ চাঁপা। আব্বা আম্মাকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে যান। বিয়ের রাতে বাসর ঘরে আম্মাকে প্রথম দেখে আব্বা নাকি ভুত দেখেছেন। ভয়ংকর রূপবতী একজন মানুষ তার বিছানায় বসা! তার চিৎকারে বাসার সবাই বন্ধ দরজার সামনে হাজির। আব্বা দরজা খুলে দাদীকে নাকি বলেছিলেন, ওই বাড়ির লোকেরা ভুল করে অন্য মেয়ে দিয়ে গেছে! এক যাচ্ছেতাই অবস্থা। গভীর রাতে নানাজানকে খবর দেয়া হয়। লোকজন সমেত উনি আমাদের বাড়িতে আসেন। সব বুঝিয়ে বলার পর আব্বা ঠান্ডা হন। নানাজান আব্বাকে পরীক্ষা করার জন্য মেয়ে কালো বলেছিলেন। আসলে আম্মার গায়ের রঙ ছিলো দুধে আলতা। 

আব্বার বেতন খুব বেশী ছিলোনা কিন্তু সবসময়ই চাইতেন আম্মা সেজেগুজে পরিপাটি থাকুক। আম্মাও নিজের মতো করে সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছিলেন। আব্বার কেনা শহরের এক কোনে বাস স্ট্যান্ডের পাশে পাঁচ শতাংশের জমিটায় তিনরুমের বাসা আব্বা আম্মার সারাজীবনের সঞ্চয়ে গড়ে উঠা ভালোবাসার প্রাসাদ। 

বিয়ের কদিন পরেই আব্বা আম্মাকে একটা কালো রঙের ট্রাংক কিনে দিলেন। আম্মা সযতনে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো ওই ট্রাংকে রেখে দিতেন। আম্মা কখনো আমাদের সামনে ট্রাংক খুলতেন না। ঘরের দরজা বন্ধ করে ট্রাংক খুলতেন আবার তালা লাগিয়ে চাবি সড়িয়ে রাখতেন। ছোটবেলায় বহুবার জিজ্ঞেস করেছি, আম্মা ট্রাংকে কি আছে একবার দেখাবে? কখনোই দেখাতে রাজি হয়নি৷ খুব চাপাচাপি করলে বলতো, গুপ্তধন, মহামূল্যবান  জিনিস এর মধ্যে রাখা আছে। আমার সারা জীবনের সবচেয়ে দামী সঞ্চয় এর মধ্যে রক্ষিত আছে। 

আমাদের চার ভাইবোনের কেমন যেন একটা আকর্ষন অথবা লোভও বলা যায় ছিলো ট্রাংকটার উপরে। আব্বাও আম্মাকে বলতেন, তোমার এই যক্ষের ধন তুমি না থাকলে সামলাবে কে? 

আম্মা কোন উত্তর দিতোনা। অদ্ভুত একটা হাসি দিতো আর আমাদের গা জ্বলতো। আম্মা গহনা তেমন পরতোনা তাই আমাদের সবার ধারণা, ট্রাংকে নিশ্চয়ই আম্মা সব গহনা রেখে দিয়েছে। আরো না জানি কতো কিছু আছে?

আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর আম্মার ট্রাংকের প্রতি দরদ আর যত্ন আরো বেড়ে গিয়েছিলো। দরজা আটকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাংক নিয়ে বসে থাকতো। আমরা এমনকি নাতিনাতনিরাও ওই সময় ঘরে ঢুকতে পারতাম না। এতে আমাদের ধারণা আরো বদ্ধমূল হলো, ট্রাংকে অমূল্য ধনরত্ন আছে। শুনেছিলাম নানাজান আম্মাকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর অনেক দামী উপহার দিয়েছিলেন। সেসবও মনে হয় ওই ট্রাংকেই রাখা। 

চার বছর আগে ছোটদার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছিলো। একদিন আম্মা পাশের বাসায় গিয়েছে এমন সময় ছোটদা আম্মার ঘরে খাটের নীচ থেকে ট্রাংক বের করে তালা ভাঙার চেষ্টা করছিলো। ঠিক ওই সময় ভাবি চলে আসায় আর ভাঙতে পারেনি। আম্মা বাসায় এসে খুব কেঁদেছিলো। ছোটদাও খুব লজ্জা পেয়েছিলো। আম্মার পা ধরে কান্নাকাটি করায় ক্ষমা পেয়েছিলো সাথে আম্মার কোলে আশ্রয়। ছোটদা ছোটকাল থেকেই একটু ডানপিটে ধরনের। একমাত্র আম্মা ছিলো ওর শেষ আশ্রয়স্থল। যত ঘটনাই ঘটাক আম্মার কোলে ঠিকই জায়গা করে নিতো। মানুষ হিসেবে কিন্তু ছোটদা অসম্ভব দিলখোলা। খরচের হাতও বেশ বড়। ধুমধাম খরচ করতে ওর চেয়ে পারঙ্গম কেউ নেই।

আব্বা মারা যাবার কিছুদিন আগেই তার রেখে যাওয়া বাড়ি এবং জমি চার ভাইবোনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন। এতে অবশ্য কারো কোন আপত্তি ছিলো না। কিন্তু সবারই চোখ রয়ে গেছে আম্মার ট্রাংকের জিনিসের দিকেই। আম্মা মারা যাবার আগের রাতে বড়দাকে ডেকে বললো, বাবা আমি চলে গেলে তোমরা ট্রাংকটা খুলে তোমাদের যার যা পছন্দ নিয়ে নিও। ট্রাংকটা ফেলে দিওনা, ঘরের এক কোনে কোথাও ফেলে রেখো। আমার খুব প্রিয় এবং ভালোলাগার সম্পদ। 

আম্মা হুট করেই চলে গেলেন। আমরা কেমন হঠাৎ করেই এক বিশাল শূন্যতায় আবদ্ধ হলাম। আমাদের সব কিছু আছে আবার কিছুই নেই। অদ্ভুত একটা বিষয় হলো, যেই ট্রাংকের ভেতরের জিনিসের জন্য আমরা বুভুক্ষু ছিলাম, আম্মা চলে যাওয়ার পর সেই ট্রাংক খোলবার কথা কারো মনেও আসলো না। আমরা চার ভাইবোন কান্না পেলেই ট্রাংকটা ছুঁয়ে আম্মার ছোঁয়া নিতে চাই। 

যে যার মতো নিজেদের শহরে চলে গিয়েছিলাম। আম্মার চল্লিশা আয়োজন করতে বাড়ির সবাই আবার চাঁদপুরে এসেছি। খাওয়াদাওয়ার পরে সবাই আম্মার ঘরে বসে কথা বলছি। এমন সময় হাসিব কথাটা পারলো। আম্মাতো অনুমতি দিয়েছেন তার ট্রাংক খুলতে, আমরা খুলে দেখতে পারি না? কেউই আগ্রহ প্রকাশ করলো না। অথচ এর ভিতরে কী আছে তা নিয়ে গত চল্লিশ বছরের অপেক্ষা আজ কেমন হালকা হয়ে গেছে। তারপরও সবাই একমত হলাম, খুলে অন্তত দেখি!

পরদিন নাস্তারপর সবাই আম্মার ঘরে জড়ো হয়েছি। বড়দা খাটের নীচ থেকে ট্রাংক বের করলো। চাবি হাতে নিয়ে তালায় ঢোকানোর সময় হাত কাঁপছে। আমরা ভিতরে অস্থিরতা বাহিরে প্রকাশ করছিনা। ট্রাংকের ঢাকনা খুলতেই দেখতে পেলাম ছোট ছোট কাগজের অনেকগুলো প্যাকেট। বড়দা প্রথম প্যাকেট নিয়ে তা খুলতেই যা বের হলো তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।

একটা বহু পুরনো আলতার শিশি। আলতা নেই শুধু লালচে দাগ রয়ে গেছে শিশিতে। সাথে ছোট্ট একটা কাগজে লেখা ওর দেয়া প্রথম উপহার। একান্ন বছর আগের একটা তারিখ।
আরেকটা প্যাকেট খুলতেই বের হলো একটা টিপের পাতা যাতে একটাই টিপ অবশিষ্ট রয়েছে। বিয়ের তারিখ লেখা সাথের কাগজে।
পরের প্যাকেটে পাওয়া গেলো একটা মেরুন রঙের পার্কার কলম। কাগজে লেখা বাবার দেয়া সবচেয়ে দামী উপহার। ম্যাট্রিকুলেশনে ভালো ফলাফলের পরে পাওয়া।
বের হলো বড়দার প্রথম জুতো জোড়া, আপার প্রথম জামা, ছোটদার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মার্বেল (বাবার হাতে কতো মার খেয়েছে এই মার্বেল খেলার জন্য), আমার কাঁচের ফিডার, বাবার বিয়ের রুমাল, দাদার টুপি, নানিজানের পানের বাটা, আমাদের চার ভাইবোনের প্রথম পরে যাওয়া দাঁত। আরো অনেক কিছুই বের হলো ট্রাংক থেকে।

আরেকটা জিনিস পাওয়া গেলো, যা আমাদের সবচাইতে বেশী অবাক করেছে, একটা মলাট বদ্ধ খাতা। সেটা ছিলো আম্মার লেখা একটা কবিতার খাতা! আমাদের অতি চেনা আম্মার নতুন আরেকটা দিক আমাদের সামনে উন্মোচিত হলো।

আম্মার এতো প্রিয়রা এই ছোট্ট ট্রাংকে এতোদিন চাপাচাপি করেছিলো! ঐ মূহুর্তে আম্মার রেখে যাওয়া গুপ্তধনেরা আমাদের চার ভাইবোনকে অদ্ভুত ভালোবাসায় জড়িয়ে নিলো। হঠাৎ করেই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পদের মালিক হয়ে গেলাম আমরা।


শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Monirul
October 2, 2020 at 9:52 PM

ভাই আপনার লেখা পড়ে দার্শনিক হয়ে গেলাম। এত্তো ভাল লাগল যে .............

Reply
avatar
Nazmul Hasan
October 6, 2020 at 3:48 PM

অসাধারন এক গল্প

Reply
avatar
October 14, 2020 at 6:16 PM

অসাধারণ গল্প। প্রাপ্তি সুখ।

Reply
avatar
October 30, 2020 at 8:26 AM

কৃতজ্ঞতা জানবেন। পাশে আছেন, এটা বিশাল পাওয়া। অশেষ ধন্যবাদ

Reply
avatar
October 30, 2020 at 8:26 AM

অফুরান শুভকামনা রইলো

Reply
avatar
October 30, 2020 at 8:27 AM

ভালোলাগা জানবেন। অফুরান ধন্যবাদ

Reply
avatar