(টোটো উত্তরপূর্ব ভারতের একটি আদিবাসি জনজাতি। বসবাস ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরে অবস্থিত জলপাইগুড়ি জেলায়। ভুটানের পাদদেশে তোরসা ও হাউরি নদী ঘেরা একটি ছোট গ্রামে টোটোদের বাস। প্রায় ৩ হাজার মানুষ বাস করেন এই গ্রামে।)
অফিসে বসেই হঠাৎ প্ল্যান। টোটো পাড়ায় যাবো।এর আগেও একবার চেষ্টা করেছিলাম জুন মাসে নিজের গাড়ি নিয়ে বৃষ্টির দিনে নদীর রূপ দেখে সাহসে কুলোয়নি। অবশেষে প্রদীপদার একান্ত ইচ্ছায় বেড়িয়ে পড়লাম তিন জনে। মানে আমি, প্রদীপ দা আর স্বপন।যদিও স্বপনের ইচ্ছে ছিল লেপচাখা যাওয়ার। যাইহোক ২০/০১/১৮ সকাল ৯.৩০-এ রওনা হলাম।কোচবিহার থেকে বাসে ফালাকাটা, ৪০ মিনিট লাগলো। ওখানে পেট পুজো করে রওনা হলাম মাদারিহাটের দিকে ওখান থেকে আবার গাড়ি ধরে তারপর টোটো পাড়া। তবে গাড়ি কোচবিহার থেকেও বুক করে নিতে পারতাম। কিন্তু সবারই ইচ্ছে বাস করে যাব।মাদারিহাট পৌঁছে গেলাম 12টায়। পৌঁছেই দেখি টোটো পাড়া যাওয়ার বাস দাঁড়িয়েই আছে। গিয়ে উঠে পড়লাম। বাপরে কি ভিড়! জানতে পারলাম এটাই নাকি টোটো পাড়া যাওয়ার শেষ বাস, ছাড়বে ১টায় টোটো পাড়ায় পৌঁছাতে ২.৩০ বাজবে। আবার ওখান থেকে রওনা হবে বিকেল ৩.৩০এ। মানে টোটো পাড়ায় ঘোরার জন্য হাতে মাত্র ১ ঘণ্টা! যাঃ তারা! এভাবে হয় নাকি! কোচবিহার থেকে গাড়ি করে নিলেই ভাল হত।বাসে বসে তিন জনেই ভাবছি কি করা যায়! হঠাৎ পাসে বসা একজন এস এস বি জওয়ান আমাদের হতভম্ব ভাবদেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কি টোটো পাড়ায় ঘুরতে যাবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ।উনি বললেন আপনারা বাস এ না গিয়ে এখান থেকে একটা গাড়ি বুক করে নিন। এতে ভাল করে টোটো পাড়া ঘুরতে পারবেন। না হলে, ঘুরেও মনে শান্তি পাবেন না। আমারা বাস থেকে নেমে গাড়ি খোঁজা শুরু করলাম।
অবশেষে সুরজকে পেয়ে গেলাম। ওর বোলেরো গাড়ি করে রওনা হলাম টোটো পাড়ার (বল্লালগুড়ি) উদ্দেশ্যে তখন প্রায় ১টাই বাজে। মাদারিহাট থেকে প্রায় ২০-২৫ কিমি আরো যেতে হবে, পেরোতে হবে তিন খানা নদী। যদিও নদী বলা ভুল হবে, বরষার সময় মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি হলে নদী হয়ে জেগে ওঠে। না হলে পিপাসিত চাতক। তার উপর দিয়ে চলছে নদী বুক থেকে পাথর বালি বা পাহার থেকে ডলমাইট বওয়া ট্রাক। তাদের পায়ের চাপে নদীর বুকে সর্পিল পথ সৃষ্টি হয়েছে। সেই সর্প অনুসরণ করেই সুরজ এগিয়ে চলল। প্রথম নদী পেরিয়ে আবার ভাল পিচ ঢালা রাস্তা চারিদিকে ঘন জঙ্গল (জলদাপারা)। বল্লাল্গুড়ি এস এস বি ক্যাম্প ছাড়িয়ে আরো দুই নদী পেরিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে টোটো পাড়া। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ২টা বেজে গেল।বল্লাল্গুরি পেরিয়ে টোটো পাড়া যখন ঢুকছি, দেখতে পেলাম এক বাড়িতে সুপারি গাছ থেকে সুপারি পেড়ে বাঁশের ছোট ঝুড়ি করে এনে বস্তায় প্যাকেট করা হচ্ছে। প্রদীপদা বলল, চল একটু গিয়ে দেখি ওদের সাথে পরিচিতি করি। সুরজ দাঁড়িয়ে পড়ল, আমরা গাড়ি থেকে নেমে ওদিকে এগিয়ে গেলাম। মহিলারা সুপারি বস্তায় ভরার কাজ করছেন। ওখানকার ব্যাবসায়ি রতন টোটো বললেন, সুপারিই এখানকার প্রধান ব্যাবসা। আর আছে আদা ও এলাচ। তবে এলাচ এখন কম হয়, ধান পাট তো দূরঅস্ত। এরকম পাথুরে জমিতে ওগুলো হয় নাকি বলুন তো? বর্ষার আগেই শহর থেকে চাল, গম, মশলাপাতি সব কিনে মজুত করে রাখা হয়; নইলে নদী বিপদ, যোগাযোগ বন্ধ। শীতের আগে পিঁপড়েরা যেরকম খাবার সঞ্চয় করে অনেকটা সেরকমই। তাকিয়ে দেখলাম চারিদিকে শুধু সুপারি গাছেই ভরতি। এই সুপারি পারি দিচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন কম্পানিতে। সুরজ জানাল, এখানের সুপারির নাম আছে তাই মার্কেট ভ্যালুও বেশী।
আবার গাড়িতে উঠে পরলাম আরো এগিয়ে যেতে হবে। এবারে চলে এলাম টোটো পাড়া বাজারে। ছোট খাটো বাজার, মুদি দোকান, ষ্টেশনারী দোকান, সব্জি-মাংসের দোকান আরো অনেক কিছু। গাড়ি থেকে নামলাম টোটো পাড়া বাজারে। সুরজকে বললাম, আমাদের ঘুরিয়ে দেখাও চারপাশটা। ও রাজি হয়ে গেল। ড্রাইভার কাম গাইড – দুদিকেই আমাদের লাভ হল। বাজার ছেড়ে একটু ভেতর দিকে চললাম। পাহাড়ের উচু নিচু চড়াই উতরাই। হঠাৎ একটা গাছ দেখিয়ে সুরজ বলল, ওই দেখুন এলাচ গাছ! আগে কখনও দেখিনি এলাচ গাছ, তাই উৎসুক হয়ে দেখতে গেলাম। দেখতে অনেকটা পুরুন্ডি গাছ বা আদা গাছ বেশী বড় হলে যেমন হবে সেরকমই। নিচ থেকে গোলাপি-সাদা রঙের ফুলের মত কুশি বেড়িয়েছে। সুরজ বলল, ওটাই বড় হয়ে ওর থেকে মুকুল বেরিয়ে তার মধ্যে এলাচ হবে। এখান থেকে ভুটান-জয়গাওঁ খুব কাছেই, ওই দেখুন না দেখাই যাচ্ছে। পাহাড়ের উপর থেকে দূরে দেখলাম জয়গাওঁ শহর, যদিও কুয়াশায় ঝাপসা। আকাশ পরিস্কার থাকলে এখান থেকে গাড়ি চলাচলও দেখা যায়।
টোটোদের বাড়ি আর আগের মত নেই বললেই চলে, কাঠ-বাঁশ বা ছাউনি দেওয়া। সরকারের দেওয়া পাকা একচালার বাড়ি এখন সবার কাছেই। রাস্তা ঘাটও কনক্রিটের বাঁধানো। টোটো ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখে বাইরে চাকরীও করছে, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে। ঘোরার পথে কিছু ছোট ছোট স্কুল ফেরত শিশুদের সাথে সেলফি তুললাম আমরা। গ্রামে হাসপাতালও আছে একটি। মুমূর্ষু রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু যাতে ভালমতন দেওয়া যায়।
প্রদীপদা কে বললাম, কি ব্যাপার তুমি তো ইন্টারভিউ নিলে না কোন? কোথাও ঘুরতে গেলে প্রদীপদার এটা স্বভাব ওখানকার মানুষের সাথে কথাবার্তা বলে মেলামেশা করা। কিছু কিছু আদিবাসী ভাষা প্রদীপদা অবশ্য জানে, তবে টোটোদের ভাষা সম্পর্কে উৎসুক্য একটু আলাদা। চলার পথেই দেখা হল ভিসেন টোটোর সাথে। তার ২ বছরের মেয়ে কোলে করে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। প্রদীপদা নিজের পরিচয় দিয়ে কথাবার্তা শুরু করল। ভিসেনবাবু জানালেন, আগের দুরাবস্থার থেকে টোটোরা এখন অনেকটা উঠে এসেছে। যোগাযোগ ব্যাবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় শহরের সাথে শিক্ষা-সংস্কৃতির আদান প্রদান বেড়েছে। টোটোদের ভাষা লিপিবদ্ধ করে ডেভিড টোটো স্বীকৃতির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। প্রদীপদা উৎসুক হয়ে বলল, আচ্ছা “আমি ভাত খাব” এটাকে টোটো ভাষায় কিভাবে বলবে? ভিসেনবাবু বললেন, “কা আমা চামম্মি”। এটা বলতেই আমাদের ৩-৪বার শুধরাতে হল। রিতিমত টাং-টুইস্টার। ভিসেনবাবু জানালেন টোটো পাড়ায় শুধু টোটোরাই থাকেন না বিহারী, বাঙালি, নেপালি ও কিছু আদিবাসীরাও থাকেন। ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য’ এখানেও। সুরজও আমাদের সাথে সাথে নেপালি ভাষায় ভিসেনবাবুর সাথে দুএকটা কথা বলল। ভিসেনবাবু বললেন, নেপালি, হিন্দি, আদিবাসী, বাংলা ও কিছু কিছু ইংরাজি ভাষাও তিনি জানেন। বিদেশি পর্যটকদের সুবিধার জন্য ইংরাজিটা বিশেষ করে জেনে রাখা। তবে চাইনিজ ভাষাটা তিনি জানেন না। তার এই কথায় আমরা হেসে উঠলাম। পর্যটকদের থাকার জন্য হোম-স্টে-র ব্যাবস্থা আছে টোটো পাড়ায়।
ভিসেনবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ফিরে এলাম টোটো পাড়া বাজারে। এসে দেখি সেই বাসটা! বাস থেকে সব্জি, চাল, বাড়ি বানানোর সিমেন্ট সব নামানো হচ্ছে। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখি প্রদীপদা নেই। কোথায় গেল লোকটা? এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে দেখি এক দোকানে দাঁড়িয়ে ‘তিনি’ কোমরের বেল্ট কিনছেন। কাছে যেতেই বলল, টোটো পাড়ায় এলাম একটা কিছু স্মৃতি তো নিয়ে যাই!
এরপর বাড়ি ফেরার পালা। দুপুর তো অনেক আগেই গড়িয়েছে। ফেরার পথে মাদারিহাটেই মধ্যাহ্ন ভোজ হবে। সুরজ বলল, তাহলে ফেরার পথে টোটো পাড়া পিকনিক স্পটটাও ঘুরে যাই! আমরাও সায় দিলাম। পিকনিক স্পট যদিও সেদিন খোলা ছিল না, তবুও আমরা ওখানে বসে মাদারিহাট থেকে আনা মোমো-পিকনিকটা সারলাম। ওখানে গুটি কতক ফোটোসেশন করে গাড়িতে উঠে সোজা মাদারিহাট। তারপর সুরজকে তার সহযোগিতার মূল্য মিটিয়ে দিয়ে লাঞ্চ-এর উদ্দ্যেশ্যে ‘বউদির হোটেল’, মাদারিহাট চৌপথির পাশেই। ছোটো খাটো তবে পয়পরিস্কার। খাবার খেয়ে দাঁত খুঁচিয়ে এবার বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে গাড়ি ধরার পালা।
দাদা টোটোপাড়ায় আমিও গিসি। হলুদিমের কালি মন্দির দেকেছেন দারুন না?
Reply