সাজেক পানে..............................রাকিব সামছ শুভ্র

বিয়ের পঁচিশ দিনের মাথায় প্রথম শহর ছেড়ে বের হলাম শুধুই আমরা দুজন। যদিও সমুদ্র আমায় সবসময়ই অনেক বেশী আকর্ষণ করে কিন্তু এবার দুজনই কেন যেন সমুদ্রের গর্জনের চেয়ে পাহাড়ের নিস্তব্ধতা উপলব্ধি করতে চাইলাম। প্রকৃতির মাঝে নিজেদের অনুভব করার আকাঙ্ক্ষা ঢাকা থেকে ২৭৩ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি শহর খাগড়াছড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের দুজনকে। ফেনী পর্যন্ত রাস্তাটা হাতের তালুর মতোই পরিচিত, ফেনী থেকে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে যখন নতুন রাস্তায় প্রবেশ করলাম তেমন নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার কাছে ঢাকা থেকে বের হলে গড়পড়তা সব রাস্তার ধার কাছাকাছিই লাগে। 
আমার দৃষ্টি টেনে নিতে বেশীক্ষন সময় নিলেননা ড্রাইভার সাহেব। হঠাৎ করেই সমতল রাস্তা ধীরে ধীরে উঁচু নিচু আঁকা বাঁকায় পরিবর্তিত হয়ে এলো। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন! বাসের একেবারে সামনের দুটো সিট পেয়েছি। ড্রাইভিং সিটের ঠিক পেছনের দুটো সিট। গাড়ি যখন চলছে মনে হচ্ছে আমি নিজেই চালাচ্ছি। একেকটা শার্প টার্ন আসছে আর ড্রাইভার সাহেবের সাথে আমিও মনে মনে ডানে বাঁয়ে বাঁকিয়ে ব্রেকে পা চেপে মোড় নিচ্ছি। যখন উপরের দিকে যাচ্ছি তেমন কিছু মনে না হলেও যখন নীচের দিকে নামছে তখন পেটের ভেতর কেমন ফুঁস করে খালি খালি লাগে। 
আঁকা বাঁকা রাস্তার দুধারের চেনা, অচেনা হাজারো গাছ পরিবেশটাকে বিমুঢ়তা দান করেছে। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে গহীন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছি।
বাসের হেড লাইটের আলোয় পাহাড়ি রাস্তা রাতের আঁধারে মিশে অন্যরকম ভালোলাগা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পথ হঠাৎ করেই সামনে আসছে আবার কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুদূর পরপর জনবসতির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। এর মাঝে বিজিবির চেকপোস্ট পেরুলাম। খুব অবাক হলাম হেঁয়াখোতে এসে চা বাগান দেখে। মনে হচ্ছিলো দার্জিলিং এর সেই বিখ্যাত রাস্তার কথা। রামগড়, মাটিরাঙা পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। মাঝে মাঝে দুএকটা কুকুর আবার শিয়াল রাস্তায় চলে আসায় ড্রাইভার হর্ন বাজাচ্ছিলেন, এছাড়া চারদিক একেবারেই সুনসান। 
আমি দুএকবার চেষ্টা করলাম আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তার ছবি তুলতে কিন্তু গাড়ির দুলুনিতে ভালো তুলতে পারিনি। মাঝে কখন চোখ লেগে এসেছে টের পাইনি। উঠে দেখি খাগড়াছড়ি আর মাত্র সতেরো কিলোমিটার দূরেই। পাশে বসা ওকে জাগালাম। দুজনে ভোরের আলোয় পাহাড় দেখছিলাম, হাতের মাঝে হাত আঙুলেরা জড়াজড়ি করে। বিয়ের পরে প্রথম ট্যুর অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছেই। ভালোলাগায় ছেয়ে আছে দেহ মন।

ভোর পাঁচটায় খাগড়াছড়ি পৌঁছে অপেক্ষা হোটেল খুলবার। সকালে নাস্তা সেরে নিয়ে চান্দের গাড়িতে চেপে বসলাম সাজেকের উদ্দেশ্যে। খাগড়াছড়ি থেকে প্রায় ৬৩ কিলোমিটার দূরে সাজেক। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক ইউনিয়ন। তবে খাগড়াছড়ি হয়ে যেতেই সুবিধা। চাঁন্দের গাড়িগুলোর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হলেও তর্জন গর্জন করে ছুটে চলছে ভালোই। শহর ছেড়ে বের হতেই শুরু হলো আবারো পাহাড়ি পথ। যত সময় পেরুচ্ছে পাহাড়ের উচ্চতাও বেড়েই চলেছে। উঁচুনিচু পথের সাথে সাপের মতো এঁকেবেকে গাড়ির পথ চলা দুপাশের বিস্তীর্ন সবুজের মাঝে নিজেদের মাঝের দূরত্ব ঘুচে গেছে কখন জানিনা। আমাদের সাথে আরো পাঁচজন কাপল ছিলো। ছয় জুটি জমিয়ে আড্ডা এবং সেল্ফি তোলার মধ্য দিয়েই সাজেক পানে ছুটছি। 
পথে একবার থামতে হলো। গাড়ির নাম্বার, ড্রাইভারের নাম এবং ফোন নাম্বার খাতায় এন্ট্রি করতে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজ দায়িত্বে টুরিস্টদের পাহারা দিয়ে দীঘিনালার পর থেকে সাজেক পর্যন্ত পৌছে দেয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। প্রায় শখানেক গাড়ি পিঁপড়ার সারি ধরে একটার পিছনে আরেকটা এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে জ্যাম লেগে গেছে। একটা গাড়ি ফেঁসে গেছে ঢাল বেয়ে উঠবার সময় ফলে পেছনের সব গাড়িকে অপেক্ষা করতেই হলো ঘন্টা খানেক। অবশ্য আমরা এসময়টুকুন কাজে লাগিয়েছি ছবি তুলে, পাহাড়ি কলা, আমড়া, জাম্বুরা,খেয়ে। বেশ গরম আর হিউমিডিটি বেশী হওয়ায় দরদর করে ঘামছিলাম। পানিই তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানীয়।
সাজেকের রিসোর্ট দেখা যাচ্ছে পাহাড়চূড়ায়। আমাদের সবার উত্তেজনাও বাড়ছে তালে তালে। দুপুর নাগাদ সাজেকে প্রবেশ করলাম।মনে হচ্ছিলো দার্জিলিং এ চলে এসেছি। শহরের ধরন এবং গড়ন অনেকটাই দার্জিলিং এর মতো। শহরটাই পাহাড়ের উপর। রাস্তা নেমে যাচ্ছে পাশে বিভিন্ন কটেজ এবং ছোটখাট দোকান। 
সাজেকের চারদিকের দৃশ্যটা এতোটাই সুন্দর, দেখলে মনে হয় ভিউকার্ড দেখছি। কথা অনুযায়ী আমরা দার্জিলিং রিসোর্ট এর সামনে নেমে গেলাম। গরম আর ঘামে অস্থির আমরা যখন ঠান্ডা পানির শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালাম মনে হচ্ছিলো সব ক্লান্তি এক নিমিষেই উধাও।

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট