কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর................................তুহিন রহমান

ব্যাঙ্গালোর রেল স্টেশন
১৯৮৯ সাল। অকটোবরের শেষ দিক। ইন্ডিয়ান ভিসা তখনও বেশ কঠোর। দিতেই চায়না। প্রতিদিন পাঁচ ডলার করে এনডোর্স করাতে হতো। এভাবে যতো দিন থাকা যায়। আমার হাতে অনেক টাকা। পুরো ইন্ডিয়া ঘোরার জন্য তিন মাসের ভিসা দরকার। ইন্ডিয়ান এ্যাম্বাসি তখন ধানমন্ডিতে, যেখানে এখন পপুলার, ঠিক তার বীপরিতে। গিজগিজ করছে মানুষ। বেশীরভাগকেই ভিসা দিচ্ছেনা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। যদি ভিসা না পাই তাহলে তো পরিকল্পনাটাই মাঠে মারা যাবে। লাইনে, আমার ঠিক পেছনে, একটা ফ্রেঞ্চ মহিলা দাঁড়িয়ে আছে হাতে তাদের দেশের পাসপোর্ট। বয়স পঁচিশ বা ছাব্বিশ হবে। বেশ ভালো ইংরেজী বলতে পারে। তবে এ্যাকসেন্টটা ডিফরেন্ট। লাল একটা শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরা মেয়েটার চুলগুলো একেবারে অবার্ন, মানে যাকে বলে লালচুলো। আগেই তার সাথে পরিচয় হয়েছে। তার নাম ওয়েলা (Wella), প্যারিসের বাইরে লিয়নে থাকে। ইংরেজীতেই বললাম, যদি ওরা আমার ইন্টারভিউ নেয় তবে আমি বলবো আমি তোমার সাথে একজন গাইড হিসাবে যাচ্ছি। ওয়েলা তার নীল চোখ ঘুরিয়ে হেসে বললো, তাহলে কিন্তু আমার গাইড হতেই হবে তোমাকে। আমি বললাম, হতে আপত্তি কোথায়? ও বললো, ইটস ওকে। তখন আবার ইন্টারভিউয়ের প্রচলন ছিল। প্রত্যেককে কবাটবিহীন একটা জানালার সামনে দাঁড় করিয়ে কিছু কথা বাংলাতেই জিজ্ঞেস করতো তারপর সিল মেরে দিত। নাহয় রিজেক্ট করে দিত। আমার পনেরো দিনের ডলার নেয়া আছে। ইচ্ছে কোলকাতা যাবার পর ভিসা বাড়িয়ে নেবো। জানালাতে আমার ডাক পড়লো। ওয়েলা নিচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওপরের সিঁড়িতে। ওকে দেখিয়ে অফিসারকে বললাম, আমি ওর গাইড হিসাবে যাচ্ছি। ও যেখানে যাবে আমাকেও যেতে হবে। অফিসার বললো, লিখিত দিতে হবে। অফিসারের কথা শেষ হবার আগে ওয়েলা বললো, নো প্রবলেম, গিভ হিম এ্যা ভিসা। হি ইউল ট্রাভেল উইথ মি। 
অফিসার একবারের জন্য আমার চেহারাটা স্ক্যান করলো তার শ্যেন দৃষ্টিতে। তারপর অনিচ্ছা সত্বেও সিল লাগালো পাসপোর্টে। আমি পনেরো দিনের ভিসা পেলাম। 

ওয়েলা আগেই আমাকে বলে রেখেছে ও কমলাপুর এর বিআরটিসির শেড থেকে বাসে উঠবে। আমার বাড়িও ওখানে। আটটায় বাস ছাড়বে, দেখি ওয়েলা আধাঘন্টা আগেই পৌছে গেছে ওখানে। ও জানালো, ও দুটো টিকিট কেটে রেখেছে। ওর পাশের সিটটাতে আমার জায়গা বুক করেছে। হাত বাড়ালো, বললো, টিকিটের টাকাটা দাও। আমি মনে মনে বললাম, ফ্রেঞ্চগুলোও কি এমন কিপটে হয়? তারপর ওর প্রতি বেশ কৃতজ্ঞ আমি। ওর কারনে ভিসা পেয়েছি। দুশো টাকা বের করে দিলাম। বেনাপোল পর্যন্ত ভাড়া একশো আশি টাকা। 
পুরো পথটা বকবক করে মাথা নষ্ট করে ছাড়লো ওয়েলা। ওর বাবা কি করে, ভাইবোনরা ওকে খুব পছন্দ করে, ও এশিয়াতে ভ্রমনে আসবে শুনে হায় হায় করেছে ওরা। কারন ওরা মনে করে পুরো এশিয়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর ভয়ানক জায়গা। সাগরকলা আর পাঁউরুটি দিয়েই সারাটা পথ চললো সে। মাঝে মাঝে আমাকে অফার করলো, কিন্তু সেটা না করার মতোই। টুরিস্টরা এমনই হয়। বেনাপোলে নেমে চেক আপ সারলাম। হরিদাসপুর থেকে রিকসায় আমি আর ওয়েলা চললাম বনগাঁ স্টেশনের দিকে। তখন বিকেল তিনটে। ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোলকাতায় ‍তুমি কি আমার সাথে হোটেলে থাকবে? 

কোলকাতায় যদিও আমার থাকার জায়গার অভাব নেই তারপরও ইতস্তত করে বললাম, ইফ ইউ এগ্রি। -তাহলে ডাবল রুম নিতে হবে। 
-আই উইল পে হাফ, আমি বললাম, ডোন্ট ওরি। 
বনগাঁ থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌছুলাম সন্ধ্যা সাতটায়। কোলকাতায় সেবার শীতকালে বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা দু’জন স্টেশনের বাইরে বেরুতেই পারছিলাম না। কোনমতে শার্ট প্যান্ট ভিজিয়ে একটা ট্যাকসি ধরে চলে এলাম ধর্মতলা। একটা হোটেলে ডাবল রুম নিলাম ৫০০ রুপি দিয়ে। কিন্তু হুট করে পরেরদিন সকালে জ্বর আসলো। উঠতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার শরীরে জ্বর রয়েছে বেশ। ওয়েলা তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ওকে ডাকলাম। ও তাড়াতাড়ি উঠে আমার সেবা করা শুরু করলো। এ্যাসপিরিন আর কি কি যেন ওর কাছে ছিল। তাই খেয়ে বিকেলের দিকে সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি। কোলকাতায় আমার কাছে একটাই প্রিয় জিনিষ আছে, সেটা হলো মিউজিয়াম। এছাড়া গোটা কোলকাতায় আর কিছুই দেখার নেই। চিড়িয়াখানাটাও তেমন নয়, পশুপাখিদেরকে এমনভাবে আবদ্ধ করে রাখে যে বাইরে থেকে দেখার উপায় নেই। পরের দিন মিউজিয়াম দেখা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। ওয়েলা প্রচুর সিগারেট খায়। পুরো রুম ধোঁয়া হয়ে থাকে। আমিও সিগারেট টানতাম তবে ওর মতো নয়। সিগারেটের ধোঁয়ায় আমি ঘুমাতে পারিনা। ধোঁয়াগুলো বের হবার জন্য শীতকালেও রুমের জানালা খুলে রাখতে হয়েছিল। 

পরেরদিনই ব্যাঙ্গালোরের ট্রেনের টিকিট কাটলাম। আমি ওয়েলার গাইড। পুরো ইন্ডিয়া কয়েকবার ঘুরেছি, তাই সব চেনা আছে। সেদিনই সন্ধ্যের ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম। ইন্ডিয়ার দক্ষিন দিকে যেতে হবে এবার। প্রায় ত্রিশ ঘন্টা সময় লাগতো তখন সেই আশির দশকে। ট্রেনগুলোও ততটা উন্নত মানের ছিলনা। হাওড়ার স্টেশনের ডিসপ্লে বোর্ডগুলোও হাতে সুইচ টিপে শো করতো কখন ট্রেন কোন স্টেশনে পৌছুবে। খাবার দাবার নিয়ে ট্রেনে উঠলাম আমি আর ওয়েলা। পানির পেট বোতল তখনও ভারতের বাজারে আসেনি। ওয়েলার কাছে একটা টেক্সান কাউবয়দের ওয়াটার বকস টাইপের বোতলে দেড় লিটার পানির সংস্থান ছিল। আর ট্রেনের বুফেতে টাকা দিলে মিলতো পানি। সারা রাত জার্নি করলাম। ভোর হলো। বন জঙ্গল, শহর পার হয়ে ছুটছে ট্রেন। সূর্য্য উঠলো। ব্যস্ত হয়ে উঠলো পরবর্তী শহরগুলো। তারপর আবার রাত। সেই রাত দুটোয় ব্যাঙ্গালোর পৌছালো ট্রেন। চমৎকার ছোটখাট স্টেশন। ইংরেজীতে বড়ো বড়ো করে লেখা ব্যাঙ্গালোর ক্রান্তিভিরা সাঙোলী রায়ান্না স্টেশন, তবে বেশীরভাগ মানুষের কাছে এটা সিটি স্টেশন নামেই পরিচিত। সবচেয়ে অদ্ভুত এখানকার বর্নমালা-মনে হলো আমরা বুঝি থাইল্যান্ডে চলে এসেছি। এদের বর্নমালার সাথে থাই বর্নমালার এত্তো মিল! কিছুই পড়তে পারছিনা। কর্নাটক রাজ্যের একটা শহর এই ব্যাঙ্গালোর, বর্তমানে ব্যাঙ্গালুরু। আসলে আমরা কোথাও দীর্ঘ সময় থাকার পরিকল্পনা নিয়ে আসিনি, অল্প টাকায় বেশীরভাগ শহর ঘোরার ইচ্ছে নিয়ে ইন্ডিয়া ভ্রমনে আসা। এখানে একটা হোটেলে তিন দিন ছিলাম। দেখার মতো দুটো জিনিষই আছে এখানে। একটা হলো কাবন পার্ক, আরেকটা হলো নেহেরু প্লানেটোরিয়াম। কাবন পার্ক আমাদের রমনা পার্কের মতো তবে বাতাসটা আরও বিশুদ্ধ। প্লানেটোরিয়ামটা আমাদের ভাসানি নভো থিয়েটারের মতো এতো উন্নতমানের ছিলনা তখন। তবে ব্যাঙ্গালোর ঘোরার মজাই আলাদা। আমরা দ্রুত প্যাক আপ করে নিলাম। আমাদের কন্যাকুমারী যেতে হবে। আমি ঘোরার একটা লিস্ট করেছিলাম। সেখানে কন্যাকুমারীর জন্য আলাদা একটা সাতদিনের স্টে প্ল্যানিং ছিল। কিন্তু ওয়েলার উত্তরে যাবার চিন্তা বেশী। ওদিকেই নাকি তার বেশী পরিকল্পনা। এদিকে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলগুলোতে ওকে মশা খুব বিরক্ত করে মারছে। চায়না থেকে কি যেন মোমের মতো একটা পেন্সিল নিয়ে এসেছে ও। ওটা গায়ে মাখতে থাকে সারাক্ষন। আমাকে মশা ধরেনা একদম। 

কন্যাকুমারী হলো তামিলনাড়ুর শেষ একটা স্থান। বলা যায় ভারতের শেষ স্থলসীমানা। ব্যাঙ্গালুরু থেকে অনেক দুরের পথ। আবারও ট্রেন যাত্রা শুরু হলো। এবারও প্রায় বিশ ঘন্টার পথ। এদিকের রেলপথটা আগের মতো নয় বরং কিছুটা লোকাল ধরনের। তারপরও নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে আমরা তামিলনাড়ু পৌছুলাম। আমাকে সব ঘটনা ছোট করে বলতে হচ্ছে কেননা আমরা এতোগুলো শহর আর রাজ্য ভ্রমন করেছিলাম যে একটা ম্যাগাজিনে তা আটবে না। শহরের পর শহর, রাজ্যের পর রাজ্য। এমন একটা সময়ের কথা বলছি যখন মানুষের হাতে ক্যামেরা লাগানো ফোন তো দুরের কথা ক্যামেরাও ছিলনা। আর বেড়ানোর সময় আমরা ক্যামেরায় ছবি তুলবো এই চিন্তাও করতাম না। ওয়েলার কাছে ক্যামেরা ছিল, ও ছবিও তুলেছিল প্রচুর। কিন্তু সেসব ছবি আর পরে নেয়া হয়নি আমার কারন ও ইন্ডিয়া থেকে নেপাল চলে গিয়েছিল। 

কন্যাকুমারী বিশুদ্ধ একটা জায়গা। বাংলাদেশের কুয়াকাটার মতো সেখান থেকেও সুর্যাস্ত সূর্যোদয় এবং চন্দ্রদয় ও চন্দ্রাস্ত দেখা যায়। কন্যাকুমারী জেলার সর্বশেষ জায়গা বা ভারতের সর্বশেষ স্থলসীমানা পয়েন্টটা হলো বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল। এটা একেবারে সমুদ্রের ভেতরে দাঁড়ানো একটা মুর্তি যেখানে আপনি নৌকায় করে যেতে পারবেন কন্যাকুমারী বিচ থেকে। 
ব্যাস, এখানে দু’দিনের ভ্রমন শেষ হলো। ওয়েলা অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে উত্তরে যাবার জন্য। আমার একবার ইচ্ছে হয়েছিল ওকে ছেড়ে চলে যেতে, কেননা আমার এত তাড়া নেই। আস্তে আস্তে ঘুরবো এটাই ছিল আমার ইচ্ছে। কিন্তু ওর সাথে সাথে থাকায় আমার সব দেখা মাটি হচ্ছে। তারপরও ওর সাথে আছি কারন খরচটা দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে বেড়াতে গেলে শেয়ারিং কতো যে উপকার করে তা বলে বোঝানো যাবেনা। 

তামিল নাড়ুর আবহাওয়া মানুষকে কালো করে দেয়। ওখান থেকে ট্রেনে ওঠার পর আয়নায় নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। আমাদের কক্সবাজারের মতো এর রোদ একেবারে চামড়ার মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। এরপরের টার্গেট গোয়া। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল গোয়াতে যাবার। বেশীদুরের যাত্রা নয়, কর্নাটক পার হলেই গোয়া। আমরা এর রাজধানী পানাজীতে না নেমে বড় শহর ভাস্কো দা গামায় নেমে গেলাম। সেখানে ওয়েলা তার পছন্দমতো একটা হোটেল নিল। আমি তার কাছ থেকে আলাদা হয়ে ঘুরতে লাগলাম। চমৎকার একটা জায়গা। ইন্ডিয়াতে যতো জায়গায় আমি গেছি, এর মতো সুন্দর জায়গা খুব কমই চোখে পড়েছে আমার। লোকাল ইন্ডিয়ানদের চেয়ে বিদেশীদের সংখ্যাই এখানে বেশী। এখানকার একটা কথা বলে নেয়া ভাল। ভারতের বেশীরভাগ জায়গায় প্রকাশ্যে মদ্যপান নিষিদ্ধ কিন্তু এখানে তা বৈধ। এখানে জুয়া খেলা, প্রকাশ্যে ক্যাবারে ড্যান্স, ক্যাসিনো, বার, পতিতালয় সবই বৈধ। আর এখানকার বেশীরভাগ স্থানীয় হলো পর্তুগীজ। আপনি যেখানে যাবেন দেখবেন, বিদেশীরা ব্যবসা করছে। বর্তমানের কথা জানিনা, আমি যখন গিয়েছিলাম আশির দশকে-তখনকার কথা বলছি। আমি এখানে থাইল্যান্ডের স্বাদ পেয়েছি। ভারতে বিনোদনের সর্বোচ্চ পয়েন্টটাই পাবেন আপনি গোয়াতে। তিনদিন থাকার পর গোয়া থেকে বাসে করে আমি ওয়েলা চলে এলাম মুম্বাইতে। ভারতের অন্যান্য শহরের মতোই মুম্বাইয়ের চেহারাতেও প্রাচীন একটা ভাব আছে। আমাদের আসলে প্রতিটা টুরিস্ট স্পটে ঘোরার এত সময় নেই। যেতে হবে জুহু বিচে। ওটা দেখে, মুম্বাই স্টুডিও থেকে ঘুরে চলে যেতে হবে আগ্রা। তবে ইচ্ছে পুনের ইলোরা অজন্তায় কিছুটা সময় কাটাতে হবে। জুহু বিচে ঘুরে আমরা চলে এলাম হোটেলে। পরের দিন শুরু হলো মুম্বাই স্টুডিও ট্যুর। পালোমা টুরিস্ট হেভেন নামে একটা ট্যুর গাইড এজেন্সি থেকে টিকিট কাটলাম আমরা একেকজন ৫০ রুপি করে। একটা এসি বাসে ওঠানো হলো আমাদের। পুরো বাসে বিদেশী আর অন্য রাজ্য থেকে আসা টুরিস্ট ভরা। মুম্বাইয়ের যেসমস্ত জায়গায় সিনেমার স্যুটিং হয় সেসব জায়গায় বাস থামিয়ে নামানো হলো আমাদের। কয়েকটা সিনেমার স্যুটিং তখনও চলছিল। দুর থেকে দেখেই ক্ষান্ত দিতে হলো। 

ব্যস, এরপর পুনা। সেই রাতেই মুম্বাই থেকে বাসে রওয়ানা দিলাম আমরা। রাতে আমি জার্নি করতে চাইনা কারন পথে আমি মোটেও ঘুমোতে পারিনা। ফলে বেশ ক্লান্ত লাগে। ওয়েলা দিব্যি কানে ওয়াকমেন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনতে শুনতে যাচ্ছে। ওর দেখাদেখি আমিও কানে ওয়াকমেন লাগালাম। 
দেড়শো কিলোমিটার তিন ঘন্টায় পাড়ি দিলো বাস। ভোর রাতের দিকে পুনা নামলাম আমরা। একটা ঐতিহাসিক আর স্নিগ্ধ শহর হলো পুনা। মন ভরে যাবার মতো পবিত্রতা আছে এই শহরে। পরে শুনেছিলাম ভারতের মধ্যে এখানেই নাকি সবচেয়ে কম অপরাধ ঘটে থাকে। মানুষজনগুলো এখন কেমন জানিনা তবে সেই সময় সবার চোখে কেমন যেন এক নির্লিপ্ততা দেখেছিলাম, যেন বাইরের কারো ব্যপারেই তাদের মাথাব্যথা নেই। খুব ভোরে রেস্টুরেন্টগুলো খোলে ওখানকার। আমরা কিছু রসগোল্লা জাতীয় মিস্টি আর পরোটা দিয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। এখান থেকে ইলোরা আবার পাঁচ ঘন্টার পথ।সেই জায়গার নাম ঔরঙ্গাবাদ। ইচ্ছে করছিল সেদিনটা ওখানে থেকে যেতে। কিন্তু ওয়েলার ভয়ঙ্কর রকম এনার্জি। কোন ক্লান্তি নেই ওর ভেতর। আবার শুরু হলো পথ চলা। মধ্য দুপুরে আমরা ঔরঙ্গাবাদ পৌছুলাম। ঔরঙ্গাবাদের যাত্রা সেদিনের মতো শেষ করে হোটেলে উঠলাম। পরেরদিন সেখান থেকে সরকারী বাসে ১৫ টাকায় ইলোরা গুহায় পৌছুলাম। অজন্তায় পৌছুতে ওখান থেকে আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। তবে ইলোরা আমার মনকে মুগ্ধ করে ফেললো। এতো বিশাল কারুকাজ করা পাহাড়ী স্থাপত্য নিদর্শন এশিয়াতে আর নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। প্রাচীন বিশালকায় শিলালিপিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দিল আমার সামনে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে খোদাই করা স্তম্ভ আর মুর্তিগুলো কতো হাজার বছরের পুরোনো কে জানে। 

ওয়েলা খুব কাছ থেকে গুহার ভেতরটা দেখছে। পাহাড়ের অনেক গভীর পর্যন্ত চলে গেছে পাথুরে গুহা। ভেতরে ইলেক্ট্রিক লাইট আছে, যেন মনে হচ্ছে কোন রাজার দরবারে চলে গেছে এই পথ। অসেলে এটা প্রায় দশ হাজার বছর আগের খোদাই করা পাথুরে পাহাড়। এতো বিশাল বিশাল মুর্তিগুলো দেখলে আপনার গায়ের ভেতর শিরশির করবে। গুহার পাথুরে দেয়ালে হায়ারোগ্লিফিকের মতো সব সাংকেতিক 
চিহ্ন। ওয়েলার কন্ঠস্বরে আমি মাঝে মাঝে চমকে উঠছিলাম। এরপর অজন্তা। সেই একই রকম একটা পাহাড়। যেন দুটো জমজ ভাই। অজন্তা আবার ইলোরার কাছ থেকে অনেক দুরে। হলে কি হবে, দুটোর নকশা, খোদাই কর্মের ভেতর অনেক মিল। আমার কাছে মনে হয় ভারতীয় সব খোদাইকর্ম প্রায় একই

রকম, বিষয়বস্তু ভগবান ও নারী। কিছু কিছু নকশা এমনই যে চোখ বন্ধ করে ফেলতে হয়। বা না দেখে দুরে সরে আসতে হয়। 

আমরা হোটেলে ফিরে কার কত টাকা খরচ হয়েছে তার হিসাব নিয়ে বসলাম। এদিকে হোটেলে শর্ট সার্কিটে ইলেক্ট্রিক চলে গেছে। আবার বেশ ঠান্ডা বাইরে। মোমের আলোতে দু’জন হিসাব করছি কতো টাকা আছে আমাদের কাছে। দেখা গেল আমার আর ওয়েলার সমান সমান খরচ হয়েছে। কিন্তু ওর ফ্রাঁ আছে অনেক যেগুলো ভাঙালে ফ্রান্স থেকে দশবার যাতায়াত করতে পারবে। আর আমার কাছে আছে মাত্র পঁচিশ হাজার রুপি। ভাবছি এই টাকা দিয়ে কাশ্মীর পর্যন্ত যেতে আসতে পারবো কিনা। 
ওয়েলা আছে বলে একাকিত্ব থেকে দুরে আছি। ভ্রমনে গেলে একা একা ঘোরা বেশ কষ্টের। কথা বলা বা সঙ্গী একজন থাকলে ভালো লাগে। ভাগ্য ভালো যে দেশ থেকেই এমন একজনকে পেয়ে গিয়েছি যার একই ধরনের ট্রিপের পরিকল্পনা ছিল। 

ম্যাপ নিয়ে বসলাম। এরপর আমার দিল্লী যাবার পরিকল্পনা। চেক করে দেখলাম আড়াইশোর ভেতর যাওয়া হয়ে যাবে। দেরী করে লাভ নেই। পরের দিনই বাসে উঠলাম ঔরঙ্গাবাদ থেকে। ইন্দোর, জয়পুর পার হয়ে আঠাশ ঘন্টার সড়কপথে যাত্রা। প্রায় দেড় দিনের মতো বাসের ভেতরই বসে থাকতে হলো। আমার মনে হলো আমরা যতোটা পথ ভ্রমন করেছি এ পর্যন্ত তা যদি টেনে সোজা করা যেত তবে ঢাকা থেকে ইরান পর্যন্ত পৌছুতাম আমরা। 

শরীরে ক্লান্তি নিয়ে দিল্লী নামলাম আমরা। একটা অটো নিয়ে চলে এলাম পুরান দিল্লীতে। একি! আমি কি নবাবপুর রোডে চলে এলাম নাকি? একি দিল্লী? এর আগে আমি দিল্লীতে আসিনি। তাই গুলিস্তানের মতো অবস্থা দেখে আমারই হতভম্ব ভাব। নবাবপুর থেকে সদরঘাটের দিকে যে রাস্তাটা গেছে হুবহু সেই রাস্তার মতো রিকশা, টেম্পু, হোন্ডা আর অটো ভরা একটা রাস্তায় এলাম আমরা। ওখানেই নাকি হোটেল বেশী। ওহ কি অবস্থা! হাউকাউ, চিল্লাচিল্লি- এর নামই দিল্লী! ক্লান্তিতে আর পারছিলাম না, একটা হোটেল নিয়ে কোনমতে উঠে পড়লাম। দুপুর হয়ে গেছে। রুমেই অর্ডার দিয়ে ভাত আনালাম। সেই সাথে বেগুন ভাজি, করোলার চপ আর ডাল। খাওয়ার পর আমার বিছানায় পড়তে যতটুকু দেরী। তারপর কি ঘটেছে আর মনে নেই।

চলবে.....................................

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Majhar
October 9, 2020 at 10:51 PM

ভাই,কিছু মনে করবেন না, ওয়েলার সাথে আপনার কোন সম্পর্ক ছিল কি?

Reply
avatar
October 9, 2020 at 11:28 PM

না ভাই,শুধুই বন্ধুত্ব।

Reply
avatar
October 14, 2020 at 2:17 PM

Bah!!chena pother anyorokom kahini

Reply
avatar