বিবর্তনের ধারায় পৃথিবীতে কিছু নতুন জিনিষ যোগ হয়েছে। মানুষের মাথার গঠনে যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি তার মেধারও উন্নতি হয়েছে অসীম। আর এই মেধার কিছু অসাধারন নমুনা হলো নতুন কিছু বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন যেমন মর্টালিটি রিপালশন মেশিন, ইউগ্রোথ ফেব্রিকেটর, টিনিউর মেশিন কেয়ার ইত্যাদি। এসব উদ্ভাবনের সাথে সাথে পৃথিবী যেমন বহুদুর, বহুধাপ এগিয়ে গেছে উন্নতির দিকে তেমন মানবজাতি হয়েছে সমৃদ্ধ। পৃথিবীতে এখন আর স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বলে কিছু নেই। সেসব বহু আগেই উঠে গেছে। মানবজাতি বুঝতে পেরেছে যে, এসব শুধুমাত্র সময় নষ্টের বড়সড় নমুনা। এভাবে ধীর গতির জ্ঞান মানুষকে অনেক পিছনে ফেলে দেয় তাই তারা আবিস্কার করেছে নিউরন মেমোরি কার্ড যা কেবলমাত্র মাথার ভেতর বসিয়ে দিলেই একজন মানুষ সবকিছু জেনে ফেলে। ফলে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত সকল জ্ঞান একসাথে লাভ করে একজন মানুষ। এরফলে খরচের ব্যপারটাও অনেক কমে যায়। সারা জীবন ধরে মানুষ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে টাকা খরচ করে তার দশভাগের একভাগও খরচ হয়না নিউরন মেমোরি কার্ড ব্রেনের ভিতর ইনস্টল করতে।
বাড়ির সব কাজ করে এখন মেশিন। বলতে গেলে রোবটই এখন বাড়িঘরের হর্তাকর্তা। কোন বোতাম টেপা ছাড়াই শুধুমাত্র গলার স্বরের কমান্ড ব্যবহার করেই তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া হচ্ছে। জানালার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে উন্নতমানের হলোগ্রাফিক টেকনোলজি। এর ফলে আপনি যদি পুরান ঢাকার কোন অলিগলিতে বাস করেন জানালা খুললেই দেখতে পাবেন দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ শষ্যখেত বা ধুসর পাহাড় অথবা ককসবাজারের সাগরের ঢেউ। সাথে থাকছে সেই দৃশ্যের অডিও অর্থাৎ ঢেউ এর শব্দ বা যে দৃশ্য আপনি দেখছেন তার শব্দ যা এর সাথে মানানসই হয়। এরফলে জানালা খুললেই এখন চোখে পড়বেনা প্রতিবেশীর ময়লা চটচটে দেয়াল থেকে গড়িয়ে পড়ছে বাথরুমের পানি। মন থাকবে চনমনে ফ্রেশ। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য আর সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠতে হচ্ছেনা আপনাকে। একে তো স্কুল যাবার প্রয়োজনই নেই তারপরও এসব সাহায্য করার জন্য রয়েছে যন্ত্র অর্থাৎ রোবট। রোবটকে এখন আর রোবট বলাও হয়না। তাদের ক্যাটাগরি অনুসারে নামকরন করা হয়। যেমন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন রোবট যারা বাড়ির রান্নাবান্না বা কাপড় কাচার মতো কাজ করে তাদের বলা হয় সি এম বা কেয়ার মেকার। আর এদের নিচের লেভেলে যারা কাজ করে যেমন গেটের দারোয়ান বা মালি রোবট তাদের বলা হয় ডি-ফোর্স। যারা বাড়ি ঘরের নির্মান কাজ করে তারা হলো ডি-৩২ বা ডায়নামিক বত্রিশ।
থানা পুলিশও বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে। অপরাধীদের ধরতে এখন কাজ করে পাওয়ার ডিভিশন। এদের ভেতর রয়েছে সিএফ বা কেয়ারফোর্স। এরা রোবট। রয়েছে রেকটিফায়ার ইউনিট, এরা বিচার বিভাগের কাজ করে। কোন অপরাধী ধরা হলে তাকে আর জেলখানায় পাঠানো হয়না বা তাকে ইলেকট্রিক চেয়ার বা ফাঁসি দেয়াও হয়না। কারন তার প্রয়োজন হয়না। রেকটিফায়ার ইউনিট অপরাধীর মাথায় ট্রাবল কার্ড বসিয়ে দেয়। ট্রাবল কার্ড বসিয়ে দিলেই অপরাধী মূহুর্তে ভালোমানুষে পরিনত হয়। ফলে তাকে আর জেলে পাঠাবার প্রয়োজন হয়না। কেয়ারফোর্স খুবই ভয়ানক রোবট। এরা অপরাধী ধরায় পূর্ন প্রশিক্ষিত।
যাইহোক এবার আমরা আমাদের গল্পে ফিরে আসি। ২০৮৬ সালের ২৪ শে অকটোবরের ঘটনাটার দিকে একবার আলোকপাত করা যাক। সেই সময় পৃথিবী পুরোমাত্রার বৈজ্ঞানিক ধাঁচের পৃথিবী যখন মানুষদের পাশাপাশি রোবটরাও এই পৃথিবীর সব কাজ করে যাচ্ছে। আমার বাড়িতে কাজ করতো ছয়টা রোবট মানে দুটো কেয়ারমেকার, দুটো ডি-বত্রিশ আর দুটো ডি-ফোর্স। আমি কিছুই করিনা কিন্তু পৈতৃক সুত্রে কোলকাতার বাড়ি বিক্রির অনেক টাকা আমার এ্যাকাউন্টে জমে আছে। ঢাকার বাড়িটাও আমি সেই টাকায় করেছি আর বাকি টাকা জমিয়ে রেখেছি ব্যাংকে। সেই টাকা দিয়ে আমার পরবর্তী জীবন খুব ভালোভাবে কেটে যাবে। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে ধর্ম নামের কালচার। আর তাই এই সময়ে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান বলে কোন বিভেদ নেই। পুরো পৃথিবী এখন এক সুতায় বাঁধা। আলাদা কোন দেশ নেই। কোন ভিসাও প্রয়োজন হয়না অন্য কোন রাষ্ট্রে যেতে। আমিও তাই সব ফেলে টেলে চলে যাই নানা জায়গায় ঘুরতে। বাড়ি দিয়ে যাই রোবটদের জিম্মায়। ওরা আমার বাড়িঘর দেখে শুনে রাখে। কিন্তু আমার ধারনায় বেশ ভুল ছিলো। একদিন আমি বাড়িতে না থাকাকালিন সময়ে দুটো কেয়ারমেকার আমার রান্নাঘরে এক হলো। একজন আরেকজনকে বললো,‘আমার মনে হয় তুমি যার কাজ করছো সে একজন বড় ধরনের স্বার্থপর লোক। কারন তুমি ভেবে দেখ এইযে আমরা এতো কষ্ট করছি এর বিনিময়ে আমরা কি পাচ্ছি? কিছুইনা। আমাদের জাস্ট ভোগ করছে মানুষেরা। মনে করো এই মালিক না থাকলে কি হতো? আমাদের এতো কাজ করতে হতোনা। তাহলে তুমি কি করবে?’
অন্য রোবটটা একটা মেয়ে রোবট। সে এসবের কিছুই ভাবেনা। রাতদিন কাজ করে যাওয়াই তার লক্ষ্য। সে কোন জবাব দিতে পারলোনা কারন তার কপোট্রনের গঠন এসব ভাবার উপযোগী নয়। কিন্তু ছেলে রোবটটা একটা সুপার রোবট ছিলো সে এসবের ধার ধারলোনা। সে আমার খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দিলো। কিন্তু ইলেকট্রনিক সেন্স থেকে দুই ডি-ফোর্স বুঝে ফেললো যে আমার খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে। তারা সাথে সাথে জানিয়ে দিলো আমাকে। আমি বাড়ি এসে পুরুষ সুপার রোবটের ব্যাটারি খুলে ফেললাম। আর এই ব্যপারটা জানিয়ে দিলাম কোম্পানীকে।
মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার বাবাকে পুনরুত্থান করার কথা কিন্তু আমার বেশ কিছু কাজ থাকাতে ঐ সময়ে তা হলোনা। আমার বাবা মারা গেছে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। সংবিধানের নিয়ম অনুসারে মারা যাবার সাথে সাথে তাকে ডিপ ফ্রিজিং সমাহিত করা হয়েছে। সবাইকে তা করা হয়। কাউকে খুব বেশী কাছে পেতে ইচ্ছে করলে জগৎ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে হয়। যথাযথ ফর্ম পুরন করে বিশাল অঙ্কের টাকা জমা দিলে ডিপ ফ্রিজার অথরিটি মৃত দেহের শরীরে নিউক্লিয়ার ডেমোনিয়াম চালু করে শরীরের কোষগুলোকে আবার জাগিয়ে তোলে। মৃতদেহের শরীরে পুনরায় শুরু হয় হার্টবিট। উঠে বসে মারা যাওয়া মানুষ। তবে এই বিষয়টা অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশীরভাগ মানুষ তা করতে পারেনা। আমার বাবা মারা যাওয়ার ঠিক সময়টাতে ডিপ ফ্রিজার আবিস্কার হওয়ায় আমার প্রথম ইচ্ছাই ছিলো বাবাকে ডিপ ফ্রিজিং করা। সেই সময় খরচ হয় চার লাখ ডলার। আর জাগিয়ে তোলার পর প্রতি সপ্তাহে খরচ হয় প্রায় এক হাজার ডলার।
আমি মনে মনে ঠিক করলাম মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এই কাজটা করবো। এর মধ্যে অনেক কাজ সেরে নিতে হবে। বাবা অনেক কিছুই দেখে যেতে পারেননি। আমার মা আরও আগে মারা যান। সে সময়টাতে ডিপ ফ্রিজার ছিলোনা। তাই মাকে আমি আর ফেরৎ আনতে পারবোনা কোনদিন। যাইহোক বাবাকে তো পারবো। নিয়ম অনুসারে মারা যাবার সাথে সাথে কোন মৃত দেহকে উঠিয়ে বসানো যায়না কারন তার শরীরে রক্ত থাকে। দীর্ঘ সময় পরে তার শরীরে ভিন্ন পদ্ধতিতে গ্লিসারিন ব্লাড প্রবেশ করিয়ে তার হার্টবিট স্বাভাবিক করা হয়।
মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমি জগৎ সরকারের প্রধান মন্ত্রীর কাছে আবেদন করলাম আমার বাবাকে উত্থানের জন্য। মন্ত্রী জানালো বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান বিজ্ঞানীর কাছে। তিনি আমার কাছ থেকে সব কাগজপত্র বুঝে নিলেন। আর আমাকে সময় দিলেন আরো এক সপ্তাহ পর। বাবার নিরাপত্তার জন্য আমি বাড়িতে আরো ভালো মানের দুটো ডি-ফোর্স এনে রাখলাম। বাবা কি খেতে পছন্দ করতেন ঠিক মনে পড়লোনা কারন তখন আমার বয়স ছিলো মাত্র উনিশ বছর। তবে আমার পছন্দমত আমি সব সুস্বাদু খাবারই বাছাই করে রাখলাম বাবার জন্য। অনেক বছর আগে মায়ের ছবিটা দেয়াল থেকে নামিয়ে রেখেছিলাম। আবার সেটা দেয়ালে তুললাম। বাবা থাকলে মায়ের ছবিটা দেখতে চাইবেন। বাবার জন্য বেশ কিছু দামী জামা কাপড় কিনলাম। বাবা লুঙ্গি পরতেন। তবে মাড় ভাঙ্গা লুঙ্গি পরতেন তিনি। তার ইচ্ছামতো আগে থেকেই লুঙ্গির মাড় ভেঙ্গে রাখলাম।
তারপর সময় এসে গেল। আমার আর ধৈর্য্য ধরছিলোনা। আমি একঘন্টা আগেই পৌছে গেলাম সাইন্স কাউন্সিলের গেটের সামনে। আমার আইডি চেক করা হলো। তারপর চলে গেলাম সরাসরি এম আর সিতে। সেখানে আমার বাবাকে পুনরুত্থিত করা হচ্ছে। আমি সেন্ট্রাল প্রসেসিং কেবিনেটের বাইরে বসে থাকলাম। আমার ভেতরে সেকি আবেগ! বাবাকে আবার আমি দেখবো দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর। বাবা এখন দেখতে কেমন হয়েছে?
তারপর সত্যিই বাবাকে দেখলাম আমি। আমার সামনে স্লাইডিং ট্রেতে করে আনার আগে ডা: আনসার আমার কানে কানে বলে গেলেন যেন বাবার সামনে আমি আমার আবেগ প্রকাশ না করি। বাবা পঁচিশ বছর আগে যেমনভাবে হাঁটতেন ঠিক তেমনি হেঁটে চলে এলেন আমার সামনে। একদম আগের মতো। তবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া শরীর, কোটরে ঢোকা চোখ আর দুর্বল চাউনি। মাত্র ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলেন তো তাই বুঝতে পারছেননা এখানে এলেন কিভাবে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন চোখে সয়ে নিলেন আলোটা তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,‘তুই কলেজে যাসনি আজ?’
আমি বোকা হয়ে গেলাম। কলেজ! আমিতো কলেজের জীবন শেষ করেছি সেই পঁচিশ বছর আগেই। বাবা কি বোকার মতো প্রশ্ন করছে! তারপরও আমি নিজেকে সামলাতে পারলামনা। ডাক্তারের কথা উপেক্ষা করে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখের পানির স্ফুরন অনেক কষ্টে রোদ করে চলেছি। বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,‘হয়েছে কি তোর বলতো? চেহারাও দেখছি কেমন বড় বড় হয়ে গেছে তোর! একি চোখের উপরে কবে এতোবড়ো কেটেছিল দেখিনি তো!’
কেটেছিলো প্রায় আট বছর আগে। গাড়িটা স্কিড করে আমার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গিয়েছিলো। বাড়ি খেয়েছিলাম কপালের উপর। চারটে সেলাই পড়েছিলো। বাবাকে বললাম,‘চলো বাড়ি যাই।’
‘তাতো যাবো। এখানে এসেছিলি কেন? আমার কি হয়েছিলো? পেটে অনেক খিদে, কি খাই বলতো?’
‘বাবা বাড়িতে চলো। অনেক খাবার আছে তোমার জন্য।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ তাই চল।’
(চলবে................................)