মুনতাহার মন ভালো হয়ে গেল...................মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন

মুনতাহা ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। খুব মেধাবী ছাত্রী। ক্লাসে কেউই তার সাথে পড়াশুনায় পারে না। এজন্য যারা তার সাথে প্রতিযোগিতায় পারে না তারা মনে মনে খুব হিংসে করে। কিন্তু হিংসে করলে কী হবে? মুনতাহার সাথে কেউ কোনো খারাপ আচরণ করতে পারে না। কারণ মুনতাহা শুধু মেধাবীই নয় বরং তার রয়েছে অপূর্ব এক গুণ।
সে খুব সহজেই যে কোনো কাউকে বন্ধু বানিয়ে নিতে পারে। কারো সাথে কখনো ঝগড়া-বিবাদ করে না। কোনো সহপাঠী পড়া জিজ্ঞেস করলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়। এসব কারণে শুধু তার সহপাঠীরাই নয় বরং তার শিক্ষকরাও তাকে খুব স্নেহ করেন, অনেক সময় বাড়তি যত্নও নেন।
মুনতাহা তার বাবা, মা, চাচা, চাচী এবং তার চেয়ে যারা বড় তাদের সকলকেই খুব সম্মান করে আর যারা তার ছোট তাদের প্রতি রয়েছে তার এক সহজাত স্নেহপ্রবণ মন।
এতকিছুর পরেও কিন্তু মুনতাহার ভেতরে রয়েছে আলাদা একটি বিষয়। তা হলো, সে যে কোনো কিছুতেই খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন, যদি তার মনের মতো কোনো কিছু হয়ে যায় তাহলে সে যেমন আহলাদে আটখানা হয়ে যায় ঠিক তেমনি তার বিপরীত হলে মন বিষন্নতায় ভরে যায়।
এই যেমন ধরো, যখন স্কুলে পরীক্ষা চলে তখন তার মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। সারাক্ষণ মনে হয়, যদি পরীক্ষায় নাম্বার কম পাই, যদি ক্লাসে সেকেন্ড হয়ে যাই কিংবা যদি পরীক্ষার সময় অসুস্থ হয়ে পড়ি। এজন্য সব সময়ই সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। অহেতুক কোনো সময় নষ্ট করে না। এই এতো অল্প বয়সেও সে ক্লাসের পড়া সব শেষ না করে কখনো খেতে বসে না কিংবা ঘুমাতে যায় না। এ রকম দুশ্চিন্তার কারণে অনেক সময় তার পড়াশুনায় মন বসাতে খুব কষ্ট হয়। আবার অনেক সময় সে পরীক্ষায় জানা উত্তরও ভুল লিখে চলে আসে।
যদি এমন কোনো বিষয় আসে যা মুনতাহা করতে পারছে না বা সে যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে ঘটছে না তখন তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, বিষন্নতা পেয়ে বসে, সে হতাশ হয়ে পড়ে। সে করতে পারছে না কিংবা যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে হচ্ছে না বলেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়।
একদিন সে খুব খুশি হয়ে এক রকম নাচতে নাচতেই স্কুল থেকে বাসায় ফিরলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো ব্যাপারে ভেতরে ভেতরে সে খুব উত্তেজিত। যখন সে বাসায় ফিরলো, তখন তার মা রান্না ঘরে বিকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। সে বাসায় ঢুকেই গড়গড় করে বলতে শুরু করলো, জানো মা, আগামী শুক্রবারে আমরা সকলে স্কুল থেকে পিকনিকে যাবো। খুব মজার মজার খাবার থাকবে। সারাদিন আমরা অনেক খেলবো - লুকোচুরি, কানামাছি, লুডু ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে যারা গান জানে, তারা গান গাইবে। আমাদের টিচাররাও নাকি গান শুনাবেন। খুব মজা হবে তাই না, মা?
হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। এ রকম হলে তো বেশ মজাই হবে। ঠিক আছে, স্কুল থেকে এসেছো, এখন হাত মুখ ওয়াশ করে নাস্তা খেয়ে পড়তে বসো। তাড়াতাড়ি হোম-ওয়ার্ক শেষ করতে হবে।
মুনতাহা মা’র নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করলো। ড্রেস চেঞ্জ করে হাত মুখ ওয়াশ করে পড়তে বসলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে খুব উত্তেজিত। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো, আগামী শুক্রবারে কতোই না মজা করবে তারা। এমন সময় হঠাৎই তার মন থেকে খুশির ভাব দূর হয়ে দুশ্চিন্তা এসে ভর করলো। তার মনে হলো, ‘যদি আমি শুক্রবারের আগে অসুস্থ হয়ে পড়ি? তাহলে তো আর আমি পিকনিকে যেতে পারবো না। সারাদিন আমাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে আর আমার বন্ধুরা সব কতো মজা করবে, খেলবে, ফড়িং ধরবে।’
রাতের খাবারের কিছু আগে মুনতাহা’র বাবা সানাউল্লাহ অফিস থেকে ফিরলেন। তিনি ফ্রেস হবার পর মুনতাহা’র মা লোপা সকলকে খাবার জন্য ডাইনিং টেবিলে ডাকলেন। তারা সকলে একত্রে খেতে বসলো। কিন্তু মুনতাহা একদম চুপচাপই বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে থেকেই তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। কিছুতেই সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। লোপা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, যে মেয়ে কতক্ষণ আগেই স্কুল থেকে খুশিতে লাফাতে লাফাতে এলো তার হঠাৎ করে কী হলো? সানাউল্লাহও মেয়ের চুপচাপ থাকা লক্ষ্য করেছেন। কারণ তিনি জানেন, প্রতিদিন খেতে বসে মুনতাহা কত কথা বলে।

মা, তুমি আজ স্কুলে সারাদিন কী করেছিলে? মুনতাহা’র বাবা জানতে চাইলেন।

আমরা আজকে অনেক নতুন কিছু শিখেছি। মুনতাহা আরো বললো, জানো বাবা, আজকে আমাদের টিচার আমাকে বোর্ডে ডেকে একটা অংক করতে দিয়েছিলেন আর আমি একটুও ভয় না পেয়ে ঠিকভাবে তা করেছি।

খুব ভালো করেছো, সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি কী তোমার স্কুলের সুখবরটা তোমার বাবাকে দিতে ভুলে গেলে? মুনতাহার মা বললো।

বাবা, আমরা আগামী শুক্রবারে স্কুল থেকে পিকনিকে যাচ্ছি।

খুব ভালো কথা মা। কিন্তু তোমাকে তো তার জন্য খুশি মনে হচ্ছে না।

লোপা বললেন, তুমি যখন স্কুল থেকে এলে তখন তোমাকে খুব বেশি উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো কিন্তু এখন কেমন যেনো বিষন্ন মনে হচ্ছে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এমন কী হলো যে তোমার মনটা এতো খারাপ হয়ে গেলো।

হ্যাঁ মা, তুমি ঠিকই বলেছো। আমি যখন স্কুল থেকে এলাম তখন সত্যিই আমি মনে মনে খুব খুশি ছিলাম। কিন্তু এরপর যখন আমি হোমওয়ার্ক করতে বসলাম তখন হঠাৎ করেই একটা বাজে চিন্তা মাথায় এসে আমার মনটা ভীষণ খারাপ করে দিলো।

বাবা বললেন, কী সে বাজে চিন্তা যা তোমার মনকে এতো খুশির সময়ও চুপচাপ করে রেখেছে?

বাবা, আমি যদি শুক্রবারে অসুস্থ থাকি তাহলে তো আর পিকনিকে যেতে পারবো না। আমার বন্ধুরা সকলে কতো মজা করবে আর আমি সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটাবো!

মা বললেন, দেখো মা, তুমি কিন্তু এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আর আমরা কেউই বলতে পারি না যে, একটু পরে কী ঘটতে যাচ্ছে। সামনে কী ঘটবে, না ঘটবে সে ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। তাহলে চিন্তা করে দেখো, তুমি এমন এক বিষয় নিয়ে মন খারাপ করছো যা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।

তার বাবা আরো যোগ করলেন, দেখো মা, এটা তোমার এ জন্যই মনে হচ্ছে যে, যা এখনও ঘটেনি সে ব্যাপারে শয়তান তোমার মাথায় সারাক্ষণ একটা খারাপ চিন্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমাদের মনে যতো খারাপ চিন্তা আসে কিংবা আমরা যতো দুশ্চিন্তা বা উদ্বিগ্নতায় ভুগি তার সবই শয়তান আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। “আর যদি প্ররোচিত করে তোমাকে শয়তানের প্ররোচনা তাহলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করো। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বোজ্ঞ।” [সুরা আল আ’রাফঃ আয়াত ২০০]

মুনতাহা, তার মা বললেন, যখনই তোমার মনে এসব খারাপ চিন্তা আসবে তখনই আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। দোয়া করবে, আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম।

তার বাবা বলতে লাগলেন, শোনো মা, আমাদের কার জীবনে কী ঘটবে তা আল্লাহ তা’আলা অনেক আগে থেকেই জানেন। যেহেতু তিনি আমাদেরকে অনেক ভালোবাসেন তাই আমাদের জন্য যেটা সবচেয়ে উত্তম সেটারই ব্যবস্থা সব সময়ে করে দেন। আমরা হয়তো ঠিকমতো বুঝতে পারি না। ধরো, তোমার যদি কোনো কারণে পিকনিকে যাওয়া না হয় তাহলে নিশ্চিত থাকবে তোমার জন্য এটাই সবচেয়ে মঙ্গলজনক। অনেক মানুষ আছে যারা ভুলে যায় যে, সব কিছুর মধ্যেই মঙ্গল আছে। কারণ হয়তো অনাকাঙ্খিত এমন দু’একটা ঘটনা তাদের সামনে ঘটে যার ফলে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। অথচ এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ কোনো না কোনো এক উসিলায় অলৌকিকভাবে সে বিপদ থেকে উদ্ধারও করতে পারেন। কিন্তু ঐ সকল মানুষ এভাবে চিন্তা করে না বলে তারা খুব সহজেই হতাশ হয়ে পড়ে। আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস কম বলেই এমন অবস্থা হয়।

মুনতাহা ঘাড় নাড়লো, হ্যাঁ, আমি এখন বেশ ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছি। আল্লাহ হলেন আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এখন থেকে যখনই আমার মনে কোনো খারাপ চিন্তা আসবে, তখনই আমি তাঁর কাছে আশ্রয় চাইবো, সাহায্য প্রার্থনা করবো এবং তাঁকে ধন্যবাদ দিবো আমাকে সবচেয়ে উত্তম জিনিস দিবার জন্য।

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট