নীলাদ্রি থেকে সাদাপাথর.......................শাহানা জাবীন সিমি

আপনি কি পাহাড় পছন্দ করেন? ঝর্ণা? পাথুরে নদী? কিংবা ঘুরে দেখতে চান চা বাগান আর সোয়াম ফরেস্ট? তাহলে এক কথায় আপনার ভ্রমণ তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে নিতে পারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট। শ্রীমঙ্গল আগেই ঘোরা হয়েছে তাই দুদিনের ছুটিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বর্ষার পরপরই চলে গেলাম সিলেট । উদ্দেশ্য ঘুরে দেখা টাংগুয়ার হাওড়, রাতারগুল আর সাদাপাথর।
কথায় বলে ভ্রমণের আনন্দ অনেকাংশে নির্ভর করে ভ্রমণসঙ্গীর ওপর। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। দীর্ঘদিনের বান্ধবী রিতু সাথে তার পতি ইমতিয়াজ ভাই, আমাদের তিনকন্যা যায়ীমা, লাবিবা আর আদিবা, ইমতিয়াজ ভাইয়ের এক বন্ধু ও বন্ধুপত্নী। আমার কন্যা যায়ীমার বাবার শেষ মুহূর্তে অফিসে একটা জরুরী মিটিং পড়ে যাওয়াতে এ যাত্রা উনি আমাদের সঙ্গী হতে পারলেন না। কি আর করা! একটু মন খারাপ নিয়ে পৌঁছে গেলাম গ্রীনলাইন পরিবহনের বাস টার্মিনালে।

বাসে উঠে বেশ নস্টালজিক হয়ে গেলাম। কারণ দীর্ঘদিন পর আবার ভ্রমণ করছি দোতলা বাসে। মনে পড়লো সেই ছোট বেলায় সত্তরের দশকে গুলিস্হান থেকে ডাবলডেকার বাসে চেপে দাদা দাদীর সাথে প্রায়ই মিরপুরে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়ানোর স্মৃতি। যাই হোক সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে বাইরের দৃশ্য খুব একটা উপভোগ করা না গেলেও ছয় সাত ঘন্টার ঢাকা সিলেট জার্নি রিতুর সাথে বকবক করে কিভাবে ফুরিয়ে গেলো টেরই পেলাম না। মাঝখানে অবশ্য ডিনারটা সেরে নেয়া হয়েছিল একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে...পরোটা, সবজি, চা আর রিতুর আনা শিককাবাব দিয়ে।

রাত বারোটা নাগাদ সিলেট শহরে পৌঁছে ইমতিয়াজ ভাইয়ের ব্যবস্থা করে রাখা মাইক্রোবাসে চেপে পৌঁছে গেলাম সুসজ্জিত একটি হোটেল মীরা গার্ডেনে। হোটেল চেকইনের ফর্মালিটিস সেরে যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে। পরদিন সকাল নয়টায় যাত্রা...গন্তব্যে টাঙ্গুয়ার হাওড়।

জম্পেশ একটা বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে সিলেট থেকে মাইক্রোবাসে রওয়ানা দিলাম সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওড়ের উদ্দেশ্য। শহরের মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে মনে পড়লো... সেই স্কুলে থাকতে বাবা মায়ের সাথে এসেছিলাম সিলেট...ঘুরে বেড়িয়েছিলাম জাফলং আর তামাবিল। পথিমধ্যে সঙ্গী হলো ইমতিয়াজ ভাইয়ের একজন সহকর্মী আর তার পাঁচ বছরের কন্যা। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের রাস্তা পুরোটা মসৃণ নয়। মাঝে মাঝে বন্ধুর ও চড়াই উতরাই পেরিয়ে ঘন্টা দুয়েক লেগে যায় টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ঘাটে পৌঁছাতে। শুনেছি পদ্ম ফুল নাকি সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ফুটে ওঠে আবার দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঁজে যায়। এই দুঘন্টার যাত্রায় অনেকগুলো দিঘীতে পদ্ম ফুটে থাকার সৌন্দর্য চড়াই

উতরাই পথের ঝাঁকুনির কষ্টটা কে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল। ঘাটে পৌঁছে একটা ইন্জিন নৌকা সারাদিনের জন্য ভাড়া করে হাওড়ের পানিতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এই নৌকাগুলো সাধারণত দোতলা হয়ে থাকে। নিচের তলায় বিছানা পেতে শোওয়ার ব্যাবস্থা, ওয়াশরুম আর কিচেন। আর দোতলার ছাদটিতে রোদ থেকে বাঁচার জন্যে মাথার উপর সামিয়ানা খাটিয়ে পরিপাটি করে বসার ব্যবস্থা...বেশ একটা জমিদারি ভাব। যে যার মতো ছাদটিতে আরাম করে বসলাম। ইন্জিন নৌকার ঘটঘট আওয়াজ প্রথমে একটু বিরক্তির কারণ হলেও যখন নৌকাটি জনবহুল ঘাট ছেড়ে এগিয়ে চললো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের মেঘালয় তার সবুজ পাহাড়ের দর্শন দিল তখন টাঙ্গুয়ার হাওড়ের নীল পানি আর সবুজের সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার।

সৌন্দর্য পিপাসুরা বলে থাকে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ভ্রমণের ভালো সময় শীতকাল তখন এখানে নানা প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে অথবা বর্ষার শেষে যখন মেঘালয় থেকে উড়ে আসা মেঘ হঠাত্ কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি ঝরিয়ে সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলে। টাঙ্গুয়ার হাওড় শীতকালে অতিথি পাখিদের জন্য যেমন অভয়ারণ্য তেমনি বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ এর সম্পদ। এই মাছের উপর নির্ভর করে এই হাওড়ের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। যাইহোক যাত্রা শুরু করেছিলাম রৌদ্রজ্বল নীল আকাশে কিন্তু দুপুরের পর আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনায় হাওড়ের পানির রঙ বদলানোর খেলা বেশ উপভোগ্য হলো। হায় রে কেনযে কবি হলাম না! হঠাত্ মনে পড়লো এই অঞ্চল তো হাসন রাজার দেশ এবং অদ্ভুত ভাবে সুযোগও হয়ে গেল হাসন রাজার কিছু বাউল গান শোনার। কিভাবে? সেটাই বলছি। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে আছে একটা ওয়াচ টাওয়ার যেখানে পর্যটকরা উঠে পুরো হাওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। আমরাও উঠে পড়লাম ওয়াচ টাওয়ারের চুড়ায়। সেখানে দেখা মিললো কিছু স্থানীয় কিশোরের যারা গেয়ে চলেছে একটার পর একটা বাউল গান...'লোকে বলে লোকে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নয় আমার। কি ঘর বানাইবো আমি শূন্যের মাঝার'।

ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটার ঘর ছুঁয়েছে ; ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে নৌকায় ফিরতে ক্ষিদে যেন চনমনিয়ে উঠলো। ফ্রেশ হয়ে নৌকার ছাদেই পাটি পেতে আহারের ব্যবস্থা। বাইন মাছ ও কাইক্কা মাছের দোপেঁয়াজি, আলু দিয়ে দেশি মুরগির ঝোল, সবজি, ডাল এবং ভাত। এতো সুস্বাদু রান্না যে নৌকার রাঁধুনি কে ফাইভ স্টার রেটিং দিতে আমরা কেউ কুণ্ঠিত হলাম না। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় চা পান করতে করতে জানতে পারলাম তাহিরপুর সীমান্তে 'নীলাদ্রি' লেকটা একবার দেখে না গেলে নাকি জীবনই বৃথা। অনেকক্ষণ পরে নৌকা থেকে নামতে পেরে তিন কন্যা আর সাথে তাদের দুই মায়েরা ফটোসেশনে ব্যস্ত হয়ে রইলাম। হঠাত্ ইমতিয়াজ ভাইয়ের ডাক শোনা গেল...তোমরা তাড়াতাড়ি এদিকে এসো 'নীলাদ্রি' তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

কে যে রেখেছিল নামটি....নীলাদ্রি!! পাহাড় বেষ্টিত অদ্ভুত সুন্দর নীলাভ সবুজ পানিতে ভরা লেকটি যেন বাংলাদেশের বুকে একটা ছোট্ট কাশ্মীর। এ সৌন্দর্য যে চুপচাপ বসে বসে আস্বাদন করতে হয়। আরো কিছু বিস্ময়কর ঘটনা যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা কে জানতো? হঠাত্ তাঁর নির্দেশে মেঘ বৃষ্টির দুত যখন অসময়ে শুরু করলো ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি তখন নিজেদের বাঁচাতে একটা উঁচু টিলার উপরে ছাউনির নিচে সবাই দাঁড়ালাম সেখান থেকে নীলাদ্রি লেক যেন আরো অপূর্ব আরো পরিপূর্ণ। হঠাত্ বৃষ্টির মধ্যেই আকাশে দেখা মিললো সূর্যের...সাথে আমাদের অবাক করে দিয়ে পরপর দুটি রঙধনু। জীবনে রঙধনু তো বহুবার দেখেছি কিন্তু 'ডাবল রেইনবো' এই প্রথম। যাইহোক মনের ক্যানভাসে নীলাদ্রি লেক আর দ্বৈত রঙধনুর ছবি এঁকে আর মোবাইল ক্যামেরার ফ্রেমে এদের সৌন্দর্য কে বন্দী করে শুরু হলো ফিরতি যাত্রা। ফিরতি যাত্রায় বোনাস হিসেবে পেলাম টাংগুয়ার হাওড়ে সূর্যাস্ত দর্শন। দ্বিতীয় দিনের গন্তব্যে রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট আর সাদাপাথর।

রাতারগুল পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি প্রাকৃতিক সোয়াম্প ফরেস্টের একটি কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে যারা সুন্দরবন যাননি তাদের জন্য রাতারগুল হতে পারে একটি 'মিনি সুন্দরবন'। সিলেট থেকে মাইক্রোবাসে গোয়াইনঘাট উপজেলায় গোয়াইন নদীর তীরে রাতারগুল পৌঁছাতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে। রাস্তা মসৃণ চাইলে একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন। সোয়াম্প ফরেস্ট ঘুরে দেখতে নৌকা ভাড়া করতে হলো। পশুপাখির অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে এখানে ইন্জিন নৌকা নিষিদ্ধ। নৌকার বৈঠা বেয়ে মাঝি ঘুরিয়ে দেখালো নানারকম জলজ উদ্ভিদে ঠাসা এই বন। যতই ভিতরে ঢুকছি বন যেন গভীর হচ্ছে ; নীল আকাশ হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের আচ্ছাদনে। তবে এখানে পাখির কলকাকলি যেমন আনন্দদায়ক তবে সদা সজাগ থাকতে হয় গাছ থেকে ঝুলে থাকা নৌকার মাঝির ভাষায় বিষহীন একধরনের চিকন

সাপের ব্যাপারে যা যখন তখন নৌকার উপর টুপটুপ করে পড়ে হানা দেয়।
রাতারগুল থেকে বেরিয়ে এবারের যাত্রা সিলেটের সীমান্তবর্তী গ্রাম ভোলাগন্জ। রাস্তা মসৃণ; গাড়ীতে বসে চিপ্স, চকলেট; কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম কোম্পানিগন্জ উপজেলার সর্ববৃহত্ পাথর কোয়ারির এই অঞ্চলে। বড় করে লেখা ভোলাগন্জ "জিরো পয়েন্ট"। সীমান্তের ওপারেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। স্হানীয়দের কাছে এই জায়গাটি সাদাপাথর নামে পরিচিত। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানির সাথে নেমে আসে পাথর। সেই পাথরই ছড়িয়ে আছে ভোলাগন্জ জিরোপয়েন্টের বিশাল এলাকা জুড়ে। এখানে ভোলাগন্জ বর্ডারের কাছে এসে ইন্জিন নৌকা ভাড়া করতে হলো। ইন্জিন নৌকায় ধলাই নদ ধরে দশ মিনিটের পথ পেরোলেই বিস্তীর্ণ সাদাপাথরের হাতছানি। মেঘালয়ের পাহাড়, ধলাই নদ আর সাদাপাথর মিলে মিশে একাকার। নৌকা থেকে নেমে আরো কিছুক্ষণ কষ্ট করে ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে হাঁটার পর দেখা মিললো স্বচ্ছ শীতল জলধারার। একেবারে সেই কিশোরবেলায় দেখা জাফলং এর মতো। সবাই এখানে ব্যস্ত হলাম শীতল পানিতে পা ডুবাতে। তবে পাথরগুলো অতিরিক্ত পিচ্ছিল হওয়ায় সতর্কতা অবলম্বন খুবই জরুরী । দ্রুতই ঘড়ির কাঁটা এগোতে লাগলো। এবার যে বিদায়ের পালা। তবে একটা কথা বলে রাখি সিলেটের এই দর্শনীয় স্থানগুলি একা ভ্রমণ না করে গ্রুপে ভ্রমণ করলে খরচের দিক থেকেও যেমন সাশ্রয় হবে তেমনি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকা ফেরার বাস। চারটার মধ্যে হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে একটু জিরিয়ে রওয়ানা দিলাম। এই দুদিনে প্রকৃতি আমাকে দিল অদ্ভুত এক মানসিক প্রশান্তি। বাসে উঠে বসলাম; খুব দ্রুতই গ্রীনলাইন পরিবহনের দোতলা বাস সিলেট ছেড়ে বেরিয়ে গেল ব্যস্ত নগরী ঢাকার দিকে।

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Anonymous
October 3, 2020 at 12:40 AM

সিলেট অনেকবার ঘোরা হয়েছে তবে টাঙুয়ার হাওর দেখা নাই

Reply
avatar
October 3, 2020 at 12:09 PM

ঘুরে আসুন ভালো লাগবে।

Reply
avatar
Anonymous
October 6, 2020 at 4:07 PM

নিঃসন্দেহে সুন্দর লেখা

Reply
avatar
October 8, 2020 at 8:31 PM

সিমি,চাকরির খাতিরে অনেকবার ওদিকে গেছি। কিন্তু তোমার মতো এতো সুন্দরভাবে ভ্রমন কাহিনী লিখতে পারবো না। তোমার লেখার concept খুবই mature. দোয়া করি আরও অনেক লেখ। ভালো থেকো।
ছোট চাচা।

Reply
avatar
October 10, 2020 at 1:50 PM

ধন্যবাদ চাচা। তোমার অনুপ্রেরণা আমাকে অনেক উত্সাহ দেয়।

Reply
avatar