স্যার শাঁক নিবেন না, নিয়া যান স্যার টাটকা শাঁক,নদীর ঐ পারের,আজ ভোরেই তোলা স্যার।আমি প্রায় প্রতিদিনই শাঁক কিনি এক মধ্য বয়সী লোকের কাছ থেকে কিন্তু এই যুবকটিকে মাত্র ক'দিন ধরে দেখছি। এর কাছ থেকে কিনিনি কখনো পুরনো শাঁক বিক্রেতার কাছ থেকেই কিনি আজ পুরনো লোকটা আসেনি এই যুবকটির ডাকে তাঁর কাছে যাই,বলি দাও দু আঁটি। টাকা দিতে যেয়ে তাঁর দিকে ভালো করে চোখ পড়লো চেনা চেনা লাগছে কিন্তু মনে পড়ছে না।
লক ডাউনের মধ্যে দোকান পাট সব বন্ধ থাকলেও তরকারির মতো নিত্য প্রয়োজনীয় শাঁক সবজী বিক্রেতার আনাগোনা কম ছিলো না,আমাদের কলোনির মূল গেটের বাইরে সকাল ন'টা পর্যন্ত সব ধরনের তরকারি বিক্রেতার ভিড় লেগেই থাকে এই সময়।প্রায় দুশো পরিবার বসবাস করে কলোনিতে একটি মাত্র মূল গেট দিয়েই আসা যাওয়া ফলে ডিম ডাল মাছ ও প্রায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদী বিক্রেতার ভিড় বেশী,অল্প সময়ে প্রচুর বিক্রির আশায়।জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে এখানে এর পূর্বে দেখিনি আগে কোথায় ছিলে?স্যার লকডাউনের আগে গুলিস্তানে শার্টের দোকানে চাকরী করতাম আপনি কি গুলিস্তানে যান কখনো?তার প্রশ্ন।বললাম ওখানে আমার দোকান আছে। তাই নাকি স্যার কোন দোকান?বললাম গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স এ। নাম কি স্যার দোকানের ? দোকানের নাম বললে সে চিনতে পেরে বললো গেঞ্জির দোকান চিনিতো স্যার,দোকানের কর্মচারি শাহীনের সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব।হ স্যার আপনেরেও দেখছি দোকানে, এইবার চিনছি স্যার আপনেরে সবাই মামা কয়।হ্যা বলে জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কি,বললো আজহার। জিজ্ঞেস করলাম আজহার কোন দোকান তোমার।আমার দোকান নাই স্যার আপনার দোকানের একটু দক্ষিণে ফুটে সাইদুলের দোকানে চাকরী করতাম।
এখনতো দোকান খুলেছে যাও না কেন?স্যার এখন বেচাকেনা নাই আমারে বাদ দিছে সাইদুল ভাই একাই দোকান চালায়।দেখলাম আজহারের সন্মান জ্ঞান বেশ পরিমিত তাঁর মাহাজন সাইদুলকে ভাই সম্বোধন করে বলছে।আচ্ছা কাল আবার আসবো বলে চলে এলাম।পরদিন আবার যখন গেলাম আজাহারকে দেখলাম না অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করলে সে বলতে পারলো না।তিনদিন পর আজাহারের দেখা মিললো সে এখন ডিম বিক্রেতা আমায় দেখে বিগলিত হাসি দিয়ে বললো স্যার শাঁক বেইচ্চা পোষায় না তাই ডিমের ব্যবসা শুরু করলাম।বললাম ডিমেতো রিস্ক বেশী ও বললো না স্যার ভোরে ডিমের আড়তেে মহাজনের কাছ থেকে ডিম এনে বিক্রি করি বাকি গুলো মহাজনরে ফেরত দিয়ে দেই এইখানে রিস্ক কম।আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে আসবো ও বললো স্যার এই কলোনিতে কি ভাড়া থাকেন বললাম না না এলোটি হিসেবেই থাকি,ও আচ্ছা তয় আপনে সরকারি চাকরি করেন?না আমি না আমার স্ত্রী চাকরি করে আমি ব্যবসা করি আজাহার বিনয়ী হাসি দিয়ে বললো স্যার ভাল কাজই করছেন ম্যডাম আর আপনে দুইজনেই ইনকাম করতাছেন ভালোই কায়দা করছেন।আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার এই ইনকামে চলে? বউ ছেলে মেয়ে আছে না? আছে বউ আর এক বাচ্চা। বউ কিছু করে না স্যার লেখাপড়া না শিখলে কি চাকরি করন যায়! আমি এক ডজন ডিম কিনে ফিরে আসবো এমন সময় সে বললো ঐ যে কইলেন না চলে কিনা, চলে না স্যার খুউব কায়দা করে চালাই,এই লক ডাউনে না খাইয়া মরার অবস্থা হইছিলো ফুট বন্ধ, কবে দোকান খুলবো জানি না কি আর করমু এক চাচার ভ্যান ভাড়া লইয়া শাঁক বেচতে নাইমা পড়ি বাচোনতো লাগবো!এরপরদিন থেকে আজাহারের কোন দেখা নেই।ফোন দিলাম ফোন বন্ধ বেশ বিরক্ত লাগছে ডিম লাগবে এখানে পেলে ভালই হয় নইলে সেই নিউমার্কেটে ভিড়ের মধ্যে যেতে হবে ইদানীং আমার পরিবারে ডিম খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে বিশেষ করে ইমিউন সিস্টেম বাড়ানো ও ইউটিউব দেখে খাবারের রেসিপির জন্য ডিম বড়ই প্রয়োজনীয়। সেদিন আজাহারের ফোন নাম্বারটা নিয়েছিলাম তাই ফোন করে জানতে চেষ্টা করে বন্ধ দেখে ডিম কিনতে নিউমার্কেটে চললাম।
হাটতে হাটতে আজাহারের কথা ভাবছি কত ধরনের ব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছে সে বাঁচার জন্য এই পেন্ডামিকেও প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যে অবধি ঘরের বাইরে থাকতে হচ্ছে। আমার অবস্থাও ভালো নেই দোকানটা প্রায় দেড় মাস বন্ধ কর্মচারিদেরকে আসতে না করেছি এলে ওরা মেসে থাকবে কিছু হলে কে দেখবে তাই,তবুও ওদেরকে কিছুটা হলেও বেতন দিতে হচ্ছে। যদিও আমাদের দুজনের আয়ে ভালোই চলছিল এখন শুধুই আমার স্ত্রীর উপর দিয়ে চলছে তবুও আমরা ভালোই আছি আজাহারের তুলনায়।আজাহারের জন্য উদ্বিগ্নতা এসে ভর করছে।কোথায় গেল সে ভাবতে ভাবতে নিউমার্কেটে যেয়ে কিছু কেনাকাটা করে ফিরে এলাম।
প্রায় দুমাস পর দোকানে যাচ্ছি সিয়াম ও হাসান গত পরশু এসে দোকান খুলেছে শাহিন এখন আসেনি অবশ্য শাহিনকে ফোনে বলেছি যেন না আসে,এখন বেচাকেনা খারাপ নিশ্চিত তিনজনের বেতন দেওয়া সম্ভব না যা বিক্রি হচ্ছে তাতে করে দুজনের বেতনই উঠছে না তিনজনের কিভাবে দেব এমনিতেই শাহীন দীর্ঘদিন কাজ করছে ওর বেতন অনেক বেশী।
কয়েকদিন পূর্বে নতুন একজনকে নিয়োগ দিয়েছিলাম কিন্তু করোনার কারণে তাকে বিদায় করে দিয়েছি।দোকানে সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরবো এমন সময় দেখি আজাহার দোকানের সামনে, আমাকে দেখে ডান হাত উঁচিয়ে সালাম দিলো তাঁর দু হাতে দেখি অনেক মাস্ক বিনয়ী হাসি দিয়ে বললো স্যার ডিমের ব্যবসা করতে পারলাম না। বললাম কেন? কয়েকদিন আগে পুলিশের গাড়ির লগে লাইগা ভ্যান উল্টাইয়া গিয়া সব ডিম নষ্ট হইয়া গেল মহাজন আর ডিম দিলো না। জিজ্ঞেস করলাম এখন তবে মাস্ক বিক্রি করো?হ স্যার কি করমু! বললাম তোমার বৌ বাচ্চা কেমন আছে? ভাল না স্যার বৌ বাচ্চা দুজনেরই জ্বর ক'দিন ধরে। গলা ব্যাথা আছে? হ গলা ব্যাথা কাশি জ্বর মাথা ব্যাথা সব আছে। মাইয়াটার অবস্থা ভালা না মাইয়াডার দিকে চাইলে মনডা হু হু কইরা উঠে।ডাক্তার দেখাইছো?ডাক্তার দেখানের টেকা পামু কই তয় বাসার পাসের ডিস্পেনসারির কর্মচারিরে কইয়া ওষুধ আনছি। কি ওষুধ দিলো নাম মনে আছে?প্যারাসিটামল,জিম্যাক্স আর কাশির সিরাফ দিছিলো তয় খালি প্যারাসিটামল খাওয়াইছি ওই দুইটা ওষুধ কিননের টাকা ছিলো না তাই কিনি নাই।এখন কি অবস্থা? ভালা না স্যার।বাসা থেকে বের হয়েছো কেন তাড়াতাড়ি বাসায় যাও।আর কয়টা বেচতে পারলে চইলা যামু বাজার করতে হইবো।আমি তাঁর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম যাও ওষুধগুলো কিনে নিয়ে তাড়াতাড়ি যাও আর শোন গরম পানি ও লাল চা খেতে দিবে।আচ্ছা স্যার বলে দ্রুত বাসার দিকে চলে গেল আজাহার।পাস থেকে সিয়াম বললো আঙ্কেল ওরে চিনেন নাকি?কদিন আগে চিনলাম আমাদের কলোনির গেটে শাঁক বেচতো বললাম তুমি চিন নাকি?হ্যা চিনি সাইদুলের দোকানে কাজ করতো এখন ওরে না কইরা দিছে,খুবই ভাল পোলা।এখন খুউব কষ্টে বাইচা আছে। আমি হু বলে বাসার দিকে রওনা হলাম মনে মনে ভাবছি এটাকেই কি কায়দা করে বেঁচে থাকা বলে না কি যুদ্ধ বলে! জানিনা।