২০০৬ সালে আমি যখন স্কুলে ভর্তি হব, তখন আমরা প্রথম মফস্বল শহরে বাসা নেই। তার আগে আমরা গ্রামে দুই রুমের টিনশেডওয়ালা দালানে থাকতাম। ওই ইউনিয়নেই আমার মায়ের জব আজ প্রায় ২০বছর। আমার খুব আবছাভাবে মনে পড়ে, ওই বাসায় থাকাকালীন সময়ে আমার একটি গল্পের বই ছিল, ‘লাশকাটা ঘর’। ভূতের গল্পের বই। কাহিনি কিছুই মনে নেই তেমন, তবে বইটি যে আমাকে পড়ে শোনানো হতো তা আমার মনে পড়ে। এছাড়াও হয়তোবা দু’একটা বই তখন পড়েছি কি পড়িনি তা ঠিক মনে নেই।
ক্লাশ টু’তে পড়ার সময় আমি সুকুমার রায় সমগ্র গোগ্রাসে গিলতাম। আমার স্মৃতির পাতায় এটি জলছবির মতো স্পষ্ট। কারণ, বাল্যকালে সেই ছিল আমার প্রথম বই পড়ার শুরু। পাগলা দাশুর গল্পগুলো সবচেয়ে বেশি ভালোলাগত। আর ভালোলাগত সুকুমার রায়ের লেখা ছড়াগুলো। তাঁর ‘সৎ পাত্র’ কবিতাটি এতই ভালোলাগত যে পড়তে পড়তে আমার পুরোটা মুখস্ত হয়েছিল। আমি একা একাই কবিতাটা আবৃত্তি করতাম। তাঁর ‘ওয়াসিলিসা’ গল্পটিও দু’বার স্কুলে গল্পের ক্লাসে বলেছিলাম। আর পড়তাম বিবিধগুলো ওই সমগ্রের। মোটামুটি আমার বাল্যকালের একটা সময় যাবত আমি শুধু সুকুমারের বইটা নিয়েই কাটিয়েছি।
এরপর যখন আরেকটু বড় হলাম, বাসায় কেউ না থাকলে আমি এই বই সেই বই বইয়ের র্যাক থেকে নামিয়ে পড়তাম। কারো সামনে পড়তে আমার কেমন যেন লাগত। কারণ সেই বইগুলো প্রাইমারি স্কুলের স্টুডেন্টের পড়ার মতো ছিল না। সবই বড়দের বই- হিমুর রূপালী রাত্রি, নীল অপরাজিতা, যুবরাজ, পরিণীতা, দেবদাস...! বাসায় ছোটদের বই একেবারে ছিল না বললেই চলে। আমারো কিনতে চাইতে ভয় লাগত। কখনো সাহস করে বলিনি কিনে দেওয়ার জন্য। কেন যেন মনে হতো বই কেনার কথা বললেই বকা শুনতে হবে।
তখন ভীষণ চুপচাপ ছিলাম। আমার প্রথম গল্পটা যখন লিখি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়, লিখে ডাইরিটা পুরোনো খাতা-ডাইরির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। মা একদিন গোছগাছ করতে গিয়ে ওটা পেয়েছিল। আমার সামনেই পড়তে শুরু করলেন। আমি কেন যেন ভয়ে ঘেমে একাকার হয়ে গেছিলাম ওই ফাগুন মাসে! কিন্তু মা যখন গল্পটা পড়ে কোথাও কোথাও দাঁড়িকমা ঠিক করে দিয়ে বললেন যে, তুই আরো লিখবি, যা ইচ্ছে হয় সেটাই লিখবি, তখনই আমি লেখালেখির ভরসা পেলাম। একটু একটু করে লিখতে থাকলাম। কিন্তু তাও বই কেনার কথা বলতে পারলাম না। ওই পুরোনো বই আর আমার শ্রদ্ধেয় আজিজুল স্যারের থেকে পাওয়া শরৎ রচনা সমগ্র লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েই দিন কাটতে লাগল।
বই কেনা শেখা শুরু করলাম, ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে। তখন থেকে যখন যেভাবে সুযোগ হতো একটা দু’টো বই কিনিয়ে নিতাম। বান্ধবীদের থেকে ধার নিয়ে পড়তাম।
জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে পড়লাম হিমু, নবম শ্রেণিতে পরিচিত হলাম মিসির আলীর সাথে। ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে পড়লাম সাতকাহন-১। তখন থেকেই আমি নিয়মিত বই পড়ি। মা বলতেন ভালো ভালো পুরোনো লেখকের বই পড়তে। কিন্তু আমার ভালোলাগত হুমায়ুন আহমেদের জোছনা মাখা গল্প আর বৃষ্টিতে ভেজা উপন্যাস। তাই কলেজে ওঠার আগে হুমায়ুন আহমেদ স্যারের বইগুলো নিয়েই থাকতাম। এসএসসি দিয়ে পড়লাম বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল- হুমায়ুন আহমেদের প্রেমের উপন্যাস সমগ্র।
কলেজে এসে যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়া শুরু করলাম, তখন পরিচিত হলাম তারাশঙ্কর-বঙ্কিমসহ দেশবিদেশের সেরা লেখকের লেখাগুলোর সাথে।অনুধাবন করলাম, কেন মা সবসময় এদের লেখা পড়তে বলতেন। এরপর আবার শুরু করলাম গোয়েন্দা সমগ্র পড়া- ফেলুদা-ব্যোমকেশ-কাকাবাবু।
আমি বুঝতে পারলাম, আমার জীবনের এই ছোট্ট পরিসরে আমি আগের কাজ আগে আর পরের কাজ পরে করতে পারিনি। যখন আমার কিশোর সমগ্র পড়ার কথা, তখন পড়েছি প্রেমের উপন্যাস। তাই আমার বই পড়ার পদ্ধতিটা ঠিক ছিল না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে না এলে হয়তো আসল সাহিত্যরস উপভোগও করতে পারতাম না কখনো। এর কারণ একটাই, আমি পরিবার থেকে সবসময় উৎসাহ পেয়েছি, কিন্তু কখনো ‘গাইডেন্স’টা পাইনি। আমার পরিবার আমাকে বই পড়তে বলেছে, কিন্তু ভালো একটা বই কিনে এনে আমার হাতে দেয়নি। হয়তো তারা আমাকে বরাবরের মতো বই পড়ার ক্ষেত্রেও পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে চেয়েছেন, কিন্তু পূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য সময়ানুযায়ী যে বই পড়ার একটা থিওরি, এটা যে গুরুত্বপূর্ণ এটাও অস্বীকার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
তাই আমার মনে হয়, আমাদের উচিৎ আমাদের ছোটভাইবোনগুলোর দায়িত্ব নিজেদের বহন করা। ওদের আনন্দের দিকে লক্ষ্য রেখেই ওদের বয়সোপযোগী বই ওদের হাতে তুলে দেওয়া, বই পড়তে উৎসাহিত করা। আর বাবা-মায়েরও তার সন্তানদের প্রতি একই ভূমিকা পালন করার আবশ্যকতা যে তীব্র, তা আমি অনুভব করতে পারি। নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথে চালিত করতে হলে তার হাল আমাদেরই ধরিয়ে দিতে হবে।