সুধাময় নীরধর (ভারতের শেষ গ্রাম ছিটকুল )...................... সেমন্তী ঘোষ (হাওড়া, কোলকাতা)

বিশ্বসংসারের অনন্ত ক্যানভাসে  ছড়িয়ে আছে কত শত রঙ।কখনো সে রঙ আনে শুষ্কতার মাঝে পূর্ণতা,কখনো ফাগুনের দামাল হাওয়ায় এলোমেলো মন,আবার কখনো গ্রীষ্মের লাল চোখ কে উপেক্ষা করে সে রঙই দেয় শৈলশিখরের হাতছানি।তুষারাবৃত পাহাড় আর কল্লোলিনীর রুমঝুম কুলকুল শব্দ পৌঁছে দেয় এক অনন্ত অমৃত বিশ্বলোকে।প্রকৃতির মাঝেই যেন স্বর্গের উপস্থিতি।স্বপ্ন ও বাস্তবতার অপূর্ব মেলবন্ধনে হিমালয়ের নেশাধরানো মোহ,নির্ঝরিনী কলতান আর চোখ জুড়ানো সবুজের নিখাদ আগ্রাসন নিয়ে মন হারায় বন-পাহাড়ের সেই অসীম সীমায়....

অভিলাষী হৃদয়ের অনাবিল চাওয়া 
অনুভবের জানালায় উজানের হাওয়া
                                                                                            নীলাভ আকাশতটে দুর্লভ জ্যোতি 
                                                                                            দুরন্ত দুর্বার অসীমের গতি... 
বাঁধা পথের বাঁধন ছেড়ে তাই যাত্রা সেই অসীমের ঠিকানায়।আকাশে আশ্চর্য ম্যাজিক আর আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ নিয়ে বাঁকে বাঁকে যার রোমাঞ্চের হাতছানি সেই ছিটকুলে।ভারতের হিমাচলপ্রদেশ  রাজ্যের হিমালয় পর্বত শ্রেণীর ভারত-তিব্বত সীমান্তের কাছাকাছি কিন্নর জেলার মধ্যে অবস্থিত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১১৩২০ ফুট উচ্চতায় দর্শনীয় স্থান ভারতের শেষ গ্রাম ছিটকুল।গ্রামটির বেশিরভাগ অঞ্চলই চার থেকে পাঁচ মাস বরফাবৃত থাকে।দূর পাহাড়ের চূড়াও থাকে শুভ্র বসন পরিধানে।পাহাড় প্রেমীরা এখান থেকেই যান lamkhaga pass ট্রেকিংয়ে। কলকাতা থেকে বিমানে চন্ডিগড় বা হাওড়া থেকে ট্রেনে চন্ডিগড় সেখান থেকে রামপুর গিয়ে রাতটি অতিবাহিত করে পরের দিন রামপুর থেকে পৌঁছে যাওয়া যায় ছিটকুল।চন্ডিগড় থেকে রামপুর আনুমানিক ২২২ কিলোমিটার।রামপুর থেকে ছিটকুল এর দূরত্ব প্রায় ১০৭ কিলোমিটার।অথবা চন্ডিগড় থেকে ছিটকুল দীর্ঘ বারো তেরো ঘণ্টার পথ চাইলে একদিনেও পৌছাতে পারেন।দীর্ঘ পথের  ক্লান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে যায় ছিটকুলে পৌঁছে   বাস্পা নদীর উপত্যকায় মনোরম প্রকৃতির শোভায়।পাইন,ওক,ফার ভুজ গাছের ছাওয়া পথ।দূর পাহাড়ের রূপের ডালি থেকে বিচ্ছুরিত বরফের দ‍্যুতি। নীলাকাশের আশ্চর্য কোলাজে মায়াবী  এক পাথুরে গ্রাম। ২০১০ সালের জনগণনা অনুযায়ী এখানে মাত্র ৮৮২ জন লোকের বসবাস।শীতপ্রধান অঞ্চলের বাড়িগুলিও বেশ দৃষ্টি আকর্ষক।বাড়ি গুলির দেওয়াল পাথর আর মাটির মিশ্রণে তৈরী  এবং দুটি দেওয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে যাতে সেই পরিমাণে শীতলতা আসতে না পারে তার জন্য কাঠ দেওয়া রয়েছে।ছাদ নির্মিত শ্লেট  পাথরের।অল্পসংখ্যক বাড়িতে পাথরের তলায় উল কিছু সংখ্যক বাড়িতে ভেড়ার লোম দেওয়া রয়েছে ছাদ থেকে জল অপসারণের জন্য।সব মিলিয়ে এক রঙিন পশমের চাদরে মোড়া স্বপ্নের গ্রাম ছিটকুল।প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অতিক্রম করে চোখে পড়লো ঘরে ঘরে দারিদ্রতার তীব্র যন্ত্রণা।বোল্ডার পরিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় এখানে সামান্য কিছু সংখ্যক চাষাবাদ লক্ষ্য করা গেলেও এদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার রসদ সংগ্রহ করতে হয় ২১ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে।এছাড়া ছিটকুলের কিছুটা আগে রয়েছে  কিছু সংখ্যক আপেল বাগান।তবুও এই বাধাহীন স্বর্গারোহিনীর রূপে হাস্যোজ্জ্বল আকাশে তারা নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখে।তাদের কাছে শুনলাম দেবী মাথির কথা।হিন্দুতত্ত্ব এবং বৌদ্ধমত মেনে এখানে রয়েছে ৫০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দির।মন্দিরের কাঠের উপর খোদাই করা কাজ অপূর্ব সুন্দর।মন্দির দর্শন শেষে পৌঁছালাম ছোট-বড় বোল্ডারে পরিপূর্ণ বাস্পা নদীর  নিকটে ছিটকুলের একমাত্র পাঠশালায়।স্বপ্নের মত সুন্দর বাগ্ময় উদার প্রকৃতির মাঝে এক ছোট্ট শিক্ষা নিকেতন।ছিটকুলের এই গ্রাম থেকে তিব্বতের বর্ডার অদূরেই-পূর্বে আই.টি.বি.পি-র সৈন্যরা পায়ে হেঁটে বা খচ্চরের পিঠে চেপে বর্ডার পর্যন্ত টহল দিত  বর্তমানে কেন্দ্র সরকারের অনুমোদনে বি.আর.ও দ্বারা একটি রাস্তা নির্মিত হচ্ছে দেখলাম।প্রকৃতির অপরূপ শোভা মন ক্যামেরার সাথে বন্দি হল ক্যামেরায়।অপূর্ব বর্ণছটার মাঝে নির্জন সৌন্দর্যের জগতে পাহাড়িয়া বাঁশির সুরে ঝুপ করে নেমে এলো আঁধার।দুপাশের উঁচু পাহাড়ের সতর্ক পাহারায় মায়াঞ্জন বাস্পা নদীর উপত্যকা কে বিদায় জানাবার সময় হল। পাহাড়ের গায়ে আকাশের মাঝে রুপালি রেখার নিভৃত মিলন নুড়িপাথর আর সবুজের নন্দনকানন নিয়ে চিরতরে স্মৃতির মণিকোঠায় স্থান করে নিল..... 

মেঘের জলসাঘরে প্রকৃতির রূপ 
নীহার তরঙ্গ মেলায় ধ্যান  নিশ্চুপ......



(চিত্র সৌজন্য পৃথ্বীশ ভদ্র)

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Anonymous
October 7, 2020 at 12:43 AM

বাধাহীন স্বর্গারোহিনীর রূপে হাস্যোজ্জ্বল আকাশে তারা নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখে-দারুন উপমা দিদি।

Reply
avatar