মধ্যরাতের চিঠি....................সঞ্জয় দেবনাথ

রাত তখন তিনটা। বিছানা ছেড়ে হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে উঠলো স্নেহ। টেবিলের পাশে রাখা প্যাডের পাতা ছিড়ে লিখতে বসলো চিঠি। কেন এতো রাতে এই চিঠি লেখার কান্ড! সকালেই তো লিখতে পারতো। কিংবা বিকাল বা মধ্যদুপুর। কি এমন হলো যে গভীর রাতে ওঠে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চিঠি লিখতে বসলো! নিশ্চই কারণ আছে। কার্যকারণ ছাড়া তো কিছুই হয়না পৃথিবীতে...।

পৃথিবী যখন ঘুমাচ্ছিলো তখন মৃত শরীরের গল্প নিয়ে অনেক লেখা স্নেহ পড়েছিলো। কেন মানুষ মরে যায় খুন হয়ে। হত্যা তো সর্বদা হয়। শোষিত শ্রেণি মরে মরে বেঁচে যায় আধমরা হয়ে। মানুষইতো মানুষকে খাটায়। তাহলে আসল মানুষ কে? ভাবনাগুলো ঘুরে তার মাথায়। তাহলে মানুষ কেন ঘুমায় প্রতিবাদী না হয়ে- এমন সব প্রশ্ন নিয়ে স্নেহ দিশেহারা। কোথায় যেনো পড়েছিলো- ‘বীর সেই, মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনকে যে সৃষ্টি করে, মৃত্যুকে যে জয় করে।’

  ঘটনাটা সেই থেকে শুরু যখন দূর নীলিমায় আকাশের রঙ লাল হয়ে সূর্য পাটে যেতে বসেছে। ঠিক তখনই নবীনার আবির্ভাব। স্নেহ রাতকে টেনে আগেকার মতো আর দীর্ঘ করতে পারেনা। কখন সকাল হবে ছুটে যাবে নবীনার কাছে। নিজের প্রতি একসময়ের অযত্নের শরীর পরিপাটি করে সে দেয় দৌড় এক নিঃশ্বাসে, বুক ভর্তি সুখশ্বাস টেনে। কি পড়েছে, কি গল্প জেনেছে তার সবটুকু জ্ঞান যে নবীনাকে দেয়া চাই। তা না হলে তার এই জানা যে ব্যর্থ! যার জন্যে বিছানায় রাতঘুম দিয়ে সকালে খেয়ালই থাকেনা সিগারেটের ছাই মুছে যাবার কথা। প্রতিরাতে খাবার পর বিছানায় শুয়ে নবীনাকে ভেবে ভেবে জ্বলন্ত সিগারেট টানা সে তো অনুভবের অনাবিল স্নিগ্ধতা। সেই নবীনা এখন তার ধ্যানজ্ঞান। তার মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা। যাকে সারাক্ষণ বুঝায় কি করে ‘মানুষ’ হতে হয়। হাজার বছরের জমানো নোংরা জিনিস মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কিভাবে নিজেকে বদলাতে হয়। পরিবর্তন নয় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সমাজকে পাল্টাতে হয় এইসব কত কি! নবীনাও স্নেহের কথায় মোহাবিষ্ট হয়। অজানা আকর্ষণে স্নেহকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়...। 

  নবীনা এখন আর হতাশা খুঁজে পায়না। সমুদ্রের অনাবিল ঢেউ প্রতি মুহূর্ত ভরসার জল হয়ে যে তাকে স্নাত করে চলেছে। ছোট্ট মনে তার রাতদিন স্নেহের বসবাস। কি করছে, কি খাচ্ছে, আজ কোথায় যাওয়া হবে- এগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ নবীনার জানা চাই। স্নেহেরও তাই...। 

  এভাবেতো অনেকদিন ভালোই চলছিলো। ধ্বংসের ভিতরে হঠাৎ কিভাবে প্রাণের জন্ম হয় আর সেই প্রাণ লক্ষকোটি প্রাণের মুক্তি ঘটায়; সে তো নবীনা শিখেছে স্নেহের কাছ থেকে। সেতো শুধু রক্ত-মাংসে গড়া মেয়ে নয়, একজন মানুষ। যে মানুষ অন্যের দুঃখে অনুশোচনা করেনা, জ্বলে ওঠে। যে মানুষ ভিতরে জমানো এতোকালের নোংরা উপাদান ত্যাগ করে দ্রোহী হয়। প্রেমিক-প্রেমিকার সস্তা ভোগ-বিলাসের আমি-তুমিতে আর আত্মকেন্দ্রিক ভালোবাসায় মগ্ন থাকেনা। নিজের আত্মসম্মানবোধে বাঁচা মানুষরাই বেঁচে থাকে, অন্যরা মরে যায়...। 

  এও জেনেছে নবীনা, ‘একটা ভালো কাজ করা কারো পক্ষেই কঠিন নয়। কঠিন হচ্ছে- সারাজীবন ধরে ভালো কাজ করা। কখনো কোনো খারাপ কাজ না করা।’ চারপাশে মুখস্থ মানুষ আর ছেলে-মেয়েদের কঠিন আবেগে বিপথগামী হওয়ার গল্পের পাঠতো অহর্নিশ নিয়েছে নবীনা স্নেহের কাছ থেকে...। 

  

  অপ্রত্যাশিত এক কালবৈশাখি ঝড় এসে সব তছনছ করে দিলো তাদের নির্মোহ-নির্মল ভাবাবেগে। স্নেহ সেটা মানতেই পারছেনা। আকাশ কালো করা অন্ধকারে রাতের জোনাক আর নক্ষত্রের আলো- এখন স্নেহের দু’চোখ সেটা খুুঁজে পায়না। চোখ দু’টো অন্ধই মনে হয়। 

  পাঁজর বিদীর্ণ করা ক্ষত নিয়ে স্নেহ বলেছিলো নবীনাকে-

  ‘কেন তুমি এটা করলে গো?’

  ‘আমি তোমাকে হারানোর ভয়ে লুকিয়েছি’

নবীনার সহজ-সরল উত্তরে তার মনটা আরও ক্ষতবিক্ষত হয়। সে আঘাত পায়। এ কেমন কথা! আমাকে হারানোর ভয়ে তোমাকে দেয়া এতোদিনের আদর্শের গল্পগুলো তুমি ভুলে যাবে? আমাকে লুকিয়ে তোমার ভিতরের সেই নোংরা উপাদান বয়ে নিয়ে বেড়াবে? হারানোর ভয়ে সেই নোংরামো করবে? 

 স্নেহ কিছুতেই মানতে পারছেনা। অসাড় ক্ষতবিক্ষত শরীর-মন নিয়ে ভাবনাগুলো মাথায় ফিরে ফিরে আসতেই থাকে...

  তোমাকে তো যত্ন করে বুঝিয়েছি। এই পৃথিবীর আত্মত্যাগী মহৎ বিপ্লবীদের কথা বলেছি। প্রতিরোধ যুদ্ধে নাৎসী বাহিনী কর্তৃক ফাঁসি দেয়া বিপ্লবী কিশোরী লেপা রেডিক থেকে শুরু করে ক্ষুদিরাম, ভগত সিং, মঙ্গল পান্ডে, প্রীতিলতার মতো মহৎপ্রাণের আত্মবলিদানের কথা বলেছি। মানুষের মুক্তি-স্বাধীনতার জন্যে এইসব বিপ্লবীরা প্রাণ দিয়েছেন খুব অল্প বয়সেই। আমিতো তোমায় দ্রোহী সত্তা ধারণ করতে বলেছি তোমার হৃদয়ে; এইসব মহৎ প্রাণের মতোই...। 

  তুমি ভুল করলে, শোধরালাম, আবার ভুল! তাও মেনে নিলাম... 

উষ্ণ রক্তে বুকের প্রকোষ্ট ভরে যায় স্নেহের। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো কি যেনো একটা জিনিস সজোরে ধাক্কা দিয়ে কাঁপায় তার সমগ্র শরীর। সে ঘুমাতে পারেনা। 

 মনকে প্রবোধ দেয়- ‘ঠিক হয়ে যাবে, ছোট মানুষ ভুল করেছে, ক্ষমাও চেয়েছে’

 আবার মন মানে না- ‘এতো বুঝাবার পরও বার বার আঘাত দেয়া! সেতো আমায় ভালোবাসে। তাহলে অন্য দশটা মেয়ের মতোই আচরণ করবে কেন? সেতো অন্যমেয়েদের পাল্টাবে নিজের মতাদর্শ দিয়ে। তাহলে? আমার সব শিক্ষা-আদর্শ কি ব্যর্থ হয়ে গেলো!’

  স্নেহ ঘুমের ওষুধ খায়, সিগারেটের টেনে নেয়া ধোয়ায় তার গলায় কফ জমে। সে কাশতে থাকে। রাতের আকাশে জেগে থাকে তার গলা-ঠোঁট-চোখ-মুখ সব। মাথাটা নিয়ে কোনরকমে বিছানায় যায়, ঘুম নিরুদ্দেশ...।

  ‘চাপ দিয়ে গোপন কথা বের করা’ এমন তো নবীনা করতে পারেনা! স্বপ্রণোদিত হয়ে গড়গড়িয়ে সব বলে দিলো না কেন? 

স্নেহ না ঘুমানো চোখে প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে গভীর রাতে চিঠি লিখতে বসে নবীনাকে। আবার বুঝাবে বলে- যদি আর ভুল না করে! নিজেকে বাঁচাবে বলেই আশা নিয়ে কলম ধরে। কারণ স্নেহ তো জানে ‘লেগে পড়ে থাকার নাম বিজয়।’        



শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Anonymous
October 3, 2020 at 7:02 PM

লেখার বিষয়বস্ত কিসের ওপর নির্ভর করেছে?

Reply
avatar