ম্যাম, হীরার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে মায়ার!
-কিরে নৌকা ঠিক হলো ?
-জি ম্যাম ঠিক হয়েছে, আপনি আর ফাহিম নৌকায় গিয়ে বসেন আমি আসছি।
-জি ম্যাম, বলে চলে যায় হীরা। ফাহিম মাঝিদের সাথে কথা বলছে। মায়া বসেই থাকলো পাথরের উপরে।
কিছুক্ষণ পর হীরা ফিরে আসে
খাবারের প্যাকেট হাতে। ওর সাথে এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের কোলে একটা তিন/চার বছরের ছেলে আর পাশে আট/ নয় বছরের একটা মেয়ে। ভদ্রলোক মায়াকে সালাম দেয়। মায়া সালামের উত্তর দিয়ে হীরার দিকে তাকায়!
-ম্যাম উনিও সাঙ্গু ভ্রমনে এসেছেন, নৌকা খুঁজছেন! আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন নৌকার কথা; আমি ওনাকে বলেছি আমাদের নৌকায় আমাদের সাথেই আসতে! উনি একলা মানুষ আর আমাদের নৌকাও অনেক বড়ো! হীরার কথায় মায়া মুচকি হাসে।
-কী বলেন ম্যাম ওনাকে নেবো?
-অবশ্যই কেনো নয়! বলে মায়া মুচকি হাসে।
-আপনাদের কোনো অসুবিধা হবেনা তো? ভদ্রলোকের জিজ্ঞাসা মায়াকে!
-তা খানিকটা হবে বৈকি! যে খাবার তিনজনে খেতাম সেই খাবার এখন ছয় জনে খেতে হবে ভাগ করে! তিনজনে মিলে হেভি খিস্তি করতাম কিন্তু এখন সেটা পারবোনা! মায়ার কথায় ওরা তিনজনই হেসে ওঠে এমনকি আট বছরের মেয়েটাও। ছেলেটা বাবার কোলে ঘুমে ঢুলছে।
-ম্যাম আপনারা নৌকায় ওঠেন।
এখন সাথে বাচ্চা অতিথি আছে আমি আরও কিছু খাবার নিয়ে আসি বলে হীরা দৌড় দেয়। ওরা নৌকার দিকে এগিয়ে যায়। নৌকার কাছে গিয়ে ফাহিমের সাথে ভদ্রলোকের পরিচয় করিয়ে দেয় মায়া। ফাহিম হাত মেলায় ভদ্রলোকের সাথে। মায়া খেয়াল করে ভদ্রলোকের চোখেমুখে তীব্র কৌতূহল আর বিস্ময়। নৌকা ছেড়েছে। শুরু হয়েছে ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ। প্রকৃতির নীরবতা ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যাচ্ছে! এখন ডিসেম্বরের শেষ। রোদ তাই মায়াবী, মোলায়েম। মাথার উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ, মাঝেমাঝে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। এই নীল মেঘ, নরম রোদের পাহাড়ের সবুজের গায়ে চুম্বন, সাঙ্গুর বুক চিরে বয়ে চলা নৌকা আর হিমেল হাওয়ার শীত শীত গন্ধে জড়ানো বিকেল সব কেমন অপার্থিব লাগে মায়ার কাছে!! মায়া প্রথমবার যখন বান্দরবান এসেছিলো বিস্ময়ে আর মুগ্ধতায় দম বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছিলো ওর। এখনও সেই মুগ্ধতা কাজ করে, বিস্ময় খানিকটা কমেছে। শীত পড়তে শুরু করেছে। এদিকে শীত একটু আগেভাগেই পড়ে। হীরা বলেছে কোথায় একটা ঝরনা আছে সেখানে নামবে আজ। মায়া হীরা আর ফাহিমের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মিশেল রাহমান মায়া। ত্রিশ এর মায়া অবিবাহিতা, ভ্রমনপিপাসু, মনখোলা, হাসিখুশি এবং মিশুক প্রকৃতির। হীরা আর ফাহিম ওর অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে দুজন। ফাহিম রানিং ছাত্র, মা নেই, মায়াকেই ও মা ডাকে। হীরা এই বান্দরবান শহরেরই ছেলে। ওদের অরিজিন কুষ্টিয়াতে বাবার চাকরির সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে ওরা বান্দরবানে।
হীরা আরও তিন বছর আগে পাশ করে বেরিয়ে এসেছে। হীরাও মায়াকে মায়ের মতো সম্মান করে। ওদের কাছে মায়া শিক্ষক কম, মা এবং বন্ধু বেশি। ওরা দুইজন মায়ার খুব প্রিয় মানুষ,ছাত্র, সন্তান, বন্ধু, সব।
ফাহিম আর হীরা ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত নৌকার ছাদে। ভদ্রলোক ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেছেন নৌকার ভেতরে, মেয়েও তার পাশে বসে আছে। মায়া খেয়াল করেছে ভদ্রলোকের গায়ে একটা পাতলা টি শার্ট । বাচ্চাদের গায়েও হাল্কা কাপড়। এদিকে নৌকার গতি বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাসও বাড়ছে সেইসাথে শীত লাগতে শুরু করেছে। শীত বেড়েই চলেছে। হীরা আর ফাহিমের গায়ে গরম কাপড় আছে। মায়া নিজেও শাড়ি পরেছে; ব্যাগে চাদরও আছে। এই বান্দরবানের সব ধরনের আবহাওয়ার সাথে পরিচিত মায়া। তাই এখানে আসলে সেইমতোই চলে । এদিকে ওই বাচ্চাটা বাবার কোলে শীতে কাঁপছে। ভদ্রলোককে অসহায় দেখালো! মায়া ভাবছে কী করা যায়! হঠাৎ ব্যাগে রাখা চাদরটার কথা মনে হোলো। এইবার আসার আগে দেশাল থেকে কিনেছে চাদরটা। খুব সুন্দর, আরামদায়ক আর বেশ বড়ো। মায়া চাদরটা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলো।
-এই চাদরটা ধরুন ওকে ভালো করে জড়িয়ে দিন। নয়তো জ্বর চলে আসতে পারে। দুচোখ ভরা কৃতজ্ঞতায় ধন্যবাদ দিয়ে চাদরটা নিলেন ভদ্রলোক।
নৌকা এগিয়ে চলছে। বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা নৌকার গলুইয়ে গিয়ে বসলো। ভদ্রলোক বের হয়ে এলেন ভেতর থেকে। মায়ার মুখোমুখি নৌকার ওপাশে বসলেন। ওনার দুই চোখে হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্ন করতে পারছেন না কিছুটা অস্বস্তি আর বাকীটা ইঞ্জিনের ভটভটির যন্ত্রনায়। কিছুই শোনা যায়না। ফাহিম আর হীরাও নেমে এসেছে ইতোমধ্যে। মেয়েটার ক্যামেরার কৌতূহল মেটাচ্ছে ফাহিম, আর হীরা ভদ্রলোকের সাথে টুকটাক কথার চেষ্টা চালাচ্ছে এই বিকট শব্দের মাঝেও। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে মায়া বিস্ময় নিয়ে। মায়ার বিস্ময় ও এতোবার এই পাহাড়্গুলোর কাছে এসেছে, এই নদীর জলে এতো নেমেছে তাও কেনো নতুন লাগে প্রতিবার! যুগের পর যুগ এক জায়গায় ঠায় দাড়িয়ে থাকা পাহাড়্গুলো এতো গতিশীল আর মায়াবী হয় কী করে? কিভাবে পারে স্থানু পাহাড় ওকে এমন চুম্বকের মতো টানতে ? মায়া কী শুধুই এই পাহাড়ের টানেই এই সবুজ পাহাড়ি শহরটাতে বারবার ফিরে আসে? নাকি অন্যকিছু? এই পাহাড়, এই সাঙ্গুর জল কিংবা সাঙ্গুর জলে পাহাড়ের ছায়া, ওই আদিবাসী নারী-শিশু, নদীর বুক চিরে চলে যাওয়া দীর্ঘ বাঁশের সারি এই সব তার বহুবার দেখা! তবুও প্রতিবার নতুন লাগে! বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়!
হীরার চিৎকারে ধ্যান ভাঙ্গে মায়ার।‘ম্যাম চলে আসছি’ বলে লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নামে হীরা। প্রায় পৌনে এক ঘন্টা ভ্রমণ শেষে সেই কাঙ্ক্ষিত ঝর্ণার কাছে পৌঁছেছে তারা। বাচ্চাটার ঘুম ভেঙ্গেছে ইতোমধ্যে। হীরা বাচ্চাটাকে কোলে নিলো এক রকম জোর করে। আর পিউ ফাহিমের
আঙ্গুল ধরে এগিয়ে গেলো। ভদ্রলোকের ছেলেটার নাম অর্ক আর মেয়েটার নাম পিউ। ভদ্রলোক নামলেন। মায়াও নামলো।
-চলুন এগোই; এই প্রথম
ভদ্রলোক কথা বললেন নিজ থেকে। ভদ্রলোকের কথার উত্তরে ‘আপনারাএগিয়ে যান আমি আসছি’ বলে পানিতে নেমে গেলো মায়া শাড়ি খানিকটা উঠিয়ে। পানি ভয়াবহ ঠাণ্ডা। ও হাঁটতে থাকে তীর ধরে। হাঁটা মুশকিল। খুব মসৃণ নয় নদীর তীর। ডিসেম্বরের শেষ বেলা, ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে। গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে। মায়া আঁচলটা টেনে নেয় ভালো করে। খানিকটা এগিয়ে থমকে পেছনে ফেরে।
-আপনি যাননি?
-আপনাকে একা রেখে যাওয়াটা কী ঠিক হতো বলেন? কি নীরব জায়গা! আর হীরাদেরও দেখা যাচ্ছেনা।
-মাঝিরা রয়েছে তো!
-তারপরও শুধু মাঝিদের ভরসায় এই বিরান জায়গায় আপনাকে একা রেখে যাওয়া বিরাট বোকামী এবং অভদ্রতা। আপনি এতোটা করলেন আমাদের জন্য!
-কী করলাম?
-চেনাজানা নেই একজনকে নিজেদের নৌকায় সঙ্গী করে নিয়ে নিলেন!
-গন্তব্য যেহেতু এক একসাথে আসাটাই উত্তম নয় কি?
- তারপরও আমি ভালো লোক না ও হতে পারতাম!
- দুই সন্তান সাথে নিয়ে
আপনি আর কতোটুকু খারাপ হবেন? আর আমার ছেলেদের দেখেছেন? এমন দুই ছেলে থাকতে আমি পাবো আপনাকে ভয়? মায়ার কথায় ভদ্রলোক হেসে উঠেন।
- কিন্তু আপনার সন্তানরাওতো আমার দুই ছাত্রের কাছে একদম একা।
-ম্যাডাম, আপনার মতো শিক্ষাগুরু যাদের আছে তাদের কাছে পৃথিবীর কেউ অনিরাপদ নয়!
- এই ৪৫ মিনিটে দুই লাইন কথা বলেই বুঝে ফেললেন?
- যাকে বুঝা যায় তাকে দুইলাইনেই বুঝা যায়।
- আপনি সেটা বিশ্বাস করেন?
-করি বৈকি।
-ভাবীকে আনলেন না যে!
- সকালে নীলগিরি গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে দুপুর। খাওয়ার পর ও বলছিলো ওর ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু বাচ্চারা বের হতে চাইলো। তাই আপনার ভাবীকে রেখেই বের হতে হোলো।
- ভাবী আসলে ভালো হতো।
- জি ও খুব মিস করলো!
-আচ্ছা শুরু থেকে আমি আপনার দুই চোখে অনেক প্রশ্ন দেখতে পাচ্ছি মিস্টার ......
-জি শাহনেওয়াজ হায়দার
-জি মিস্টার হায়দার, কিসের এতো প্রশ্ন বলুনতো?
- জি মিস...
- মায়া
-মিস মায়া আপনার কী মনে হয়না এই আপনারা তিনজন যে কারো জন্যই এক বিস্ময় ?
-কেনো বিস্ময় হতে যাবো কেনো?
-মিস মায়া লুক এট ইউ এন্ড ইউর স্টুডেন্টস। আপনারা তিনজন ছাত্র শিক্ষক কিন্তু আপনার ছাত্রদের সাথে আপনাকে যে খুব বেশি আলাদা করা যাচ্ছে বয়সে বা আচরণে তা কিন্তু নয়! আপনি বলছেন আপনি ওদের শিক্ষক কিন্তু ওদের সাথে আপনার আচরণ মোটেই শিক্ষকসুলভ নয়!
-বয়সে খুব বেশি আলাদা করা যাচ্ছেনা কারণ ওরা দেখতে বয়সের তুলনায় বড়ো, লম্বা চওড়া। ওদের একজন আমার চেয়ে আট বছরের আর একজন ১২ বছরের ছোট। খুব ভালোভাবে অবসারভ করলে সেটা বুঝবেন। আর আচরণের কথা বলছেন? আমি ওদের শিক্ষক ক্যাম্পাসে। কিন্তু ব্যক্তিগত ভ্রমনে আমি ওদের শিক্ষক কম, বন্ধু বেশি। খুব ব্যক্তিগত ভ্রমণে শুধুই ছাত্রছাত্রী নিয়ে কেউ যায়না! ওরা দুজন আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ; মাই ব্রিদিং স্পেস।
-ঠিক এই জায়গাটার ব্যাপারেই আমার আগ্রহ বেশি। আমি শুরু থেকেই খুব মুগ্ধ আপনাদের দেখে। ইনফ্যাক্ট আমি আমার এইটুকু জীবনে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের এই রসায়ন দেখিনি। একটু ডিটেইলে বলবেন মিস মায়া যদি অনধিকার চর্চা মনে না করেন!
- না না তা কেনো মনে করবো! নিশ্চয়ই বলবো! আমি অবিবাহিতা এবং পরিস্থিতির কারণেই গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় একাই থাকি। এই তীব্র একাকীত্বের দিনে ওরা মানে আমার ছাত্রছাত্রীরাই আমার ভালো থাকার উৎস। আমার অধিকাংশ কলিগের জীবন যেখানে আত্মীয়, পরিজন, বন্ধুবান্ধবকে ঘিরে আবর্তিত হয় সেখানে আমার জীবন আবর্তিত হয় ছাত্রছাত্রীদের ঘিরে। আমার ব্যাক্তিগত এবং পেশাগত জীবন সব জায়গায় ছাত্রছাত্রীদেরই আনাগোনা। আমি জানিনা ওরা ঠিক কী ভেবে আমার কাছে আসে, আমাকে অনেক কিছু বলে, আমাকে ভালোবেসে ফেলে, আমার কাছে নিজের গোপন কথাটা শেয়ার করে কেঁদে ফেলে।
থেমে যায় মায়া। ঝর্ণার শব্দ পাচ্ছে ওরা।
-একটু বসি?
-জি অবশ্যই বলে মায়া নিজেও একটা পাথরের উপর বসে।
- আমি প্রচুর কথা বলি এবং অতি অবশ্যই মিষ্টভাষী; আশা করি সেটা এতক্ষণে বুঝে গেছেন। উচিত কথা সবসময় যে মুখের উপর বলে দিতে পারি তা নয়; ছাত্রছাত্রীদের উপর রাগ করতে পারিনা বা ধমকাধমকিও আমার দ্বারা হয়না। আমার চরিত্রে দুর্বোধ্যতা নেই। আমি সহজ মানুষ । ক্লাসে খুব সহজ পদ্ধতিতে পড়াতে চেষ্টা করি তার চেয়েও বেশি চেষ্টা করি ওদেরকে বুঝতে। ছাত্রছাত্রীদের মনের, তাদের ভাবনার, যাপনের খানিকটাও যদি বুঝা বা জানা যায় তাহলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়, পড়ানোটাও। এটা আমার মত, আমার অব্জারভেশন। আপনি একমত না ও হতে পারেন। হায়দার সাহেব মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকেন মায়ার কথা। থেমে যায় মায়া। কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে আসছে ওর ।
-লেকচার লেকচার লাগছে আমার কথা না? মাস্টার তো ! বকবক করা অভ্যাস। বলার সুযোগ পেলে আর থামতে মন চায় না। হায়দার সাহেব তাকিয়ে থাকে মায়ার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
-ভাই সাহেব কী দেখেন এমন অবাক হয়ে?
-আপনাকে দেখছি আর ভাবছি ম্যাডাম!
-কি ভাবছেন?
-ভাবছি শিক্ষক আপনার মতো হয়?
-আমার মতো বলতে কেমন?
-এই মায়ের মতো বা বন্ধুর মতো?
-কেনো হবেনা অবশ্যই হয়। আমি
নিজেই এমন অনেক শিক্ষককে চিনি। আমার ধারনা অনেক শিক্ষকই এমন শুধু তাদেরকে সবাই আবিষ্কার করেনা বা করতে জানেন না। কিংবা হয়তো ওনারা চান না কেউ ওনাদের আবিষ্কার করুক।
-হয়তো! কিন্তু আমি আপনাকেই প্রথম দেখলাম।
-সেটা হতেই পারে।
-বিয়ে করেন নি যে?
-সে আর এক গল্প। শোনাবো কখনও।
-প্রেমে পড়েননি?
-বহুবার।
-বললেন একলা জীবন? বন্ধু নেই কোনো?
-আছে আবার নেইও।
-সেটা কেমন?
-সেই গল্পটাও একদিন শোনাবো যদি আবার দেখা হয়ে যায়।
-উঠেছেন কোথায়?
-বার্মিজ মার্কেটের উপরে একটা গেস্ট হাউজ আছে । ওখানেই উঠেছি। যদিও গতকাল রাতে হীরাদের বাসায়ই ছিলাম।
-সব দেখা শেষ আপনার?
-সব কী দেখা শেষ হয় হায়দার সাহেব? এতো সহজ সব দেখে ফেলা!
-বাহ! ভালো বললেন তো!
ভদ্রলোকের কথায় মায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠে!
-জি আমি ভালোই বলি! আর হ্যাঁ সবাই যা দেখে এখানে আসলে সেসব দেখে ফেলেছি সেই কবে। কিন্তু কেউ যা দেখেনি সেটা দেখার জন্যই আমি বারবার আসি এখানে।
-সেটা কী?
-সেটাতো বলে বুঝানো যাবেনা ভাই! চলেন এবার ওদের কাছে যাই। আপনার বাচ্চারা অনেকক্ষণ আপনাকে ছাড়া আছে !
- জি আর আপনার বাচ্চারা আপনাকে ছাড়া, বলে হেসে ওঠেন হায়দার সাহেব।
-ঝর্নার কাছাকাছি যেতেই ওরা শুনতে পায় ফাহিম গাইছে ‘আমার সারাদেহ খেয়গ মাটি’! অদ্ভুত নীরবতা চারিদিকে। ঝর্নার শব্দ শুধু আর ফাহিমের গান কেমন আচ্ছন্ন করে রেখেছে সব। বাচ্চা দুটোও চুপচাপ উপভোগ করছে প্রকৃতির এই নৈবেদ্য । সবাই অদ্ভুত রকম চুপ। মায়া গায় “ওরে এই না ভুবন ছাড়তে হবে দুদিন আগে পরে................................................। গাইতে গাইতে ও ফাহিমের কাছে চলে আসে। ওর পাশে দাঁড়ায় । ফাহিম এক হাত দিয়ে পেছন দিয়ে মায়ার কাঁধে হাত রাখে। মায়া ফাহিমের কাঁধে মাথা রেখে ঝর্নার দিকে তাকিয়ে থাকে কি সুন্দর ঝর্নার জল সাদা ফেনায় ভর করে নিচে নেমে আসছে অদ্ভুত ছন্দে! আপনাদের একটা ছবি তুলি?
-অবশ্যই বলে মায়া হেসে ফেলে।
ফাহিম শক্ত করে মায়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। হায়দার সাহেব ওনার মোবাইলে ছবি নেন। এবার হীরা চিৎকার করে ওঠে “ওই ফাহিম উনি মা তোর একার আমার না?” বলে দৌড়ে এসে অন্য পাশ থেকে মায়াকে জড়িয়ে ধরে। দুজন মায়ার দুই কাঁধে তাদের থুতনি রেখে পোজ দেয়! হায়দার সাহেব বিপুল বিস্ময় আর আগ্রহে সেই দৃশ্য তার মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দী করেন। তারপর চলে সবাই মিলে ফটোসেশন।
ফটো সেশন শেষ হোলে মায়া পায়ে পায়ে অর্কর কাছে এগিয়ে যায়। একটু দূরে দূরে থাকছে ছেলেটা! তাই খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় মায়া।অর্ক লাফ দিয়ে ওর কোলে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে। মায়া অর্ককে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তীব্র ভালো লাগায় ছেয়ে যায় মায়ার মন। অর্কর শরীরে বান্টির গায়ের গন্ধ। মায়া চুমো খায় অর্ককে। অর্কর সুড়সুড়ি লাগে! ও খিলখিলিয়ে হাসে! মায়া কেঁদে ফেলে। সেই কান্না অর্ক ছাড়া কেউ দেখেনা। অর্ক এবার মায়ার গালে টুক করে চুমো খায়। ওর চোখের জল মুছে দেয়। মায়ার চোখের জলে এবার আর একটা ঝর্ণা বয়ে যায়। অবাক বিস্ময়ে অর্ক মায়াকে দেখে। অর্ককে জড়িয়ে থাকতে থাকতে সময় বয়ে যায়। ভর সন্ধ্যা। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। উঁকি দেয় চাঁদ, ঝকঝকে তকতকে চাঁদ। ফেরার পালা। হঠাৎ মায়া শুনতে পায় কেউ কানের কাছে ফিসফিস করছে ‘আপনি আসলেই একটা মায়া’।
কাহিনীর সাথে নামটি যথার্থ হয়েছে।
Replyসেলিম সালেহা
মনোহরদি
পড়লাম খুব ভাল লেগেছে দৃশ্যগুলো, দারুন গল্প প্রতিটি গল্প এই মেইল পাঠাবার অনুরোধ থাকল
ReplyEi golpota khub sundor
Reply