ছোট্ট একটা রুম। একটা মেয়ে গভীর আগ্রহে রং তুলিতে করে রঙ নিয়ে কাগজে আঁকিবুকি টানছে। তারপর সেগুলোকে স্ক্যান করে কম্পিউটারে নিয়ে ফটোশপে কাজ করে প্রিন্ট করে দেখছে কেমন হলো বইয়ের কাভারটা। কারন সামনে বইমেলা, প্রচুর চাপ প্রকাশকদের, লেখকদের। দ্রুত হাতে তাকে বইয়ের কাভার ডিজাইন করতে হচ্ছে। তার কাজের শেষ নেই। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি তাকে মাথার ঘাম ঝরিয়ে কাজ করে যেতে হচ্ছে। যার কথা বলা হচ্ছে সে বর্তমান প্রজন্মের একজন বুক কাভার ডিজাইনার নাহিদা নিশা। বাংলাদেশে যেক’জন হাতে গোনা নারী বুক কাভার ডিজাইনার রয়েছেন তাদের মধ্যে একজন এই নিশা। বয়সে কম হলেও তার অভিজ্ঞতা অনেক। ইতিমধ্যে তার কাজের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হয়েছে অসংখ্য বইয়ের কাভারে। বেশীরভাগ বইয়ের কাভার যদিও শিশুতোষ, তারপরও তিনি এরইমধ্যে নানা উপন্যাসের কাভারও করেছেন। তার প্রতিটি কাভার দৃষ্টিনন্দিত, বহুরঙা ও শৈল্পিক মানোতীর্ন। নিশা বলেন তিনি শিশুতোষ বইয়ের কাভার করতেই বেশী সাচ্ছন্দ বোধ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ২০০৭-৮ বর্ষের ছাত্রী নাহিদা নিশার পুরো নাম নাহিদা আক্তার নিশা। গ্রামের বাড়ি খুলনা। এখানেই বেড়ে ওঠা এবং বিভাগীয় শহরের চেনাজানা ছিল সব কিছুই। ইন্টারমিডিয়েটের গন্ডি পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ উঠলো, নিশার প্রথম পছন্দই ছিল চারুকলা। আর তার বাবার পছন্দ ছিল নাট্যকলা। নিশা তখনও জানতেন না যে ঢাকার চারুকলা অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত। তিনি ভাবতেন চারুকলা অন্য একটি সতন্ত্র একাডেমি।
এই ধারনাকে সঙ্গী করেই ঢাকা এলেন নিশা। উঠলেন ফার্মগেটে। এরপর চারুকলার শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত কর্মশালায় অংশগ্রহন করলেন। পরীক্ষা দিলেন কিন্তু তার ধারনা ছিল টিকবেন না। তাই তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবারও ভর্তি পরীক্ষায় বসলেন। সেখানে টিকেও গেলেন। ক্লাস শুরু হয়ে গেল। কিন্তু বাবা যখন জানলেন যে নিশা ঢাকায় ভর্তি না হয়ে চট্টগ্রামে ভর্তি হয়েছে তখন কড়া ভাষায় তিনি ধমকালেন মেয়েকে। জানিয়ে দিলেন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হও নাহয় খুলনা চলে এস। তোমার পড়াশোনা করে কাজ নেই।
বইমেলার কিছু বই এর কাভার |
কিন্তু একগুঁয়ে নিশার খুব ইচ্ছে শিল্পী হবার। হঠাৎ একদিন ভাগ্যটা যেন খুলে গেল। নিশা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছেন এমনি সময় ফোন এলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জানানো হলো তিনি টিকে গেছেন। নিশা বিশ্বাস করলেন না যে আসলেই তিনি চারুকলা অনুষদে টিকে গেছেন যা তার চিরকালের স্বপ্ন হয়ে রয়েছে। তার মনে হলো কেউ তার সাথে দুষ্টুমি করেছে। অনেকেই বললো এটা হতে পারেনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এতোদিন পর ফোন করেছে মানেই হলো কোন প্রতারক এই ধরনের ফাঁদ পেতেছে। তারপর স্বপ্ন বলে কথা, নিশা সেই রাতেই এক কাপড়ে একটা ব্যাগ সম্বল করে চট্টগ্রাম ছাড়লেন। ঢাকা এলেন। চারুকলা অনুষদে গিয়ে জানলেন সত্যি সত্যি তিনি টিকে গেছেন সেখানে। তারপর তো কল্পনা সত্যি হবার গল্পই শুধু।
নিশা বললেন,‘আমি ভাবতাম চারুকলা বা ফাইন আর্টস মানে কেবল জল রঙ নিয়ে কারবার। পরে দেখলাম সেখানে স্কাল্পচার সহ আরও অনেক বিভাগ রয়েছে।’ তবে যেহেতু তিনি সবসময় খুব কোমল মনের মানুষ তার কাছে রঙতুলি নিয়ে কাজ করাই শ্রেয় বলে মনে হতো।
তাই ওরিয়েন্টাল আর্ট বিভাগেই ভর্তি হলেন। সেখান থেকেই মাস্টার্স করলেন। মাস্টার্স পাসের পর তিনি পরিচয়ের সূত্র ধরে বিয়ে করলেন একজন শিল্পীকেই। সংসার জীবনে নিশা খুব একটা সময় দিতে পারেন না। কারন তার কাজই হলো বইয়ের কাভার নিয়ে। চারুকলায় পড়ার সময় চিন্তা করেছিলেন তিনি এমন কিছুর সাথে সম্পৃক্ত থাকবেন যেখানে সবসময় ছবি আঁকাতেই থাকতে পারেন। বইমেলাতে গিয়ে যখন বইয়ের কাভারগুলো দেখতেন, মনের ভেতর গুনগুনিয়ে উঠতো-কেমন হতো যদি আমি এই কাভারগুলো বানাতাম! সেই স্বপ্ন থেকেই এগিয়ে চলা। এ পর্যন্ত অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন নিশা ও ইলাস্ট্রেশন করেছেন।এগুলোর মধ্যে রয়েছে Room to read Bangladesh এর প্রকাশনায় ৬টি বই। কলা ছবি আঁকে, ময়ুর ও মূশিক, মুক্তার মালা, বানর ও পঙ্গপাল, বড় হই এবং সাজিয়ে তুলি উল্লেখযোগ্য। বাবুই প্রকাশনীর বুদ্ধিমান মোরগ ও বোকা কাকের গল্প। পুঁথিনিলয় প্রকাশনী থেকে বুলবুল চৌধুরীর সম্পাদনায় বাঙালীর রূপকথা। ছায়াবীথি প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে পর্বতাভিযানে ‘শ্বাসরুদ্ধকর পনেরো ঘন্টা,’ তুহিন রহমানের ‘মেঘ অরণ্য,’ মাহফুজা গোলন্দাজের ‘আকাশ নীলে ছড়ার ঘুড়ি,’ সাজ্জাদ ইমরানুল ইসলাম প্রধানের ‘ভূতের পিঠে মুক্তোর হাড়ি’, শাহরিয়ার সোহাগের ‘লং জার্নি,’ আশিকুর রহমান বিশ্বাসের ‘জোড়া কাক,’ ইফতেখার হালিমের ‘প্রিয় নেতা জাতীর পিতা,’ আলমগীর কবিরের লেখা ‘অনুভবে বঙ্গবন্ধু’, ‘আলোর দিশারী’ সহ আরও বহু বই যেগুলো তার নিজেরই কালেকশনে নেই। নিশা নবাগতদের ভেতর অনেক প্রচ্ছদ শিল্পীর চেয়ে এগিয়ে আছেন। প্রচ্ছদ শিল্পী হিসাবেই
তিনি নিজেকে এগিয়ে
পাতা যখন তাকে কাভারের মডেল হবার প্রস্তাব দিল তখন তিনি ম্রিয়মান হেসে বললেন এতো বড়ো বড়ো শিল্পী থাকতে আমি কেন?
সম্পাদকের আত্মভোলা উত্তরঃ আপনি তো তাদের ছাড়িয়ে গেছেন। তারচেয়েও বড়ো যুক্তি দিনের আলোতেই রঙধনু ওঠে, যদিও রঙধনু উজ্জ্বলতার দিক
থেকে তাদের ছাড়িয়ে যায়না, তবে তার বাহারী রঙ ও বৈশিষ্ঠ্য তাকে আলাদা করে রাখে। আপনার প্রত্যেকটি প্রচ্ছদের যে ডিজাইন বা নকশা এবং যে বৈশিষ্ঠ্য সেটা অন্যদের থেকে আপনাকে আলাদা করেছে। অন্তত আপনার বয়সের তুলনায় আপনি অনেকটা এগিয়ে আছেন।
নিশা বলেন, আমি যা কিছু করেছি তা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্যই করেছি। আর পড়াশোনা চলাকালেও আমি কখনও বসে থাকিনি। কোথাও না কোথাও চাকরি করেছি। আজিজ সুপার মার্কেটে একটা শপের ডিজাইনার হিসাবেও কাজ করেছি। প্ল্যান বাংলাদেশের একটা প্রোজেক্টে আমি আর্টের ট্রেনার ছিলাম। মূলত আমি একজন চিলড্রেন বুক ইলাস্ট্রেটর। আমার বাবা ও ভাই দু’জনেই নাট্যকর্মী এবং খুলনায় বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত। পারিবারিকভাবে আমি এসব ব্যপারে অনেক অনুপ্রেরনা পেয়েছি যার জন্য আজ আমি এখানে আসতে পেরেছি।
ছবি আঁকায় নিমগ্ন নিশা |
‘আঁকিয়ে খুঁজছি’ নামে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখে প্রথম আমি একটি ওয়ার্কশপে যাই এবং সেই ওয়ার্কশপে ট্রেনিং নিয়ে আমি বুঝলাম যে আসলে বইয়ের কাভার আমরা যেমনভাবে চিন্তা করি মোটেও তেমন নয়। একটা বইয়ের কাভার যে একটা শিল্প হতে পারে সেটা তাদের ওয়ার্কশপেই প্রথম জানলাম। একটা বইয়ের কাভার কেমন হবে। ভেতরের ইলাস্ট্রেশন এর মাপ কেমন হবে। এসবই আমার কাছে একেবারে নতুন তখনও। তাদের ট্রেনিংটা পেয়ে আমার অনেক উপকার হয়েছিল।
তারপর দেখলাম আমাকে ডিজিটাল মাধ্যমগুলো জানতেই হচ্ছে। বর্তমানে একজন আর্টিস্ট কেবল রঙতুলি নিয়ে কাজ করেনা তাকে কম্পিউটারেও কাজ করতে হয়। সেখানেও তাকে অনেক কিছু জানতে হয়। সেই চিন্তা থেকে
পরিবারের সাথে নিশা |
নিশা বর্তমানে দুরন্ত টিভিতে একজন ফ্রিল্যান্সার ভয়েজ আর্টিস্ট হিসাবে
আছেন। এর পাশাপাশি করছেন থিয়েটার।
মূলতঃ তিনি চান নিজেকে একজন
বুক ইলাস্ট্রেটর হিসাবে দেখতে। তাছাড়া বড়
নিশার আঁকা একটি ছবি |
বর্তমানে তাড়ুয়া নামে একটি নাট্যদলের সাথে আছেন তিনি।
সুন্দর একজন আর্টিস্ট
Replyঅমিতাভ কর