আজ আমাদের বন্ধুত্বের দশ বছর পূর্ণ হলো। এই বন্ধুত্বের খবর জানেনা একমাত্র তাহসান। পুরো নাম তাহসান আর কিবরিয়া। ঘরে আমি কিবরিয়া নামে ডাকলেও বাইরে সবার কাছে ও তাহসান নামেই পরিচিত। দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে পিকনিকের আয়োজন করা হয় আমার বসবাসের পাশেই।
একমাত্র আমার জন্যেই ওরা দূরে কোথাও যাওয়ার সাহস পায়নি। শায়ন্তি লিয়ন আর শান্তা সাথেই ছিলো। শান্তা গত সাত বছর যাবত আছে আমার কাছে। এখন বয়স প্রায় সতেরো।
একমাত্র আমার জন্যেই ওরা দূরে কোথাও যাওয়ার সাহস পায়নি। শায়ন্তি লিয়ন আর শান্তা সাথেই ছিলো। শান্তা গত সাত বছর যাবত আছে আমার কাছে। এখন বয়স প্রায় সতেরো।
সকালে বের হবার সময় তাহসানের কথা,-- কি ব্যাপার তিনজনে কই যাওয়া হচ্ছে এত্ত সেজেগুজে?
-- কই আর যাব, কথায় আছে মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। আমাদের দৌড় দুইজনের আঠারো কুঁড়ি বান্ধবী ছাড়া আর কই হবে।
আমার মুখে কথাটা শুনে তাহসান খিলখিলিয়ে হেসে উঠে,-- আঠারো কুঁড়ি বান্ধবী যাদের তারা আরো ঘুরার জায়গা চায়। হে মাবুদ আমায় রক্ষা কর।
-- রক্ষে তোমার পুরাই হবে আজ। তোমায় ভাড়া দিতে হবে না, কাছেই যাচ্ছি, মৌমিতাদের বাসায়।
-- খালি হাতে যেও না।
-- আরে না, তা কি আর যাওয়া যায়। কালকে টিসিবির ট্রাক থেকে দুইকেজি পেঁয়াজ এনেছি, ভাবছি এককেজি নিয়ে যাব। তাহসান আর কথা বাড়ায়নি। দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে যায়। মনে করে ওকে এক ঝোপা চাবিও দিয়ে দিই। বলা যায় না কে কার আগে বাসায় ফিরে।
ও চলে যাবার পায় মিনিট সতেরো পরে আমরা বের হই। সিএনজিতে জায়গা হবে না বলে উবার কল করে লিয়ন। অল্প জ্যাম হলে ও আমরা ঠিক সময়ে পৌছাই।
বিকেল পাঁচটা। এখান থেকে বাসায় যেতে আমাদের মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট সময় লাগার কথা। কারণ আমরা মৌমিতাদের বাসায় যাইনি, গিয়েছি আমার বন্ধুদের সাথে পিকনিকে। অনেক খাবার বেঁচে গেছে আমাদের। সব্বাই ভাগ করে নিয়েছে। আমাকে অনেকটু বেশি দিয়েছে কারণ তাহসান যায়নি। একটা উবার ডেকে রওয়ানা দিই, রাস্তায় যে জ্যাম পড়েছে। পঁয়ত্রিশ মিনিটের রাস্তা পুরো পৌনে দুইঘন্টা। ইচ্ছে করেছিল নেমে হাঁটা দিই। কিন্তু উঁচু সেন্ডেল পায়ে হাঁটা অনেক সমস্যা। তার উপর খাবার নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। শান্তার চিন্তা খাবারগুলো যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে ও খুব কষ্ট পাবে। তাই বারবার জিজ্ঞেস করে,-- খালাগো বাসা আইতে আর কদদুর বাকি।
-- জায়গা তো অল্পই বাকি, কিন্তু গাড়ি তো চলে না।
খাবার নষ্ট হলে কষ্ট আমিও পাবো, খাবারের জন্যেই পৃথিবীতে কত্ত সমস্যা। খেতে বসে কয়েকজন অর্ধেক খেয়েই প্যাকেট রেখে দেয়। দেখে খুব খারাপ লাগলো, এই খাবার চোখের সামনেই নষ্ট হবে? খুব সুন্দর করে খাবারগুলো প্যাকেট করে সাথে নিয়ে নিই। পথে তিনজনকে খেতে দিই। দিতে পেরেই শান্তি লাগলো।
-- আম্মু বাবাকে কলদিয়ে জেনে নাও বাবা কি বাসায়। লিয়নের কথা।
-- ঠিক বলেছিস বাবা।
কল দিতে যাব অমনিই তাহসানের কল। ইসস চারপাশে যে হারে গাড়ির হর্ণ, তাহসান শুনলেই বুঝবে আমরা দুরে কোথাও এসেছি। কিন্তু কল না ধরেও উপায় নেই। একবার দিলে না ধরলে ও বারবার কল দিতে থাকবে।
কল ধরতেই জিজ্ঞেস করে, -- তোমরা কই? আমি ডাক্তারের কাছে যাব।
-- এইতো বাসার কাছে, তুমি কোথায়?
-- বাসায়।
-- ওকে।
খাবার নিয়ে বাসায় উঠা যাবে না, হাতে খাবারের ব্যাগ দেখলেই নানান প্রশ্ন করবে। বুদ্ধি মাথায় সাথে সাথে। আসলে মানুষ যতটা পরিস্থিতির শিকার হবে তত বুদ্ধিমান হবে। গাড়ি থেকে নেমে পাশের বাসার চৈতিদের বাসায় খাবারের ব্যাগ রেখে বাসায় উঠি। কলিংবেল দিতেই তাহসান দরজা খুলে দেয়। বাইরের সেন্ডেল পরেই বসা সে। বুঝলাম দ্রুত বের হবে। ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করি,
-- চা খাবে?
-- দ্রুত দাও, খেয়েই বের হই।
দ্রুত চা আর এক পিস কেক দিই। তাহসান খেয়েই বেরিয়ে পড়ে। এই ফাঁকেই খাবারগুলো নিয়ে আসি। খুলে দেখি নষ্ট হয়নি। সাথে সাথে ফ্রিজে রেখে দিই।
-- মা রাতে কিন্তু আমি পুরো একটা প্যাকেট খাবো। শায়ন্তির আবদার।
-- ঠিক আছে তাই হবে মা। সাথে সাথেই হারিয়ে যাই সেই ছাব্বিশ বছর আগের স্মৃতিতে। তখন আমি রাজধানীর নামকরা কলেজের শিক্ষার্থী। সবে মাত্রই আমরা কলেজে প্রবেশ করি। উড়ো উড়ো মন, সেই বছর আমাদের কলেজের রজতজয়ন্তী পালিত হয়। কলেজে নতুন আগমন আমার, স্কুল জীবনে মায়ের কড়া শাসনে ছিলাম। কলেজে ঢুকেই যেন উড়তে শুরু করি, অবশ্য ততটাই উড়তে শিখেছি পাখার মাথা কাটা থাকলে যতটা উড়তে পারা যায়। রজতজয়ন্তীতে পুরো দুইদিনের অনুষ্ঠান আমাদের। প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থীকে ভলিন্টিয়ার নির্বাচন করে। যাদের অনেক দায়িত্ব প্রোগ্রামের। আমিও সেই অর্ধশতজনের একজন ছিলাম। প্রথম দিন হলুদ শাড়ি পড়া, দ্বিতীয় দিন লাল শাড়ি।
আমি লাইজু আপা আর আপার বান্ধবী সহ আমরা তিনজন একটা রুম ভাড়া করে থাকতাম কলেজের পাশেই। দুই আপাও একই কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। দুইদিন আমাদের দুপুরের খাবার আর বিকেলের নাস্তার আয়োজন ছিল অনুষ্ঠানে। প্রথমদিন দুপুরের সময় ঘোষণা দেয় ভলিন্টিয়ার কর্মীরা ডাবল প্যাকেট পাবে। সেভাবে আমি আমার খাবারের কুপন দিয়ে দুই প্যাকেট খাবার নিই। তখন আমাদের কুপনে একটা চিহ্ন দেয়া হয় যাতে বুঝা যায় এটা ভলিন্টিয়ার কুপন। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো লাইজু আপা আর হেনা আপাকে গিয়ে বলি,-- আফা তোমাদের কুফন গুলা দে। আঁই খাবার লই আই।
ওদের কুপন দিয়েও আমি দুই প্যাকেট করে খাবার নিই, সাথে সাথে কুপনে সেই চিহ্ন দিয়ে নিয়ে আসি। আমাদের তিনজনের তিন কার্ডে ছয় প্যাকেট খাবার পেলাম। তিন প্যাকেট কলেজে খেলাম বাকি তিন প্যাকেট বাসায় এনে সন্ধ্যার পরপরেই খেতে বসি। তখন তো আর ফ্রিজ ছিল না যে ফ্রিজে রেখে পরে খাব। নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়েই সন্ধ্যায় দ্রুত খেয়ে ফেলি।
পরের দিন ছোট ভাই ইকবাল আসে আমাদের বাসায়। ওকে সাথে করেই নিয়ে যাই কলেজে। যথারীতি পরের দিন আমি লাল শাড়ি পরে কলেজে যাই। অনেক দায়িত্ব আমাদের উপর, দুপুরের খাবারের সময় আপাদের কুপন নিয়ে আমিই খাবার নিয়ে আসি। মোট ছয় প্যাকেট খাবার হয় আমাদের। ইকবাল সহ আমরা চারজনে চার প্যাকেট খাবার খেয়ে নিই। বাকি দুই প্যাকেট রেখে দিই বাসায় নিয়ে খাওয়ার জন্যে। দায়িত্ব পালনে এদিক ওদিক সব দিক ছুটতে হয় আমাদেরকে। মাঠের মাঝখান দিয়ে যেতেই একটা কুপন পড়ে থাকতে দেখি। তুলে নিয়ে দেখি এটা কোন এক ভলিন্টিয়ারের কুপন। যেখানে আলাদা চিহ্ন দেয়া আছে। কুপন হাতে নিয়ে অন্য বুথ থেকে আরো দুইটা খাবারের প্যাকেট নিই। প্যাকেট দুইটা নিয়ে আপাদের কাছে আসি। আপা বলে,-- তোকে এত মাস্তি মাস্তি মনে হয় কেন?
খাবারের প্যাকেটের দিকে ওরা তো হা করে তাকিয়ে আছে। লাইজু আপা বলেই বসে,-- কিরে তুই আবার দুই ফ্যাকেট লই আইচচ কোত্তুন।
-- হ আফা, মাডের মাইজগানে একটা কুফন হাইছি। হেই কুফন দিয়ে লই আইছি।
সবাই খুব খুশি হয়ে যাই, আমাদের চার প্যাকেট হল। রাতে আর রান্না করতে হবে না। বিকেলে আমরা বাসায় ফিরি। আজ আর আমরা রান্না করছিনা। পাশের রুমের হায়দার ভাই ভাবি এসে জিজ্ঞেস করে,
-- আজ কি রান্না করবে না তোমরা।
-- না বাভি, দুপুরে আমরা ব্যাকে এত্ত এত্ত খাইছি আর খিদা নাই।
আমাদের সবার চিন্তা কখন খাব, দ্রুত খাওয়াই উত্তম। নইলে নষ্ট হয়ে যাবে এত্ত স্বাদের খাবার। সন্ধ্যার পর পরেই আমরা দরজা বন্ধ করে খেতে বসি। খুবই আনন্দ আমাদের মনে। খাওয়া যেই অর্ধেক হল অমনি হায়দার ভাই এসে দরজায় নক করে। বাধ্য হয়ে দরজা খুলি। ভাই ভাবি এসে দেখেন আমরা চারজনের সামনে চারটা প্যাকেট। সেই কি অবস্থা আমাদের তখন, হায়দার ভাইতো ধরেছেই আমাদের। প্যাকেট কোথায় পেলাম। পুরা ঘটনা শুনে বললেন,-- এমন আনন্দ কিন্তু সব্বাই করতে পারেনা।কলিংবেল এর শব্দে কল্পনা থেকে বাস্তবে আসি।
দরজা খুলে দেখি তাহসান এসেছে। শায়ন্তিকে এক প্যাকেট খাবার গরম করে দিই। পুরো ঘরে কাচ্চি বিরিয়ানির সুগন্ধি, আমার ডাক পড়ে ড্রয়িংরুমে।
-- সুন্দর সুগন্ধি বাসায়, কি রান্না হচ্ছে আজ।
-- সে খেতে গেলেই দেখবে।
-- তাহলে খাবার দাও, নাকে সুগন্ধি যা এসেছে এখুনি খেতে হবে।
প্লেট সাজিয়ে নিয়ে আসি, খাবারের দিকে তাকিয়ে বলে,-- এ খাবার কোথা থেকে।
-- দোকানে কি খাবারের অভাব আছে।
তাহসান কথা আর বাড়ায়নি। কথা বাড়লে যদি আবার খাবারের দাম দিতে হয়। তাহসান খাচ্ছে আর কোথায় যেন হারাচ্ছে। দুর থেকে তাকিয়ে দেখছি আমি। তাহসান ভাবনা খাবার গুলো আসলো কই থেকে, মৌমিতাদের বাসা থেকে কি খাবার দেয়ার কথা। ওরা দুপুরে খেয়েও এলো আবার নিয়েও। নাকি ওরা আজ অন্য কোথাও গিয়েছে, আর গেলেও কোথায় সেটা। তাও আবার সব্বাই গেলো, শান্তাকেও নিয়ে গেলো। কাউকেই জিজ্ঞেস করা যাবে না। নীলাঞ্জনা ওদের যা শিখিয়ে দিয়েছে ওরা তাই বলবে। জানি তাহসানের মনে এমন অনেক প্রশ্নই জন্ম হচ্ছে, যতই হোক কিছুই বলবে না আজ। কারণ বললেই টাকার কথা উঠে আসবে। তার চেয়ে চুপে চুপে খাওয়াই উত্তম।সবাই রাতের খাবার শেষ করলাম। আবার মন চলে যায় সেই ছাব্বিশ বছর আগের দিনগুলোতে। এই শহরে এসেছি সেই ছাব্বিশ বছর আগে। তখন কথা বলতেই সবাই বুঝে যেতো আমি কোন জেলার, কিন্তু এখন কেউ বোঝেনা। পিকনিকে বসে সবার সাথে গল্প করছিলাম, সাহেদ ভাই এসেই হাসি মুখে কথা বলেন,-- আন্নে বালা আছেন নি।
-- আঁই তো বালা আছি, আন্নে আছেন তো বালা।
-- আন্নেগো লগে আইছি বালা না থাই কি হারি।
আঞ্চলিক ভাষায় অনেকক্ষন মজা হলো। সেদিন মাস্তি করার বয়স ছিল বলেই কলেজ মাঠের মাঝে অন্যের কুপন পেয়ে তা দিয়ে নিজেই ডাবল খাবার ঘরে নিয়ে আসি। আর মজা করে খাই। অথচ এখন একটু খাবার বেশি হলে নষ্ট না করে একজন ক্ষুদার্থ মানুষের মুখে তুলে দিই। সেদিন যার কুপন আমি খুঁজে পেয়েছিলাম সে তো সেদিন না খেয়েই ছিল। চেষ্টা করলে আমি যার কুপন তাকে খুঁজে ঠিক ফেরত দিতে পারতাম। বুঝতে পারি ছাব্বিশ বছরে শুধু আমার বাহ্যিক দিকের পরিবর্তন হয়নি, ভেতরের আমারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
খাবারের গল্প মনে হল। নামটি কুপন ক্যান?
Replyবিষয়বস্তু জটিল কেবল লুকোচুরির ভেতর দিয়াই গেলেন কিন্তু স্বামীকে জানালে কি হতো। যদি কোন ঘটনা ঘটে যাইত তখন আপনার স্বামী জানতোনা যে আপনি কোথায়। আর এমন করবেন না :)
Replyভাল লাগছে তবে শেষটা বুঝিনাই
Reply