আতংক বার্তা................শ্রীলা পান্ডা

ময়ে অসময়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুক করা রোহিনীর একটা নেশা। বাকি সবকিছু ছাড়তে ছাড়তে আজ নিজের সব ভালো লাগাই হারিয়ে গেছে।
অন্যদিন গুলোর মতন আজ ও রাত্রে তাই করছিল। ওর কাজ হচ্ছে news feed scroll করতে করতে কিছু কিছু জিনিস পড়া। আজও তাই করতে করতে একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল। page টাকে না খুলে পারলনা। page টা একটা website নিয়ে লেখা। খবরটা বলছে ওই website টি একটি মেয়ের নামে। কেউ যদি মাঝরাতে ওখানে online হয় তাহলে ওই মেয়েটি আসবে আর যে online হয়েছে তার জীবনের সবচাইতে যে ক্ষতি করেছে তার নাম জানতে চাইবে । তারপর মেয়েটি ওর হয়ে প্রতিশোধ নেবে। তবে এর বিনিময়ে ওকেও কিছু দিতে হবে। রোহিনী ঠিক করলো ও যাবে ওই page এ। তখন প্রায় মাঝরাত ই। ও webpage টা খুলে নিজের details দিল। কিন্তু কোন উত্তর এলনা। ও অনেকক্ষন অপেক্ষা করল। তারপর বিরক্ত হয়ে ফোন বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। এর ঠিক দুদিন পরে রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল রোহিনীর। অনেকক্ষণ ছটফট করেও ঘুম আসলোনা দেখে ও ফোনটা খুললো। টুক করে একটা message ঢুকলো। Message টা খুলতেই ওর পিঠ দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সেই মেয়েটি ওকে message করেছে। নাম জানতে চাইছে যে ওর ক্ষতি করেছে। রোহিনীর এখন ভয় করতে শুরু করেছে কারণ মেয়েটি খুব ভয়ঙ্কর দেখতে। ও ভয় পেয়ে ফোন বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।
অনেক্ষন ছটফট করতে করতে কখন যেন ঘুম এসে গেছিল। কিন্তু ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে। ও দেখল মেয়েটি ওকে তাড়া করছে হাতে একটা ছোরা নিয়ে। ঘুমটা ভেঙ্গে যেতে খুব ভয় করতে লাগল রোহিনীর। ও আবার ও ফোন খুলে website এ গেল আর তার নাম টা দিয়ে দিল যে ওর সবচাইতে বেশী ক্ষতি করেছে। এটা করেই ও ফোন বন্ধ করে দিল‌। সারারাত আর ঘুম হলনা।অজানা আতঙ্কে এককোনে বসে কাটিয়ে দিল। সকাল হয়ে গেলেও ভয়ে রোহিনী নড়তে পারছে না। হঠাৎ landline ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। কে জানে কেন মনটা কূ ডাক ডাকল। আসতে আসতে গিয়ে ভয়ে ভয়ে ফোনটা তুলতেই শুনল সুমনার গলা। প্রথমে অনেকক্ষণ ধরে বুঝতেই পারলনা যে সুমনা কি বলছে। তারপর একটু ধাতস্থ হতে বুঝল ও জিজ্ঞেস করছে ওর মোবাইল বন্ধ কেন? ওর তখন মনে পরলো যে রাতে ও ভয়ে ফোন বন্ধ করে দিয়েছিল। সুমনাকে ফোনের charge শেষ বলে এদিক ওদিক কথা বলে কাটিয়ে দিল। তারপর এসে নিজের ফোনটা on করল। একটা message ঢুকল টুং করে। Message টা খুলে পরতেই ফোনটা ভয়ে হাত থেকে পরে গেল রোহিনীর। Message এ লেখা "তোমার শত্রু শেষ,এবার আমার পারিশ্রমিক আমাকে দাও।তুমি যাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসো তাকে আজ রাতে আমাকে আহুতি দাও"।

( ২ )

মেয়েটির নাম মার্থা। মেয়েটি যখন জন্মে ছিল তখন নাকি একজন ওকে দেখে বলেছিলেন ওকে মেরে ফেলতে।স্বয়ং শয়তান নাকি জন্ম নিয়েছে।কিন্তু মায়ের মন। চার সন্তান মৃত জন্মানোর পর এই মেয়ে জন্মাল। তাকে কি করে প্রাণে ধরে শেষ করবেন। তাই মেয়েকে নিয়ে অনেক দূরে এক কেল্লায় আশ্রয় নিলেন লোকালয়ের থেকে দূরে। সময়ের থেকে একটু যেন অস্বাভাবিক ভাবেই মার্থা বেড়ে উঠছিল। আর অদ্ভুত ব‍্যাপার মেয়ে জন্ম থেকে কোনদিনই কাঁদে ও নি আর হাসেওনি। অদ্ভুত ঠান্ডা। তার থেকেও বেশী ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে মায়ের ও বুক কেঁপে উঠত অজানা আশঙ্কায়। এভাবেই বছর পাঁচ বয়সের হয়ে গেল মার্থা। একদিন মায়ের ফিরতে একটু দেরি হচ্ছে।মার্থার অনেকক্ষণ থেকে খুব ক্ষিদে পেয়েছে। খুঁজে দেখেছে ঘরে কোন খাবার নেই। তাই বাগানে এসে বসে আছে। হঠাৎ একটা শব্দে মুখ তুলে দেখে একটা পাখি ডালে বসে আছে। মার্থা একদৃষ্টিতে পাখিটাকে দেখতে থাকল। হঠাৎ পাখিটা ধপ করে মাটিতে পরে গেল। মার্থার মুখে প্রথমবার হাসি ফুটল। উঠে পাখিটাকে তুলে মুখে পুরে দিল। গোটা মুখের ভেতর রক্ত ভরে উঠল আর মার্থার মন খুশিতে। মা ফিরে এসে দেখছে সব অন্ধকার। একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে মা মার্থাকে খুঁজতে খুঁজতে উপরে উঠে এলেন। মার্থার ঘরে এসে দেখেন ও জানালার দিকে ফিরে বসে আছে। দুবার নাম ধরে ডেকেও সারা না পেয়ে এগিয়ে গিয়ে ওর পিঠে হাত দিলেন। আস্তে আস্তে মার্থা ঘুরে বসল। পুরো মুখে রক্তের দাগ আর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। মেয়ের মুখ দেখে মায়ের হাত থেকে লন্ঠন পড়ে সব অন্ধকার হয়ে গেল।

( ৩ )

রোহিনীর মাথায় আর কিছু আসছে না। একটা নিছক কৌতূহলের এতবড় দাম দিতে হবে!ও ভাবতে পারেনি। এখন কি করবে ও। হাতে আর সময় ও নেই।আজ রাতেই .....না আর ও ভাবতে পারছেনা।কতক্ষণ এভাবে কেটেছে কে জানে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠতে ধড়ফড় করে উঠেছে ।দোমোনা করতে করতে এগিয়ে যায় ফোনের দিকে। আবার সুমনা।কি চায় এই মেয়েটা । বারবার ফোন করছে কেন আজ।রোহিনী ওকে এড়িয়ে যাবার জন্যে বলে "আজ busy আছি, পরে কথা বলবো।"ওকে অবাক করে দিয়ে সুমনা বলে"দরজা খোল,আমি তোর বাড়ির দরজায়"। মাথা গরম হয়ে গেল রোহিনীর। আজ ওর জীবন মরণ সমস‍্যা আর এই মেয়ে সকাল থেকে পেছনে পড়ে আছে।
কিছু কটু কথা বলবে বলে দরজা খুলতেই সুমনা ওকে জড়িয়ে ধরে। রোহিনীর হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে যায়।সুমনাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। সুমনা কিছু বুঝতে না পেরেও চুপচাপ রোহিনীকে জড়িয়ে ওকে কাঁদতে দেয়। কিছুক্ষণ পরে রোহিনী নিজেকে সামলে নিয়ে সুমনাকে জিজ্ঞেস করে ও কেন এসেছে। সুমনা বলে " আমি কাল রাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছিরে তোকে নিয়ে তাই তোকে সকালে ফোন করলাম। ফোনে তোর গলা শুনেই বুঝলাম তোর কিছু হয়েছে। তাই চলে এলাম রে। তোর কি হয়েছে রে?"রোহিনী কিছুক্ষণ ইতস্তত করতে করতে সব বলতে শুরু করল সুমনাকে । সুমনা সব শুনে সাংঘাতিক ভয় পেয়ে বল্লো"এ তুই কি করলি? এখন এর থেকে মুক্তির উপায় কি?" রোহিনী বলছে "জানিনারে এর থেকে মুক্তির উপায় কি? বোধহয় আজ রাতই আমার জীবনের শেষ রাত। আমার মাথায় কিছুই আর আসছে না।" সুমনা বল্লো "মাথা ঠান্ডা রাখ। একটা কিছু উপায় বেরবেই।"সুমনা ওর মামাকে ফোন করলো। উনি একসময় প্রেতচর্চা করতেন। উনি সব শুনেই বললেন "মেয়েটির নাম মার্থা।"

( ৪ )

নিজের মায়ের শরীরটা খেতে এত উপাদেয় হবে মার্থা সেটা আগে বুঝতে পারেনি। অনেক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে সেটাকে খেল। তারপর লম্বা একটা ঘুম। পরদিন ঘুম ভাঙ্গতেই খুব ক্ষিদে পেয়ে গেল। কিন্তু কোন খাবার নেই আর।অগত‍্যা দূর্গ থেকে মার্থা বেড়িয়ে পড়ল। মায়ের কাছে শুনেছিল নদীর ওই দিকে একটা গ্রাম আছে। তারমানে ওখানে মানুষ ও আছে। মানুষ আছে এটা ভাবতেই একটা হাসি খেলে গেল মুখে। শুরু হল মার্থার জীবনের দ্বিতীয় অধ‍্যায়।একটু বিকেলের দিকে গ্রামের দিকে গিয়ে লুকিয়ে থাকত। একা কাউকে পেলেই নিজের ক্ষুধা মেটাত। আস্তে আস্তে গ্রামে একটা চাঞ্চল্য পড়ে গেল। হঠাৎ হঠাৎ কিছু মানুষ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের প্রধান পুরোহিতের কাছে সবাই এর কারণ জানতে চাইল। উনি গণনা করে বল্লেন গ্রামের উপর একজন শয়তানের নজর পড়েছে। তারপর উনি মার্থার কথা বল্লেন। সব শুনে গ্রামের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল।কিভাবে এর হাত থেকে বাঁচবে সেটাই তারা ভাবতে থাকল। প্রধান পুরোহিত বল্লেন "একটা ফাঁদ পাততে হবে। একজনকে একা নদীর দিকে পাঠাতে হবে।বাকিরা একটু আড়ালে থেকে ওকে ধরতে হবে।"সেইমত পরদিন একটি ছেলে সন্ধ্যের দিকে নদীর দিকে চললো।বাকিরা পিছনে আড়ালে রইল। ছেলেটিকে একা বসে থাকতে দেখে মার্থা বেড়িয়ে এল আড়াল থেকে। ব‍্যাস মার্থাকে দেখেই সব গ্রামের লোক তেড়ে এল। সবাই মিলে ওকে ধরে একটা গাছের সাথে বেঁধে আগুন লাগিয়ে দিল। জীবন্ত দগ্ধ হতে হতে মার্থা বলতে থাকল "আমি আবারও ফিরে আসব"।
মামার মুখে মার্থার কথা শুনতে শুনতে সুমনা ভয়ে আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল। ও মামাকে জিজ্ঞেস করল "মামা রোহিনীর কি হবে এবার।"উনি বল্লেন "আমাদেরকেও একটা ফাঁদ পাততে হবে। মার্থাকে আমাদের মাঝে টেনে আনতে হবে।"
সুমনা বল্লো "কি ভাবে ?"
বাকি কথা শুনে নিয়ে সুমনা ফোন ছেড়ে দিল।
পূর্ব কথামত রাত আটটার দিকে মামা অনেক কিছু নিয়ে রোহিনীর বাড়ী চলে এলেন। উনি রোহিনী ও সুমনাকে কিছু মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে ঘরে গিয়ে দ্রুত বাকী কাজ সারতে লাগলেন। রাত ঠিক এগারোটায় দরজায় মৃদু টোকার আওয়াজ হল। মামার ইশারা মত রোহিনী গিয়ে দরজা খুলল। খুলেই দেখল পচাগলা শরীর নিয়ে বীভৎস‍ মার্থা দাড়িয়ে। তাড়াতাড়ি ও ভিতরে ঢুকে এল। ওর পিছন পিছন মার্থা। রোহিনী ভয়ে আর ওর দিকে না তাকিয়ে বল্লো "তুমি আমার সাথে এস"। বাড়ীর পিছন দিকে একটা পরিত্যক্ত ঘর ছিল। রোহিনী মার্থাকে সেই ঘরে নিয়ে গেল। ওকে ওই ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে ও বল্লো "আমি তোমার জন‍্য আমার প্রিয় জনকে নিয়ে আসছি।" এই বলে ও বেরিয়ে আসতেই দেখল মামা আর সুমনা দাঁড়িয়ে। তাড়াতাড়ি তিনজন মিলে ঘরের চারপাশে মন্ত্র পড়ে গন্ডি কেটে দিল। মার্থা টের পেয়ে গেল।ছুটে বেড়িয়ে আসতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে গন্ডি কাটা হয়ে গেছিল। তাই ও আর বেরতে পারলনা কিন্তু আক্রোশে ফেটে পড়ল। মামা তাড়াতাড়ি মন্ত্র পড়তে পড়তে ওর দিকে প্রসাদী ফুল ছুড়ে দিলেন। তারপর ঘরে আগুন ধরিয়ে দিলেন আর তিনজন মিলে সমানে মন্ত্র পড়ে যেতে লাগলেন। ভোররাতে আগুন নেভার পর সমস্ত ছাই একটা বড় ঘটে ঢুকিয়ে মুখটা বেঁধে মামা ওটাকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে এলেন। রোহিনীকে বল্লেন " তোর আর ভয় নেই।"
অনেক বছর পরে আজ রোহিনী এই গল্পটা নাতিকে বল্লেন ।রোজ রাতে গল্প ছাড়া ঘুম আসেনা ওর। কিন্তু বুঝতে পারলেন না নিজের অজান্তে আবার একটা ভুল করলেন। দশ বছরের নাতি পরেরদিন ই ঠাকুমার গল্পের সত‍্যতা যাচাই করতে মায়ের ফোন থেকে মার্থার website -এ ঢুকে পড়ল।

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট