ভালবাসার যোগ বিয়োগ................শাহানা জাবীন সিমি

জ অনেক দিন পর দুপুরে পাক্কা দুঘন্টার একটা ঘুম দিল সে। বেশ ফ্রেশ লাগছে। হাতমুখ ধুয়ে মাইক্রোওয়েভে এক মগ পানিতে দুটো টি ব্যাগ দিয়ে বিকেলের চা টা বানালো।
মগটা হাতে নিয়ে তার দুই রুমের ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে বসতেই চোখ পড়লো সামনের খোলা মাঠে আকাশ ছুঁতে চাওয়া ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলোর দিকে।
বিকেলে খানিকটা সময় গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেয় ও। রৌদ্রজ্বল আকাশে গাছের পাতাগুলো যেমন চিকচিক করে আবার মেঘলা দিনে গাছগুলোর দিকে তাকালে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে তার প্রিয় গানের দু তিনটে লাইন....আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায় অশ্রুভেজা দুটি চোখ; কাকে মনে পড়লো তার? শ্রাবন্তী কে না সুস্মিতা কে?
নিচ থেকে হঠাত্ চিত্কার করে ডেকে উঠেন তার বস ডাঃ বারী।
.....নেমে এসো একসাথে হাঁটি। বৈকালিক ভ্রমণে ব্যস্ত তিনি। হাত নেড়ে চায়ের মগে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। সিঙ্কে চায়ের কাপটি নামিয়ে রেখে হাসপাতালের ইভনিং রাউন্ডের জন্য তৈরী হয় ডাক্তার কবির।
সদর হাসপাতাল টি শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত। রাউন্ড শেষ করে বেরিয়ে রিক্সায় উঠতেই মোবাইল বেজে ওঠে কবিরের। শ্রাবন্তীর কল। কথা বলতে বলতে পৌঁছে যায় চেম্বারে। সার্জারিতে এফসিপিএস করে এই জেলা সদর হাসপাতালটিতে পোস্টিং পেয়েছে সে। বছর তিনেক হয়ে গেল বলা যায় একধরনের রোবটের মতো জীবনযাপন করছে
....হাসপাতাল, চেম্বার আর ডক্টরস কোয়ার্টারে তার দুই রুমের ফ্ল্যাট। এদিকে নিজের করপোরেট জব, ছেলে আহিরের পড়শোনা আর সংসার এক হাতে সামলাচ্ছে তার স্ত্রী শ্রাবন্তী। বেশির ভাগ সময় প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সারতে হয় ফোনে বা মেসেন্জারে। আগে চিকিত্সক স্বামীর এত ব্যস্ততা মেনে নিতে পারতো না সে। রাগ করতো, ঝগড়া করতো কিন্তু এখন মনে হয় কোনো অভিযোগ নেই তার। মাঝে মাঝে উইকএন্ডে আহির কে নিয়ে চলে আসে শ্রাবন্তী। আবার লম্বা ছুটিছাটা পড়লে বা কোনো অকেশনে ঢাকার বাসে উঠে বসে কবির। এই যেমন আগামী কাল শশুর শাশুড়ির পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করতে সে ঢাকা যাচ্ছে। এমনিতেই গত ছয়মাসে শ্শুরবাড়ির ছায়া মাড়ায়নি কবির। তার উপর এই বিশেষ অনুষ্ঠান টিতে যদি সে পার্টিসিপেট না করে তাহলে শ্রাবন্তীর ভাইবোনেরা তাকে খোঁচা দিয়ে বলবে...কিরে কবির কি একদিনের জন্য তার চেম্বার বন্ধ রাখতে পারেনা? আর এর ফলশ্রুতিতে মোবাইলের ভেতর যে বোমা বর্ষণ হবে তার দায়িত্ব কবিরের পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়।
তিন দিনের ছুটির দরখাস্তটা আগেই দেয়া ছিল। সকালে হাসপাতালে পৌঁছাতে হঠাত্ একটা এমারজেন্সি ওটি করতে হলো কবিরকে। রাউন্ড শেষে মেডিকেল অফিসার কে কিছু কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সাড়ে বারোটার মধ্যে ডক্টরস কোয়ার্টারের রুমে ফিরে এলো সে। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে দুপুর দুটোর ঢাকার বাসে চেপে বসলো। বাসে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাওয়া কবিরের স্বভাব। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। হঠাত্ ঘুম ভাঙল একটা মহিলা কন্ঠস্বরে....
--- এক্সকিউজ মি; ভাইয়া জানালার ধারের সিট টা আমার। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে তার নির্দিষ্ট আসনে বসতে দিয়ে একটু সরে বসলো সে।
--- কবির ভাই চিনতে পারছেন আমি সুস্মিতা। সেইম মেডিকেল কলেজ আপনার তিন বছরের জুনিয়র। আরেকটু আড়ষ্ট হয়ে গেল কবির। এটা কিভাবে সম্ভব? এভাবে সুস্মিতার সাথে এতদিন পর এতো কাছাকাছি আবার দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। কি যেন এখন বলে...ক্রাশ। মেডিকেল কলেজে সুস্মিতা ছিল কবিরের প্রথম ও একমাত্র ক্রাশ। মাঝে পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে...অনেক সময়।
তৃতীয় বর্ষে সুস্মিতার যখন মেডিসিন ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট হলো তখন কবির এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। খুব সিরিয়াসলি লেখাপড়া করছে সে। তাছাড়া ভালো ছাত্র হিসেবে তার একটা সুনাম ছিল। সকাল সন্ধ্যা ওয়ার্ডে যাওয়া, রুগী দেখা এসবের মধ্যে একদিন খেয়াল করলো মিষ্টি চেহারার, ছিপছিপে গড়নের সুস্মিতা কে। অসম্ভব সম্মোহনী দুই চোখ দিয়ে সুস্মিতাও তাকে লক্ষ্য করতো। পরীক্ষা কাছে চলে আসাতে কবির চাচ্ছিলোনা কোনো রিলেশনে জড়াতে। ভাবলো সুস্মিতা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। পরীক্ষার পর দেখা যাবে। কিন্তু দিনে দিনে ভালো লাগা মনে হয় বেড়েই যাচ্ছিল। অবশেষে আসলো সেই দিন যখন পরীক্ষা শেষ হলো আর কাছের কিছু বন্ধু কে তার মনের কথা জানাতেই মাথায় বাজ টা পড়লো। --- দোস্ত ভুল একটা করছিস ইফতির উত্তর।
---কী ভুল?
---সুস্মিতা হিন্দু।
সেই মুহূর্তে আর কিছু ভাবতে পারছিলনা কবির। চললো কয়েকদিন মনের সাথে যুদ্ধ। বন্ধুরা ভালো মন্দ সবদিক বুঝালো। সবকিছু বুঝেও একদিন সুস্মিতা কে প্রপোস করেই বসলো কবির।
---কবির ভাই আমাকে ক্ষমা করবেন। আমিও আপনাকে পছন্দ করি কিন্তু আমার ধর্ম, পরিবার আর সমাজের বাইরে যেয়ে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
--- আমরা যদি এদেশে না থাকি ? পৃথিবী তে তো দেশের অভাব নাই। আমেরিকা, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া আমরা যে কোনো দেশে গিয়ে সেটেল করবো। কেন জানি খুব ভয় পেয়ে গিয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিল সুস্মিতা। পরের এক সপ্তাহ কলেজেই আসেনি। কবিরও বন্ধুদের মাধ্যমে জেনে গিয়েছিল ওর অসম্মতির কথা। ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাটায়নি সে। কিছু দিন খুব কষ্ট হয়েছিল কিন্তু সবকিছু মানিয়ে নিয়ে আবার জীবন স্রোতে মিশে গিয়েছিল কবির।
ইন্টার্নশিপ শেষ করে ঢাকার বাসায় ফিরে এলো কবির। কয়েকদিন এলোমেলো ঘোরাঘুরি, ক্লিনিকের ডিউটির পাশাপাশি চললো বিসিএস এর প্রস্তুতি। বছর দুয়েকের মধ্যে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি তে যোগদান, অতঃপর পারিবারিক ভাবে ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশ নিয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়া শ্রাবন্তীর সাথে বিয়ে। বিয়ের কিছুদিন পর কথায় কথায় সুস্মিতার ব্যাপারে জানিয়েছিল শ্রাবন্তীকে। সবকিছু চুপচাপ শুনে দু একটা প্রশ্ন করেছিল শ্রাবন্তী কিন্তু আর কোনোদিন এ ব্যাপারে ওদের মধ্যে কোন কথা হয় নি।
মৌনতা ভেঙ্গে কবিরই প্রথম জিজ্ঞেস করলো;
---কেমন আছো? কি করছো?
--- এই তো চলে যাচ্ছে। কমলগন্জ থানা হেলথ্ কমপ্লেক্সে পোস্টিং।
--- আপনি?
--- সদর হাসপাতালে সার্জারির কনসালটেন্ট।
আরো কিছুক্ষণ পেশা রিলেটেড টুকটাক কথা। হঠাত্ সুস্মিতাই কৌতুহল বশতঃ জিজ্ঞেস করে বসলো ভাবী কি করেন?...
ইত্যাদি ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন। মওকা পেয়ে কৌতুহলী হলো কবিরও। ভাবলো শাখা সিদুঁর তো চোখে পড়লো না তাহলে কি এখনো অবিবাহিত?
---সিঙ্গেল মাদার নিজেই বললো সুস্মিতা।
---মানে?
---নিয়তি কবির ভাই। সেদিন আপনার কথা শুনে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। স্বধর্ম, স্বগোত্রে বিয়ের পরও শেষ রক্ষা হয়নি। পুত্রের বাবা তার পরিবার পরিজনের সাথে ভারতে চলে গিয়েছে। অবশ্য ওখানে আগে থেকেই আমার শশুরের বিরাট সেটেলমেন্ট আছে। বিয়ের আগে একবারো বুঝতে দেয়নি তারা ইন্ডিয়াতে সেটেল করতে চলেছে। কিন্তু আমি বাবা মা আর এই দেশের মাটিকে ফেলে কোথাও যেতে পারবো না তাই আর সংসার টা সেভাবে করা হলো না।
---সরি টু হিয়ার সুস্মিতা।
--- মাঝে মাঝে ভাবি কেন সেদিন আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম...আজ হয়তো আমার অন্যরকম একটা জীবন হতো।
---হতো না। উপরওয়ালা যা করে ভালোই করে। তখন আমার বয়স কম ছিল, আবেগ ছিল বেশি। জীবনাদর্শ ও ধর্মীয় ভাবাবেগ ছিল অন্য রকম। এখন তার অনেক পরিবর্তন এসেছে। আবারও লম্বা মৌনতা। একসময় বাসটি ঢুকে পড়লো ঢাকায়। দুজনাই বিদায় নিল। কবির লক্ষ্য করলো সেই সম্মোহনী দৃষ্টির আকর্ষণ আজো আছে! কিন্তু সেই দৃষ্টি কে অগ্রাহ্য করার মতো শক্তি কবিরের এখন তৈরী হয়েছে।
একটা উবার ডেকে উঠে বসতেই মোবাইল টা দুইবার শিষ দিল। শ্রাবন্তী কলিং।
---ইয়েস সুইট হার্ট
---কি ব্যাপার খুব খুশি মনে হচ্ছে
---ঢাকায় পৌঁছে গেলাম তাই খুশি
---আচ্ছা শোনো আসার পথে মিঃ বেকার থেকে দুই কেজি বাকলোভা নিয়ে আসবে। আম্মু খুব পছন্দ করে।
---আচ্ছা বলে ফোন রাখে সে।
শাশুড়ির জন্য বাকলোভা আর আহিরের জন্য একটা কেক কিনে গাড়ী তে উঠতেই না দেখা সুস্মিতার ছেলের কথা কেন যেন মনে হয় কবিরের!
শ্রাবন্তী কে আজ দারুণ দেখাচ্ছে। কালো আর লালের কম্বিনেশনে জামদানি, লাল লিপস্টিক আর খোঁপা ভর্তি বেলী ফুলের মালা। এলিজাবেথ আরডেন এর স্নিগ্ধ সুবাসে কবিরের মনে হচ্ছে আজ আর কোথাও বেরিয়ে কাজ নেই। জম্পেশ খানা আর আড্ডা শেষে শশুর বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটার উপর বাজলো। আহির এসে বাবার বুকের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে শুরু করলো গত দুই তিন সপ্তাহে স্কুলে ঘটে যাওয়া রাজ্যের গল্প। মোবাইল টা হাতে নিয়ে সারাদিন পর একটু অনলাইন হতেই টুপ করে স্কৃনে ভেসে উঠল... সুস্মিতা মিত্র সেন্ট ইউ ফ্রেইন্ড রিকোয়েস্ট। এক মুহূর্ত ভেবে ডিলিট বাটনে চাপ দিল কবির। মনে মনে ভাবলো.... সুস্মিতা ছিল অপরিণত বয়সের একটা ক্ষনস্হায়ী ভালো লাগা আর শ্রাবন্তী যে ওর সব। প্রান দিয়ে ভালোবাসে ওকে আর আহির কে ঘিরে সেই ভালোবাসার শেকড় হৃদয়ের অনেক গভীরে প্রোথিত।
ফ্রেশ হয়ে এলো শ্রাবন্তী। বিছানায় বসে ড্রয়ার খুলে বের করলো এবারের সামারে ওদের বহু প্রতিক্ষিত ফ্রান্স, ইটালি আর সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের টিকেট আর পাসপোর্ট যা গতকালই ট্রাভেল এজেন্ট ওর অফিসে এসে দিয়ে গিয়েছে। বেডসাইড লাইটের হালকা আলোতে কবিরের হঠাত্ মনে হলো যত সুখ এসে যেন ধরা দিয়েছে ওদের এই ষোলশ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের বেডরুমটায়।

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Anonymous
September 1, 2020 at 9:43 AM

খুব ভাল করেছেন আপু। পরকীয়াতে না জড়ানোই ঠিক। খুব ভাল লেগেছে।

রিমি,মিরপুর

Reply
avatar
Anonymous
September 2, 2020 at 4:26 PM

শেষটা অসাধারন দিয়েছেন পুরোনো প্রেম ভুলে যাওয়াই বেটার।

সায়মা সিরাজ (রুপন্তি)
ক্লাস টেন
বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়

Reply
avatar
Shahana Zabeen Simi
September 2, 2020 at 9:55 PM

ধন্যবাদ।

Reply
avatar
aysha khatoon
September 2, 2020 at 11:34 PM

ভালবাসার যোগ বিয়োগ, কেন গুন ও ভাগ নয়......সমাজ ধ্বংশ হয়ে যাচ্চে যখন আমরা ভাবি আমাদের চারপাশ কত খারাপ মানুষ

Reply
avatar
ফারিহা হক
September 11, 2020 at 11:43 AM

যে যাই বলুক গল্পটা চমতকার। লিখে থাকুন আপু

Reply
avatar
September 11, 2020 at 7:55 PM

ধন্যবাদ ফারিহা।

Reply
avatar