ক্ষত..............মনিরুল ইসলাম জোয়ারদার

কুদরতকেএক নজর দেখেই চিনে ফেললো শানু। মেইন রাস্তার ধারে এক লোকের সাথে কথা বলছে। লোকটাকেও চিনতে পারলো, ওতো আসগর ভাই। আসগর ভাই ও তার হাজবেন্ড সাজ্জাদ একই কলেজে পড়ায়।সাজ্জাদ কেমেস্ট্রি , আসগর ভাই ইতিহাসে। তবে আসগার ভাই ভাল কবিতা লেখে। সারাক্ষণ কবিতা আওড়ায়, বিরক্তিকর। মাঝে মাঝে বৌ নিয়ে বাসায় আসে, বৌটা খুউব মিশুক। দীর্ঘক্ষণ কথা বলা যায়, সময় কাটে বেশ। কিন্ত আসগরের সাথে কুদরতের পরিচয় কিভাবে? এই দূরতম বগুড়া জেলা শহরে কিজন্যে এসেছে কুদরত বুঝতে পারলো না শানু। হ্যাঁ সেই অবিকল একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে, প্রায়শই পা বদল করছে । কথা বলতে বলতে ডান হাত দিয়ে চুল ঠিক করছে বারবার। তবে চুলগুলো অনেকটাই পাকা। ডাই করে সাদা চুল ঢাকার চেষ্টা করেনি একটুও। এটা শানুর ভাল লাগলো। ক্লিন সেভড। নতুন যোগ হয়েছে চশমা, মনে হচ্ছে হাই পাওয়ারের গ্লাস। কথা বলার সময় মিটিমিটি হাসিটা মুখে লেগেই থাকে। এই হাসি দেখেইতো ও পাগল হয়েছিল। কত বছর আগের কথা বিশ থেকে পঁচিশ বছর হবে। মনে হচ্ছে এইতো সেদিন। সরকারি গার্লস স্কুলে ক্লাশ সেভেনে পড়ে শানু। দারুন দুরন্ত ও ডানপিটে ছিল। কপালেে এখনো দুটো অস্পষ্ট কাটার দাগ রয়ে গেছে। পাড়ায় এমনও দিন ছিলনা যে তার বিরুদ্ধে বাবার কাছে নালিশ যেত না। বাবা তাকে খুউব আদর করতো এজন্যে তার গায়ে কখনো হাত না দিলেও মাঝে মাঝে ভীষন বকতো। তখন চুপটি করে থাকলেও পরদিন যা তাই। শানুর একটা ছোট্ট দল ছিল সাত আট জনের।তারাও ওরকমই ছিল। দল বেধে দুরন্তপনাই ছিল ওদের কর্ম।
এ সময়ই থানা শহর থেকে জেলা শহরে ওদের পাড়ায় এলো কুদরতের পরিবার। কুদরত তখন ক্লাশ নাইনে পড়ে প্রচন্ড মেধাবী ছাত্র। ম্যাথে সে অত্র জেলায় প্রথম। বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে তাই জেলা শহরে আসা। বাবা তার নাম রেখেছে বাংলাদেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ কুদরত ই খোদা'র নামানুসারে । মোঃ কুদরত ই খোদা একসময় বড় বিজ্ঞানী হবে এ আশায়। পড়াশুনায় ভাল হলে কি হবে চলাফেরায় একদম অগামগা। সব সময় মাথা নিচু করে চলে আর কি যেন ভাবে। একদিন কুদরত স্কুল থেকে ফেরার পথে শানু ওর পায়ে ল্যাং মেরে ফেলে দিলে পড়ে গিয়ে কুদরতের হাটু ছড়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে শানুকে বলে আপনি আমাকে ফেলে দিলেন কেন? সেই থেকে কুদরতকে দেখলেই শানু বলতো আল্লার কি কুদরত চোখের কোনায় পানি ও ছেলে তুই ছিচ কাদুনি। কুদরতের এস এস সি পরীক্ষার বছর খানেক আগে শানু এ ধরনের কথা বলতেই কুদরত ওকে মারতে তেড়ে এসেছিল। শানু তো অবাক। ও বুঝতে পারেনি যে পাড়ায় বছর খানেকের মধ্যে কুদরত খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কিন্তু শানুর ডানপিটে দলের মারমুখী ভঙ্গি দেখে কুদরত পিছিয়ে আসে।
এসএসসি পরীক্ষায় কুদরত বোর্ডে সপ্তম স্থান পায়। তখন তার সেকি নামডাক। এসময় শানু ক্লাশ টেনে পড়ে, অংকে ভীষন কাঁচা। ওর বাবা কুদরতের বাবাকে বললো আপনার ছেলেটি যেন কিছুদিন আমার মেয়েকে অংকটা শিখিয়ে দেয় ছেলেটাকে বুঝিয়ে বলেন কিন্তু। শানুর বাবা প্রভাবশালী বিধায় না করা হয় না কুদরতের। অংক শেখার চেয়ে কুদরতের সাথে গল্প করতো চাইতো বেশী। প্রথম প্রথম রাগ হলেও কিছুদিনের মধ্যে ওদের সম্পর্কটা মধুর হয়ে উঠে। দুজনের এভাবেই কেটে যায় দু’ তিন বছর। কুদরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে ভর্তি হয়। ও তখন সেকেন্ড ইয়ারে। শানু এইচএচসি পাশ করে স্থানীয় সরকারী কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হয়। ক্লাশ শুরুর আগেই ঘটলো দুর্ঘটনা। শানুর বাবা ওর বিয়ে প্রায় পাকা করে ফেলে। পাত্র দেখতেও হেভি হ্যান্ডসাম। তদুপরি বিসিএস ক্যাডারে শিক্ষা বিভাগে একটা কলেজে পড়ায়। সবারই পছন্দ সুতরাং শানু বিয়েটা কোন রকমেই এড়াতে পারলো না। সব ধরনেই যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। শানু কুদরতের সাথে কিন্তু কুদরত যোগাযোগ করতে পারেনি।গায়ে হলুদের দিন হন্তদন্ত হয়ে শানুকে ডেকে কুদরত জিজ্ঞেস করে কেন তুমি এমনটি করলে? কেন আমাকে জানাওনি? শানুর হাত দুটো ধরে বলে চল আমরা পালিয়ে যাই। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই হু হু করে কাঁদতে থাকে। প্লিজ শানু আমাকে শেষ করে দিও না।শানু চুপ করে থেকে খানিক্ষণ পরে বলে, কুদরত এখন আর তা হয় না। সব আয়োজন শেষের পথে তাছাড়া সন্মানেরও বিষয় জড়িত। তুমি আমাকে ভুলে যাও। কুদরত বলে শানু আমি এখন কি করবো বলো।শানু কষ্টটা বুকে চেপে বলে কুদরত, তুমি লেখাপড়া শেষ করে চাকরি বাকরি নাও তারপর বিয়ে করে সংসারি হয়ো। কুদরত হঠাৎ দিশেহারার মত বলে উঠে, ‘শানু তুমি আমাকে শেষ করে দিয়ে ভূল করলে। দেখো আমি কোনদিন তোমাকে ভুলতে দেবনা এই আমাকে। আমাকে চিনতে তুমি ভুল করেছো শানু, আমার ভালবাসাকে অপমান করে ভূল করলে শানু।’ কুদরত চলে যায় ঝড়ের গতিতে শানুর হাতটা ঝটকা দিয়ে ছেড়ে। শানু হাতে প্রচন্ড ব্যাথা পায় তবুও এ ব্যাথা হৃদয়ে ব্যাথার চেয়ে ক্ষুদ্রতম।
শানু উদাস দৃষ্টিতে কুদরতের চলে যাওয়া দেখে আর নীরবে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়ায়। ‘এই শানু ,শানু এই শাহানা’ একটু জোরেই ডাক দেয় সাজ্জাদ । ‘ওদিকে কি দেখছো? দেখো আপেল নেবে না পেয়ারা নেবে?’ একটা ফলের দোকানে রিক্সা থামিয়ে ফল কিনছিলো ওরা। ‘ওদিকটায় দেখ উনি আসগর ভাই না ? শানু চোখের জল লুকোতে চায়। চোখ ওর ঝাপসা হয়ে আসে। আসগর ওদিকে চেয়ে বলে ‘হ্যাঁ তাইতো।’ আসগর আসগর বলে ডাক দেয় সাজ্জাদ। আসগর ওদিকে তাকিয়ে হাত ইশারা করে অপেক্ষা করতে বলে। কুদরত শানুর দিকে তাকায়। শানু ডান দিকে ঘুরে যায় যেন কুদরত ওকে দেখতে না পারে। কিন্তু সাজ্জাদ দেখে ফেলে শানুর চোখে জল।
‘কি হয়েছে চোখে?’ 
‘চোখে কি যেন পড়েছে,’ শানু আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। ঢাকার বাস এলে কুদরত ওতে উঠে যায়। কুদরতকে বিদায় জানিয়ে আসগর ওদের কাছে আসে। 
‘কি ব্যাপার স্যার এখানে? ভাবির চোখে কি হয়েছে?’  
‘ওর চোখে পোকা টোকা পড়েছে মনে হয়’। 
আসগর দ্রুত পাশের চায়ের দোকান থেকে এক মগ পানি নিয়ে আসে। চোখে মুখে পানি ছিটা দেয় শানু। সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করে ‘ঐ লোকটা কে?’
‘আরে ওকে চিনলেন না স্যার উনিতো বাংলাদেশের নাম করা কবি কুদরত ই খুদা!’ 
শানু হা করে তাকিয়ে থাকে আসগরের মুখের দিকে। মুখ ফসকে বলে উঠে ‘ও এখানে কেন?’ ‘বগুড়াতে একটা সাহিত্যের আসর ছিল উনাকে চিফ গেষ্ট করা হয়েছিল।’ 
‘উনাকে তুমি চেন,’ সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করে। 
শানু বলে ‘হ্যা উনি বেশ নাম করা কবি চিনবোনা কেন?’ 
‘ও হ্যাঁ তুমিতো আবার গল্পের বই টই পড়ো।’ 
‘উনিতো বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল,’ শানুর প্রশ্ন। 
‘বাহ, তাঁর অনেক খবরই জানেন দেখি,’ আসগর বলে। 
‘এতটুকুই জানি এর বেশি না।’ মনে মনে ভাবে কিছুই জানতাম না এখন জানলাম। বা বিজ্ঞান নিয়ে পড়লে কি কবিতা লেখা যায় না! তা যায় বৈকি। ‘আচ্ছা আসগর ভাই উনি চাকরি বাকরি করেন না?’ ‘তা করেন একটা সরকারি অফিসে। জানেন ভাবী উনার একটা স্যাড ব্যাক আছে। উনি এখনো বিয়ে থা করেনি।’ 
‘বলেন কি কেন?’ 
‘একটা মেয়ের সাথে উনার প্রেম ছিল কিন্তু মেয়েটা অন্যত্র বিয়ে করে, ফলে উনি আর বিয়েই করবে না বলে পণ করে। আরো একটা মজার ঘটনা আছে।’ 
‘কি সেটা?’ 
‘উনি সারাদিন হেড ফোনে একটি মাত্র গানই শোনেন।’ 
‘কোন গানটি?’ শানু জিজ্ঞেস করে।’ 
‘ঐ যে 'যেটুকু সময় তুমি থাক কাছে মনে হয় এদেহে প্রান আছে বাকিটা সময় শুধু মরন আমার, হৃদয় জুড়ে নামে অথৈ আধার।' 
‘কেন শুধু এ গানটিই শোনে?’ 
‘উনি যাকে ভালবাসতো সেই মেয়টির নাকি এই গানটি ভাল লাগতো।’ 
আর সহ্য করতে পারছে না শানু। বুকের মধ্যে হু হু করে উঠে।সাজ্জাদকে বলে, ‘চলোতো আমার চোখ জালা করছে। তাছাড়া ছেলে মেয়ে দুটোরই পরীক্ষা।’ 
‘ওরা যেন কি পরীক্ষা দিবে ভাবী’, আসগরের প্রশ্ন। 
শানু উত্তর দিতে পারে না, কান্না ঠেকাতে পারছে না, শাড়ীর আঁচলে চোখ মোছার ভান করে।  উত্তরটা সাজ্জাদই দেয়। মেয়েটা এইচ এস সি, ছেলেটা এসএসসি। বাসায় এসো আসগর,’ বলেই ওরা রিক্সায় উঠে বসে। বাসায় এসেই সোজা ওয়াশ রুমে ঢুকে যায় শানু। ট্যাপ ছাড়ে ফুল স্পিডে তারপর ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে, কান্নার দাপটে গলার ভিতর থেকে শুধু ঘড় ঘড় শব্দ বের হয়। যখন কান্নার ঝড় থেমে যায় তখন বেসিনের আয়নায় নিজেকে নিজেই বলে, ‘কিরে শাহানা খাতুন শানু তুই ঠিকই হেরে গেলি। কুদরত তোকে কিছুই ভূলতে দিলো না। তোর হৃদয় মাঝে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা কোনদিন কি মুছবে?  কোনদিনই মুছবে না।।’

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
aysha khatoon
September 1, 2020 at 11:42 PM

পরকীয়া খুব অপছন্দ বিষয়

Reply
avatar