একদিন সরফুদ্দিন ও তার বউ............আশিকুর রহমান বিশ্বাস


'আমাকে বলতে বলবেন না
              আমি বলতে শুরু করলে
              প্রকাশ্য সভায় আপনারা নগ্ন হয়ে যাবেন।'
           (প্রদীপ বালা)

গ্রীষ্মে এই ছায়াটুকু বড়ই মনোহর। পথিকের ক্লান্ত শরীরে প্রশান্তি বয়ে আনে বটে। তখন চোখদুটো পাথরের মতো ভারি হয়ে আসে; শরীর ক্রমশ ভেঙে এসে জড়ো হয়; আর ভাবনাচিন্তার পরিধি ছোট হতে থাকে। সূর্য তখনও ঠিক উলম্ব কিরণ দেয়। পাখিরা ভঙ্গুর শরীরে ডানা ছেড়ে হাঁপাতে থাকে, নদ নদীর পানি শুকাতে থাকে, সবুজ গাছেরাও বিবর্ণ হয়, বালুকাময় এই শহর মনুষ্য বসবাসের একেবারেই অনুপযোগী হয়। ঠিক তখন এই ছায়াটুকু কি প্রশান্তির নয়? কিন্তু কখনও আবার সে ছায়া কুকুরের দখলে। মৃদুমন্দ বাতাসে ছায়া নড়ে আর কুকুরের দল খেলা করে। ঘেউঘেউ। উঁচু চিমনি চূড়া অনর্গল কালো ধোঁয়া বমি করে তার কিছুটা ছিটকে আকাশের গায়ে লাগে, স্কেচ তৈরি হয়।অথচ আজ ছায়া নেই তাই কুকুরের খেলাও নেই। আছে শুধু আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। ধোঁয়া। আবর্জনা। আঁশটে গন্ধ। সরফুদ্দিন আর ওর বউ শেফালী ভেবেছিল বৃষ্টির আগেই ওরা ভালোই ভালোই কেটে পড়তে পারবে, তখন না হয় দু'দণ্ড জিরিয়ে নিতে পারবে ছায়ায়। আগেও নিয়েছিল। সেবার নতুন বিয়ে করেছিল সরফুদ্দিন, ছায়ায় দাঁড়িয়ে দু'জন দু'টো আইসক্রিম চেটে সাবাড় করেছিল ওরা। লম্বা ঘোমটার ভিতর থেকে খেতে বড় অস্বস্তিই লাগছিল। সরফুদ্দিন বার বার বলছিলো-
- ঘোমটা ছাড়ো বউ, কে আছে আমি ছাড়া?
আসলে ওর বড় দেখতে ইচ্ছে করছিলো বউকে। এভাবে নানা ছলচাতুরী করে যাচ্ছিল ও, আর শহরের মর্ডান মেয়েদের গল্প। সে-গল্প শেফালীর সব জানা তবু অদ্ভুত কৌতূহলে শুনে যাচ্ছিল ও। হেসে ঢুলে পড়ছিলো সরফুদ্দিন। শেফালীও হাসছিলো। সেই হাসি বড় দেখতে ইচ্ছে করছিল সরফুদ্দিনের কিন্তু ঘোমটা ছাড়ে নি বউ। এই অবাধ্যতাটুকু একসময় মনে ক্রোধ বয়ে এনেছিল সরফুদ্দিনের। শেফালী বুঝতে পারে নি। কিন্তু আজ সরফুদ্দিন খেয়াল করেছে ওর বউ ঘোমটা টানে নি। ভিড়, গা ঘেঁষাঘেষি, অশ্লীলতা, তবুও। বউকে সে ইতোমধ্যে বারকয়েক বলে ফেলেছে-
- ঘোমটা টানো বউ। আহা ঘোমটা টানো বউ।
টানে নি শেফালী। চুপ থেকেছে। শেফালী আজ ঘোমটা তলে আবদ্ধ থাকতে চায় না, ও বেরুতে চায়, জরাজীর্ণতার দেয়াল
টপকাতে চায় ও। সবার মুখোশ খুলে দিতে চায়। সরফুদ্দিন যে হলুদের মিলে কাজ করতো ওখানে অগোচরে আটা মেশানো হতো রাতে, জেনে গেছে শেফালী। সবাইকে বলে দিতে চায় সে। সরফুদ্দিন সতর্ক করেছিলো-
- চুপ বউ, সাবধান! কাউকে বলবা না এ-কথা।
- কেন বলবো না?
- যা বলি তাই শোনো। তোমার কথা কেউ শুনবে
না, কেউ বিশ্বাস করবে না ওরা বরং হেসে 'পাগলি' বলবে। অশ্লীল গালি দিবে।
- বলেই দেখি না?
মুখ চেপে ধরেছিল সরফুদ্দিন। দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ও-কথা সবাইকে বলে দেবে সে। সরফুদ্দিন প্রায়শ মিছিলে যেত। লম্বা মিছিলের সামনে থাকতো ও, স্লোগান দিতো। বাসায় ফিরে ঘন চা চাইতো, গলা বসে যেত ওর। খেতে পারতো না, শরীরে ব্যথা করতো, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতো। লেপ মুড়ে নিতো শরীরে, প্রলাপ বকতো। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারতো না সে, সেই সরফুদ্দিন একদিন বউকে ডেকে বললো-
- আজ নির্ঘাত মারা পড়তাম বউ।
- ওমা কেনো! পুলিশ তাড়া করছিলো বুঝি?
- আরে পুলিশের ভয় এই সরফুদ্দিন করে না।
- তবে?
- অপজিশনের হামলা। কোনোমতে বেঁচে ফিরছি।
- এই আজি শেষ আর যেতে পারবা না বললাম। দরকার হলে না খেয়ে থাকবো, তবুও।
সেই মিছিলের সব খবর জেনে গেছে শেফালী, সবাইকে জানিয়ে দিতে চায় ও।
- খবরদার বউ। হুশিয়ারি দিয়েছিল সরফুদ্দিন।
- আর ক'দিন মুখ বন্ধ রাখবা তুমি? সবাই জানুক, সবাই চিনুক ওদের।
- খামখা একটা ঝামেলা কেন ক্রিয়েট করতে চাও বউ। এগুলো হলো পলিটিক্স বুঝেছ।
- তোমাকে যে ওরা টাকা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে যায় এটা জানুক সবাই। প্রেসক্লাবে ভাড়া করা লোক থাকে, রাস্তায় ভাড়া করা লোক থাকে, অনশনে থাকে, জনসভায় থাকে, এটা সবাই জানুক। সবাই বুঝুক। চিনুক ওদের। -আকুতি জানিয়েছিল শেফালী।
- চিনলে কী হবে? জানলে কী হবে? বুঝলে কী হবে? জিজ্ঞেস করেছিল সরফুদ্দিন। পরপর। সপ্রশ্নে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
- জেগে উঠবে সবাই। -খুব সরল গলায় বলেছিল শেফালী।
সরফুদ্দিন বিকৃত হেসেছিল। সে জানে ওদের কিচ্ছু হবে না। ওদের কিছু হয় না। কেউ জেগে ওঠে না। ওদের চেতনার মৃত্যু
ঘটেছে তাই ওরা এখন আর জেগে ওঠে না। নিশ্চুপ ঘুমিয়ে থাকে। বস্তুত জেগে ওঠেনি হাসপাতালের কোনো একজন রোগী আর তাদের স্বজনরা। শেফালী প্রাইভেট হাসপাতালে
ছিলো অনেকদিন, ওদের ব্যাবসা জেনে গেছে সে। সেবা? ঘেঁচু, টাকা সব। কশাইখানা। ওদের অনিয়ম শেফালী আজও ভুলতে পারেনি তাই হয়ত ঘৃণা ধরে গেছে। সবকিছু স্পষ্ট চোখে ভাসে ওর। ঘুমোলে আরও স্পষ্ট
হয়। বুঝতে পারে সরফুদ্দিন। ঘুমোতে পারে না শেফালী, স্রেফ হত্যা বলে ও। মানুষগুলোর চাপা আর্তনাদ শুনতে পারে আজও। হত্যা, তোমরা হত্যা করেছো, তোমরা একেকজন মস্তবড় একেকটা হত্যাকারী- প্রলাপ বকে চলে শেফালী। ঘুমিয়েও বকে ও।
সরফুদ্দিন ধমক দেয়। শেফালী এই শেফালী, কী যা তা বলছো?
ঘন শ্বাস নেয় শেফালী, তখন ওর বুক ওঠানামা করে, শরীর ঘাম ছাড়ে। তারপর ধীরে চোখ মেলে ও। উঠে বসে।
- হত্যা! কে কাকে হত্যা করলো বউ? কার কথা বলছো?
- হত্যা করে ওরা। ওরাই করলো। এইতো আমার সামনে করলো।
- কারা? তারা কারা বউ।
শেফালী যেন হোঁচট খেয়ে ওঠে। সামলে নিয়ে বলে, পানি, আমাকে একটু পানি দাও। আমি পানি খাবো।
সরফুদ্দিন দৌঁড়ে গিয়ে পানি আনে। ও ঢকঢক করে মুখে টেনে নেয় সবটুকু। হাঁপিয়ে ওঠে। তারপর ধীরে শান্ত হয়। সরফুদ্দিন ওকে শুইয়ে দেয়, শিশুদের মতো শুয়ে থাকে ও। সরফুদ্দিন ও'কে আদর করে, কপালে চুমু এঁকে দেয়, ঠোঁটে দেয়, তারপর সমস্ত শরীরে। নিভাঁজ সুখে ভরিয়ে তোলে ও'কে। যে সুখের নেশায় একদিন সব ছেড়ে চলে এসেছিল ও। কিন্তু সরফুদ্দিন কি সুখী করতে পেরেছে ও'কে? আজ সে হিসাব নয়, শেফালী মাথা নাড়ে। ভুলে যায় সবকিছু; সুখে ভুলে থাকে ও, কিন্তু তা সীমিত সময়ের জন্য। শেফালীর ওর বাচ্চাটার কথা মনে হয় তখন। ডুকরে কেঁদে ওঠে ও। হঠাৎ বাচ্চাটার কী যেন হলো! পায়খানা, জ্বর, বমি, তারপর চোখ উল্টে গেল, মুখটা নীল হয়ে এলো। দৌঁড়ে হাসপাতালে নিয়েছিল শেফালী, কত পয়সা যে ওই কসাইখানায় ঢাললো ওরা অথচ শেষমেশ বাঁচলো না। বাঁচতো ও, কিচ্ছু হতো না, থাকলে অনেক বড় হতো আজ- শেফালী বিশ্বাস করে। সেই কথাগুলি বলে দিতে চায় ও। কী ঘটেছিল সেই রাতে সব জানে শেফালী শুধু একবার চিৎকার করে জানিয়ে দিতে চায় সবাইকে।
হয়তো মানুষ কখনও জাগবে না।
হয়তো ওদের কিচ্ছু হবে না; ওরা বেঁচে যাবে; ওরা তো এভাবেই বেঁচে যায়; রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, মুদ্রানীতি ওদের বাঁচিয়ে রাখে; আর বাঁচিয়ে রাখে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, বন্যা, সাইক্লোন। তবু একবার শেফালী জানিয়ে দিতে চায় সবাইকে।
সরফুদ্দিন বলল, ঘোমটা টানো বউ।
শেফালী টানলো না।
সরফুদ্দিন আবার বলল, ঘোমটা টানো বউ।
এবার শেফালী অস্ফুটে বলল, না।
- কী করতে চাও তুমি?
- বলতে চাই। আমি সব বলতে চাই।
- কাকে বলবা?
- যারা শুনবে। যাদের এখনও মৃত্যু হয় নি।
- যদি তারা আর কেউ না থাকে?
- তবুও বলবো।
- কাদের সাথে?
- ফুটপাতে বলবো, গাছেদের সাথে বলবো, পাখিদের সাথে, বিদ্যুৎ পিলারের সাথে, আর ঐ ময়লার বাক্সের সাথে।
- ওরা কি শুনবে?
- অবশ্যই শুনবে। আমি চেঁচিয়ে বলবো। ওদের শুনতেই হবে। আমি চেঁচিয়ে গলা চিরে
ফেলবো, তারপর হড়হড় করে রক্ত বমি করবো, আর সেই রক্তবমি যারা শুনবে না, যারা শুনতে চাইবে না, যারা চির-বধির, যারা চির-অন্ধ, যারা চির-মৃত একে একে তাদের গায়ে ছুড়ে মারবো। রক্তে ডুবিয়ে ফেলবো ওদের।
- তারপর?
- তারপর মরে যাবো।
সরফুদ্দিন স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টি তখনও থামেনি, সরফুদ্দিন ও তার বউ ভিজে গেছে। কিন্তু এ বৃষ্টি তাদের রক্তমাংসের শরীর ভেদ করে ভিতরে যে একটা দাবানল সৃষ্টি হয়েছে সেখান অবধি পৌঁছাতে পারে নি। ভেতরটা দাউদাউ করে পুড়ছে তখন। গনগন করছে আগুন। চুপ করে পুড়ছে, মুখ বুজে পুড়ছে। কিন্তু পুড়ছেই।
সরফুদ্দিন বলল, গাড়িতে ওঠো বউ।
- যাবে?
- চলো যাই।
- কোথায় যাবে?
- প্রেসক্লাবে।
- সেখানে যদি কেউ না আসে?
- তবে রাস্তায় দাঁড়াবো।
- তখনও কেউ যদি না শোনে।
- তবে আবাসিক এলাকায় যাবো, কলকারখানার সামনে, প্রয়োজনে চায়ের দোকানে, লঞ্চ ঘাটে, টার্মিনালে, স্টেশনে।
- চলো যাই।
সরফুদ্দিন ও তার বউ একসময় প্রেসক্লাবে হাজির হলো। একে একে হাজির হলো সাংবাদিক, সুশীল, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, শিল্পী, কবি, সেবিকা, ক্যামেরাম্যান, গোয়েন্দা, কেরানি আর যারা রাস্তায় শুয়ে থাকে তারাও। কী বলে সরফুদ্দিনের বউ?
কী বলতে চায় সে? চারিদিক চাপা গুঞ্জন। সরফুদ্দিন চুপটি দাঁড়িয়ে রইলো একটি কথাও বললো না। শেফালী মুখ খুলতে শুরু করলো। ও হলুদ মিলের আটা ভেজালের খবর জানিয়ে দিলো সবাইকে। মিছিলে লোক ভাড়া করার খবর দিলো।হাসপাতালের খবর দিলো।
চেঁচিয়ে বললো শেফালী, চাপা আক্ষেপ থেকে বললো, হয়ত অন্তরের দাবানল থেকে বললো শেফালী। কিন্তু সেই দাবানলে আর কারো অন্তর পুড়লো কিনা তা জানা গেলো না। সবাই চুপ শুনে গেলো। 

"আশিকুর রহমান বিশ্বাস যশোরের ছেলে। বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে অধ্যয়নরত আছেন। আগামী বইমেলাতে তার ‘এক নক্ষত্রের নিচে’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হবার কথা রয়েছে।”

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট
Anonymous
August 31, 2020 at 2:16 PM

ছবিটা এ্যাডল্ট কিন্তু ভেতরের লেখায় তেমন কিছু নাই পড়তে বসে ধুকা খাই--নাসিরউদ্দিন মৌলভীবাজার

Reply
avatar
Anonymous
September 1, 2020 at 9:40 AM

কাহিনী ভাল কাভারটাও ভাল কিন্তু গল্পের সাথে মানায়নি

রিমি

Reply
avatar
September 1, 2020 at 9:13 PM

আন্তরিক ধন্যবাদ, রিমি।
পরের সংখ্যায় নিশ্চয়ই বিষয়টা দেখা হবে।

Reply
avatar
রিমি
September 1, 2020 at 11:44 PM

ভাইয়া কেন যেন রিপ্লাই দিলে যায়না বুঝলাম না। কমেন্ট করার সময়

Reply
avatar
September 2, 2020 at 12:28 PM

ধন্যবাদ রিমি।
এখানে রিপ্লাই অপশন টা কাজ করে না। কাজেই কমেন্টই ভরসা।

Reply
avatar
শাকিবুর রেজা অনন্ত কবি
September 10, 2020 at 8:39 PM

দারুন গল্পের ছবি আর দারুন গল্প। লেখক ভাইয়া কিন্তু পরিস্কারভাবে বোঝাতে পারেননি শেষ পর্যন্ত কি হলো। দেখা গেল তারা কি ব্যর্থ হল না জিতলো বুঝা যায়নাই

Reply
avatar
September 10, 2020 at 8:56 PM

অনেক ধন্যবাদ,ভাইয়া।
আসলে সাধারণ মানুষ তো বেশি কিছু করতে পারে না। বড়জোর পারে বলতে। সরফুদ্দিন ও তার বউ শুধুমাত্র সমস্যাগুলো বললো। বাকি দায়িত্বটুকু করবে পলিসি মেকাররা।

ভালোবাসা রইল, অনেক অনেক।

Reply
avatar
Mazhar Rupak
September 17, 2020 at 1:00 PM

সরফুদ্দিন ও তার বউ ভিজে গেছে। কিন্তু এ বৃষ্টি তাদের রক্তমাংসের শরীর ভেদ করে ভিতরে যে একটা দাবানল সৃষ্টি হয়েছে সেখান অবধি পৌঁছাতে পারে নি। ভেতরটা দাউদাউ করে পুড়ছে তখন-তারপরটা আরও একটু বর্ননা দিলে কি হত

Reply
avatar
September 19, 2020 at 4:16 PM

Mazhar Rupak,
এই ক্ষুদ্র মানুষটির ভালোবাসা নেবেন।
ভালো থাকবেন সবসময়।

Reply
avatar