সমুদ্র বিলাস................রাকিব সামছ শুভ্র

'গরীব মিসকিন আত্মীয় বাসায় আসা মানেই টাকা ধার চাইতে আসা' ফুপার শুনিয়ে জোরে বলা কথাটা হয়তো অপমান সূচক। কিন্তু আমি শুনেও না শোনার ভান করলাম। পাশে বসা ফুপুর চেহারার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছে না। না তাকিয়েও আমি বেশ বুঝতে পারছি, তার বড় ভাইয়ের এই ছেলেটার জন্য দুয়েক ফোটা অশ্রুজল ভালোবেসে গড়িয়ে পরছে।
ঢাকা শহরে আমার এই একজনই আত্মীয় যে কিনা নিঃস্বার্থভাবে আমাদের ভালোবাসেন। নিজেদের প্রয়োজনে হলেও এখানে আমরা মাঝে মাঝেই আসি। বাসার সবাই খুব আনন্দচিত্তে আমাদের আসাকে পছন্দ করে বললে ভুল বলা হবে। তারপরও আপন ভাইয়ের ছেলে তাই হয়তো মেনে নেয়।

আমি আব্দুর রহমান, বিএ। মফস্বলের কলেজ থেকে পড়াশোনা করে ঢাকায় এসেছিলাম দশ বছর আগে। এই ফুপুর বাসাতেই উঠেছিলাম। ডুপ্লেক্স বাড়ির গেস্ট রুম সারা বছর খালি পরে থাকে, তারপরেও আমার জায়গা হয়েছিলো ড্রাইভারের থাকার ঘরে। রুমটা বাসা লাগোয়া গ্যারেজের উপরে। অনেকটা দেড়তলা উচ্চতায়। আমার তাতে অবশ্য আপত্তি ছিলোনা। ফুপু কষ্ট পেতেন কিন্তু আমার হাসিমুখ তাকে একটু দম ছাড়ার সুযোগ করে দিতো। পড়ালেখায় মোটামুটি হলেও সততায় একশোতে কানা কড়ি নাম্বারো কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। এবাসায় এসে আমার উপর প্রথম দায়িত্ব পরলো বাজার করবার। আমি প্রায় একবছর এ দায়িত্ব পালন করেছি এবং একদিনের জন্যেও একটা টাকা এদিক ওদিক করিনি। ফুপা উঠতে বসতে অপমান করলেও ঝানু ব্যবসায়ী। মানুষ চিনতে কখনো ভুল করেন না। বাজারের খরচ কমে যাওয়াতেই ফুপুকে একদিন বললেন, তোমার ভাইপো আব্দুর নাজানি আব্দুল! ওকে আমার অফিসে পাঠিয়ে দিও। ওকে অফিসে একাউন্ট সেকশনে বসিয়ে দেবো। পরের দিন থেকেই আমার ফুপার অফিসে এসিস্ট্যান্ট একাউন্টেন্ট এর চাকুরি শুরু। বেতন ধরলেন সাড়ে ছয় হাজার টাকা।

চারবছর মনপ্রাণ দিয়ে চাকুরি করারপর একদিন ফুপু ঘরে ডেকে পাঠালেন। ফুপার চাচাতো ভাইয়ের এক মেয়ের জন্য আমাকে প্রস্তাব করতে চান। আমি না বলে দিলাম। আমার যা সামর্থ্য! বিয়ে করাটাই বোকামি হবে তাও আবার ফুপার ভাইয়ের মেয়ে! ফুপু অনেক করে বোঝালেন, এই ভাই পয়সা ওয়ালা না। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, পাঁচটা মেয়ে। মেয়েরা বড় হচ্ছে পয়সার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না। ফুপা কোন প্রকারের দায়িত্ব নেন না। যদিও ফুপা নাকি এই ভাইয়ের কাছে থেকেই পড়ালেখা করেছেন প্রাইমারী স্কুলে। ফুপু ভাইয়ের ঋণ শোধ করতে চান মেয়েকে ভালো পাত্রস্থ করে। আমাকে মেয়ে পক্ষ কিছুই দিতে পারবে না আর আমারও তাদের কিছুই দেওয়া লাগবে না। ফুপু আমাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আমার মিয়াভাই গরীব হতে পারেন কিন্তু আমার জন্য জীবনে জান দেয়া ছাড়া সব করেছেন হয়তো চাইলে জানটাও দিয়ে দিতেন। তার ছেলে তুইও হয়েছিস বাবার মতোই। আর আমার ভাসুরের মেয়ে নিতুও খুব লক্ষ্মী। তোরা খুব সুখী হবি রে। আমি কিছু বলতে পারিনি। ফুপুর পা ছুঁয়ে সালাম করে শুধু বললাম, ফুপু তুমি দোয়া কর এবং যেটা ভালো মনে হয় কর। আমার আপত্তি নেই। ফুপু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বিড়বিড় করে বললেন, মা মরা মেয়েটা ভালো একটা ঠিকানা পেলো।

নিতু আর আমার বিয়ে হয়ে গেলো মাস খানেকের মধ্যেই। কাজী সাহেবকে ডেকে আমার বাবা মা, বোনেরা আর ওদের পরিবারের চারজন সবমিলিয়ে দশ বারোজন। শুধু এই একটা দিন ফুপাকে দেখলাম বেশ হাসিখুশী। ফুপুই পোলাও কোরমা রাঁধালেন। ওনার বাসাতেই খাওয়া দাওয়া হলো। নিতুকে আমার এক রুমের বাসায় তুললাম। মিরপুর এক নাম্বার মাজারের পেছনে একরুম সাবলেট নিয়েছি। 
তখন সর্বসাকুল্যে বেতন পেতাম দশ হাজার টাকা। ঘর ভাড়া দিতাম সাড়ে তিন হাজার সাথে গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল আটশো টাকা। অফিসে যেতে আসতে খরচ হতো চারশো টাকার মতো। দুজনে খেয়ে পড়ে কিছু টাকা জমানো যেতো। তা সে দুশো টাকাই হোক কিংবা পাঁচশো টাকা। নিতু খুব বেশী লক্ষ্মী মেয়ে। কোনদিন মুখ ফুটে কিছু চায় না। আমি যা এনে দেই তাই হাসিমুখে গ্রহন করে। পাঁচ সাতশো টাকার শাড়ী পড়ে যখন সামনে আসে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রই! এই মেয়েটা আমার বউ? এতো অল্পতেই এতো খুশী কিভাবে থকে মানুষ! ওর শুধু একটা প্রিয় জিনিস আছে আমি তা জানি। বাসায় ফ্রিজ নেই নয়তো আমি কষ্ট হলেও বাক্স ভরে নিয়ে আসতাম। আইসক্রিম খেতে খুব পছন্দ করে। অবশ্য ও কমলা রঙের ললি আইসক্রিম ছাড়া অন্য আইসক্রিম কখনো খায় না। অনেকবার জোর করেছি কিন্তু রাজি হয় না। ও অদ্ভুত ভাবে আইসক্রিম খায়। মুখে নিয়ে টেনে চুষে আইসক্রিমের রস আর কালারটুকুন খেয়ে নেয়। আইসক্রিমটা তখন একেবারে সাদা হয়ে যায়, শুধুই বরফ। সেই বরফটাই কামড়ে কামড়ে খাবে। আমার কাজ হচ্ছে ওই সময়টা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে দেখা। আমি আইসক্রিম খাই না। একটা খেলেই সাতদিন গলা ব্যথা করে। টনসলের সমস্যা ছোট বেলা থেকেই। 

পাঁচ বছরে আমাদের সংসারের পালে খুব একটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগেনি। বেতন বেড়েছে আমার। এখন চোদ্দ হাজার পাচ্ছি। নিতুও পাশের একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়াচ্ছে। বেতন শুনলে হাসবেন। দেড় হাজার টাকা। স্কুলের আয়ার বেতন চার হাজার টকা! জিজ্ঞেস করে জেনেছি ওদের প্রিন্সিপাল বলেন, আয়াতো আর টিউশনি করে আয় বাড়াতে পারবে না কিন্তু নিতুতো টিউশনি করলে হাজার টাকা কামাতে পারবে! নিতু একটা টিউশনি করায় বেতন নির্ধারণ করে দেয় নি। আয়ার মেয়ে বাসায় এসে পড়ে যায়। যখন যেমন পারে দেয়। কখনো দুইশো কোন মাসে তিনশো। আমি বলেছিলাম তুমি ফ্রি পড়ালেই পারো এই দুশো তিনশো টাকা না নিলেই হয়। ও উত্তরে বলেছিলো ফ্রি পড়ালে গুরুত্ব দিবে না। এখন টকা দিতে হচ্ছে বলেই নিজে থেকে বাচ্চাকে পড়তে দিয়ে যায়। ওর যুক্তিতে কিছু বলার পাইনি। 
আমরা সাবলেট থেকে বেড়িয়ে নিজেরা একটা দেড়রুমের বাসা নিয়েছি। একটা বেডরুম সাথে আধাখানা ডাইনিং, একটা ছোট্ট রান্নাঘর। একটা বাথরুম আর আমাদের প্রিয় জায়গা একটা চার ফিট বাই আড়াই ফিটের বারান্দা। নিতু খুব সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছে ঘর। বারান্দায় কয়েকটা গাছও লাগিয়েছে। নীল অপরাজিতা, একটা গোলাপ আর দুটো ঝুলন্ত গাছ শোভা বাড়াচ্ছে আমাদের বারান্দার। ছোট দুটো টুল পেতে মাঝে মধ্যেই আমরা চা পান করি আর দুজনে স্বপ্নের কথা বলি। বিয়ের পরে একটা আব্দার করেছিলো নিতু। যদি কোনদিন আমাদের টাকা হয় তাহলে যেনো ওকে একবার সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাই! সত্যি কথা বলতে কি! আমি নিজেও কখনো সমুদ্র দেখিনি। আমার খুব ইচ্ছে করে এক গোধুলিবেলায় নিতুর হাত ধরে সমুদ্র জলে পা ভিজাবো। ও নীল রঙের শাড়ী পড়বে, ওর আঁচল বাতাসে উড়বে। আমি একদিকে পড়ন্ত সূর্যকে দেখবো অন্যদিকে আমার জীবনের জ্বলজ্বলে সূর্যকে সাথে নিয়ে। 
হিসেব করে দেখেছি যাওয়া আসা, হোটেলে থাকা খাওয়া সব মিলিয়ে দশ বারো হাজার টাকা লাগবেই। এই টাকাটা কতবার চেষ্টা করেছি যোগাড় করতে। কোননা কোন ভাবেই টাকাটা খরচ হয়ে যায়। একটা কথা বলা হয়নি। চার বছর আগে নিতু আর আমার ভালোবাসার ফসল অনির জন্ম। এরপর থেকে আমাদের জীবন এবং জীবনের গল্প অনিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। পাওয়া না পাওয়া সব ওকে নিয়েই।
প্রতিবার টাকা জমাতে জমাতে দশ হাজারের কাছে গেলেই একটা বিপদ কিংবা প্রয়োজন এসে সামনে দাঁড়ায়। একে এড়িয়ে টাকাটা ধরে রাখা আর হয় না। গত দুই বছর ধরে প্রতিমাসে বেতন থেকে পাঁচশত টাকা আলাদা করে আলমারিতে রাখা ছোট বক্সে রেখে দেই। এবার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি এই টাকা ভাঙবো না। নিতু আর অনিকে নিয়ে সমুদ্র দর্শনে যাবোই। গতমাসে দশ হাজার টাকা পূর্ণ হয়েছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে গুনে দেখি সাথে দিবা স্বপ্নে হারিয়ে যাই। এখন অবশ্য স্বপ্নে দুজন দুজনের হাত ধরিনা বরং দুজনে মিলে অনির দুহাত ধরে সমুদ্র জলে পা ভিজাই। 
মনে মনে ঠিক করেছি ওদের চমকে দেবো সবকিছু ঠিক করে। ছুটি নেয়ার চেষ্টা করছি। নিতুকে বলতেই ওর মুখে খুশীর ঝলক দেখতে পেলাম। আর চার বছরের অনিটা! পুরো বাসা জুড়ে প্রজাপতির মতো উড়ছে আর বলছে, কি মজা সমুদ্দ দেখতে যাবো, সমুদ্দ দেখবো (ও এখনো সমুদ্র বলতে পারে না। সমুদ্দ বলে।) ওর আনন্দ দেখে আমাদের চোখে পানি চলে এসেছে। আমি নিতুকে আমার বাহুডোরে টেনে নিলাম। ও আমার বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে। আর আমাদের পাকনা পাখিটা এসে দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে। এরচেয়ে বেশী সুখ আর কি বা চাওয়ার আছে?

নিতু জামাকাপড় গুছাচ্ছে। আমাদের ভালো কোন ব্যাগ নেই। দুজনে মার্কেটে গিয়ে একটা ব্যাগ কিনলাম। বিয়ের পর এই প্রথম বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও বেড়াতে যাবো। দুজনের মধ্যেই খুব এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। অকারণেই আমরা হাসছি, দুজনের চোখে চোখ পরলেই। অনিতো আশেপাশের বাসায় গিয়ে এরইমাঝে বলে এসেছে আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি। 
আমি ভয়ে ভয়ে আছি। সামনে কোন অযাচিত বিপদ বা প্রয়োজন সামনে এসে দাঁড়ায় কিনা! আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তদের সাধ আর সাধ্য কখনোই এক সুতোতে গাঁথা হয়ে উঠে না। অবশ্য এখনকার পরিবেশে নিজেদের নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাবার চাইতে মধ্যে মধ্য বাদ দিয়েই ভাবতে হয়।
চারদিন বাদে আগামী বৃহস্পতিবার রাতে আমাদের কক্সবাজার যাবার কথা। সব গোছগাছ শেষ। অফিসের এক কলিগের কাছ থেকে একটা ক্যামেরাও ধার করে এনেছি। 

অফিস থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে চা মুড়ি খাচ্ছি। এমন সময় দরজায় শব্দ। সাথে কলিং বেলের মুহুর্মুহ বেজে ওঠা। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো নিতু। পাশের বাসার রিতা ভাবি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকলেন। ভাবি আমার হৃদয়কে বাঁচান। ও সিড়িতে পরে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে, এখন বমি করছে। শুনে আমি হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে বললাম, ভাবি এক মূহুর্ত সময় নষ্ট করবেন না, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। পাঁচ বছরের হৃদয়ের বাবা বোকার মতো তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। মাসের শেষ পকেট খালি। এখন চিকিৎসার টাকা পাবেন কোথায়? ওনারাও আমাদের মতোই স্বল্প আয়ের পরিবার। 
একবার ভেবেছিলাম চুপ থাকি। কিন্তু নিতুর চোখে চোখ পরতেই যা বোঝার বুঝে নিলাম। আমি ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে কক্সবাজারের যাবার জন্য রাখা টাকাটা এনে নিতুর হাতে দিলাম। নিতু টাকাটা নিয়ে ভাবির হাতে দিয়ে বললো, ভাবি এটা রাখুন এরচেয়ে বেশি দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। 
ভাবি জানতেন আমাদের কক্সবাজার যাবার কথা। টাকাটা ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। নিতুর জোড়াজুড়িতে টাকাটা নিতে বাধ্য হলেন।

ভাই সহ আমি হৃদয়কে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলাম। তিনদিন পর হৃদয়কে নিয়ে বাসায় ফিরলে আমরা ওকে দেখতে গেলাম।
অনি আর হৃদয় খেলতে শুরু করেছে। ওদের নিষ্পাপ প্রাণবন্ত হাসির আওয়াজে আমরা সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন অনুভব করছিলাম। সবার অলক্ষ্যে আমি নিতুর হাত হাতে নিলাম। ওর গভীর স্পর্শ আমাকে অনেক কথাই বলে দিলো।

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট