এয়ারপোর্টের ভেতরে বাস থেকে নেমে চলন্ত সিড়ি দিয়ে উপরে চলে এলাম। চারিদিকে তাকিয়ে এয়ারপোর্টের সৌন্দর্য্য দেখছিলাম আর চমকিত হচ্ছিলাম। বিশাল বড় এই সিডিজি এয়ারপোর্ট। প্লেনের কমতি নেই যাত্রীরও কমতি নেই তবুও হৈ চৈ বিহীন অনেকটা নীরবে সমস্ত কার্যক্রম চলছে। চেকিংয়ের পর ইমিগ্রেশান পার হয়ে লাগেস বেল্টের কাছে দাড়ালাম, কিছুক্ষণ পর লাগেসগুলি পেলাম, দুটো ট্রলি নিয়ে এলো আনান। ব্যাগগুলো উঠিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে চলে এলাম এক্সিট এরিয়ায়। ওদের গাড়ি ছেড়ে দিলে আমি আর কাকা ছয় তলা থেকে তিন তলায় নেমে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে এলাম।রাস্তায় ছোট্ট কাঁচের এক রুমের টিকেট কাউন্টার থেকে কাকা একটা টিকেট কিনলো উনার টিকেট মাসিক হিসেবে আগেই কেনা। টিকেট দুটো ইলেকট্রনিক বক্সের মেশিনে এক দিকে ঢুকাতেই তা আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে এলো। সে টিকেট দুটো হাতে নিয়ে আমরা কোমর সমান গেট পার হয়ে একে একে বের হয়ে এসে মাটির নিচে নির্মিত ট্রেন স্টেশানের ভেতরে ঢুকলাম। সে এক অদ্ভূত ব্যাপার বাস্তবে না দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো। মাটির উপর দিয়ে চলছে নানা ধরনের গাড়ি নিচ দিয়ে চলছে ট্রেন। স্টেশানগুলিও অত্যাধুনিক এবং কম্পিউটারাইজড। এখনে ঘড়ির সময় ধরেই চলছে যেন সব। এয়ারপোর্ট মেট্রো স্টেশানে ট্টেনের অপেক্ষায় থাকলাম। পাসাপাসি দুটো ট্রেন লাইনে দু মিনিট পরপর ট্রেন চলাচল করে।একটা আপ অন্যটি ডাউন। এই ট্রেন লাইন শহরের নানা দিকে ছড়ানো। সোজা গন্তব্য না হলে লাইন বদলাতে হয়। বিভিন্ন লাইনের নাম সংখ্যা দিয়ে উল্লেখ করা আছে যেমন লাইন ১,২,৩,৪। ট্রেন এলে অটো দরজা খুলে যাচ্ছে আবার ত্রিশ থেকে চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে দরজা লক হয়ে যায় তবে শুনলাম কখনো কখনো ড্রাইভার দরজা নিজের কন্ট্রোলে নিতে পারে। আগে যাত্রীদেরকে নামতে দিতে হয় পরে উঠে সবই শৃঙ্খলের সাথে। আমরা ট্রেনে চড়লাম সিট খালি নেই দাড়িয়েও আছে অসংখ্য মানুষ অগ্যতা আমরাও রড ধরে দাড়ালাম। ট্রেনের ভেতরটা বেশ ঝকঝকে এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। দরজার উপরে দুপাসেই ইলেকট্রনিক বোর্ডে প্রতিটা স্টেশনের নাম লেখা আছে যে স্টেশানে থামবে পাঁচ সেকেন্ড আগে থেকেই সেখানে লাইট জ্বলে এবং লাউড স্পীকারে ফ্রেন্স ভাষায় স্টেশানের নাম বলে।
হঠাৎ চোখ পড়লো এক জোড়া যুবক যুবতীর দিকে ওরা দুজন কথা বলতে বলতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করছে শুধু একবার না বারবার সেকি আবেগঘন চুম্বন আমিতো এসব দেখে অভ্যস্ত না ফলে মাথা ঘুরিয়ে কাকার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম কাকা বাংলায় বললো এসব এখানে ডালভাত দেখছেননা কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না আপনি চুপচাপ দেখতে থাকেন ভুলেও কিছু বলেন না কিন্তু। আমি আর ভুলেও তাকাইনি। ডান দিকে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে দাড়িয়ে এক হাতে রড ধরে আছে অন্য হাতে এক মনে মোবাইল টিপছে বয়স বাইশ চব্বিশ হবে গায়ে হাতা কাটা ছোট্ট গেঞ্জি পায়ের দিকে দৃষ্টি গেল দেখি পরনেও জিন্সের একটা ছোট্ট হাফপ্যান্ট এত ছোট যে হিপের (বাংলায় যাকে বলে পাছা) উঁচু জায়গাটার নিম্নাংশ থেকে পুরো পা খোলা। আমি আবারো চোখ সরিয়ে নিলাম।দু এক জন হিজাবী মহিলাকেও দেখলাম। এরা সবাই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত কেউ কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। অনেককে গভীর মনোযোগের সাথে বই পড়তে দেখলাম। একজন পাগলকে দেখলাম ট্রেনের এমাথা ওমাথা ঘুরে বেড়াতে। যাহোক কিছুদুর আসার পর লাইন চেঞ্জ করে আবার অন্যদিকে অন্য স্টেশানে ঢুকে অন্য ট্টেনে চড়ে গন্তব্যে পৌছালাম। লুমিয়া স্টেশানে এসে এস্কেলেটরে উঠে দাড়ালাম। এস্কেলটরের ডান দিক ঘেসে দাড়িয়ে থাকছে সবাই বাদিকে একজনের যাওয়ার পথ খালি রাখতে হয় যারা চলন্ত এস্কেলেটরেও দ্রুত যেতে চায় তাদের জন্য। স্টেশানের ভিতরে ল্যান্ডিং এবং লবিতে দেখলাম দু একজন হকার দ্রব্য বিক্রি করছে একজনকে দেখলাম গীটার বাজিয়ে গান গাইছে আমদের তাড়ার জন্য দ্রুত সরে এলাম কাকার কাছে শুনলাম গান শেষে অনেক শ্রোতা দু এক ইউরো দিয়ে যায়। এটা অনেকের পেশা তবে এরা আরো নামীদামি গায়ক হবার জন্য চেষ্টা করে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে মেট্রো ট্রেন বা বাসের টিকেট ঘন্টা হিসেবে বা মাস হিসাবে কিনতে হয়।সময় শেষ হয়ে গেলে টিকেট আবার কিনতে হয়।
ঠিক বিকেল আটটায় হোটেলে পৌছালাম।
বড়সড় একটা রুম ভাড়া করেছে কাকা আমাদের চার জনের পরিবারের জন্য খুব একটা অসুবিধা হয়নি। দুটো বেড একটা ডাবল একটা সেমি ডাবল। বেশ সস্তার জন্য এই এক রুম নেওয়া। তবুও আমাদের টাকায় প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় চার হাজার টাকা।
প্যারিসে তখনো রাত হয়নি।আগষ্ট মাসের শেষ দিকে ওখানে সন্ধ্যে হয় সাড়ে নটায়। হোটেলে পৌছেই আনোয়ার কাকা বললো একটু রেষ্ট নিয়ে চলেন আইফেল টাওয়ার দেখে আসি। মেট্রোতে গেলে পনের মিনিট লাগবে। আমরা সুটকেসগুলো না খুলেই ঢাকা থেকে যে পোশাক পরে এসেছি সেভাবেই ফ্রেস হয়ে নটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম
আইফেল টাওয়ার
-----------
বিশ মিনিটের মধ্যেই আইফেল টাওয়ারের সামনে চলে এলাম মেট্রোতে করে। মনুমেন্টের মত কংক্রিটের তৈরি সামান্য উঁচু ট্রোকেডরো চত্বরের পাসেই মেট্রো স্টেশান 6 থেকে রাস্তার উপরে উঠলাম। মনুমেন্টের সামনে পাকা চত্ত্বরের উপর উঠে এলাম। এই চত্ত্বরের নামও ট্রোকেডরো আসলে ঐ এলাকার নামই এটা। ওখান থেকে একটু দূরে আইফেল টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। তখন সন্ধ্যা হয় হয় লাইটগুলো এখনো জ্বলে উঠেনি।আইফেল টাওয়ার দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমরা ছবি তুলতে ব্যস্ত হলাম।খানিকটা পর আলো জ্বলে উঠলো আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য্য বাড়তে লাগলো। এই চত্তরে অনেক লোকের আনাগোনা। ফলে এখানে অনেক হকার দেখা গেল এরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। দুজন বাংলাদেশীকেও দেখলাম। পুলিশের আগমন টের পেয়ে ওরা দৌড় দিল ফলে কথা বলতে পারলাম না। এই সব বাংলাদেশীরা দশ বারো লাখ টাকা খরচ করে এসে এই হকারি কেন করে আমি বুঝতে পারছি না। তবে কেন আসে এবং এত কষ্ট করে পরে বুঝেছিলাম তা অন্য পর্বে লিখব আশা করছি। সে যাই হোক
ধীরে ধীরে ওখান থেকে নেমে আইফেল টাওয়ারের দিকে চললাম।
আইফেল টাওয়ার এলাকায় ঢুকতে ব্যাগ চেক করা হলো। আমরা টাওয়ারের চারদিক ঘুরে দেখলাম। বিংশ শতাব্দীর বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের এক আশ্চর্য ছিল এই আইফেল টাওয়ার।১৮৮৪- ১৮৮৯ সালে লোহার তৈরী টাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে উর্দ্ধমুখি তাকিয়ে দেখলাম এর উচ্চতা, ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেল। নিরেট লোহা দিয়ে তৈরী এর স্ট্রাকচার। নানা ধরনের অতি আশ্চর্যের আবিস্কারের ফলে এটি এখন আর আশ্চর্য নেই। অনেকে মনে করে আমাদের দেশের ইলেক্ট্রিক টাওয়ারের মতই এটা দেখতে এত আদিখ্যেতা কেন।আসলে এর সৌন্দর্য দেখতে হলে চলে যেতে হবে সোয়াশো বছর পূর্বে।সবে মাত্র ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছে এই সময় স্বল্প উন্নত যন্ত্র দিয়ে তৎকালীন সময়ে এই রকম একটা উচু টাওয়ার তৈরী করা ভাবলে অবাক হতে হয়। তাছাড়া এর আর্কিটেকচারাল ভ্যালু সাংঘাতিক রিচ।এই টাওয়ারে এখন নানা ধরনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক যন্ত্রাংশ ও সার্ভার সেটিং করা হয়েছে। টিকেট কেটে লিফটে চড়ে আইফেল টাওয়ারের চুড়ায় উঠা যায়।ওখান থেকে সারা প্যারিসের সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হওয়া সহজ ব্যাপার। আলোকছটায় প্রজ্জ্বলিত আইফেল টাওয়ার দেখে ফিরে এলাম হোটেলে তখন রাত বারটা।
চলবে.....।