আব্দুর রহমান সাহেব বন্দী পাক চৌকিতে। গত তিন দিনে তাঁর ওপর দিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের ষ্টিম রোলার চলেছে। শারীরিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত তিনি। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে কিন্তু শরীরের ব্যথায় ঘুমাতেও পারছেন না। তারপরও সন্ধ্যার পর থেকেই ঘুমের ভান করে রূমের এক কোণায় মেঝেতে শুয়ে আছেন আর স্ত্রী সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা করছেন। রাত ১১টার পর চারদিকের সব আলো নিভিয়ে দেয়া হলো।
অন্ধকারের মধ্যেও তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন দু'জন সিপাহী পাহারা দিচ্ছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, তারা ফিসফিস করে পরষ্পর কথা বলছে। তিনি কান খাড়া করলেন, এখন শুনতে পাচ্ছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না। চারদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে, আপাতত আলো জ্বলার সম্ভাবনা নাই।
এবার উঠে পা টিপে টিপে এগুতে লাগলেন গেটের দিকে। হ্যাঁ, এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছেন তিনি।
১ম ব্যক্তিঃ অপারেশান শুরু হোয়া। ইন সাবকো মিত্তিকে সাথ পিছাল দো।
২য় ব্যক্তিঃ হামারে সাথ কন্সপিরেসী? ইতনা বড়া হিম্মত হো তোম কেহতে হো, এবার কো সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। দেখো আভি কিতনে মজা! আভি পিঞ্জিরে মে ছাড়তে রাহো।
১ম ব্যক্তিঃ আজ এক অফিসার কো কেহতে শুনা কি কালুরঘাটসে আজাদী কি এলান কিয়া। শালা, বাঙ্গালী কো মালুম নেহি কি পাক আর্মি কেয়া চিজ হ্যায়।
২য় ব্যক্তিঃ শুনায়ে কি কাল এক বকরা কা বলিদান হোগা। বকুল মোল্লাসে এক বিরাট বাহিনী বানানে কা কাম শুরু হোয়া।
যা বুঝার আব্দুর রহমান সাহেবের বুঝা হয়ে গেছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, মৃত্যু তো নিশ্চিতই। দেখা যাক চেষ্টা করে কিছু করা যায় কিনা। অন্ততপক্ষে যে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের কথা তিনি জানতে পেরেছেন তা স্থানীয় লিডারদেরকে জানানো দরকার। আর যদি কোনোভাবে বাপের ব্যাটা মেজরের সাথে সাক্ষাৎ করা যায় তাহলে সব খুলে বলতে হবে।
তাঁর মন বলছে এবার কিছু একটা হবেই। মাত্র কয়েকদিন আগেই বঙ্গবন্ধু সকলকে যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত হতে বলেছেন। কিন্তু অস্ত্র ছাড়া ঘটি বাটি দিয়ে তো আর যুদ্ধ হয় না। এবার যেহেতু আর্মির একজন মেজর ঘোষণা দিয়েছেন কাজেই কিছু একটা নিশ্চিত হবে। এখন বাকি শুধু সকলে একত্র হওয়া।
তিনি ঘরের কোণায় ফিরে গেলেন। সেখান থেকে সিপাহীকে ফিসফিসিয়ে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে এলেন সামনে। বললেন, বাথরূমে যাওয়া প্রয়োজন। একজন মুখ ভেংচিয়ে ঘরের মধ্যেই কাজ সারতে বললেন। তিনি কাতরভাবে বুঝাতে লাগলেন, এটা তার অভ্যাস নাই। অবশেষে অন্যজন গেট খুলে তাকে বাথরূমে যেতে দিলো আর বলল, কাজ সেরে দ্রুত ফিরতে।
তিনি ভেতরে ঢুকেই আল্লাহর নাম নিয়ে ভেন্টিলেটরে হাত দিলেন। সময় অল্প, খুব দ্রুত কাজ সারতে হবে। নতুবা একটু পরেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হবে।
পুরনো বিল্ডিং। একটু চাঁড়া দিতেই ভেন্টিলেটরের বড় জানালাটা খুলে গেলো। কাকতালীয়ভাবে তা এতো দ্রুত হলো যে, তিনি কিছুটা ভড়কেই গেলেন। আস্তে করে জানালার ভার সামলে তা নিচে নামিয়ে রেখে বের হয়ে পড়লেন খুব সাবধানে।
একবার শুধু পেছন ফিরে দেখলেন। আবছা আলোয় যা দেখা যায় তা দিয়ে দেখে অনেকটা হামাগুড়ি দেয়ার মতো করে দ্রুত দৌড় দিলেন বাগানের পাশে দিয়ে। ধরা পড়ার ভয়ে রাস্তা এড়িয়ে চললেন তিনি।
মূল গেটের কাছাকাছি এসে দেখতে পেলেন দু'জন বিশালদেহী সিপাহী ভারী অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে। চেহারা দেখেই অনুমান করলেন, এরা বেলুচ রেজিমেন্টের হবে। বেলুচরা সাধারণত পাঠানদের চেয়ে দূর্ধর্ষ হয়।
সেখান থেকে কিছুটা বাঁক ঘুরে একটা বড় ড্রেনের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। খেয়াল করে দেখলেন ড্রেনটা সামনের পাঁচিলটা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে বাইরে। নেমে পড়লেন ড্রেনে খুব সাবধানে। আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলেন। বিশ্রী দূর্গন্ধে বমি আসতে চাচ্ছিল কিন্তু পেটে কিছু থাকলে তো! গত তিনদিন পেটে তেমন কিছু পড়েনি। বাঙ্গালী মানুষ, সারাদিনে দুইপিস রুটি আর এক দলা গুড় খেয়ে কি চলতে পারে?
অবশেষে পাঁচিলটা পেরিয়ে বাইরে এসে যেনো হাঁফ ছাড়লেন। কিন্তু এখনই ওপরে ওঠা যাবে না। এখনও ঝুঁকি আছে। মূল গেটটা এখান থেকে কাছেই। সুতরাং, আরো কিছু দূর যাবার পর ড্রেন থেকে বের হতে হবে।
কিছুটা এগিয়েছেন, হঠাৎ পায়ে কিছু একটা ধাক্কা লাগাতে শব্দ হয়েছে। মাথা তুলে দেখলেন, একজন সিপাহী এদিকে তাকিয়েছে। ভয় পেয়ে গেলেন। দেখলেন, ঐ সিপাহী পাশের সিপাহীকে কিছু একটা বলে এদিকেই আসছে। এবার তো দম বন্ধ হবার পালা। চিন্তা করছেন উঠে দৌড় দিবেন কিনা। কিন্তু সেটা করতে গেলে তো এক গুলিতেই ঝাঁঝড়া। সিদ্ধান্ত নিলেন দম বন্ধ করে বসেই থাকবেন শেষ দেখার জন্য। সিপাহীটা দ্রুত এগিয়ে এলো একদম কাছাকাছি। এবার কাঁধ থেকে অস্ত্র নামিয়ে হাতে নিয়েছে।