সুশীল আর জাহিদ চোখ বড়ো বড়ো করে আছে। হীরা ভাইয়ের অবস্থাও একই। মনে হয় এই সময়ের ভেতর তারা একটা ঢোক পর্যন্ত গেলেনি। অচিনদেব একটু থামতে সুশীল হামলে পড়লো,‘তাহলে আপনি একজন অবতার?’ সে তার দুই হাতের তালু ইতিমধ্যে একত্র করে প্রনামের ভংগি করে ফেলেছে।
‘হ্যাঁ আমি এখন একজন অবতার তবে তোমরা যেমন ভাবো তেমন নয়।তোমাদের হিন্দু ধর্মে দেবী তার অবতারের ওপর ভর দিয়ে মর্তে আসেন। অথচ আমার সাথে আমার দেবী ডোরিনিয়ার কথা হলেও তাকে কোনদিন দেখিনি। সে স্বর্গে থাকে, আমি পৃথিবীতে। চল্লিশ বছর যেদিন পূর্ন হয়েছিল তখন আমি কোলকাতার বেহালার বাড়িতে শুয়ে আছি। তখন গভীর রাত। হঠাৎ আমার মনে হলো বাড়িটা দুলছে।আমি ঘুম ভেঙে দেখলাম চারপাশ অন্ধকার, অথচ আমি বাতি জ্বালিয়ে ঘুমোই। কোথাও কোন শব্দ নেই। চারপাশে যেন আদিম নৈঃশব্দ। সেই দোদুল্যমান অবস্থায় আমি বহুদুর থেকে আসা কোন হ্রদের পানির শব্দ শুনলাম। যেন সেই পানি বহু নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে।সেই সাথে মৃদু টুংটাং।আমার বুকের ভেতর কি একটা শিহরন বয়ে গেল আমি বোঝাতে পারবোনা।এগারো শো বছর আগের সেই শিহরন আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আমি সেই টুংটাং শব্দ শুনলাম, তারপর চরম বিশ্ময়ের মধ্যে বুঝলাম ওটা কোন টুংটাং নয়। একজন নারীর গলার স্বর। এটা কিভাবে সম্ভব! একজন নারী এমন অপরূপ গলায় কিভাবে কথা বলতে পারে। এতো মধুর সেই সুর আমি পাগল হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো সেই সুর শোনার কারনেই আমার বয়সটা সেখানেই থেমে গেল। আমার শরীরের চামড়া টানটান হয়ে গেল। আমার মস্তিস্কের মৃত নিউরনগুলোও যেন প্রান ফিরে পেল, শরীরের কোষগুলোও যেন সজীব হয়ে উঠলো। এ কোন সাধারন নারী কোনভাবেই নয়। সেই কন্ঠস্বর শোনার সাথে সাথেই আমার জৈবিক কামনা এমন তীব্র আকার ধারন করলো যে সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। তোমাদের পার্বতীকে প্রথম দেখার পর শিবের যে অবস্থা হয়েছিল আমার সেই অবস্থা হলো। আমার মনে হলো আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো। না, আমি স্থির হলাম অবশেষে। দেবী শুধু একটি কথাই বলেছিল সেই রাতে,‘অচিনদেব তুমি পেরেছ আমাকে জয় করতে।’ অথচ সেই কন্ঠস্বরকেই আমি ধারন করতে পারিনি। একটি বাক্য ধারন করতে গিয়ে আমাকে একটা রাত পাগল হয়ে যেতে হয়েছে।ভাবলাম এভাবে যখনই দেবী আমাকে নির্দেশ দেবে আমি তো তা ধারন করতে গেলে শেষ হয়ে যাবো।দেবীর কন্ঠস্বর আমার জৈবিক তাড়না বাড়িয়ে দেয়। তাহলে তার উপাসনা করবো কিভাবে? আমি তো তার প্রেমে পড়ে যাবো। অবশ্য এই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়িই। দেবীও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল আমার অবস্থাটা। এর পর যখনই দেবীর নির্দেশ পেয়ে আমি পাগল হয়ে যেতাম সেই রাতেই স্বপ্নে আমার কাছে চলে আসতো অসাধারন রূপসী কোন নারী। আমিও নিবৃত্ত হয়ে যেতাম।এভাবেই শুরু, তারপর এগারোশো বছর একইভাবে পথ চলছি। এখনও সেই কন্ঠস্বর শুনলে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। বিশ্মিত হয়ে ভাবি, কিভাবে একই কন্ঠস্বর বারবার আমাকে প্রভাবিত করে। তাহলে ওই উপাসকদের দোষ দেব কিকরে? তারা শুধু শুনেছে তার রূপের কথা, শোনেনি তার কন্ঠস্বর। আর তাতেই তারা তাকে দেখার জন্য জীবন দিয়ে দিয়েছে। তারা পেয়েছিল আমারই মতো অসীম জীবন, পেয়েছিল সুখের জীবন তারপরও তারা একটাই জিনিষ দেখতে চেয়েছিল জীবনে যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের আজন্ম আকর্ষন থাকে যেমন ছিল আদম আর হাওয়ার। স্বর্গের সুখ তাদের ত্যাগ করতে হয়েছে একটা মাত্র গন্ধম ফলের লোভ সংবরন করতে না পারার ফলে।আমাদের ধর্মে সেই গন্ধম ফল হলো অপরূপা ডোরিনিয়া। আমার দেবী। আমার প্রার্থনার একমাত্র উপাস্য। আমার সহস্র বর্ষীয় জীবনে আর কোন ইচ্ছা নেই। পৃথিবীর একমাত্র লক্ষ্যই আমার শুধু তার উপাসনা করা আর তাকে সুখী করা। আমি জানিনা আমার মতো আর কতোজন তাকে এই মুহুর্তে ভাবছে।’ একটু থামলো অচিনদেব।তার চেহারায় বিভ্রান্তি ফুটলো একটু।মনে হলো দ্বিধা করছে সে কথাটা বলতে, পরক্ষনে সামলে নিল।‘সত্যি কথাটা বলি।হীরা, আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত।গত এগারোশো বছর বেঁচে থাকা কিন্তু খুব সাধারন ব্যপার নয়।আমি কিন্তু তোমার মতোই একজন মানুষ, কেবল দেবীর আনুকুল্যে আমি হাজার হাজার বছর বেঁচে আছি এবং থাকবো।তোমাদের মৃত্যুর লাখ বছর পরও এখানে বা পৃথিবীর কোথাও আমাকে থাকতে হবে।এই ভাবনাটা আমাকে কাহিল করছে।আমি আর বইতে পারছিনা এই শেষহীন জীবন।এর ভার অনেক।আমি ইচ্ছে করলেই আত্মহত্যা করতে পারছিনা।কারন আমি তো অমর।দেবী না চাইলে আমি মরতে পারবোনা।কারন আমি তার বার্তাবাহক,তার সব নির্দেশ আমি পালন করি।তাছাড়া আমি তার প্রেমে পড়ে গেছি হীরা যা প্রচন্ড পাপের।একজন মানুষ হয়ে আসলে এই কন্ঠস্বরকে অবজ্ঞা করা অসম্ভব।গত এগারোশো বছর ধরে আমি কামনালিপ্ত যা আমি প্রকাশ করতেও ভয় পাই।ভয় হয় দেবী হয়তঃ ব্যপারটা জানতে পেরেছেন।তিনি ক্ষমারও দেবী।তাই হয়তঃ আমি বেঁচে আছি এখনও নাহয় এতোদিন তো নরকে থাকার কথা।বিশ্বাস করো হীরা ঘুমের মাঝে আমি তাকে দেখি।কষ্টে কান্না করি।এই কষ্ট কাউকে বলতেও পারিনা।কারন কেউ আমার সমসাময়িক নয়।তাই তোমাকে বললাম।আমি দেবীর প্রেমে পড়েছি এটা এখন আমি মাঝেমাঝে জোরে জোরে উচ্চারন করি।দেখি কি বলে দেবী।আমি তো উপাসক নই, আমি ম্যাসেঞ্জার।সে কিভাবে এই সমস্যার সমাধান দেবে জানিনা।গত পঞ্চাশ বছরে সে কোন জবাবও দেয়নি।মনে হয় কোনদিন দেবেওনা।তাকে বলি আমি তাকে দেখতে আসবো একদিন।একবার হলেও আমি তাকে দেখবো।শুধু এক সেকেন্ডের জন্য হলেও তাকে দেখবো।মাত্র এক সেকেন্ড।দেবীর রূপ আমি একনজর দেখবো।তারপর আর চাইনা।তার শারিরিক সৌন্দর্য দেখে আমি আমার জীবনটাকে শীতল করে দেবো।হোক পাপ, হই আজন্ম নরকে পতিত।তবু তাকে আমি একনজর দেখতে চাই।’
হীরাভাই হাত তুললো,‘তুমি বললে যে তুমি তাকে দেখতে যাবে।তাকে কোথায় দেখতে যাবে? স্বর্গে যাবার পথ কোনটা?’
অচিনদেব কি যেন ভাবছে।ভাবছে এদেরকে কথাটা বলা যায় কিনা।তার চোখের পাতা কাঁপছে।তারপর কাঁধ নাচিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে।খোলা দরজায় গিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকালো।সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেই।প্রকৃতির হালকা আলোর আভা ছাড়া ঘরের ভেতর কেবল মোবাইলের আলো জ্বলছে।‘তার কাছে যাবার একটা পথ আছে।তোমাদেরকে বলি কিন্তু তোমাদের প্রমিস করতে হবে তোমরাই শেষ ব্যক্তি যাদের আমি এই কথাটা বললাম।’
‘আমি প্রমিস করছি।’ হীরাভাই বললো।‘আর ওরাও কথাগুলো গিলে ফেলবে আমি যদি ওদের বলে দেই।’
অচিনদেব ঘুরলো,‘এখান থেকে আরো অনেক পথ দুরে পাহাড়ের উপত্যকায় একটা জায়গা আছে পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।প্রাচীর এতো উঁচু যে একটা পর্বতের সমান।কারো বোঝার সাধ্য নেই যে সেটা পাহাড় নাকি প্রাচীর।পাহাড়ে ওঠা যায় কিন্তু প্রাচীরে ওঠার মতো কোন জিনিষ নেই কারন সেই প্রাচীরের গা অত্যন্ত মসৃন। আর ওপরটা ফাঁকা নয়, পাথর জুড়ে জুড়ে ছাউনির মতো করা।সেটা প্রাকৃতিক নাকি মনুষ্যনির্মিত কেউ বলতে পারেনা।ওখানটাতে যাবার মতো একটাই পথ আছে।আমাদের ধর্মে ওটাই হলো একমাত্র পবিত্র স্থান যা সরাসরি দেবীই দেখাশোনা করেন স্বর্গ থেকে।যেহেতু আমি ম্যাসেঞ্জার তাই আমি জানি।ওখানে বিশাল উদ্যানের ভেতর এক সাদা বাড়ি আছে যার সাতটা খিলানের মতো দরজা।মাঝখানের দরজাটা অন্য ছয়টা দরজা থেকে অনেক বড়ো।পুরো বাড়িটা অজানা কোন কিছু দিয়ে বানানো যার গা থেকে আলোকচ্ছটা নির্গত হয়।এই বাড়িটার ভেতর দিয়ে দেবী সরাসরি চলে আসেন পৃথিবীতে।যদিও আমি কেবল শুনেছি কিন্তু যাচাই করে দেখার সাহস নেই।একদিন যাবো বিষয়টা নিশ্চিত হবার জন্য।’
হীরা ভাই মোচড় দিয়ে উঠলো।‘অচিনদেব তুমি আমাকে কিন্তু অতিমাত্রায় উৎসাহী বানিয়ে ফেলেছো।এর আগে তোমার সাথে এতোদিন ছিলাম কিন্তু এতো কথা বলোনি।’
‘কারন তখন তোমার বয়স ছিল কম।এসব কথা তুমি ধারন করতে পারতেনা।তাই বলিনি।’
হীরাভাই একটা সিগারেট ধরালো,‘কতোজনকে এ পর্যন্ত তুমি তোমাদের ধর্মে কনভার্ট করতে পেরেছো অচিনদেব?’
‘খুবই সামান্য।তাছাড়া আমি ঠিক ম্যাসেঞ্জার হতে পারিনি মনে হয়।দেবী যাকে একবার দুত বানান তাকে সারাজীবন দুত হয়েই থাকতে হয়, তাই রয়ে গেছি।তানাহলে কবেই আমার দুতের চাকরি চলে যেত।আমি গৌরের মতো নিবেদিতপ্রান হতে পারিনি।আমার দীর্ঘ জীবনটাকে আমি ভোগ করেছি বেশী।খুব কমই আমি মানুষের কাছে গেছি আমাদের ধর্মের বার্তাবাহক হয়ে।বেশীরভাগ সময়ই আমি অনন্ত যৌবনকে ভোগ করেছি নানাভাবে।দেবীর দেয়া সুগন্ধ অপব্যবহার করেছি।তবে তিনমাস আগে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’
‘কি সিদ্ধান্ত?’ জিজ্ঞেস করলো হীরা ভাই।মোবাইলের আলোতে সে সরাসরি তাকিয়ে আছে অচিনদেবের দিকে।
‘আমি আর এই অনন্ত জীবন চাইনা।মুক্তি লাভ করবো এই জীবন থেকে এবং সেটা খুব শীগ্রি।’
‘কিভাবে সম্ভব সেটা?’
‘একটাই পথ দেবীর ওই সাদা বাড়িতে গিয়ে দেবীর সাক্ষাত প্রার্থনা করা।আমি সেখানে যাব।দেখা করবো দেবীর সাথে।আমার দেবী।আমার প্রেমিকা।আমি তাকে ভালবাসি।আমি তার সাথে থাকতে চাই।এছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই এই জীবনে।’
‘কিন্তু সেতো ভয়ানক পাপের কাজ!’
‘আমি জানি।কিন্তু এছাড়া আমার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।এই অসীম জীবনের একটা পরিসমাপ্তি দরকার।যদি দেবী চান তবে আমাকে তার কাছে টেনে নেবেন।যদি চান তবে আমার মৃত্যু দেবেন।সেটা তার বিবেচ্য বিষয়।’
হীরা সুশীল আর জাহিদ নিশ্চুপ।তারা এমন একটা জায়গায় এসেছে যা তাদের মাতৃভুমি থেকে অনেক দুরে।এমন কিছু দেখেছে আর শুনেছে যা কখনও দেখেনি বা শোনেনি।একটা অদ্ভুত অনুভুতি তাদের মনজুড়ে।হীরা ভাই উশখুশ করছে দেখে অচিনদেব বললো,‘আমি বুঝতে পারছি তুমি কি বলতে চাচ্ছো।’
হীরা ভাই থেমে গেল মাঝপথে।অচিনদেব বললো,‘তুমি আমার সাথে যেতে চাইছো আমাদের পবিত্র স্থানে,ঠিক কিনা?’
হীরা ভাই মাথা নাড়লো,‘শুধু আমি নই, আমরা তিনজনই।’
অচিনদেব মাথা নাড়লো,‘সেটা সম্ভব নয়।খুবই ঝুঁকিপূর্ন হবে সেটা তোমাদের জন্য।আমি নিজেই সেখানে কখনও যাইনি।কেবল শুনেছি, আর কিভাবে যাওয়া যায় তা জেনেছি।আমি জানিনা দেবী আমার ভাগ্যে কি রেখেছেন।আমার জীবনের বিনিময়ে আমি তাকে একবারের জন্য দেখতে চাইছি।’
‘আমরাও তাকে দেখতে চাইছি।’
‘তুমি কেন দেখতে চাইছো?তুমি কখনও তার কথা শোনোনি, তার সাথে কথা বলোনি।আমার কথা শুনেই তার ব্যপারে আগ্রহী হয়ে উঠলে?তাছাড়া তুমি একজন মুসলিম, আর ওই ছেলেটাও।’ অচিনদেব আঙুল তুলে জাহিদকে দেখালো।
‘তাতে কিছু যায় আসেনা।’ হীরাভাই বললো,‘যেকোন মূল্যে আমরা ওই পবিত্র স্থানে যেতে চাই।দেখতে চাই তোমার দেবীকে যিনি অপার সৌন্দর্যের অধিকারিনী।’
‘আমি নিশ্চিত নই কি ঘটবে আমার ভাগ্যে।’ অচিনদেব বললো, তার চেহারায় চিন্তার ছাপ।‘তুমি যদি যাও তবে তোমাকে লুকিয়ে থেকে দেখতে হবে এবং যদি আমার কিছু ঘটে যায় তবে পালিয়ে আসতে হবে সেখান থেকে।’
‘অবশ্যই আমরা কোন ঝুঁকি নেবোনা যা তোমার ও আমাদের জন্য ক্ষতিকর।আমরা দুর থেকে তোমাকে অনুসরন করবো যেন আমরা তোমাকে চিনিনা।দুর থেকেই দেখবো যতোটুকু দেখা যায়।’
মাথা নাড়লো অচিনদেব,‘সেজন্য রাতের বেলা যেতে হবে আমাদের।মেনে নিলাম তোমাদের কথা।যেহেতু আমি নিজে নিজের ভাগ্য সম্পর্কে নিশ্চিত নই তাই তোমাদের বিষয়টা তোমরাই সামলাবে।কোন শব্দ বা কোন কথা যেন তোমরা সেখানে না বলো বা না করো এটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’
‘করলাম,’ হীরাভাই বললো,‘তুমি নিশ্চিত থাকো আমাদের ব্যপারে।তোমার কোন ক্ষতি আমরা হতে দেবোনা আমাদের জন্য।বলো কবে যেতে চাও?’
অচিনদেব কোন চিন্তা না করেই বললো,‘কালকেই।’ এটা সে আগে থেকেই ভেবে রেখে দিয়েছিল।
পাঁচ
গত এগারোশো বছরের কুটিরের মায়া ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে এলো অচিনদেব।তার পিছু পিছু হীরা ভাই, সুশীল আর জাহিদ।শেষবারের মতো ফিরে তাকালো পাহাড়ের ওপরে নীল আকাশের পটভুমিতে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের কুটিরটার দিকে।সামনে অনির্দিষ্ট।চারজন কোন বলেনি সকাল থেকে।কেবল জাহিদ একটু বিব্রত ছিল বিষয়টা নিয়ে।ওর চিন্তা ছিল ফিরে যাবার, কিন্তু সুশীল আর হীরাভাইয়ের অতি উৎসাহে সাড়া দিতে গিয়ে তাকে তাদের সাথে যেতে হচ্ছে।গতরাতে কেবল কিছু ফলটল দিয়ে রাতের খাবার খেতে হয়েছে।এভাবে কখনও রাতের খাবার খায়নি জাহিদ।সকালেও অজানা কিছু রসালো ফল দিয়ে ব্রেকফাস্ট করেছে।পানি খেয়েছে, ইচ্ছে করছে বাড়িতে যেমন পেটভরে পরোটা ডিম ভাজি খায় তেমন কিছু খেতে।আসলে মানুষ যতোই প্রকৃতি প্রকৃতি করুক না কেন, শহরের মানুষ কখনও প্রাকৃতিক হতে পারবেনা।আসলে মানুষ জাতিটাই রোবট হয়ে গেছে।এখন তারা মানুষের তৈরি করা খাবার ছাড়া প্রাকৃতিক খাবার খেতে ভুলে গেছে যে কারনে তাদের ভেতর নানা রোগ বাসা বেঁধেছে।পশুপাখি ফল খায়, মানুষ খায় হটডগ, পিজা, নুডুলস, কফি, কাবাব।ফলে মানুষের ভেতর যে প্রাকৃতিক বল ছিল এখন তা নেই।গত এগারোশো বছর ধরেই ফল খেয়ে জীবন ধারন করছে অচিনদেব।তার ভেতর যে শারিরিক আর মানসিক শক্তি আছে মনে হয় তার চারভাগের একভাগ শক্তিও নেই ওদের কারো ভেতর।তাছাড়া সে তো একজন বার্তাবাহক, সরাসরি দেবীর ক্ষমতা তার হাতে।
অনেক দুর্গম পথ পার হচ্ছে ওরা।জঙ্গলই শেষ হতে চাইছেনা। কুটির থেকে বের হবার পরপরই আলাদা হয়ে গেছে অচিনদেব।এমনভাবে হাঁটছে যেন তাদেরকে চেনেইনা সে।কুটির থেকে বেরুবার আগে সে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করেছে।বিদায় নিয়েছে সকলের কাছ থেকে।বারবার একটা কথাই বলেছে যদি দেখে তার কিছু ঘটে গেছে তবে তারা যেন যতো দ্রুত পারে ওই জায়গা ত্যাগ করে নিরাপদে সরে পড়ে।ওরা মাথা নেড়েছে কিছু না বুঝেই।
দুর্গম পথ যে এতোটা দুর্গম হবে ধারনা করতে পারেনি ওরা।দুপুর পার হয়ে বিকেল হয়ে আসছে তবু জঙ্গলই শেষ হয়না।মাঝে মাঝে জঙ্গলের ভেতরই চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে ওদের।ভেবেছিল কোথাও জঙ্গল ফাঁকা হয়ে আকাশ দেখা যাবে, কিন্তু না, এদিকটায় বনের মাথাগুলো আরো ঘন হয়েছে।কয়েকটা ছোট নালা পেরুতে হয়েছে ওদেরকে।বিকেলের শেষ দিকে আবার থামলো অচিনদেব, পেছনে তাকালো। সে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে পড়েছে।কি একটা আপেল মতো ফল চিবুচ্ছে।জাহিদ বসে পড়লো।হীরাভাই তার ব্যাগ থেকে দু’দিন আগের একটা পাউরুটি বের করলো। এটার কথা মনে ছিলনা তার।হোটেল থেকে একটা জেলির কৌটোও কিনেছিল সে।ওটা দিয়ে তিনজনের খাবার হয়ে গেল মোটামুটি।ব্যাগে পানির বোতল ছিল।বোতলটা খালি করে ফেললো তারা।এখন পানি তেষ্টা পেলে নালার পানিই খেতে হবে তাদের।দেখতে পেল অচিনদেব আবার হাঁটতে শুরু করেছে।ওরাও উঠে পড়লো।সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে জঙ্গল পার হয়ে একটা পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা।বিকেলের শেষ সুর্যের আলো ছিটকে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীতেই যেন স্বর্গ দেখতে পাচ্ছে ওরা।হীরাভাই ফিসফিস করে বললো,‘আমার মন বলছে এসে গেছি সেইখানে যেখানটাতে আসার কথা আমাদের।’
সুশীল আর জাহিদ হীরাভাইয়ের দিকে তাকালো।ওদের চোখে ভয় নাকি উত্তেজনা বুঝতে পারলোনা হীরাভাই।তবে দু’জনই যে বিষয়টা দেখার জন্য মুখিয়ে আছে এটা সত্যি।ওরা এমন একটা জায়গায় এসে গেছে যেখানটাতে আসার জন্য লাখ লাখ রুপি এ পর্যন্ত খরচ করেছে ওরা।এসব জায়গায় এর আগে কখনও মানুষের পা পড়েছে কিনা জানা নেই ওদের।সম্ভবতঃ এখানটাতে কখনও কোন গ্রাম বা উপজাতীয়দের বসতি গড়ে ওঠেনি।তেমন কোন লক্ষন চোখে পড়েনি পথে।এখানকার আকাশ পরিস্কার নীল, তাতে সাদা মেঘ।নীল আকাশের পটভুমিতে লাল পাহাড়ের সারি বহুদুর চলে গেছে।এমন দৃশ্য কেবল বইয়ের পাতায়, ছবিতেই দেখা যায়।পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছে অচিনদেব।ওপরে যাবার কোন রাস্তা নেই আর।পথ এখানেই শেষ।সাধারন পাহাড়ের গায়ে কোন না কোন পথ থাকে বেয়ে ওঠার। এটার গা একেবারে মসৃন।সবচেয়ে বড়ো ব্যপার এর গায়ে কোন উদ্ভিদও গজিয়ে ওঠেনি।সাধারনত পাহাড়ের গায়ে নানা ধরনের ফুলের গাছ, প্রাচীন বৃক্ষের জন্ম হয়।এটা একদম ন্যাড়া পাহাড়।
অচিনদেব জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে দু’হাত মেলে আছে।দুর থেকে বোঝা যাচ্ছেনা সে কি করছে।ওরা কেউ জঙ্গল থেকে বের হয়নি।অচিনদেবের কাছ থেকে ন্যুনতম দু’শো হাত দুরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে ওরা।জঙ্গল থেকে বের হলেই যে কেউ দেখতে পাবে তাদের।
‘আমরা দেবীর চোখ এড়াতে চাইছি।’হঠাৎ সুশীল বললো,‘এটা কি সম্ভব? আমরা স্বর্গের প্রবেশদ্বারের কাছে চলে এসেছি।এখান দিয়েই দেবী পৃথিবীতে আসেন।যে বিশ্ব চালায় তার ফাঁকি দিতে চাইছি আমরা।’
অনেকটা স্বগতোক্তির সুরে বললেও জাহিদ আর হীরাভাই দুজনেই অনুভব করলো কথাটা ঠিক।দেবী যেই হোক, তিনি তো আধ্যাত্বিকভাবে ক্ষমতাবান, তিনি যে ধর্মেরই হোক না কেন, মানুষের চেয়ে ক্ষমতাবান।ওরা তার চোখ এড়িয়ে এখানে প্রবেশ করবে এটা কিভাবে সম্ভব?তবে কথাটা বেশী আমল দিলনা কেউ।অচিনদেব কি যেন হাঁতড়াচ্ছে এখন।নাকি দেয়ালে হাত বুলোচ্ছে কিছুই বোঝা গেলনা দুর থেকে।সন্ধ্যার আধাঁর হুট করে নেমে আসে জঙ্গলে।কিছুক্ষন আগের প্রতিফলিত রোদের শেষ অংশ পাহাড় ছেড়ে সরে যেতেই ঝুম করে সন্ধ্যা ঘনালো।অচিনদেবকে এখন একটা সাদা টুকরো বলে মনে হচ্ছে।ওরা জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে অচিনদেবের কিছুটা কাছে চলে এলো।দুরত্ব কমিয়ে আনলো প্রায় একশো হাতের মতো।কাছে আসার পর বুঝতে পারলো পাহাড়ের দেয়ালে কিছু দিয়ে একটা নকশা আঁকছে অচিনদেব।আধ ঘন্টা হয়ে গেছে নকশা এঁকেই যাচ্ছে সে।বিরক্ত হয়ে গেলেও তিনজন স্থানুর মতো দাঁড়িয়েই রইলো।শীতপ্রধান অঞ্চল বলে এদিকটাতে মশার প্রকোপ নেই।তা নাহলে ঠান্ডার সাথে তাদের অস্থির হয়ে যেতে হতো মশার কামড়ে।
আকস্মাৎ সচকিত হয়ে উঠলো ওরা।একটা ঘড়ঘড় শব্দ উঠেছে পাহাড়ের ভেতরে।এমন একটা শব্দ যা অবিশ্বাস্য।মনে হচ্ছে বড়ো বড়ো গিয়ার, চেইন আর লিভার চলছে পাহাড়ের ভেতর।আর তারপরই চমকে উঠলো ওরা যখন দেখলো পাহাড়টার একটা অংশ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।অচিনদেবের একটা কথা মনে পড়লো হীরাভাইয়ের,‘এটা লক্ষ বছর আগে মানুষের উপাসনার মন্দির হিসাবে ব্যবহৃত হতো।তারপর দেবী পূর্বের বার্তাবাহককের মাধ্যমে এটা বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দেন কোন কারনে।উপাসকদের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু কেউ কেউ কোন না কোন মাধ্যমে জেনে যায় এর কথা।যুগে যুগে কিছু কিছু মানুষ এখানে এসেছে কিন্তু এর অবস্থান নির্নয় করতে পারেনি।’
এ যেন আলীবাবা চল্লিশ চোরের সেই চিচিং ফাঁক! পাহাড়ের দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেছে।ঠিক তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে অচিনদেব।একবার সে পেছনে ফিরে তাকালো।অন্ধকারে ঠিকমতো তাদের দেখতে পেল কিনা কে জানে, হাঁটা ধরলো ভেতরের দিকে।ওরা দেখতে পেল ভেতরটা আলোয় ভরে আছে।আলোর উৎসটা নির্নয় করা যাচ্ছেনা দুর থেকে।তিনজন পড়িমরি করে ছুট লাগালো।অচিনদেব হেঁটে ভেতরে চলে গেছে।তাকে আর দেখা যাচ্ছেনা।তিনজন প্রায় দৌড়ে পাহাড়ের দরজার কাছে এসে গেছে।তারপর তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।একি দেখছে! এ কোন জায়গা? অসম্ভব! এতো পৃথিবী হতেই পারেনা!এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোনভাবেই পার্থিব নয়।কোনভাবেই নয়।এদিকের প্রকৃতি আর ওপাশের প্রকৃতির ভেতর আকাশ পাতাল ব্যবধান।এই বর্ননাতীত সৌন্দর্য ওদের সব ভুলিয়ে দিল।চেতনাবিনাশী এক অভিজ্ঞতা তাদের বিহ্বল করে দিল।কোন কিছু খেয়াল নেই ওদের।তিনজনই যেন কোন প্রতিবন্ধী এমনিভাবে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করলো।কি রূপ এই সৌন্দর্যের! কি আলোকচ্ছটা এই সৌন্দর্যের! অচিনদেব হেঁটে বিশাল উদ্যানের ভেতর চলে গেছে।তিনজন যেন কোন স্বপ্নের ঘোরে নিজেদের লুকানোর কথা ভুলে বসে আছে।হাঁটছে তো হাঁটছেই।কি বিশাল গাছ একেকটা!মনে হচ্ছে একেকটা গাছের বয়স হবে কয়েক লক্ষ বছর!কি বিশাল উদ্যান! একপাশ থেকে অন্যপাশ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছেনা।নীল আকাশ সরাসরি সবুজ উদ্যানে এসে মিলে গেছে।পার্থিব চোখে এমন দৃশ্য ধারন করা অসম্ভব।বাইরের শীতল বাতাস ওদের দেহে কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু এখানে তা নেই।বাতাসটা কি মোলায়েম যেন ফুসফুসের গোড়া পর্যন্ত পৌছে যাচ্ছে।মনের ভেতর অপূর্নতা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ওদের, যেন কোন চাওয়া ছিলনা কখনও।
অচিনদেব হাঁটছে তো হাঁটছেই।তার খুব কাছ থেকে তাকে অনুসরন করছে ওরা তিনজন।যতো সামনে যাচ্ছে তত আলোকচ্ছটা বাড়ছে।সামনে একটা নদী দেখা যাচ্ছে।কিংবা রুপোলি ফিতে।নদী এমন হয় ওদের জানা ছিলনা।এত স্বচ্ছ তার পানি যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।মনে হচ্ছে পানি নয়, তরল কাঁচ গড়িয়ে যাচ্ছে।আর তার কি সুন্দর শব্দ!শুনলে অবিশ্বাস্য অপার্থিব মনে হয়।হঠাৎ অচিনদেব ফিরে এলো তাদের কাছে।তার চোখ জ্বলজ্বল করছে কি এক উত্তেজনায়।‘আমি এই সুর শুনেছিলাম।এই স্রোতধারার টুংটাং শব্দ।আর সেই শব্দের সাথে মিশে ছিল দেবীর কন্ঠস্বর।তারমানে এখান থেকেই আমার সাথে কথা বলতো দেবী।আমি তার অনেক কাছে চলে এসেছি! আমি তার অনেক কাছে চলে এসেছি!দেবী!আমার দেবী!’
অচিনদেব যেন তার সহ্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে এমনি আচরন করছে।তার চোখ বলছে সে আর ধারন করতে পারছেনা।একটা বিশাল মহীরূহ যখন কাটা হয়, হুড়মুড় করে পড়ে যাবার আগে সেটা যেমন একটু একটু নড়ে অচিনদেবকেও তেমনি মনে হচ্ছে।‘ওপাশেই আছে সেই প্রাসাদ!সেখান দিয়েই আসবে দেবী!আমার দেবী।তোমরা চলে যাও।’ বলেই সে হাঁটা ধরলো।নদী নামের রুপোলি ফিতের কাছে গিয়ে নিচু হয়ে আঁজলা ভরে তার পানি পান করলো।তারপর হেঁটে চলে গেল নদীর ভেতর দিয়ে।ওর দেখাদেখি ওরা তিনজন আঁজলা ভরে পানি মুখে দিল।দিয়েই স্তব্দ হয়ে গেল, কি পানি এটা? নাকি কোন ফ্রিজের ভেতর রাখা ঠান্ডা অমৃত সুধা!এক আঁজলা পানিতে তাদের সব তৃষ্না মিটে গেল।শরীরটা এতো হালকা হয়ে গেল মনে হলো এখন ইচ্ছে করলে না খেয়েও কতোদিন পার করে দিতে পারবে।
অচিনদেব পার হয়ে গেছে নদীটা।তাড়াতাড়ি ওরাও হেঁটে পেরিয়ে গেল।নদীর পর থেকে পথটা আরো মায়াময় আরও অপার্থিব।ঘাসগুলো এতোটা সুন্দর যে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।কিছুদুর এগুতেই সাদা বাড়িটা দুর থেকে দেখতে পেল ওরা।এটা কোন বাড়ি নয়, দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয় এমন অচেনা কোন ধাতু দিয়ে বানানো যা আলো ছড়াচ্ছে অথবা এটা কোন বাড়ি নয়, আলোর প্রাসাদ যা কেবল আলো দিয়ে বানানো হয়েছে।বাড়ির পেছনেই নীল আকাশটা যেন নেমে এসে ছুঁয়ে দিয়েছে সবুজ উদ্যানকে।প্রাসাদের দিকে প্রায় তাকানোই যাচ্ছেনা।ওরা যে পথটা দিয়ে এসেছে তা গাঢ় নীল পাথরের পথ ছিল, আর নদীর পর তা হয়েছে রূপালী। ফলে আলোর তীব্রতা আরও বেড়েছে।
‘এ কোথায় এলাম?’জাহিদ ফিসফিস করে বললো।‘আমি এখান থেকে কোনদিন যাবোনা।’
‘আমিও না।’ সুশীল বললো।
হীরাভাই কেবল চুপ।সে সম্ভবতঃ সব অনুভুতিকে নিজের ভেতর চাপা দিয়ে রাখতে চাইছে।জাহিদ বললো,‘ওইযে দেখ, অচিনদেব প্রাসাদের সামনে বসে পড়ছে।ও প্রার্থনা করছে।আমরা ওই পাথরটার পেছনে বসে পড়ি।’
তিনজন একছুটে পড়ে থাকা একটা বোল্ডারের পেছনে চলে এলো।সেটা আসলে কোন বোল্ডার নয়, একটা ঝরনার উৎপত্তিস্থল।ঝিরিঝিরি পানি গড়িয়ে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
বিশাল প্রাসাদের সামনে হাঁটুগেড়ে বসে আছে অচিনদেব।বোল্ডারের পেছন থেকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তিনজন।অচিনদেব তার হাতের তালুদুটো এক করে বুকের সামনে রেখে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতো প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছে।কিছুই ঘটছেনা।এক ঘন্টা পেরিয়ে গেল।একইভাবে বসে আছে অচিনদেব।দুই ঘন্টা পেরুলো।জাহিদ বিরক্ত হয়ে গেছে।সে বললো,‘দেবী মনে হয় সাজাগোজা করতেই ব্যস্ত।ভক্তের সাথে সেলফি তুলতে হবেনা?’
‘চুপ!’ হঠাৎ ঠান্ডা গলায় বললো হীরাভাই।‘শোনো!’
সত্যি!শোনা যাচ্ছে কিছুর শব্দ।মনে হচ্ছে শত শত সেনাদল ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে কোন প্রান্তরের বুকে! তীব্র বাতাসের গর্জনের মতো সেই শব্দ।হ্যাঁ বাতাসের গতি বেড়েছে।গাছপালাগুলো নুয়ে পড়ছে বাতাসে।আকাশের নীল রঙ বদলে যাচ্ছে।ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে।বোল্ডারের ওপর মাথা রেখে তারা তাকিয়ে আছে প্রাসাদের দিকে। প্রাসাদটা যেন আরো উজ্জল হয়ে উঠেছে।সেই সাথে শব্দের মাত্রা বাড়ছে।মনে হচ্ছে ঘোড়া ছুটিয়ে সৈন্যদল খুব কাছে চলে এসেছে।ওরা দেখলো প্রার্থনা থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে অচিনদেব, খুব ধীরে সোজা হচ্ছে।ও বুঝে গেছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে এখনই।জীবনের হয়তঃ শেষ সীমার কাছেই ওর অবস্থান এখন।সেই প্রস্তুতি নেয়াও শেষ।প্রার্থনার ভংগি থেকেই ও দু’হাত শরীরের দু’পাশে বাড়িয়ে দিল যেন প্রিয় কাউকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছে।
আকস্মাৎ সব শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।পৃথিবীর গতি যেন থেমে গেল।ঘড়ির কাঁটা থেমে গেল ওদের।শরীরের শার্টের বোতামগুলো ফটফট করে ছিঁড়ে চলে গেল।পরনের প্যান্টগুলো টুকরো টুকরো হয়ে গেল।হীরাভাইয়ের চশমা চুর্নবিচুর্ন হয়ে গেল। তিনজনের মাথার চুলগুলো বাতাসের টানে ছিঁড়ে চলে গেল। পায়ের জুতো গলে গেল।তারপরই আলোর প্রাসাদের বিশাল তোরনের নিচে এসে দাঁড়ালেন দেবী!
এক সেকেন্ডের শত কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্য তিন জন দেখতে পেল তাকে।সৌন্দর্যের দেবী ডোরিনিয়াকে।সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ের ভেতর দেখলো মানব ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্যসীমার বাইরের সেই রূপবতীকে যা কোন মানুষ কোনদিনে কল্পনাও করতে পারেনি।সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ের ভেতর তার অচিন্তনীয় শারিরিক রূপের ঝলক দেখলো তারা যা কোন মানব চোখের জন্য বানানো হয়নি।দেখলো অচিনদেব বাতাসে মিশে যাচ্ছে।দেবী তাকিয়ে আছেন তাদের দিকে, মুখে হাসি।আর তারপরই গলে গেল তাদের চোখ, কান।ঠোঁটগুলো গলে গেল, হারালো কথা বলার ক্ষমতা।মাথার কঠিন আবরন গলে গেল।চামড়া পুড়ে গেল দেবীর রূপের তীব্র আলোতে।তাদের সবক’টা ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা হারিয়ে গেল চিরতরে।
বোকার মতো তারা দেবীকে দেখতে এসেছিল।তারা এই সত্যটাকে উপলব্ধি করতে পারেনি যে দেবীর স্বরূপ সহ্য করার মতো শক্তি মানব ইন্দ্রিয়ের থাকতে পারেনা।তারা পড়ে গেল মাটিতে।তারা পুরোপুরি মারা যায়নি তখনও, হয়ত মারা যাবেওনা আর কোনদিন তবে তখন তাদের আর মানুষ বলা যাবেনা।তারা পরিনত হয়েছে তিনটুকরো সাদা পাথরে।অচিনদেব নেই।সে বাতাসে মিশে গেছে।দেবী তাকে গ্রহন করেছেন কিংবা তার অমরত্বের অবসান ঘটেছে।পাহাড়ের বিশাল দরজাটা একা একাই বন্ধ হয়ে যায় যেন কোনদিন সেখানে কোন দরজাই ছিলনা।
সমাপ্ত
কি অসাধারণ গল্প! আমি বোবা হয়ে বসে আছি। নিজের হার্টবিটের শব্দ পাচ্ছি কেবল। কি হয়ে গেল?
Replyহুমায়ুন আহমেদ এর দেবী ফেইল তুহিন রহমানের দেবীর কাছে।
Reply