পহেলা বৈশাখ ১৪২৭
ওর সাথে দেখা হয়েছিলো পহেলা বৈশাখের দিন রমনা পার্কে। দিনটাকে এখনও আমি আমার জীবনের সেরা দিন মনে করি। কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে দুটো রিকসায় আমরা সকাল সকাল চলে গিয়েছিলাম রমনায়। উদ্দেশ্য পান্তা ইলিশ খাবো। তখন সুর্য্যমামা সবেমাত্র উঠেছে ওপরে। বাতাসে কেমন একটা ঘ্রান। রাস্তায় অনেক মানুষ। এতো সকালবেলাতেই সবাই একটা আমেজ নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। মন খারাপ হয়ে গেল। আগেরদিন অনেক পরিকল্পনা করে ভোরবেলা রমনায় যাওয়ার জন্য আগেভাগে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেকেই আমাদের আগে আগে রমনায় পৌছে গেছে। ভোরবেলা গোসল আর শেভ সেরেছি। মুখে মেখেছি মুলতানী মাটি। কাঁচা হলুদও কিছুটা মাখা হয়েছে। পরনে লাল পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা। আমাকে নিখাদ রাজপুত্রের মতো লাগছে।
ভোরের বাতাসে চুল উড়ছে আমার। পাশের রিকসা থেকে সাগর চেঁচিয়ে উঠলো,‘কিরে রাজপুত্র, আজও কি খালি হাতে ফিরে আসবি নাকি গতবারের মতো? নাকি সাথে রাজকন্যা থাকবে?’
‘ইনশাল্লাহ্ সাথে রাজকন্যা থাকবে!’ আমি হাসলাম। আমার গালে টোল পড়লো। নিশ্চয় দেখতে আমাকে কিছুটা শ্রী কৃষ্ণের মতো লাগছে।
সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। আমাকে নিয়ে যতো চিন্তা ওদের। কারন এখনও আমি এনগেজড নই। আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। অথচ ওদের সবার কেউ না কেউ আছেই। যার নেই সে অন্তত: ছাদে উঠে পাশের বাড়ির মেয়ের সাথে টাংকি মারে। ববির সাথে তানিয়ার অনেক দিনের সম্পর্ক। একবার কাট্টি একবার ভাব-এই অবস্থা। ইশান প্রেম করে টিনার সাথে। আমরা ওকে অনেক ক্ষ্যাপাই টিনা নামটা নিয়ে। বলি টিনার আকারটা উঠিয়ে দিলে ওর নাম টিন মানে ঢেউটিন হয়ে যাবে। আর ববিকে ক্ষ্যাপাই ছড়া দিয়ে:
ববির বউ তানিয়া
সকল কথা জানিয়া
সংসার করে ববি
বউ এর আদেশ মানিয়া।
ববি হাসে কিন্তু কিছু বলেনা। কি বলবে ও? বলার কিছু আছে নাকি ওর? প্রেম করলে মাথা ঠান্ডা হয়ে যায় আর ছ্যাক খেলে মাথা গরম। কামরুল ওরফে কালা মিয়া ভালোবাসে একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে যে কিনা এখনও ম্যাট্রিক পাস দুরে থাক ক্লাস টেনেই ওঠেনি। আমরা ওকে ক্ষ্যাপাই নানা নাতনি বলে। একবার নাকি ও লতা মানে ক্লাস নাইনের মেয়েটাকে নিয়ে গিয়েছিলো রমনা পার্কে। তখন অনেকেই ওকে নানা নাতনি বলে কমেন্ট করেছিলো। এই কথা আমাদের কাছে বলার পর থেকেই সে আমাদের কাছেও নানা নাতনি। আমি অবশ্য এসবের চরম বিরোধী ছিলাম, মানে এইসব প্রেম প্রেম খেলার। আমার কাছে এসব হালকা বিষয়কে নিতান্তই ছেলেখেলা বলে মনে হতো সবসময়। আমি গভীরতায় বিশ্বাসী সবসময়। যদি কাউকে পছন্দ হয় তাকে ভালোবাসবো জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।
শিল্পকলার গলির মাথা পর্যন্ত রিকসা যেতেই আটকে দিলো পুলিশ। রিকসা আর যাবেনা। আমরা নেমে পড়লাম। কেবল আমি ছাড়া আর অন্য তিনজন ছড়িয়ে গেল তিনদিকে। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম যেখানে রিকসা থেকে নেমেছিলাম সেখানেই। ওদের তিনজনের গার্লফ্রেন্ড ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে কে কোথায় থাকবে। তিনজন তিনদিকে যেভাবে ছিটকে গেল তাতে মনে হলো ওরা তাদেরকে এতোই গুরুত্ব দেয় যে আমার কথাটা পর্যন্ত মনে থাকলোনা। অথচ রিকসা থেকে নামার আগেও জানতামনা তাদের কেউ এখানে আসবে। এটাই হলো প্রেম। আর প্রেম মানে হলো চরম গোপনীয়তা।
আমি বোকার মতো চারপাশে তাকাচ্ছি। আশেপাশে বেশ মানুষজন জড়ো হয়েছে। সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা হলুদ, সাদা শাড়ী পরে বান্ধবীদের সাথে মজা করছে। চমৎকার সাজ পোশাক সবার। চারপাশে যেন রঙের মেলা চলছে। এখনও মানুষজন তেমন আসেনি। একটুপরই ভিড় জমে উঠবে। আমার দিকে সবাই বেশ অবাক হয়েই তাকাচ্ছে। মেয়েরা তো পারলে দু’বার তাকায়। কেউ কেউ আমাকে নিয়ে বান্ধবীদের সাথে কানে কানে কথা বলে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ছে। এর কারন আমার নায়ক নায়ক চেহারা। খুব কম মানুষের আমার মতো সুন্দর চেহারা আছে-থ্যাংক গড।
দু’জন মেয়ে আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় কি যেন বললো আমি ঠিক শুনতে পেলামনা। শোনার চেষ্টাও করলামনা। কারন মেয়েদের এরকম কমেন্ট শুনে আমি অভ্যস্ত। আমি পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে তিনজনকেই ফোন দিলাম। শালারা ফোন বন্ধ করে রেখেছে। মেজাজটা বিগড়ে গেল আমার। ঝাড়া তিরিশ মিনিট ওদের অপেক্ষা করলাম আমি। তারপর বড়বড় পা ফেলে স্থান ত্যাগ করলাম।
রমনা পার্কের ভেতর অনেক ভিড়। নানা জায়গায় পান্তা ইলিশের আয়োজন। আমি ঘুরতে লাগলাম। এক জায়গায় মেয়েমানুষের সাজ সরঞ্জাম নিয়ে বসেছে কিছু মহিলা। কিছু ছেলে বাঁশি আর ঢাক ঢোল নিয়ে ঢুকেছে ভেতরে। সম্ভবত: তারা এসব বাজাবে আর জমিয়ে আড্ডা দেবে। আমার পাশে এসে গেল রঙের প্যালেট আর রঙ তুলি নিয়ে একটা লোক,‘একটা আর্ট করে দেই স্যার?’
‘আর্ট মানে?’
লোকটা হাতের প্যালেট উঁচু করে দেখালো,‘এইতো স্যার, রঙ দিয়ে ডিজাইন করে দেবো। লেখা থাকবে পহেলা বৈশাখ। একটা একতারার ছবিও থাকবে নাকের পাশে।’
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সকাল বেলা কতো কষ্ট করে ফেসিয়াল করেছি। আর এই ব্যাটা আমার নাকের পাশে একটা একতারা আঁকবে রঙ দিয়ে। ঘুরে অন্যদিকে হাঁটা ধরলাম আমি। সবাইকে বলেছি বটে আমি আজ একজনকে সাথে নিয়ে তবে ফিরবো, বাস্তবে তার ইচ্ছা মোটেও নেই। কথাটা বলা হয়েছে ওদেরকে সুখী করার জন্য। যে প্রেম করে সে চায় সবাই প্রেম করুক। যে বিয়ে করে সে চায়না পৃথিবীর কেউ বিয়ে করুক। এটাই হলো জীবনের গনতন্ত্র।
প্রধান রাস্তার পাশ দিয়ে বাগানের ভেতরে হাঁটছি। লোকজন ভিড় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সকাল আটটা বাজে। ফেরিওয়ালা আর খাবারের দোকানদাররা খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জায়গায় জায়গায় চটপটি আর ফুচকার দোকান। হঠাৎ হাত টেনে ধরলো কেউ। ঘুরতেই দেখলাম ইয়ং একটা ছেলে। হাতে সেই রঙের প্যালেট। সাথে সাথে হাত তুললাম আমি,‘আমি ভাই নাকের পাশে একতারা আঁকবোনা।’
‘না না একতারা কেন? আরো কত কিছু আছে বৈশাখের প্রতিক! যেমন ধরুন ইলিশ মাছ, প্যাঁচা, হাতপাখা, ঢেঁকি....।’
‘আরে দাঁড়ান দাঁড়ান।‘ হাত তুললাম আমি।‘আপনার কি মনে হয় আমার মতো একজন নাকের পাশে ঢেঁকি বা ইলিশ মাছ নিয়ে ঘুরবে?’
ছেলেটা অপ্রতিভভাবে হাসলো,‘দেখুন সবাই করছে। একদিনই তো।’
‘এই একদিন নাকের পাশে ঢেঁকি নিয়ে হাঁটতে হবে? কমপালসারি?’
ছেলেটা কি বলবে বুঝতে না পেরে অন্যদিকে হাঁটা দিলো।
আমি আবার হাঁটতে লাগলাম। তিনজনকে দ্বিতীয়বারের মতো রিং করলাম। এবার একজন ছাড়া বাকি দু’জনকেই পেলাম। দু’জনই বললো তাদের মোবাইল বন্ধ ছিলোনা। নেটওয়ার্কের সমস্যা ছিলো। আমি চরম রাগে জানতে চাইলাম তারা এখন কোথায়। কেউ বললো দুই নাম্বার গেটের কাছে। কেউ বললো রমনার ভিতরে যে পানির পাম্পটা আছে সেখানে আছে। তিন নাম্বারের তো পাত্তাই নেই। যতোক্ষন প্রেমিকার জন্য অপেক্ষায় ছিলো ততক্ষন ফোন ছিলো খোলা। আর দেখা হবার পর সব ফোন বন্ধ।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ওদেরকে খুঁজতে যাবোনা। দরকার হলে একাই থাকবো এখানে। সারাদিন। আবার হাঁটা। মানুষজন বারবার আমার দিকে তাকায় এটা অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। আমি চুইংগাম চিবোতে চিবোতে হাঁটতে লাগলাম। অনেকটা উদাসিনভাবে হাঁটছি। বড়ো পুকুরটাকে কেন্দ্র করে একপাক দিলাম। ইতিমধ্যে জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতি চলে এসে দখল নিয়ে ফেলেছে পুকুরের পাড়গুলোতে। সাধারন মানুষ শুধু ঘুরছে আর দেখছে। আমার বেশ মজাই লাগছে হাঁটতে। বন্ধু বান্ধব থাকলে কথা বলতে হয়, গল্প করতে হয়। একা থাকলে বরং নিরিবিলি থাকা যায়, চিন্তা করা যায় এবং বেশী উপভোগ করা যায় সবকিছু। আমার জীবনে বড়ো যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং যেসব ঘটনা সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে সেগুলো ঘটেছে বন্ধু ছাড়া। আমি একা থাকার সময় ঘটেছে।
আবার হাতে একটা টান। আমি জানি কে টান দিয়েছে। সেই প্যালেটআলা কেউ একজন। এরা যে কেন এসব জায়গায় ঘুরঘুর করে আনন্দ নষ্ট করে! আমি রাগ করে ঘুরলাম সেদিকে। হ্যাঁ, প্যালেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তবে লোক বা ছেলে নয় একটা সুন্দরী মেয়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
‘ভাইয়া, এঁকে দেই?’ মেয়েটা সুন্দর করে হাসলো। ‘শুভ নববর্ষ?’
‘শুভ নববর্ষ?’
‘নাকি ঢোল?’
আমি ঢোক গিললাম।‘আপনি আঁকবেন?’
‘হ্যাঁ, আমি আঁকবো।’
‘না তাহলে প্যাঁচা আঁকতে হবে।’ আমি হাসলাম।‘মানে একটা বার্ন আউল।’
মেয়েটা একটু চিন্তা করলো। তাকে একটু চিন্তিতও দেখাচ্ছে মানে টেনস্ড। মনে হয় প্যাঁচা কখনও আঁকেনি আগে। তারপর হঠাৎ হেসে উঠলো,‘ঠিক আছে আসুন এদিকে। এঁকে দিচ্ছি।’
আমি তারপরও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম,‘আচ্ছা যদি প্যাঁচা না হয়ে ওটা একটা ডাইনোসর হয়ে যায় তখন?’
‘ডাইনোসর হবে কেন?’ মেয়েটা অবাক হয়ে বললো।
‘আপনি যেভাবে চিন্তা করলেন তা’তে ভয় হচ্ছে।’ আমি বললাম।
মেয়েটা খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো। ‘যদি দেখি প্যাঁচা হচ্ছেনা তাড়াতাড়ি ওটাকে একটা ঢোল বানিয়ে দেবো।’
‘তাহলে তো আমার গালটাকে শেষ করে দেবেন।’
‘না না শেষ হবেনা।’ মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো।‘আপনার গালের ওপর প্যাঁচার চেয়ে ঢোল সুন্দর লাগবে।’
‘না না প্যাঁচাই লাগবে। প্যাঁচা আমার ফেবারিট পাখি।’
‘প্যাঁচা ফেবারিট পাখি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি বলছেন? এতো সুন্দর সুন্দর পাখি থাকতে প্যাঁচা আপনার ফেবারিট পাখি?’
‘ঠিক বলেছেন। প্যাঁচা আমাদের বৈশাখী পাখি। তাছাড়া এটার সাথে আমাদের কালচারের একটা সম্পর্ক আছে।’
‘কিন্তু আপনাকে দেখে তো মনে হয়না এতো একটা বিশ্রী পাখি আপনার প্রিয় পাখি।’
‘ওরে বাবা চেহারা দেখে এতো কিছু বুঝতে পারেন নাকি?’
‘পারি পারি।’
‘দেখি কি পারেন। আমার গালে একটা প্যাঁচা এঁকে দিন।’ আমি বাগানের কিনারে গিয়ে একটা বট গাছের পাশে থাকা বেঞ্চে বসে পড়লাম। মেয়েটা তার প্যালেট আর রঙ তুলি নিয়ে এগিয়ে এলো আমার পেছন পেছন। তার নরোম বাম হাতে আমার মুখটা ধরে তার দিকে ঘোরালো। আমার গালের ওপর নজর দিলো ও। ঝুঁকে পড়লো আমার মুখের ওপর। খুব কাছ থেকে আমি তার মুখটা দেখতে পাচ্ছি। চমৎকার চেহারা, ভ্রু, চোখ, ঠোঁট যেন একটার সাথে একটা অতি সামঞ্জস্যপূর্ন। পাতলা ঠোঁটটা একটু ফাঁক। চমৎকার একটা মেয়েলি সুবাস পাচ্ছি তার গলা আর বুক থেকে। হঠাৎ করে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে নিলাম।
মেয়েটা প্যাঁচা আঁকছে। তার রঙ তুলির টান আমার গালের ওপর সুড়সুড় করছে। আমার বেশ ভালো লাগছে। আমার বড়ো চুল মেয়েটা হাত দিয়ে সরালো। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ যতœ করে ছবিটা আঁকার চেষ্টা করছে আমার গালের ওপর। নাকি সে একটু বেশী সময় নিচ্ছে? তার কি আমার গালের ওপর ছবি আঁকতে ভালো লাগছে? অনেক কথা ভাবছি আমি চোখ বুঁজে।
তারপর তার ছবি আঁকা শেষ হলো। সে নিচু হয়ে ফুঁ দিয়ে রঙগুলো শুকাতে চেষ্টা করছে। আমার মনে হচ্ছে এই কাজটা সে বাড়তি করছে। ফুঁ দিয়ে শুকানো তো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা। গালের ওপর এক অচেনা নারীর ফুঁ। আমার নিসঙ্গ একাকী হৃদয়টা কেমন যেন মোচড় খেয়ে উঠলো। মনে মনে একটা কবিতা লিখতে শুরু করলাম আমি ঃ
রমনার দখিনা হাওয়ায় যখন মাতলো সারা শহর
তখন সবাই ছেড়ে গেছে আমায়
নিসঙ্গ সবার মাঝেও আমি
একাকী তবে বেশ খোশমেজাজে
কারন?
গালের ওপর এক অচেনা নারীর ফুঁ।
‘আপনার স্কিন খুব সুন্দর। ছেলেদের স্কিন এমন হয়না।’ মেয়েটা বললো।
‘ধন্যবাদ। প্যাঁচা আঁকা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। শেষ।’
‘রঙগুলো কি শুকিয়েছে?’
‘না এখনও শুকায়নি। দাঁড়ান শুকিয়ে দিচ্ছি।’ মেয়েটা নিচু হয়ে আবার ফুঁ দিতে লাগলো।
আমি মনে মনে হাসলাম। রবী ঠাকুরের সেই কথা মনে পড়ে গেল-সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। কথাটা প্রমান করার জন্য বোধহয় মেয়েমানুষের প্রয়োজন। সে আরো এক মিনিট ফুঁ দিলো। আমি নিচু স্বরে বললাম,‘আমার মনে হয় এখনও শুকায়নি।’
মেয়েটার চেহারাটা একটু লাল হয়ে উঠলো সাথে সাথে।
আমি পকেট থেকে আমার স্যামসুং ডুয়োসটা বের করে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম,‘একটা ছবি তুলে দিন আমার গালের। সাথে তো আয়না নেই।’
‘আমার কাছে আয়না আছে, দেখবেন?’ মেয়েটা তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ভেতর থেকে একটা কমপ্যাক্ট পাওডার কেস বের করে খুললো। আয়নাটা বের করে বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। আয়না দিয়ে দেখলাম চমৎকার একটা প্যাঁচা এঁকেছে মেয়েটা আমার বাম দিকের গালে। তিনটা রঙ ব্যবহার করেছে সে। লাল আর সবুজ রঙে লিখেছে শুভ নববর্ষ। মেয়েটা নিশ্চিতভাবে আর্ট জানে। অসাধারন। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,‘চমৎকার!’
মেয়েটা হাসলো,‘বললামনা, আঁকতে পারবো আমি।’
‘এটা থাকবেনা বেশিক্ষন। একটা ছবি তুলে দিন।’
মেয়েটা আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে আমার গালের একটা ছবি তুলে দিলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম,‘গালের আর্টের ছবি তো তুললাম এবার আর্টিস্টের একটা ছবি নিতে পারি?’
মেয়েটা তার সুন্দর ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো। একটু ভাবলো।‘ঠিক আছে নিন।’ সে পোজ দিলো। আমি তার একটা ছবি নিলাম। ‘আপনার নামটা?’
‘ইরিনা মুম।’ মেয়েটা বললো।‘আনকমন তাইনা?’
‘একেবারে রাশিয়ান বাট আর্টিস্টিক।’ আমি হাসলাম। ‘খুব সুন্দর নাম। আই স্যয়ার।’
মেয়েটা লজ্জা পেলো। আমি তাড়াতাড়ি বললাম,‘এতো সুন্দর একটা আর্ট করলেন কতো দেবো বলুনতো?’
‘আপনার ইচ্ছা।’ সে নিচু মুখে বললো।
‘ঠিক আছে।’ আমি পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিলাম। মানিব্যাগে গুনে গুনে চারটা পাঁচশো টাকা তিনটে একশো টাকা আর কিছু দশ বিশ টাকার নোট আছে। কিন্তু পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়েই জমে গেলাম। মানিব্যাগটা নেই। ডানদিকের পকেটে হাত দিলাম। সেখানেও নেই। তারমানে পকেটমার হয়ে গেছে। পাঞ্জাবীর পকেট মারা খুব সোজা ব্যপার। এই ভিড়ের ভেতর আমার রোমান্টিক মুডের সুজোগে কেউ মেরে দিয়েছে পকেটটা। আমি শেষ।
মেয়েটা আমার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে গেল ব্যপারটা। আমি কিছু বলার আগেই সে জিজ্ঞেস করলো,‘কি হয়েছে? হারিয়ে গেছে টাকা?’
‘মানিব্যাগ নেই।’
‘ও মাই গড!’
‘সব টাকা সেখানেই ছিলো। ফোনটা অন্য পকেটে ছিলো তাই সেটা বেঁচে গেছে।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে আপনার টাকাটা এখনই দিতে পারছিনা।’
মেয়েটা হেসে উঠলো,‘আপনি আমার টাকা নিয়ে চিন্তা করছেন? লাগলে আরো নিন আমার কাছ থেকে।’
‘না না ছিঃ কি বলেন। আমি খুব লজ্জিত। তবে আমার সমস্যা নেই। আমি আমার ফ্রেন্ডদের ডেকে আনছি। ওরা আশেপাশেই আছে।’
ফোনটা তুলতে যেতেই মেয়েটা হাত চেপে ধরলো আমার। আমি স্থির হয়ে গেলাম। ‘বললাম তো টাকার চিন্তা করবেননা। আপনার এতোবড়ো একটা অঘটন ঘটে গেছে আর আপনি ভাবছেন আমি আপনার কাছে টাকা চাইবো?’ ইরিনা অন্যরকম একটা ভঙ্গি করলো যেন ও আমার কতোদিনের চেনা। ‘আপনি বসুন। মানিব্যাগে কি গুরুত্বপূর্ন কিছু ছিলো?’
‘না তেমন কিছুনা। হাজার দু’য়েক টাকা এই আরকি।’ আমি বললাম। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম।‘আমিই কি আপনার প্রথম ক্লায়েন্ট?’
ইরিনা আবার হাসলো,‘এর আগে একটা বাচ্চার গালে একতারা এঁকে দিয়েছি।’
‘তারমানে আমি দ্বিতীয়?’
‘হ্যাঁ। চটপটি খাবেন?’
আমি আড়ষ্ঠভাবে বললাম,‘আপনি খাওয়াবেন কেন? একটু অপেক্ষা করুন আমি আপনাকে খাওয়াবো।’
ইরিনা ভ্রু কোঁচকালো,‘আপনাকে স্মার্ট দেখালেও আপনি আসলে আনস্মার্ট।’
‘একথা কেন মনে হলো?’
‘জানিনা তবে আপনি যেভাবে সংকোচ বোধ করছেন সেটা আপনার চেহারার সাথে মানাচ্ছেনা।’
আমি হেসে উঠলাম। ‘আপনি একজন আর্টিস্ট। আপনার চোখে আসলে পুরো পৃথিবীটাই অন্যরকম।’
ইরিনাও হাসলো,‘চটপটি খাবেন কিনা বলুন।’
‘ঠিক আছে খাবো।’
ইরিনা কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা চটপটির গাড়ির কাছে গিয়ে কিছু বললো। তারপর ফিরে এলো আমার কাছে। হাতের রঙের প্যালেট আর তুলি নামিয়ে রাখলো পাথরের বেঞ্চের ওপর। নিজেও বসলো। আমার দিকে তাকালো,‘আপনি আবার দাঁড়িয়ে গেছেন?
‘না না এইতো বসছি।’ আমি ইরিনার পাশে বসলাম। বললাম,‘আমি কিন্তু একা আসিনি। আমার বন্ধুরাও আমার সাথে এসেছে। মানিব্যাগটার মতো ওরাও হারিয়ে গেছে।’
‘মানে!’
‘আরে ওরাও হারিয়ে গেছে। আমি ওদের তিনজনকে খুঁজে পাচ্ছিনা।’
‘খুঁজে পাচ্ছেননা মানে? ওদের মোবাইল নাম্বার নেই আপনার কাছে?’
‘আছে কিন্তু ফোন দিলে বলছে এখানে আছি সেখানে আছি।’
ইরিনা একটু চিন্তা করে বললো,‘তারমানে তাদের সাথে কেউ আছে?’
‘রাইট ইউ আর!’ আমি বললাম। ‘এই জন্যেই তারা আমার কাছে আসছেনা। একেকজন একেকদিকে চলে গেছে সাথের জনকে নিয়ে।’
ইরিনা ভেবে বললো,‘তারমানে আপনি ছাড়া বাকি তিনজনই এনগেজড?’
আমি মাথা নাড়লাম।
‘একে বন্ধুত্ব বলে? তারা আপনার সাথে এলো আর আপনাকে রেখে চলে গেল?’ ইরিনা এপাশ ওপাশ মাথা দোলালো।‘আপনার এক ফ্রেন্ডের নাম্বার দিন তো?’
আমি ববির নাম্বারটা ডায়াল করে ইরিনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ইরিনা আমার ফোনটা তার কানে চাপালো। ওদিক থেকে ববি ফোন রিসিভ করতেই ও বললো,‘হ্যালো,এই মোবাইলটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি। ডায়েল লিস্টে আপনার মোবাইল নাম্বার ছিলো তাই এই নাম্বারটায় ডায়েল করলাম। আমি এখানে আর দশ মিনিট আছি। প্রয়োজন মনে করলে ফোনটা আমার কাছ থেকে সংগ্রহ করুন। আমি লেকের দক্ষিন পাড়ে পাথরের বেঞ্চে বসে আছি।’
লাউডস্পিকার থাকায় আমি বেশ ভালোভাবে শুনতে পেলাম ববি বলছে,‘ও এটা তো আমার ফ্রেন্ড সায়েমের নাম্বার। আমি আসছি। একটু অপেক্ষা করুন।’
ইরিনা তার ফোনটা কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকালো,‘কেমন হলো বলুন তো?’
‘ও মাই গড! আপনার সিচুয়েশন কাভার করার অসাধারন ক্ষমতা তো!’ আমি অবাক হয়ে বললাম,‘এখন তো ও দৌড়ে চলে আসবে।’
‘আসুক না। তারপর দেখুন আমি তাকে কি বলি।’ ইরিনা ফোনটা আমার হাতে ফেরৎ দিলো।
দশ মিনিট পার হবার আগেই দেখতে পেলাম ববি সাথে তানিয়াকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। আমার পাশে ইরিনাকে দেখে ও থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তানিয়াকে কিছু একটা বললো নিচু স্বরে তারপর এগিয়ে এলো আমার দিকে,‘কিরে তুই? তোর ফোন নাকি হারানো গেছে?’
আমি জবাব দেয়ার আগেই ইরিনা বললো,‘আপনার বন্ধুকে একা রেখে বান্ধবীকে সময় দিচ্ছেন? ফোন দিলে কখনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কখনও নিজের লোকেশন বলছেননা। আপনার বন্ধুকে যদি আপনার সাথে নিয়ে যেতেন তাহলে কি খুব একটা সমস্যা হতো? উনি একটু দুরে বসে থাকতেন।’
ববি নিজের কান চুলকালো বোকার মতো। কান থেকে চুলে চলে গেল আঙুল। কি বলবে বুঝতে পারছেনা।
ইরিনা বললো,‘আপনাদের আরো দুই জন কোথায় গেছেন?’
‘আমি বলতে পারবোনা।’ ববির কান চুলকানো থামছেনা। ‘আসলে ওরা কোন দিকে গেছে....।’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। বসুন। চটপটি খান।’
‘না না চটপটি আমরা খেয়েছি।’ ববি আমার দিকে একটু প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। আমার গালের ওপর প্যাঁচা আঁকা দেখে ও আরও বিশ্মিত হয়েছে।
‘ঠিক আছে তাহলে যান। আপনার বন্ধুর দায়িত্ব এখন আমার হাতে।’ ইরিনা বললো। ও আবার আমার পাশে এসে বসলো। ববি চলে যাওয়ার ভঙ্গি করতেই আমি হাত তুললাম,‘দাঁড়া, আমাকে পাঁচশো টাকা ধার দে। আমি মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলেছি।’
‘এক টাকাও না। আপনি যান।’ ববির দিকে তাকিয়ে বললো ইরিনা।‘আমি দেখবো ব্যপারটা।’
ববি আরেকবার আমাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে তানিয়াকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। ও যার পর নাই বিশ্মিত আমার কাজ কারবারে। হোক বিশ্মিত। ওদের কাজ কারবারে আমিও কি কম বিশ্মিত? ওরা দু’জন বেশ কিছুটা দুরে গেল বটে কিন্তু একেবারে উধাও হলোনা। আমি দেখতে পেলাম ওরা একটু দুরে গিয়ে বসে আমাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা এতোকিছু দেখতে পেলনা-ও আমার জন্য একটা আর নিজের জন্য একটা চটপটির প্লেট নিয়ে এসে পাশে বসলো,‘নিন শুরু করুন। আজকের দিনের প্রথম চটপটি। শুভ নববর্ষ।’
‘শুভ নববর্ষ।’
চটপটি দিয়ে নববর্ষ শুরু করলাম। ইচ্ছা ছিলো পান্তা ইলিশ খাবো কিন্তু আমার বন্ধুদের অন্তর্ধানের কারনে সব ভেস্তে গেল। সকাল ন’টা বাজতে চললো। রমনা পার্ক ভরে যাচ্ছে মানুষে। নানা ধরনের নানা বর্নের চটকদার মানুষ। আজ সবাই হ্যাপি মুডে আছে। কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে, কেউ হৈ হৈ করছে, কেউ দল বেঁধে লাফাতে লাফাতে আসছে, কেউ জোকার সেজে আসছে, তবে বেশীরভাগ আসছে জোড়ায় জোড়ায়।
ববি মনে হয় ইশানকে ফোন দিয়েছিলো। একটু পরে ওকে দেখা গেল। আমাদের সাথে বেশ কিছুটা দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে টিনা। আমাদের দিকে ওদের দু’জনার দৃষ্টি। আমি ভাব করলাম যেন ওদেরকে দেখতেই পাইনি। লেকের দিকে মুখ করে বসে থাকায় ভালোই হয়েছে। আমাদের মুখ দেখতে পাচ্ছেনা কেউ। আমি একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলাম ইরিনার সাথে। বললাম,‘যাক এখনও সারাদিন পড়ে আছে। আমি ভেবেছিলাম একা একা ঘুরতে হবে। আপনি মানুষের মুখে ছবি আঁকুন আর আমি এখানে বসে বসে দেখবো-তাও ভালো।’
‘না না ঠিক আছে। আজ আর কিছুই করবোনা। এখানেই বসে থাকবো সারাদিন। ভালোই লাগছে।’ ইরিনা বললো চটপটি খেতে খেতে। ‘আপনার মতোই অবস্থা হয়েছে আমারও। একজনকেও সাথে আনতে পারিনি। সবাই যার যার মতো যার যার পথে চলে গেছে। ভেবেছিলাম আর্ট কেমন করতে পারি একটা এক্সপিরিয়েন্স দরকার। হয়েছে।’
‘দুটো ডিজাইন করে শখ মিটে গেল?’
ইরিনা ওর নিজের হাতের দিকে তাকালো। কিছু রঙ ওর হাতে লেগে আছে। ‘সারা দিন যদি এসব করি তাহলে আর আনন্দ করা হবেনা।’
‘কতোক্ষন আনন্দ করার ইচ্ছে?’
‘সারাদিন। ধুলোয় ধুসরিত একটা দিন। রোদে আর ঘামে ভেজা একটা দিন। গাছের ছায়ায় বসে হাতের তালপাখা দিয়ে বাতাস করার একটা দিন। কপালের চুলগুলো ঘামের সাথে মিশে লেগে থাকবে। কোথাও একটা কোকিল ডাকবে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,‘আপনি তো একজন কবি!’
‘শিল্পী।’ ইরিনা বললো,ওর চোখে খেলা করছে রোমান্টিকতা। ‘যারা ছবি আঁকে তারা স্বপ্ন দেখে। আর এই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে চায় তারা। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তব থেকে অনেক দুরের পথ। একা একা হেঁটে যেতে হয়-তাই কেউ স্বপ্নের কাছে যেতে চায়না।’
আমি হেসে উঠলাম,‘কি চমৎকার উদাহরন। আপনি ভবিষ্যতে অনেক বড়ো একজন শিল্পী হবেন।’
‘যদি হই আপনাকে নিয়ে প্রথম একটা পোট্রেট করবো। নাম দেবো কবি।’
‘কবি কেন?’
‘কারন আপনাকে দেখে কেমন যেন কবি কবি মনে হয়েছিলো। কেমন ভাবুক ভাবুক একটা ভাব। জীবনের প্রতি আকর্ষনহীন একজন। পকেটমার হয়ে গেছে কিন্তু কোন বোধ নেই।’
‘বোধ থাকবে কিভাবে? তার আগেই তো আপনি চলে এলেন।’
ইরিনা হাসতে লাগলো। ওর চটপটি খাওয়া বাধাগ্রস্থ হলো। ববির পাশে গিয়ে বসেছে ইশান। আমাকে দেখিয়ে কি সব বলছে। এবার আমি সাগরকেও দেখতে পেলাম ওদের মাঝে। তিনজন জোট বেঁধেছে। আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। নিঃসন্দেহে ওদের প্রত্যেকের গার্লফ্রেন্ডের চেয়ে ইরিনা অনেক সুন্দরী।
ছোট্ট একটা ঘটনা অথচ কি অপুর্ব তার আবেশ। জীবনে তো কোন মেয়ের সাথে এভাবে ঘনিষ্ঠভাবে বসিনি। সবসময় নিজের সৌন্দর্য নিয়ে এতোটাই বিমোহিত ছিলাম যে আর কারো দিকে তাকানোর সময় হয়ে ওঠেনি। বলতে গেলে কিছুটা অহংকারীও ছিলাম।
সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় বলছে অপুর্ব জুটি। দু’জনেই সুন্দর। এমনটা খুব একটা চোখে পড়েনা।
‘সত্যি বলছি আমি বাস্তববাদী নই।’ আমি বললাম। ‘অন্যদের কারো মতো নই। জীবনটাকে আমি অন্যভাবে সাজাতে চেয়েছি সবসময়। আমার চিন্তাধারার সাথে আমি কারও মিল পাইনি।’
খুব কাছ থেকে ইরিনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ও বুঝতে চেষ্টা করছে আমি কি বলছি। ‘তাহলে আপনিও চেষ্টা করলে আর্ট করতে পারবেন। দেবেন আমার গালে একটা ঢেঁকি এঁকে?’
‘ঢেঁকি? আপনার গালে?’ আমি হেসে উঠলাম।‘ডাক্তারকে ওষুধ দেবো আমি?’
‘দুর! আমি ফাজলামী করছিনা। দেবেন একটা ঢেঁকি এঁকে?’
‘কি বলছেন এসব?’
‘আমি বলছি আপনি আমার গালে একটা ঢেঁকি এঁকে দিন। সবার গালে কতোকিছু লেখা রয়েছে কেবল আমার গালে নেই।’ ইরিনা তার হাতের রঙতুলি বাড়িয়ে দিলো। ‘খাওয়া শেষ করে আমার গালে এঁকে দিন।’
আমার চটপটি খাওয়া শেষ। রঙতুলি হাতে নিয়ে ইরিনার মুখটা ধরলাম এক হাতে। কিছুটা সংকোচ আমাকে বেঁধে ফেললো আস্টেপৃষ্ঠে। ওর নরোম গাল,গা থেকে ভেসে আসা মিস্টি সুবাস আমার মনকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিলো। ভালোলাগার এক অন্যরকম অনুভুতি। ওর গালে আমার হাত। ইচ্ছে হচ্ছে ওর আরো কাছে যেতে। ওর গালে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে। আমি ঢেঁকি আঁকা শুরু করলাম। বৈশাখের ঢেঁকি। বাঙালীর রঙের বাহারী ঢেঁকি। চারপাশের কোলাহল আর আমেজের মাঝে অন্য এক অনুভুতি।
রঙের প্রতিটি টান আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। তারপর একসময় ঢেঁকি আঁকা শেষ হলো। ইরিনা নিজের আয়নায় গালটা দেখলো তারপর অবাক হয়ে বলে উঠলো,‘আপনিও তো আর্টিস্ট! কি চমৎকার এঁকেছেন।’
সত্যি আঁকাটা সুন্দর হয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি এতো সুন্দর করে আঁকতে পারবো। আমি গ্রামের ছেলে নই। জীবনে কখনও ঢেঁকি দেখিনি আমি সামনে থেকে। যা দেখেছি ছবিতে বা টিভিতে। তা’তেই এতো চমৎকার হয়েছে আঁকাটা যে আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিনা। ‘ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই।’ আমি বললাম। ‘যা শিখেছি আপনার কাছ থেকে শিখেছি।’
‘আমার কাছ থেকে?’
‘এই এক ঘন্টায় আমি ছবি আঁকার যে অনুপ্রেরনা পেয়েছি আপনার কাছ থেকে তা থেকেই এঁকেছি এটা।’
ইরিনা একটু হেসে বললো,‘কতো দেবো?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,‘কতো দেবো মানে?’
‘আপনি যে আমাকে দিতে চাইলেন তখন। এবার আমি আপনাকে কতো দেবো বলুন?’
আমি হেসে ফেললাম।‘আপনি দিতে চাচ্ছেন আমাকে? হ্যাঁ, দিতে পারেন। বাড়ি ফেরার ভাড়াটা।’
ইরিনাও হাসলো,‘বাড়ি আমি আপনাকে পৌছে দেবো।’
‘আপনি?’
‘হ্যা্’ঁ
‘আপনি আমার বাড়ি যাবেন?’
‘যাবো।’
‘সত্যি?’
‘সত্যি। কারন আমি আপনার মাকে বলবো যেন উনি আপনাকে বাড়ির বাইরে বের হতে না দেন। আপনি নিজেই কখন যে হারিয়ে যান তাই বা কে জানে।’
আমি হা হা করে হেসে উঠলাম। ‘আপনার ধারনা আমি একটা শিশু কারন আমি আমার মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলেছি।’
‘ঠিক তাই।’
‘ভুল।’
‘ভুল?’
‘হ্যাঁ, কারন এই আমিই আবার আজ আপনার মতো একজনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললাম এই বা কম কিসে?’
ইরিনা মুখ বাঁকালো,‘উঁহু এটা কোন ব্যপার হলোনা। মানুষ এর চেয়েও বড়ো বড়ো কাজ করে।’
‘যেমন?’
‘যেমন মানুষ চাঁদে গেছে, পারমানবিক বোমা বানিয়েছে, কতো কিছু আবিস্কার করেছে আর আপনি?’
‘আমি আবিস্কার করেছি আপনাকে।’
ইরিনা হাসলো,‘এটা কোন আবিস্কার হলো? আমি তো এখানেই ছিলাম।’
‘আমি আপনাকে আবিস্কার করলাম এটাই আমার কৃতিত্ব। আপনি সত্যি বলছেন আমার বাড়ি যাবেন?’
‘অবশ্যই যাবো।’
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম সকাল দশটা বাজতে চলেছে। ববিদের দিকে তাকালাম। ওরা নিজেরা নিজেদের ভেতর কি নিয়ে যেন গল্প করছে আর ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। একটু পর ববি উঠে এলো। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ও অন্যদের সাথে কি যেন পরিকল্পনা করে এসেছে। চেহারায় কেন যেন মুখস্ত মুখস্ত একটা ভাব ফুটে উঠেছে।
‘কিরে? কিছু বলবি?’ আমি ববির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম।
ববি আমাকে পাত্তাই দিলোনা। সে ইরিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,‘আপনাকে তো চিনলামনা, আপনি কি ওর গার্লফ্রেন্ড?’
ইরিনা মূহুর্তে লাল হয়ে গেল। কিন্তু ও সামলে নিয়ে বললো,‘কি হলে আপনি খুশি হবেন?’
‘আপনি যদি ওর গার্লফ্রেন্ড হয়ে থাকেন তবে আমি সবচেয়ে বেশী খুশি হবো কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ব্যপার হলো ও আমাদের কাছে কোনদিন আপনার কথা বলেনি। এইটা ও খুব খারাপ করেছে।’ ববির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ও সিরিয়াসলি বলছে। ‘আমি ওর ক্লোজড ফ্রেন্ড কিন্তু ও আমার কাছেই বলেনি আপনার কথা।’
ইরিনা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো,‘বলেননি কেন?’
আমিও হাসলাম,‘কারন আমি চেয়েছিলাম পহেলা বৈশাখের দিন ওদেরকে সারপ্রাইজ দেবো। তোরা সারপ্রাইজড তো?’
ববি বললো,‘সারপ্রাইজড মানে? আমি তো এখনও বিশ্বাস করতেই পারছিনা যে তোর মতো একটা ছেলে এমন রূপসী একটা মেয়ে বাগাতে পারে। আর তুই তো কোন কথা চাপা রাখতেই পারতিসনা, কিভাবে এমন একটা গল্প চাপা রাখলি বলতো?’
আমি বলার আগেই ইরিনা বললো,‘অনেক কষ্টে। অনেকবার ফোন করে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আপনাদের বলবে কিনা। আমিই নিষেধ করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম পহেলা বৈশাখের দিনই ওদেরকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। তাই ফোন হারানোর ভান করে আপনাকে ডেকে এনেছিলাম।’
আমি ইরিনার বুদ্ধিমত্তা দেখে হতবাক হলেও মনে মনে ওর প্রশংসা করলাম। এ ধরনের বুদ্ধি সব মেয়ের থাকেনা। মনে মনে আরও আনন্দ লাগছিলো যে ইরিনা নিজেই স্বীকার করলো যে সে আমার গার্লফ্রেন্ড। জানিনা বিষয়টা ও মন থেকে বলছে কিনা। নাকি ওদের সাথে ফাজলামী করছে? যাইহোক, মেয়েটার একটা প্রস্তুতি আছে বলতে হবে। আমার ভালো লাগছে যে আমাকে আর বেশী দুর এগুতে হবেনা।
ববি ইশারায় বাকিদের ডাকলো। সবক’টা এসে ঘিরে দাঁড়ালো আমাদের। ইশান আমার মাথায় একটা খোঁচা দিলো,‘কিরে শালা, তুই আমাদের ঠকিয়েছিস, এখন তোকে এর জরিমানা দিতে হবে।’
‘উনি জরিমানা দিতে পারবেননা কারন ওনার মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে।’ ইরিনা আমার হয়ে বললো,‘আমি জরিমানা দেবো।’
‘তাই?’ সাগর পাশ থেকে বললো।‘তাহলে তো আমরা আজ বাইরে লাঞ্চ করছি।’
‘নো প্রবলেম,’ ইরিনা বললো।‘আজ আমরা বাইরে খাবো এবং তারপর ফিরে আসবো আবার। এখানে।’
‘আবার এখানে ফিরে আসবো?’ আমি বললাম।
‘আমরা আজ এখানেই থাকবো সারাদিন। বছরের প্রথম দিন। কবিতা লিখবো। ঘুরবো। চটপটি খাবো। ছবি আঁকবো।’ ইরিনা বললো। ‘আপনি কি বলেন?’
আমি বললাম,‘আমার আপত্তি নেই।’
‘আপনি আপনি কেন?’ ববি বললো,‘তুমি নয় কেন?’
‘সময় হলে।’ ইরিনা বললো।‘আমিই বলবো।’
‘না-না, আজ। আজ যখন এতোকিছু হবে তখন এটা বাকি থাকে কেন?’ ববি বললো।‘আজই তুমি শুরু হবে।’
আমি হাসলাম,‘না আজ নয় অন্যদিন।’
‘না আজই।’ ইশান অনড়, ‘আমরা দেখতে চাই।’
‘এটা একটা বিশেষ দিন।’ ববি আবার বললো।‘নামটাই তো জানলামনা।’
‘ইরিনা।’
‘চমৎকার নাম। তো ইরিনা আমি দেখতে চাই আপনি ওকে তুমি করে ডাকছেন।’
ইরিনাও এক ডিগ্রী বেশী। ও আমার দিকে ফিরে বললো,‘তুমি বলো আমরা কোথায় কি দিয়ে লাঞ্চ করবো?’
আমি হেসে বললাম,‘আপনি খাওয়াবেন আপনিই বলতে পারবেন সেটা।’
‘এ্যাই!’ ববি ধমকে উঠলো,‘আপনি কি? ও তোকে তুমি বলছে আর তুই ওকে আপনি বলছিস?’
‘আচ্ছা তুমি বলবো।’
‘বলবো কি? বল?’
‘আমি একটু দেরি করে বলতে চাইছি।’
‘না-না কোন দেরি নয়। আজ এই শুভক্ষনে বলতে হবে।’ জেদ ধরলো ববি। ‘বল। আমাদের সামনে বল।’
‘আচ্ছা তুমি।’
‘আচ্ছা তুমি কি? একটা সেনটেন্স বল?’
আমি ইরিনার দিকে তাকিয়ে বললাম,‘তুমি যা খাওয়াবে তাই আমরা খাবো।’
ছয়জন একসাথে চিৎকার করে উঠলো। ববি, ইশান, সাগর আর ওদের তিন বান্ধবী। লোকজন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। মাত্র দুটো ঘন্টা আগেও আমরা কেউ কাউকে চিনতামনা। আর এখন, দু’ঘন্টা পর, একে অন্যকে আমরা তুমি করে বলছি।
একেই বলে ভাগ্য। বছর শুরুর দিনেই তার সাথে পরিচয় এবং দু’ঘন্টা পরই তুমি করে বলা। একে সাহিত্যের ভাষায় কি বলা যেতে পারে তা আমার জানা নেই তবে যদি শিল্পীর তুলি দিয়ে তা প্রকাশ করা হয় সেটা বোধহয় আরও ভালো ফুটবে, কারন আমরা দু’জনই ভালো শিল্পী।
ববি, ইশান আর সাগর তিনজনই পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। ববি বললো,‘দু’জন দু’জনার হাত ধর-আমি ছবি তুলবো।’
ও ঘুরে এসে আমাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।
অনিচ্ছা সত্বেও আমি ইরিনার হাতে হাত রাখলাম। ইরিনাও একটু সংকোচ করে আমার হাত ধরলো।