স্বাধীনতার পরপরই মা আমাদের গ্রাম থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে শ্রীমঙ্গল চলে যায়। আমি তখন মাত্র কয়েক মাসের বাচ্চা। মা ওখানে চা বাগানে কাজ নেয়। আমার মায়ের গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু চোখা নাক খুব সুন্দর। খুব মায়াময় চেহারা। সহজেই সবার চোখে পরতেন। আর আমার চেহারা? একেবারে ফর্সা, লম্বা ছয় ফুট। দেখলে যে কেউ ভাবে পাঠান!!
আমার বাবা করিম উদ্দিন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই এপ্রিলের শুরুতে পালিয়ে ভারত চলে যান ট্রেনিং নিতে। রমিজ চাচা বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। এক সময় মাকে খুব পছন্দ করতেন। মায়ের বিয়ে হয় বাবার সাথে, তখন থেকেই তার হিংসা ছিলোই। বাবা যুদ্ধে যাবার পর থেকেই তার আমাদের বাড়িতে আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিলো। মায়ের কাছ থেকে বাবার খোঁজ জানতে চাইতেন। মা কখনোই বলেনি বাবা কোথায় গিয়েছে। রমিজ চাচা ধারণা করতে পেরেছিলেন বাবা যুদ্ধে গেছেন। একদিন রাতে দরজা ঠকঠকালো। মা ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কে? বাহির থেকে উত্তর এলো, ভাবি আমি রমিজ দরজা খুলেন। আমার মা সরল বিশ্বাসে দরজাটা খুলে দিয়েছে। দরজা খুলতেই তিন চারজন পাকিস্তানি আর্মি ঘরে ঢুকলো। এরপর টানা সাত মাস আমার মায়ের উপর দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চলেছে। আর এরই ফসল হচ্ছি আমি। নিজেকে ভালোবাসার কোন কারণ আছে কি?
আমি এসব কিছুই জানতাম না। মা নিজের পরিচয় লুকিয়ে চা বাগানে কাজ নিয়েছে। সেখানেও মা খুব শান্তিতে ছিল তা না! বড় বাবু ছোট বাবু সহ আরো অনেকেই মায়ের একা থাকার সুযোগটা নিয়েছে। মা সব সহ্য করেছে শুধু আমার জন্য। মায়ের একটাই ব্রত ছিল, আমাকে মানুষ করতে হবে। আমি মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই মা এড়িয়ে যেতো। যখন আমার ১১ বছর বয়স! একদিন মা আমাকে ডেকে অনেক কথা বলল। তখন সব কথার মানে বুঝিনি। বরং মায়ের উপর আমার ঘৃণা জন্মেছে রাগ, অভিমান। মনে আছে অনেকদিন মার সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছিলাম।
আমার বাবার পরিচয় না কি মায়েরও জানা নেই। মা মাঝে মাঝে বলতো, মায়ের উপর কতজন যে অত্যাচার করেছে কোন হিসেব নেই। শুধু একজনের কথা আলাদা করে বলতে পারে মা। ইয়াসির খান। সবার মতো সেও মাকে ভোগ করেছে কিন্তু কোথায় যেন তার একটা টান ছিল মায়ের প্রতি। মাঝে মাঝে নিজের খাওয়া থেকে কিছু খাওয়া উঠিয়ে রাখতো মায়ের জন্য। সবাই যখন অত্যাচার করতো, একমাত্র ইয়াসির খানে সে মাঝে মাঝেই ওষুধ খাইয়ে যেত। মায়ের কেন যেন মনে হয়, আমার মধ্যে মা ইয়াসির খানের ছায়া দেখতে পায়। আমার শারীরিক গড়ন রং চেহারার আদল নাকি ইয়াসির খানের সাথে মিলে যায়। আমি বুঝতে পারিনা লোকটাকে কি আমি মায়ের অত্যাচারী হিসেবে ঘৃণা করবো নাকি নিজের বাবা হিসেবে মেনে নিবো? নিজেকে জারজ সন্তান ভাবতে খুব কষ্ট হয়। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে।
মা আমাকে কতোটা ভালোবেসেছে তা এখন উপলব্ধি করি। আমি যখন হতবিহ্বল হয়ে যেতাম কিংবা হতাশায় ভুগতাম! মা বলতো, তোর বাবা কে আমি জানি না কিন্তু তুই আমারই ছেলে এটা জানি। তোর কি আমার পরিচয়ে বড় হতে সমস্যা আছে? আমি মেনে নিতাম আবার নিতাম না।
মায়ের আগ্রহে আর পরিশ্রমের ফল আমি আজ পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকুরে। এখন আর আমার অতীত কেউ জানতে চায় না। আমার পরিচয়েই আমি পরিচিত। একটা সময় মাকে আমি অভিমানে দূরে সরিয়েছি আর এখন? আমি সারাদিন আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে খুঁজি অন্য মায়েদের মাঝে। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এগারো বছর আগে। আমি বিয়ে থা করিনি। সারাদেশে চষে বেড়াই আর সেই মায়েদের খুঁজে বের করি, যারা ১৯৭১ এ পাকিস্তানিদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে এবং এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। আমি তাদের আমার কাছে নিয়ে আসি। আমার এক মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এখন আমার কাছে আরো চার মা আছেন। একদিন হয়তো আমার কাছে হাজারো মা থাকবেন। আমি আমার মায়েদের মাঝেই আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে পাই। নিজেকে এখন আর একা মনে হয় না। হাজারো বীরাঙ্গনা মায়েদের আদরের সন্তান হয়েই এদেশে আমার বেঁচে থাকা।
বিঃদ্রঃ এটা সত্য ঘটনা না। তবে অনেক সত্য ঘটনা আমরা হয়তো জানিও না।