নীল নির্জনে...................সেমন্তী ঘোষ

প্রকৃতির বিমূর্ত বিচিত্র রূপ। একদিকে তার সৃষ্টির মহিমান্বিত মধুর কলতান,অন্যদিকে প্রলয়হারিনি ধ্বংসের সুর।চতুর্দিকে কত বৈচিত্রের সমাবেশ -কল্পনার ইন্দ্রধনুর বর্ণালী। কোথায় মরুর বুকে উঠের সারি,কখনো অরন্যের বুগিয়ালী স্বপ্নসুখ।আবার কখনো সহস্য তুষারধবল শৃঙ্গরাশি উচ্চশির দণ্ডায়মান,কখনো বা দরিয়ার দিগন্ততটে শুভ্র ফেনায়িত তরঙ্গ রাশির উত্তাল সমীরন। প্রত্যেক রূপেই সে অনন্যা। কর্মসূত্রে 'ইনফরমেশন এন্ড টেকনোলজির সেন্টারে'র অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট ম্যানেজার,সহ অধ্যাপিকা হওয়ার জন্য এই অনন্ত চলার পথে বারংবার বিভিন্ন রূপে দেখা সেই প্রকৃতির সাথে__তার সৃষ্টির জলছবির কাহিনী তাই স্বপ্নের বিভোরতায় গল্পের পাহাড় বুনে হৃদয়ে এক বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছে....

প্রকৃতির ক্যানভাসে স্বপ্নিল সুখ 
অনাহুত আবিলতা দরিয়ার রূপ
বিগলিত অশ্রুর মুখরিত ধ্বনি
"কলমের ডাকনামে" দিনমানে শুনি......

নীল দিগন্তের মাঝে উত্তাল সমুদ্রের শান্ত সমাহিত রূপের সন্ধানে এবারের যাত্রা আন্দামানে।বহুচর্চিত ঐতিহাসিক ও স্বদেশীদের সাক্ষ্য বহন করা পোর্টব্লেয়ারের 'সেলুলার জেল'আর নীল আইল্যান্ডের নিবিড় সমুদ্র তটে।কলকাতা থেকে সকালের বিমানে পোর্টব্লেয়ার। বিমানবন্দরে নামার আগেই বিমান থেকে দেখা যায় সবুজ বনানী ঘেরা বিভিন্ন আইল্যান্ড আর নীলরঙা সমুদ্র। ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপাসাগরের বুকে অবস্থিত ৫৭২ টি দ্বীপের সমষ্টি নিয়ে এই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। যার মধ্যে যাওয়ার অনুমতি মেলে কেবল মাত্র ৩৮ টি দ্বীপে। এই দ্বীপ গুলির মধ্যে সবথেকে শান্ত সমাহিত রূপে বৈচিত্র্যে ভরা অথৈ নীলের অপার সাগর বেলা নীল আইল্যান্ড। কাজের সূত্রে বারবার আসার জন‍্য এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার সময় ২০১৪, ২০১৭ আর ২০১৯ পরিবর্তনটা বেশি করে যেন চোখে পড়ছিল। কালের নিয়মে পরিবর্তন আসবেই তবুও প্রকৃতির মায়াবী রূপের যে মনোহর ছটা আগে দেখেছিলাম আজ মানুষের ঢল, হোটেলাদি নির্মাণে অনেকটাই ম্লান মনে হল।

এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'সবুজ দ্বীপের রাজা' তার গৌরব হারিয়ে ম্লান হয়ে যাবে না তো যন্ত্রমানবের রূপায়নে!!!!যদিও পরবর্তী মুহূর্তেই নীলাভ প্রকৃতির সুরেলা ধ্বনি এই প্রশ্ন ভুলিয়ে হৃদয়ের আঙিনায় প্রশান্তির ঢেউ তুলে সব দ্বিধা দূর করে দিল তার অসীম রূপমাধুর্যে।হোটেলে পৌঁছে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পৌঁছে গেলাম নিরালা নিভৃতে আকাশের নীল আর সমুদের নীলের নীল দরিয়ায়। নিরালা নির্জনে শ্বেতশুভ্র সৈকতবেলা 'করবাইনস কোভ'। প্রকৃতির পরম যত্নে কোমলতায় আচ্ছাদিত এখানকার ঢেউয়ের খেলায় একবার নামলে খুব কম মানুষ এখান থেকে সহজে উঠতে চান।মনে হয় যেন শান্ত বেলাভূমির কোলঘেঁষে চঞ্চল সমুদ্র শখার অনন্তকালের অবিশ্রান্ত খেলায় আরো কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে যাই। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে থেকে হোটেলে ফিরে এসে দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষে যাওয়া হল ঐতিহাসিক সেলুলার জেলে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত দলিল। সাগরমুখী পাহাড়ের পিছনেও খাড়া পাহাড়। জানালাহীন সংকীর্ণ সেল। সাগরের রং কালো হোক বা না হোক রক্ত সংগ্রামের ইতিহাসে "কালাপানি"। পাশে রয়েছে ফাঁসি ঘর।উপরে টাওয়ার;যেখান থেকে পূর্বে নজর রাখা হত সমগ্র জেল চত্বরের। সেখান থেকে উন্মুক্ত প্রকৃতির রূপ বিস্মিত করে। বিকেলে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো এর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাস। যা এই অনন্ত সৌন্দর্যের মাঝেও মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া হলো মেরিন পার্কে। সাগরপারের মৃদুমন্দ নির্মল বাতাসের মনোরম পরিবেশ।চোখে পড়বে বিধ্বংসী সুনামির স্মারকরূপে' একটি স্মৃতিসৌধের স্তম্ভ। রাত্রি অতিবাহিত সুখস্মৃতি রোমন্থনে।পরের দিন সকালে যাত্রা করা হল নীল এর উদ্দেশ্য। পোর্টব্লেয়ার থেকে নীলের দূরত্ব প্রায় 37 কিলোমিটার।পোর্টব্লেয়ার বা হ্যাভলক থেকে জাহাজে চেপে আসা যায় নীল আইল্যান্ড। জাহাজের সামনের আর পিছনের ঢেউ খেলানো জলের তোড় ডেকে বসে দেখতে দেখতে আমরা পৌছে গেল নীল দ্বীপে। জাহাজ থেকে নেমে জেটি দিয়ে হেঁটে আস্তে আস্তে চোখে পড়ল স্বচ্ছ নীল জলের নীচে কোরালের রাজ্য। তটভূমি বরাবর সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে স্পিডবোট, গ্লাস-বটম র্বোট, ওয়াটার স্কুটার। সবদিক জুড়ে নারকেল সুপারি সহ বিভিন্ন গাছ গাছালি। সাথে আনা ব্যাগ হোটেলে রেখে বেরিয়ে পড়া হল নীলাভ্র জলের মায়ার টানে। আসমানী নীল আর জলতলের নীলে প্রকৃতির রূপের বাহার। জলের স্বচ্ছ রং এ যারা শুধুমাত্র পাহাড় প্রেমী তারাও এসে প্রেমে পড়ে যাবেন।এখানে বেশ কতকগুলি সমুদ্র সৈকত রয়েছে -ভরতপুর, লক্ষণপুর,সীতাপুর প্রভৃতি।প্রত্যেক জায়গাতেই নীল জলের স্বচ্ছ রূপ। জলের স্বচ্ছতা এতটাই যে গভীর জলে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের পাতা দেখা যায়।বেশ কয়েকজনকে দেখলাম 'স্নরকেলিং' এ যেতে।আমরা গেলাম 'গ্লাসবটমে' চেপে গভীর জলের তলদেশের কোরাল,স্টারফিশ দেখতে।বেশিরভাগই জীবিত কোরালের সমাগম। ফিরে আসার সময় সমুদ্রতটে কিছু শামুক,ঝিনুক,শঙ্খ জমে আছে দেখলাম। সেখান থেকে যাওয়া হলো রক ফাউন্ডেশন দেখতে। অসংখ্য কোরাল, কাঁকড়া,সামুদ্রিক ছোট ছোট প্রাণী,রঙিন মাছ আর পাথুরে বোল্ডারে পরিপূর্ণ অঞ্চল। মুহূর্তকে মুহূর্ত বন্দি করে সেখান থেকে ফিরে এসে সীতাপুর বীচে ঘুরে আসা হলো। চাইলে নীল জলতটৈ নিজেকে ভিজিয়ে নেওয়া যেতে পারে।নীল সবুজের চোখজুড়ানো জলছবি। 

আবারো ফিরে যাওয়া হল লক্ষণপুর বীচে। নীল নির্জন বালুচরে বসে মনে হল সমুদ্রের অসীম জলরাশি যেন সাদা বালির বুকে আলপনা এঁকে দিয়ে যাচ্ছে।প্রাত্যহিক ক্লান্তিময় শহুরে জীবন থেকে দূরে নিস্তব্ধতার মাঝে ঢেউয়ের তালে পৃথিবী যেন তার আপন সৌন্দর্য ছড়িয়ে রেখেছে এখানে। রুপমাধুরীর এক অমোঘ আকর্ষণে স্নিগ্ধ বাতাস অনির্বচনীয় নির্জনতা মুখর হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে সূর্য অস্তাচলে। সমুদ্রের জলে ক্ষণে ক্ষণে সেই রঙের পরিবর্তন। কখনো আবির রাঙালাল,কখনো কমলা,আবার কখনো হালকা লালে।ধীরে ধীরে দূর সমুদ্রের বুকে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম হাসিতে গোধূলি বেলার ঝিরঝিরে সমীরন। মধুর হাওয়া আর নীলাভ স্বপ্নকে সাথে নিয়ে হোটেলে ফিরে আসা হলো। পরেরদিন প্রভাতে একই ভাবে ক্রজে চেপে ফিরে আসা হল পোর্ট ব্লেয়ার।পোর্টব্লেয়ার এসে দেখে নেওয়া হলো এনথ্রপলজিকাল মিউজিয়াম,সামুদ্রিকা নাভাল মিউজিয়াম আর জুওলজিক্যাল মিউজিয়াম। এক মুঠো স্বপ্নসুখের স্মৃতি কে অবলম্বন করে পরের দিনের বিমানে ফিরে আসা হল কলকাতায়। তবুও চোখে লেগে রইল নীল মেঘতটে সাদা বালুকারাশিতে নীল আইল্যান্ডের মোহ........

(চলবে)

ছবি: পৃথ্বীশ ভদ্র

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট