পুকুরের স্বচ্ছ জলে আকাশচুম্বী নারিকেল গাছগুলোর ছাঁয়া ভাসছে। নীল আকাশে তুলতুলে সাদা মেঘগুলো দলবেঁধে ছুঁটছে অজানায়। হালকা মিষ্টি বাতাসে জলে একটা অদ্ভুতরকম কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে আর সেই টলটলে জলে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে নীলাম্বরী। আজ তার মন ভালো নেই। মন খারাপের সময়টা সে এই পুকুরপাড়েই একা বসে থাকে। বসে বসে সে এটা ওটা আরো কত কি যে ভাবে! এই যেমন আজ তার মনে হলো সে পুকুরে ঝুপ করে একটা লাফ দিবে তারপর সেই শীতল শ্যামল বারিতে সে মৎস্যকন্যার মত উথাল-পাথাল সাঁতার কাটবে এপাশ থেকে ওপাশ। গল্প করবে মাছেদের সাথে, জানবে তাদের জীবন কেমন। তাদেরও কি এই উষ্ণতাহীন পাতালপুরী থেকে ক্ষনিকের জন্য হলেও সূর্যালোকের তপ্ত জগতে আসতে ইচ্ছে করে? কিন্তু নীলাম্বরীর আর তা জানা হয়না কারন সে যে সাঁতার জানেনা। তাই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাঁকালো আর ওমনি তার মনে হলো সে ওই পাখিগুলোর মত উড়তে চায়। যখন যেখানে খুশি উড়ে বেড়াবে, মন্দ কি! এলোমেলো এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ নীলাম্বরী খেয়াল করলো জলে কার যেন একটা ছায়া পড়েছে। -কিরে নীলু এখনো এখানে বসে আছিস? বললো কণিকা।
কণিকা, ভীষণ মেধাবী আর বুদ্ধিমতি মেয়ে। ধনাঢ্য পরিবারের একমাত্র মেয়ে, যেমন সুন্দরী তেমন চটপটে। ওরা স্কুলজীবন থেকে একসাথেই বড় হয়েছে, বলতে গেলে বেস্ট ফ্রেন্ড। অথচ দুইজনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য একদমই যেন দুই মেরুর! তাই বন্ধুমহলে প্রায়ই সবাই ওদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে কিন্তু ওরা যেন সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকেই দলিলে সই করে ওদের বন্ধুত্বের একশো ভাগ সত্তাধারী হয়ে এসেছে। পরিস্থিতি যেমনি হোক না কেনো ওরা সবসময় একে অপরের পাশে থাকবেই!
নীলাম্বরী চুপ করে রইল। কণিকা তার পাশে এসে বসলো।
-নীলু মন খারাপ করিসনা।
-আমার যে মন খারাপ তোকে কে বললো? নীলাম্বরীর শীতল কন্ঠ।
-এতো বছর পরও এই একই প্রশ্ন তুই প্রতিবারই করিস। তোর মন খারাপ আর আমি জানবোনা! কণিকার উত্তর। নীলাম্বরী এবার একটু হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো, -ইশ এতো বছর পরও যদি সবকিছু একটু বদলাতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ এই প্রশ্নই করতে হতোনা।
-কি দরকার এসব ভেবে? মানুষের হাতে কি আর সব থাকে? তাছাড়া তুই তো তোর জায়গা থেকে অনেক চেষ্টা করছিস, আর কত? বললো কণিকা।
-থাক এসব কথা। চল ক্লাসে যাই। নীলাম্বরী উঠে দাঁড়ালো।
-না আজ ক্লাসে যাবোনা, আজ আমরা দুইজন সারাদিন রিকশায় ঘুরবো, ফুচকা খাবো, আর রাতে তুই আমার বাসায় থাকবি। কণিকার আবদার নীলাম্বরী ফেলতে পারেনা কারন সে জানে কণিকা কেন এসব করে। সে জানে পৃথিবীতে তার সবচেয়ে কাছের মানুষদের মধ্যে কণিকা অন্যতম।
রিকশায় এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে ক্যাম্পাসে এলো নীলাম্বরী আর কণিকা। ক্যাম্পাসের করিম মামার দোকানের ফুচকা চটপটি তাদের খুব পছন্দ। শুধু তাদেরই না বরং সবার কাছেই বেশ নামডাক আছে মামার দোকানের। নরম আলু আর গোল গোল গরম ডাবরির উপর মামা কি যেন একটা চটপটে মসলা ছিটিয়ে দেয় যা তাদের কাছে অমৃতের মত লাগে! তেতুলের টক মিষ্টি স্বাদ যেন তাদের মনের ক্ষুধা আরো বাড়িয়ে দেয়, তাই তারা প্রায়ই এখানে আসে সেই অমৃতের স্বাদ নিতে।
-আরে কণিকা দেখি! কেমন আছো? আজ তোমরা ক্লাসে আসোনি কেনো? বললো শুভ্র।
শুভ্র ওদের দুই বছর আগের ব্যাচের ছাত্র কিন্তু ওদের সাথে বেশ খাতির। মাঝে মাঝেই শুভ্র ওদের বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে ওঠে। তবে কেন জানি শুভ্রর এই অযাচিত অনুপ্রবেশ কণিকার ভালো লাগেনা।
-আজ আমাদের ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করেনি তাই আর যাওয়াও হয়নি! বললো নীলাম্বরী।
-আমরা ক্লাসে গিয়েছি কিনা সেটা আপনার জেনে কি হবে? আর তাছাড়া আপনি জানলেনই বা কিভাবে? আপনি কি তাহলে ২ বছর লস দিয়ে আমাদের ব্যাচের সাথে ক্লাস শুরু করলেন নাকি? বলেই একটা দুষ্টু হাসি হাসলো কণিকা।
একটু বিব্রতবোধ করলো শুভ্র, সে বোঝে না কণিকা কেন তার সাথে এমন টিপ্পনী কেটে কথা বলে। তাকে অপদস্ত করে কণিকা কি মজা পায়? -না মানে রিচির সাথে দেখা হয়েছিলো, সে বললো তোমরা নাকি আজ ক্লাসে আসোনি। তাই ভাবলাম তোমরা ঠিক আছো কিনা! ইনিয়েবিনিয়ে শুভ্র বললো।
-আচ্ছা শুভ্র ভাই, আমরা আজ আসি। আরেকদিন কথা হবে কেমন? ভালো থাকবেন। বলেই কণিকা নীলাম্বরীর হাতটা ধরে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো।
কিছুদূর যেতেই নীলাম্বরী কণিকাকে বললো, -কণি তুই সবসময় শুভ্র ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলিস কেন? সে তো আমাদের খারাপ কিছু বলেনি কখনো!
কথাটা শুনে কণিকার মনে হলো সত্যিই তো! কেন সে এমন করে শুভ্রর সাথে আর কেনই বা তার ওকে ভালো লাগেনা? শুভ্র ওদের ২ বছর বড় তারপরও এতো বেশি সখ্যতা চায়, তাই বলে কি কণিকার সন্দেহ হয়? শুভ্র কোনদিন কোন ক্ষতি করবেনা তো ওদের বা ওদের বন্ধুত্বের? এসব ভাবতে ভাবতেই কণিকা নীলাম্বরীর প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে যায় বা দিতে চায়না।
কণিকাদের বাড়িতে আসলেই নীলাম্বরীর মনে হয় সে কোন সাধারণ ইট পাথরের বাড়িতে নয় যেন একটা সোনাখচিত বিশাল রাজপ্রাসাদে বেড়াতে এসেছে। ডুপ্লেক্স এই বাড়িতে কেবল দেশি নয় বরং বিদেশি আধুনিক সব সরঞ্জামাদি আর সুযোগ সুবিধাও রয়েছে। জীবনকে সহজ ও সুন্দর করতে কোনরকম কমতি নেই এখানে। একাধিক চাকর বাকরের টুয়েন্টি ফোর সেভেন পরিচর্যা ও সেবায় বাড়ির চারপাশটা একদম স্বর্ণের খনির মত চকচক করে। খালি একটাই সমস্যা। বাড়িতে মমতাময়ী মা নেই। কণিকার বয়স যখন ৫ বছর তখন তার মা মারা যায়। মা ছাড়া বাড়িতে যে শুন্যতা বিরাজ করে তা নীলাম্বরীর ভালো লাগেনা। হয়তো কণিকাও তাই বাড়িতে থাকার চেয়ে বাইরে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কণিকার বাবা অনেক বড় ব্যবসায়ী। নাহ ব্যবসায়ী বললে ভুল হবে, ব্যবসায়ী তো আলু, পেঁয়াজ বিক্রেতাকেও বলা হয় অথবা মোড়ের মুদি দোকানদার সেও তো ব্যবসায়ী! কণিকার বাবাকে বিজনেস ম্যাগনেট বললে হয়তো তার উপযুক্ত পরিচয় দেয়া হবে। তিনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। বাড়িতে তাকে দেখাই যায়না। আজ দেশে তো কাল বিদেশে।বাড়িতে ফেরেনো বেশ রাত করে তাই কণিকার সাথে তার দেখাও হয় কয়েকদিনে একবার। কণিকা পরিবারের ভালোবাসা, বন্ধন থেকে অনেক বেশি বঞ্চিত বলে নীলাম্বরীর খুব মায়া হয়। যদিও কণিকা কখনোই তার একাকিত্বের অনুভূতি প্রকাশ করেনা। সে খুব শক্ত মানসিকতার যে! আজ কোন এক কারনে কণিকার বাবা মিস্টার রায়সুল কবির বাড়িতে একটু আগেই ফিরেছেন। দরজা দিয়ে ঢুকতেই নীলাম্বরীর সাথে তার দেখা হয়ে গেল।
-আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন আপনি?
নীলাম্বরীকে দেখেও না দেখার ভান করে মোবাইল টিপতে টিপতেই রায়সুল সাহেব ভেতরে চলে যান। ব্যাপারটা নীলাম্বরী খেয়াল করে তবে অবাক হয়না কারন এমন এর আগেও হয়েছে তার সাথে। সে বোঝে যে তার এ বাড়িতে আসা কণিকার বাবা পছন্দ করেন না। এদিকে টেবিলে রাতের খাবার তৈরি বলে কণিকা নীলাম্বরীকে ডাক দেয়। দু'জনে টেবিলে বসতেই রামু কাকা কণিকাকে বলেন, -কণি মনি স্যার আপনারে ডেকে পাঠাইসেন।
রামু কাকা হলেন এ বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো সেবক। কণিকার পুরো শৈশব যেন তার হাতেই বোনা। ভীষণ স্নেহ করেন কণিকাকে।
-এখন যেতে পারবোনা বলে দাও। খেতে বসেছি দেখছোই তো! গম্ভীর গলায় বলে কণিকা।
-কিন্তু স্যার যে এখনই ডেকে পাঠাইসেন! একটুখানি শুইনা আসো লক্ষী মামনি আমার!
বেশ বিরক্তি নিয়েই কণিকা উঠে তার বাবার রুমে যায়।
-আমাকে ডেকেছো বাপি?
-হুম কেমন আছো তুমি? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?
-এটা জানতেই কি ডেকেছো! যাই হোক, আসল কথাটা বলে ফেলো বাপি আমি শুনছি। খুব দৃঢ়ভাবে বললো কণিকা। -আসল কথাতো তুমি জানোই কণিকা! তোমাকে না কতবার বলেছি তুমি ওই মেয়েটার সাথে মিশবেনা। তোমাকে আর কতবার বুঝাবো যে তুমি আমার মেয়ে, মিস্টার রায়সুল কবিরের মেয়ে! তুমি যার তার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারোনা। তোমাকে স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে চলতে হবে। তোমার বন্ধু হবে আমাদের মতই বড়লোক ঘরের ছেলেমেয়েরা আর তুমি কিনা ওই রিটায়ার্ড সরকারি চাকুরীজীবি একটা হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ের সাথে টইটই করে ঘুরে বেড়াও! একবারও কি তোমার আমার মান সম্মানের কথা মনে হয়না?
প্রতিবারের মতই এবারো কথাগুলো শুনে কণিকার রাগে শরীরে জ্বালা দিয়ে ওঠে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে সে আবারও বলে ওঠে, -বাপি তোমাকে আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, নীলু আমার খুব কাছের বন্ধু তার ব্যাপারে আমি এসব অবান্তর কথা আর শুনতে চাইনা। তাছাড়া বন্ধুত্বে আবার স্ট্যাটাস কিসের? স্ট্যাটাস দিয়ে আর যাই হোক বন্ধুত্ব হয়না বাপি আর যদি হয়েও থাকে তাহলে সেটা বন্ধুত্ব নয়, সেটা কেবল স্বার্থের আদান-প্রদান। স্বার্থ ফুরোলে সেই বন্ধুত্বও ফুরিয়ে যায়। যাই হোক, তুমি এসব বুঝবেনা, তার চেয়ে বরং তুমি তোমার বিজনেসের হিসাবের বইটা দেখো!
বলেই কণিকা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আর রায়সুল সাহেব বিরক্তিভরে তাকিয়ে রইলো। ফিরে এসে কণিকা দেখলো নীলাম্বরী দাঁড়িয়ে আছে মেইন গেটের সামনে। -কিরে কই যাচ্ছিস নীলু?
-বাসা থেকে ফোন এসেছিলো মায়ের শরীরটা আবার খারাপ করেছে। আমাকে যেতে হবে রে!
-কিন্তু রাতের খাবারটা খেয়ে যা!
-না রে আজ থাক, অন্য কোনদিন। বলেই নীলাম্বরী বেরিয়ে যায়।
কণিকা জানে যে নীলু সবই বোঝে। তার খুব কষ্ট হয় নীলুর জন্য। একইসাথে ভীষণ রাগ হয় এই ভেবে যে একটা ছোট্ট জীবনে "স্ট্যাটাস মেইনটেইন" এর নামে মানুষের এই রঙ তামাশা কবে বন্ধ হবে? আসলেই কি বেঁচে থাকতে এতোকিছুর প্রয়োজন, নাকি সবই মানুষের বানানো নাটক? জীবনে যদি সুখই না থাকে তবে কি হবে এই "স্ট্যাটাস" দিয়ে!
(চলবে........)
চালিয়ে যান। আসলেই মা না থাকলে সে সংসারকে কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগে!
Replyগল্পটা অনেক সুন্দর হয়েছে। দ্বিতীয় পর্ব দিন।
Replyজি সত্যিই তাই...মা ছাড়া বাড়ি যেন প্রানহীন নিথর দেহ।
Replyঅবশ্যই সামনের দিনে পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে আশা করছি। সাথেই থাকবেন! 🙂
Replyবাংলা সিনেমার মন হয়ে গেল গল্পটা।
Replyজি গল্প সিনেমা সবই তো আসলে জীবন থেকেই নেয়া। 🙂
ReplyDarun hoyeche really����
Replydhonnobad
Replyপড়ে ভালো লাগলো। আরেকটা পর্বের জন্য অপেক্ষায় আছি
Reply