মন অরণ্যের শূন্যতা ( পর্ব ২)........জান্নাতুল ফেরদৌসী

মন অরণ্যের শূন্যতা ( পর্ব ২)........জান্নাতুল ফেরদৌসী

নীলাম্বরীদের বাসাটা খুবই সাদামাটা। একতলা বাসার দেয়ালগুলো বেশ পুরোনো আর রঙ উঠে গেছে বেশ খানিকটা। স্যাঁতসেঁতে একটা ভাব পুরো বাসার মেঝেতে। জরাজীর্ণ আঙিনায় একটা বিশাল বড় আমগাছ। সেই গাছে গ্রীষ্মের সময় বেশ আম ধরে আর কাল বৈশাখী ঝড় হলে তো কথাই নেই। নীলাম্বরী, তার ছোটভাই শ্যামল আর ওদের মা বাবা একসাথে সবাই আম কুঁড়োতে ছুটে যেত। সে যে কি আনন্দের সময় ছিলো ভাবতেই নীলাম্বরীর খুব আফসোস হয়, কেনো যে সেই দিনগুলো আবার ফিরে আসেনা! এখন আর সেই স্বর্ণযুগ নেই ওদের। নীলাম্বরীর বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী, বেশ কয়েকবছর আগেই রিটায়ার করেছেন। মা দু'বছর ধরে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। বাকি রইল এক ভাই, সে পড়ছে ক্লাস নাইনে। পেনশনের স্বল্প টাকা দিয়ে ওদের সংসার চলে গেলেও, নীলুর মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে বেশ বেগ পেতে হয় ওদের।
তাই নীলাম্বরী নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু ছাত্রছাত্রী পড়ায়। কিন্তু মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে যেন তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে। সংসারের একটা অদৃশ্য কঠিন বোঝা যেন ওকে দিন দিন কোনঠাসা করে দিচ্ছে। তার এমন ছকে বাঁধা জীবন ভালো লাগেনা। তার ইচ্ছে করে একটা দুরন্ত,মুক্ত,উচ্ছ্বাসের জীবন পেতে। মন চায় নীল আকাশের নীচে খোলা প্রান্তরে প্রানভরে গান গাইতে। মাঝে মাঝে কেন যেন তাই নীলাম্বরী কণিকার জীবনটা পেতে চায় কারন কণিকা তো একাই, ওর নেই কোন বাঁধা, নেই কোন পিছুটান! রয়েছে কেবল বিশাল বড় প্রাসাদ আর প্রাচুর্য। কাঁধের ব্যাগ টা নামিয়ে নীলাম্বরী হাতমুখ ধুয়ে এলো। তার মনে পড়লো মায়ের ওষুধটা দেবার কথা। সে ব্যাগ খুলে মায়ের ওষুধটা বের করতে গিয়ে খেয়াল করলো তার ব্যাগে পাঁচশো টাকার বেশক'টি নোট। এতো টাকা কোথা থেকে এলো?! পরক্ষনেই তার মনে হলো এটা কণিকার কাজ। সে এমন এর আগেও করেছে। কিভাবে যেন কণিকা বুঝে যায় যে নীলুর মন কখন কেনো খারাপ থাকে বা তার আসলে কি সমস্যা। এই যেমন আজ! নীলু এই টাকার অভাবেই মায়ের কিছু টেস্ট করাতে পারছিলোনা বলেই মন খারাপ করে পুকুরপাড়ে বসে ছিলো, সেটা কণিকা বুঝে গেছিলো আর তাই সে এতোকিছু করে নীলুকে তার বাড়িতে নিয়ে গেছিলো। নীলাম্বরীর খুব লজ্জা হয়। সে এর আগেও এভাবে কণিকার দেয়া টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলো এমনকি ওকে বলেছিলো এভাবে না চাইতে টাকা না দিতে। কিন্তু কণিকা কখনোই একবার দেয়া টাকা ফেরত নেয়নি। বারবার বলেছে "আজ আমার মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এটাই করতেন আর আমি চাইনা আমার মত তুইও মা হারা হয়ে পড়!" নীলু ভাবে সত্যিই তো! তার তো এখন মাকে বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, কি দরকার এতোসব ভেবে! নীলুদের ক্যাম্পাসটা অনেক বড়। অনেকবছরের পুরোনো গাছ আর বিল্ডিং এর জন্য ক্যাম্পাসের চেহারাটাই কেমন যেন একটু গম্ভীর গম্ভীর লাগে দেখতে। কিন্তু আসলে দেখতে গুরুগম্ভীর হলেও ওদের ক্যাম্পাসটা ভীষণ প্রানবন্ত আর উদ্দীপনায় ভরপুর। তারুণ্যের যেই উচ্ছ্বাস এখানে আসলে দেখা যায় তা হয়তো অনেক ক্যাম্পাসেই নেই বলে ধারণা নীলুর। যদিও তার অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখার সুযোগ হয়নি। তবুও ক্যাম্পাসে আসলেই নীলুর মন যেন প্রান খুঁজে পায়। 
-কিরে রিচি কেমন আছিস? গতকালের লেকচারটা আমাকে দিস তো! বললো নীলু। 
-হুম আছি বেশ ভালোই। এই শোন, গতকাল যা দারুণ একটা নিউজ দিয়েছে না স্যার আমাদের! রিচির চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো। 
-কি নিউজ? 
-আমাদের ক্যাম্পাস থেকে ৭ দিনের শিক্ষা সফরে যাওয়া হবে! জানিস কোথায়? বান্দরবানে! ওখানের সবগুলো ঝর্ণা আর পর্যটনকেন্দ্র গুলো ঘুরানো হবে! শুনেই আমার কি যে আনন্দ লেগেছে জানিস না! আমিতো এখনই সব গুছানো শুরু করে দিয়েছি, তুইও শুরু করে দে নীলু! 
রিচি, নীলুদের বন্ধুমহলের একজন। হাসিখুশি মেয়েটা খুব অল্পতেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে শিশুদের মত বেশ শোরগোল তৈরি করে ফেলে। যদিও ব্যাপারটা নীলু খুব পছন্দই করে। জীবনে অল্পতেই খুশি থাকতে পারাটাও যে অনেক বড় গুণ! আর এই শিক্ষাসফরের বিষয়টা তো রীতিমতো খুশিরই খবর! নীলু কখনোই তার জেলার বাইরে দূরে কোথাও ঘুরতে যায়নি। ঝর্ণা দেখার তার খুব ইচ্ছে ছিলো, এবার মনে হয় সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। ভাবতেই নীলুর খুশিতে মনটা ভরে গেলো। 
এরইমধ্যে কণিকাও চলে এলো। তাকেও শিক্ষাসফরের খরবটা দিতেই সেও বেশ উল্লাসে মেতে উঠলো। তারা সবাই ঠিক করলো যে ক্লাস শেষে তারা একটা লিস্ট করবে যে তাদের এই ট্যুরে কি কি নিতে হবে আর তারা কি কি আনন্দ করবে! ক্লাস শেষে তারা সেই লিস্ট করতে তাই সোজা বড় মাঠে গিয়ে বসলো। ওদের ক্যাম্পাসে দুইটা মাঠ, একটা ছোট আর আরেকটা বেশ বড়। ওরা সাধারণত বড় মাঠটাতেই আড্ডা দেয়। বড় মাঠে বিভিন্ন সংগঠন, পলিটিকাল পার্টি ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বৈঠক বসে। ছোট মাঠটা অঘোষিতভাবে ক্যাম্পাসের কপোত-কপোতীদের দখলে চলে গেছে। 
সেখানে গেলে নাকি সবচেয়ে নীরস কর্কশ মানুষেরও মনে প্রেম ভুত ভর করে, এমনই কথার প্রচলন রয়েছে। তাই সবাই অলিখিতভাবেই ছোট মাঠের নাম দিয়েছে "প্রেমনগর"। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হলো নীলুদের আরেক বন্ধু সুব্রত প্রায়ই সেই প্রেমনগরে গিয়ে শুয়ে বসে থাকে, এই আশায় যে তার কাছেও একদিন সেই স্বপ্নের রমনী আসবে, প্রেমময় হবে তার জীবন আর সেই প্রেমবোধ থেকে সে লিখে ফেলবে গদ্য, পদ্য, কাব্য, মহাকাব্য! কিন্তু হায়! এতোদিনেও তার কোন গতিই হলোনা, তবুও সে হাল ছাড়েনা। রোজ ক্লাসের পরে সে ওখানে যায় আর কোন একা মেয়ে দেখলেই কথা বলার চেষ্টা করে। এভাবে দুই একবার সে মারও খেয়েছে বটে! তবুও সে "একবার না পারিলে দেখো শতবার" মন্ত্রে দীক্ষিত যোদ্ধা!

নীলুরা বসে গল্প করছিলো এমন সময় শুভ্র এসে বসলো ওদের পাশে। ওদের আলোচনা শুনে সে হুট করে বলে ফেললো, -হুম আমিও যাবো তোমাদের ট্যুরে। 
সাথে সাথেই কণিকা চটাং করে বললো, -আপনি? আপনি কেনো যাবেন আমাদের সাথে? আপনার কি নিজের কোন বন্ধু নেই? তাদের সাথে বেড়াতে যান! 
-হুম আমার বন্ধু আছে আর ওরাও যাবে তোমাদের সাথে। আমি যতদূর জানি এই ট্যুরটা ওপেন ফর অল মানে ভার্সিটির যেকোন ব্যাচের যে কেউ যেতে পারবে। 
-আহ! বাদ দে না কণিকা! যেতেই যখন চাচ্ছে শুভ্র ভাই, তাহলে চলুক না! বরং আরো বেশি মানুষ হলে মজাও হবে বেশ! বললো নীলু। 
নীলুর উচ্ছ্বাস দেখে কণিকা নিশ্চুপ হয়ে গেলো।


আজ সকাল থেকেই নীলুর মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। নীলু মায়ের ঔষুধ খাইয়ে ক্লাসের জন্য বের হবে, রাতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ভেবেছে। বাসার সামনে নীলু রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ শুনতে পেলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। 
- নীলু, এই নীলু! এই যে এইদিকে! 
- আরে শুভ্র ভাই আপনি! এখানে কি কাজে? 
- এই একটু কাজ ছিলো এদিকটায়, তুমি কি ক্যাম্পাসে যাচ্ছো? 
- জি। 
- ও তাহলে চলো একসাথে যাই আমিও ক্যাম্পাসেই যাচ্ছিলাম। 
নীলু শুভ্রর কথা ফেলতে পারলোনা। শুভ্রর সাথে নীলুর যেদিন প্রথম দেখা হয়, সেইদিনের কথা নীলুর এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ভার্সিটিতে ভর্তির পর সেইদিনই প্রথম ক্লাস ছিলো। আনন্দ, উত্তেজনার একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে নীলু প্রথম ক্লাস শেষ করে বের হয়েছিলো, ঠিক তখনই প্রায় ৭-৮ জন ছেলে নীলুকে ডাক দিয়েছিলো। - এই মেয়ে, হ্যা তুমিই, এদিকে এসো! 
নীলু একটু অবাক হলো অপরিচিত এতোগুলো ছেলে কেনো ওকে ডাকছে ভেবে। 
- হুম কি নাম তোমার? একজন দুষ্টু হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো। 
- নীলাম্বরী 
- ওরে বাবা! নীলাম্বরী! এতো দেখছি কবিতার বা গল্পের নায়িকাদের নাম! তুমি জানো এই নামের অর্থ? 
- হুম জানি। নীল রঙের শাড়ি। একটু অস্বস্তিভরে নীলু বললো। 
- কিন্তু আমরা তো দেখছি তুমি একটা শ্যামলা রঙের মেয়ে। নীল রঙের শাড়ি না! তাহলে এই নাম কেনো? 
বাকি সব ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠলো। 
নিলু খুব অপমানবোধ করেছিলো কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছিলোনা কারন সে একা ও নতুন এখানে। অন্যদিকে ওরা ছিলো নীলুর সিনিয়র ও সংখ্যাগরিষ্ঠ। নীলু এটাও বুঝেছিলো যে ওরা তাকে অপমান করতে বা র‍্যাগিং দিতেই ডেকেছে। হঠাৎ করে বিকটশব্দে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলো! সবাই দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড়াতে লাগলো। যে যেদিকে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। নীলু দেখলো ওর সামনের একটা ছেলেও নেই সবাই নিমিষেই পালিয়েছে। কিন্তু নীলু আতংকে আর ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলু খেয়াল করলো হুট করে কে যেন ওর হাতটা ধরে একটা হেঁচকা টান দিলো তারপর দৌড়াতে লাগলো। নীলুও কিছু না বুঝে পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। কিছুদূর দৌড়িয়ে যাওয়ার পর ওরা একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়ালো। 
দুইজনই বেশ হাঁপাচ্ছে। নীলু দেখলো একটা লম্বা, সুঠামদেহী, শ্যামবর্ণের সুদর্শন ছেলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 
- তুমি কি পাগল নাকি? এমন পরিস্থিতিতে কেউ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকে নাকি বোকার মত? আরেকটু হলে তো মরতে বসেছিলে! ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো। 
- না মানে ইয়ে... নীলুর মুখ দিয়ে আর কথা বের হয়না। 
- শোন, ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে এমন ঘটনা ঘটে, পলিটিকাল পার্টিদের মধ্যে গোলাগুলি হয়, তখন নিজের সেফটি নিজেকেই বুঝতে হবে। যাই হোক, আমি শুভ্র আর তুমি? নীলু কেবল তাকিয়েই থাকে আর ভাবে সে এখন নিরাপদে আছে। এমন নিরাপদ বোধ তার আগে কখনো হয়নি। এটা আসলে নিরাপত্তা নাকি অন্যকিছু? নীলু ভেবে পায়না। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই ক্যাম্পাসে তাদের দেখা, কথা হতে থাকে। নীলুর ভালো লাগে শুভ্রর সঙ্গ। তার জানতে ইচ্ছে করে শুভ্ররও কি একই অনুভূতি হয়?

(চলবে....)

মন অরণ্যের শূণ্যতা........জান্নাতুল ফেরদৌসী

 মন অরণ্যের শূণ্যতা........জান্নাতুল ফেরদৌসী
পর্ব এক
পুকুরের স্বচ্ছ জলে আকাশচুম্বী নারিকেল গাছগুলোর ছাঁয়া ভাসছে। নীল আকাশে তুলতুলে সাদা মেঘগুলো দলবেঁধে ছুঁটছে অজানায়। হালকা মিষ্টি বাতাসে জলে একটা অদ্ভুতরকম কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে আর সেই টলটলে জলে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে নীলাম্বরী। আজ তার মন ভালো নেই। মন খারাপের সময়টা সে এই পুকুরপাড়েই একা বসে থাকে। বসে বসে সে এটা ওটা আরো কত কি যে ভাবে! এই যেমন আজ তার মনে হলো সে পুকুরে ঝুপ করে একটা লাফ দিবে তারপর সেই শীতল শ্যামল বারিতে সে মৎস্যকন্যার মত উথাল-পাথাল সাঁতার কাটবে এপাশ থেকে ওপাশ। গল্প করবে মাছেদের সাথে, জানবে তাদের জীবন কেমন। তাদেরও কি এই উষ্ণতাহীন পাতালপুরী থেকে ক্ষনিকের জন্য হলেও সূর্যালোকের তপ্ত জগতে আসতে ইচ্ছে করে? কিন্তু নীলাম্বরীর আর তা জানা হয়না কারন সে যে সাঁতার জানেনা। তাই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাঁকালো আর ওমনি তার মনে হলো সে ওই পাখিগুলোর মত উড়তে চায়। যখন যেখানে খুশি উড়ে বেড়াবে, মন্দ কি! এলোমেলো এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ নীলাম্বরী খেয়াল করলো জলে কার যেন একটা ছায়া পড়েছে। -কিরে নীলু এখনো এখানে বসে আছিস? বললো কণিকা।
কণিকা, ভীষণ মেধাবী আর বুদ্ধিমতি মেয়ে। ধনাঢ্য পরিবারের একমাত্র মেয়ে, যেমন সুন্দরী তেমন চটপটে। ওরা স্কুলজীবন থেকে একসাথেই বড় হয়েছে, বলতে গেলে বেস্ট ফ্রেন্ড। অথচ দুইজনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য একদমই যেন দুই মেরুর! তাই বন্ধুমহলে প্রায়ই সবাই ওদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে কিন্তু ওরা যেন সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকেই দলিলে সই করে ওদের বন্ধুত্বের একশো ভাগ সত্তাধারী হয়ে এসেছে। পরিস্থিতি যেমনি হোক না কেনো ওরা সবসময় একে অপরের পাশে থাকবেই! 
নীলাম্বরী চুপ করে রইল। কণিকা তার পাশে এসে বসলো। 
-নীলু মন খারাপ করিসনা। 
-আমার যে মন খারাপ তোকে কে বললো? নীলাম্বরীর শীতল কন্ঠ। 
-এতো বছর পরও এই একই প্রশ্ন তুই প্রতিবারই করিস। তোর মন খারাপ আর আমি জানবোনা! কণিকার উত্তর। নীলাম্বরী এবার একটু হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো, -ইশ এতো বছর পরও যদি সবকিছু একটু বদলাতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ এই প্রশ্নই করতে হতোনা। 
-কি দরকার এসব ভেবে? মানুষের হাতে কি আর সব থাকে? তাছাড়া তুই তো তোর জায়গা থেকে অনেক চেষ্টা করছিস, আর কত? বললো কণিকা। 
-থাক এসব কথা। চল ক্লাসে যাই। নীলাম্বরী উঠে দাঁড়ালো। 
-না আজ ক্লাসে যাবোনা, আজ আমরা দুইজন সারাদিন রিকশায় ঘুরবো, ফুচকা খাবো, আর রাতে তুই আমার বাসায় থাকবি। কণিকার আবদার নীলাম্বরী ফেলতে পারেনা কারন সে জানে কণিকা কেন এসব করে। সে জানে পৃথিবীতে তার সবচেয়ে কাছের মানুষদের মধ্যে কণিকা অন্যতম।


রিকশায় এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে ক্যাম্পাসে এলো নীলাম্বরী আর কণিকা। ক্যাম্পাসের করিম মামার দোকানের ফুচকা চটপটি তাদের খুব পছন্দ। শুধু তাদেরই না বরং সবার কাছেই বেশ নামডাক আছে মামার দোকানের। নরম আলু আর গোল গোল গরম ডাবরির উপর মামা কি যেন একটা চটপটে মসলা ছিটিয়ে দেয় যা তাদের কাছে অমৃতের মত লাগে! তেতুলের টক মিষ্টি স্বাদ যেন তাদের মনের ক্ষুধা আরো বাড়িয়ে দেয়, তাই তারা প্রায়ই এখানে আসে সেই অমৃতের স্বাদ নিতে। 
-আরে কণিকা দেখি! কেমন আছো? আজ তোমরা ক্লাসে আসোনি কেনো? বললো শুভ্র। 
শুভ্র ওদের দুই বছর আগের ব্যাচের ছাত্র কিন্তু ওদের সাথে বেশ খাতির। মাঝে মাঝেই শুভ্র ওদের বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে ওঠে। তবে কেন জানি শুভ্রর এই অযাচিত অনুপ্রবেশ কণিকার ভালো লাগেনা। 
-আজ আমাদের ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করেনি তাই আর যাওয়াও হয়নি! বললো নীলাম্বরী। 
-আমরা ক্লাসে গিয়েছি কিনা সেটা আপনার জেনে কি হবে? আর তাছাড়া আপনি জানলেনই বা কিভাবে? আপনি কি তাহলে ২ বছর লস দিয়ে আমাদের ব্যাচের সাথে ক্লাস শুরু করলেন নাকি? বলেই একটা দুষ্টু হাসি হাসলো কণিকা। 
একটু বিব্রতবোধ করলো শুভ্র, সে বোঝে না কণিকা কেন তার সাথে এমন টিপ্পনী কেটে কথা বলে। তাকে অপদস্ত করে কণিকা কি মজা পায়? -না মানে রিচির সাথে দেখা হয়েছিলো, সে বললো তোমরা নাকি আজ ক্লাসে আসোনি। তাই ভাবলাম তোমরা ঠিক আছো কিনা! ইনিয়েবিনিয়ে শুভ্র বললো। 
-আচ্ছা শুভ্র ভাই, আমরা আজ আসি। আরেকদিন কথা হবে কেমন? ভালো থাকবেন। বলেই কণিকা নীলাম্বরীর হাতটা ধরে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো। 
কিছুদূর যেতেই নীলাম্বরী কণিকাকে বললো, -কণি তুই সবসময় শুভ্র ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলিস কেন? সে তো আমাদের খারাপ কিছু বলেনি কখনো! 
কথাটা শুনে কণিকার মনে হলো সত্যিই তো! কেন সে এমন করে শুভ্রর সাথে আর কেনই বা তার ওকে ভালো লাগেনা? শুভ্র ওদের ২ বছর বড় তারপরও এতো বেশি সখ্যতা চায়, তাই বলে কি কণিকার সন্দেহ হয়? শুভ্র কোনদিন কোন ক্ষতি করবেনা তো ওদের বা ওদের বন্ধুত্বের? এসব ভাবতে ভাবতেই কণিকা নীলাম্বরীর প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে যায় বা দিতে চায়না।

কণিকাদের বাড়িতে আসলেই নীলাম্বরীর মনে হয় সে কোন সাধারণ ইট পাথরের বাড়িতে নয় যেন একটা সোনাখচিত বিশাল রাজপ্রাসাদে বেড়াতে এসেছে। ডুপ্লেক্স এই বাড়িতে কেবল দেশি নয় বরং বিদেশি আধুনিক সব সরঞ্জামাদি আর সুযোগ সুবিধাও রয়েছে। জীবনকে সহজ ও সুন্দর করতে কোনরকম কমতি নেই এখানে। একাধিক চাকর বাকরের টুয়েন্টি ফোর সেভেন পরিচর্যা ও সেবায় বাড়ির চারপাশটা একদম স্বর্ণের খনির মত চকচক করে। খালি একটাই সমস্যা। বাড়িতে মমতাময়ী মা নেই। কণিকার বয়স যখন ৫ বছর তখন তার মা মারা যায়। মা ছাড়া বাড়িতে যে শুন্যতা বিরাজ করে তা নীলাম্বরীর ভালো লাগেনা। হয়তো কণিকাও তাই বাড়িতে থাকার চেয়ে বাইরে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কণিকার বাবা অনেক বড় ব্যবসায়ী। নাহ ব্যবসায়ী বললে ভুল হবে, ব্যবসায়ী তো আলু, পেঁয়াজ বিক্রেতাকেও বলা হয় অথবা মোড়ের মুদি দোকানদার সেও তো ব্যবসায়ী! কণিকার বাবাকে বিজনেস ম্যাগনেট বললে হয়তো তার উপযুক্ত পরিচয় দেয়া হবে। তিনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। বাড়িতে তাকে দেখাই যায়না। আজ দেশে তো কাল বিদেশে।বাড়িতে ফেরেনো বেশ রাত করে তাই কণিকার সাথে তার দেখাও হয় কয়েকদিনে একবার। কণিকা পরিবারের ভালোবাসা, বন্ধন থেকে অনেক বেশি বঞ্চিত বলে নীলাম্বরীর খুব মায়া হয়। যদিও কণিকা কখনোই তার একাকিত্বের অনুভূতি প্রকাশ করেনা। সে খুব শক্ত মানসিকতার যে! আজ কোন এক কারনে কণিকার বাবা মিস্টার রায়সুল কবির বাড়িতে একটু আগেই ফিরেছেন। দরজা দিয়ে ঢুকতেই নীলাম্বরীর সাথে তার দেখা হয়ে গেল। 
-আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন আপনি? 
নীলাম্বরীকে দেখেও না দেখার ভান করে মোবাইল টিপতে টিপতেই রায়সুল সাহেব ভেতরে চলে যান। ব্যাপারটা নীলাম্বরী খেয়াল করে তবে অবাক হয়না কারন এমন এর আগেও হয়েছে তার সাথে। সে বোঝে যে তার এ বাড়িতে আসা কণিকার বাবা পছন্দ করেন না। এদিকে টেবিলে রাতের খাবার তৈরি বলে কণিকা নীলাম্বরীকে ডাক দেয়। দু'জনে টেবিলে বসতেই রামু কাকা কণিকাকে বলেন, -কণি মনি স্যার আপনারে ডেকে পাঠাইসেন। 
রামু কাকা হলেন এ বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো সেবক। কণিকার পুরো শৈশব যেন তার হাতেই বোনা। ভীষণ স্নেহ করেন কণিকাকে। 
-এখন যেতে পারবোনা বলে দাও। খেতে বসেছি দেখছোই তো! গম্ভীর গলায় বলে কণিকা। 
-কিন্তু স্যার যে এখনই ডেকে পাঠাইসেন! একটুখানি শুইনা আসো লক্ষী মামনি আমার! 
বেশ বিরক্তি নিয়েই কণিকা উঠে তার বাবার রুমে যায়। 
-আমাকে ডেকেছো বাপি? 
-হুম কেমন আছো তুমি? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? 
-এটা জানতেই কি ডেকেছো! যাই হোক, আসল কথাটা বলে ফেলো বাপি আমি শুনছি। খুব দৃঢ়ভাবে বললো কণিকা। -আসল কথাতো তুমি জানোই কণিকা! তোমাকে না কতবার বলেছি তুমি ওই মেয়েটার সাথে মিশবেনা। তোমাকে আর কতবার বুঝাবো যে তুমি আমার মেয়ে, মিস্টার রায়সুল কবিরের মেয়ে! তুমি যার তার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারোনা। তোমাকে স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে চলতে হবে। তোমার বন্ধু হবে আমাদের মতই বড়লোক ঘরের ছেলেমেয়েরা আর তুমি কিনা ওই রিটায়ার্ড সরকারি চাকুরীজীবি একটা হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ের সাথে টইটই করে ঘুরে বেড়াও! একবারও কি তোমার আমার মান সম্মানের কথা মনে হয়না? 
প্রতিবারের মতই এবারো কথাগুলো শুনে কণিকার রাগে শরীরে জ্বালা দিয়ে ওঠে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে সে আবারও বলে ওঠে, -বাপি তোমাকে আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, নীলু আমার খুব কাছের বন্ধু তার ব্যাপারে আমি এসব অবান্তর কথা আর শুনতে চাইনা। তাছাড়া বন্ধুত্বে আবার স্ট্যাটাস কিসের? স্ট্যাটাস দিয়ে আর যাই হোক বন্ধুত্ব হয়না বাপি আর যদি হয়েও থাকে তাহলে সেটা বন্ধুত্ব নয়, সেটা কেবল স্বার্থের আদান-প্রদান। স্বার্থ ফুরোলে সেই বন্ধুত্বও ফুরিয়ে যায়। যাই হোক, তুমি এসব বুঝবেনা, তার চেয়ে বরং তুমি তোমার বিজনেসের হিসাবের বইটা দেখো! 
বলেই কণিকা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আর রায়সুল সাহেব বিরক্তিভরে তাকিয়ে রইলো। ফিরে এসে কণিকা দেখলো নীলাম্বরী দাঁড়িয়ে আছে মেইন গেটের সামনে। -কিরে কই যাচ্ছিস নীলু? 
-বাসা থেকে ফোন এসেছিলো মায়ের শরীরটা আবার খারাপ করেছে। আমাকে যেতে হবে রে! 
-কিন্তু রাতের খাবারটা খেয়ে যা! 
-না রে আজ থাক, অন্য কোনদিন। বলেই নীলাম্বরী বেরিয়ে যায়। 
কণিকা জানে যে নীলু সবই বোঝে। তার খুব কষ্ট হয় নীলুর জন্য। একইসাথে ভীষণ রাগ হয় এই ভেবে যে একটা ছোট্ট জীবনে "স্ট্যাটাস মেইনটেইন" এর নামে মানুষের এই রঙ তামাশা কবে বন্ধ হবে? আসলেই কি বেঁচে থাকতে এতোকিছুর প্রয়োজন, নাকি সবই মানুষের বানানো নাটক? জীবনে যদি সুখই না থাকে তবে কি হবে এই "স্ট্যাটাস" দিয়ে!

(চলবে........)

চাঁদ যেটুকু আমরা ভাগে পেয়েছি........ গোলাম রসুল

চাঁদ যেটুকু আমরা ভাগে পেয়েছি........ গোলাম রসুল


আকাশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঈগল উড়ছে
আর ওই ঈগল গুলোর ওপর বায়ুমণ্ডলের
সাক্ষী স্বরূপ চড়ে বসে আছে হাওয়া
কি মারাত্মক আমাদের জীবন
আর মানবতার দুটো কোণ
আমি জনতার সামনে আয়না ধরলাম
তারা যদি তাদের প্রভুকে দেখতে পায়
আমাদের জীবন নাকি প্রজাতান্ত্রিক দাসত্ব

নিরব রাত্রি আরো নিরব
চাঁদ যেটুকু আমরা ভাগে পেয়েছি 
সমুদ্র থেকে পাহাড় পাহাড় থেকে সমুদ্র 
মেঘ পাথরনামা একটি বই 
যার প্রস্তাবনায় রয়েছে সূর্যের মূর্তি 
আমি আলোর ব্যবসায়ী সূর্যের কাছে থেকে 
এক পেয়ালা আলো চাই 
বিনিময় মূল্য আমার হৃদয় 
মৃত্যুকে রাখবো বলে 
সর্বশেষ শূন্যতাও আমার জানা নেই 
মহাজগতের কেন্দ্রে থাকা জনতা 
তোমাদের চোখের দলিল কুচিকুচি করে ভাসিয়ে দাও 
ওই জলের ওপর কেঁদো না মানুষ
আমাদের রক্ষী আমাদের হাত

নীল যেখানে........শাহরিয়ার জাওয়াদ

নীল যেখানে........শাহরিয়ার জাওয়াদ
ধূসর বালুকাবেলা পেরিয়ে অনেকটা নীল
যে নীল মিশে গিয়েছে দিগন্তে;
যতদূর চোখ যায়- সে কী ভীষণ নীল!
হঠাৎ সমুদ্র!
তীরের ধূসর বালিতে আছড়ে পড়ে ঢেউ
সে কী দারুণ উল্লাস নীলের,
খোলা আকাশের নিচে তখন মনে হয়...
তুচ্ছ আমি, অতি ক্ষুদ্র!

মাঝে মাঝে মনে হয়-
আমি নাবিক হবো;
জাহাজের ডেকে আছড়ে পড়বে
উন্মত্ত ঢেউ।
কিংবা বেহালা কাঁধে কোন
নিঃসঙ্গ যুবক;
উড়তে থাকা সীগালের ঝাঁক ছাড়া
বেহালার সুর শুনবার নেই কেউ!

কখনো আবার বলিষ্ঠ পেশির
এক মধ্যবয়স্ক জেলে;
ভয়ঙ্কর উন্মত্ত নীলের সাথে যুদ্ধ করে
যে বেঁচে থাকে।
কিংবা ওই অ্যালবেট্রস পাখিটা
যার কালো ডানায় ভর করে
কোন আশাহত নাবিক
                                                                                                                                       তার স্বপ্ন আগলে রাখে!

উড়ে যাব আমি এই লোকালয় ছেড়ে
উড়ে যাব আমি সেই অসীম নীলে,
হয়তো কোন নিঃসঙ্গ নাবিক-
নয়তো কোন অ্যালবেট্রসের ডানায় চড়ে;
এই নগর, এই শহর...
অন্তত আমার জন্য নয়।
চলে যাব দূরে- অসীম নীল যেখানে
ফিরবো না আর এই লোকালয়ে, মানুষের ভীড়ে!

চিরবসন্ত........মুশফিকুর রহমান আবীর

চিরবসন্ত........মুশফিকুর রহমান আবীর

মানুষের সম্পর্কগুলো অনেকটা ফুটন্ত গোলাপের মতো। গোলাপ দূর থেকে তার স্বজীবতার চিরন্তন নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু মানুষ সেই সৌন্দর্যের আলিঙ্গন লাভ করার জন্যে গাছ থেকে সংগ্রহ করে প্রসাদময়  অট্টালিকার সবচেয়ে সুন্দর ফুলদানিতে গোলাপটিকে স্থান দেয়। তাতে গোলাপটির সৌন্দর্য যেন আরো বৃদ্ধি পায়। গোলাপটির সৌন্দর্য দেখে তার উপর ভ্রমর এসে বিচরণ করে।

এতো কিছু দেখে মানুষ তখন ভাবতে শুরু করে গোলাপটিকে গাছ থেকে তার আরো আগে এই ফুলদানিতে রাখা উচিত ছিলো।  আহ!  কি না ভুল করে ফেলেছে সে!

পর দিন তারা দেখতে পায় ফুলটি একটু মলিন হয়ে পড়েছে হঠাৎ করে। কালকের মতো আজ আর ভ্রমররা গোলাপটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেনি। পরের দিন দেখলো ফুলদানির সব সুন্দর জিনিস গুলোকে গোলাপটি কেমন যেনো বিবর্ণ করে রেখেছে। পরের দিন গোলাপটির পাতা গুলো শুকিয়ে মাটিতে পরে গিয়ে ফুলদানিটা সহো আসে পাশের জায়গাটা ময়লা করে দিতেছে। তখন মানুষ ভাবে এই সুন্দর ফুলদানিটার ভিতোর এই গোলাপটা রাখলে ফুলদানিটা অসুন্দর হয়ে যাচ্ছে। তাই তাকে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। গোলাপটা যেনো সময় যাওয়ার সাথে সাথে তার সব সৌন্দর্য হারিয়ে আজ তার আশেপাশের সব সৌন্দর্যের জন্যে বিশাদময় হয়ে উঠেছে।


মানুষে মানুষে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার সম্পর্ক গুলোও যেনো একই সূত্রে গাঁথা।  সম্পর্ক গুলোতে আপনজনদের সন্নিকটে পাওয়াটা অনেক বেশি মধুর মনে হয়।একটা সময় যখন সে তাদের সান্নিধ্য লাভ করে এবং ভাবতে থাকে, কতো না ভালো হতো, যদি এই কাছের মানুষগুলোকে আগে কাছে পাওয়া যেতো। তখন নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে খুশি মানুষ মনে হয় আপন ভালোবাসার মানুষগুলোকে কাছে পাওয়ার জন্যে। মনে হয় এই সুখ যেনো চিরস্থায়ী, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও এ ভ্রাতৃত্ব ভালোবাসার বন্ধন যেনো শেষ হওয়ার নয়।


কিন্তু মানুষের স্বভাব এমনই যে, তুমি যদি তোমার ভালোবাসা, ভাতৃত্বের বন্ধনের  দুয়ার ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্যে যতটুকু উন্মোচিত করবে, তারা তোমাকে দিন যাওয়ার সাথে সাথে ঠিক ততোটুকুই বা হয়তো তার চেয়ে বেশি তোমাকে হেয়ো করবে। ভালোবাসার প্রতিদানে তারা কষ্ট, হিংসা,গৃণা, অবহেলা, তাচ্ছিল্যতা ছাড়া আর কিছুই দিবে না। 


সময় যাওয়ার সাথে সাথে এই পরিচিত মানুষগুলোই যেনো খুব অপরিচিত হয়ে পড়ে। কাছের সবাইকে পেয়েও যেন নিঃসঙ্গ দ্বীপের কোনো এক বাসিন্দা হয়ে পড়তে হয়।  আজ তারাই যেন তোমাকে সব থেকে একা করে দিয়েছে। কাছে আসার জন্যে আজ তারা সবচেয়ে দুরে চলে গিয়েছে। শেষ পান্তে এসে মানুষ গুলোর সাথে  সম্পর্কটায় তিক্ততা ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না। মনে হয় তখন,

সম্পর্কটা তো দুর থেকে চিরস্থায়ী মধুর ছিলো। তখন তো সম্পর্কের ভিতর কোনো তিক্ততা ছিলো না। সবাই থেকেও আজ যেনো তুমি একা কোনো এক জনসমুদ্রের মাঝখানে। 


মানুষকে বিশ্বাস আর ভালোবাসলেই মানুষ সে বিশ্বাস আর ভালোবাসার অমর্যাদা, অবহেলা করবেই। এটাই মানুষের আসল পরিচয়।

অনেক মায়ের এক সন্তান........রাকিব শামছ শুভ্র

অনেক মায়ের এক সন্তান........রাকিব শামছ শুভ্র

মি কার ঔরসজাত সন্তান, সেটা মা কখনোই বলতে পারেনি। পারার কথাও না। আমার জন্মটাই যে এক আশ্চর্য! আমি একটা সময় পর্যন্ত মাকে প্রচন্ড ঘৃণা করতাম। নিজেকে অস্পৃশ্য মনে হতো। সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। মায়ের পরিচয় দিতেও লজ্জা পেতাম। কেন আমার সাথেই এমন হলো?

স্বাধীনতার পরপরই মা আমাদের গ্রাম থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে শ্রীমঙ্গল চলে যায়। আমি তখন মাত্র কয়েক মাসের বাচ্চা। মা ওখানে চা বাগানে কাজ নেয়। আমার মায়ের গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু চোখা নাক খুব সুন্দর। খুব মায়াময় চেহারা। সহজেই সবার চোখে পরতেন। আর আমার চেহারা? একেবারে ফর্সা, লম্বা ছয় ফুট। দেখলে যে কেউ ভাবে পাঠান!!

আমার বাবা করিম উদ্দিন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই এপ্রিলের শুরুতে পালিয়ে ভারত চলে যান ট্রেনিং নিতে। রমিজ চাচা বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। এক সময় মাকে খুব পছন্দ করতেন। মায়ের বিয়ে হয় বাবার সাথে, তখন থেকেই তার হিংসা ছিলোই। বাবা যুদ্ধে যাবার পর থেকেই তার আমাদের বাড়িতে আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিলো। মায়ের কাছ থেকে বাবার খোঁজ জানতে চাইতেন। মা কখনোই বলেনি বাবা কোথায় গিয়েছে। রমিজ চাচা ধারণা করতে পেরেছিলেন বাবা যুদ্ধে গেছেন। একদিন রাতে দরজা ঠকঠকালো। মা ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কে? বাহির থেকে উত্তর এলো, ভাবি আমি রমিজ দরজা খুলেন। আমার মা সরল বিশ্বাসে দরজাটা খুলে দিয়েছে। দরজা খুলতেই তিন চারজন পাকিস্তানি আর্মি ঘরে ঢুকলো। এরপর টানা সাত মাস আমার মায়ের উপর দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চলেছে। আর এরই ফসল হচ্ছি আমি। নিজেকে ভালোবাসার কোন কারণ আছে কি?

আমি এসব কিছুই জানতাম না। মা নিজের পরিচয় লুকিয়ে চা বাগানে কাজ নিয়েছে। সেখানেও মা খুব শান্তিতে ছিল তা না! বড় বাবু ছোট বাবু সহ আরো অনেকেই মায়ের একা থাকার সুযোগটা নিয়েছে। মা সব সহ্য করেছে শুধু আমার জন্য। মায়ের একটাই ব্রত ছিল, আমাকে মানুষ করতে হবে। আমি মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই মা এড়িয়ে যেতো। যখন আমার ১১ বছর বয়স! একদিন মা আমাকে ডেকে অনেক কথা বলল। তখন সব কথার মানে বুঝিনি। বরং মায়ের উপর আমার ঘৃণা জন্মেছে রাগ, অভিমান। মনে আছে অনেকদিন মার সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছিলাম।

আমার বাবার পরিচয় না কি মায়েরও জানা নেই। মা মাঝে মাঝে বলতো, মায়ের উপর কতজন যে অত্যাচার করেছে কোন হিসেব নেই। শুধু একজনের কথা আলাদা করে বলতে পারে মা। ইয়াসির খান। সবার মতো সেও মাকে ভোগ করেছে কিন্তু কোথায় যেন তার একটা টান ছিল মায়ের প্রতি। মাঝে মাঝে নিজের খাওয়া থেকে কিছু খাওয়া উঠিয়ে রাখতো মায়ের জন্য। সবাই যখন অত্যাচার করতো, একমাত্র ইয়াসির খানে সে মাঝে মাঝেই ওষুধ খাইয়ে যেত। মায়ের কেন যেন মনে হয়, আমার মধ্যে মা ইয়াসির খানের ছায়া দেখতে পায়। আমার শারীরিক গড়ন রং চেহারার আদল নাকি ইয়াসির খানের সাথে মিলে যায়। আমি বুঝতে পারিনা লোকটাকে কি আমি মায়ের অত্যাচারী হিসেবে ঘৃণা করবো নাকি নিজের বাবা হিসেবে মেনে নিবো? নিজেকে জারজ সন্তান ভাবতে খুব কষ্ট হয়। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে।

মা আমাকে কতোটা ভালোবেসেছে তা এখন উপলব্ধি করি। আমি যখন হতবিহ্বল হয়ে যেতাম কিংবা হতাশায় ভুগতাম! মা বলতো, তোর বাবা কে আমি জানি না কিন্তু তুই আমারই ছেলে এটা জানি। তোর কি আমার পরিচয়ে বড় হতে সমস্যা আছে? আমি মেনে নিতাম আবার নিতাম না।

মায়ের আগ্রহে আর পরিশ্রমের ফল আমি আজ পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকুরে। এখন আর আমার অতীত কেউ জানতে চায় না। আমার পরিচয়েই আমি পরিচিত। একটা সময় মাকে আমি অভিমানে দূরে সরিয়েছি আর এখন? আমি সারাদিন আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে খুঁজি অন্য মায়েদের মাঝে। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এগারো বছর আগে। আমি বিয়ে থা করিনি। সারাদেশে চষে বেড়াই আর সেই মায়েদের খুঁজে বের করি, যারা ১৯৭১ এ পাকিস্তানিদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে এবং এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। আমি তাদের আমার কাছে নিয়ে আসি। আমার এক মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এখন আমার কাছে আরো চার মা আছেন। একদিন হয়তো আমার কাছে হাজারো মা থাকবেন। আমি আমার মায়েদের মাঝেই আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে পাই। নিজেকে এখন আর একা মনে হয় না। হাজারো বীরাঙ্গনা মায়েদের আদরের সন্তান হয়েই এদেশে আমার বেঁচে থাকা।


বিঃদ্রঃ এটা সত্য ঘটনা না। তবে অনেক সত্য ঘটনা আমরা হয়তো জানিও না।