নীল যেখানে........শাহরিয়ার জাওয়াদ

নীল যেখানে........শাহরিয়ার জাওয়াদ
ধূসর বালুকাবেলা পেরিয়ে অনেকটা নীল
যে নীল মিশে গিয়েছে দিগন্তে;
যতদূর চোখ যায়- সে কী ভীষণ নীল!
হঠাৎ সমুদ্র!
তীরের ধূসর বালিতে আছড়ে পড়ে ঢেউ
সে কী দারুণ উল্লাস নীলের,
খোলা আকাশের নিচে তখন মনে হয়...
তুচ্ছ আমি, অতি ক্ষুদ্র!

মাঝে মাঝে মনে হয়-
আমি নাবিক হবো;
জাহাজের ডেকে আছড়ে পড়বে
উন্মত্ত ঢেউ।
কিংবা বেহালা কাঁধে কোন
নিঃসঙ্গ যুবক;
উড়তে থাকা সীগালের ঝাঁক ছাড়া
বেহালার সুর শুনবার নেই কেউ!

কখনো আবার বলিষ্ঠ পেশির
এক মধ্যবয়স্ক জেলে;
ভয়ঙ্কর উন্মত্ত নীলের সাথে যুদ্ধ করে
যে বেঁচে থাকে।
কিংবা ওই অ্যালবেট্রস পাখিটা
যার কালো ডানায় ভর করে
কোন আশাহত নাবিক
                                                                                                                                       তার স্বপ্ন আগলে রাখে!

উড়ে যাব আমি এই লোকালয় ছেড়ে
উড়ে যাব আমি সেই অসীম নীলে,
হয়তো কোন নিঃসঙ্গ নাবিক-
নয়তো কোন অ্যালবেট্রসের ডানায় চড়ে;
এই নগর, এই শহর...
অন্তত আমার জন্য নয়।
চলে যাব দূরে- অসীম নীল যেখানে
ফিরবো না আর এই লোকালয়ে, মানুষের ভীড়ে!

চিরবসন্ত........মুশফিকুর রহমান আবীর

চিরবসন্ত........মুশফিকুর রহমান আবীর

মানুষের সম্পর্কগুলো অনেকটা ফুটন্ত গোলাপের মতো। গোলাপ দূর থেকে তার স্বজীবতার চিরন্তন নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু মানুষ সেই সৌন্দর্যের আলিঙ্গন লাভ করার জন্যে গাছ থেকে সংগ্রহ করে প্রসাদময়  অট্টালিকার সবচেয়ে সুন্দর ফুলদানিতে গোলাপটিকে স্থান দেয়। তাতে গোলাপটির সৌন্দর্য যেন আরো বৃদ্ধি পায়। গোলাপটির সৌন্দর্য দেখে তার উপর ভ্রমর এসে বিচরণ করে।

এতো কিছু দেখে মানুষ তখন ভাবতে শুরু করে গোলাপটিকে গাছ থেকে তার আরো আগে এই ফুলদানিতে রাখা উচিত ছিলো।  আহ!  কি না ভুল করে ফেলেছে সে!

পর দিন তারা দেখতে পায় ফুলটি একটু মলিন হয়ে পড়েছে হঠাৎ করে। কালকের মতো আজ আর ভ্রমররা গোলাপটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেনি। পরের দিন দেখলো ফুলদানির সব সুন্দর জিনিস গুলোকে গোলাপটি কেমন যেনো বিবর্ণ করে রেখেছে। পরের দিন গোলাপটির পাতা গুলো শুকিয়ে মাটিতে পরে গিয়ে ফুলদানিটা সহো আসে পাশের জায়গাটা ময়লা করে দিতেছে। তখন মানুষ ভাবে এই সুন্দর ফুলদানিটার ভিতোর এই গোলাপটা রাখলে ফুলদানিটা অসুন্দর হয়ে যাচ্ছে। তাই তাকে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। গোলাপটা যেনো সময় যাওয়ার সাথে সাথে তার সব সৌন্দর্য হারিয়ে আজ তার আশেপাশের সব সৌন্দর্যের জন্যে বিশাদময় হয়ে উঠেছে।


মানুষে মানুষে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার সম্পর্ক গুলোও যেনো একই সূত্রে গাঁথা।  সম্পর্ক গুলোতে আপনজনদের সন্নিকটে পাওয়াটা অনেক বেশি মধুর মনে হয়।একটা সময় যখন সে তাদের সান্নিধ্য লাভ করে এবং ভাবতে থাকে, কতো না ভালো হতো, যদি এই কাছের মানুষগুলোকে আগে কাছে পাওয়া যেতো। তখন নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে খুশি মানুষ মনে হয় আপন ভালোবাসার মানুষগুলোকে কাছে পাওয়ার জন্যে। মনে হয় এই সুখ যেনো চিরস্থায়ী, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও এ ভ্রাতৃত্ব ভালোবাসার বন্ধন যেনো শেষ হওয়ার নয়।


কিন্তু মানুষের স্বভাব এমনই যে, তুমি যদি তোমার ভালোবাসা, ভাতৃত্বের বন্ধনের  দুয়ার ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্যে যতটুকু উন্মোচিত করবে, তারা তোমাকে দিন যাওয়ার সাথে সাথে ঠিক ততোটুকুই বা হয়তো তার চেয়ে বেশি তোমাকে হেয়ো করবে। ভালোবাসার প্রতিদানে তারা কষ্ট, হিংসা,গৃণা, অবহেলা, তাচ্ছিল্যতা ছাড়া আর কিছুই দিবে না। 


সময় যাওয়ার সাথে সাথে এই পরিচিত মানুষগুলোই যেনো খুব অপরিচিত হয়ে পড়ে। কাছের সবাইকে পেয়েও যেন নিঃসঙ্গ দ্বীপের কোনো এক বাসিন্দা হয়ে পড়তে হয়।  আজ তারাই যেন তোমাকে সব থেকে একা করে দিয়েছে। কাছে আসার জন্যে আজ তারা সবচেয়ে দুরে চলে গিয়েছে। শেষ পান্তে এসে মানুষ গুলোর সাথে  সম্পর্কটায় তিক্ততা ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না। মনে হয় তখন,

সম্পর্কটা তো দুর থেকে চিরস্থায়ী মধুর ছিলো। তখন তো সম্পর্কের ভিতর কোনো তিক্ততা ছিলো না। সবাই থেকেও আজ যেনো তুমি একা কোনো এক জনসমুদ্রের মাঝখানে। 


মানুষকে বিশ্বাস আর ভালোবাসলেই মানুষ সে বিশ্বাস আর ভালোবাসার অমর্যাদা, অবহেলা করবেই। এটাই মানুষের আসল পরিচয়।

অনেক মায়ের এক সন্তান........রাকিব শামছ শুভ্র

অনেক মায়ের এক সন্তান........রাকিব শামছ শুভ্র

মি কার ঔরসজাত সন্তান, সেটা মা কখনোই বলতে পারেনি। পারার কথাও না। আমার জন্মটাই যে এক আশ্চর্য! আমি একটা সময় পর্যন্ত মাকে প্রচন্ড ঘৃণা করতাম। নিজেকে অস্পৃশ্য মনে হতো। সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। মায়ের পরিচয় দিতেও লজ্জা পেতাম। কেন আমার সাথেই এমন হলো?

স্বাধীনতার পরপরই মা আমাদের গ্রাম থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে শ্রীমঙ্গল চলে যায়। আমি তখন মাত্র কয়েক মাসের বাচ্চা। মা ওখানে চা বাগানে কাজ নেয়। আমার মায়ের গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু চোখা নাক খুব সুন্দর। খুব মায়াময় চেহারা। সহজেই সবার চোখে পরতেন। আর আমার চেহারা? একেবারে ফর্সা, লম্বা ছয় ফুট। দেখলে যে কেউ ভাবে পাঠান!!

আমার বাবা করিম উদ্দিন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই এপ্রিলের শুরুতে পালিয়ে ভারত চলে যান ট্রেনিং নিতে। রমিজ চাচা বাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। এক সময় মাকে খুব পছন্দ করতেন। মায়ের বিয়ে হয় বাবার সাথে, তখন থেকেই তার হিংসা ছিলোই। বাবা যুদ্ধে যাবার পর থেকেই তার আমাদের বাড়িতে আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিলো। মায়ের কাছ থেকে বাবার খোঁজ জানতে চাইতেন। মা কখনোই বলেনি বাবা কোথায় গিয়েছে। রমিজ চাচা ধারণা করতে পেরেছিলেন বাবা যুদ্ধে গেছেন। একদিন রাতে দরজা ঠকঠকালো। মা ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কে? বাহির থেকে উত্তর এলো, ভাবি আমি রমিজ দরজা খুলেন। আমার মা সরল বিশ্বাসে দরজাটা খুলে দিয়েছে। দরজা খুলতেই তিন চারজন পাকিস্তানি আর্মি ঘরে ঢুকলো। এরপর টানা সাত মাস আমার মায়ের উপর দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চলেছে। আর এরই ফসল হচ্ছি আমি। নিজেকে ভালোবাসার কোন কারণ আছে কি?

আমি এসব কিছুই জানতাম না। মা নিজের পরিচয় লুকিয়ে চা বাগানে কাজ নিয়েছে। সেখানেও মা খুব শান্তিতে ছিল তা না! বড় বাবু ছোট বাবু সহ আরো অনেকেই মায়ের একা থাকার সুযোগটা নিয়েছে। মা সব সহ্য করেছে শুধু আমার জন্য। মায়ের একটাই ব্রত ছিল, আমাকে মানুষ করতে হবে। আমি মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই মা এড়িয়ে যেতো। যখন আমার ১১ বছর বয়স! একদিন মা আমাকে ডেকে অনেক কথা বলল। তখন সব কথার মানে বুঝিনি। বরং মায়ের উপর আমার ঘৃণা জন্মেছে রাগ, অভিমান। মনে আছে অনেকদিন মার সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছিলাম।

আমার বাবার পরিচয় না কি মায়েরও জানা নেই। মা মাঝে মাঝে বলতো, মায়ের উপর কতজন যে অত্যাচার করেছে কোন হিসেব নেই। শুধু একজনের কথা আলাদা করে বলতে পারে মা। ইয়াসির খান। সবার মতো সেও মাকে ভোগ করেছে কিন্তু কোথায় যেন তার একটা টান ছিল মায়ের প্রতি। মাঝে মাঝে নিজের খাওয়া থেকে কিছু খাওয়া উঠিয়ে রাখতো মায়ের জন্য। সবাই যখন অত্যাচার করতো, একমাত্র ইয়াসির খানে সে মাঝে মাঝেই ওষুধ খাইয়ে যেত। মায়ের কেন যেন মনে হয়, আমার মধ্যে মা ইয়াসির খানের ছায়া দেখতে পায়। আমার শারীরিক গড়ন রং চেহারার আদল নাকি ইয়াসির খানের সাথে মিলে যায়। আমি বুঝতে পারিনা লোকটাকে কি আমি মায়ের অত্যাচারী হিসেবে ঘৃণা করবো নাকি নিজের বাবা হিসেবে মেনে নিবো? নিজেকে জারজ সন্তান ভাবতে খুব কষ্ট হয়। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে।

মা আমাকে কতোটা ভালোবেসেছে তা এখন উপলব্ধি করি। আমি যখন হতবিহ্বল হয়ে যেতাম কিংবা হতাশায় ভুগতাম! মা বলতো, তোর বাবা কে আমি জানি না কিন্তু তুই আমারই ছেলে এটা জানি। তোর কি আমার পরিচয়ে বড় হতে সমস্যা আছে? আমি মেনে নিতাম আবার নিতাম না।

মায়ের আগ্রহে আর পরিশ্রমের ফল আমি আজ পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকুরে। এখন আর আমার অতীত কেউ জানতে চায় না। আমার পরিচয়েই আমি পরিচিত। একটা সময় মাকে আমি অভিমানে দূরে সরিয়েছি আর এখন? আমি সারাদিন আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে খুঁজি অন্য মায়েদের মাঝে। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এগারো বছর আগে। আমি বিয়ে থা করিনি। সারাদেশে চষে বেড়াই আর সেই মায়েদের খুঁজে বের করি, যারা ১৯৭১ এ পাকিস্তানিদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে এবং এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। আমি তাদের আমার কাছে নিয়ে আসি। আমার এক মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এখন আমার কাছে আরো চার মা আছেন। একদিন হয়তো আমার কাছে হাজারো মা থাকবেন। আমি আমার মায়েদের মাঝেই আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে পাই। নিজেকে এখন আর একা মনে হয় না। হাজারো বীরাঙ্গনা মায়েদের আদরের সন্তান হয়েই এদেশে আমার বেঁচে থাকা।


বিঃদ্রঃ এটা সত্য ঘটনা না। তবে অনেক সত্য ঘটনা আমরা হয়তো জানিও না।